লুব্ধক
আমাদের ভূগোলস্যারের দুই যমজ ছেলে, অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ। ক্লাস ইলেভেনের ফার্স্ট বয় অক্ষাংশ সারাদিন ঘরে বসে থান ইটের মতো মোটা-মোটা বই পড়ে, কঠিনস্য কঠিন সব অংকের ফর্মূলা নিয়ে মাথা ঘামায়। ওদিকে দ্রাঘিমাংশ হল টোটো কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। স্কুল ছুটির পর বাড়ি এসে পোশাকটা বদলেই এক ছুটে বেরিয়ে পড়ে সে। বিকেলবেলা সাইকেলে চেপে দু'-এক ঘন্টা এদিক সেদিক না বেড়িয়ে এলে ভাল লাগে না দ্রাঘিমাংশের।
গুয়াহাটির মালিগাঁওতে থাকে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের পিসতুতো দিদি রুমকিদিদি। তার বিয়ে উপলক্ষে গত শীতে বাবার সঙ্গে মালিগাঁও গিয়েছিল দুই ভাই। রুমকিদিদির একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর আছে। খয়েরি রং, বাঘের মতো চেহারা। কুকুরটার নাম জিয়ান। তার মুখের হাঁ এত বড় যে দেখলে পিলে চমকে যায়। এমনিতে সে শান্ত। তবে দ্রাঘিমাংশ জিয়ানকে দেখে মুখ ভ্যাংচানোর পর তাকে দেখলেই রেগে যাচ্ছিল জিয়ান। তার দিকে তেড়ে আসছিল বারবার। তবে অক্ষাংশর সঙ্গে বেশ বনিবনা হয়ে গিয়েছিল জিয়ানের। রুমকিদিদি দু'হাত দিয়ে জিয়ানকে ধরে রাখত, অক্ষাংশ জিয়ানের সোনালি-খয়েরি লোমগুলো ঘেঁটে দিয়ে ভয়ে ভয়ে আদর করত। জিয়ান কিছু বলত না।
গুয়াহাটি থেকে ফিরে আসার পর থেকেই অক্ষাংশ বায়না ধরেছে তাকে একটা কুকুর কিনে দিতে হবে। ছেলের আবদারে প্রথমটায় না-না করলেও পরের দিকে ভূগোলস্যার নিমরাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল দ্রাঘিমাংশকে নিয়ে। ঘাড়-টাড় নাড়িয়ে দ্রাঘিমাংশ বলল, কুকুর খুব খারাপ জানোয়ার। এ'বাড়িতে কোনও কুকুর যদি এক দরজা দিয়ে ঢোকে তবে অন্য দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে যাব। এ আমার সাফ কথা।
দ্রাঘিমাংশকে অক্ষাংশ বড্ড ভালোবাসে। তার কুকুর পোষার ব্যাপার দ্রাঘিমাংশর কড়া আপত্তি থাকায় অক্ষাংশ চুপ করে গিয়েছিল। আর
কুকুর প্রসঙ্গ তোলে না। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দ্রাঘিমাংশ একটা লিফলেট নিয়ে এসেছে বাড়িতে। রাতে খাবার টেবিলে সেই হলদে
কাগজটা ভূগোলস্যারের হাতে দিয়ে ঘোষণা করল, এবার পয়লা জানুয়ারিতে জাগ্রত সংঘ থেকে একটা সাইকেল রেসের আয়োজন করছে।
কোনও এন্ট্রি ফি নেই। আমি সেই রেসে নাম দিয়ে এসেছি।
মা-মরা ছেলেদুটোর কোনও আবদার চট করে বাধা দেন নে ভূগোলস্যার। বললেন, বেশ তো, এ তো ভালো কথা। তা কতদুরে সাইক্লিং করতে
হবে তোদের?
দ্রাঘিমাংশ হাসল, বেশি দূর নয়, চুইখিম আর অ্যালবাং থেকে জলপাইগুড়ি শহর পর্যন্ত। ভয় পেয়ো না, এটা ওয়ান ওয়ে জার্নি। জাগ্রত সংঘের লোকেরা অ্যালবাংয়ে নিয়ে যাবে আমাদের। সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে আমাদের ফিরতে হবে জলপাইগুড়িতে।
ভূগোলস্যার চোখ কপালে তুললেন, চুইখিম আর অ্যালবাং ? সে তো বহুদূর রে! বাগরাকোট থেকে সোজা উত্তরে দিকে ঢুকে গেলে জলপাইগুড়ি জেলার সীমানা শেষ আর দার্জিলিং জেলার শুরু। সামরিক ছাউনি পাশে রেখে পাহাড়ি খাড়া পথে পৌঁছে যাওয়া যায় চুইখিমে। আরও একটু এগোলে অ্যালবাং। সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে এতদূর ফিরে আসা কি চাট্টিখানি কথা?
অক্ষাংশর চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে গেছে। সে বলল, আর ইউ ক্রেজি! অতদূর সাইকেল চালালে তো মরে যাবি তুই! দ্রাঘিমাংশ হেসে বলল, অত ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি কি যুদ্ধে যাচ্ছি নাকি? তছাড়া ওদের মেডিক্যাল টিমও তো থাকবে সঙ্গে। ভয়ের কিছু নেই। তাছাড়া আমি তো আর একা নাম দিই নি, পঞ্চাশের বেশি ছেলে নাম দিয়েছে রেসে।
ভূগোলস্যার রাগ করলে ছেলেদের বকেন না। শুধু গুম মেরে যান। এবারও তাই হল। তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। অক্ষাংশও চুপ করে গেল। দুজনেরই আশংকা, ছেলেটা পাগলামি করতে গিয়ে অসুস্থ না হয়ে পড়ে।
ইংরেজি বছরের শেষ সূর্য ডুবে গেল একটুক্ষণ আগে। সন্ধেবেলা দোতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে দুই ভাই। কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। সাঁঝের আকাশে একটা দুটো করে ফুটছে তারার গুচ্ছ। আকাশে ভেসে আছে বিরাট গোল চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে দ্রাঘিমাংশ নিচু স্বরে বলল,গত কিছুদিন ধরেই একটা স্বপ্ন বারবার দেখছি জানিস।
অক্ষাংশ জানতে চাইল, কীসের স্বপ্ন?
দ্রাঘিমাংশ দূর আকাশের দিকে চোখ রেখে বলল, চুইখিম আর অ্যালব্যাংয়ের স্বপ্ন। ঘুমোলেই ওখানকার দৃশ্য ভিড় করে আসছে চোখে। পাহাড়ের ঘন পাইন গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে রডোডেনড্রন। চিরসবুজ বনের মাথা ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। পাহাড়ি পাকদন্ডীর নীরবতা ভেঙে দিচ্ছি ঝিঁঝিঁ পোকার দলের ঘন্টাধ্বনির মতো আওয়াজ। ওখানে যাবার জন্য আমার আর তর সইছে না রে!
অক্ষাংশ নরম গলায় বলল, কপাল ভাল থাকলে ওখানে ম্যাগপাই পাখির দেখা পেতে পারিস। ম্যাগপাই আকারে বেশ বড়, জেব্রার মতো সাদা-কালো মেশানো ডানার রং। এছাড়াও কিট নামে এক রকম লুপ্তপ্রায় পাখিরও আসাযাওয়া আছে অ্যালব্যাং আর চুইখিমে।
ভোররাতে বেরিয়ে গেল দ্রঘিমাংশ। প্রতিযোগীরা আর তাদের সাইকেল গেল আলাদা আলাদা গাড়িতে। অ্যালব্যাংয়ে থেকে ঠিক বেলা আটটায় শুরু হবে সাইকেল রেস। জলপাইগুড়ি জাগ্রত সংঘের মাঠে এসে শেষ হবে সেই প্রতিযোগিতা। তারপর হবে পুরষ্কার বিতরণ। দুটো টিভি চ্যানেলও থাকবে অনুষ্ঠানটা কভার করার জন্য।
অশান্ত মন নিয়ে খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন ভূগোলস্যার। অক্ষাংশ একটা গল্পের বইতে মন বসানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। দ্রাঘিমাংশর জন্য বড় ভাবনা হছে তার। বসার ঘরের ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল। অক্ষাংশ আর ভূগোলস্যার দুজনেই দুজনের দিকে তাকালেন। দুজনের মুখেই ফুটে আছে দুশ্চিন্তা।
বিকেলবেলা জাগ্রত সংঘের মাঠে চলে এসেছে সবাই। কানাঘুঁষো শোনা যাছে তিস্তা ব্রিজ পার করে এসছে সাইকেল আরোহীরা। সাতজন প্রতিযোগী নাকি প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে সাইক্লিং করছে। দ্রাঘিমাংশও নাকি আছে সেই সাতজনের মধ্যে। জাগ্রত সংঘের মাঠে শুরু হয়ে গিয়েছে গুঞ্জন। পুরষ্কার দিতে মন্ত্রী এসেছেন দুজন। মঞ্চে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছিলেন এতক্ষণ। এবার নড়ে চড়ে বসেছেন তাঁরও। মিডিয়ার লোকজনও ক্যামেরা আর বুম রেডি করে চলে গেছে মাঠের মধ্যিখানে। সবার মধ্যেই একটা উত্তেজনার আঁচ। দ্রাঘিমাংশকে দেখা গেল প্রথমে। দ্বিতীয় প্রতিযোগীকে প্রায় একশো মিটার পিছনে ফেলে প্রবলবেগে প্যাডল করতে করতে আসছে সে। চোখে একাগ্র দৃষ্টি, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে তার শরীর। তার পেছন পেছন ছুটে আসছে, কী আশ্চর্য, একটা দৈত্যের মত কুকুর! পাটকিলে রংয়ের গা ভর্তি চকচকে লোম কুকুরটার।ছোট্ট ল্যাজ, বিরাট বড় মুখ। লম্বা কান দুটো ঝোলা ঝোলা, লাল টুকটুকে জিভ বার করে দৌড়াচ্ছে কুকুরটা।
জাগ্রত সংঘের মাঠে পৌঁছে রিবনে সবার আগে বুক ছুঁইয়েই সাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে গেল দ্রাঘিমাংশ। হাঁপাচ্ছে, ছোট্ট বুকটা উঠছে
নামছে হাপরের মতো। সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। ওদিকে কুকুরটা ছুটে এসে চুকচুক করে চাটতে শুরু করে দিয়েছে দ্রাঘিমাংশের গাল। অত
ক্লান্তির মধ্যেও দ্রাঘিমাংশ কুকুরটার মাথাটা ধরে আদর করে দিল একটু। আহ্লাদে কুঁই কুঁই করছে কুকুরটা।
ঘটনা দেখে স্তম্ভিত ভূগোলস্যার আর ওক্ষংশ। তাজ্জব মঞ্চের বিশিষ্টজনেরা, অবাক উপস্থিত মানুষজন। এমন অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী কেউ হন নি কখনও। দ্রাঘিমাংশ একটু ধাতস্থ হতেই সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। মিডিয়ার লোকজন ক্যামেরা তাক করেছে। দুজন দুটো বুম ধরেছে দ্রাঘিমাংশর মুখের কাছে। সবাই কৌতুহলী, প্রত্যেকেই এই আশ্চর্য ঘটনাটার কথা তার মুখে শুনতে চায়।
দ্রাঘিমাংশ কুকুরটাকে নিয়ে কোলে। লাজুক হেসে বলতে শুরু করল তার গল্প। সকালে রেস শুরু হবার আগে অ্যালবাংয়ে প্রতিযোগীদের চিকেন
স্যান্ডুইচ খেতে দেওয়া হয়েছিল। সবাই পুরোটা খেয়ে নিলেও দ্রাঘিমাংশ অত বড় স্যান্ডুইচ খেতে পারে নি। সে অর্ধেকটা ফেলে দিয়েছিল পথের ধারে। এই পাহাড়ি কুকুরটা ছিল আশেপাশে কোথাও। সে গলাধঃকরণ করেছিল সেই চিকেন স্যান্ডুইচের ভুক্তাংশ। তারপর থেকেই সে ছুটে ছুটে আসছে। কুকুরটা দ্রাঘিমাংশর সঙ্গে সঙ্গে পুরো পাহাড়ি পাকদন্ডী পথ ধরে নেমেছে, সমতল পথ ধরে ছুটেছে। প্রথমটায় দ্রাঘিমাংশ ভেবেছিল তাকে বুঝি তাড়া করছে কুকুরটা। সে প্রানভয়ে প্যাডল করে চলছিল। একটা সময় তার দম শেষ হয়ে যায়। চালসা মোড়ের কাছে এসে বাধ্য হয়ে তাকে থেমে যেতে হয়।কিন্তু অবাক হয়ে দ্রাঘিমাংশ দেখে কুকুরটা তাকে আক্রমন করতে আসছে না, বরং জিভ দিয়ে তার হাত-পা চেটে দিচ্ছে কুঁই কুঁই করে। এমনকী জাগ্রত সংঘের মাঠ পর্যন্ত সে চলে এসছে দ্রাঘিমাংশর পেছন পেছন।
বিরাট একটা ট্রফি আর মোটা টাকার চেক নিয়ে জাগ্রত সংঘের মাঠ থেকে পাড়ার ছেলেদের ঘাড়ে চেপে বাড়ি ফিরেছে দ্রাঘিমাংশ। সঙ্গে সঙ্গে এসেছে সেই কুকুরটা। ঠাঁই নিয়েছে এ'বাড়িতে। এখন অক্ষাংশের সঙ্গেও দিব্যি দোস্তি হয়ে গেছে তার। সে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করে না, ছোট্ট ল্যাজটা নাড়ে আর আদুরে গলায় কুঁইকুঁই করতে থাকে। সকালের খবরের কাগজ বারান্দায় দিয়ে গেলে সেটা মুখে করে ভূগোলস্যরের কাছে এনে দেওয়া এখন তার ডিউটি। তবে স্বভাবে সে মোটেই নিরীহ নয়। একটা বিরাট গন্ধগোকুল এ'বাড়িতে উৎপাত করছিল মাস খানেক ধরে। চালে উঠে লাফঝাঁপ করত, সিলিংয়ে হিসি করে দিত যখন থখন। একদিন রাতের অন্ধকারে গন্ধগোকুলটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফালাফালা করে দিয়েছিল কুকুরটা।
রাতের আকাশে যে কালপুরুষ দেখা যায় তার শিকারি কুকুরের নামে ভূগোলস্যার কুকুরটার নাম দিয়েছেন 'লুব্ধক'। দুই ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমোয় সে। বিছানা নোংরা করে না, বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজকর্ম করে আসে চুপ করে। খাওয়া নিয়েও ঝামেলা নেই। প্রতিদিন সোনামুখ করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে দুধভাত খেয়ে নেয় সে।
তবে লুব্ধক মোটেই সাধুসন্ন্যাসী নয়। তারও একটা দুর্বল জায়গা আছে। সেটা হল চিকেন স্যান্ডুইচ। যেদিন দ্রাঘিমাংশ লুব্ধকের জন্য চিকেন স্যান্ডুইচ কিনে নিয়ে আসে সেদিন লুব্ধকের ল্যাজ নাড়া অনেক বেশি বেড়ে যায় !
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
উপসংহার
“এরকম ছবি কারা তোলে?... কি রকম ক্যামেরা দিয়ে এইসিব ছবি তোলে?... কোন দেশে এরকম দেখা যায়?...” এক কালে, গ্রীষ্মের দুপুরগুলো এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই কেটে যেত। যদিও তার বহু আগে ছাত্রজীবনকে বিদায় জানানো হয়ে গেছে, তবু তখন আমার গ্রীষ্মের ছুটি। খড়গপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় অযাচিত ভাবেই জীবনে গ্রীষ্মের ছুটি আবার ফিরে এসেছিল। বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লে ছাত্রদের সাথে শিক্ষকদেরও এক মাসের অব্যাহতি। আমার বাসস্থান ওই স্কুলের কাছেই ছিল। আর ওই ছোট একতলা বাড়ির বারান্দা থেকেই একটা প্রকাণ্ড মাঠ দেখা যেত। গ্রীষ্মের সকালে বা বিকেলে বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখতে পেতাম আমার কোনও না কোনও ছাত্র সেখানে হুটো-পাটি করে খেলছে। তাদের খেলার মধ্যে কৈশোরের উল্লাস দূর থেকে উপভোগ করতে বেশ লাগত। শিক্ষকের অনাহুত উপস্থিতি তাদের পাছে বিব্রত করে, তাই সামনে গিয়ে তাদের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতাম না। তবে সেই খেলার মাঠে যে ছেলেটিকে একেবারেই দেখা যেত না, সে হ’ল বিমল। যে স্কুলে পড়াতাম, সেই স্কুলেরই ছাত্র ছিল বিমল পাত্র। কোনও বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা অসাধারণ মেধার জন্য এত বছর পরও তার নাম স্মরণে আছে, এমন ভাবলে ভুল হবে। বিমল ছিল পেছনের সারিতে বসা অতি সাধারণ মানের ছাত্র। তার চেহারা, বাচনভঙ্গি বা পড়াশুনোয় অমনোযোগিতা দেখে বোঝা যেত যে সে স্কুলের গণ্ডি পার হলেই তার পরিবার উদ্ধার হয়ে যাবে।
সেই ছেলেটি প্রায়ই কামাই করত। প্রায় তিন-চার দিন পর ক্লাসে এসে বলত “জ্বর হয়েছে”। প্রথম প্রথম এরকম হ’তে দেখে বেশ বিরক্ত লাগত। সেই সময়, গ্রাম বাংলায় বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষালাভ করার সামর্থ্য সকলের থাকত না। আর যারা স্কুলে যেত তারা মনোযোগ দিয়েই স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার চেষ্টা করত। বিমলের মধ্যে বিদ্যা-শিক্ষার প্রতি এহেন অবহেলা বড়ই অসন্তোষজনক ছিল। সহকর্মীদের বলতে তাঁরা বললেন “সব বাঁদর ছেলেপিলে... স্কুলের বদনাম... ঘার ধরে বেড় করে দেবে... ঠেঙ্গিয়ে ঠিক করে দেওয়া উচিৎ।” আপাত ভাবে প্রথম ভাগের রাখালের সাথে বিমলের সাদৃশ্য দেখা যেত। কিন্তু বিমল ক্লাসে বিশেষ চপলতা করত না। এমন কি খেলার মাঠেও তার দেখা মিলত না। আর পাঁচজন অভিজ্ঞ সহকর্মীর পরামর্শ মত তার সাথে কঠিন হওয়ার চেষ্টা করলাম। লঘুদণ্ড, কিঞ্চিৎ প্রহার বা স্কুল থেকে বেড় করে দেওয়ার আস্ফালনেও তার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করলাম না। যত দিন যেতে লাগল সেই অতি সাধারণ বালকের প্রগলভতা যেন হঠকারিতার রূপ নিয়ে মাথায় শেলের মত বিঁধতে লাগত। কেবলই মনে হ’তে লাগল এই ছেলেটির অদ্ভুত ব্যবহারের পেছনে কোনও নির্দিষ্ট কারণ আছে। সেই কারণ জানার কৌতূহল এযাবৎ কেউ দেখায়নি। সেই কৌতূহল প্রকাশের ধৃষ্টতা আমিই দেখালাম।
যে সব ছেলেরা বিকেলে মাঠে খেলত, তাদেরই ক’জন কে ধরে আলাদা ভাবে জানতে পারলাম বিমলের খবর। বিমলের বাড়ি ঠিক কোথায় কেউই বলতে পারল না। তবে সেই খেলার মাঠ থেকে দু’মাইল দক্ষিণে সবেদাবাগান বলে এক অঞ্চলে বিমল থাকে। আরও জানলাম, বিমলের বাবার একটা চায়ের দোকান আছে, বিমলকে সেখানে পাওয়া যেতে পারে। এর বেশি খবর কেউ দিতে পারল না। এর পরের রবিবারই সবেদাবাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। পথের ধারে কোনও চায়ের দোকান, বা গুমটি চোখে পড়তেই খেয়াল করছিলাম বিমলকে পাওয়া যায় কি না। কিন্তু তাকে দেখা গেল না। গোটা সবেদাবাগান অঞ্চলের চক্কর দিয়েও বিমলের দর্শন পেলাম না। এরপর আরও দু’দিন সাইকেল করে গেলাম ওই দিকে। দু-তিন দিন এভাবে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন বিমলকে দেখা গেল। তখন সকাল সাড়ে সাতটা হ’বে, সেদিনও আমি সাইকেল করেই গেছি। দেখি আমার সামনে রাস্তা দিয়ে একটি ছেলে কাঁধে বাঁশের লাঠি বয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সেই লাঠির দু’ধারে দু’টো টিনের পাত্র ঝুলছে। সেই ওজনের ভারে ছেলেটি সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু সেই ভাবেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সাইকেলের গতি বাড়িয়ে সেই ছেলেটির সামনে যেতেই দেখলাম সে বিমল। আমাকে হঠাৎ সম্মুখে দেখা সে থমকে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে বাঁশটা ফেলে দিল। টিনের পাত্র দু’টো ধাতব শব্দ করে রাস্তার ওপর পড়ল। ছলকে পড়া জলের ধারা, মেঠো পথ সিক্ত করে রাস্তার পাশের ডোবার দিকে এগিয়ে চলল। আমরা দু’জনে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলাম, কিন্তু কেউ কিছু বললাম না। অবশেষে আমার মুখে হাসির রেখা দেখে সেও সামান্য হেসে পুনরায় তার গুরুভার বহন করে এগিয়ে চলল। আমি ধীর গতিতে সাইকেল চালিয়ে তার সাথে তাল রেখে এগিয়ে চললাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম – “তুই কি রোজই সকালে জল দিতে যাস?”। সে কেবল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
--- “আর তাই বুঝি স্কুলে যেতে দেরি হয়?” এই প্রশ্নের আর কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
--- “তোদের বাড়ি কোথায়?”
--- “সামনেই”
--- “কে কে আছেন?”
--- “মা আর আমি”
--- “বাবা?”
--- “নেই... গত বছর, মারা গেছেন।”
--- “তাহলে চায়ের দোকান?”
চায়ের দোকানের কথা শুনে সে থমকে দাঁড়াল, আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার চলতে শুরু করল। আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করতে বলল “মা বসে... আমিও থাকি... যতক্ষণ পারি।” তারপর আমাকে প্রশ্ন করল “আপনি এ পাড়ায় হঠাৎ?” আমি সরাসরি বললাম “তোর খোঁজ নিতে।” বিমল হা হা করে হেসে ফেলল। টিন থেকে জল ছলকে পড়ল আবার। বিমলকে আবার জিজ্ঞেস করলাম “তোদের বাড়ি কত দূর?”। সে এড়িয়ে গিয়ে বলল “এখন আমি ঘরে যাচ্ছি না... জল দিতে যাচ্ছি।” তারপর আর আমার কোনও বক্তব্যের অপেক্ষা না করে রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে গেল। আমার আর ওর পেছন পেছন যেতে ইচ্ছে করল না। ততক্ষণে বিমলের দেরিতে স্কুলে আসা, পড়াশুনোয় অমনোযোগ, প্রভৃতি রাখালবৎ আচরণের কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। কারণ না জেনে ছেলেটিকে তিরস্কার করার জন্য একটা আত্মগ্লানি মনকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল। ঘরে ফিরে স্নান করার পরেও সেই গ্লানি দূর হ’ল না। বিমল সেদিন আর স্কুলে এলো না।
এর দু’দিন পর বিমল আবার স্কুলে এলো। সেদিনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমি আর ওকে বিব্রত করলাম না। স্কুল ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই সাইকেল নিয়ে মাঠের পাশে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম বিমল আপন মনে চলতে চলতে সবেদাবাগানের দিকে যাচ্ছে। সন্তর্পণে তার পিছু নিলাম। বেশ খানিকটা দূর থেকে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলাম। মিনিট কুড়ি হাঁটার পরে সে পথে ধারে একটি গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। সেই গলিরই একটা ছোট্ট টিনের চালওলা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাস্তার ধারে সাইকেল দাঁড় করিয়ে সেই হতশ্রী গলির ভেতর প্রবেশ করলাম। সেই দরজার কাছে এসে দেখলাম, তার পাশে একটা জানালা, সেই জানালার একটা পাল্লা খোলা। আর সেই গলির বাকি গার্হস্থ চিত্রটাও একই রকম। পাশাপাশি টিনের চাল, আর দরজা। রাস্তা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে তিন নম্বর দরজাটা বিমলদের, এই সনাক্তকরণ নিশ্চিত করে সেদিন প্রত্যাবর্তন করলাম।
এরপর এক শনিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই বিমলদের ঘরের সামনে গিয়ে হাজির হ’লাম। দরজায় প্রথমবার টোকা দিতে কেউ খুলল না, দ্বিতীয়বার টোকা দিতে দরজা অল্প ফাঁক হ’ল। ভেতরে ঘনীভূত অন্ধকার থেকে কেবল একটা চোখের আভাস পেলাম। কাঁসার বাসনের মত খনখনে স্বর ভেসে এলো – “কাকে চাই?” আমি ইতস্তত করে বললাম “বিমল আছে?” প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ দরজার একটা পাল্লা খুলল। ফুরিয়ে যাওয়া দিনের পরে থাকা আলোয় এক মহিলাকে দেখতে পেলাম। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মলিন বস্ত্র দিয়ে কোন মতে মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। কপালে কোনও টিপ নেই, সিঁথি খালি। কপালে দারিদ্রের বলিরেখা আর চোখে করুন অভিব্যক্তি নিয়ে তিনি আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি নিজে থেকেই বললাম “আমি বিমলদের স্কুলে পড়াই... আপনি বোধহয় বিমলের মা...”। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সলজ্জ-ব্যস্ততার সাথে তিনি দরজার দু’টো পাল্লা খুলে আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। একটি মাত্র ঘর, তার এক পাশে স্টোভ আর রান্নার অন্য সরঞ্জাম পড়ে আছে, আর এক পাশে মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর কিছু বই পড়ে আছে। আর দেওয়ালের ধারে পড়ে আছে দু’জোড়া ক্ষয়িষ্ণু হাওয়াই চটি। এক কোনে একটা ছোট খাট, মলিন চাদর দিয়ে তোশক নিজের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে। সেই খাটের ওপর পড়ে থাকা একটা হাত পাখা দিয়ে বিমলের মা আমাকে বাতাস করতে লাগলেন। ঘরের মধ্যে জ্বলা একটিমাত্র হারিকেনের আলোয় তখনও তাঁর চোখে অপ্রস্তুত হওয়ার আভাস। তিনি বললেন “বিমল একুন ঘরে নেই, সন্ধেবেলা দোকানে বসে... ওই দোকানটাই একুন শেষ সম্বল কিনা... আমি একুনি গিয়ে ডেকে আনচি... দু’মিনিট বসুন। চা করে দি, খান।” আমি বাঁধা দিয়ে বললাম “আপনাকে অত ব্যস্ত হ’তে হবে না। আমি আপনার সাথেই কথা বলতে এসেছিলাম। বিমলকে নিয়ে কিছু কথা ছিল।” উনি কেবল “ও” বলে থেমে গেলেন। আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম “বিমলের কি সত্যিই লেখাপড়ায় আগ্রহ আছে? নাকি আপনারা জোর করেন বলে স্কুলে যায়?” আমরা প্রশ্নের উত্তরে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন “ওর বাপের সাধ ছিল লেখাপড়া শিকে ছেলে বড় কিচু হবে। তাই অভাবের মধ্যেও ছেলেকে ইস্কুলে ভর্তি করল। বাপকে মান্যি করত, কোনও ঝামেলা ছিল না। গেল বছর ওর বাবা চোখ বুঁজলেন, আর এই ছেলেও কেমন হয়ে গেল। সকাল হলেই কাজে যাচ্চি বলে বেড়িয়ে যায়। কোনোদিন ইস্কুল যায়, কোনোদিন যায় না। আমার কোনও কথাই গেরাজ্জি করে না।” বক্তব্য শেষ করে তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ওনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম “আহা, বিমলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নিয়ে আমি আসিনি। কেবল জানতে চাইছিলাম ছেলেটার পড়াশুনোর প্রতি কতটা আগ্রহ।” তিনি কান্না থামিয়ে বললেন “আগে পড়ত, এখন পড়তে চায় না। আপনি দেকুন যদি বুজিয়ে-ধমকিয়ে কিচু করতে পারেন। আমি আর পারচি না।”
অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ অনেক সময়ই কিশোর মনে গভীর ছাপ ফেলে। সংসারে অবশিষ্ট একমাত্র পুরুষ হওয়ার জন্য বিধাতা তার ঘারেই জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছেন। মা কে অধিক পরিশ্রম করতে না দিয়ে কৈশোরেই সংসারের ভার বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিমল। এমন সংকল্পের কাছে শিক্ষালাভের ব্রতও ম্লান হয়ে যায়। লেখাপড়া শিখে বিশেষ উপকার হবে, সেই আস্থা আর থাকা না।
বিমলের মায়ের করুন দৃষ্টি, আর অব্যক্ত মিনতি সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম একটা চায়ের দোকানে বিমল বসে আছে। দু-একজন দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। দোকানের সামনে সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়েছিল, তাই বিমল আমাকে দেখতে পেল না।
... ... ... ... ...
সোমবার বিমল স্কুলে এলো এবং ক্লাস চলাকালীন কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে পাঠ্যর প্রতি কোন মনোযোগ নেই, কৌতূহলের বিষয় কেবল আমি। এরপর একদিন আবার বিমলের চায়ের দোকানে গেলাম। আমাকে দোকানের সামনে সাইকেল থেকে নামতে দেখে ওর হাতের কেটলি থেকে খানিকটা চা বাইরে পড়ে গেল। আর পাঁচজনের মত আমিও দোকানের সামনে বেঞ্চের ওপর বসলাম। সে উপস্থিত গ্রাহকদের হাতে চায়ের ভাঁড় তুলে দিয়ে আমার দিকে তাকাল। কোনরকম সৌজন্য না দেখিয়ে বলল “আপনার কি লাগবে?” হারিকেনের আলোয় সদ্য-প্রকাশিত গোঁফ-দাড়ির রেখায় ডাকা মুখটা বেশ কঠিন মনে হ’ল। কোন উত্তর না পেয়ে আবার সে বলল “আপনাকে কি চা দেব? সঙ্গে বিস্কুট না মামলেট?” আমি বললাম “শুধু চা।” একটা মাটির ভাঁড়ে চা ঢেলে সে আমার দিকে এগিয়ে দিল। সেটা হাতে নিয়ে পাশে রাখলাম, তারপর ওকে প্রশ্ন করলাম “তুই বাড়ি থাকিস কখন?”
--- “কেন?”
--- “তোর সঙ্গে জরুরি দরকার ছিল। এখানে হবে না।”
--- “আমি কখন থাকি, কখন থাকি না... কোনও ঠিক নেই।”
--- “আমি চাইলে তোর মার সাথে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু তোকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল... তোর হাতেই দেবো।”
---“তাহলে এখানেই দিন...”
--- “না”
--- “তাহলে রবিবার বিকেলে আসুন, ঘরেই থাকব।”
চা শেষ করে বিস্কুটের বয়ামের ওপর এক টাকার কয়েন রাখলাম। বিমল ঘাড় নেড়ে সেই টাকা নিতে অসম্মতি জানিয়ে বলল “মা বলল আপনি সেদিন কিছু না মুখে দিয়েই উঠে গেছেন... ” আমি ওর পিঠে একটা হালকা চাপর মেরে বললাম “বেশ গুরুজন হয়েছিস! চা তোদের বাড়ি গিয়েই খাব আবার। এখন এই টাকাটা রাখ।” টাকাটা ওই বয়ামের ওপর রেখেই বেড়িয়ে এলাম, পেছন ফিরে আর দেখলাম না। কেউ পেছন থেকে কিছু বলল বলেও মনে হ’ল না। সাইকেল করে খানিকটা দূরে এসে পেছন ফিরে দেখলাম বিমলের দৃষ্টি আমার গতিপথের দিকে।
রবিবারের বদলে শনিবার বিকেলেই ওদের ঘরে গিয়ে হাজির হ’লাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম বিমল খাটের ওপর বসে চোখ কচলাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরে ঘুমচ্ছিল, আমার জন্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। বিমলের মা বিমল কে বললেন “মাস্টারমশাই এসেচেন, দেকেচিস?” বিমলের চোখের মধ্যে ঘুমের ঘোর কেটে এক অযাচিত সচেতনতা চলে এলো। নিতান্ত অপ্রস্তুতের মত চারপাশ হাঁতরে একটা শার্ট গলায় গলিয়ে নিলো। তারপর ব্যস্ত ভাবে খাট পরিষ্কার করতে লাগল। ওর মা বললেন “আপনি সেদিন কিছু মুখে না দিয়েই চলে গেলেন। আজ চা খেয়ে যেতেই হবে... জল চাপিয়েচি।” বিমল বসা গলায় বলল “আপনি তো বলেছিলেন রবিবার আসবেন।” একথা শুনে আমার মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল “হ্যাঁ, আমি রবিবার আসি, আর তুমি তাল বুঝে সরে পড়!” বিমলের মুখে ভদ্রতার হাসি ম্লান হয়ে গেল, কান লাল হয়ে উঠল। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল খাটের পাশে। বিমলের মা চুপ করে স্টোভে বসানো কেটলির দিকে চেয়ে রইলেন। বিমলের হাত ধরে কাছে টেনে বললাম “তোকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে বলেছিলাম? এই নে... ” প্লাস্টিকের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আসতে আসতে প্যাকেট থেকে জিনিসটা বার করে দেখল... একটা নতুন বই। যে বই না নিয়ে যাওয়ার জন্য ক’দিন আগেও ক্লাসে শাস্তি পেয়েছে। বইটা হাতে নিয়ে সে প্রথমে হাসল, তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
কেটলির ভেতর জমে থাকা বাষ্প তার মুখ থেকে উষ্ণ প্রবাহে নির্গত হয়। কিন্তু মনুষ্য-হৃদয়ে জমে থাকা বাষ্প নির্গত হয় অশ্রু রূপে। পৌরুষ-সম্ভ্রম নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরুষ তাকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করে। সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত বালকের সেই কৌশল অবগত নয়। আর স্ত্রী জাতি সেই চেষ্টা করে শক্তির অপচয় করে না। বিমলের মায়ের মুখে হাসি থাকলেও, স্টোভের শিখার আভায় তাঁর চোখের কোন চিক চিক করছিল।
... ... ... ... ...
এরপর থেকে মাসে দু-তিনবার বিমলের বাড়িতে বা চায়ের দোকানে যেতাম। সেই সাধারণ শ্রীহীন কিশোরের মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য ছিল যা আমার ভালো লেগে গেল। সেই ভাল লাগার মধ্যে দয়া বা করুণার লেশ মাত্র ছিল না। ছেলেটির এক অদ্ভুত চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল। মেধাবী না হলেও, লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা ছাই চাপা আগুনের মত ধিক্ ধিক্ করে তার ভেতরে জ্বলত। কখনও ছুটির দিনে ওকে সঙ্গে নিয়ে অল্প দূরে কোন ঝিল বা দিঘির পারে যেতাম। পরিষ্কার জল দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত, আমি পারে দাঁড়িয়ে শত চিৎকার করলেও উঠে আসত না। পথে কোনও ফল গাছে দেখলে তরতরিয়ে গাছে উঠে তিন-চারটে ফল পেরে আনত। নীতি শিক্ষা দিতে গেলে বলত “ওই ফল গাছের পাখি আর হনুমানেও নষ্ট করে। আমিও না হয় একটা হনুমান।” বিমলের মধ্যে তীব্র নাস্তিকতা ছিল লক্ষণীয়। সাধারনতঃ গ্রামের মানুষদের মধ্যে এইরূপ নাস্তিক দেখা যায় না। বিমল কে কোনদিনও স্কুলের সরস্বতী পুজোয় আসতে দেখিনি। গ্রামের দূর্গাপুজোর সময় মণ্ডপের ধারেকাছে সে আসত না। পথ চলতে চলতে কোন মন্দিরের সামনে কাউকে প্রণাম করতে দেখলে, অদ্ভুত অবজ্ঞার হাসি নিয়ে তাকে দেখত। ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে জনসাধারণের এহেন ভক্তি দর্শনের মধ্যে যেন ভারী কৌতুকপূর্ণ কিছু লুকিয়ে আছে। সেই কৌতুক যেন সেই কেবল দেখতে পায়। হয়ত বিধাতাপুরুষ বাল্যকালে যাদের জাগতিক ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন, তারা এইভাবেই তাঁর কর্মের মধ্যে কৌতুকের উৎস খুঁজে নেয়।
এক প্রতিবেশীর সহায়তায় বিমলের মায়ের জন্য একটা জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। ওনাকে মাসিমা বলে ডাকতাম। ছেলে স্কুলে যাওয়ার পর উনি সেলাইয়ের দোকানে কাজ করতে যেতেন। সন্ধ্যের পর ছেলের সাথে আবার চায়ের দোকানে বসতেন। বিমল ওই দোকানেই বই নিয়ে বসত। কেবল পরীক্ষার সময় দোকানে বসত না। তবে শত চেষ্টা করেও বিমলের সকালে জল বাড়ি বাড়ি জল দেওয়ার কাজ বন্ধ করতে পারিনি। বহুকালের পরিচিত প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন দৈব-রূপে সাক্ষাত শয়তান এলেও বোধ করি আর্তের মধ্যে এমন বিহ্বলতা প্রকাশ পায়। বিমলের বাবা অবর্তমানে সে ও তার মা হয়ত আমার মধ্যে এক আকাঙ্ক্ষিত অভিভাবক কে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি বা ভদ্রতাও তাদের কৃতজ্ঞতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিত।
গ্রীষ্মের ছুটিতে দুপুরবেলা বিমল মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে আসত। আমার ঘরে নানারকম রঙিন ছবিওয়ালা বিদেশি বই থাকত। আমি বসে কোনও একটা বই পড়তাম বা রেডিও শুনতাম, আর বিমল সেই সব বই আর পত্রিকার পাতা উলটে পালটে দেখত। পাশ্চাত্যের শহরের গগনচুম্বী বহুতল অট্টালিকা, ঝর্ণা, গাছের পাতার ওপর বসে থাকা উজ্জ্বল কীট-পতঙ্গ, এই সব ছবি বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত। সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত, তুষার মণ্ডিত গিরি-শৃঙ্গর ছবি দেখে বলত “এরকম ছবি কারা তোলে? কি করে তোলে? কোথায় এরকম দেখা যায়?...” সেই ছবিগুলো আরও একবার দেখার আকর্ষণেই সেই বার বার আমার বাড়িতে আসত। আমার একটা ক্যামেরা ছিল, তাতে সাদা-কালো ছবি তোলা যেত। মাঝে মাঝে সেই ক্যামেরা নিয়ে বেরোতাম, আর ছবি তুলতাম। বিমল সেই ক্যামেরার লেন্স-এ চোখ রেখে চারিদিক দেখত আর ছবি তোলার ভান করত। ক্যামেরা হাতে পেয়ে গ্রাম্য কিশোরের সেই বালকোচিত আচরণ বড়ই অদ্ভুত দর্শন ছিল।
বিমল মেধাবী ছিল না, ঠিক ভাবে লেখাপড়া করার মত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু প্রবল মানসিক দৃঢ়তাকে সম্বল করে সে দু’বার মাধ্যমিকে ফেল করেও তৃতীয়বার পরীক্ষা দিল, এবং ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল। পাশ করার খবর পেয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল “তিন বছর একই জিনিস পড়া তো, তাই তিন বারের বার ঠিকঠাক শেখা হয়েছে... এক বারে পাশ করে গেলে শেখা হ’ত না।” ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেছে বলে মাসিমা মৌরলা মাছের বাটি চচ্চড়ি খাইয়েছিলেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে ঋণ পরিশোধের প্রবল আকুতি মুহুর্মুহু প্রকাশ পেত। সেই আকুতি নিয়েই প্রতিবার তিনি বলতেন “আবার এসো বাবা...”।
জেলা হাইস্কুলে বিমল একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হ’ল। ঠিক সেই সময়, অপ্রত্যাশিত ভাবে আমি কলকাতায় একটি চাকরি পেয়ে গেলাম। খড়গপুরের বাসা ত্যাগ করার সময় ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল। কলকাতা ফেরার ক’দিন আগে বিমলদের বাড়িতে গেলাম ওদের সাথে শেষবার দেখা করে নিতে। আমার কলকাতা ফেরার খবর শোনার পরেও বিমলের ভাবলেশহীন চোখে অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হ’ল না। তবে সেদিন ওদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় মাসিমার চোখের অবলম্বনহীন অসহায়তা সারা জীবন হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
কলকাতায় ফিরে আসার মাস ছয়েক পর একবার খড়গপুরে গেছিলাম। কিন্তু বিমলদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম দরজায় তালা ঝুলছে। পাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানলাম বিমল ও তার মা খড়গপুর ছেড়ে চলে গেছে। কোনও এক পরিচিত আত্মীয় বিমলের জন্য শহরে কাজের ব্যবস্থা করেছে, তারা তার সাথেই চলে গেছে। বিমল এইভাবে ছ’মাসের মধ্যে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কর্মসন্ধানে আত্মীয়র শরণাপন্ন হ’বে, একথা ভাবতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বিমল বা তার মায়ের সাথে খড়গপুর অথবা কলকাতায় আর দেখা হয়নি। মাসিমার চোখে সেই সজন হারানোর শূন্যতাই শেষ স্মৃতি হয়ে থেকে গেল।
... ... ... ... ...
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেলো। সেই সময় আমি কলকাতায় থাকি। আমার এক বন্ধুর সাথে ছুটির দিনে নাটক, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্র প্রদর্শনী অথবা আলোচনা সভায় যেতাম। বেশ লাগত সৃষ্টিশীল সমাজের কেউকেটাদের নানারকম মতামত শুনতে। শহরের বিদ্বজ্জনের কথোপকথনের একটা-দুটো টুকরো হঠাৎ ভেসে এলে মাঝে মাঝে কৌতুকও বোধ করতাম। সেইরকম একদিন ‘অপ্রতিম’ নামক এক এক শিল্পীর আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখতে গেলাম। তার নাম আগে কখনও শুনিনি, তবে “ওয়াইল্ড লাইফ”-এর ওপর কিছু ছবি অনবদ্য। শুনলাম তিনি বেশ কিছু বছর বেলজিয়ামেই কাটিয়েছেন... তারপর আফ্রিকা মহাদেশে এবং ব্রাজিলে। শিল্পী সেই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু আলোকচিত্রের নিপুণতা দেখে তাঁর সাথে দেখা করার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার সেই বন্ধুর চেষ্টায় কিছুদিন পরেই শিল্পীর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির হ’লাম।
দোতলা বাড়ির সদর দরজায় নেম প্লেট, তাতে স্পষ্ট লেখা ‘অপ্রতিম’। বেল বাজাতে একজন বেয়াড়া এসে দরজা খুলে দিল। সেই পথ দেখিয়ে আমাদের দোতলায় নিয়ে চলল। বাড়ির প্রতিটা দেওয়াল জুরে অসাধারণ সব আলোকচিত্র। বর্ণ, আকৃতি, আলো-ছায়া চারিদিকে খেলা করছে। বেয়ারা আমাদের প্রশস্ত ড্রইং-রুমে বসিয়ে তার দাদাবাবু কে ডাকতে গেল। ড্রইং-রুমের চারিদিকে চোখ বোলাতে গিয়ে একটা দেওয়ালে কেবল মাত্র একটি ছবি চোখে পড়ল। এক প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক নির্মল হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই মুখ অতি পরিচিত। তবে সেই মুখে কোনও মলিনতা নেই, দৃষ্টিতে করুণ আকুতি নেই, সহানুভূতির প্রতিদানে অসহায় কৃতজ্ঞতাবোধের চিহ্ন নেই। নিশ্চিন্ত, প্রশান্ত দৃষ্টি। সেই ছবিতে মোটা রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। আর তার ঠিক নীচে একটা ছোট পিঁড়ির ওপর একটা মালা রাখা, আর তার চার পাশে ফুল ছড়ানো। সোফা থেকে উঠে এক পা এক পা করে সেই ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম জলচৌকির ওপর একজোড়া পুরনো হাওয়াই চটি। তারই ওপর মালা রাখা, আর চারপাশে ফুল ছড়ানো। বুঝতে অসুবিধে হ’ল না এ চটি কার। সেদিনের গ্রাম্য, হতশ্রী, নাস্তিক বিমল আজকের প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিম হয়েছে। তবে তার মা কে যথার্থ ভাবে দেবীর সম্মান দিতে ভোলেনি। মাসিমার স্মিতহাস্য মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেড়িয়ে গেলাম। বন্ধুর পিছু-ডাক গ্রাহ্য করতে ইচ্ছে হ’ল না। বিমল বা অপ্রতিম কারও সাথেই আর দেখা হয়নি।
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
আশ্রয়ের খোঁজে
মুখ গোমড়া থমথমে মেঘলা আকাশ থেকে সাত সকালে ঝির ঝিরে বৃষ্টির দুষ্টুমি শুরু হল। মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। আর তক্ষুনি মনের আনন্দে মা ভৈরবী তানে গলা সাধত শুরু করে। আমিও মায়ের সুরে সুর মেলানোর চেষ্টা করি, যদিও সেটা বেসুরো হচ্ছে তবুও মা মুচকি হাসি হেসে আমাকে উৎসাহিত করছে। এদিকে বাবাও কখন ঘুম জড়ানো চোখে হেঁড়ে গলায়আমাদের তালে তাল মেলাতে থাকে। মা তান বন্ধ করে হেসে কুটো পাটি! বাবা অপ্রতিভ হয়ে লজ্জা পেয়ে যায়। অভিমানে বলে - "জানি আমার হেঁড়ে গলায় ভালো লাগছে না। তবুও এই সকালের বৃষ্টি ভেজা পরিবেশটা মনটাকে এতো ভালো করে দিল, কখন যেন অজান্তে গেয়ে ফেলেছি বেসুরো গলায়।"
মা হেসে সান্ত্বনা দিয়ে বলে-"কে বলল তুমি হেঁড়ে গলায় গাও! তোমার গলাটা বি-শার্পে যায়। খাদে তোমার গলাটা ভালোই লাগে। ধরো ধরো ---"
অমনি আমরা সবাই এক সঙ্গে গাইতে শুরু করি - "গ্যাঙ্গর-গ্যাঙ্গর-গ্যাঙ ----"
গানের তালে তালে ঝোপের মাথা থাকে বৃষ্টি বিন্দুগুলি ঝরে পড়ছে কচুপাতার উপর। তৈরী হচ্ছে এক অদ্ভুৎ ছন্দ। তারপর ধীর লয়ে বিন্দুগুলি কালচে সবুজ ঘাসের মাথা ছুঁয়ে চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়ছে ডোবার জলে। বৃষ্টি ফোঁটাগুলোর ছোট ছোট চক্রাকার জলের বৃত্তগুলো অতিক্রম করে মাকড়সার দৌড় ঝাঁপ এলোমেলো। হঠাৎ করে কালো জলে রুপোলি পুঁটির বিদুৎ ঝলক! সে এক আনন্দ, পুলকের অনুভূতি।
ক্রমশ বৃষ্টির ধারা দ্রুত লয়ে চলতে থাকে। মায়ের তান সমানে দ্রুততর হতে থাকে। তক্ষুনি আমাদের পেছনে বিকট শব্দ! তারপর মুহুর্তের নিস্তব্ধতা। সবাই প্রমাদ গুনছি। আমরা আমাদের জায়গায় নিস্তব্ধ নিথর হয়ে বসে রইলাম।আবারো বিকট শব্দ! চোখের সামনে সব যেন
অন্ধকার দেখি! সম্বিত ফিরে দেখি বিশাল বিশাল আকৃতি মাটির চাঁই উপর থেকে গড়িয়ে গুঁড়িয়ে ঝোপ-জঙ্গল, গাছ-গাছালি, ঘাস-পাতা
সব সবকিছু নস্যাৎ করে পড়ছে ডোবার জলে। ঝপাং করে একটা শব্দ, তারপর ডোবার জল ছলকে ছিটকে পড়ে পাড়ে।
ভ্যাবাচাকা খেয়ে বসে রয়েছি। তক্ষুনি বাবা চিৎকার করে আমাদের সাবধান করে দেয়-"এক মুহুর্ত দেরি নয়। চলো সবাই, উপরে চলো।"
প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুত থেকে দ্রুততর পাড়ে উঠে আসছি। ফিরে ফিরে দেখতে পাচ্ছি আমাদের পূর্ব পুরুষের ভিটে-মাটি, বসত-বাড়ি সব একে একে ধুলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের এতোদিনের নিশ্চিন্ত ঠিকানা-আমাদের স্মৃতি! মা ঝর ঝর করে কাঁদতে থাকে। বাবা মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে -"এখন কাঁদবার সময় নয়, চলো, দ্রুত চলো এখান থেকে।" মা হাঁউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে - "আমরা উদ্বাস্তু হয়ে গেলাম।" বাবা কঠোর দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে-"উদ্বাস্তু! পৃথিবীতে আমরা সবাই উদ্বাস্তু - এবার নতুন কি!"
পাড়ে উঠে এসে দেখি একটা মাটি বোঝাই লরি ডোবার সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে একটা ঢাউস হোর্ডিং, লেখা আছে - "গ্রীন শেল্টার হাউসিং প্রজেক্ট।" তাকে ছড়িয়ে একটু দূরে রাস্তার ওপারে একটা নালা বৃষ্টির জলে খরস্রোতা। তারপরে যতদুর চোখ যায়শুধু কুয়াচ্ছন্ন আবছা গগণচুম্বি বাক্সঘরের কাঠামো। তার মধ্যে থেকে ঘ্যরর-ঘ্যরর, ঠক-ঠক, ঝনাৎ -ঝনাৎ যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে। এদিকে মাটি বোঝাই লরি থেকে কয়েকটা মানুষ মাথায় ঝুড়ি করে মাটি টেনে ফেলছে ডোবার মধ্যে। মানুষগুলো খুব খুব শয়তান। ওরা ওদের ঘর বানাতে গিয়ে আমাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করছে আবলিলায়। আমরা যে বড্ড অসহায়। ওরা বড় নিষ্ঠুর। প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নেবে একদিন -সবুর করো।
হঠাৎ সেই বৃষ্টি কুয়াশার মধ্যে লরিটা মাটি খালি করে ঘ্যরর - ঘ্যরর শব্দ করে, কালো ধোঁয়া উড়িয়ে, বিটকেল ডিজেলের গন্ধ ছড়িয়ে
দানবের মতো দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে! তক্ষুনি বাবা চেঁচিয়ে সাবধান করে আমাকে বলে - "সোনা লাফিয়ে পালাও এক্ষুনি, নালার
পাশের ঝোপে লাফিয়ে পড়। আমরা আসছি তোমার পরেই।"
আমি আমার গায়ের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে খু-ব জোরে লাফাতে শুরু করি। তিন লাফে অবশেষে ঝোপের মধ্যে পড়লাম। পড়েই প্রমাদ গুনছি।
এমন সময় ঝুপ্ ঝাপ্ শব্দ করে মা-বাবা দুজনে লাফিয়ে এসে পড়ল আমার পাশে। তখন দানবটা বিকট চিৎকার করে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা নিয়ে অসহায়ভাবে বসে রয়েছি। কোথায় যাবো, থাকবো কোথায়! মা তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে - "আর এক মুহুর্ত
নয়। চলো পালাই এখান থেকে। ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। আর নয়-----"
হঠাৎ দেখতে পাই মাথার ঝোপের মধ্যে একটা হলদেটে লোটকলমির পাতা মাকড়সার জালে দুলছে। আর তক্ষুনি একটা মৃদু দখিনা হাওয়া সঙ্গে
ঝির ঝিরে বৃষ্টির ফোঁটা পাতাটাকে ধাক্কা দিয়ে উড়িয়ে ফেলল নালার জলে। তারপর নালার স্রোতে ঘুরপাক খেয়ে স্রোতের টানে ভেসে চলল। আমারা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। নিমেষে নির্বাক হয়ে লাফিয়ে তিনজন চেপে বসলাম পাতাটার উপর।
তারপর কত যে নালা-খন্দ, খাল-বিল, নদী পেরিয়ে কতো অজানা দেশ দেখে অবশেষে আদিগন্ত সবুজ প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম। যেদিকে চোখ যায়
শুধু সবুজ আর সবুজ। মাথার উপর নীল আকাশ। পায়ের তলায় ভেজা সবুজ ঘাস। বুক ভরে নিশ্বাস নেই। একটু এগোতেই দেখি কানায় কানায় ভরা একটা ডোবা। পাড়ে গাছ গাছালিতে ভর্তি ঝোপ। ওটাই বুঝি আমাদের নিরাপদ নিশ্চিন্ত আশ্রয়! আমরা এগোচ্ছি, এমন সময় একটা উড়ন্ত দুষ্টু মেঘ আকাশঢেকে কালো ছায়া ফেলে উড়ে গেল উত্তরে। সঙ্গে বৃষ্টি ফোঁটাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে, আমাদের ভিজিয়ে দিল নিমেষে। স্বস্তির নিঃশ্বাস চলে আসে অজান্তে। মা তখন মেঘমল্লারে তান্ ধরেছে আপন মনে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমি লাফাতে থাকি।
নিধু সর্দার
ভুবনগ্রাম
- বিস্তারিত
- লিখেছেন নিধু সর্দার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
গোল বাঁচাল কালু মিঁয়া
মানসদের স্কুলে সেবার নানা ছুটি জুড়েটুড়ে একটা মিড-টার্ম ব্রেক হয়ে গেলো। প্রাণের বন্ধু শুভময়ের আদি বাড়ি তিলডাঙা, ওর দাদু-কাকারা এখনও সেখানে থাকেন – এই মওকায় সে সেখানে ঘুরে আসবে ঠিক করলো। মানসের কোনো প্ল্যান নেই শুনে শুভময় ওকে ধরে ঝুলোঝুলি শুরু করলো সঙ্গে আসার জন্য। শেষ অবধি মা-বাবার হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্ট থেকে অনুমোদন আদায় করা গেলো – অবশ্য “সব সময় সাবধানে থাকবি, যেখানে-সেখানে টো টো করে ঘুরবি না, বোতলের জল ছাড়া খাবি না” হ্যানোত্যানো হাজার শর্তসাপেক্ষে।
নামে যাই হোক তিলডাঙা জায়গাটা কিন্তু বেশ ছিমছাম ছোট্ট একটা শহর। শুভময়দের বাড়ি রেল স্টেশন থেকে গাড়িতে যেতে মিনিট পনেরো লাগলো। তখন সবে সন্ধে, কিন্তু এলাকায় কেমন একটা গা ছমছম ভাব। রাস্তায় বিশেষ লোকজন নেই, বাড়িঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। “তোদের শহর কি এত চটপট ঘুমিয়ে পড়ে? নাকি – কোনো ভয়ডর আছে?” মানস জিজ্ঞেস না করে পারলো না।
“ন্-না, তেমন কিছু নয়।” শুভময় জোর করে হাসার চেষ্টা করলো। মনে হলো ও কী যেন চেপে যাচ্ছে।
শুভময়ের বাড়ি ঢুকেও এক চমক। তখন সবে শীতের আমেজ পড়তে সুরু করেছে, কিন্তু সবারই যেন কেমন জবরজং পোষাক – কান-টুপি, মোটা ফুলহাতা গরম জামা, সর্বাঙ্গ ঢাকা চাদর। তার মধ্যে এক ভদ্রমহিলা, সম্ভবতঃ শুভর কাকিমা, একটা ধুনুচি হাতে যেন নেচে নেচে বেড়াচ্ছেন। এতক্ষণে মানসের চোখে পড়লো – অন্যান্যদের হাতে-পায়েও যেন চটুল নৃত্যের ছন্দ।
“সবাই অমন বর্ম পড়ে নাচছে কেন রে?” মানস ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোরা কি শাক্ত? এটা কি কোনো রণনৃত্য?”
“উঁহুঃ – এ হচ্ছে মশক নৃত্য।”
“মশক – মানে, ভিস্তি? ইউ মীন – ফোক ডান্স?” মানস উচ্ছসিত হয়ে ওঠে।
“দুর গাড়ল – মশক মানে মচ্ছর, মানে পাতি মশা। সন্ধেবেলা জানালা-দরজা বন্ধ করে ধোঁয়া না দিলে টিঁকতে দেবে না। আর হাত-পা না নাড়িয়ে একবার দেখ দেখি – কামড়ে গোদা গোদা করে ফুলিয়ে দেবে। বিশেষ করে এই সময়টাই ডেঞ্জারাস। এইডিস, এনোফিলিস, কিউলেক্স যত কিসিমের মশা – এই সন্ধেটাই ওদের শিফট চেঞ্জের সময় কিনা। কে যে কামড়াবে ঠিক নেই – তারপর ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, গোদ, বিষফোঁড়া, কী না হতে পারে!”
“ঢপ দিস না – মশা কামড়ালে বিষফোঁড়া হয় না।”
“ওই হলো। যাক গে চল – দুটো মুখে দিয়ে স্থির হয়ে বসবি।”
“স্থির হয়ে বসতে দেবে, বলছিস? না, আমি ওই লাইনেই নেই – নাচতে পারবো না, সুতরাং সোজা মশারির তলে।”
‘দুটো’ মুখে দিয়েই অবশ্য মানসের দিল খুশ। ঘরে তৈরি মোয়া, নাড়ু, ক্ষীরের সন্দেশ – এনি ডে ম্যাকডোনাল্ড-কেনটাকিকে পেঁদিয়ে সমুদ্দুর পার করে দেবে। এরপর রাত বাড়ার সাথে সাথে উড়ন্ত খুদে দুশমনদের বিমান হানা যেন একটু স্তিমিত হয়ে এলো, সাথে সাথে মানুষগুলোও ধীরে ধীরে ‘ছন্দে’ ফিরতে লাগলো। একটু পরেই মানস বুঝতে পারলো, এরা লোক খুব ভালো।
একই কথা শুভও বললো। তবে সাথে কী যেন যোগ করতে যাচ্ছিলো, কাকু এসে পড়ায় থেমে গেলো।
অমন টিফিনের পর রাতের খাওয়া যেন অধিকন্তু হয়ে যায়। তার মধ্যেও মাছটার স্বাদ মানসের মুখে লেগে রইলো। “মাছটা কী ভালো রে!” সে উচ্ছসিত হয়ে বললো।
“ছিলো, এখন আর নেই!” শুভ হাত চাটতে চাটতে উদাস ভঙ্গীতে বললো, “ভালো মাছ আর ভালো মানুষরাই তাড়াতাড়ি চলে যায়।”
পরদিন ভোরে সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে জড়ো হয়েছে। একটু আগেই সুযোগ পেয়ে শুভ কাল রাতের সেই না-বলা ‘কী যেন’টা শুনিয়ে দিয়েছে – দাদু সম্বন্ধে একটু সাবধান। উনি এমনিতে লা-জবাব লোক। শুধু ফিলজফি নিয়ে একবার চড়ে গেলে বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন। মানস ইশারায় জানিয়েছে, ঠিক ম্যানেজ করে দেবে।
যেখানে বাঘের ভয়! ওরা সবে অমলেটে কামড় বসিয়েছে, এমন সময় কী একটা প্রসঙ্গ থেকে যেন দাদু মুডে এসে গেলেন। মাতব্বরি হেসে শুভকে বললেন, “কী রে ছোঁড়া, তোরা নাকি খুব লেখাপড়া শিখছিস, বিজ্ঞান-ফিজ্ঞান ঝাড়ছিস – সৃষ্টিরহস্য কী, জানিস?”
“জানি না, তবে শিগগিরই জেনে নেবো – এখনো বাচ্চা আছি কিনা!” শুভ ভয়ে ভয়ে বলে।
হা-হা হেসে দাদু বললেন, “দু’দিনের ছোঁড়া, তোরা জেনে যাবি – পণ্ডিতরাই যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে ভেবে বের করতে পারলো না ডিম আগে, না মুরগি আগে?”
“সে প্রশ্নের ফয়সালা তো হয়ে গেছে দাদু!” মানস জ্বলজ্বলে চোখে বললো, “ব্রেকফাস্টে অমলেট আর লাঞ্চে চিকেন কারি।”
দাদুর গলায় অমলেট আটকে গেলো। কাশতে কাশতে সভয়ে মানসের দিকে তাকাতে তাকাতে তিনি টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। পরে নাকি শুভময়কে বলেছিলেন, “কী জিনিস এনেছিস, শুভ! এ যে দেখি পকেট ডায়নামাইট!” তবে লাঞ্চে যাতে চিকেন হয়, তার ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন।
একটু পর সব পড়শি মহিলারা এসে ভিড় জমাতে আরম্ভ করলেন। “কী গো দিদি, শুনলাম তোমার নাতি এসেছে? তাই দেখতে এলুম।” ঠাকুমার কাছ এসে বিগলিত হেসে তাঁরা আর্জি পেশ করলেন।
শুভ বিড়বিড় করে বললো, “এই এক জ্বালা। দেখতে এসেছে না কচু, কলকাতা থেকে এলে প্রত্যেকের জন্য কিছুমিছু না এনে উপায় নেই। সেই খোঁজে এসেছেন।”
মানস এতক্ষণে বুঝলো, ভালো কাকিমা অর্থাৎ শুভময়ের মা টুকিটাকি ভর্তি একটা ব্যাগ শুভময়ের হাতে তুলে দেবার সময় কেন অত গজগজ করছিলেন। শুভকে সান্ত্বনা দিয়ে সে বললো, “যাক গে, হাজার হলেও এরা তো তোদের neighbor –”
“এভার নেবার – নেভার দেবার!” বলতে বলতে শুভ ঘাড় গোঁজ করে ব্যাগটা বের করে ঠাকুমার হাতে তুলে দিলো। তারপর মানসের দিকে চেয়ে বললো, “চল, ক্রিকেট খেলবি?”
মানস তো একপায়ে খাড়া। পাড়ার ছেলেগুলো অবশ্য চমৎকার। ক্যাম্বিস বল আর কাঠির উইকেটে মিঠে রোদের মধ্যে দারুণ একখান টি-টুয়েন্টি হলো। ক্যাম্বিস বলেও স্রেফ পেস বদলের যাদুতে প্রতিপক্ষকে চার ওভারে পনেরো রানে বেঁধে রেখেও মানস পারলো না, কিছু এলোপাথারি শট নিয়ে ওরা দু’ বল বাকি থাকতে রানটা তুলে দিলো। তবে খেলার শেষে সবাই এসে মানসের সাথে হাত মেলালো আর বিকেলে ফুটবল খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানালো।
ফেরার সময় মানসের চোখে পড়লো, শহরের উত্তরে কিছু দূরে এক জংলা এলাকা। একটু উত্তেজিত হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, “জন্তু-জানোয়ার আছে নাকি রে?”
“এককালে ছিলো, চোরাশিকারিদের দৌরাত্মে এখন দু-একটা শেয়াল-ফেয়াল ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা যায় না।” শুভ তাকে আশ্বস্ত করলো। তারপর যোগ করলো, “তবে ওদিকে না যাওয়াই নিরাপদ। পুলিশের তাড়া খেয়ে ক্রিমিনালরা মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে গা ঢাকা দেয়।”
মানস-শুভ ‘কলকাতার বাবু’ বলে দুপুরে পুকুরের বদলে ওদের ধরা জলে স্নান করতে হলো। দুপুরের খানাটা বলা বাহুল্য বেশ ভারী হলো, তবে খেলাধূলায় চনমন শরীরে সেসব কোথায় তলিয়ে গেলো। বিকেলে ফুটবল। মানস যথারীতি তেকাঠির নীচে, অর্থাৎ গোলি। সে একটা ‘ডাইভিং সেভ’ করার পর মাঠ জুড়ে পটাপট হাততালি। এতক্ষণে মানসের চোখে পড়লো, চারপাশ দর্শকে ভরে গেছে। কলকাতার ছোঁড়াদের খেলার কথা শুনে বোধহয় অনেকে হুজুগে হাজির হয়েছে।
সেই দর্শকদের মধ্যে ছিলো পচা মন্টু, ল্যাংড়া যতে আর হুব্বা পাঁচু। এটা ওদের বেপাড়া। কিন্তু একটা ‘কেস’ করার পর আপাতত পাড়ায় যাবার উপায় নেই। কিছুদিন কাছাকাছি কোনো শহরের একটা হোটেলে লুকিয়েছিলো। কিন্তু কাগজে ওদের ফোটো বেরিয়ে হাওয়া গরম হয়ে যাবার পর বাধ্য হয়ে সে আস্তানা ছেড়ে জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে হয়েছিলো। এখন আবার হাওয়ায় ‘কেসের’ গন্ধ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।
“আমার খবর ভুল হয় না।” মন্টু ফিসফিসিয়ে বলছিলো, “ঐ যে ছেলেটা গোলে খেলছে, ওর বাপই কলকাতার মস্ত ডাক্তার – এবেলা ওবেলা রোগীর পেট কাটছে। একবার তুলতে পারলে বাপকে রগড়ে কোন না চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ!”
“সাথে লোকাল ছোঁড়াটাকেও ফাউ হিসেবে তুললে হতো না? যা পাওয়া যায়।” পাঁচু জিজ্ঞেস করলো।
“ধুর, ওসব ফালতু পার্টি। এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে একখান বাড়ি আছে বটে, কিন্তু সব পাতি চাকরি করা পাবলিক। ওতে খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি হয়ে যাবে।”
“বেশ, এবার তুমি কী প্ল্যান ছকেছো, বলো।”
“বলছি, কিন্তু আগে সাইডে আয়।” মন্টু চেলাদের একটু দূরে টেনে আনে।
“দেখছিলি, ছোঁড়াগুলো কেমন ফুটবল খেলছিলো? তোরা কেউ কখনো খেলেছিস?”
“কী যে বলো গুরু – নইলে এই ঠ্যাংটা এমন অষ্টাবক্র হলো কীভাবে?” যতে দাঁত বার করে।
“হলো কেন, জানিস? তুই ডিফেন্সকে টপকাতে পারিসনি, তাই আটকে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙেছিস। ডিফেন্সের অনেকগুলো ভাগ থাকে – হাফ লাইন, তারপর ডীপ ডিফেন্স, তারপর –”
“সে যাক, এবার বলো তুমি সেগুলো টপকাচ্ছো কীভাবে ।” পাঁচু ধৈর্য রাখতে না পেরে বললো।
“বলছি। প্রথম কথা – দিনেমানে এখন কোনো কেস করা যাবে না। পাবলিক যেমন তেড়িয়া হয়ে আছে, ধরা পড়ে গেলে থানায় যাবার আগেই গণধোলাইয়ে কম্মো শেষ। তাই কাজ নামাতে হবে রাতে।”
“সে আর বলতে। তারপর?”
“তবে আমার খবর – আশেপাশে কেস হবার পর এখানে ছেলেরা রাতপাহারা দেয়। এটাই হচ্ছে এক্ষেত্রে হাফ লাইন।”
“ফুঃ, লাঠি হাতে কতগুলো ডরপোক ছোকরা – দু’মিনিটে উড়িয়ে দেবো।”
“অত সহজ নয়। ওরা দলে অনেক, চোরাগোপ্তা অস্তর-শস্তরও থাকতে পারে। শুধুমুধু প্রাণের ঝুঁকি নেবো কেন?”
“তাহলে ওদের কাটাবে কীভাবে?”
“স্রেফ ধোঁকা দিয়ে, ভুলিয়ে।” মন্টু গোঁফে তা দিয়ে বললো, “এই ব্রেনে যে কত আইডিয়া খেলে, তা যথাসময়েই জানতে পারবি।”
“নইলে কি আর তোমায় গুরু মানি?” যতে গড় করলো।
“তারপর ব্যাক লাইন হচ্ছে সরকার বাড়ির দরজা-জানালা। ওগুলো খুব শক্তপোক্ত। ভাঙতে সময় লাগবে, খুটখাট আওয়াজও হতে পারে। এখানেও লোকজন উঠে গেলে কাজটা ঝামেলার হয়ে যাবে। ফটাফট টেলিফোনে ডেকে লোক জড়ো করবে, পুলিশে খবর দেবে। তাই সব চুপিসারে নামাতে হবে।”
“কীভাবে?”
একগাল হেসে মন্টু বললো, “কীভাবে আবার, ঐ ফুসফাসে।”
“এস্প্রে?” পাঁচু হেসে বললো, “তা, যদি জানালা বন্ধ করে ঘুমোয়?”
“এ তো আর কাঁচের ফেরেঞ্চ জানালা নয়, ফাঁক দিয়ে ঠিক গ্যাস ঢুকে যাবে। তারপর দশ মিনিটের মধ্যেই নিদুলি মন্তরে বাড়ি অচেতন। এবার গোটা দুই দরজা ভাঙো। তারপর দোতলার উত্তর-পুব কোনের ঘরটায় ঢুকে মাল তুলে নিয়ে বেরিয়ে এসো, ব্যস।”
“তুমি এত জানলে কীভাবে?”
“গুরুদের জানতে হয়। তবে ভুল করে সরকার বাড়ির ছেলেটাকে তুলিস না। ওই যে শুঁটকো-লম্বাটা গোলে খেলছে, ভালো করে দেখে নে। অন্ধকারেও তাহলে ঠাওর পাবি। কী রে, কিছু বাকি রইলো নাকি?”
“না, গুরু!” বিগলিত হেসে বললো দুই সাকরেদ।
কালু মিয়াকে হতাশার রোগে ধরেছে। বেশ কিছুদিন ধরে ছোট-বড় কোনো পার্টির ঘাড় ভাঙতে পারেনি, এখন গোটা পরিবারের সামনে অনাহারের হাতছানি। শেষ অবধি কি ঘাসপাতা খেয়ে থাকতে হবে নাকি? স্বীকার করো মিয়া, গতরটা বড় হলেও তোমার বয়েস হয়েছে। কিন্তু সেকথা কি পোড়া পেট মানে?
ভাবতে ভাবতে খেয়াল করেনি সে পায়ে পায়ে কখন শহরের দিকে এগিয়ে এসেছে। শহর তার পক্ষে নিরাপদ নয়। কিন্তু জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থেকেই বা লাভটা কী হচ্ছে? যাক, রাত হয়েছে – এখন লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতটা ঘুরেফিরে কিছু সুবিধে না হলে ভোরবেলা আবার বেরিয়ে পড়া যাবে। তারপর – নাঃ, আর সে ভাবতে চায় না!
ছোট শহর, রাতে রাস্তাঘাটে তেমন আলো নেই। শুধু এই বড় রাস্তাটা নিরাপদে পেরিয়ে যেতে পারলেই হলো। পেরোতে গিয়ে মনে হলো, দূর থেকে কারা যেন আসছে। দু লাফে রাস্তাটা পেরিয়েই কালু খিঁচে দৌড় লাগালো। আর ভয় নেই – এবার দুধারে প্রায় নিটোল অন্ধকার। আর বয়েস হলেও কালুর সাথে দৌড়ে পাল্লা দেয় কার সাধ্যি! ছুটতে ছুটতে একসময় সে একটু দম নেবার জন্য থামলো। পাশেই একটা তিনতলা বাড়ি। বিশেষ আলো দেখা যাচ্ছে না, মনে হয় দু-একটা রাতবাতি জ্বালিয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে। নীচের তলায় একটা গাড়িবারান্দার মতো জায়গা, তার এক পাশে অন্ধকারে কুঁকড়ে শুয়ে পড়লো কালু।
“কে যেন রাস্তাটা পেরিয়ে গেলো না, সুধীরদা?”
রাতপাহারার লীডার সুধীরদা একটু ভেবে বললেন, “ঠিক বুঝলাম না। একটা কালো ছায়া যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো। সত্যি, না চোখের ভুল কে জানে। চলো, একটু কাছে গিয়ে দেখা যাক।”
দেখেশুনেও অবশ্য কিছুই বোঝা গেলো না। ভুলই দেখেছেন তাহলে। আবার সবাই এগিয়ে চললেন। কিন্তু একটু পরেই বোঝা গেলো, আজকের রাতটা উত্তেজনায় ভরা। হঠাৎ মনে হলো, দূরে জঙ্গলের ধারে সাদামতন কী একটা নড়ছে। জায়গাটা অন্ধকার, শুধু চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট আবছায়া তৈরি হয়েছে। ওরা এগোবে কিনা ভাবছে, এমন সময় যেন শোনা গেলো একটা বাঁশির আওয়াজ – নাকি চাপা আর্তনাদ?
ছেলেদের চোখে ভয়ের ছায়া। একজন বললো, “চলুন, সুধীরদা – মানে, রাতে-বিরেতে, যদি তেনারা কেউ হন?”
“তুমি না সাইন্স পড়ছো?” লীডার এক ধমক দিয়ে বললেন, “চলো, দেখে আসা যাক।”
“কিন্তু – যদি মানুষ, মানে গুণ্ডা-ডাকাত হয়?”
“এটুকুতে ভয় পেলে চলবে? আমরা প্রায় পনেরো জন। আর আমাদের কাছে দু-একটা জিনিসও আছে। চলো স্কোয়াড, দ্বিধা ফেলে এগিয়ে চলো।”
সুতরাং দ্বিধা ফেলে বা না ফেলে স্কোয়াড এগিয়ে চললো – এই পরিস্থিতিতে দলছুট হয়ে পেছনে থেকে যাবার ঝুঁকিই বা কে নেবে? কাছাকাছি এসে মনে হলো, সত্যিই একটা মানুষ গুড়ি মেরে বসে। হঠাৎ মনে হলো, কিছু ফিসফাস কথাবার্তার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।
অসমসাহসী সুধীরদা এরপর নিজে সামনে দাঁড়িয়ে “এই, খবরদার, নড়বি না” বলে বিকট চিৎকার করেই সরাসরি গিয়ে চার্জ করলেন। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা গেলো, একটা নিশ্চল মূর্তি গাছতলায় বসানো। আর একটু দেখে বোঝা গেলো, একটা কাকতাড়ুয়া-গোছের জিনিসের ওপর সাদা চাদর জড়ানো হয়েছে। তার পাশে একটা বড় বাঁশের বাঁশি এমন কায়দা করে বসানো যে তার মধ্য দিয়ে হাওয়া বইলেই এক বিকট আওয়াজ হচ্ছে।
কিন্তু ফিসফিস কথাটা? হঠাৎ যেন সেটা আবার শোনা গেলো না? ফের তদন্ত করে সুধীরদা আবিস্কার করলেন একটু দূরে ঘাসের মধ্যে লুকোনো একটা টেপ রেকর্ডার অনবরত বেজেই চলেছে।
“কেউ আমাদের বুদ্ধু বানিয়েছে। কিন্তু কেন?”
“এ নিশ্চয়ই তপনদার দলের কাজ, সুধীরদা। ওরা আমাদের দেখতে পারে না, তাই নাকাল করে মজা দেখছে।”
“হলেই ভালো।” গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে সুধীরদা বলতে লাগলেন, “নাকি, কারণ আরো গুঢ় – কেউ আমাদের এভাবে সরিয়ে এনে সেই ফাঁকে কোনো বদ মতলব হাসিল করতে চায়? নে, তাড়াতাড়ি চল। দেখেছিস, টানে টানে আমরা শহর ছেড়ে কদ্দুর চলে এসেছি?”
সুধীরদা এবার জোরকদমে শহরের দিকে চললেন। তারপর কী ভেবে মোবাইলে স্থানীয় থানার ও-সি সীতেশ বড়ুয়াকেও একটা খবর দিয়ে রাখলেন।
এদিকে মন্টুর দলও জোরকদমে চলেছে। তাদের লীডারের মুখে ফিচেল হাসি। “দেখেছিস তো, হাফ লাইনকে কেমন ডজ মারলাম? রাতপাহারার দল এতক্ষণে পেট ভরে জঙ্গলের হাওয়া আর জঙ্গুলে মশার কামড় খাচ্ছে।”
“তোমার জুড়ি নেই, গুরু।” বলতে বলতে চেলারা সাথে সাথে ছুটছে। দেখতে দেখতে তারা সরকার বাড়ি এসে গেলো।
“এবার ডীপ ডিফেন্স।” বাড়ির কাছে এসে মন্টু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর স্কোয়াডকে কয়েকটা ফাঁক ফোকর দেখিয়ে দিলো। দেখতে না দেখতে সরকার বাড়ির ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো এক অদৃশ্য ঘুমপাড়ানি গ্যাস। বাড়িতে অবশ্য প্রায় সবাই অলরেডি গভীর ঘুমে। শুধু দাদুর সবে ঝিমটি ধরেছিলো, ঘুম আসেনি। তিনি টেরও পেলেন না কখন গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আর মানস একটা রহস্য উপন্যাসের শেষ পর্বে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছে, শেষ করে তবে শোবে। হঠাৎ কেন যেন চোখের পাতা ভীষণ ভারি হয়ে উঠতে লাগলো। আর এক পাতা এগোবার আগেই বই টুপ করে হাত থেকে খসে নীচে পড়ে গেলো।
“ডীপ ডিফেন্সও কিলিয়ার।” এবার অ্যাকশনের জন্য রেডি হ। নাকি কিছু ভুলে গেলাম?”
“ন্-না। কিন্তু গুরু ব্যাককে কাটালাম, এবার যদি গোলকিপার –”
“গোলকিপার? হা-হা, ভালো জোক করেছিস – সরকার বাড়ির গোলকিপার!” বলে মন্টু যন্ত্রপাতির ব্যাগে হাত দিলো।
কালু মিয়া গাড়িবারান্দার তলায় বসে ছিলো। রাতে তার ঘুম আসে না। কিন্তু হঠাৎ যেন বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। একটা ফুরফুরে আমেজ – নাক ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তার প্রায় মৌজ এসে গেছে। এমন সময় সদলবলে মন্টু সেখানে এসে উপস্থিত হলো। অন্ধকারে কালু মিয়া প্রায় ছায়ার মতো মিশে আছে। “নে, এই দরজাটাই ভাঙ”, বলতে বলতে মন্টু তার গায়ের ওপর এসে পড়লো।
“এগুলোর জ্বালায় – পৃথিবীর কোনোখানে শান্তি নেই!” প্রবল আস্ফালনে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো কালু মিয়া, তারপর এক ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়লো।
তারপর যে কী ঘটেছিলো, সেটা স্পষ্ট ধারণা করা শক্ত। কারণ এরপর সব খালি এলোমেলো কথা বা দৃশ্য। শুধু রাতপাহারার দল একটা বিকট আওয়াজ শুনে ঘুরে দেখে, সরকার বাড়ির থেকে তিনটে লোক “বাঁচাও, বাঁচাও” চীৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। “ধর, ধর” বলতে বলতেই তারা পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে রাতপাহারার বেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু পেছনেই থানার ও-সি জিপ নিয়ে আসছেন দেখে “বাঁচান, বড়বাবু – খেয়ে ফেললে!” বলে দৌড়ে তাঁর জিপে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলো।
জিপের মধ্যে তিন বন্দুকধারী সেপাই, সুতরাং ও-সি নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা কারা?”
“আজ্ঞে, আমরা মন্টু, যতে আর পাঁচু।”
“ওঃ, তোরাই সেই তিন গুণধর, যারা ঘুঘুডাঙায় ব্যাঙ্ক লুটেছিলি?”
“বলে লজ্জা দেন কেন, বড়বাবু!”
“তা, আমার এরিয়ায় কী করতে? মিথ্যে বললে কিন্তু –”
“বলছি হুজুর – দয়া করে নামিয়ে দেবেন না। ঐ সরকার বাড়িতে কলকাতা থেকে আসা ডাক্তারের ছেলেটাকে তুলতে এসেছিলাম। একবার কাজ হাসিল হলে ওর বাপের থেকে মোটা দাঁও মারার ইচ্ছে ছিলো। তাহলে আর অনেকদিন কাজকম্মে নামতে হতো না – মানে আমাদের শান্তি, আপনারও শান্তি।”
“তা, শান্তি স্বস্ত্যয়নটা হলো না কেন? আটকালি কীসে?”
“আজ্ঞে, সরকারবাবু যে ইয়াব্বড় এক কালটে চিতাবাঘকে গোলকীপার রাখবেন, জানবো কী করে? ইস, অমন ওপেন নেট গোলটা! তা, শিগগিরি গাড়ি চালান, বাবু – ঐ এলো বলে, খেলো বলে! আপনার পায়ে পড়ি নামিয়ে দেবেন না, বরং আমাদের হাজতে পুরে দিন।”
“কালো চিতাবাঘ, মানে প্যান্থার? তিলডাঙায়? কী খেয়ে কাজে নেমেছিলি, বলতো?”
“মা কালীর দিব্যি, বড়বাবু – কাজের দিনে দ্রব্য ছোঁয়া গুরুর নিষেধ।”
“ঠিক আছে, যা বোঝার বুঝেছি। তবে এত করে যখন বলছিস, হাজতেই চল।”
তিলডাঙার বিশেষ কেউও অবশ্য চিতাবাঘের গপ্পে বিশ্বাস করলো না। ডাকাতগুলো কোনো বড় কুত্তা-টুত্তা দেখে আচমকা ভয় পেয়েছিলো বলেই শেষ অবধি সাব্যস্ত হলো। শুধু মানসের ঘুমটা তখনো গাঢ় হয়নি, সে বারবার বলতে লাগলো যে আধঘুমে বাঘের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছে। তার কথাও একমাত্র দাদু ছাড়া কেউ বিশ্বাস করলেন না।
আর দিলু কসাই দিব্যি গেলে বলতে লাগলো যে গত রাতে কোনো একটা বড় জন্তু তার খোঁয়াড় থেকে একটা ছাগল তুলে নিয়ে গেছে। এটা তালেগোলে পঞ্চায়েতের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ছল বলেই সবাই সন্দেহ করলো। শুধু দাদু তাকে ডেকে বললেন – একটা কেন, তোকে আমি দুটো ছাগলের দাম দেবো। ও বাঘ আমার সোনা – আমাদের ধনেমানে বাঁচিয়েছে।
অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অনিরুদ্ধ সেন
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ-পর্ব ৩
.... অনিফিশ...সেই হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া পাপাঙ্গুলের ঘরে বসে সূর্যাস্ত দেখছিল। আস্তে অস্তে সন্ধ্যে নামছে সবুজ গাঁয়ে। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে..হোগলা পাতার ছাউনি থেকে টুপটাপ -টুপটাপ জল পড়ছে। বিকেল বেলার কমলা আলো আর বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধে অনিফিশ এর নরম মনটা আরো নরম হয়ে গেছে। অনেক হুড়োহুড়ি আর আনন্দের পর পাপাঙ্গুলের দেশের লোকেরা ফিরে গেছে তাদের নিজেদের বাড়ি...এখন অনিফিশ একটা ছোট্ট ছুটি পেয়েছে। পাপাঙ্গুলও নেই ঘরে, সে বেরিয়েছে তার "ডাকপুলি"র পুটুলি নিয়ে সারা গাঁয়ে ডাকপুলি বিলি করতে। তার সেই ডাকপুলি পেয়ে ছেলেরা সবাই খুব খুশী। কি সুন্দর ক্ষীরের পুলি ! তাতে আবার কি সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ। পাপাঙ্গুল তাকে বলেছে, সে এগুলো বাংলাদেশ থেকে এনেছে।ওখানে মা ঠাকুমারা শীতকালে নানা রকম পুলি পিঠে বানান।...আহা!তার নাকি ভারি ভালো স্বাদ। অনিফিশ তো কোনো দিনও বেশি দূরে যায়নি, এসব খায়নি, তার খাবার তো খালি সমুদ্রের ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন আর মাঝে মাঝে তারই মধ্যে কখনো যদি পায়, দু একটা ছোট্ট জলের পোকা। পাপাঙ্গুল অনিফিশকে দিয়েছে একটা পুলি। সেটা খেয়ে অনিফিশ তো বেজায় খুশী।
অনিফিশ আপন মনে বসে বসে ভাবছিল এসব কথা। হটাত করে পিছন থেকে পাপাঙ্গুলের গলা -"কি? আর একটা ডাকপুলি খাবে নাকি?" অনিফিশ খুব চমকে উঠে লজ্জা পেয়ে গেল...সে তো খুব লাজুক। এমনি করে জিজ্ঞেস করলে খুব লজ্জা পায়। তা ছাড়া সে যে এখন মনে মনে ডাকপুলির কথা ভাবছিল, পাপাঙ্গুল সেটা কি করে যে টের পেয়ে গেল সেটা ভেবে অনিফিশ খুব অবাক হয়ে গেল।
পাপাঙ্গুল অনিফিশকে বলল "অনিফিশ..তুমি চটপট তৈরী হয়ে নাও, তোমায় আজ এক্ষুনি একটা জায়গায় নিয়ে যাব।" অনিফিশ বলল, "আমার তৈরী হওয়ার কি আছে...তুমি আমায় সঙ্গে নিলে আমি সব সময় তৈরী।" এই বলে সে তার ছোট্ট পাখনা দুটো একটু নেড়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে নিল। তারপর পাপাঙ্গুলের হাত ধরে অনিফিশ চললো সেই সবুজ পথ বেয়ে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা একটা একটা টিলার নিচে এসে পৌছল। অনিফিশ চারিদিকে চেয়ে পাপাঙ্গুলকে বলল -
"আমরা এবার কোথায় যাব?"পাপাঙ্গুল তার সবুজ চুলটা একটু ঠিক করে নিয়ে বলল " তুমি আগে তোমার চোখ দুটো বন্ধ কর...দেখো তোমায় কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়।" এই বলে পাপাঙ্গুল তার হাত দিয়ে অনিফিশের চোখটা বন্ধ করে দিল।।অনিফিশকে একটা সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে নিয়ে চললো কিছুক্ষণ। ছোট্ট অনিফিশ তো ছটফটকরে বলে "পাপাঙ্গুল, ও পাপাঙ্গুল, আমরা কোথায় যাচ্ছি? বলো না...আমরা কোথায় যাচ্ছি?"পাপাঙ্গুল হাসতে হাসতে বলে চুপ করে দেখো না কোথায় নিয়ে যাই।..এ ভাবে কিছুক্ষণ চলার পর পাপাঙ্গুল অনিফিশের চোখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিল। অনিফিশ চোখ বন্ধ করেই বুঝলো একটা হালকা সবুজ আলোর আভাস...তারপর চোখ পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেল সবুজ মশালের আলো। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা মাঝে একটা ছোট জায়গা খুব সুন্দর। সেখানে সব পাপাঙ্গুলের দেশের লোকেরা এসে জড়ো হয়েছে।। ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-ছোট-বড় ..কেউ বাদ নেই।তারা সব্বাই সুন্দর করে সেজেছে, তাদের কারো হাতে সবুজ মশাল, কারো হাতে বাজনা। ছোট্ট ছোট্ট পাপাঙ্গুলরা ভেঁপু বাজছে, অনেকে আবার মাথায় সবুজ পালক দিয়ে সেজেছে।পাপাঙ্গুল মানেই তো সবুজ..এখানে সব্বাই সবুজ কে ভালবাসে। অনেকগুলো বাচ্ছা পাপাঙ্গুল ছুটে অনিফিশের কাছে এসে হাতে হাত ধরে গোল করে অনিফিশকে ঘিরে নাচতে সুরু করলো। অনিফিশ এসব দেখে আনন্দে আত্মহারা।সে খুশী ধরে রাখতে পারছে না, তার চোখের মনি দুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছে খুশিতে..চোখের কোণে দু ফোঁটা খুশির জল। সব্বাই চারিদিক থেকে গাইছে গান। "আহা আলঙ্গুশ...আজকে মোদের মেজাজ বড় খুশ।".....সব্বাই মিলে অনিফিশকে নিয়ে গেল সেই টিলার মাথায়।। সেখানে আগুন জ্বেলে বসে আছে বড়রা। তারা অনিফিশের গলায় একটা সবুজ ফুলের হার আর মাথায় পাতার মুকুট পরিয়ে দিল।পাপাঙ্গুলের দেশ তাকে স্বাগত জানালেও, অনিফিশ তো এই এত্ত আনন্দ এত্ত সব্বার ভালবাসা কোনো দিন দেখে নি তাই সে ভারী খুশি হয়ে পাপাঙ্গুলকে জড়িয়ে ধরল।পাপাঙ্গুল তার কানের কাছে মুখ এনে বলল -"আজ থেকে তুমিও আমাদের সবার প্রিয়জন হলে, দেখো তোমার মনের কোনো দুঃখ নেই তো? দেখো তুমি এক সাথে কত গুলো বন্ধু পেয়ে গেলে। অনিফিশ জীবন টাই তাই।। ভালোবেসে সবাইকে আপন করে নেওয়া ..একটু ভালবাসা অনেক মজা আর কখনো থেমে না থাকা, এরই নাম জীবন "- পাপাঙ্গুলের কথা শুনে অনিফিশ আবেগ ভরে বলল - "তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড পাপাঙ্গুল।তাই শুনে পাপাঙ্গুলও খুব খুশী। এরপর সবাই মিলে খুব লাফালাফি আরআনন্দ করে নাচতে শুরুকরলো।
লেখা ও ছবিঃ
অনন্যা দত্ত
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অনন্যা দত্ত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প