সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
লেডি গণেশের গল্প

দুর্গাপুজোর আগে আগে বেশ ধুমধাম করে পালিত হয়ে গেলো গণেশ পুজো। তারপরে আধাপথ বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই ফের দুর্গাঠাকুরের সঙ্গে আবার এলেন তিনি। তাই ভাবলাম, তোমার সঙ্গে গণেশ ঠাকুরকে নিয়ে একটু গল্প করি।

আচ্ছা  বলোতো, গণেশঠাকুর  ছেলে না মেয়ে? এই দেখো! ভেংচি কাটলে নাকি? আরে শোনো শোনো, তোমাদের মতন আমিও তো জানতাম গণেশ দাদার পেটটি নাদা আর সামনে লাড্ডুর ভোগ গাদা গাদা। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে ওই হাতির মাথা ওয়ালা গণেশের গোলু গোলু চেহারা থেকে শুঁড় এমনকি ইঁদুরটাও আমার ভারী পছন্দের। কিন্তু কেউ কি জানো যে গণেশ ঠাকুরের আবার  একটা মেয়ে রূপ-ও হয়।  এই দেখো, বিশ্বাস করেনা।  আরে! সত্যি বলছি তো!! আমিও কি ছাই জানতাম নাকি!!! সেবার তোমাদের মতন সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে ইস্কুল থেকে বেড়াতে গেছি ভারতীয় জাদুঘরে। এ ঘর, ও ঘর ঘুরছি। কী পুরোনো ওষুধ ওষুধ গন্ধ! হবেই তো! সবকিছু সংরক্ষণ করে রাখা যে ! তার মধ্যেই হঠাৎ দেখি একজায়গায় একটা ভাঙ্গা-মতন গণেশ মূর্তি রাখা যার মাথাটা তো গণেশের কিন্তু বাকি শরীরটা মেয়েদের মতন। ভুল দেখছি নাতো! এই ভেবে এগিয়ে গিয়ে দেখি নাহ ! ঠিক-ই।  নিচে লেখা রয়েছে বিনায়কী। অর্থাৎ কিনা মহিলা গণেশ।

লেডি গণেশের গল্প
গণেশিনী

ব্যাস! অমনি মাথায় খেয়াল চাপলো জানতেই হবে যে আর কোথায় কোথায় এমন মূর্তি পাওয়া যায় আর কোত্থেকেই বা এলো এমন মূর্তি!   কিন্তু যাকেই জিজ্ঞেস করি সেই বলে জানিনাতো!!!

তাহলে উপায়? তখন মনে পড়লো দাদাইয়ের কথা।  দাদাই মানে আমার বাবার এক কাকা। বয়েসে আবার কিন্তু বাবার থেকে ছোট।  বহুদেশ ঘুরেছেন তিনি। একসময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে বেশ দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করতেন। সেই ছোট থেকেই দাদাইয়ের বাড়ি যাবার কথা হলেই আমার মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যেতো।  পুরাণ ,রামায়ণ,মহাভারত,আর ইতিহাসের কত যে গল্প শুনেছি দাদাইয়ের কাছে তার ইয়ত্তা নেই।  

লেডি গণেশের গল্প
অভয়মুদ্রা সহ স্ত্রী গণেশ

চলেই  গেলাম সময় করে এক রবিবার সকালে দাদাইয়ের গরপাড় রোডের বাড়িতে আর একথা সেকথার পরে পেড়ে ফেললাম লেডি গণেশের কথা।  দাদাই শুনে বললে , এ আর এমন কী ! সেতো আমি আরো কত জায়গাতেই  দেখেছি।  সবাই ঠিক খেয়াল করেননা , ভাবেন  বুঝিবা গনেশ-ই, কিন্তু তোর মতন আমার-ও চোখে টেনেছিল সেই  পৈতে পরা গণেশের নারীমূর্তি।  আর আশ্চর্যের কথা হলো গণেশের নামের স্ত্রীলিঙ্গেই তিনি  পরিচিত পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়।...যেমন, বিনায়কী, গজাননী , বক্রতুনডা , বিঘ্নেশী , গনেশিনী, গনেশি, গনেশিকা, গণপতিকা ইত্যাদি।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এঁকে জানেন গণপতিহৃদয়া হিসেবে, অর্থাৎ কিনা স্ত্রী হিসেবে শ্রীগণেশের হৃদয়ে অবস্থান করেন তিনি। জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ দেবতা হিসেবে এই বিনায়কীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে হিন্দুধর্মের মৎস্যপুরাণ ছাড়া অন্য কোথাও এঁর সৃষ্টির উৎস সম্পর্কে তেমন উল্লেখ পাওয়া যায়না। কেবল একা গণেশই দেখা যায় সর্বত্র বিঘ্ননাশক দেবতা হিসেবে পূজিত হন।

লেডি গণেশের গল্প
হীরাপুরের চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের বিনায়কী

আমি কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই  ফেলি আর কোথায় কোথায়  দেখেছো তুমি এই মূর্তি?

দাদাই বলে, আমি প্রথম এঁকে দেখি জব্বলপুরের কাছে ভেরাঘাটের চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরে। এরপর প্রত্নতত্ব বিভাগের কাজে রাজস্থান গিয়ে এক শিবমন্দিরে খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকের কাছাকছি সময়ের টেরাকোটার তৈরী একটা স্ত্রী-গণেশ মূর্তি দেখেছিলাম। উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কাছে হীরাপুরে খৃষ্টপূর্ব দশম শতকের এক মন্দিরের দেওয়ালে এই মূর্তি রয়েছে। কোথাও নাম ঐঙ্গিনি, কোথাও বিনায়কী আবার কোথাও গনেশিনী। শিরালীর চিত্রপুর মঠে তিনি তলোয়ার  হাতে শাক্ত দেবীর চেহারা পেয়েছেন কেবল মাথাটি রয়ে গেছে গণেশের মতন।  বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে আবার যখন  প্রতিহার যুগের প্রাচীন বিনায়কী  মূর্তি পাওয়া গেলো, দেখা গেলো তাঁর তিনহাতে  রয়েছে  গদা, পদ্ম এবং কুঠার। অন্য হাতের অস্ত্রটা  কেউ চিনতেই পারলোনা ,  কিন্তু শুঁড়ে ধরা ছিল লাড্ডুর মতন দেখতে কোনো খাবার, মহারাষ্ট্রে যাকে কিনা  বলে মোদক । আর সবচেয়ে যেটা নজর কেড়েছিল যে  এই মূর্তিটা মোটেই অন্য সব গণেশের মতন মোটা ভুঁড়িওয়ালা চেহারার নয়।  আরেকটা দেখেছিলাম কন্যাকুমারীর  থনুমল্যান মন্দিরে। বিখ্যাত প্রত্নতত্ববিদ শান্তালিঙ্গমের সাথে কাজে বেরিয়েছিলাম সেবার। ওই মন্দিরের ঈশান কোনের দেওয়ালে রয়েছে সুখাসনে পা মুড়ে বসা এক দেবীমূর্তি, যার মাথা গণেশের মতন, হাতে ধরা শঙ্খ এবং কুঠার। এই মূর্তিগুলো এক একজায়গায় এক একরকম ভাবে বসা বা দাঁড়ানো অবস্থায় দেখেছি আমি।  কোথাও ললিত ভাব, কোথাও ত্রিভঙ্গে, কোথাও বা আবার হাতে রয়েছে অভয়মুদ্রা।

লেডি গণেশের গল্প
ঐঙ্গিনী

স্কন্দপুরাণে বিনায়কী নামের কোনো উল্লেখ বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না। কিন্তু গজমুখী নামের হাতির মতন মাথাওয়ালা দেবীর উল্লেখ রয়েছে, যিনি নাকি সেসময়ে গণেশের স্ত্রী হিসেবে গণ্য হতেন । দাদাই বলেন, আসলে কী জানিস, গণেশ যেহেতু দেখতে ওরকম শুঁড়ওয়ালা তাই তার স্ত্রীর -ও ওরকম চেহারাই  হবে যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গণেশ যেমন সিদ্ধিদাতা হিসেবে পূজিত হন, সেই সময়ের গজমুখীর কোনো পূজা বা আরাধনার তথ্য পাওয়া যায়না। বরং গজমুখীর পরিচিতি ছিল দুর্ভাগ্যের দেবী হিসেবে। অন্যদিকে গোরক্ষসংহিতায় বিন্ধ্যপর্বতের বাসিন্দা ত্রিনয়নী বিনায়কীর স্পষ্ট উল্লেখ  রয়েছে। মূর্তিকে কল্পনা করা হয়েছে সিঁদুরবরণী,দশভুজা,ত্রিনয়নী এবং বরাভয়দাত্রী হিসেবে যেটায়  শাক্তধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট। মাদুরাইয়ের কাছে এক মন্দিরে এই বিনায়কী 'ব্যাঘ্রপাদ গণেশানী' নামে পূজিতা হন কারণ তাঁর পায়ের পাতা বাঘের থাবার মত দেখতে। কয়েকটি দেবীপুরাণে এবং উপপুরাণে আবার গননায়িকা বা বিনায়কীকে গণেশের শক্তিদাত্রী  হিসেবে বিঘ্ননাশিকার ভূমিকায় দেখানো হয়েছে। সেখানে তিনি নবম মাতৃকা শক্তির স্থানে রয়েছেন। এছাড়াও কাজের সূত্রে জেনেছি যে শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত প্রভৃতি জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন নামে এই দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে।

লেডি গণেশের গল্প
ব্যাঘ্রপাদ গণেশানী

মৎস্যপুরাণ থেকে আরেকটু বিশদ জানা যায়। মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয়, অন্ধকাসুর যখন পার্বতীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন পার্বতী বিরক্ত হয়ে স্বামী মহাদেব কে সে কথা জানান। প্রবল ক্ষিপ্ত মহাদেব ত্রিশূল নিক্ষেপ করেন অন্ধকের দিকে। কিন্তু অসুর ছিল বরপ্রাপ্ত।  পার্বতী জানতেন, অন্ধকের এক ফোঁটা  রক্ত মাটিতে পড়লে তার থেকে আরো এক অন্ধকের সৃষ্টি হবে তাই তিনি নিহত অসুরের রক্ত মাটিতে পড়া আটকানোর  জন্যে প্রত্যেক স্বর্গীয় অস্তিত্বকে আহ্বান জানালেন কারণ প্রত্যেক স্বর্গীয় অস্তিত্বের মধ্যে দুটো রূপ থাকে। মননের অংশটিকে পুরুষ এবং সৃষ্টির অংশটিকে স্ত্রী হিসেবে মানা হয়।  এই স্ত্রীশক্তি একত্রিতভাবে শক্তিরূপে উদ্ভূত হয়ে ত্রিশূলের আগায়  ক্ষতবিক্ষত অন্ধকের দেহ থেকে একটি ফোঁটা রক্ত-ও মাটিতে পৌঁছাতে দিলোনা। এই সম্মিলিত স্ত্রী-শক্তির একজন ছিলেন এই বিনায়কী। 


বিনায়কী

দাদাইয়ের কথা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম একদম কীভাবে বেলা একটা বেজে গেলো টের-ই পাইনি। টনক নড়লো দিদুনের ডাকে। গল্প করতে করতে দুপুরের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিলাম বাড়ির পথে তোমার জন্যে সবকথা লিখে রাখবো  বলে।

ছবিঃ উইকিপিডিয়া , টুইটার

সূত্র: পুরাণকথা এবং বালাজি মানকড ও যুবরাজ কৃষ্ণান এর বিনায়কী বিষয়ক দুটি বিখ্যাত বই।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা