অটোগ্রাফ
খ্যাতনামা লোকেদের অঙ্গে
কলম থাকে সদা সঙ্গে।
না থাকলেও ক্ষতি নেই,
অনুরাগী এগিয়ে দেবে ভাই!
যদি তাঁরা প্রশ্ন করেন কি চাই?
"যদি দেন একটা সই"
সই দিয়ে ব্যথা হয় হাতে,
অনুরাগী ধন্য হয় তাতে।
ছাত্রের খাতায় থাকে শিক্ষকের সই
যদিও তা দিয়ে ছাত্রের প্রয়োজন নেই
প্রয়োজন আছে তার অভিভাবকেরঃ
তিনি দেখবেন কত উন্নতি হচ্ছে ছেলের!
"বিল" পাস হতে লাগে রাষ্ট্রপতির সই,
অধিকাংশ এম পির ও স্বাক্ষর চাই।
পাঁচ থেকে পাঁচশ টাকার নোটেও থাকে,
আর বি আই গভর্নরের সই, একটা ফাঁকে।
সই জাল করা নিয়ে হল কত গল্প
ছায়াছবির খোরাক ও হয়েছিল অল্পস্বল্প।
বিখ্যাত আঁকিয়েদের ছবি, যা দাগ কাটে মনে,
তাতেও থাকে স্রষ্টার সই, ছবির এক কোণে।
প্রথম অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে কি আনন্দ হয়,
নিজে ছাড়া কাউকে কি বুঝিয়ে বলা যায়!
কত বিখ্যাত লোক ই করেন একথা স্বীকার,
তার মধ্যে লুকিয়ে আছে কত গল্প মজার!
কিশোরদের খাতার পেছনে দেখতে পাওয়া যায়
হিজিবিজি আঁকিবুকি কে বুঝবে তায়?
কিন্তু যদি একটুখানি ভেবেচিন্তে দেখ,
বুঝতে বেশী সময় লাগবে নাকো -
কতরকম স্বাক্ষর নিয়ে পরীক্ষা করা,
সবচেয়ে ভাল যেটা, সেটা মক্স করা।
কারন শুধু একটাই,
ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে তাই।
যদি বিখ্যাত হয়ে যাই!!
তখন তো একটা জবরদস্ত সই চাই!
তাই তো বলি ভাই,
স্বাক্ষরের অনুশীলন চাই।
কৌস্তুভ রায়
আহমেদাবাদ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কৌস্তুভ রায়
- ক্যাটfগরি: ছড়া-কবিতা
বড়দিন
টুকাইয়ের মন ভালো নেই।
যেদিন ওর মা পঞ্চমীর হাত ধরে এই বাড়িতে কাজে ঢুকেছে, সেদিন থেকেই ওর ছোট্ট জীবনটা যেন পাল্টে গেছে। কাজ তেমন কিছুই না। এ বাড়ির মামা অফিসে যায়,মামী কলেজে পড়ায়। সারাদিন ফাঁকা বাড়িতে দেড় বছরের পিন্টুর সঙ্গী টুকাই। মা এই বাড়িতে রান্না করে আরও তিন বাড়িতে কাজে যায়। তারপর ওকে মামা-মামীর এঁটো বাসন মেজে, ঘর ঝাড়া-মোছা করে দিতে হয় , ওরা থাকতে থাকতেই। এরপর পিন্টুকে চান করানো,খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো-ওর নিজেরই ঘুম পায়।
খেয়ে উঠতে বেলা গড়িয়ে যায়। মামী ফিরে আসে। চা করে দিয়েই পিন্টুকে নিয়ে ও পার্কে যায় বেড়াতে। মামা ফিরবার পর কেউ না কেউ আসে বাড়িতে। পিন্টুর জন্য খেলনা, জামাকাপড় নিয়ে আসে। সবাই বলে মেয়েটাকে তো বেশ পেয়েছো, দাও না ভাই আমাদের জন্য একটা দেখে। মামা ভালো ভালো খাবার আনে। সবার হয়ে গেলে ও একটু ভাগ পায়। রাতে খাবার টেবিলের পাশে, মাটিতে বসে ও খায়। মেঝেটার ঠান্ডা লাগে ইজেরের তলা দিয়ে। ও বলে না কিছু।
রান্নাঘরের পাশে মাটিতে ওর বিছানা। সবাই শুয়ে পড়লে পুতুলটা বার করে। তার একটা চোখ নেই।চুলগুলোও উঠে গেছে। অনেকদিন আগে বাবা কিনে দিয়েছিলো। বাবা এখন জেলে। একদিন স্বপনকাকু আর মা-কে নিয়ে কী একটা হয়েছিল । বাবা খুব মারলো স্বপনকাকুকে। তারপর পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে গেলো। স্বপনকাকু এখন আর আসে না।বগলে একটা কাঠের ডান্ডায় ভর দিয়ে হাঁটে। বাবা টুকাইকে খুব ভালোবাসতো। অনেক লেখাপড়া শেখাবে বলেছিলো। মামী পিন্টুকে 'অ-আ-ক-খ' আর 'এ-বি-সি-ডি' শেখাতে চেষ্টা করে। টুকাইও একটু একটু শেখে, আবার ভুলে যায়। তাতে কিছু না, কাজগুলো ভুললেই ভয়।
মামা-মামী অবশ্য খুব ভালো। পিন্টুর অনেকরকম দিদি আছে,তাদের ছোটো হয়ে যাওয়া পুরনো জামা মাঝে মধ্যেই এনে দেয়। গাড়ি করে বেড়াতে গেলে ওকে নিয়ে যায়। চিড়িয়াখানাও নিয়ে গিয়েছিলো। তবে পুজোর সময় গোয়া না কোথায় গিয়েছিলো অনেক দিনের জন্য তখন টুকাই মার কাছেই ছিলো। ওরা ফিরে আসার পর ছবিগুলো দেখেছিলো টুকাই। কী দারুণ! পাহাড়, সমুদ্র -কী নীল। পিন্টু কি মজা করেছে ওখানে। সেই প্রথম ওর পিন্টুকে হিংসা হয়েছিলো।
আজ সকালে একটা মজা হয়েছে।
পাশের বাড়িতে একটা দাদু থাকে, সব চুল সাদা আর ইয়া মোটা। মূর্তি গড়ে। মাঝে মাঝে অনেক লোক আসে বাড়িতে ট্রাকে চাপিয়ে বিরাট বিরাট কালো সাদা মূর্তি নিয়ে যায়। আজ মামা-মামী চলে যাবার পর ও পিন্টুকে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে, দাদুটা ডাকলো। কিন্তু কিন্তু করেও দরজায় তালা দিয়ে, পিন্টুকে নিয়ে ও দাদুটার বাড়ি গেল।
দাদুটা ওকে নিয়ে গেল বিরাট একটা ঘরে। বাব্বা! সেখানে কত পুতুল আর মূর্তি। মানুষ, বাঘ,বেড়াল, গণেশ আরও কত কী! আবার একটা কাঠের গুঁড়ির মধ্যে তিনটে বানর ছানা। টুকাই তো হাঁ।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো নিজেরই খেয়াল নেই। হঠাত দাদুটা বললো,"দ্যাখতো চিনতে পারিস কিনা?" এ কী? যে গোল টেবিলটার ওপর একতাল মাটি ছিলো-সেখানে ওটা কে? ও মা! এ যে টুকাই নিজেই। দাদু বললো,"তুই এতো সুন্দর দেখতে, তাই ভাবলাম তোকে বাড়িতেই রেখে দিই। এবার বল দেখি,হয়েছে কিনা তোর মতো?"
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে,এক ছুট্টে ও বাড়ি চলে এলো পিন্টুকে নিয়ে। অনেকক্ষণ লাগলো বুক ঢিপঢিপটা ঠিক হতে। তারপর ও বুঝলো মনটা
ভালো হয়ে গেছে। আর কক্ষোণো পিন্টুকে হিংসা করবে না টুকাই।
পার্থ দাশগুপ্ত
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন পার্থ দাশগুপ্ত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
বন্ধু কোথায়...
অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো রিয়া আর মৌনিকা। উফ যা টেনশান।
এখন কয়েকটা দিন শুধু মজা। রিয়া মৌনিকাকে বললো,"এবারের ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় বলতো? "
মৌনিকা তখনি বললো, "আমি একটা সুন্দর জায়গা জানি। জায়গাটার নাম দেবপুর। সেখানে আমলকি গাছের ওপরে পাখিরা গান করে। নীচে পড়ে থাকা আমলকি কুড়োতে ভিড় করে কতশত কাঠবেড়ালী। মাঠ জুড়ে ঘুরে বেড়ায় হরিণের দল। দূর থেকে ভেসে আসে ঝরণার জলের ঝিরঝির শব্দ।" আনন্দে রিয়া লাফিয়ে উঠলো। মৌনিকাকে জড়িয়ে ধরে বললো, "কেমন করে আমরা যাবো দেবপুর?" মৌনিকা বললো, "কেন ট্রেনে করে। সেখানে তো আমার মাসির বাড়ি।"
বাড়ি গিয়ে বাবা -মা দের রাজি করানোটা অবশ্য একটু মুশকিল হল প্রথমে। দুই বাড়ির বড়োরা কেউ রাজি হচ্ছিলেন না দুজন কে একা একা ছেড়ে দিতে। কিন্তু শেষ অবধি মৌনিকা আর রিয়া ই জিতে গেল। দেবপুর লোকাল ট্রেনে ঘন্টাখানেকের পথ, আর ওখানে স্টেশনে মেসো নিতে আসবেন। তাছাড়া দুজনের কাছেই তো মোবাইল ফোন আছে, তাই চিন্তা কিসের? বাবা মা তো চাইলেই কথা বলতে পারবেন।
চারদিনের মাথায় সক্কালবেলা দুই বন্ধু রিক্সা চেপে মনের আনন্দে স্টেশনে পৌঁছোলো। মৌনিকা গেল লোকাল ট্রেনের টিকিট কাটতে আর রিয়াকে সব জিনিপত্র দেখার জন্য একটা বেঞ্চিতে বসতে বললো। রিয়া মৌনিকাকে বললো, "শোন টিকিট কিনে ফেরার সময় একটু ঝালমুড়ি কিনে আনিসতো। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।" মৌনিকা খিচমিচ করে উঠলো, "এইতো বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে লুচি,ফুলকপির তরকারি,নলেন গুড়ের সন্দেশ সব চেটেপুটে খেলি। আবার এখনি তোর ক্ষিদে পেয়ে গেলো?" রিয়া তবুও ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলো। মৌনিকা বললো,"আচ্ছা বাবা নিয়ে আসছি। কিন্তু চুপটি করে বসে থাকবি কোথাও যাবি না।"
আসলে দুজনে একক্লাসে পড়লেও মৌনিকা একটু বেশি হম্বিতম্বি করে। রিয়া কিছু বলে না। আসলে ওরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু। একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারে না।
টিকিট কাউন্টারে গিয়ে মৌনিকা দেখলো বিশাল লাইন। সবাই বেড়াতে যেতে চাইছে। মৌনিকা সেই ভিড় লাইনে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়িওলাকে খুঁজতে থাকলো। এমন সময় মৌনিকা শুনতে পেল প্রচন্ড গোলা-গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ। পিছনে ফিরে দেখে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে,চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে অসহায় মানুষ। মৌনিকা কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। বাইরে বসে আছে তার প্রিয় বন্ধু রিয়া। সেখান থেকেই ছুটে আসছে আগুনের হল্কা,গুলির শব্দ। মৌনিকা ছুটে বাইরে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। একজন কম্যান্ডো অফিসার ততক্ষণে ধরে ফেলেছেন মৌনিকাকে। চেঁচিয়ে বলছেন, "কেউ ওদিকটায় যাবেন না। ব্যারিকেডের পাশের ঘরটায় চলুন। হ্যাঁ টিকিট ঘরের পেছনের ঘরটায়।" মৌনিকা কম্যান্ডো অফিসারকে বোঝাবার চেষ্টা করলো তার প্রিয় বন্ধু রিয়া বাইরে। অফিসার কোনো কথা শুনলেন না। বললেন,"আপনারা কেউ বাইরে বেরোবার চেষ্টা করবেন না। কেউ ডাকলেও দরজা খুলবেন না। জঙ্গীরা গোটা শহরটা ঘিরে ফেলেছে।"
ঘরবন্দি মৌনিকা বারবার রিয়াকে মোবাইলে ট্রাই করলো। কিন্তু পেল না। বাড়িতে ও করল, সেখানেও পেল না। গভীর চিন্তা আর অবসাদে তার সারারাত কাটলো। মোবাইলের নেটওয়ার্ক কখন চলে গেছে খেয়াল নেই। কারো খাওয়া নেই, ঘুম নেই। একটু খাবার জল নেই। বড় ঘরটায় শুধু নেই আর নেই এর বিলাপ। বাথরুমের গন্ধ। ঠিক কখন মনে নেই, হয়তো বিকেলের দিকে ঘরের বড় দরজাটা খুললো। সেই কম্যান্ডো অফিসার বললেন, "আপনারা সবাই বিপদ মুক্ত।" ঘর থেকে বেরিয়েই মৌনিকা ছুটলো সেই বেঞ্চির দিকে যেখানে রিয়া কাল সকালে বসেছিলো। কিন্তু কোথায় রিয়া? চারিদিকে শুধু চাপচাপ রক্ত, মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ, পোড়া মাংসের গন্ধ। কিন্তু ওটা কি? আরে ওই তো রিয়ার লাল রঙের ব্যাগ। এগিয়ে যায় মৌনিকা। তারপর শুধু তাকিয়ে থাকে গুলিতে ঝাঁঝরা তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু রিয়ার নিথর দেহের দিকে।
ততক্ষণে মৌনিকাকে ঘিরে ধরেছে টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে যাচ্ছে একের পর এক। কী দেখেছো? তোমার কেমন লাগছে? আর কে কে ছিলো?মৌনিকা মাথা নীচু করে আস্তেআস্তে হাঁটছিলো। এবার সে দাঁড়িয়ে পড়লো। যারা এতক্ষণ তাকে প্রশ্ন করছিলো তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি ঝালমুড়িওলাকে খুঁজছি। কাল রিয়া,আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ঝালমুড়ি খেতে চেয়েছিলো।" এই প্রথম মৌনিকা আর কথা বলতে পারলো না। তার চোখ আর গাল বেয়ে গড়াতে থাকলো সেই ঝিরঝিরে ঝরণাটা। যাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিলো মৌনিকা আর রিয়ার।
সৃজনী লাহিড়ী
সপ্তম শ্রেণী,পাঠভবন,ডানকুনি
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সৃজনী লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ফেস্টিভ্যাল অফ লাইট
বহু বছর আগের কথা। তখন আসানসোল আজকের মত জনবহুল শহর ছিল না।ছিল না এত ব্যস্ততা। মহকুমা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে মাত্র। ধস ধস শব্দ করে হাজার রকমের কলকব্জা পেটে পুরে ই-আই-আর লাইনের ইঞ্জিন যাওয়া আসা করত হরদম। ভোঁস ভোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ত বিশাল বিশাল স্টীম ইঞ্জিন গুলো। দূরে আকাশে কুন্ডলি পাকাতে পাকাতে মিশে যেত সেই ধোঁয়া। জানলায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে দেখত হিল্ডা। সামনে ফাঁকা মাঠ আর ঝুপড়ি জঙ্গল, তার ওপাশে কাঁটা তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে ইঞ্জিনের চাকা ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক, ওর মনটাও যেন চলত সেই সঙ্গে। ফাদার বলতেন, "বাছা, জানলা বন্ধ করে দাও"। নিঃশব্দে জানলা বন্ধ করে সরে যেত হিল্ডা।
সেই কোন ছোট্টবেলায় ফাদার জেকব হিল্ডাকে এনেছিলেন এই মিশনারি স্কুলে, কোথায় তার বাড়ি ছিল, কিছুই তার মনে পড়েনা। এখানেই সে পড়াশোনা করে। শহরের একপ্রান্তে এই মিশনারি স্কুল ই তার বাড়িঘর সবকিছু। এই স্কুলে পড়াশোনা করে খনি অঞ্চলের গরিব দুঃখী ছেলেমেয়েরা আর থাকে অনাথ শিশুরা। ফাদার হিল্ডাকে একদম ছোট ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার ভার দিয়েছেন। হিল্ডা তাদের সাথে গল্প করে, খেলা করে। মিশনের গরুগুলোকে জল দেওয়া, বাগানের ছোট ছোট চারাগাছগুলোর যত্ন নেওয়া তার কাজ। সন্ধ্যায় যখন গীর্জার ঘন্টা বাজে ঢং ঢং করে, সেই শব্দে উড়ে যায় ঝাঁকে ঝাঁকে বক, কাক, আরো কতরকমের পাখি। হিল্ডা অবাক হয়ে দেখে ওদের মুক্ত ডানায় ভর দিয়ে উড়ে যাওয়া। এক চক্কর দিয়ে আবার এসে বসে গাছে। তখন ফাদার পিয়ানো নিয়ে বসেন। প্রার্থনা হয়ে গেলে হিল্ডা কে গান শেখান। বড়দিনের উতসবে হিল্ডা সেই গান গায়।
হিল্ডা হাঁটে চলে নিঃশব্দে, পরনে তার সাদা পোশাক, মুখে তার যেন সর্বদা এক বিষাদের ছায়া। দূরে দেখা যায় মস্ত ইঞ্জিন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ঘাসের গালিচা ভেদ করে আঁকাবাঁকা লাইনের উপর দিয়ে চলেছে। হিল্ডার মন চলে যেতে চায় তার সঙ্গে। সে ভাবে তার পরিবার কেমন ছিল, তার বাবা মা কারা ছিলেন, তার কোন ভাইবোন ছিল কিনা... ফাদার তাকে বলেছেন ঈশ্বরপুত্র যিশু যেমন সবার পিতা, তেমন তারো পিতা। চারিপাশের জীব -জন্তু মানুষ সবাইকে ভালবাসতে হবে , তাহলেই যিশুকে ভালবাসা হবে। ঈশ্বরের ভালবাসা পেতে হলে কোন কঠিন তপস্যার প্রয়োজন নেই, চাই শুধু নিঃস্বার্থ ভাবে নিজের কাজ করে যাওয়া।
দিন যায়, শরত গিয়ে হেমন্ত আসে, নিস্তরঙ্গ জীবনে মাঝে মাঝে এখানে ওখানে ছোট ছোট ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ঢেউ ওঠে। হেমন্ত ও চলে যায়, আসে শীত। সন্ধ্যের আগেই অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধকার যত গাঢ় হয়, শীত ও যেন জাঁকিয়ে বসে তত। দেখতে দেখতে খ্রিসমাস এসে গেল। ফাদার হিল্ডাকে এক নতুন দায়িত্ব দেন খ্রিসমাস এর জন্য গীর্জা সাজানোর।
স্কুলের বাগানের চারাগাছগুলো ভরে ওঠে নানারকম মরসুমি ফুলে। হঠাত হিল্ডার গতিবিধি যেন পালটে যায়। এখন হাঁটলে তার পায়ের শব্দ পাওয়া যায়, পোষাকে আশাকে যেন একটা উজ্জ্বলতার ছোঁয়া। হাতে নানা জিনিষ পত্র নিয়ে সে ফাদারের ঘরে দিনে কতবার যে আসাযাওয়া করে, তার হিসাব থাকে না। এখন আর সে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকে না।
আজ খ্রিসমাস ইভ, কাল খ্রিসমাস ডে। স্কুলের পেছন দিকের ছায়া ঘেরা বনপথ দিয়ে ফাদার, স্কুলের শিক্ষকেরা, আর ছেলেমেয়েরা গীর্জায় আসে। দূর থেকে দেখা যায় দরজায় দরজায় প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে আলোর মালা যেন। মোম জ্বেলে আলোকময় করে তোলা হয়েছে চারদিক। সব দীপ জ্বালিয়েছে হিল্ডা। নিজের হাতে হিল্ডা তৈরি করেছে নানা জিনিস, আর অনেকগুলি ছোট চ্যাপেল। চ্যাপেলগুলিতে আছে পরমপিতা যিশুর জীবনের সমস্ত ঘটনার বর্ণনা। হিল্ডার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ফাদার দেখলেন, হিল্ডা তেমনি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু মুখের উপর থেকে সরে গেছে সেই বিষাদের আবরন, আলোয় উদ্ভাসিত তার শান্ত মুখে যেন লেগে আছে একটুখানি মুক্তির হাসি। ফাদার বুঝলেন ঈশ্বরের কাজের মাঝে থেকেই হিল্ডা আজ অনুভব করেছে ঈশ্বরের ভালবাসা।
ই-আই-আর লাইনে ইঞ্জিন যাচ্ছে ধস ধস করে। অন্ধকারে ধোঁয়ার কোন আভাস ই দেখা যায়না। দেখা যায় শুধু শত শত মোমের আলোর রোশনি। সেই আলোয় সবার ই মুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ফাদার, হিল্ডা আর গীর্জায় আসা অনেক মানুষের।
ছন্দা দে
রূপনারায়ণপুর
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ছন্দা দে
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক
সামনের জমি থেকে প্রচুর ধোঁয়া উঠছে। কোনো কোনো গর্ত থেকে হিস্হিস্ গরম জল বেরিয়ে আসছে। জল এত গরম যে কাছাকাছি গেলে গরম হল্কা টের পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে তাকালে জল ফোয়ারা হয়ে বেরিয়ে আসছে। কোনো ফোয়ারাটা এতো জোরে মাটি থেকে বেরোচ্ছে যে ফোয়ারার জল কুড়ি থেক তিরিশ তলা উঁচু বাড়ি ছাড়িয়ে চলে যাবে। জায়গাটার নাম ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক। আমেরিকার ওয়াইওমিং রাজ্যের পশ্চিম কোণে। আমরা গাড়ি থামিয়ে, সামনের মাঠটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সন্ধ্যে নেমে আসছে। গাড়ি নিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম আমদের হোটেলের দিকে যেখানে আমরা রাত কাটাবো। যাবার পথে একদিকে দেখি মাঠের মধ্যে মোটা মোটা বাইসন ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইসনগুলো ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে মাটিতে জোরে জোরে খুর ঠুকছে। আর তখন চারপাশ ধুলোয় ভরে যাচ্ছে। বাইসনকে দেখতে শান্ত, নিরিহ মতো। কিন্তু মুখটা গম্ভীর যেন বলে দিচ্ছে-আমাকে ঘাঁটিও না। অবশ্য তার সিং ও চেহারা দেখলে ঘাঁটানোর সাহস হবে না। বাইসন নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে পরে বলছি। এই বাইসনটা রাস্তার ধার ধরে হাঁটছিলো।
রোদ পড়ে এসেছে,সময়টা অগষ্ট মাস। এই সময়ে রোদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাত চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তাই আবার আমরা রওনা দিলাম। সামনে একটা উঁচু পাহাড়। সেটা পেরোলেই আমাদের হোটেল। গাড়িটা পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলাম সামনে উঁচু পাহাড়টার ওপরে কিছু নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। বাইনাকুলারটা চোখে লাগিয়ে দেখতে পেলাম-হরিণ,প্রচুর হরিণ। এতো হরিণ আগে কখোনো দেখিনি। বাচ্চা হরিণ, শিংওলা হরিণ, শিং বিহীন হরিণ সবাই মিলে দঙ্গল বেঁধে পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে খাবার খাচ্ছে। আর একটু কাছে যাবার পর খালি চোখে দেখা গেলো। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেছে বলে আর ছবি তোলা গেল না। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হোটেলের দিকে।
অন্ধকার নেমে আসলো। এতো অন্ধকার যে এক হাত দূরের জিনিষ দেখা যায় না। শুধু চারিদিকে মাটি থেকে হিসহিস করে গরম জল ওঠার শব্দ শোনা যায়। কান পাতলে মনে হবে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। সেই অন্ধকারে গা ছমছম করে ওঠে। হোটেলের বাইরে আলো ছাড়া ঘুরতে যাওয়া নিরাপদ নয়। আমরা রাতের খাবার খেয়ে গল্প করতে করতে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম...আমি যেন এক স্বপ্নের দেশে চলে গেছি। রূপকথার রাজপুত্রের মতো আমাকেও তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে হবে। সামনে ধোঁয়া ভরা মাঠ। বাইসনগুলো চোখে চোখে রাখছে। আমাকে বাইসনের মধ্যে দিয়ে ফুটন্ত গরম ফোয়ারার মধ্যে দিয়ে মাঠ পেরোতে হবে। আমি হাঁটবো না দৌড়াবো ঠিক করতে পারছি না। হঠাত বাইসনগুলো হেসে বললো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ কোন জায়গায় এলাম যেখানে বাইসন কথা বলে!
পরের দিন সকালে উঠে প্রথমেই যেটা চোখে পড়লো সেতা এই নীচের ছবিটার মতো। নাম জানলাম ফিউমারোল [fumarole]। জায়গাটা দেখে মনে হলো এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা।
এখানে মাটি এতো গরম যে জল বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। বাষ্প আর অন্যান্য গ্যাস বেরিয়ে আসছে ওপরের ছবিটাতে। চারিদিকে একটা তীব্র রাসায়নিক রাসায়নিক গন্ধ। কাছাকাছি আরো অনেক জিনিষ দেখলাম ও জানলাম যা আগে কখোনো দেখিনি। নাম জানলাম গীজার ( geyser)- উষ্ণ প্রস্রবণ এবং মাডপট। নীচের ছবিটা ওল্ড ফেইথফুল গীজারের। ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক সবচেয়ে জনপ্রিয় দেখার স্থান।
জলটা ১৮০ থেকে ১৯০ ফুট উঠে যায়। প্রত্যেক ৯০ মিনিট অন্তর এই গীজার টা থেকে গরম জল ফোয়ারা হয়ে বেরিয়ে আসছে। ৯০ মিনিট অন্তর ফোয়ারার জল আসে বলে একে পুরোনো বিশ্বস্ত (old faithful) বলে। একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে মেলানো যাবে।
জায়গাটা রূপকথার দেশ। প্রত্যেক পদে পদে নতুন জিনিষ দেখার,নতুন জিনিষ জানার। ইয়েলোস্টোন পার্কে পৃথিবীর সবচেয়ে জিওথার্মাল বিষয়ক জিনিষ দেখার আছে। আমি ভারতে বেশি জায়গা ঘোরার সুযোগ পাইনি। তোমাদের জানা যদি কোনো জায়গায় তোমরা এই ধরনের জিনিষ দেখে থাকো তাহলে আমাকে জানিও। পরেরবার ভারত গেলে আমি সেখানে বেড়াতে যাবো।
জায়গাটাতে বন্য জন্তু আছে অনেক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ভাল্লুক। আমরা ভাল্লুক দেখতে পেয়েছি। এটা চিড়িয়াখানার ভাল্লুক নয়। তাই কখোনো ভাল্লুক দেখা যায়,আবার কখোনো দেখা যায় না। গ্রিজলি ভাল্লুক আর কালো ভাল্লুক দুটোই আছে এখানে। আমাদের
ভাগ্য খুব ভালো ছিলো, দুধরনের ভাল্লুক দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু তারা এতোটাই দূরে আছে আর আমার কাছে দূরের ছবি তোলার
লেন্স ছিলো না। নীচের দুটো ছবি ইয়োলোস্টোন ন্যাশানাল পার্কের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। ছবি গুলি সবার ব্যবহারের জন্য অনুমতি
প্রাপ্ত।
নীচের ছবিটা কালো ভাল্লুকের। গায়ের রঙ কালো। আর পিঠে কোনো কুঁজ নেই।
এটা গ্রিজলি ভাল্লুকের ছবি। এর পিঠে বড় কুঁজ আছে। এই কুঁজ দেখে বোঝা যায় কোনটা গ্রিজলি আর কোনটা ব্ল্যাক বা কালো ভাল্লুক। দুজনেই কিন্তু সমান ভাবে ভয়ঙ্কর।
এবারে বাইসনের মজার গল্পটা বলে আমার লেখা শেষ করি। সকালবেলা বেরিয়ে ভাল্লুক, হরিণ, এল্ক এইসব বন্য জন্তু দেখে আমদের মনটা বেশ খুশি খুশি। আমি ড্রাইভ করছিলাম আর আমার পাশে আমার বউ পিউ বসেছিলো হাতে ক্যামেরা নিয়ে। একটা জায়গায় এসে রাস্তা দু দিকে ভাগ হয়ে গেছে। আমি বাঁ দিকের রাস্তাটা নিলাম। গাড়ি ঘোরাতে সামনে অবাক হবার পালা। রাস্তা জুড়ে বাইসনের দল। আমাদের যাবার জায়গা নেই। তাই আমরা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাইসনের দলটা আমাদের থেকে ২০-৩০ ফুট দূরে। আমাদের আগে বা পেছনে কোনো গাড়ি নেই।
এইভাবে পাঁচ মিনিট কাটলো। বাইসনের দল নড়ার কোনো ইচ্ছা দেখাচ্ছে না। আমরা ভাবছি হর্ণ বাজাবো কিনা। আবার হর্ণ বাজালে আমাদের গাড়ির দিকে যদি ছুটে আসে ! কি করবো ঠিক রতে পারছি না।
এমন সময় একটা বাইসন দলছুট হয়ে আমাদের গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। আমাদের গাড়ির দিকে বাইসনের হাঁটার গতি যত বেড়ে যাচ্ছে ততই আমাদের বুকের ভেতর জোরে জোরে ড্রাম বাজতে শুরু করেছে। গাড়ি ঘোরানোর জায়গা নেই। আমি ফিসফিস করে পিউকে বললাম, ছবি তোলো...ছবি তোলো। তিন-চারবার বলার পর পিউয়ের ছবি তোলার কোনো আওয়াজ পাচ্ছি না বলে পিউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি পিউ ক্যামেরা অন করার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত কাঁপার জন্য ক্যামেরা অন আর হচ্ছে না। আমিও ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। আমার গা,হাত,পা সব অবশ। বাইসনটা
পাঁচ-ছয় ফুট দূরে চলে এসেছে। এরমধ্যে সে তার হাঁটার দিক পরিবর্তন করেনি, সোজা আমাদের গাড়ির দিকেই আসছে। আরো কাছে চলে এসেছে। আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। যে কোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ হবে। কোনো আওয়াজ না পেয়ে সাহস করে চোখ খুলে দেখি বাইসনটা মাত্র দু ফুট দূরে। হঠাত বাইসন হাঁটার দিক পরিবর্তন করলো। বাঁদিকে ঘুরে গিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
বাইসন আমাদের ফেলে চলে গেলে আমরা আবার নিশ্বাস নিতে নিতে পারলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম বাইসনের দৃষ্টি শক্তি তেমন প্রখর হয় না। তাই দূরের কিছু দেখতে পায় না। বাইসনটা আমাদের তাড়া করেনি, হয়তো আমাদের দেখতেও পায়নি। কাছে এসে গাড়িটা দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমরা ভয়ে নড়তে পারছিলাম না। এখন হাসি পায়, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমরা ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম।
জায়গাটাতে বন্য জন্তু ছাড়াও আরো অনেক কিছু দেখার আছে। ভূপ্রাকৃতিক জিনিষ যেমন জলপ্রপাত, ক্যানিয়ন আছে। ইয়োলোস্টোনে গোটা পৃথিবীর অর্দ্ধেক জিওথার্মাল দ্রষ্টব্য জিনিষ আছে। পার্কে আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের বাস করার নিদর্শন আছে। সেটা নিয়ে অন্য একদিন গল্প করা যাবে। বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে পার্কের ওয়েব সাইটে( http://www.nps.gov/yell/index.htm)
আগামী সংখ্যাতে আমি এমন একটা জায়গা নিয়ে লিখবো যেখানে অনেক ধরনের টিয়া পাখি আছে। সে এক মজার জায়গা। এই লেখাটা পড়ে তোমাদের প্রশ্ন থাকলে জানিও। আর অবশ্যই জানিও কেমন লাগলো। ভালো থেকো সবাই।
লেখা ও ছবি-
দেবাশিস পাল
ওকলাহোমা সিটি
- বিস্তারিত
- লিখেছেন দেবাশীষ পাল
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে