সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
প্যারালিম্পিক গেমস, ভারত আর কিছু কথা

তোমরা নিশ্চয়ই একলব্যের গল্প শুনেছ। সেই যে মহাভারতের একলব্য, সেই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, যে আচার্য দ্রোণকে নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙুল গুরুদক্ষিণা দিয়েছিল... তার কথা?

একলব্য কিন্ত জানত, ডানহাতের বুড়ো আঙুল কেটে ফেললে আর সে আগের মত শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর থাকবে না। দ্রোণাচার্যের আসল অভিসন্ধি কী... তা জেনেও পিছু হটল না নিষাদরাজের ছেলে। কিন্তু তারপর? একলব্য কি হতাশ হয়ে ভুলে গেল সব কিছু? সরে গেল তিরন্দাজ হওয়ার লক্ষ্য থেকে? ভাগবৎ পুরাণ কিন্তু বলছে-- একলব্য সেদিন হেরে যায়নি। সে পরবর্তীকালে একজন বীর যোদ্ধা হয়েছিল। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় তার উল্লেখ আছে। এমন কি মথুরা নরেশ কৃষ্ণের বিরুদ্ধে মগধের রাজা জরাসন্ধ যখন যুদ্ধ ঘোষণা করল, তখনও একলব্য ছিল জরাসন্ধের পাশে। সেই যুদ্ধেই একলব্য বীরগতি লাভ করে। অর্থাৎ, তার মৃত্যু হয়।

এর থেকে কী বোঝা যায়? বোঝা যায়— একলব্য সেদিন তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল হারিয়ে ভেঙে পড়েনি। তার স্বপ্নকে ত্যাগ করেনি। আবার নতুন করে অনুশীলন শুরু করল... বাঁ হাত দিয়ে তির ছোঁড়ার, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের বদলে তর্জনী আর মধ্যমাকে ব্যবহার করে তির ছোঁড়ার। এবং আগের মত অত ভালো তিরন্দাজ না হলেও , একলব্য যে একজন বীর যোদ্ধা হয়ে উঠেছিল... তা বোঝাই যায়।

ঠিক এমনই দৃষ্টিহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ছিল ভীষণ শারীরিক শক্তি। দৃষ্টিহীন হলেও উনি ছিলে দক্ষ মল্লযোদ্ধা। যুদ্ধের শেষে লৌহ ভীমকে পিষে চুরমার করে দিয়েছিলেন। সেদিন ওই লোহার মূর্তির বদলে ভীম নিজে এগিয়ে গেলে আর রক্ষে থাকত না!

এরপর আছে মুনি অষ্টাবক্রর কথা। মাতৃগর্ভেই বেদজ্ঞান লাভ করা মহা-পণ্ডিত। ভ্রূণ অবস্থায় পিতা কহোড়ের ত্রুটি ধরায় তাঁর অভিশাপে অষ্ট-বক্র শরীর নিয়ে জন্মালেন এই পণ্ডিত-- শরীরের আটটি স্থান বাঁকা। শারীরিক ত্রুটির কারণে সংকোচে থাকতেন। অনেকে পরিহাস করত। শেষে জনক রাজার সভায় বন্দী নামক এক দুষ্টু পণ্ডিতকে শাস্ত্র-তর্কে পরাজিত করে তিনি নিজের প্রজ্ঞার পরিচয় দিলেন। পিতা কহোড়কে উদ্ধার করলেন (যার এতদিন সবাই সলীল সমাধি হয়েছে ভাবত)। সেই পিতা কহোড়েরই বরদানে নিজের অষ্ট-বক্র ত্রুটিপূর্ণ চেহারা থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। রাজর্ষি জনকের সঙ্গে অষ্টাবক্র মুনির যে দার্শনিক প্রশ্নোত্তর তা পরিচিতি পেল 'অষ্টাবক্র গীতা' নামে।

বিভিন্ন সূত্রে বলে, অষ্টাবক্র শারীরিক ত্রুটিমুক্ত হলেও নিজের আসল রূপকে এবং তার ফলে অন্যের থেকে পাওয়া প্রহসনকে ভুলতেন না। উনি অনেক বেশি বয়সেও, নিজের অষ্ট-বক্র চেহারা ধারণ করেই পথে-ঘাটে হাঁটতেন, অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন… অনেক সময়ে অহংকারীদের উপযুক্ত শিক্ষাও দিতেন। সেসব নিয়ে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক প্রচলিত গল্প বা উপকথা আছে।

এই যে একলব্য, ধৃতরাষ্ট্র বা অষ্টাবক্রর কথা বললাম... শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার উদাহরণ হিসেবে এদের অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ তো গেল পুরাণ-মহাকাব্যের গল্প। আমাদের চারপাশেই আমরা ছোটবেলা থেকে এমন কত মানুষ দেখেছি, যাঁরা শারীরিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে গেছেন... হতাশাগ্রস্ত হন নি। একজন বেলুন বিক্রী করতেন, তাঁর একটি হাত কনুই অবধি। তিনি কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে একটি হাত আর অন্য হাতের কনুই ব্যবহার করে বেলুন ফোলাতেন, সুতো বাঁধতেন... ছোটোবেলা অবাক হয়ে দেখতাম। এখানে কোনো 'আহা' নেই। উনি একজন ফাইটার ছিলেন। একদিনে তো এই দক্ষতা আসেনি! অনেক বৃদ্ধ বয়স অবধি ওঁকে দেখেছি মাঠের ধারে বসে বেলুন বিক্রী করতে। সরু লম্বা বেলুন বেঁকিয়ে-চুড়িয়ে বেড়াল, গদা, ফুল... এমন কিছু না কিছু বানিয়ে ফেলতেন। তারপর একটি ছেলে আসত মাঠে খেলতে, ছোটোবেলায় তার ডানহাতটি পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল এবং সরু হয়ে যায়। ছেলেটির নাম ছিল বিশু, দেখেই বোঝা যেত খুব গরীব পরিবারের ছেলে। ওর বাবা রিকশা চালাত, ও নিজেও একবেলা কাজ করত ওর মায়ের সঙ্গে-- কাগজের ঠোঙা বানানোর কাজ। কাজের ফাঁকে খেলতে আসত মাঠে... বেশিরভাগই বিকেলে, মাঝে মাঝে দুপুরে। বাঁ হাতে চমৎকার বল করত। ভীষণ ভালো উইকেট লক্ষ করে বল ছুঁড়তে পারত। ব্যাট করত একহাতে, যতটা ভালো পারা যায়। সম্ববতঃ পোলিওর কারণে ডান পাও সামান্য দুর্বল ছিল। কিন্তু তাতেও কোনো ভাবে দমে যেত না। কোনোভাবেই ওর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ওকে হারাতে পারেনি। কী ভীষণ প্রাণোচ্ছল... হই হই করা ছেলে বিশু! এখন 'ডিফারেন্টলি এবেলড'-দের বিভিন্ন রকম ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা দেখি আর ভাবি, সুযোগ পেলে হয়ত বিশুও এমন খেলায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেত। ওর সে স্কিল ছিল।

এমন কতজনের কথাই না বলা যায়! শিল্পী এবং সাংবাদিক চণ্ডী লাহিড়ী, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী কৃষ্ণ চন্দ্র দে, সাঁতারু মাসুদুর রহমান বৈদ্য, ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনসুর আলি খান পটৌদি... এঁরা সকলেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজের নিজের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সাফল্যের পাশাপাশি সম্মান এবং শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন মানুষের। কিন্তু এত কিছু পরেও ভাবো তো... একদল ছেলে হইহই করে ফুটবল খেলছে, আর একটা ছেলের মাঠের ধারে হুইল চেয়ারে বসে— শুধু খেলা দেখতেই পারে সে। অথবা একসময়ে দারুণ বল করত, অথচ কোনো দুর্ঘটনার পর থেকে আর ক্রিকেটই খেলতে পারে না। তাদের মনের মধ্যে না জানি কতটা কষ্ট জমে থাকে। হঠাৎ ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, কিশোর বয়সে এক বড়ো আঘাত হেনে বসে। অথচ আমরা কেউই চাই না ছেলে-মেয়েগুলো এভাবে মনে মনে কষ্ট জমিয়ে বড়ো হোক। তাই না?

সত্যি বলতে... সংবেদনশীল হয়ত আমরা অনেকেই, কিন্তু সকলে বুঝতে পারি না কী করব... সকলে স্থির করতে পারে না, কখন কী করলে মানুষের মনের কষ্ট লাঘব হয়। অজ্ঞাতে তাকে করুণা দেখিয়ে ফেললে তার প্রভাব কী পড়বে, সেই সংকোচ থেকে যায় কোথাও। হয়ত এই একই রকম চিন্তা এবং পরিকল্পনা চলত স্যার লুডউইগ গুটম্যানের মাথাতেও। কিন্তু তিনি সংকোচ কাটিয়ে সংগঠনের পথে এগিয়েছিলেন। এমন কিছু আয়োজন করলেন, যা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

কে এই লুডউইগ গুটম্যান (Ludwig Guttmann)? ইনি-ই সেই ব্যক্তি... এক জার্মান ইহুদী স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যিনি না থাকলে হয়ত প্যারালিম্পিক্‌স অর্থাৎ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে এমন ক্রীড়াবিদদের অলিম্পিক গেমস হওয়ার পরিকল্পনা আরো দশ-বিশ বছর পিছিয়ে যেত।

*****
প্যারালিম্পিক গেমস, ভারত আর কিছু কথাস্যার লুডউইগ গুটম্যান

লুডউইগ গুটম্যানের নিজের জীবনটিও বেশ ঘটনাবহুল। উনি জন্মেছিলেন ৩রা জুলাই ১৮৯৯, তৎকালীন জার্মান সাম্রাজ্যের টস্ট বলে একটি ছোটো শহরে, যা বর্তমানে পোল্যান্ডের টোজেক (Toszek) নামে পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে সামরিক সেবায় ডাক পড়ল উনিশ বছরের তরুণ গুটম্যানের। আর সেই সময়েই উনি ডাক্তারি পড়াও শুরু করলেন। ডাক্তারি পাশ করলেন ১৯২৪-এ। এবারে, ঘটনাচক্রে গুটম্যান যেহেতু ছিলেন ইহুদী জার্মান, ওঁর পক্ষে জার্মানী থাকা ক্রমে প্রতিকূল হয়ে উঠতে শুরু করল। দশকের পর দশক গেল… যে ইহুদীরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, তারাও জার্মানীতে নিরাপদ বোধ করছিল না। হিটলারের ক্ষমতা বাড়ছিল, বাড়ছিল ইহুদী বিদ্বেষ। ১৯৩৭-এ নাৎসি আদেশে অনেক অঞ্চলেই ইহুদীদের মেডিকেল প্র্যাক্টিস করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। গুটম্যান তখন প্রখ্যাত নিউরো সার্জেন। ব্রেসলও-এর ইহুদী হাসপাতালে তখন উনি মেডিকাল ডিরেক্টর। প্রশাসনের কড়া নজরদারীকে ফাঁকি দিয়ে, সংকটপূর্ণ অবস্থায় থাকা ইহুদীদের একের পর এক চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে জেস্টাপো (নাৎসি বাহিনির এক বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগ) জানতে পারে এদের মধ্যে অনেককেই ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করছিলেন হাসপাতালের কর্তারা। সমস্যা বাড়ছিল, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গুটম্যান নাৎসি জার্মানী থেকে সপরিবার পালানোর উপায় খুঁজতে লাগলেন। যেহেতু চিকিৎসকদের তখনও একটা গুরুত্ব ছিল, এবং গুটম্যান একজন দক্ষ স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, তাই নাৎসিরা বিশেষ ভিসার (অন্য দেশে যাওয়ার অনুমতি পত্র) ব্যবস্থা করে ওঁকে পাঠালো পর্তুগলে, সেই সময়কার পর্তুগীজ ডিক্টেটর অলিভিয়েরা সালাজারের (António de Oliveira Salazar) এক নিকট জনকে চিকিৎসা করতে।

পর্তুগল থেকে ফেরার সময়ে, লন্ডন হয়ে বিমানে ফেরার কথা। এই সুযোগটিই কাজে লাগালেন ডাক্তার গুটম্যান। সেই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক ভাবে সংকটের মধ্যে থাকা অ্যাকাডেমিক বা গুণীজনদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসত Council for Assisting Refugee Academics (CARA) নামক একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান। নাৎসি জার্মানী থেকে মুক্তি পেতে অন্য দেশে গিয়ে যারা বাঁচার চেষ্টা করত, সেই সব গুণীজনদের এবং তাঁদের পরিবারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত এই প্রতিষ্ঠান। লুডউইগ গুটম্যান এই প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হতে এরাই তাঁর পরিবারকে সাহায্য করল ইংল্যান্ডে থেকে যেতে। সে যাত্রায় বিরাট বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেল একটা ইহুদী পরিবার। ডাক্তার গুটম্যান পণ্ডিত মানুষ… কথাতেই আছে—‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’। যে বিদ্বান, যে যোগ্য, তার সর্বত্র সম্মান এবং সমাদর প্রাপ্য। গুটম্যান পরিবার গিয়ে পৌঁছল অক্সফোর্ড, সেই সময়ে আড়াই শ পাউন্ড সাম্মানিক পেল সেই শরনার্থী প্রতিষ্ঠান CARA-র ব্যবস্থায় এবং আবার নিজের জীবিকা এবং গবেষণায় ফিরে গেলেন ডাক্তার গুটম্যান।

১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার ডাক্তার গুটম্যানকে আবেদন জানাল মেরুদণ্ডের অসুখ এবং আঘাতের চিকিৎসা ও গবেষণার জন্য বাকিংহ্যামশায়ারে (Buckinghamshire) একটি বিভাগের প্রতিষ্ঠা করতে। এর উদ্দেশ্য ছিল মূলতঃ বিমানবাহিনীতে মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পাওয়া সৈন্যদের চিকিৎসা এবং তাদের জীবনযাপনকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। তোমরা জানিয়ে রাখি-- আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই মেরুদণ্ড। এতে চোট পেলে, সে আঘাত যদি গুরুতর হয় তাহলে মানুষের চলাফেরা করা সারাজীবনের মত বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমাদের সব সময় সাবধানে থাকা উচিৎ কোমর বা মেরুদণ্ডতে যাতে তেমন আঘাত না লাগে। ডাক্তার গুটম্যান বিশ্বাস করতেন, যারা অসুস্থ হয়ে আসছে তাদের চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজন তাদের মানসিক এবং শারীরিক শক্তিকে বাড়িয়ে তোলার মত অনুপ্রেরণা, উপযুক্ত পদ্ধতিতে থেরাপি। ১৯৪৪ সালে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করা শুরু করল বাকিংহ্যামশায়ারের Stoke Mandeville Hospital-এ, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পরেই ডাক্তার গুটম্যান ১৯৪৮ সালে একটি ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজন করলেন Stoke Mandeville Games নাম দিয়ে। এখানে অংশগ্রহণ করলেন সেই সব প্রাক্তন সেনারা, যাঁরা মেরুদণ্ডের আঘাতের কারণে প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন… হুইল-চেয়ারেই চলাফেরা করতে হয়। তারিখটা ছিল ২৯শে জুলাই, ১৯৪৮… ঘটনাচক্রে সেই একই দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর পর সেই প্রথম বার সামার অলিম্পিক্‌স শুরু হয়েছিল লন্ডনে। ঐতিহাসিক ভাবে গুটম্যান সাহেব সূচনা করে ফেললেন শারীরিক প্রতিবন্ধীদের প্রথম উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতা (ইতিহাসে এমন ঘটনার উল্লেখ আর দ্বিতীয় দেখি না)। উনি বলতেন প্যারাপ্লেজিক গেমস (ডাক্তারি ভাষায়)… পরে প্যারালিম্পিক শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।

১৯৫২ সালে ১৩০ জন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগী অংশ নেয় লুডউইগ গুটম্যান আয়োজিত স্টোক ম্যান্ডেভিল গেমস-এ। এই উৎসাহ এবং সামাজিক কল্যাণমূলক উদ্যোগের সাফল্য দেখে অলিম্পিক কমিটিও গুটম্যানকে সম্মানিত করল ১৯৫৬ সালে। ১৯৬০ সালে রোমে (Rome, Italy) আবার সামার অলিম্পিক্স-এর সঙ্গে অনুষ্ঠিত হল স্টোক ম্যাণ্ডেভিল প্যারাপ্লেজিক গেমস (ইতালির রোমেই)। এর সাফল্য, আয়োজন, প্রতিযোগীের অংশগ্রহণ করা, গেম ইভেন্ট… সব দিক থেকে দেখে এই ১৯৬০-এর অনুষ্ঠানকেই প্রথম অফিশিয়াল প্যারালিম্পিক গেমস বলে চিহ্নিত করা হয়।

লুডউইগ গুটম্যান ১৯৪৫ সালে বৃটিশ নাগরিকত্ব লাভ করেন। এবং এর পর চিকিৎসা এবং গবেষণা ছাড়া শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা ক্রীড়া-ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে তাদের উপযুক্ত থেরাপি, মনোবল বাড়ানো, মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় দীর্ঘদিন কাজ করে গেছেন। অবশেষে ১৯৬৬ সালে নাইটহুড পেয়ে হলেন স্যার লুডউইগ গুটম্যান। তখন তাঁর জগৎজোড়া নাম… সম্মান।

*****

আমাদের দেশ ভারত, ১৯৬৮ এবং ১৯৭২ সালের প্যারালিম্পিক গেমস-এ প্রতিদ্বন্দীতা করেছিল। কিন্তু তারপর আবার অংশগ্রহণ করে ১৯৮৪তে। তারপর থেকে ধারাবাহিক ভাবেই সামার প্যারালিম্পিক্স-এ অংশগ্রহণ করছে আমাদের দেশ। আমাদের দেশে যেমন অলিম্পিক কমিটি আছে, ঠিক সেরকম প্যারালিম্পিক কমিটিও আছে — Paralympic Committee of India (PCI), যার প্রতিষ্ঠা ১৯৯২ সালে।

প্রতিটি অলিম্পিক গেম্‌স-এর আসর সমাপ্ত হওয়ার পর যেমন আমরা অনুভব করি আমাদের দেশে কত পরিশ্রমী এবং প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ আছেন, ঠিক সেরকম প্রতিটা প্যারালিম্পিক গেমস-এর পরেও বোঝা যায়-- আমাদের দেশে প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়া কত সংগ্রামী মানুষ আছেন। প্রতিবন্ধকতা তাঁদের দুর্বল করেনি… নিজেদের আরো বড়ো মঞ্চে প্রমাণ করার জেদ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন মানুষ… এঁদের অংশগ্রহণ করা, পদক নিতে উঠে এঁদের হাসি বা চোখের জল যে কতটা অনুপ্রেরণা জোগায়… তা বলে বোঝানো যায় না!

আরো একটা মজার কথা কি জানো? ১৯৭২-এর প্যারালিম্পিক গেমস-এ ভারত যে প্রথম পদক পেয়েছিল… সেই প্রথম পদকই ছিল স্বর্ণ পদক! জার্মানীর হাইডেলবার্গ-এ (Heidelberg) ৫০ মিটার ফ্রী-স্টাইল সাঁতারে বিশ্বরেকর্ড করে সোনা জিতে এনেছিলেন সাঁতারু মুরলীকান্ত পেটকার (Murlikant Petkar) । মুরলীকান্ত ছিলেন ১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধে আহত প্রাক্তন সৈনিক। শুধু সাঁতার না, আরো অনেক রকম খেলায় অংশ নিতে পারতেন… প্রতিবন্ধকতার কারণে বক্সিংটা আর পারতেন না, যে খেলায় তিনি সব থেকে পারদর্শী ছিলেন।

কিন্তু ১৯৮৪-র পর থেকে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও ছিল কম, এবং পদকও আসত কম… অথবা আসতই না। প্রতিযোগী ক্রীড়াবিদরা তেমন উৎসাহ পাচ্ছিলেন না, নাকি পরিকাঠামোর অভাব, না অন্য কোনো সমস্যা… বলা মুশকিল। আসলে, আমাদের দেশে তো অনেকরকম খেলাই কিছু প্রধান খেলার আড়ালে চলে যায়… তাই প্যারালিম্পিক বা প্যারা-অ্যাথলিটদের সমস্যা খুব একটা আলোচিত হতে দেখিনি। একসময়ে তো এমনও গেছে, যে মাত্র দু জন বা চারজন অংশ নিয়েছে ভারত থেকে। ২০০৪-এ এথেন্স (Athens, Greece) প্যারালিম্পিক গেমস-এ দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া (Devendra Jhajharia) অনেক বছর পর আবার সোনা (জ্যাভলিনে) নিয়ে আসার পরেও পরিস্থিতি খুব একটা পালটায়নি। তবে, অনেক বছর পর আবার ২০১৬তে এসে একটু আশার আলো দেখা গেল-- ভারত থেকে রিও ডি জ্যানেরিও (Rio de Janerio, Brazil) প্যারালিম্পিক গেমস-এ অংশগ্রহণ করলেন ১৯জন প্রতিযোগী। এবারে দুটো সোনা এলো, মোট চারটি পদক। দ্বিতীয়বার অলিম্পিকে সোনা পেলেন জ্যাভলিন থ্রো করে দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া। হাই জাম্পে সোনা পেলেন মারিয়াপ্পান থঙ্গভেলু (Mariyappan Thangavelu)। এর ফলে কিছু একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ল ভারতের প্যারা-অ্যাথলিটদের মধ্যে। তাদের উৎসাহ বাড়ল, পরিশ্রম এবং প্রত্যাশার পালে একটা হাওয়া লাগল। ২০২০ টোকিও (Tokyo, Japan) প্যারালিম্পিক গেমস-এ (যা কোভিড পরিস্থিতির জন্য অনুষ্ঠিত হল এই বছর, ২০২১-এ) ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করলেন ৫৯ জন ক্রীড়াবিদ। এত বছরের প্যারালিম্পিক গেমস-এর ইতিহাসে ভারত থেকে এত সংখ্যক অংশগ্রহণকারীর নজির এই প্রথম। এবং তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের প্রমাণও করলেন ভীষণ ভালো ভাবে বিভিন্ন ইভেন্টে নিজের সেরাটি দিয়ে। ভারতের হয়ে ঘরে আনলেন ১৯টি পদক! যার মধ্যে পাঁচটি স্বর্ণ পদক। সেই ১৯৭২ থেকে ২০১৬ অবধি সব মিলিয়ে ভারতের ছিল ১২টি পদক প্যারালিম্পিকে। সেখানে এই একটি প্যারালিম্পিক গেমস-এই ১৯টি পদক! বুঝতেই পারছ কী ব্যাপক এই সাফল্য! টোকিও সামার অলিম্পিক গেমস-এ ১টি স্বর্ণ পদক সহ ৭ট পদক জয় করে ইতিমধ্যেই ক্রীড়াজগতে একটা আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই গৌরব এবং উল্লাস দ্বিগুণ হয়ে গেল প্যারালিম্পিক গেমস-এর এই সাফল্যে।

প্যারালিম্পিক গেমস, ভারত আর কিছু কথাবাঁদিকেঃ অবনী লেখারা, ডান দিকে ভাবিনা প্যাটেল

সামার অলিম্পিক গেমসের মত প্যারালিম্পিকেও প্রথম পদকটি এলো ভারতমাতার এক কন্যা সন্তানের হাত ধরে। টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ভাবিনা প্যাটেল (Bhavina Patel) জিতলেন রৌপ্য পদক। এর পর শুটিং অর্থাৎ বিভিন্ন দুরত্বে থাকা নিশানায় বন্দুক তাক করে গুলি ছোঁড়ার প্রতিযোগিতাতেও প্যারালিম্পিকের ইতিহাসে ভারতের প্রথম পদকটি আনলেন অবনী লেখারা (Avani Lekhara)। শুধু তাই নয়, উনি হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদ, যিনি প্যারালিম্পিক গেমস-এর আসরে সোনা জিতলেন। একই সঙ্গে একটি ব্রোঞ্জও পেয়েছেন উনি শুটিং-এর অন্য একটি বিভাগে। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা, এবং ৫০ মিটার এয়ার রাইফেলে ব্রোঞ্জ। এও একরকম রেকর্ড বা কৃতিত্ব-- একই অলিম্পিকে দুটি পদক নিয়ে আসা।

এছাড়া, আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে এই প্যারালিম্পিক গেমস-এ।

মোট নয়টি আলাদা আলাদা বিভাগে অংশ নেয় ভারতীয় প্রতিযোগীরা —

তীরন্দাজী, অ্যাথল্টিক্স, ব্যাডমিন্টন, প্যারাকোনোইং (ক্যানো নামক এক প্রকার নৌকা বাওয়া প্রতিযোগিতা), পাওয়ারলিফটিং, শুটিং, সাঁতার, টেবিল টেনিস, তায়কোওন্ডো (ক্যারাটে বা জুডোর মত এক প্রকার মার্শাল আর্টসের খেলা)। এর মধ্যে আবার অ্যাথলেটিক্সেরও অনেকগুলি নিজস্ব বিভাগ থাকে। আবার বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতারও আলাদা আলাদা বিভাগ বা ডিভিশন থাকে, কোন প্রতিযোগির শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কতটা, তার ওপর সেই ব্যক্তিকে একটি গ্রুপে বা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ভারতের আটটি পদক আসে অ্যাথলেটিক্স-এ। পাঁচটি রূপো, দুটো ব্রোঞ্জ এবং একটি সোনা।

জ্যাভলিন ছোঁড়া প্রতিযোগিতায় ৬৫.৮৮ মিটার দূরত্বে জ্যাভলিন ছুঁড়ে প্যারা-অ্যাথলিটদের মধ্যে বিশ্ব রেকর্ড করেন ভারতের সুমিত অন্তিল (Sumit Antil)। অলিম্পিকে নীরাজ চোপড়ার (Neeraj Chopra) মত সুমিতও নিয়ে এলেন সোনা।

প্যারালিম্পিক গেমস, ভারত আর কিছু কথাবাঁদিকেঃ সুমিত অন্তিল, ডান দিকেঃ হরভিন্দর সিং

ব্যাডমিন্টনে বেশ কয়েকটি পদক জেতে ভারত। দুটি সোনা, একটি রূপো, একটি ব্রোঞ্জ।

তীরন্দাজ হরবিন্দর সিং (Harvinder Singh), প্রথম ভারতীয় হিসেবে তীরন্দাজী প্রতিযোগিতায় পদক আনলেন— ব্রোঞ্জ।

প্যারালিম্পিক গেমস, ভারত আর কিছু কথা দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া

ভারতের সব থেকে সফল অ্যাথলিট দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া এবারো পদক পেলেন, রৌপ্য পদক। এই নিয়ে তিনটি অলিম্পিক পদক হল ওঁর (এর আগে দুটি সোনা ছিল, ২০০৪ এবং ২০১৬ তে)।

প্রায় দু সপ্তাহ ধরে এভাবেই একের পর এক সাফল্যের উপহার দিতে থাকেন প্রতিযোগীরা। এমনও অনেকে আছেন, যাঁরা অল্পের জন্য পঞ্চম বা চতুর্থ হয়েছেন… কিন্তু তাঁদেরও চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল না। ডিস্কাস ছোঁড়া প্রতিযোগিতায় বিনোদ কুমার (Vinod Kumar) ব্রোঞ্জ পেয়েও অন্য কারণে ডিসকোয়ালিফায়েড হলেন।

২৪শে আগস্ট থেকে ৫ই সেপ্টেম্বর, এই পুরো সময়টা জুড়ে এত এত আবেগঘন মুহূর্ত উপহার দিয়েছে এই প্যারালিম্পিক গেমস-এর প্রতিযোগীরা— তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে দেশের পতাকা তুলে ধরলেন অবনী লেখারা।

আমরা সবাই তো সব রকম খেলা আর তার নিয়ম বুঝি না। দেখতে দেখতে আগ্রহ আর ভালো লাগা জন্মায়। আরো বেশি করে সেই আগ্রহ বাড়ে, যখন দেখি আমাদের দেশের কেউ খেলছে। এবং সেই খেলা এমন যে তাদের সঙ্গে বিশ্বের অন্য সেরা খেলোয়াড়রাও পেরে উঠছে না। তারা জয় ছিনিয়ে নিচ্ছে, লড়াই করে যাচ্ছে দাঁতে-দাঁত চেপে। ঠিক এই আনন্দটাই দিয়েছে এবারে প্যারালিম্পিক গেমস। যারা খেলা দেখে না বা দেখছিল না, তাদেরও কৌতূহল বাড়ছিল খবরের কাগজের পাতায় নজর রাখার, দেখার যে কী হল আজকের খেলায়… কেমন খেলছে ভারতীয় প্রতিযোগী। সামার অলিম্পিক্স তৈরী করা যাওয়া রেশটাই যেন পুরো চলে এলো প্যারালিম্পিক গেমসে। এখানে কোথাও ‘প্যারা’ শব্দটা আলাদা করে মাথায় আসছিল না। সমবেদনা বা সহানুভূতি থেকে তাদের খেলা দেখা নয়, খেলা দেখা তাদের যোগ্যতা আর দক্ষতাকে সম্মান দিয়ে। হয়ত এটাই এই ক্রীড়াবিদ, এই প্রতিযোগিদের সব থেকে বড়ো সাফল্য। এঁরা সেরা খেলাটা খেলতে শুরু করলে, হুইল চেয়ার, প্রসথেটিক পা, একটি হাতের অভাব আর মুখ্য থাকে না। তাদের পারফর্মেন্স অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। যে ছেলেটা মাঠের ধারে বসে রোজ খেলা দেখে, খেলতে পারে না। যেয়ে মেয়েটা বারান্দায় বসে সাইকেল চালানো দেখে, সাইকেল চালাতে পারে না-- তারাও মনে জোর পাবে, নতুন করে ভাববে… যদি একবার চেষ্টা করে দেখা যায়? এরা তো পারছে… চেষ্টা করলে আমিই বা কেন পারব না? হয়ত এই ছেলে-মেয়েদের অভিভাবকরাও ভাববেন— আমাদের মাঝেই এমন দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া, ভাবিনা প্যাটেল, অবনী লেখারা, সুমিত অন্তিল লুকিয়ে আছে। আর শুধু ক্রীড়া কেন, সব রকম ভাবেই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারে এমন উজ্জ্বল অভিজ্ঞতা।

*****

সত্যি বলতে, এখানে কেবল সেই সব প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়ের কথাও বলব … বলব সবার কথা। সবার কাছেই অনুপ্রেরণা প্যারালিম্পিক গেমস এবং তাতে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা। প্রতিযোগিতা থাকলে তাতে প্রথম-দ্বিতীয় তো থাকবেই। কিন্তু এই অংশ নেওয়াও কি কম মনের জোর? কম যোগ্যতার ব্যাপার? কত দেশের মানুষ অংশ নিচ্ছেন। কত দেশের মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত। কত কোটি মানুষ দেখছেন এই প্রতিযোগিতা! কী জানো? যখন এইসব প্রতিযোগিদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আলাদা করে পড়ি বা খোঁজ নিই, তাঁদের অতীত জীবন বা কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় বা হতভাগ্যের কারণে অঙ্গহানি হওয়ার ঘটনা জানতে পারি… মন খারাপ হয়। প্রথমে ভাবি, এমন কি হওয়া উচিৎ ছিল? এ তো একপ্রকার দুর্ভাগ্যই। কিন্তু এঁরা হতাশাগ্রস্ত হননি। হলেও, সেই হতাশাকে অতিক্রম করে জীবনে ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মানুষ হিসেবে সম্মান পাওয়ার জন্য নিজেকে কিছু একটা প্রমাণ করা এবং অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখার চেষ্টা অনেকের মধ্যেই থাকে, যদিও তা জরুরি নয়। মৌখিক সম্মান এবং সৌজন্যবোধ সকলের প্রাপ্য… মেধা বা জনপ্রিয়তা নির্ভর হওয়া উচিৎ না। কিন্তু সেই অষ্টাবক্র-এর সময় থেকেই-- যে শারীরিক ভাবে একটু পিছিয়ে, তাকে একটু বেশিই কিছু করতে হয়েছে আলাদা ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সম্মান এবং স্বীকৃতি পেতে। প্যারালিম্পিক গেমস-এর এইসব প্রতিযোগীরা হতাশা, অবসাদ বা অন্যের করুণার পাত্র হয়ে কাটানো জীবনে আবদ্ধ না থেকে ভীষণ ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ যে সমাজের ওপর কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে… তা বলার নয়। যে হুইল চেয়ারে বসে থাকে মাঠের ধারে, সে কেন শুধু মাঠের ধারে থাকবে? হুইল চেয়র বসে খেলেই তো পদক জিতলেন ভাবিনা! হুইল চেয়ার বা প্রস্থেটিক পায়ে ভর দিয়েই তো কত প্রতিযোগি লড়াই করে গেলেন, পদক ছিনিয়ে নিলেন এই অলিম্পিকের আসরে!

স্যার লুডউইগ গুটম্যানের চিন্তা এবং উদ্যোগের কথাই এখানে আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে আচার্য বিনোবা ভাবে, বাবা আমতে বা সুন্দরলাল বহুগুণার মত মানুষরা যেমন সমাজে মহীরুহর মত থেকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ঠিক সেরকমই এক মানুষ লুডউইগ গুডম্যান। এত কিছু করার পেছনে ওঁর নীতিই ছিল— এই হুইল-চেয়ারে থাকা মানুষগুলো খুশি থাকতে হবে, আনন্দে থাকতে হবে। এদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। এদের ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। এবং এইসবের মধ্যে দিয়েই এদের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ করে ফিরিয়ে আনতে হবে জীবনের মূল স্রোতে। 'আমরা এখনো অনেক কিছু করতে পারি' — এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত হতে দেখে বেড়ে উঠবে মানুষের ইচ্ছাশক্তি।

এই সত্যি, এই উপলব্ধি শুধু সেই প্যারাপ্লেজিক গেমস-এ অংশ নেওয়া মানুষগুলোর জন্য নয়। এই সত্যি আমাদের সকলের জন্য। প্রতিবন্ধকতা কি শুধু শরীরেই হয়? মনের প্রতিবন্ধকতা? সামাজিক প্রতিবন্ধকতা? লড়াই তো সব ক্ষেত্রেই চলছে। লড়ে যাচ্ছেন কত মানুষ।

তোমরা খেলাধুলো করতে ভালোবাসো, কত রকম খেলা আমাদের ছোটোবেলায় ছিল। কত নতুন নতুন খেলা এখন এসেছে। পুরনো খেলার নিয়ম বদলেছে। প্যারিলিম্পিক গেমস-এর মতই দেখো অন্য সব খেলাতেও শারীরিক সমস্যাকে পেছনে ফেলে ক্রীড়াবিদরা অংশ নিচ্ছে। তাদেরও টুর্নামেন্ট এবং লীগ হচ্ছে। দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট এবং ক্রিকেট বিশ্বকাপ হয়… জানো?

তোমাদের তেমন কোনো বন্ধু আর মাঠের বাইরে বসে থাকবে না। তোমরাই তাকে হাত ধরে টেনে এনে খেলবে একসাথে। খেলবে তো?

(সূচনা চিত্রঃ বাঁদিকে প্যারালিম্পিক গেম্‌স্‌- এর লোগো; ডান দিকে জার্মানির বন শহরে প্যারালিম্পিক গেমস-এর প্রধান কার্যালয়)

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা