সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
দেশ-বিদেশের বসন্তের দেবীরা

উত্তরগোলার্ধের বসন্তকাল রবি শস্য আহরণের কাল। তাই সে বসন্ত জুড়ে উর্বরতা এবং সৃজনীশক্তির প্রতীক মাতৃকাদেবীদের উপাসনা। নিরক্ষরেখা থেকে যত উত্তরে যাওয়া যায় ততই বসন্তের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রধান শস্য আহরণ কাল। আর বসন্তের দেবীই হয়ে ওঠে প্রধান দেবী, সৃজন-পালন-সংহারের অধিশ্বরী, জগন্মাতৃকা। আমাদের বসন্তের দেবী 'সরস্বতী', বসন্তেশ্বরী 'অন্নপূর্ণা'র কাহিনি তো আমরা জানিই। চলো, শুনে নেওয়া যাক অন্য দেশের অচেনা বসন্তের দেবীদের কাহিনি। 

প্রাচীন জার্মানির মাতৃকাদেবী 'ইয়োস্ত্রি' বা 'অস্তারা'

দেশ-বিদেশের বসন্তের দেবীরা

প্রাচীন জার্মান বর্ষপঞ্জিতে শস্য আহরণের গোটা এপ্রিল মাসটাই ছিল এই দেবীর নামে।  শব্দের উৎস খুঁজতে প্রাচীন প্রোটো-জার্মানিক ভাষায় গেলে দেখা যাবে 'অস' শব্দের অর্থ জ্যোতি। 'ইয়োস্ত্রি' বা 'অস্তারা' শব্দের অর্থ দাঁড়াচ্ছে জ্যোতির্ময়ী দেবী। দ্বিতীয় খৃষ্টপূর্বাব্দে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে এই দেবীর নাম ছিল 'মাত্রোনি অস্ত্রিয়াহীনি'। দেবী ছিলেন ত্রি-মূর্তির অংশ। দুই পাশে সূর্য এবং চন্দ্র। অর্থাৎ পশ্চিম এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের মাতৃমূর্তির সাথে এই দেবীর মূর্তির পার্থক্য নেই। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে এই দেবী বসন্ত বিষুবচ্ছদের সামান্য পরে পূজিত হতেন। বিভিন্ন উপকথার উপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় শিল্পীরা দেবীর যে ছবি এঁকেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে দেবী আকাশপথে উড়ে চলেছেন, তাঁর হাতে পুষ্পদন্ড, পাশে রয়েছে শশক, ডানাযুক্ত দু'টি শিশু, সামনে রাজহংস। দেবীর ভঙ্গিমা এবং দেবীর পরিমন্ডল কিন্তু কন্যারাশির দিকে ইঙ্গিত করছে না। বরং নির্দেশ করছে উত্তর আকাশে আরেক কন্যা দেবযানী নক্ষত্রমন্ডলী বা অ্যান্ড্রোমিডাকে। স্বাভাবিকভাবেই এখানে কোন বৃষ সংহারের কাহিনি নেই। শশকমন্ডলী, পারসিউস, রাজহংস বা সিগনাস তারকামন্ডলী ইঙ্গিত করছে উত্তর ইউরোপে বিলম্বিত শস্য আহরণ কালকে।

প্রাচীন নর্স দেবী 'ফ্রেয়া'

দেশ-বিদেশের বসন্তের দেবীরা

    নর্স উপকথার শস্যের দেবী 'ফ্রেয়া'র ভিত্তি কিন্তু আকাশের কন্যারাশি নয়। নর্স জাতির আবাসভূমি যেহেতু অনেক উত্তরে, তাই তাদের মাথার ওপরে থাকা উত্তর আকাশের দেবযানীমন্ডল বা অ্যান্ড্রোমিডা কনস্টেলেশন হল দেবী ফ্রেয়ার মূর্তি। সামনে থাকা মীনরাশির দু'টি নক্ষত্র তাঁর রথের দুই বিড়াল, ত্রিভুজ তারকামন্ডলী তাঁর লাঙ্গল, চক্রাকৃতি 'করোনা বোরিয়ালিস' তাঁর অলঙ্কার। পক্ষীরাজ তারকামন্ডলীর চারটি তারকাই সম্ভবত দেবী ফ্রেয়ার কাহিনির চার বামন। পৃথিবীর অন্যান্য মাতৃকাদেবীর মতোই ফ্রেয়া যেমন শস্য ও উর্বরতার দেবী, তেমনই তিনি যুদ্ধ ও সংহারেরও দেবী। ফ্রেয়া বা অ্যান্ড্রোমিডার কাহিনিও সুদূর উত্তর ইউরোপের নর্স জাতির বিলম্বিত শস্য আহরণ কালকে নির্দেশ করে।

প্রাচীন রোমের দেবী 'আনা পেরেনা'

দেশ-বিদেশের বসন্তের দেবীরা

এই ছবিতে ভাই ডিডোকে উদ্ধার করতে এসেছেন লাল পোষাক পরিহিতা আনা পেরেনা

  প্রাচীন রোমের শস্যের দেবী আনা পেরেনা। চান্দ্র ক্যালেন্ডারে বসন্তের প্রথম পূর্ণিমায় এই দেবীর উপাসনা হত। ওভিদ এবং ভার্জিলের রচনায় দেবী আনা পেরেনার কাহিনি রয়েছে।  ঐতিহাসিক মার্কোবিয়াসের বিবরণ অনুযায়ী, এই দেবীর প্রাচীন উৎসবে রোমের মানুষ উন্মুক্ত শস্যক্ষেত্রে তাঁবু খাটিয়ে দেবীর উপাসনা করত, চড়ুইভাতি করত। সারা বছরের জন্য প্রার্থনা করা হত আনা পেরেনার উদ্দেশ্যে। রোমের শিল্পীরা দেবীর যে ছবি এঁকেছেন তাতে এট্রুস্কান মাতৃমূর্তি মিলে মিশে গিয়েছে। পরবর্তীকালের রোমান শস্যদেবী মিনার্ভার দাপটে দেবী আনা পেরেনা বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যান। আধুনিক যুগের ঐতিহাসিক মহলে এই দেবীকে নিয়ে বিশেষ চর্চা হয় নি। ১৮৯৯ সালে সিসিলি দ্বীপে আনা পেরেনার শিলালেখ পাওয়া যায়। এর ঠিক ১০০ বছর পরে রোমে দেবীর নামাঙ্কিত একটি ফোয়ারা আবিষ্কৃত হয়।

কেল্টিক জনজাতির দেবী 'আর্শিও'

দেশ-বিদেশের বসন্তের দেবীরা

মধ্য ইউরোপের কেল্টিক জনজাতির বসন্তের দেবী আর্শিও। উত্তর মন্ডলের উত্তর আকাশের বসন্তের নক্ষত্রমন্ডলী সপ্তর্ষি বা ঋক্ষমন্ডল বা বৃহৎ ভল্লুকের সাথে কল্পনা করা হয়েছে এই দেবীর মূর্তি। প্রাচীন গল-রোমান মিশ্র জনজাতির বসন্তের দেবী দিয়া আর্শিওর অস্তিত্ব এবং উপাসনা রীতি এই দেবীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। সুইজারল্যন্ডের বার্ণ শহরের কাছে মুরিতে দেবী আর্শিওর যে মূর্তি পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, দেবী একটি বৃহদাকার ভালুকের সামনে বসে রয়েছেন, ভালুকটির পিছনে বসন্তের নবমুকুলিত বৃক্ষের শাখা, দেবী ভালুকটিকে ফল খাওয়াচ্ছেন।

উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার শস্য দেবী 'বেইবে'

সুইডেন, ফিনল্যন্ড, নরওয়ে এবং রাশিয়ার উত্তর প্রান্তের সুমেরুবৃত্ত অঞ্চলের প্রাচীন সামি জনজাতির শস্য দেবী বেইবে। সূর্যের গতির সাথে সম্পর্কিত এই দেবীর উপাসনা। শীতের মরশুমে উইন্টার সলস্টিস বা মকরক্রান্তি দিয়ে সূচিত হয় দেবীর আগমন। সেইদিন একটি শ্বেতবর্ণ স্ত্রী-হরিণ উৎসর্গ করা হয় দেবীর উদ্দেশ্যে। ঘরের চৌকাঠের সামনে রাখা হয় গলন্ত মাখন। দেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হয়, যাতে তিনি আকাশের সর্বোচ্চ অবস্থানে আরোহণ করে কৃষিক্ষেত্রে উর্বরতা আনেন, বরফের শীতলতা কমিয়ে পৃথিবীকে শস্যশ্যামল করে তোলেন, বলগা হরিণের জন্যে তৃণভূমিকে প্রাণোচ্ছল করে তোলেন।

পূর্ব শ্লাভিক বাসন্তী দেবী 'কোস্ত্রমা'

দেশ-বিদেশের বসন্তের দেবীরা
শিল্পীর তুলিতে দেবী কোস্ত্রোমার অন্তিম যাত্রা

দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশিয়ার বসন্তের শস্য দেবী কোস্ত্রমা। শীতের শেষে শুকনো বার্চ পাতা পুড়িয়ে বহ্নুৎসবের মাধ্যমে দেবীর আবাহন করা হত সেকালে। এক আটি খড় বা পবিত্র খড়ের মানুষ পুড়িয়ে সেই ছাই ফেলা হত শস্যক্ষেত্রে। প্রার্থনা করা হত শস্যক্ষেত্রের উর্বরতা বৃদ্ধির। দেবীর মৃত্যুতে শোকপালন করা হত। আবার বসন্তের নতুন মুকুলোদ্গমে দেবীর নবজন্মে মানুষ মেতে উঠত উৎসবে। শ্লাভিক অঞ্চলের কৃষিকাল অনুযায়ী, ইস্টার পরবর্তী সপ্তম সপ্তাহ জুড়ে পালিত হত দেবী কোস্ত্রমার উৎসব।

পশ্চিম আফ্রিকার দেবী 'হারা কে'

পশ্চিম আফ্রিকার দেবী হারা কে বসন্তের শস্যের দেবী। মিঠেল জলের বৃষ্টি আর ফোয়ারার দেবী তিনি। নাইজার নদীর তীর থেকে সুদূর দক্ষিণের নামিবিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অংশের মানুষ বসন্তের বীজ বপন কালে এই দেবীর অলৌকিক শক্তির সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই দেবীর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্তোত্র পাঠ হয় কৃষিকর্মের বিভিন্ন পর্যায়ে। দেবী সুবাতাস এবং আলোকের দিক নির্দেশ করেন, স্বাদু জলধারার দিক নির্দেশ করেন। শস্যে-শস্যে, ফুলে-ফলে ভরিয়ে তোলেন বসন্তের বসুন্ধরাকে।

জাপানের দেবী 'কোনোহানাসাকুয়া-হাইমে'

বসন্তের ফুলের কুঁড়ি ফোটানোর দেবী তিনি। সংক্ষিপ্ত নাম সাকুয়া-বিমে। পর্বতের দেবতা অহোয়ামাৎসুমির কন্যা এই দেবী। জাপানী উপকথায় দেবী সাকুয়া-বিমের বিয়ে নিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড। সমুদ্রতীরে আলোর দেবতা নিনিগি সাকুয়া-বিমেকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু পিতা অহোয়ামাৎসুমি অনূঢ়া জ্যেষ্ঠা কন্যা ইবা-নাগা-হিমেকে বিয়ে না দিয়ে কনিষ্ঠা সাকুয়ার বিয়ে দিতে নারাজ। অমতেই হল বিয়ে। এরপর অভিশাপ, অশান্তি আর বিশ্বাসভঙ্গ। রামায়ণের সীতার মতো সাকুয়া-বিমেকে দিতে হল অগ্নিপরীক্ষা। যা আসলে শীতের অবসানে বসন্তের প্রথম অগ্নি-উৎসবের প্রতীক।

পূর্ব ইউরোপের শস্য দেবী 'জীবোনা'

দেশ-বিদেশের বসন্তের দেবীরা

পোল্যান্ডে এই দেবীর নাম জীবোনা। সার্বিয়ায় দিল্বিকা, চেক প্রজাতন্ত্রে দেবানা এবং স্লোভেনিয়ায় দেওয়েনা। আকাশের দেবতা পেরুন এবং ডোডোলার কন্যা এই দেবী শুধু বসন্তের দেবী নন- তিনি যুদ্ধের দেবী, উর্বরতার দেবী, কৃষিকর্মের দেবী। শক্তিমতী এই দেবী একাই ঘোড়ায় চড়ে শীতের অরণ্যে শিকার করে বেড়ান, শীতের অন্ধকার দূর করেন। গাছে গাছে নতুন ফুল ফোটান। ফলে-ফুলে ভরিয়ে তোলেন বসন্তের পৃথিবীকে।


ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য লিঙ্কগুলি

জন্ম হুগলী জেলার কোন্নগর নবগ্রামে। বর্তমানে পেশাসূত্রে দেরাদুনে। পেশায় বিশ্বব্যাংকের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। কৈশোরের শেষ থেকে ছড়া-কবিতা লিখছেন বিভিন্ন মুদ্রিত কিশোর পত্রিকায় এবং পরে বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায়। 

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা