সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

মহেশ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এপারে তো বেশ ভাল সময় কাটল, ওপারে কি কি আছে?, সে খুব আগ্রহের সঙ্গে বলেছিল, "টেম্পল স্যার, স্বামী রঙ্গনাথ... আচ্ছা টেম্পল।" রঙ্গনাথ স্বামী মানে বিষ্ণুর মন্দির, এই মন্দিরের কথা আমি শুনেছি। বিজয়নগরের রাজাদের সময় স্থাপিত এই প্রাচীন মন্দিরের দেবতা শ্রী রঙ্গস্বামীর নামেই এই জায়গার নামকরণ – শ্রীরঙ্গপত্তনা। কিন্তু টিপু সুলতানের শ্রীরঙ্গপত্তনার তোরণ পার করে ঢুকছি, আর কেবল এই একটি মাত্র প্রাচীন মন্দির অপেক্ষা করছে... এটা মেনে নেওয়া একটু কঠিন। এই প্রাচীরের ভেতরেই সুলতানের বাসস্থান, মসজিদ, এমন অনেক কিছু থাকার কথা... এমন কি সেই জায়গাও যেখানে টিপুর সঙ্গে ইংরেজদের শেষ সংঘাত হয়েছিল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আর কি কি আছে? তখন বলল, "বাকি সব রোডসাইড মেঁ স্যার, অন দি ওয়ে... কোই এন্ট্রি নেহি।" কথা শুনে মনে হ'ল ব্যাটার রীতিমত তাড়া আছে। দুপুর বেড়ে যাচ্ছে বলে খাওয়ার তাড়া। তাই মন্দির বাদে বাকি সব কিছুই অন দি ওয়ে। তবে আমারও জেদ ছিল, একদম তালিকা করে নিয়ে গেছিলাম, কি কি দেখার মত আছে, সে যেখানেই থাকুক খুঁজে বার করে দেখেই যাব। এসেছি যখন, দেখতেই হবে!

একটার পর একটা তোরণ পার হয়ে এগলো আমাদের গাড়ি। পাথরের গাঁথনি, বেশ পুরনো... দেখে বোঝা যায় এগুলো এক একটা গেটের মত ছিল। এরকম একটার পর একটা গেটের পাহারা এবং নিরপত্তারক্ষীদের পার করে তবেই নগরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যেত। এখন শুধু হাঁ করা পাথরের বড় প্রবেশ-দ্বার বই কিছু নয়। তার পাশে ভেঙ্গে পড়া চওড়া পাথরের দেওয়াল। একসময় এই দেওয়াল ছিল নগরের প্রাচীর, পুরোটা ঘিরে রাখত চারদিক থেকে, এখন এখানে-ওখানে খণ্ড খণ্ড অবশেষ উঁকি দিচ্ছে, গাছ গজিয়ে গেছে। আর সেই চওড়া পাথুরে দেওয়াল পার করেই বেশ খানিকটা জায়গা মাটি খোঁড়া, ঠিক পরিখার মত। এও নগরের সুরক্ষারই পরিকল্পনা। কাবেরী নদী থেকে জল টেনে এই পরিখা ভরা হ'ত... যেদিকে নদী নেই, সেদিকটা ঘেরা থাকত পরিখা দিয়ে। একপাশে নদী বয়ে যাচ্ছে, আর বাকি দিকে পরিখা দিয়ে ঘেরা; যাতে শত্রুকে রীতিমত বাধা অতিক্রম করে নগরের কাছাকাছি আসতে হয়। এমন পরিখাকে ইংরিজীতে বলে Ditch (ডিচ) বা Moat (মোট), এর ব্যবহার একাধিক দূর্গ, প্রাসাদ বা নগরের স্থাপত্য-পরিকল্পনায় দেখা যায়। এমন কি বিদেশেও এর প্রচলন হয়েছে খুব। নিরাপত্তার এক মোক্ষম ধাপ, জল পার হওয়া বড় সহজ কথা নয়, পরিখাগুলো গভীর হ'ত... আর তাতে ছাড়া থাকত কুমীর, অথবা হাঙরের মত সাংঘাতিক মাংসাশী মাছ। এছাড়া একহাতে সাঁতার হয় না, যুদ্ধের ভারী বর্ম (যাকে বলে আর্মার) পরেও জলে ভেসে থাকা শক্ত। কেউ দুঃসাহস দেখিয়ে জল সাঁতরে পার হ'তে চাইলেও একাধিক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ত, আর সেই ফাঁকে প্রহরী বা সৈন্যদের নিশানা হয়ে যেত বিনা বাধায়। ঠিক এরকমই পরিখা দিয়ে সুরক্ষিত ছিল শ্রীরঙ্গপত্তনা। সেই পরিখার জলে কুমীর রাখার প্রথাও ছিল (এখানে চুপি চুপি জানিয়ে রাখি, মাইসোরের করঞ্জী হ্রদে কিন্তু এখনও মেলা কুমীর দেখা যায়)। পরিখার ভেতর সেই সব কুমীরদের ভেসে বেড়াতে দেখে লোকজনের কেমন পিলে চমকাতো তা আশা করি বুঝতেই পারছ। তার ওপর প্রচলিত আছে সুলতান মাঝে মাঝে অপরাধীদের এই পরিখার জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার হুকুম দিতেন, তারা এই সব পোষ্য কুমীরদের সেদিনের লাঞ্চ বা ডিনার হয়ে যেত। ভাবলেই গায় কাঁটা দেয়, একটা জ্যান্ত মানুষ চারদিক থেকে কুমীর ঘিরে ধরছে! কিন্তু নবাব-সুলতানদের খেয়াল-খুশির শাস্তি এমনই হ'ত, বা এর থেকেও সাংঘাতিক। রাজাদের এমন আজব-সাজা'র গল্পও কিছু কম নেই... সে অন্য কোনও দিন সময় নিয়ে বলব, কেমন?


ওয়াটার গেট

রাস্তা ডানদিকে বাঁক নিতেই ডানদিকে গাছ-পালার ওপারে কাবেরী নদীর স্রোতের আভাস পেলাম। হ্যাঁ, ওই দিক দিয়েই বয়ে যাচ্ছে কাবেরী নদী। নগরের এদিকটায়... মানে নদীর দিকের প্রাচীরে থাকত লক গেট, জলপথে বেরিয়ে যাওয়ার-বা প্রবেশ করার গোপন সুঁড়িপথ, আর নৌকোর মত ছোট জলযান চলাচলের ব্যবস্থা। এইসব গেটদের বলা হ'ত 'ওয়াটার গেট', যা নগর থেকে নদীর দিকে যাওয়ার দ্বার। সেই পাঁচিলের ফাঁকে এখনও ওয়াটারগেটগুলো রয়েছে, নদীর জল অনেকটা নীচে নেমে গেছে, না হ'লে এই গেট দিয়ে জল আসার কথা জোয়ারের সময়। এমনই এক ওয়াটারগেট খুলে দেওয়া হয়েছিল সেই দিন কোনও এক বিশ্বাসঘাতক গুপ্ত শত্রুর তত্ত্বাবধানে, সেই ওয়াটারগেট দিয়েই নদীপথে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনা আচমকা আক্রমন করে টিপুর শ্রীরঙ্গপত্তনা। একটি বিশেষ ওয়াটারগেট কে দেখিয়ে এখনও চিহ্নিত করা হয়, যে এই সেই অভিশপ্ত ওয়াটারগেট যা টিপু সুলতানের শেষ অধ্যায় লিখেছিল।


ব্রিটিশ শিল্পী জে এম ডাব্লিউ টার্নার-এর আঁকা ছবি 'সিজ অফ সেরিঙ্গা্পত্তম'

পরবর্তী কালে থমাস সিডেনহ্যাম (Thomas Sydenham) নামে এক সাহেব এই ওয়াটারগেটের একটি ছবি আঁকেন, পেন্টিং। শোনা যায়, এই সাহেব শ্রীরঙ্গপত্তনার ওপর সেই অন্তিম আক্রমনে ছিলে কর্নেল শেরব্রুকের সঙ্গে (Col. Sherbrooke)। বিখ্যাত ব্রিটিশ শিল্পী জে এম ডাব্লিউ টার্নার ( J.M.W.Turner) তাঁর 'সিজ অফ সেরিঙ্গা্পত্তম' (Siege of Seringapatam) চিত্রটিতেও এই ওয়াটারগেট-এর ছবি আঁকেন। মোট কথা, এই শেষ দিনের আক্রমণ, টিপু'র পরাক্রম, ব্রিটিশদের জেতার এবং টিপুর পরাজয়ের এই আখ্যানের 'Saga' হয়ে ওঠা... এই সবকিছু যে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী, তথা ইংল্যাণ্ডে বসে থাকা অন্য ইংরেজদের মধ্যেও একটা ছাপ ফেলেছিল, তা বোঝা যায়। ইতিহাসের কোনও ঘটনা বিশেষ প্রভাব না ফেললে, তা কখনও এই ভাবে শিল্পের নিদর্শন হয়ে উঠতে পারে না। আমরা অবহেলায় অযত্নে এইসব ইতিহাসের সাক্ষ্য দেওয়া নির্মান, স্থাপত্য নষ্ট করে ফেললেও, ব্রিটিশদের কাছে এসবের একটা মূল্য ছিল, সেই সব জলরং আর তৈলচিত্রের মূল্য এখনও আছে। তোমরা যদি যাও, তোমাদেরও হয়ত কোনও গাইড এই দরজাটা দেখিয়ে তাদের জানা গল্প শোনাবে বেশ আগ্রহ ভরে।


বলা হয় এই স্থানে টিপু সুলতানের দেহ পাওয়া গেছিল

সেই ওয়াটার গেটের কাছাকাছিই একটা সমাধিস্থলের মত। বলা হয় এইখানেই যুদ্ধের শেষে টিপু সুলতানের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। একটা পাথরের ফলকের ওপর ইংরিজীতে লেখা 'THE BODY OF TIPU SULTAN WAS FOUND HERE'। তবে এই ওয়াটারগেট এবং এই বিশেষ স্থান যেখানে নাকি টিপু সুলতানের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল, এই নিয়ে একটু মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলে পূর্বদিকের ওয়াটারগেট দিয়ে ঢোকা হয়েছিল আর সেখানেই কাছাকাছি কোথাও টিপুর দেহ পাওয়া যায়। আবার কোনও কোনও ইতিহাসবীদের মত দক্ষিণ দিকের ওয়াটারগেট, এবং দেহ-প্রাপ্তির জায়গাটা তারই কাছাকাছি। আসল সত্যি যা-ই হোক, এখন এই সৌধ'র সামনেই মানুষ লড়াকু সুলতানের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করেন... যার একেবারে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার পরেও আমৃত্যু লড়ে যাওয়ার গল্প লোকের মুখে মুখে ফেরে। এক বিরাট অংশ আজও টিপু সুলতানকে নিয়ে গর্ব অনুভব করেন এই অঞ্চলে এবং কর্ণাটকের অন্যত্রও। তবে এই সৌধ এবং আগে দেখা সেই সমাধিস্থলকে কিন্তু গুলিয়ে ফেলো না। ওয়াটারগেটের পাশে এই সৌধতে টিপু'র দেহ উদ্ধার হয়েছিল, আর তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল যেখানে, তাকে এখন গুম্বজ বলা হয় (যার কথা আগেই বলেছি তোমাদের)।


জামা মসজিদ

রাস্তার বাঁদিকে দু'টো বিশাল লম্বা হলুদ রঙের মিনারওয়ালা মসজিদ দেখতে পাবে। তার নাম জামা মসজিদ। সুলতানের আমল থেকেই এই মসজিদ ওখানে রয়েছে।


টিপুর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ

সে মসজিদ পার করে গেলে একটা জায়গায় দেখবে কিছুই নেই, ধ্বংশাবশেষ ছাড়া... শুধু একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে একটা চাতালের মত বিস্তৃত জায়গায়। আসলে এখানেই ছিল টিপু সুলতানের রাজপ্রাসাদ। বলা হয় টিপু'র মৃত্যুর পরেই এই প্রাসাদ প্রথমে লুঠ হয় এবং তারপর আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এখন আর সেই প্রাসাদের কিছুই নেই, স্রেফ এই সিঁড়ি আর চাতাল পড়ে আছে। আর এই ভগ্নাবশেষ (যদিও কোনও অবশেষই নেই বলার মত) পার করে বাঁদিকে এগোলেই শ্রীরঙ্গনাথ স্বামীর মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা। তবে সেদিকে এগোলাম না আমি, সোজা গেলাম। সেদিকে এগোলে একটা রেললাইন দেখা যায়... আর ডানদিকে একটা ইমারৎ কাবেরী নদীর ধারে। এখন দেখলে বোঝারই উপায় নেই।


কর্নেল বেইলির কারাগার

এই ইমারৎ এককালে ছিল ভয়ানক কারাগার, টিপু সুলতান বন্দীদের এখানে রাখতেন, এবং রীতিমত ভয়ানক শাস্তির ব্যবস্থা ছিল সেই সব বন্দীদের। কারাগারের যে নামকরণ হয়েছে তা হ'ল Colonel Bailey's Dungeon (কর্নেল বেইলির কারাগার), অথচ এই কারাগার কোনও কর্নেল বেইলির অধিকারে ছিল না। বরং এই কর্নেল বেইলি নিজেই একজন ইংরেজ বন্দী ছিলো টিপু সুলতানের, যাকে এই অন্ধকূপের মত কারাগারে রাখার শাস্তি দেওয়া হয়, এবং ১৭৮০ সালে এই নরকবাসেই তার মৃত্যু। কর্নেল বেইলি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানার অবকাশ নেই, তবে একজন কারাবন্দী হয়েও তার নামে রয়ে গেল এই কারাগারের পরিচয়। নেহাৎ হেঁজিপেঁজি কেউ হলে বোধহয় এমন নামকরণ হ'ত না।


কর্ণেল বেইলির কারাগারের বিবরণ

বোঝাই যায় এই নামকরণ ইংরেজরাই করেছিল, কর্নেল বেইলির প্রতি (ধরে নেওয়া যাক করুন পরিণতি এবং আত্মবলিদান) তাঁদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে। এই কারাগার সম্বন্ধে অনেকরকম গল্প এবং ইতিহাস শোনা যায় জানো তো? আর কারাগারের ভেতরে পা রাখলেই বাতাসের মধ্যেই সেই সোঁদা গন্ধে ইতিহাস মিশে আছে! কি... শুনতে ইচ্ছে করছে? তাহ'লে এর পরের দিনে এই কর্নেল বেইলির কারাগার নিয়েই বলা শুরু করব তোমাদের। ঘুরতে নিয়ে যাব আমার সাথে... তার ভেতর কি দারুণ একটা জিনিস লুকিয়ে আছে, তা দেখার জন্য!


ছবিঃ লেখক
জে এম ডাব্লিউ টার্নারের আঁকা ছবিঃ টেট গ্যালারি ওয়েবসাইট

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা