ওয়াহাবি-ফরাজী আন্দোলন
এই যে ছোট্ট বন্ধু, কেমন আছ তুমি? গরমে হাঁস-ফাঁস তো?বৃষ্টির জন্য হা-পিত্যেস করে বসে থাকতে থাকতে আবার ঘুরে গ্রীষ্মকাল ফিরে এল যেন। বৃষ্টি হল যা দু চার ফোঁটা, তাতে শুধু রাত্তির টুকুই ভাল করে ঘুমনো গেল। সকাল হলেই আবার সেই একই রকম ব্যাপার—চটচটে অস্বস্তি। তবে হ্যাঁ, এইতুকুই যা রক্ষা, যে গরমের ছুটিটা বেশ লম্বা হয়ে গেল। আমার বেশ মনে পড়ে, জানো, মামারবাড়িতে ছোটোবেলায় প্রতিবছর গরমকালে যখন থাকতে যেতাম, বাবা-মা এর শাসনের কোনো বাঁধন ছিল না। গ্রামের চাষীদের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে খেলা করতাম। এখন না হয় গরমের দুপুরে রোদ্দুর-এর তেজে বাইরে বেরনোর কথাআ ভাবলেই ভয় লাগে, আর তখন খেলার নেশায় সে সব অনুভূতি-ই ছিল না।কত্ত নতুন নতুন অভিযান! নতুন নতুন শেখা!কলাপাতা-কে পানের মত করে মুড়ে তার মধ্যে কাঁচা আম থেঁতো করে নুন, চিনি আর লঙ্কাপোড়া দিয়ে মেখে তার রস ওই কলাপাতার খিলির গোড়া দিয়ে টেনে টেনে খেয়েছ কোনোদিন? পৃথিবীর কোনো রেঁস্তোরা বা আচারের দোকানে এ জিনিস পাবে না! পাকা আম কে ‘বেলো’ করে খেয়েছ কোনোদিন? বঁটি-ছুরি ছাড়াই একটা আমের ভিতরের শাঁস খোসা না ছাড়িয়েই হাপিস; পড়ে থাকবে শুধু খোসা আর আঁটি।– খেয়েছ কোনদিন?মহাত্মা গান্ধির খুব প্রিয় খাবারের মধ্যে একটা ছিল এই বেলো করা আম।মহাত্মা গান্ধির কথাটা বললাম কেন জান? না হলে তোমার বাড়ির বড়রা আবার ভাববেন কি সব বদ গেঁয়ো শিক্ষা দিচ্ছি তোমাকে!যাই হোক তবু আমার ছেলেবেলার আনন্দ-টা শুনেও তো তুমি কিছুটা আনন্দ পাবে, আর আমার তাতেই বেশি আনন্দ।তবে ওই সব বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম, যা কোনো স্কুলে শেখা যায় না। একদম মাটির শিক্ষা, হাতে নাতে শিক্ষা, ধৈর্যের শিক্ষা, অনেক কিছু ছাড়াই খুশিতে বাঁচার শিক্ষা, একজোট হয়ে কাজের শিক্ষা, সব রকম মানুষ-কে সম্মানের শিক্ষা – যা সিলেবাসের বাইরে।শেখার মূল মন্ত্রটা তোমার কানে কানে বলে দিই আজ – তোমার সঙ্গে যিনিই থাকুন না কেন, যদি তাঁর কাছ থেকে শেখার কিছু থাকে, তাহলে তাঁর বয়েস আর শ্রেনী বিচার না করে বরং তাঁর জানা আর তোমার অজানাকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দিও। ব্যাস। দেখবে, কাম খতম।
আধুনিকতার মায়াজালে এক আশির্বাদ দুর্ভিক্ষ সে ভাবে না হওয়া।তবে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলা তথা পুরো উত্তর ভারতে প্রতি দশকে গড়ে একবার করে বড় রকমের দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। কারণ – বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের আগ্রাসী অপশাসন, বাণিজ্যের নামে দুর্ণীতি ও জুলুমবাজি, মুঘল আমলের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণশ খাজনা আদায়, বাংলার কৃষিব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেয়।তার মধ্যে আবার গোদের অপর বিষফোঁড়া, লর্ড কর্নওয়ালিশের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’।
আচ্ছা তুমিই বল এরকম অবস্থায় কোন গরীব সাধারন মানুষটা আর স্বাভাবিক থাকতে পারে।কৃষ্কদের মনে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটল ওয়াহাবি বিদ্রোহের মাধ্যমে। ফরাজী তার অনুসারী হয়।
বৃটিশ শক্তি তখন প্রায় সারা ভারতেই প্রসারিত। শেষ ভরসা টিপু সুলতান পরাজিত হয়ে বীরের মত ইংরেজদের হাতে নিহত হয়েছেন।মারাঠা শক্তি তখনো জ্বলছে তুষের আগুনের মত।দাবানল হওয়ার শক্তি তার আর নেই।শুধু রণজিত সিংহ তখনও পাঞ্জাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ঠিক সেই সময়ে হোলকারের এক প্রাক্তন সেনাপতি সৈয়দ আহমেদ বারলেচী-র (১৭৮৬-১৮৩১) আবির্ভাব হয়।। তিনি ভারতের সকল মুসলিমদের ওয়াহাবি আন্দোলনের ডাক দেন। ওয়াহাবি শব্দের মানে জান? এর অর্থ হল ‘নবজাগরণ’। তাঁর আহ্বান ছিল ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা করা। এটা ত’ সত্যি কথা যে ওয়াহাবি আন্দোলনে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ছিল। তবে নিঃস্ব রিক্ত কৃষকদের মধ্যে এবং বেশ ভালভাবেই জনসাধারনের মধ্যে এই আন্দোলন বিপুল সাড়া জাগায়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলায় যে জমিদার শ্রেনির উদ্ভব হয় তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। আর বাংলার অধিকাংশ কৃষকই ছিল মুসলমান।সাম্প্রদায়িকতার ছাপ স্পষ্ট হলেও যেহেতু ইংরেজদের অন্যায় অত্যাচারের বিরূদ্ধে এই ওয়াহাবি আন্দোলন সংগঠিত হয়, তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।কেন জান? দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধা জাত-ধর্ম বিছার করে আসে না। কৃষক সমাজে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল। বৃটিশদের সৃষ্ট ‘মারী মন্বন্তরে’ যে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাতে স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিমদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ওয়াহাবির ডাক তাই তখন মুসলিমদের খুবই বেশি করে উদবুদ্ধ করেছিল।সাপ্রদায়িক আন্দোলন হওয়া সত্বেও হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ও বিবাদ এর মধ্য এক্কেবারেই ছিল না।বরং সবাই একজোটে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল সব জমিদার, জোতদার ও তাদের পরম পৃষ্ঠপোষক বৃটিশদের বিরূদ্ধে।
বাংলায় ওয়াহাবিদের নেতা ছিলেন মৌলবী শরিয়তুল্লাহ। সৈয়দ আহমেদ বাংলায় এসে ওয়াহাবির আদর্শ প্রচার করেন। মক্কায় বহুদিন থাকার পর দেশে ফিরে তিনি ধর্ম-সংস্কারের উদ্দেশ্যে কৃষক জনসাধারণের মধ্যে তাঁর আদর্শ প্রচার করেন।তাঁর সংস্কার ছিল পরশাসন ও শোষণ বিরোধী।পরশাসনের ছাতার নিচে থাকা সমস্ত সমর্থক, জোতদার, জমিদার, সামন্ত, গোমশ্তা, তহশিলদারেরা শ্বাভাবিকভাবেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
শরিয়তুল্লাহ এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী গোপন সংগঠন ‘ফরাজী’ সম্প্রদায় গঠন করেন।বাংলায় ফরাজীরাই হল ওয়াহাবি আন্দোলনে্র সংগঠক ও প্রচারক। ফরাজীরাই হল তার সদস্য ও যোদ্ধা। তাদের মূল শ্ত্রু হল ইংরেজ এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার সমর্থক শ্রেনী।কিন্তু দুঃখের কথা কি জান, এই আন্দোলন ভালোভাবে সংগঠিত হওার আগেই শরিয়তুল্লার মৃত্যু হয়। তাঁর যোগ্য পুত্র দুদু মিঞা বাংলায় ওয়াহাবি-ফরাজী বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। পুর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যোগ দেয়।
শ্বেতাঙ্গ নীলকরেরাও কম ছিল না অত্যাচারের দিক থেকে। বাংলার শিক্ষিত শ্রেনী নীল্কর সাহেব্দের অত্যাচারে প্রতিবাদ শুরু করারা আগেই দুদুমিঞা-নেতৃত্বে ওয়াহাবিরা নীলকুঠির ওপর অত্যাচার চালায়। সাহিত্য যে সমকালীন সমাজের ঐতিহাসিক দর্পন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, দীনবন্ধু মিত্রের কালজয়ী নাটক ‘নীলদর্পন’। হরিশচন্দ্র মুখার্জীর তত্বাবধানে প্রকাশিত হিন্দু পত্রিকায় নীলকরদের বিরূদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলা হয়। অনেক ব্রিটিশ সাহেবও কিন্তু ছিলেন যাঁরা এই দেশকে ভালবাসতেন। রেভারেন্ড জেমস লং এর কথা এই প্রসঙ্গে তমাদের না বললেই নয়।‘নীলদর্পণ’ ইংরেজি-তে অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর তা হরিশচন্দ্র তা তাঁর পত্রিকার প্রকাশ করেন জেমস লং এর সহায়তায়। ফলে লং সাহেবের এক মাসের জেল ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়। কালিপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় তক্ষুনি সেই টাকা আদালতে জমা দেন।
ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবী সুস্পষ্টভাবে ঘোষণার অনেক আগেই ওয়াহাবিরা কৃষকদের একভাবে সংগঠিত কর ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল।বাংলার বহু জায়গায় তারা মুক্তাঞ্চল গড়তে পেরেছিল। কিন্তু দুদুমিঞা ছাড়া এই আন্দোলনে দ্বিতীয় আর কোনো নেতা না থাকায় তার গতি ও তেজ বেশীদিন স্থায়ী হতে পারে নি।সুসংগঠিত বিরোধীদের প্রতিআক্রমনে তাদের প্রতিরোধ আন্দোলন হারিয়ে যায়। তবে সিপাহী বিদ্রোহের সম্য পর্যন্ত ওয়াহাবিদের আন্দোলন ও ইংরেজ শাসন নির্মূল করার সংগঠিত চেষ্টা বেশ সক্রিয় ছিল।
ওরে বাবা!!! অনেকটা লিখে ফেললাম যে!!! তুমি আবার যেন রাগ কোরো না বাপু!আর এটা তো গল্প, পড়া তো আর নয়! তাই না!
আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন আর্য চ্যাটার্জি
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
স্থির তড়িতের কথা
একখানা চুম্বককে লোহার তৈরী কোন কিছুর ( যেমন সেফটিপিন বা আলপিন) কাছে আনলে চুম্বক তাকে আকর্ষন করে, এটা তোমাদের সাধারন অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটাকি জান যে কাগজের টুকরোকেও কোন কিছু দিয়ে আকর্ষিত করা যায়! দেখেছ কখনও ? দেখ নি ? তাহলে যা যা বলি করে দেখ, কি হয়। শীতের দিন হলে ভাল হয়, কেননা এই পরীক্ষা করতে গেলে শুকনো আবহাওয়া প্রয়োজন। কেন শুকনো আবহাওয়ার দরকার তা পরে বলছি।
একদিন মাথায় ভাল করে শ্যাম্পু কর, যাতে চুলে তেল না থাকে। আর চিরুনীটাকেও সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে নাও।
এবার কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দাও। চুল, চিরুনী সব শুকিয়ে গেলে ভাল করে মাথা আঁচড়ে চিরুনীটাকে কাগজ-টুকরোগুলোর কাছে নিয়ে যাও। কি দেখবে বল দেখি ? আলপিন যেমন চুম্বকের দিকে আকর্ষিত হয়, কাগজ টুকরোগুলোও তেমনি চিরুনীর দিকে ছুটে যাবে বা আকর্ষিত হবে। অথচ দেখ চিরুনীটাও চুম্বক হয়নি বা কাগজের টুকরোগুলোও আলপিন হয়ে যায় নি। অবাক ত' হলেই, না কি ?
অবাক করা আরও এক আধটা উপমা দিই তাহলে। একটা ছোট বেলুন ভাল করে ফুলিয়ে মুখটা বেঁধে নাও যাতে হাওয়া বেরিয়ে না যায়। এবার ঐ ফোলান বেলুনটা কোন নাইলন বা টেরিলিন কাপড়ে ভাল করে ঘসে নাও।দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারের গায়ে বেলুনের ঘসা দিকটা ঠেকিয়ে হাত সরিয়ে নাও। দেখ অবাককান্ড, বেলুনটা পড়ে গেল না, ক্যালেন্ডারের গায়ে সেঁটেই রইল!
এমন উদাহরন অনেক দেওয়া যায়। ব্যাপারখানা বুঝতে পারলে কিছু! এসব আসলে তড়িতের খেলা, যাকে ঠিক করে বললে বলতে হয় 'স্থির তড়িৎ' এর খেলা। স্থির তড়িৎ তাহলে কি রকম ?
যখন কোন দু'টি বস্তুকে পরস্পর ঘসা হয় তখন স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়, যেমন এখানে চুলের মধ্যে চিরুণী, কিংবা বেলুনকে নাইলন কাপড়ে ঘসা হল।
এমন ঘর্ষনে উৎপন্ন তড়িৎকে বলে 'স্থির বিদ্যুৎ', আর এই ব্যাপারকে বলে 'তড়িতাহিত করণ'। এখানে যেমন কাগজ আর চিরুণী দু'টিই তড়িতাহিত হয়ে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করেছে।
আর দু'চারটে কথা বলে নি । তাহলেই সব বুঝতে পারবে।
তাপ সম্পর্কে বলার সময় বলেছিলাম দু' রকম পদার্থের কথা, যারা কিনা 'সুপরিবাহি' আর 'কুপরিবাহি'।
যারা তাপ পরিবহন করে তারা সুপরিবাহি আর যারা করে না তারা কুপরিবাহি। তেমনি যারা তড়িৎ পরিবহন করে তারা 'পরিবাহী'(conductor) আর যারা তা পারে না তারা 'অপরিবাহী' (non-conductor)। সব চেনা ধাতু এবং অন্যান্য কিছু পদার্থ তড়িতের পরিবাহী। মানুষের দেহ কিন্তু এই পরিবাহীদের দলে, জলীয় বাষ্পও তাই। বেশীরভাগ অধাতু অপরিবাহী। ঐযে চিরুণীর কথা বললাম, সেটা কিন্তু অপরিবাহী। কাগজ, বেলুনও তাই।
যদি ঐ চিরুণীটা যা দিয়ে তৈরী সেই প্ল্যাস্টিক, পলিথিন বা সেলুলয়েডের না হয়ে পিতল বা আলুমিনিয়মের তৈরী হত (চুল কাটার সেলুনে যেমন থাকে), তাহলে কি কাগজকে টানত ? একেবারেই না। কারণটা কি জান ? কারণ হল, ধাতু পরিবাহী। চুলের সাথে ধাতব চিরুণীর ঘসায় স্থির বিদ্যুৎ তৈরী হয় ঠিকই, কিন্তু সেই বিদ্যুৎ, পরিবাহী চিরুণী আর তোমার শরীরের মাধ্যমে (শরীরও পরিবাহী) সোজা মাটিতে চলে যাবে, অর্থাৎ নিস্তড়িৎ হয়ে পড়বে। চিরুণী যদি তড়িৎ হারিয়েই ফেলে তাহলে আর আকর্ষণ করবে কি করে!
প্লাস্টিকের চিরুণী অপরিবাহী বলে আমাদের দেহের মাধ্যমে তড়িৎ মাটিতে যায় না, যেখানকার তড়িৎ সেখানেই থাকে। তাই ত' সে চিরুণীর মধ্যে থেকে কাগজের টুকরোকে আকর্ষন করে। তাই বলে কি ঐ তড়িৎ চিরকালই থেকে যাবে নাকি! মোটেই না। একটু পরেই চিরুণী নিস্তড়িৎ হয়ে যাবে, কেননা তড়িৎ বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্পের মাধ্যমে বাতাসে চলে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলে 'তড়িৎ মোক্ষণ' হওয়া (leakage of electricity)। ঠিক এই কারণেই ক্যালেন্ডারের সাথে বেলুনও চিরকাল ঝুলে থাকবে না।
ধাতব চিরুণীর যদি একটা অপরিবাহী হাতল থাকে তাহলেই, মানুষের দেহের সাহায্যে তড়িৎ মোক্ষণ হবে না, তড়িৎ চিরুণীতেই থেকে যাবে। তবে একটু পরেই তা নিস্তড়িৎ হয়ে যাবে বাতাসে তড়িৎ মোক্ষনের জন্য। বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্প এই মোক্ষনের জন্য দায়ী।
অপরিবাহী পদার্থকে আমরা অন্তরকও বলি। বাড়িতে যে বিদ্যুতের তারের সাহায্যে আলো জ্বালানো হয় (সুইচ আর বাল্বের মধ্যে তারের সংযোগ থাকে), সেই তার রবার, সুতো বা প্লাস্টিক জাতিয় অন্তরক দিয়ে মোড়া থাকে, যাতে অসাবধানে বৈদ্যুতিক তারে হাতের ছোঁয়া না লাগে। তারে হাত লাগলে 'শক' লাগে এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। রাস্তার পাশে যে বিদ্যুৎবাহী তার থাকে সেটা কিন্তু অন্তরক দিয়ে মোড়া থাকে না। তাহলে যে স্তম্ভগুলোর সাহায্যে তারকে একস্থান থেকে আর এক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেগুলো ঐ তারের সংস্পর্শে বিদ্যুতবাহি হয়ে পড়ে। আর সেগুলোয় হঠাৎ ছোঁয়া লাগলে শক লেগে যেতে পারে। তাই লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে যে এক ধরনের অন্তরক পর্সিলিনের বাটির সাহায্য নেওয়া হয়, যাতে তারের সাথে আলোকস্তম্ভের সংযোগ হয়ে না যায়। অবশ্য এভাবে খোলা পরিবাহী দিয়ে তড়িৎ পাঠালে একটা ক্ষতি হতে থাকে, অন্তরকবিহীন তার থেকে তড়িৎমোক্ষণ আটকানো যায় না।
এ ব্যাপারে উঁচু শ্রেণীতে উঠে আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।
* * * * * *
একটা মজার খেলা দিয়ে লেখাটা শেষ করি।
টেবিলের ওপর দু'খানা বই ১০-১২ সেমি দুরে রাখ। সে দু'খানা যেন ২ সেমির মত উঁচু হয়। এর ওপর একখানা কাঁচের প্লেট রাখ। তবে তার আগে টেবিলের ওপর বই দু'খানার মাঝখানে কিছু কাগজের টুকরো, থার্মোকলের ছোট ছোট বল, সুতোর টুকরো---এই সব রাখতে হবে। এবার নাইলন বা টেরিলিন কাপড় দিয়ে কাঁচের ওপরটা ঘষতে থাক। (সিল্ক বা পশমের সোয়েটার দিয়েও ঘষতে পার, তাতেও হবে)।বন্ধুদের সামনে
এটা কর, দেখ না কেমন মজা হয়। ওরা দারুণ অবাক হয়ে যাবে। কি হবে বলতে পার ? টেবিলে ছড়ানো ঐ সব জিনিষগুলো ঝট পট উঠে কাঁচের গায়ে সেঁটে যাবে, একেবারে ম্যাজিকের মত।
কেন হল তার কারণটা ত আগেই বলেছি।
সন্তোষ কুমার রায়
অ্যাটলাস মোড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সন্তোষ কুমার রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মেঘ-বৃষ্টির দেশে... (পর্ব-১)
ছোট্ট ছোট্ট শাদা মেঘের নৌকা আমার পাশ দিয়ে, হাতের কাছ ঘেঁষে নীল আকাশে ডিঙি বেয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি চুপটি করে প্লেনের জানলার কাছে বসে ভাবছি তোমার কথা সিরাজুল। ভাবছি তুমি আর আমি এমনি এক বর্ষার দিনে সুন্দরবনের হরিণভাঙা নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। তাও কতদিন আগে তাই না? হ্যাঁ তখন তোমার এখনকার মতো গোঁফের রেখা ওঠেনি সিরাজুল। ওমা, ওকি লজ্জা পেলে নাকি? ধুর বোকা, আমি তো গল্প করছি তোমার সাথে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলবো না তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার সদ্য ওঠা গোঁফে কেমন করে তা দাও। আর তোমার বোন আনন্দি লুকিয়ে সেটা দেখে ফেললেই তার ওপর তর্জন গর্জন করো। ওকি...চললে কোথায়? আচ্ছা ঠিক আছে এই কান ধরছি সিরাজুল আর বলবো না। সত্যি আর বলবো না দক্ষিণ রায়ের মিশ কালো গোঁফের মতো তোমার গোঁফটাও বেশ হৃষ্ট পুষ্ট হবে আর আমার সেই ছোট্ট সিরাজুল, যে আমাকে শোনাতো কুমীরের গল্প তার গোঁফ দেখতে আমার মনটা উড়তে চাইবে আকাশে। এই বর্ষার সকালে ছুট্টে চলে যেতে চাইবে সুন্দর বনে। ওই দেখ আবার রাগ করে! বুঝতে পারছো না এটা গল্প...আরে বাবা আমি সত্যি সত্যি তো উড়ছি আকাশে।
এর আগে আমি কোনোদিন প্লেনে উঠিনি জানো। অনেক দিন আগে থেকেই মনটা খুশিতে নেচে উঠছিলো, তারপর আবার কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছিলো। অতো ওপর দিয়ে যেতে যেতে তোমার সুন্দর বনের সেই দুষ্টু ঈগলটার সাথে যদি দেখা হয়ে যায়। পাইলট মানে যিনি প্লেন চালান, তাঁর গুরু গম্ভীর কন্ঠে বলে দিলেন বাইরের আবহাওয়া খুব খারাপ, বৃষ্টি পড়ছে, তাই কেউ দুষ্টুমি করবে না, সবাই প্লেনের সিট বেল্ট বেঁধে চুপটি করে বসে থাকবে। তুমি জানো সিরাজুল একটু পরেই প্লেন দৌড়োতে শুরু করলো সাঁ সাঁ...আমি ভাবলাম ওমা, এটা আবার দৌড়ায় কেনো? উড়বে তো! পাশের বন্ধু বিরক্ত হলো। আর ঠিক তোমার মতো বকে দিলো সিরাজুল। আমি দেখলাম এক ঝাঁকুনিতে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্লেন...। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, অনেক নীচে... আমার পায়ের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে আমার প্রিয় শহর, আমার মন কেমনের সব কিছু। আচ্ছা সিরাজুল এই যে এতোক্ষণ আমি বক বক করে তোমার মাথা ধরিয়ে দিলাম তবুও কি তুমি আমায় বলবে না এই বছরে খলসি ফুলের মধু রেখেছো কিনা আমার জন্যে? বলবে না তো আনন্দি এখোনো তার সেই ছোট্ট ডিঙাতে মাছ ধরতে যায় কিনা? রাতের বেলায় কুপি জ্বালিয়ে তোমরা দুই ভাই বোন পড়তে বসো কিনা দাওয়ায়? এখোনো কি সেই দুষ্টি বাঘটা এসে গ্রামের বাইরে হালুম হালুম করে ভয় দেখায়? ও আচ্ছা রাগ হয়েছে? অনেকদিন চিঠি লিখি না তাই? কী করবো বলো? আমিও তো অনেকদিন কোথাও বেরোয়নি। সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি দিয়ে আমাকে কে যেনো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলো অনেক দিন। আমার পোষ্ট বক্সে অনেকদিন কেউ বেড়ানোর চিঠি রেখে যাইনি যে সিরাজুল। তাই একদিন সকালে আমার মোবাইলের ইনবক্সে যখন মেঘালয় থেকে উড়ে এলো নেমনতন্নের চিঠি তখন আনন্দে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বাইরের কদম ফুলের গাছা হাওয়ায় পাতা নেড়ে বলেছিলো এবার তুমি বেরিয়ে পড়ো টুকনু। খেয়াঘাটের বুড়ো মাঝি বলেছিলো থেমে থেকোনা বাবু...নদী কি থেমে থাকে? সে কেমন আপন মনে একা একা বয়ে চলে সবাইকে নিয়ে। আমিও আপন মনে বয়ে চলছি সিরাজুল। হ্যাঁ এই তো দেখো না, আমাদের প্লেন নামবে এবার গৌহাটি বিমান বন্দরে। এই তো আমি ওপর থেকে দেখতে দেখতে পাচ্ছি বহ্মপুত্র নদীকে। মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে আমি এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে। ঝির-ঝিরে বৃষ্টি আমার জানলা ধুয়ে দিচ্ছে। আর আমার কানের কাছে শিরশিরে হাওয়া বলে যাচ্ছে, মেঘ বৃষ্টির দেশে তোমাকে স্বাগত টুকনু।
তুমি কি বিরক্ত হয়ে পড়ছো সিরাজুল? আমি জানি তুমি যত রাগ করেই থাকো না কেনো আমার নীল খামের চিঠিটা তুমি এতোক্ষণে রফিকুল, আনন্দি এদের সবাইকে পড়ে শুনিয়ে দিয়েছো। গৌহাটি থেকে নেমে আমরা যাবো শিলং। বাইরে অপেক্ষা করে আছে আনন্দ। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। সেই আমাদের নিয়ে যাবে শিলং। গাড়িতে চেপে বুঝতে পারলাম ক্ষিদে পেয়েছে। একটু পরেই শহর ছাড়তেই পথের ধারে পাহাড় আর জঙ্গল আমার অনেক অনেক চেনা কিছু ছবি মনে করিয়ে দিলো।
আমার মনে পড়ে গেলো উত্তরবঙ্গের চিলাপাতার কথা। জঙ্গলে ঘেরা গ্রামের কথা। আন্দু রাভা, জয়ন্তী মেচ, সুনীল নার্জিনারিন, হেমবং টোটো, ফুলমণি মেচ সবার কথা। মনে মনে ঠিক করলাম আর আমি সোনার কাঠি-রুপোর কাঠির ছোঁওয়ায় ঘুমিয়ে থাকবো না সিরাজুল... বেরিয়ে পড়বো আমার পিঠের সেই বড় বোঁচকাটা নিয়ে। আবার সবার সাথে দেখা করবো। আবার তিস্তার চরে সবার সাথে কাশ ফুলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে বেড়াবো। আনন্দ গাড়ি থামালো। আনারস বিক্রি হচ্ছে। খুব মিষ্টি আনারস খেলাম আমরা। এখানে আনারস খুব শস্তা। বর্ষার যেসব ফল হয় আনারস তার মধ্যে প্রধান।
রাস্তার চারপাশে জঙ্গল, পাহাড় দেখতে দেখতে আর আনন্দের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে চলে এসেছি শিলং বুঝতেই পারিনি। টিপটিপ বৃষ্টি আর শীত শীত ঠান্ডা হাওয়া আমাদের নিয়ে চললো পুলিশ বাজারের দিকে। ওকি আবার পুলিশের কথা শুনে ভয় পাচ্ছো। নানা সিরাজুল পুলিশ বাজার নাম শুনেই ভেবো না সব কিছু পুলিশদের। আসলে এটা শিলংয়ের সবচেয়ে বড় বাজার। অনেক কিছু বিক্রি হয় এখানে। আর এখানেই হোটেল পাইন বোরোতে আমরা কিছুদিন থাকবো। আনন্দকে ফিরতে হবে গৌহাটি...অনেক খানি রাস্তা। চলে গেলো সে। কথা থাকলো আবার দেখা হবে, গৌহাটিতে, মাত্র কয়েকদিন পরেই।
কে যেনো একটা ঠান্ডা হাত পিঠে রাখলো। পেছন ফিরে দেখি, এখানকার খাশিয়াদের মতো সুন্দর দেখতে বাপী। হ্যাঁ এবার তার ট্যাক্সিতেই আমরা শিলং দেখবো। বাপী আমাদের নিয়ে গেলো ইন্টারন্যাশানাল গলফ মাঠে। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার বাড়িতে। এখানে বেশ কিছুদিন কবি ছিলেন। লিখতে শুরু করেছিলেন শেষের কবিতা। বড় হয়ে সে না হয় তুমি পোড়ো। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলো সিরাজুল। তারপর থেকে একটুও ঘুম এলো না আর। কারণ কাল সকালে উঠেই যে আমরা যাবো চেরাপুঞ্জি। সেই কবেকার ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি...। বাইরে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে আমার ঘরের কাঁচের জানলায়। সেই তুমুল বৃষ্টি আর বিদ্যুতের মধ্যে হঠাত ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভুল শুনছি না তো? না, ওই তো আবার। ঠক ঠক...। এতো রাতে দরজায় আওয়াজ করছে কে? শরীরের মধ্যে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। হোটেলে ভূত-টুত নেই তো? বালিশের পাশ থেকে হাতড়ে টর্চটাকে খুঁজে বের করলাম। ধুর ছাই, কাজের সময় বিগরোবে। জ্বলছে না। আবার আওয়াজ, ঠক...ঠক...ঠক...। শরীরের মধ্যে দিয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। আস্তে আস্তে উঠে দরজার দিকে যাবো আর ঠিক সেই সময় কড়কড় করে বাজ পড়লো। দমকা হাওয়ায় খুলে গেলো দরজা। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো আমার মুখে। সেই আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম তালগাছের মতো লম্বা একটা কি যেনো। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। (চলবে)
লেখা ও ছবি
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া, হুগলী
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
বর্ষার আড্ডা
আবার মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে । এখন চলবে কিছুক্ষণ । তেলেভাজার অর্ডার দিলো ভুডুলমামা । আই-ফোনটা টেবিলে রেখে, সোফায় গা এলিয়ে ভুডুলমামা টিভিটা খুলে দিলো । মা বলে, 'এল সি ডি স্ক্রিনে'র আলো - 'এল সি ডি স্ক্রিনে'র বাংলা কি 'তরল স্ফটিক প্রদর্শন পর্দা' ? যাই হোক - তার আলো চোখের রেটিনায় ধরা পড়লেই টিকলির আর আমার মাথাটা নাকি সেদিকে ঘুরে যায় । তাই হল । টিভিতে প্রোগ্রাম, 'রিফ্লেকসন' । পর্দায় চলছে দুই নেতার মধ্যে ... একে কি তর্ক-বিতর্ক বলা যায় ? বেচারা 'হোস্ট্' কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না । না ! আর দেখা যায় না ! ভুডুলমামা রিমোটের বোতাম টিপল ।
ভুডুলমামা একটু অদ্ভুত লাগবে শুনতে ।
তবুও -
বলতো দেখি, ভেবে চিন্তে ।
হায়েনা ।
হ্যাংলা, জিব তার
ঝোলে মুখ থেকে বেড়িয়ে ।
আয়নায় দেখে তা
লজ্জায় মুখটাকে
কেন ফেলে না সে লুকিয়ে ?
গিরগিটি ।
হরদম রঙ সে তার
বাদলায় ।
মুশকিল হয় কি
চিনতে নিজেকে,
যখন প্রতিচ্ছবি
ধরা পড়ে আয়নায় ?
বাদুর।
রক্ত চোষে, কদাকার ।
অন্য কিছুই
মুখে তার রোচে না ।
আয়নায় দেখে নিজেকে,
আতঙ্কে মূর্ছা
কেন সে যায় না ?
বিছে ।
বিষাক্ত দাঁড়া
সর্বদা উঁচিয়ে ।
হঠাৎ দেখে যদি নিজেকে
আয়নার পিছনে
বুকটা কি কাঁপে তার,
সটকান -
দাঁড়াটা নামিয়ে ?
টিকলি জঙ্গলেতে আয়না !
কোথায় পাবে হায়েনা ?
তাছাড়া - ওরা বন্য ।
তবে, [একটু ভেবে] সহজ নয় উত্তর ।
আসল প্রশ্নটা যে অন্য ।
এই মুহূর্তে ভুডুলমামার মোটা গোঁফে তলায় একটা হাসি কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে । টিকলির দিকে তাকায়, উত্তর দেয় না । দরজায় ঘণ্টা । নিশ্চয় গরমা-গরম ডেলিভারি নিয়ে হাজির তেলেভাজার দোকানের ঘেঁটু । ভুডুলমামা পকেট থেকে 'ওয়ালেট'টা বার কারে আমার দিকে ছুড়ে দেয় ।
শিব শঙ্কর বসু,
এপেক্স, নর্থ ক্যারোলাইনা
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শিব শঙ্কর বসু
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
বুলু পুকুরে যাও
একবার সেজদার মাথায় ম্যাজিক ভর করল। আমার তখন কতই বা বয়স? ক্লাস টু বা থ্রি-তে পড়ি। আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি-বাইশ আগেকার কথা। যাই হোক, সেবার গ্রামের বাড়ি গিয়েই সেজদার পাল্লায় পড়লাম। আমায় পাকড়াও করে নিয়ে এল নিজের ঘরে – “এই দ্যাখ।” একটা দু’টাকার নোট তুলে দেখালো সেজদা – “এটাকে আমি ভ্যানিশ করে দেব।” উৎসুক চোখে দেখলাম সেজদা বিছানার ওপর একটা পরিস্কার সাদা কাগজ মেলে তার ওপর নোটটা রাখল। তারপর পাশের টেবিল থেকে একটা কাচের গ্লাস তুলে নিল – “এইবার...” সেজদা একটা ওস্তাদি হাসি হেসে বলল – “বল গিলি গিলি ছু।” আমিও দারুণ কিছু একটা ঘটবে এমন আশায় একদমে বললাম – “গিলি গিলি ছু।” আমার কথা শেষ হতে না হতেই সেজদা দু’টাকার সেই নোটের ওপর থপ করে গ্লাসটা উপুড় করে রাখল। আর কী আশ্চর্য! কাচের গ্লাসের নিচে নোটটা দেখাই যাচ্ছে না। একেবারে উধাও। বাইরে থেকে দেখছি গ্লাসের নিচে শুধু সাদা কাগজ। সেজদা এবার তাড়া দিল – “তাড়াতাড়ি বল গিলি গিলি ছু। নাহলে টাকাটা আর ফেরত পাওয়া যাবে না।” আমি আবার এক নিশ্বাসে বললাম – “গিলি গিলি ছু।” সেজদা গ্লাসটা উঠিয়ে নিল এবং বহাল তবিয়তে সেজদার সেই নোংরা দু’টাকার নোট সাদা কাগজের ওপর হাসছে।
আমি হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা দেখার চেষ্টা করতেই সেজদা গ্লাসটা উঠিয়ে টেবিলে রেখে দিল – “ম্যাজিকের সরঞ্জামে অন্য কারোর হাত দেওয়ার নিয়ম নেই। গুরুর বারণ।” আমার তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। সেজদা নিজেই একটা পি. সি. সরকার হয়ে উঠেছে; তারও আবার গুরু আছে! সেজদা তার দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে উত্তর দিল – “সব ম্যাজিশিয়ানেরই গুরু আছে। আমার গুরুরও গুরু আছেন। তিনি এই মূহুর্তে গঙ্গার তলায়। গত দু’মাস ধরে আছেন।” সেজদার গুরুর গুরু জলের তলায় দু’মাস ধরে কী করছেন? পরে জনিদার মুখে জানা গেল বড় বড় ম্যাজিশিয়ানরা ঐভাবে নাকি দম ধরে রাখা প্র্যাকটিস করে। এই তো গতমাসেই আমাদের গ্রামে এক ছোটোখাটো জাদুকর মাটির তলায় নিজের মাথা প্রায় একঘন্টা ঢুকিয়ে রেখছিল। শুনে আমি হাঁ। একঘন্টা! জনিদা বিজ্ঞের গলায় বলল – “টিনের চালের ওপর ঐ কুমড়োটা দেখছিস?” ৫ নম্বর ফুটবল সাইজ কুমড়োর দিকে আঙুল তাক করে জনিদা বলল – “সেই জাদুকরের কাছে অমন বড় একটা মাথার খুলি ছিল।” ব্যাপারটা এবার বোধগম্য হল। যে জাদুকরের কাছে ফুটবল সাইজের মাথার খুলি আছে, সে মাটির নিচে একঘন্টা কেন, দশ ঘন্টা মাথা গুঁজে রাখলেও মরবে না। কিন্তু সে সব বাইরের ম্যাজিশিয়ানদের ব্যাপার। আমাদের বাড়িতেই যে সেজদার মত ম্যাজিশিয়ান আছে, সেটা কী কম আশ্চর্যের!
জনিদা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল – “ওসব ম্যাজিক আমিও দেখাতে পারি।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “বিশ্বাস করছিস না মনে হচ্ছে। আয় তা হলে।” জনিদা আমায় ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির করল বড়কাকুর ঘরে। তারপর বড়কাকুর আলমারি ঘেঁটে একটা রুমাল বের করে আমায় বলল – “খাওয়ার পর এই রুমাল দিয়ে তোকে এমন একটা ম্যাজিক দেখাবো যে হাঁ হয়ে যাবি।”
জনিদা কী ম্যাজিক দেখাতে পারে তাই ভাবতে ভাবতেই কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে খাওয়া শেষ করলাম। খুব বড় ম্যাজিশিয়ান হলে হয়ত উড়ুক্কু কার্পেটের মত সেই রুমালের ওপর চড়ে এদিক ওদিক উড়ে বেড়ানোর ম্যাজিক দেখাতেন। কিন্তু জনিদা তো আর অতবড় ম্যাজিশিয়ান নয়, এই সবে তার ক্লাস ফাইভ। হয়ত জনিদা রুমাল ঝেড়ে পায়রা উড়িয়ে দেখাবে। গাবলুর কমিক্সে এমন একটা ম্যাজিক ছিল। যাই হোক, খাওয়া শেষ করে ছোটমেজদার ঘরে আমি আর জনিদা হাজির হলাম। ছোটমেজদা এই সময় স্কুলে থাকে, তাই দুপুরে তার ঘরটা আমাদের দখলেই থাকে।
জনিদা বিছানার ওপর সোজা হয়ে বসে একটা দেশলাই কাঠি ধরল আমার সামনে – “হাতে নিয়ে দেখে নে। কোথাও কোনও কিছু ভাঙা নেই তো?” সতর্কভাবে পরীক্ষা করে কাঠিটা ফেরত দিলাম। নাঃ! গোটাগুটি একটা দেশলাই কাঠি। এবার সেই কাঠিটা রুমালের মাঝে রেখে জনিদা রুমালটা ভাঁজ করে আমার হাতে দিল। রুমালের মধ্যে কাঠিটা শক্ত হয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বিড়বিড় করে পড়ে নিয়ে জনিদা বলল – “এবার কাঠিটা ভেঙে ফেল।” আমি রুমালে জড়ানো সেই দেশলাই কাঠিটাকে ২-৩ জায়গায় ভেঙে দিলাম। আমার হাত থেকে রুমালটা ফেরত নিয়ে জনিদা আবার চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলে রুমালটা খুলে ফেলল। এবং সত্যিই ম্যাজিক। রুমালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অক্ষত একটা দেশলাই কাঠি। তাহলে আমি যে রুমালের মধ্যে ভেঙে দিলাম কাঠিটা? জনিদা বিজ্ঞের হাসি হেসে বলল – “তোর কী মনে হয় এই যে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়লুম, সেটা কিছু নয়? এগুলো কি ভাঁওতা?”
আমি গদগদ স্বরে বায়না ধরলাম – “আর একটা ম্যাজিক দেখাও।” জনিদা একটা হাই তুলে বলল – “একসাথে বেশি ম্যাজিক দেখালে মুশকিল। রাতে ঘুম হবে না ভালো করে। তোকে বরং কাল একটা ম্যাজিক দেখাবো। পাকা কলা না ছাড়িয়ে খোসার মধ্যেই দেখবি টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু তার জন্যে তোকে আমার একটা কাজ করতে হবে।”
কী কাজ?
আগামী পরশু থেকে আমাদের গ্রামের ক্লাবের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমি গ্রামের বাড়ি এসেছি সেই অনুষ্ঠান দেখব বলেই। আগের বার আসতে পারিনি। শুনেছিলাম দারুণ সব ব্যাপার হয়েছিল। তাই এবার বায়না করে বাপি-মাকে ছেড়ে একাই নদার সাথে এসেছি। বড়দিনের ছুটিতে স্কুলও বন্ধ। তাই নিশ্চিন্তে ৩ দিনের অনুষ্ঠান দেখে আবার বাগনানে ফেরা যাবে।
যাই হোক, জনিদা আমাকে আমার কাজ বোঝাতে আরম্ভ করল। অনুষ্ঠানের প্রথম দিন স্পোর্টস হয়। সারাদিন খেলাধুলোর পর বিকালে শুরু হয় গো এ্যজ ইউ লাইক – যেমন খুশি সাজার প্রতিযোগিতা। জনিদা এর আগের বছর কচ্ছপ সেজে ফার্স্ট হয়েছিল। জনিদা কচ্ছপ সাজল কী ভাবে? প্রথমে ভাঁড়ার ঘরে পড়ে থাকা পুরানো এক টিন আলকাতরা আর চুনকামের জন্যে ভিজিয়ে রাখা চুন জোগাড় করেছিল। তারপর মেজোকাকীমার মুরগির বাচ্চা চাপা দেওয়ার জন্যে একটা বড় ঝোড়া (বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বোনা বড় ঝুড়িকে আমরা ঝোড়া বলি) সেই আলকাতরা আর চুন দিয়ে কচ্ছপের খোলের মত রঙ করেছিল। তারপর জনিদা একটা থলের মধ্যে ঢুকে শুধু মুখটা বের করে ঝোড়ার নিচে গুটিশুটি মেরে ঢুকে পড়েছিল। ছোড়দি একটু কায়দা করে গুণ সূচ আর থলে সেলাই করা দড়ি দিয়ে ঝোড়াটাকে থলের সাথে আটকে দিয়েছিল। থলের চারটে কোণ কেটে দিতেই বেরিয়ে এল কচ্ছপের ছোট ছোট হাত-পা। তারপর আর কী, জনিদা গো এ্যাজ ইউ লাইকে কচ্ছপের মত হামাগুড়ি দিয়ে ফার্স্ট হয়ে গেল।
তা এবারও জনিদার মাথায় দারুণ একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে। সেটা ঠিকঠাক করতে পারলে ফার্স্ট প্রাইজ ঠেকায় কে। কিন্তু সেটার জন্যে সাথে আর একজন দরকার। আর জনিদা আমাকেই সেই সুযোগটা দিতে চায়। আমি কখনও স্কুলের স্পোর্টসে কোনও প্রাইজ পাইনি। এবার জনিদার পাল্লায় পড়ে হয়ত একেবারে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব। আমি তো একপায়ে খাড়া। তা কী সাজতে হবে?
জনিদা সাজবে গুন্ডা। আর আমি নিরীহ পথচারী। জনিদা একটা ছুরি বের করে আমার থেকে টাকা চাইবে। আমি টাকা দিতে চাইব না। আর জনিদা আমার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেবে। আমার পেট থেকে গলগল করে রক্ত বের হবে। শুনেই তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। রক্ত বের হবে মানে? “আহ! সত্যি করেই রক্ত বের হবে নাকি? জামার নিচে তোর পেটের সাথে একটা বেলুনে আলতা গোলা জল থাকবে। আমি ছুরি দিয়ে বেলুনটা ফুটো করে দিলেই ফিনকি দিয়ে লাল জল বের হবে। দেখে মনে হবে সত্যি রক্ত। তুই শুধু পেটটা চেপে ধরে একটু কাতরাবি।”
বাহ! জনিদার মাথা বটে একখানা। খাসা প্ল্যান। শুনে মনে হচ্ছে আমরা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েই যাব। কিন্তু এই রক্তারক্তি আমরা বেশিক্ষণ চালাব কীভাবে? আমাদের স্কুলের স্পোর্টসে মাঠের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় গো এ্যাজ ইউ লাইক হতে দেখেছি। সেখানে যে যা খুশি সেজে মোটামুটি আধ ঘন্টা মত এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। বিচারকরা ঘুরে ঘুরে দেখে মার্কস দেন। কিন্তু জনিদার এই প্ল্যান তো খুব বেশি হলে ১-২ মিনিটে শেষ। তাহলে?
জানা গেল আমাদের ক্লাবের গো এ্যাজ ইউ লাইকটা একটু অন্যরকম। তুমি নিজের সাজ দেখানোর জন্যে এক মিনিট সময় পাবে। একটা ছোট্ট জায়গার মধ্যে এসে প্রতিযোগীরা নিজের নিজের সাজ দেখাবে একের পর এক। “যেমন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় হয় আর কী।” – আমার বোঝার সুবিধার জন্যে জনিদা বলল।
যাই হোক, আমাদের সাজের জন্যে প্রস্তুতি দরকার। একটা ছুরি, একটা বেলুন, একটা আলতার শিশি আর লিউকোপ্লাস্ট। লিউকোপ্লাস্ট কেন? বেলুনটা পেটের সাথে ভালো করে আটকে রাখতে হবে। লিউকোপ্লাস্ট পাওয়া যাবে মেজদার ফার্স্ট এইড বক্স থেকে। সেটা সরানোর দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। ২টো বেলুন কেনা হল মানিক কাকুর দোকান থেকে (যদি একটা কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যায়)। বেলুনের ২০ পয়সা গেল জনিদার পকেট থেকে। তার বদলে মেজোকাকীমার আলমারি থেকে আলতার শিশি হাতাতে হল আমায়। আর বড়কাকুর দেরাজ থেকে ফল কাটা ছুরি সরালো জনিদা। স্পোর্টসের একদিন আগেই সব সরঞ্জাম মজুদ, অথচ কেউ কিছু টেরও পেল না।
আসলে জনিদার কড়া নিষেধ আমরা কী করছি তা কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়। কারণ সেজদা নিজেও গো এ্যাজ ইউ লাইকে কিছু একটা করবে। কী করবে আমাদের বলছে না। অতএব আমরাও কাউকে বলব না। বলা তো যায় না, আমাদের প্ল্যান শুনে আর যদি কেউ নকল করে দেয়? আমরা ছোট মেজদার বিছানায় সারা দুপুর রিহার্সাল দিলাম। জনিদা পাকা পরিচালকের মত বোঝাতে লাগল – “মুখটা আর একটু বাঁকা। পেটে ছুরি ঢুকলে অত কম যন্ত্রণা হয় নাকি?” আমার পেটে ছুরি ঢোকার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। তাও প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলাম।
পরদিন দুপুরের খাওয়ার একটু পরেই আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। নীল দেওয়ার বালতিতে আলতা গুলে তার মধ্যে ফোলানো বেলুন ডুবিয়ে লাল জল ভরা হল। তারপর কষে বেলুনের মুখ বেঁধে আমার পেটে লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে সেটা সেঁটে দেওয়া হল। বলাই বাহুল্য, পুরো কাজটাই করল জনিদা। তারপর বেলুনের ওপর জামা পরতেই দেখা গেল আমার পেটে একটা সন্দেহজনক ভুঁড়ি। জনিদা একটু ভেবে নির্দেশ দিল – “কুঁজো হয়ে হাঁট। ভুঁড়ি লুকিয়ে পড়বে। আর কুঁজো হয়ে হাঁটলে তোকে বেশ গরীব-গরীবও লাগবে।” এমনিতে জনিদার একটা পুরানো রঙ ওঠা স্কুল ইউনিফর্মের জামা-প্যান্ট পরেছি। এবার কুঁজো হয়ে আয়নার সামনে হেঁটে দেখতে লাগলাম যথেষ্ট গরীব লাগছে কিনা।
জনিদার বেশভূষা অবশ্য বেশ সুন্দর। ঈদে রাঙাকাকুর দেওয়া একটা নতুন জামার সাথে জিনসের প্যান্ট পরেছে। দেখে মোটেও গুন্ডা মনে হচ্ছে না। কিন্তু জনিদার মাথায় অদ্ভূত সব প্ল্যান খেলা করে। আমাদের গ্রামের রাস্তায় পিচ হচ্ছে তখন। ঠান্ডা হয়ে গেলে আলকাতরার বড় বড় ড্রামের গায়ে রাবারের মত পিচ আটকে থাকে। জনিদা কোত্থেকে সেই পিচ একটু জোগাড় করে এনেছে। হাতে গুলির মত করে পাকিয়ে বাম গালে থেবড়ে আটকে দিল। বাম গালে পিচের তৈরি আঁচিল নিয়ে জনিদাকে এক নিমেষে পাক্কা বদমাশ লাগছে এবার। পকেটে ছুরিটা ঢুকিয়ে আমায় বলল – “চল।”
গো এ্যাজ লাইক হবে হাই স্কুলের মাঠে। আমাদের বাড়ি থেকে একটুখানি। জনিদা আগে থেকেই নাম লিখিয়ে এসেছিল। জানা গেল আমরা ৬ নম্বর প্রতিযোগী। বুকে ধুকপুক নিয়ে দেখছি আর কে কী সেজেছে। মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটা জায়গা বাঁশ আর দড়ি দিয়ে ঘেরে দেওয়া হয়েছে। ওর মধ্যে প্রতিযোগীরা নিজেদের সাজ দেখাতে ঢুকবে। তার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে দর্শক। প্রথমে এল একজন রাখাল। তার ২টো ছাগলের একটা চারদিকে এত ভিড় দেখে ‘ম্যা গো’ বলে ছুট দিল। বেচারা রাখাল নিজের সাজ দেখাবে কী, ছাগলের সাথে সেও ছুটলো। পরের জন বড় একটা দাড়ি মুখে এল, পিঠে লেখা রবীন্দ্রনাথ। তার পরের জন সেজেছে পাগল ভিখারি। একটা ছেঁড়াখোড়া লুঙ্গি পরে কালি মাখা গায়ে দর্শকদের দিকে তেড়ে এল।
একসময় আমাদের নাম ঘোষণা করা হল। প্রতিযোগিতার ঘেরা জায়গাটাতে ঢুকতেই জনিদা আমার কলার ধরে চেঁচাতে আরম্ভ করল আর আমি একটা ঢোক গিলে বেচারার মত মুখ করে বললাম – “আমার কাছে টাকা নেই।” আমায় ২-১ বার ঝাঁকুনি দিয়ে জনিদা পকেট থেকে ছুরিটা বের করে আমার পেটের বেলুনে খোঁচা দিল। কিছুই হল না। ছুরিটার ধার পরীক্ষা করা উচিত ছিল। নেহাতই ফল কাটা নিরীহ ছুরি সেটা। জনিদা আবার চেষ্টা করল। পেটে ছুরি মারার পরও কিছু হচ্ছে না দেখে দর্শকরা কেউ কেউ চেঁচাতে আরম্ভ করেছে। মরিয়া জনিদা কলার ছেড়ে দিয়ে আমার পেটে এক মোক্ষম ঘুষি দিল। আচমকা এমন ঘুষিতে আমি ২-৩ ফুট দূরে গিয়ে মাটিতে পড়লাম। আর ব্লগাস শব্দে পেটের বেলুন ফেটে একেবারে রক্তারক্তি ব্যাপার। আমি উঠে জনিদাকে পালটা একটা ঘুষি লাগাব কিনা ভাবছি। এর মধ্যে দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়ল। আমি নিশ্চিত হিন্দি সিনেমাতেও কেউ কারও পেটে ঘুষি মেরে রক্ত বের করতে পারেনি। যেহেতু সবাই প্রশংসা করছে আমিও জনিদার ঘুষি হজম করে উঠে পড়লাম। আমাদের কাজ শেষ।
এবার দেখতে হবে আর কে কী করছে। “আমরাই ফার্স্ট হব কী বলো?” জনিদা তার গাল থেকে আঁচিল ছাড়াতে ছাড়াতে বলল – “চিন্তা করিস না। যেভাবে লোকে চেঁচিয়েছে, তাতে জাজেরা আমাদেরই ফার্স্ট করে দেবে।” আরও কয়েকজন প্রতিযোগীর পর এল সেজদা। কিন্তু নেহাতই ভদ্রলোকের মত ফিটফাট সেজে। সেজদা কী সেজেছে?
ম্যাজিশিয়ান। জামা খুলে একটা শতরঞ্জি পেতে তার ওপর সেজদা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কোত্থেকে সে একটা এ্যাসিসটেন্ট জোগাড় করেছে। জনিদার কাছে শুনলাম, ছেলেটার নাম মন্টু। সাইকেল দোকানে কাজ করে। একটা খবরের কাগজ পাকিয়ে মন্টু সেটাতে দেশলাই জ্বেলে আগুন ধরালো। তারপর সেই জ্বলন্ত খবরের কাগজটা মশালের মত সেজদার পিঠে আলতো করে ছুঁইয়ে দিল। সেজদার পিঠটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। অথচ সেজদা নির্বিকার শুয়ে আছে। হাততালিতে ফেটে পড়ল গোটা মাঠ। আমি তখন হা-হুতাশ করছি। ইস! কেন যে সেজদার এ্যাসিসটেন্ট না হয়ে জনিদার পাল্লায় পড়লাম। ফার্স্ট প্রাইজ তো এখন সেজদারই বাঁধা।
কুড়ি-তিরিশ সেকেন্ড পর সেজদা হাত নাড়তেই তার এ্যাসিসটেন্ট এসে একটা বোতল থেকে জল ঢালতে লাগল সেজদার পিঠে। উদ্দেশ্য আগুন নেভানো। কিন্তু পরে জানা গিয়েছিল সেজদা পিঠে যে রাসায়নিক পদার্থটা ব্যবহার করে ম্যাজিক দেখাচ্ছিল, তাতে নাকি জল ব্যবহার করা উচিত নয়। কম্বল জাতীয় ভারী কোনও কাপড় চাপা দিয়ে আগুন নেভানো উচিত ছিল। যাই হোক, জল ঢালতেই আগুন নেভার বদলে নতুন উদ্যমে দপ করে জ্বলে উঠল। আর সেজদাও ম্যাজিক ভুলে ‘বাবা-রে মা-রে’ করে তিড়িং-বিড়িং নাচতে আরম্ভ করল। প্রায় সন্ধ্যের মুখে আলো-আঁধারিতে সেজদার আগুন পিঠে সেই নাচ অদ্ভূত সুন্দর লাগছিল। আগুন নেভানোর কথা ভুলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সবাই দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর “জল আন”, “মাটিতে গড়াগড়ি দে”, “শতরঞ্জিটা চেপে ধর” ইত্যাদি হাজারো উপদেশ ভেসে আসতে লাগল। এদিকে আগুনের জ্বালায় সেজদা মাঠের মধ্যে ছুটতে আরম্ভ করেছে। নিজের গা বাঁচাতে জনতা ছত্রখান।
এমন সময় মাইকে ভেসে এল ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি মালেক কাকুর গলা। সেজদাকে উদ্দেশ্য করে মালেক কাকু তারস্বরে চেঁচাচ্ছে – “বুলু পুকুরে যাও। বুলু পুকুরে যাও।” এবং এই উপদেশটা কাজ লাগল। স্কুল মাঠের লাগোয়া পুকুরে আগুন পিঠে সেজদা ঝাঁপ দিল। পুকুরে পড়ে আগুন নেভার সাথে সাথে আরও কয়েকজন ঝপ-ঝপাং করে ঝাঁপ দিল সেজদাকে টেনে তুলে আনার জন্যে।
সেই ঘটনার পর কত বছর কেটে গেছে। পিঠ পুড়িয়ে সেজদাও সেই কবেই ম্যাজিক দেখানো ছেড়ে দিয়েছে। বড় হওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে ছোটবেলার সব ম্যাজিকগুলো হারিয়ে গেছে এক-এক করে। কিন্তু সব কিছুই যে একেবারে পালটে গেছে তা নয়। এতগুলো বছর পরও আড়াল থেকে গম্ভীর স্বরে “বুলু পুকুরে যাও” হাঁক দিলেই সেজদা বিলক্ষণ রেগে যায়।
রোহণ কুদ্দুস
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রোহণ কুদ্দুস
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত