সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আগের পর্বঃ ঊদেয়ার রাজাদের দেশ- মহীশূর-পর্ব ৩

ফেরার পথে গাড়ি কিছু দূর এগোতেই সেই পর্যটকদের পরিচিত ভিড় নজরে পড়ল, রাস্তার ধারে দু’তিনটে বাস আর বেশ কিছু গাড়ি দাঁড় করানো। পথের বাঁদিকেই তোরণ, সামনে ফলকে তিনটি ভাষায় লেখা ‘গুম্বজ’ (Gumbaz)। টিপু সুলতান তাঁর প্রতাপশালী পিতা হায়দার আলীর স্মৃতিতে এই সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে এই স্মৃতি সৌধ ভারতীর পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্বাবধানে আছে। আয়তক্ষেত্র আকারের জমি, পুরোটাই সুন্দর সাজানো বাগান... সবুজ ঘাসে মোড়া বাগিচা, ছায়া দেওয়া বড় বড় গাছ, আর পথের দু’ধারে বাহারি গাছের সারি। রাস্তার ধারেই যে বড় তোরণ, সেটা পার হয়েই মোরাম বিছানো রাস্তা, সোজা চলে গেছে বাগানের মাঝামাঝি বেলফুলের কুঁড়ির মত সেই স্মৃতিসৌধর দিকে... সেই সৌধর মস্ত বড় গম্বুজ-এর জন্যই এই নামের পরিচিতি... গুম্বজ, স্থানীয় লোকজন বলে গুম্বাজ। সামনের সেই তোরণ, ভেতরে তৈরী সৌধ... এসব দূর থেকে দেখেও পারস্যের স্থাপত্যশৈলীর ছাপ স্পষ্ট (যাকে ইস্‌লামিক আর্টও বলা হয়)। সেই সৌধর আকৃতি দেখলে বোঝা যায়, ওই এক আগ্রার তাজমহল কত স্থাপত্যকে সেই সময় প্রভাবিত করত। ভেতরের কারুকার্য, ব্যবহৃত পাথর বা অন্য সরঞ্জামের গুণগত মান, সে সব তো আলাদা আলাদা হয়েই যায়... সবাই তো আর সম্রাট নন, সেই ঐশ্বর্য বা ব্যয় করার ক্ষমতা থাকবে না সবার। কিন্তু এই আদলের আলগা অনুকরণ, সত্যিই খুব লক্ষণীয়। ঠিক তাজের সামনে দিয়ে চলার সেই পথ, এবং অনুপাত বজায় রেখে আয়তাকার উঁচু স্থাপত্যের ওপর (যার ওপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়) সেই সৌধ। শুধু সেই চারটি পৃথক মিনার নেই চারদিকে... যা আগ্রার তাজ-এর চারদিকে দেখা যায়।

তখন টিকিটের ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে, টিকিট কেটেই ঢুকতে হয়েছিল আমাকেও। মোরাম বিছানো রাস্তা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে বুঝলাম, পর্যটকদের ভিড় অনেকটাই... তারা শুধু ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে পথের মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেই ব্যস্ত নয়, সবাই সেই বিস্তৃত বাগিচের এদিক ওদিকে ছড়িয়ে আছে... কোনও পরিবারের ছোটরা ঘাসে ছুটোছুটি করছে, তো কোনও পরিবার গাছ তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। তোমরাও অমন সুন্দর সবুজ বাগান দেখলে, বেশিক্ষণ শান্ত থাকবে না। তবে সত্যি বলতে এই ভাবে ঘাসের ওপর পর্যটকদের বসে থাকা, ঘুরে বেড়ানো বড়ই অস্বাভাবিক লাগে। এতে বাগানের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, ঘাস নষ্ট হয়... অপরিচ্ছন্নও হয়ে যায় সব কিছু। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হ’লে, কর্তৃপক্ষ সেখানে এই ভাবে ঘাসের ওপর চলা ফেরা করতে দেয় না। স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকে, নির্দিষ্ট রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটা এবং নির্দিষ্ট স্থানেই বিশ্রাম নিতে বলার ব্যবস্থা থাকে। এমন সুন্দর বাগান, কারও খামখেয়ালী কাজকর্মের জন্য যদি নষ্ট হয়ে যায়, কার না খারাপ লাগে বল তো? রোজ এত এত মানুষ ভিড় করে দেখতে আসছে, একটু নিয়ম মেনেই চলা উচিৎ সকলের, তাই না? দু’ধারে সুন্দর সেই সব বাহারি গাছের সারি দেখলেই বোঝা যায়, বেশ যত্ন নিয়ে সব কিছুর দেখাশুনো করা হয়। ঝলমলে রোদ্দুরে চারিদিকের সবুজ বাগিচা আর তার মাঝে হালকা হলুদ রঙের সেই স্মৃতিসৌধ সত্যিই খুব উজ্জ্বল লাগছিল। তবে যত তার কাছে এগিয়ে এলাম, তত অযত্নের ছাপগুলো স্পষ্ট বোঝা যেতে থাকল। জায়গায় রঙ বিবর্ণ হয়ে গেছে, বৃষ্টির জল অথবা শ্যাওলার দাগে কালো হয়েছে সৌধের নিচের দিকে বেশ কিছু অংশ। এমন কি গম্বুজের গায়েও সেই রকম কালো ছোপ ছোপ দাগ। আগে আমারও মনে হ’ত – কেন এভাবে ফেলে রাখা হয়, এত কিছু করে, আর একটু রঙ করে ঠিক করতে পারে না? কিন্তু তোমরা একটু বড় হ’লে যদি এই নিয়ে ( পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের রক্ষণাবেক্ষণ) খোঁজখবর কর তাহলে জানবে, ঐতিহাসিক গুরুত্বের যে সব স্থাপত্য, চাইলেই তাদের ওপর খোদকারি করা যায় না। সে বড় জটিল পদ্ধতি, ভাল করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হ’লে সকলের বিপদ। কি ধরণের রঙ ব্যবহার হবে, কোন রঙে কি রসায়নিক প্রতিক্রিয়া হ’তে পারে... কোন অংশে কতটুকু মেরামত হবে আর তার কি পদ্ধতি, মই ব্যবহার হবে না মাচা... সব কিছুই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মত করতে হয়। স্মৃতি সৌধের গায়ে বিভিন্ন অংশে রঙের এই অসামঞ্জস্য নজরে পড়তে সেরকমই মনে হ’ল। এক একটি কালচে রঙের থাম, সৌধের দেওয়াল, ওপরের জাফরি এবং সূক্ষ কাজ যে সব অংশে, সব কিছুই বেশ ঝাঁ চকচকে... এদিকে গম্বুজে কালচে ছোপ পড়েছে, উঁচু জায়গা বা প্ল্যাটফর্মের ওপর স্থাপত্য, তারও বিবর্ণ অবস্থা।

চারপাশের এই সৌন্দর্য, রোদ ঝলমলে দিন... সব কিছু বেশ ভালই লাগছিল। চারিদিকে পর্যটকদের পরিবার, প্রথমে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন একটা সুন্দর উদ্যানের মধ্যে এসে পড়েছি। কিন্তু সেই সৌধের কাছে এসে বুঝতে পারলাম... উদ্যান কোথায়? এতো আস্ত একটা সমাধিক্ষেত্র! দূর থেকে দেখে যা বাগান মনে হয়... তার সবুজের মাঝেই এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে একের পর এক সমাধি। প্রতিটা সমাধির ওপরেই পাথরে ফারসীতে খোদাই করে, অথবা কালো রঙ দিয়ে লেখা আছে বেশ কিছু কথা। খুব সম্ভবতঃ, সমাধিতে যিনি শায়িত আছেন, সেই ব্যক্তির সম্বন্ধে, সেই ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে। এক একটি সমাধি এক একরকমের, দেখে বোঝা যায় সুলতানের সঙ্গে অথবা সুলতানের পরিবারের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা, কিংবা তাঁদের পদ মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেগুলি নির্মিত। আর্থিক সামর্থও যে একটা ব্যাপার, সে কথা বলাই বাহুল্য। বেশ কিছু সমাধি খুবই সাধারণ পাথরের, তার ওপরে খোদাই করা লেখাও অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আবার কিছু সমাধির পাথরে উৎকৃষ্ট মানের, বেশ ভাল অবস্থায় আছে এখনও। আরও একবার পারিপার্শ্বিক সবকিছু বড় বেমানান মনে হ’ল। সমাধিক্ষেত্র অথবা গোরস্থানের প্রথম শর্তই হওয়া উচিৎ নীরবতা। যেখানে এত ব্যক্তির মৃতদেহ সমাধিতে শায়িত আছে, সেই স্থান সেই শৃংখলা এবং সম্মানটুকু দাবী করে। বিদেশে কোনও সিমেটারিতে গিয়ে দেখেছি, কি ভাবে মানুষ নীরবতা পালন করে। এমন কি আমাদের দেশেও একাধিক জায়গা, ধর্মীয় স্থান এমন আছে যেখানে বিশেষ ভাবে নীরবতা পালন করা হয়। অথচ তার ছিটেফোঁটাও সেই সমাধিক্ষেত্রর আশেপাশে নেই! রীতিমত পিকনিক করতে আসার মত আবহাওয়া, যা একটি সমাধিক্ষেত্রের ভেতর একেবারেই অভিপ্রেত নয়। তোমরা যদি কেউ কখনও এমন কোনও সমাধিক্ষেত্রে বেড়াতে যাও, মনে রেখো কোনও সভ্য দেশে সমাধিক্ষেত্রের ভেতর মানুষ উঁচু আওয়াজে কথা বলে না... তোমরাও সেই মত থেকো, অন্যদেরও বল।

নিচে একটি বিশেষ জায়গা পর্যটকদের জুতো খুলে জমা দিয়ে দিতে হয়, প্রধান সৌধের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে। আমাকেও একই ভাবে নিয়ম মেনে জুতে খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে হ’ল ওপরে। সেই প্ল্যাটফর্মের ওপরেই প্রধান সমাধিক্ষেত্রর স্থাপথ্য। তার চারিদিকে বিস্তৃত চাতালের মত অনেকটা অংশ। সেই অংশেও চারিদিকে এক একজনের সমাধি ছড়িয়ে রয়েছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, এখানে যাদের সমাধি তাঁরা সুলতানের পরিবারেরই সদস্য, অথবা বিশেষ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। আমাকে একজন বলেছিলেন, যারা বাগানে শায়িত তাঁদের অনেকেই টিপু সুলতানের সৈনিক, যাঁরা টিপুর শেষ যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন। আর যাদের সমাধি প্রধান সৌধের কাছাকাছি, ওই চাতালে দেখা যায়... তারা শুধু পরিবারবর্গই নন, অনেকে আছেন যারা সেই সৈন্যদলের প্রধান, অথবা রাজ পার্ষদদের মধ্যে বিশেষ কেউ। এমনকি সৌধের মূল কক্ষের যে চারটি প্রবেশ দ্বার, তার চারিদিকেও একটি উঁচু চাতালের মত নির্মিত... সেখানেও বেশ কিছু সমাধি। তাদের কাছে গেলে বোঝা যায়, ঐতিহাসিক কারণে সেগুলি বেশ গুরুত্বপূর্ণ... বেশিরভাগ সমাধির গায়ে ইংরেজীতে বিবরণ দেওয়া। উল্লেখযোগ্য, টিপু সুলতানের বেগমদের সমাধিও সেই বিশেষ সমাধিগুলোর মাঝেই। সমাধিকক্ষকে কাছ থেকে প্রদক্ষিণ করলে বোঝা যায়, তার পরিসীমা বর্গাকার। গ্র্যানাইট পাথর দিয়ে নির্মিত আনুমানিক কুড়ি মিটার উচ্চতার এই সৌধ, খুবই নিপূণ ভাবে প্রস্তুত হয়েছিল... মসৃণ পালিশ করা স্তম্ভ, সেই স্তম্ভ আকৃতি... দেওয়াল এবং জাফরির সূক্ষ কারুকার্য... ছবি তুলে রাখার মতই সুন্দর। ৩৬টি কালচে পাথরের স্তম্ভ ওই উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের সৌধর রঙের সঙ্গে একেবারেই বিপরীতধর্মী। অনেকে বলেন, ওই ৩৬টি স্তম্ভ আসলে হায়দার আর টিপু’র মিলিত ছত্রিশ বছরের শাসন কালের প্রতীক। আমার অবিশ্যি এটা হজম করতে একটু কষ্টই হয়। যদি টিপু’র আমলে এ নির্মান হয়ে থাকে... তা হ’লে নিজেই নিজের শাসনকাল গুনে এমন নির্মান করবেন বলে মনে হয় না। আর তা ছাড়া হায়দার আলি স্বয়ং শাসকও ছিলেন না সে অর্থে। সুলতান ছিলেন শুধু টিপুই।

একটু দূরে সরে এসে মাথা উঁচু করে তাকালে বোঝা যায়, ওপরে সৌধের ছাতের কিছুটা অংশ ঝুল বারান্দার মত চারদিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, সেই বারান্দার মত অংশকে ধরে রাখার জন্যই এতগুলো স্তম্ভ বা পিলার। ওপরে ছোট ছোট দরজা বা জানলার মত খোদাই করা নকসা দেখে মনে হয়, আগে সেই সব দরজা বা জানলা ব্যবহৃত হ’ত, গম্বুজের ঠিক নিচের ওই অংশকেও ব্যবহার করা হ’ত... যা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কোনও সংগত কারণে। এমনকি তার ওপরে যে সুবৃহৎ গম্বুজটি, তারও চারিদিকে বেশ খানিকটা জায়গা, তারপরে ছাতের পাঁচিলের মত নক্সা করা পাঁচিল। দেওয়ালের সেই সব নক্সাও বড় চমৎকার... ফুল, পাতা... প্রভৃতি খুব সূক্ষ্ম কাজ। রাতে প্রদীপ বা আলোর অন্য কোনও উৎস রাখার জন্য ঘুলঘুলির মত ছোট ছোট খোপ সেই গম্বুজের নিচের পাঁচিলে। আর গম্বুজের চারটি কোণে চারটি ছোট মিনার (যাকে মিনারেট বলে)। সেই মিনারেটের গায়েও সূক্ষ্ম কারিগরির নিদর্শন স্পষ্ট। সেই সময়ের একাধিক স্থাপত্যের মত একে নিয়েও ঐশ্বর্যের ইতিহাস কথিত আছে, আজ যেমন একে দেখছ... চিরকাল তেমন ছিল না। বলা হয় সোনা-রূপা দিয়ে সাজানো ছিল এই সৌধের দেওয়ালের নকশা, দরজার পাল্লা, মিনার, স্তম্ভগুলি... সব কিছু। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী সিরাঙ্গাপাটনা দখল করার পর সেই সব সোনা-রূপো খুলে নিয়ে যায় (যেমন বিজয়ীরা করে থাকে বিজিতের সম্পত্তিতে)। সৌধের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার যে দরজা, তার ওপরের নকশাকেও তারিফ না করে পারা যায় না। ছবি পাগল মানুষ, ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সমাধি সৌধ দেখতে এসে এভাবে ছবি তোলা মোটেই শোভনীয় নয়।

অবশেষে প্রবেশ করলাম সেই সমাধি-সৌধের মূল কক্ষে। ঘরের ভেতরটা একটু অন্ধকারই... দেওয়ালের এদিক ওদিক আলো জ্বলছে ঠিকই... তবে দরজার ভেতর দিয়ে যে বাইরের সূর্যের আলো প্রবেশ করেছে, সেই আলোর ওপরেই বেশি নির্ভর করতে হয়। হয়ত দেওয়ালের পুরনো হয়ে যাওয়া রঙ, মলীনতার কারণেই এমন। তা ছাড়া, শুধু দু’টো দরজাই খোলা থাকে, একটি প্রবেশ ও একটি বাহির পথ... যার ফলে, সূর্য অবস্থান পরিবর্তন করলে, বাইরের আলো প্রবেশ করা মুশকিল। সেই ঘরে ঢুকে তিনটি সমাধি দেখলাম, পাশাপাশি শায়িত। বেশ যত্ন করেই রাখা, চাদর, ধূপ প্রভৃতি দিয়ে সাজানো। মুসলিমদের দরগার মত পরিবেশ ভেতরে। দু’জন ব্যক্তি বড় সাদা রঙের চামর দুলিয়ে বাতাস করছে সমাধির ওপর। আরও দু’তিনজন আশেপাশে তদারকি করছে, খেয়াল রাখছে যাতে ঘরের ভেতর পর্যটকরা ভিড় না জমায়, দেওয়ালে বা অন্য আসবাবে হাত না দেয়। আর সেই ঘরের দেওয়ালও বেশ চোখে পড়ার মত। হলুদের ওপর কালো ছিট ছিট ডোরা কাটা দাগ। ‘টাইগার অফ মাইসোর’, টিপু সুলতান-এর সেই নাম কে সম্মান দেওয়ার জন্য। এমনকি যে তিনটি সমাধি ঘরের মাঝখানে, তার মধ্যে টিপু সুলতানের সমাধিকেও খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়, ওই হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা দাগ এর নকশা করা চাদর দিয়ে ঢাকা দেখে। হ্যাঁ, টিপু সুলতানের সমাধি এই গুম্বজের কক্ষেই। হায়দার আলি, টিপু সুলতান, এবং টিপু সুলতানের মা ফাক্‌র-উন-নিসা এইখানেই সমাধিস্থ আছেন। ইংরেজী ফলকে প্রতিটা সমাধিতে লেখা, কোনটি কার সমাধি। সেই কক্ষে কথা বলা এবং ছবি তোলা যথাযথ ভাবেই নিষিদ্ধ। বেশিক্ষণ কক্ষের ভেতর থাকারও অনুমতি নেই।

হায়দার আলি এবং টিপু সুলতানের সমাধি পাশাপাশি দেখে আরও একবার ইতিহাস, এবং প্রচলিত কথকথার মধ্যে বিরোধ দেখতে পাই। যদি টিপু সুলতান স্বয়ং এই গুম্বজ নির্মাণ করে থাকেন হায়দার আলির স্মৃতিতে... তাহ’লে পরিকল্পিত ভাবে তিনজনের সমাধি এমন পাশাপাশি সাজানো কি করে? উনি কি জীবিত অবস্থাতেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে ওনাকেও এইখানেই সমাহিত করা হোক? নাকি, আসলে অন্য কোন জায়গা থেকে পরবর্তীকালে সমাধি স্থানান্তরিত করে এখানে আনা হয়? (যা খ্রীষ্টধর্মে প্রচলিত হলেও, ইসলামে খুব একটা সমর্থন করা হয় না) কারণ যাই হোক, সুলতানের সমাধি আরও একটা প্রশ্নের সম্মুখীন করে... তা হ’ল এই গুম্বজের সৌধর যে বর্তমান রূপ... তা নিঃসন্দেহে আদি সংস্করণ নয়। টিপু’র জীবদ্দশায় যদি গুম্বজ নির্মিত হয়, তাঁর মৃত্যুর পর তাকে সমাধি দিতে গিয়ে আবার খোঁড়া হয়েছে এই সৌধ... এমন কি তাঁর বেগমদের সমাহিত করার জন্যেও খোঁড়া হয়েছে সৌধর বাইরের অংশ। আর দেওয়ালের ওই বাঘ-ছাপ রঙ... সে তো টিপুর জন্যই! অবশ্যই তাঁর মৃত্যুর পরে সেই রঙ করা হয়। এমন ছোট ছোট অনেক কিছুই যদি নজরে পড়ে, তাহ’লে ভাবায়... আরও খোঁজ করার ইচ্ছের জন্ম দেয় মনের মধ্যে। ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে যাওয়ার এইটাই সব থেকে বড় মজার। এক জায়গা দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাল-তারিখের যুক্তির পরিবর্তে প্রচলিত লোককথাকে বিশ্বাস করতেই বেশি ভাল লাগে। সেই সরল বিশ্বাসে বলা কথাগুলো ইতিহাসের মত ‘অথেন্টিক’ ভা যুক্তিযুক্ত মনে না হলেও, নিষ্ঠুর নয়... আবেগ আর সততা মিশিয়ে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করে সেই সব পাথরের ইমারতে।


মসজিদ-এ-আক্সা

তোমাদের একটা কথা তো জানানোই হয় নি! এই বাগিচা, গোরস্থান... এইসব কিছুর মাঝে সুলতানের সমাধি সৌধই কিন্তু একমাত্র নির্মান নয়। গুম্বজের পাশেই রয়েছে একটা সাদা ধবধবে মসজিদ। এই রাজকীয় এবং সুন্দর মসজিদও টিপু সুলতানের সময়েই নির্মিত... নাম মসজিদ-এ-আক্সা। মসজিদটি এখনও বেশ ভাল অবস্থাতেই আছে, নিয়মিত নামাজ পাঠও হয়। বরং বলা যায়... গুম্বজের থেকে এই মসজিদ কোনও অংশে কম সুন্দর নয়। তবে ধর্মীয় আচরণের জায়গা বলেই, নির্দিষ্ট সময়তে তার দরজা খোলা হয়। পর্যটকদের প্রবেশের ব্যবস্থা নেই তার ভেতরে। বাইরে থেকেই দেখে নিতে হয়, যা কিছু পর্যবেক্ষণ করার, অথবা ছবি তোলার। আমি আরও কিছুটা সময় সেই চাতালের ওপরেই ঘোরাফেরা করলুম। রোদটা তখন একটু কড়াই লাগছিল, আর বেলা বাড়ার সাথে সাথে পর্যটকদের ভিড়ও বেড়ে চলেছিল সমানুপাতে। মোবাইল ফোনে সময় দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম, এখানে ঘুরতে ঘুরতে যে আধ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেছে... খেয়ালই করিনি! এখনও সামনে অনেক কিছু দেখা বাকি আছে... সবে তো শুরু!


ছবিঃজয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা