আমার ছোট্টবেলাঃপর্ব ৪
গত সংখ্যায় সন্ধ্যাবেলার ভাল লাগার কথা বলেছিলাম, এবারসন্ধ্যার খারাপ লাগার কথা বলি। ছোটবেলায় প্রায় সবাই একটু ভিতু থাকে বোধ হয়,তাই না? আমিও ছিলাম।
লন্ঠনের আলোয় ঘরের দেওয়ালে পড়া লম্বা লম্বা ছায়াগুলো দেখলে গা ছম ছম করত। দাদুর কাছে শোনা গল্পের মধ্যে কোনটা ভূতের হলে তো কথাই নেই। দিয়ানীর কোলে সেঁধিয়ে যেতাম একেবারে।
পড়া হয়ে গেলে রোজই ছিল দাদুর কাছে গল্প শোনা। কাজ সেরে বড়রা একে একে জড়ো হতেন দাদুর ঘরের দাওয়ায়। দাদু আলবোলায় গুরুক গুরুক করে তামাক খেতেন। নানা রকমের কথা হত সে সময়।
কি একটা পাখি এক নাগাড়ে কুঁক কুঁক করে চলত। একঘেয়ে ঐ ডাকটাকে কেন জানিনা ভয় পেতাম দারুন।
দাদুর একটা বন্দুক ছিল। সেটা ছিল গ্রামের মানুষের বল ভরসা। কোনো বিপদ আপদ হলেই তারা দাদুর কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে আসত।
একবার কি হয়েছিল শোনো। ক'দিন ধরে শোনা যেতে লাগল কি একটা জানোয়ার এসেছে গ্রামে । বিটকেল দেখতে । খরগোশের মত বড়। গায়ে বড় বড় কাঁটা, দৌড়লে নাকি ঝুম ঝুম করে আওয়াজ হয় । তাড়া করলে গর্তে বা ঝোপ ঝাড়ে লুকিয়ে পড়ে।
মাতব্বরেরা দাদুর কাছে এলেন এই আবেদন নিয়ে যে ওটাকে মারতে হবে । সব কিছু শুনে দাদু বললেন যে ওটা সজারু হতে পারে। নিরীহ প্রানী, কোনো ক্ষতি করবে না। তাই মারবার দরকার নেই।
কিন্তু কে শোনে সে সব কথা।সবার এক অনুরোধ ওটাকে মারতে হবে। অগত্যা দাদু রাজী হলেন।
একদিন বিকেলের দিকে কয়েকজন লোক এসে দাদুকে ডেকে নিয়ে গেল।সন্ধ্যের মুখে মড়া জানোয়ারটাকে নিয়ে অনেকেই এলেন আমাদের বাড়ীতে।কৌতুহল নিয়ে দেখতে গিয়ে ভয়ে গুটিয়ে গেলাম। গায়ে বড় বড় কাঁটাওয়ালা ছিন্ন ভিন্ন জন্তুর মরদেহ থেকে বিকট দুর্গন্ধ বেরচ্ছে। ঐ সব দেখে শুনে আর গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল একেবারে। দিয়ানীর আঁচল ধরে পেছন থেকে উঁকি মেরে দেখতে দেখতে দুচোখ ভরে জল এলো। সজারুটার জন্য তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
অনেকেই বলাবলি করছিল যে ওর একটা জোড়া থাকা সম্ভব। সেদিন সন্ধ্যা থেকে কোন শব্দ হলেই কেবলই মনে হত যে জোড়ার অপর সজারুটা এসেছে বোধ হয়। এই বোধ হয় তেড়ে কামড়াতে এল বা ভয়ংকর কাঁটা ফোটাতে এল। আর ঐ বোঁটকা গন্ধটা যেন নাকের সাথে লেপ্টে আছে। কত দিন যে ছিল !
সজারু সম্পর্কে কিছু কথা এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি । এ সব তখন জানতাম না পরে জেনেছি।ওদের গায়ে যে কাঁটা হয় সেগুলো তিন চার ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। আর খুব ছুঁচলো। আমার কাছে ঐ কাঁটা কয়েকটা অনেক দিন ছিল, এখন হারিয়ে গেছে। সজারু ভয় পেলে নিজের শরীরটাকে গুটিয়ে কাঁটাওয়ালা গোল বলের মত করে ফেলে যাতে কেউ আক্রমন করতে না পারে। করতে এলে সে কাঁটার খোঁচা খেয়ে পালিয়ে যায়।
কিন্তু শেয়াল ভারি চালাক। সজারুর মাংস খেতে খুব ভালবাসে। সে কাঁটার বলের মত সজারুকে সাবধানে ঠেলে ঠেলে কোন পুকুর বা জমা জলের মধ্যে ফেলে দেয়। সজারু ডুবে যাবার ভয়ে হাত পা ছড়িয়ে সাঁতার দিতে গেলে শেয়াল আক্রমন করে তাকে মেরে ফেলে।
যাক যে কথা বলছিলাম। দাদুর দাওয়ায় সন্ধ্যার আড্ডার মধ্যেই আমার খাবার ডাক পড়তো সবার আগে। সবার ছোটো কিনা তাই। দাদুর ঘরটা ছিল বড় উঠোনের এক ধারে। আর রান্নাঘর ছিল ভেতরের উঠোনে। দাওয়ায় সবাই বসে থাকত তাই নির্ভয়ে এক দৌড়ে গিয়ে খেয়ে আবার এক দৌড়ে ফিরে আসতাম।
কিন্তু মুশকিল হত এর পর। বড়দের খাবার ডাক পরলে।সবাই চলে যেত রান্নাঘরে। আমি একা শুয়ে থাকতাম দাদুর ঘরে দিয়ানীর খাটে। ভয় পেতাম খুব। হয়ত একটা শেয়াল ডেকে উঠল কোথাও বা অন্য কোন শব্দ হল, আর সেই পাখিটা ডেকেই চলত। চমকে চমকে উঠতাম।
এই সময় রোজই প্রায় ঘড়ি ধরে আসার মত আসত প্রানগোপাল দা। হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে আর তালে তালে গান গাইতে গাইতে সে আসত। কোথা কোথা থেকে যাত্রা দেখে এসে সেই সব গান গাইত উচ্চকন্ঠে। অনেক দূর থেকে তার আসার আওয়াজ পাওয়া যেতো এতে। ও যেত বড় উঠোন দিয়ে। এক দিক দিয়ে ঢুকে আর এক দিক দিয়ে বেরিয়ে যেত। এটা ছিল ওর শর্টকাট। ওর গান গাওয়া আর লাঠি ঠোকার শব্দে আমার ভয় অনেকটাই কেটে যেত।
প্রানগোপালদা'র কথা আগে বলা হয়নি। আমাদের বাইরের উঠোনের পাশে ছিল কাছারিঘর। তার একটা অংশে ছিল একটা মুদিখানা। হরেন মামাকে মুদিখানাটা করতে দিয়েছিলেন দাদু। প্রানগোপালদা ছিল তারই ভাগ্নে। সে রোজ রাতে মামার দোকানে শুতে আসত দোকান পাহারা দিতে। আমার সাথে ওর খুব ভাব ছিল।
এর পর নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসে যেত। ভাঙত সেই সকালে, ঘুঘুর ডাকে ---- যে ডাকের কথা প্রথমেই বলেছিলাম।
একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি। এখানে যেসব ঘটনার কথা বলছি সে সব ঘটেছিল আমার প্রায় ছয় থেকে দশ বছর বয়সের মধ্যে আমার মামার বাড়িতে।
কোনটা আগে আর কোনটা পরে সেটা আর এ বয়সে মনে নেই। থাকার কথাও নয়।
যতটা সম্ভব ক্রমানুসারে বলে যাবার চেষ্টা করছি।
সন্তোষ কুমার রায়
রূপনারায়নপুর, বর্ধমান
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
আশ্চর্য দেশলাইকাঠি
এক কাঠুরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গুনগুন করে গাইতে গাইতে চলেছিল। ওর মন ছিল খুশিতে ভরা। এর আগে এতো খুশি বোধহয় ও কোনদিন হয়নি। ওর কিছু পড়শি জঙ্গলের মধ্যে একটা নতুন অংশ খুঁজে বার করেছে- সেখানে অনেক বড় বড় আর লম্বা লম্বা গাছে ভর্তি। হাঁটতে হাঁটতে কাঠুরে পৌঁছে গেলো বনের মধ্যে সেই অংশে। ঘন জঙ্গল আর বড় বড় গাছগুলি দেখে ও মুগ্ধ হয়ে গেলো। খানিক্ষণ দেখে শুনে এবার ও ভাবতে বসলো কোন গাছটা কাটবে। আরো ভালো কাঠ খুঁজে বার করার জন্য ও জঙ্গলের আরো গভীরে ঢুকে গেলো। হটাত ও দেখতে পেলো একটা খুব উজ্জ্বল আলো ওর দিকে যেন এগিয়ে আসছে। সেই আলোয় ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। কাঠুরে আলোর তেজ থেকে বাঁচার জন্য দুই হাত দিয়ে চোখ ঢাকলো। এইভাবে খানিক্ষণ গেলো। তারপর আলোটা ধীরে ধীরে মরে গেলো। তখন কাঠুরে দেখলো ওর সামনে, ঘাসের ওপর পড়ে আছে কতগুলি পোড়া দেশলাইকাঠি। কাঠুরে তো অবাক! জঙ্গলের মধ্যে এই দেশলাইকাঠি গুলো এলো কোথা থেকে? কিছুক্ষণ আগেও তো ছিলোনা। আর ওই আলোটা?
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছে, এমন সময় ও দেখতে পেলো জঙ্গলের ভেতর থেকে সাতজন মানুষ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। তারা সবাই খুব লম্বা, গায়ে তাদের ঢোলা রেশমের আলখাল্লা, আর তাদের মুখে সুন্দর হাসি। "এই তো এইখানে" বলে তাদের মধ্যে একজন নিচু হয়ে দেশলাইকাঠিগুলি তুলে নিলো। তারপরেই তারা হটাত করে কাঠুরেকে দেখতে পেলো।
"কে তুমি? এখানে কি করছো?" গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলো একজন।
কাঠুরে হাত জোর করে বললো," প্রভু, আমি একজন গরিব কাঠুরে, ভালো কাঠের খোঁজে জঙ্গলে ঢুকেছি।" তখন তাদের মধ্যে একজন বললো, "প্রমাণ কোথায় যে তুমি কাঠুরে?" কাঠুরে তাদেরকে তার কুড়ুল আর বস্তা দেখালো। তখন সেই সাতজন মিলে কাঠুরেকে বললো -"এসো আমাদের সঙ্গে।"
সাতজনের পিছনে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে কাঠুরে দেখতে পেলো জঙ্গলের মধ্যে একটুখানি পরিষ্কার জায়গা। সাতজনের মধ্যে যে সবচেয়ে লম্বা, সে বললো- "দাঁড়াও এখানে"।
এই বলে সবাই মিলে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেলো।
কাঠুরে একলা বসে অনেক্ষন অপেক্ষা করলো। করতে করতে ভাবলো, স্বপ্ন দেখছি না তো? চারিপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল, আর কতরকমের গাছ - তাদের মধ্যে অনেকগুলো সে কোনদিন দেখেইনি। এমন সময়ে সেই সাতজন তার কাছে ফিরে এলো। তাদের মধ্যে একজন তার দিকে কি যেন ছুঁড়ে দিল! কাঠুরে তাকিয়ে দেখলো তার সামনে পড়ে আছে পাঁচটা পোড়া দেশলাইকাঠি।
"এগুলি কি?" জিজ্ঞাসা করলো কাঠুরে।
"এগুলি হল আমাদের অদ্ভূত সৃষ্টি। এইগুলি সঙ্গে থাকলে কেউ কোনদিন শীত বোধ করবে না। যখন খুব শীত পড়বে, তখন এইগুলোকে একসাথে ঘষলেই চারপাশটা গরম হয়ে যাবে। আমরা এইগুলির নাম দিয়েছি 'আশ্চর্য দেশলাইকাঠি'।
"কিন্তু আমাকে এগুলো দেখাচ্ছেন কেনো?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো কাঠুরে।
"আমরা তোমাকে এগুলির শক্তির কথা জানালাম। তুমি যদি আমাদের জন্য একমাস কাজ করে দাও, তাহলে আমরা এইগুলি তোমাকে দিয়ে দেবো। তোমার আর শীতে কোনদিন কষ্ট হবেনা। তুমি আমাদের হয়ে কাজ করো, তোমার বাড়িতে ঠিক খবর পৌঁছে যাবে। ওদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেটা আমরা দেখবো।"
এই কথা শুনে কাঠুরে রাজি হয়ে গেলো। কাঠুরে সেই সাতজনের কথামতো জঙ্গলের মধ্যে কাজ করতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে তাকে মাটি কোপাতে হত, মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ কাটতে হত, আবার কখনও জঙ্গল পরিষ্কার করতে হত। সেই সাতজন মাঝে মাঝে এসে তার কাজ দেখে যেতো, আরো কাজ দিয়ে যেতো, আর তার খাবার দিয়ে যেতো।
এইভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর এক রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়লো। সে সাতজন এসে তখন সেই আশ্চর্য দেশলাইকাঠি গুলো ঘষলো, আর অমনি কাঠুরের খুব গরম আর আরাম লাগতে থাকলো। সেই কাঠিগুলোকে মাঝখানে রেখে সবাই তার চারিদিকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
শুয়ে শুয়ে কাঠুরের চোখে তো ঘুম আসেনা। তার মাথায় এক দুষ্টুবুদ্ধি এলো। চুপচাপ উঠে কাঠুরে দেশলাইকাঠিগুলোকে কুড়িয়ে নিলো। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে তার কুড়ুলটা অন্য হাতে নিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে দৌড় লাগালো।
পরদিন সকালে বাড়ি পৌঁছালে তার বউ আর ছেলে-মেয়ে তো খুব খুশি হল। কাঠুরে দেখলো সেই সাতজন তাদের কথামত তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল অনেক খাবার, জামা-কাপড়, আর টাকা-পয়সা। তাই তার বাড়ির সবাই বেশ আনন্দেই ছিলো। কাঠুরে কাউকে সেই দেশলাইকাঠিগুলির কথা বললো না। খুব সাবধানে তার একটা পুরোনো জামার পকেটের ভিতর রেখে দিলো।
তারপর একদিন রাতে শনশন করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে বরফও পড়তে শুরু করলো। বাড়ির সবাই যখন আগুনের পাশে বসেও শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, তখন কাঠুরে চুপিচুপি পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই আশ্চর্য দেশলাইকাঠিগুলিকে ঘষে দিলো। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে চারিপাশটা আরো গরম হয়ে গেলো। কাঠুরে আর তার বউ আর ছেলে-মেয়ের আর একদম শীত করলো না। কাঠুরে ছাড়া অন্যরা অবশ্য বুঝতে পারলো না কেনো এমন হলো।
এইভাবে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা দিন আর রাত। বাইরে বরফ পড়লেও কাঠুরের বাড়ির ভেতর সবাই বেশ আরামে থাকলো।
তারপর একদিন রোদ উঠলো। কাঠুরে কাজে বেরোলো। কাজের পর বাড়ি ফিরে এসে সে আর দেশলাইকাঠিগুলিকে খুঁজে পেলোনা। খুব চিন্তায় পড়ে গেলো কাঠুরে। এমন সময় তার বউ এসে রাগি গলায় বললো -"আবার যদি ঘর নোংরা করো, তাহলে তোমার সব জিনিষ ফেলে দেবো, যেমন আজকে দিয়েছি তোমার পুরোনো জামার পকেটের থেকে কতগুলি পোড়া দেশলাইকাঠি!"
"কি করেছো! কোথায় সেগুলি?" চিতকার করে বললো কাঠুরে।
"অন্য ময়লাগুলোর সাথে রাস্তার ধারে ফেলে দিয়েছি। এতক্ষনে জমাদার তুলে নিয়ে চলে গেছে" বলে বউ গটগটিয়ে চলে গেলো।
কাঠুরে রাস্তার ধারে গিয়ে আঁতিপাতি করে খুঁজলো, কিন্তু সেই চুরি করা আশ্চর্য দেশলাইকাঠিগুলিকে আর খুঁজে পেলো না।
ঋদ্ধি চক্রবর্তী
অষ্টম শ্রেণী
দ্য ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুল
কলকাতা
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
টিপ টিপ বৃষ্টি
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, আর মেঘের দল ছুটে আসছে আমার দিকে। আমি দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি...সামনে ছোট্ট একটা পাহাড়ের গ্রাম। চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্নটা আমাকে যখন তখন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। আর আমি আলসেমি করে চোখ বন্ধ করে থাকতাম।
সামনে ছোট্ট একটা পাহাড়ের গ্রাম...
মা বলতেন, "টুকনু পড়ার সময় তুমি পড়ো...আর খেলার সময় খেলো।" রাগে গজগজ করতে করতে সহজপাঠ খুলে বসতাম। তুমি কি সহজ পাঠ পড়েছো? কার লেখা বলোতো? হুম ঠিকই ভেবেছো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
"বাদল করেছে। মেঘের রঙ ঘন নীল। ঢং ঢং করে ন-টা বাজলো। বংশু ছাতা মাথায় কোথায় যাবে? ও যাবে সংসার-বাবুর বাসায়।"
আমার চমক ভাঙলো। কারণ স্কুলের মিড-ডে মিলের ঘন্টা পড়লো। জয়ন্তী রাভা, বিকাশ রাভা তাদের আরো সব বন্ধুরা এবার মাঠে দঙ্গল বেঁধে খিচুড়ি খাবে। আমিও লোভে লোভে তাদের সঙ্গে বসে পড়লাম।
সবাই দঙ্গল বেঁধে খিচুড়ি খাওয়া...
এরা সবাই থাকে জঙ্গলে ঘেরা একটা গ্রামে। বাজার করতে যেতে হয় অনেক দূরে। অসুখ করলে ডাক্তার দেখানোর কথা অনেকে ভাবতেই পারে না। আমার বেশ ভালো লাগলো গ্রামটাতে গিয়ে। ওদের সাথে কথা বলে। খিচুড়ি খাওয়া শেষ হলে জয়ন্তীরা আবার যখন পড়তে গেলো আমি নিজে নিজেই গ্রাম দেখতে বেরোলাম। আর মাঝপথে সেই টিপ টিপ বৃষ্টি নেমে এলো। ছাতাটা তখন আমার নাগালের বাইরে। একজন রাভা মহিলা আমাকে ভিজতে দেখে তার কাঠের বাড়ির নীচে বসতে বললো। রাভাদের বাড়ি কেমন হয় জানো তো সব বাড়ি কাঠের পাটাতনের ওপর। অনেকে বলেন এটা তাঁদের প্রাচীন রীতি আবার অনেকের বিশ্বাস একটু উঁচুর জন্য হাতির হাত থেকে কিছুটা হলেও বাঁচা যাবে। দেখতে পেলাম বন থেকে ফিরছেন মহিলারা। তাঁদের সবার মাথায় জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠের বোঝা।
জঙ্গল থেকে কাঠের বোঝা নিয়ে ফিরছেন...
বাড়ি ফিরে এই কাঠ জ্বালিয়ে কেউ রান্না করবেন আবার কেউ বা হাটে বিক্রি করে সেই টাকায় চাল, ডাল, তেল, নুন কিনবেন।
আরে পায়ের বুড়ো আঙুলে কেউ যেন ঠুকরোচ্ছে। দেখলাম মুরগীর ছানার মতো কি যেন একটা ...সেটাকে কোলে তুলে নিতে আমলা রাভা বললো "দাদা ওটা ময়ূরের ছানা"।
ময়ূরের ছানা...
আমি তো অবাক ছানাটাকে কোলে নিয়ে ঘুরলাম সারা গ্রাম। দেখলাম আরো একটা অলস ময়ূর বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে বাড়ির মাচার নীচে। কত বললাম একটু নাচ দেখাও তো বাছা...কিছুতেই নড়লো না।
অলস ময়ূর...
ওদিকে জঙ্গলের পথ ধরে জয়ন্তীর গ্রামের বড়রা যাচ্ছিলেন মাছ ধরতে আমিও তাদের সঙ্গে চললাম।
জঙ্গলের পথ ধরে মাছ ধরতে যাওয়া...
জলপাইগুড়ি জেলার চিলাপাতার জঙ্গলে যদি কোনো দিন যাও তাহলে আন্দু বস্তি,কোদালবস্তি,কুরমাই বনবস্তি অবশ্যই ঘুরে এসো। খুব ভালো লাগবে। আর তার সাথে তো থাকবেই নল রাজার গড়। গড়ের কথায় পরে আসছি,তোর্সার জলে আমিও নামলাম মাছ ধরতে। বর্ষার সেই ঠান্ডা জলে পা দিতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।
তোর্সার জলে মাছ ধরা...
কি কি মাছ ধরা পড়লো? আরে সবই ছোট ছোট চিংড়ি। না সেগুলোর ছবি তোলা হয়নি। কারণ তার আগেই আমাকে চলে আসতে হয়েছিলো নল রাজার গড়ে। ফেরার সময় দেখলাম বর্ষার তোড়ে ভাঙছে পাড়। পড়ে যাচ্ছে বড় বড় গাছ। মনে মনে বললাম আরো অনেক অনেক গাছ লাগাতে হবে আমাদের...আরো অনেক অনেক সবুজ চাই।
পাড় ভাঙছে তোর্সা নদীর...
চিলাপাতা এক দুর্ভেদ্য অরণ্য। কোন এক সময়ে নল রাজারা এখানে থাকতেন। চুপি চুপি একটা গল্প শোনাই তোমাকে। এই জঙ্গল থেকে কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারে না।
জঙ্গলের মধ্যে নল রাজার গড়...
এমনকি গাছের পাতাটা পর্যন্ত না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কেউ যদি এই অরণ্য থেকে কিছু নেয় তাহলে তার সংসারে অমঙ্গল হয়।
কেউ পাতা পর্যন্ত তুলে আনতে পারে না...
ঝিম ধরা পরিবেশে যখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কানে তালা লেগে যাচ্ছে তখন আমার গাইড আমলা বলে উঠলো,"এবার বেলাবেলি বেড়িয়ে পড়ুন স্যার...পথে হাতির ভয়।" সি সি লাইন থেকে ফেরার পথে আবার টিপ টিপ বৃষ্টি। আরে ওকি...ওমা... তোর্সাতে স্নানে নেমেছে বুনো হাতি।
তোর্সাতে স্নানে নেমেছে বুনো হাতি...
এখানে আমি অনেক দিন থেকেছি। কাজ করেছি, তাই কেউ কেউ আমাকে চেনে। ক্ষিদে পেয়েছে ভেবে আমলার মা আমাদের যত্ন করে খেতে দিলেন। কি জানো? আমলার বাড়ির উঠোনে হওয়া আনারস। ফেরার পথে আমলাকে বললাম,"অনেক ধন্যবাদ আমলা। এতো মিষ্টি আনারস আমি এর আগে খাই নি।" আমলা তখন আমাকে ঝুড়ি ভরা আনারস দেখালো। আমি ছবি তুললাম। আর মনে মনে বললাম ইস...এগুলো যদি ইচ্ছামতীর সবার সাথে বসে ভাগ করে খাওয়া যেত।
ঝুড়ি ভরা আনারস...
ওদিকে পিঁপ পিঁপ শব্দে এস এম এস আসতে শুরু করলো। সবসময় তো এখানে আর ফোনের কানেকশান থাকে না ,দেখি চাঁদের বুড়ি লিখেছে,"আসার সময় কাঁঠালের কিছু ছবি এনো।" কাঁঠাল আমারও খুব প্রিয়। আরে এই তো আমার সামনেই গাছ ভর্তি কাঁঠাল। ক্যামেরা ক্লিক করলো।
গাছ ভর্তি কাঁঠাল...
সাধন রাভা এসে বললেন,"চলুন দাদা নাচের আসর বসেছে। আপনাকে সবাই ডাকছে।" গিয়ে দেখলাম এলাহি ব্যাপার। জয়ন্তী...অমল সবাই সেজে গুজে রেডি ওরা জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাবার নাচ দেখাবে।
কাঠ কাটতে যাবার নাচ
হঠাত ঘুমটা ভেঙে গেলো। ঝোড়ো হাওয়ায় জানলাটা দড়াম দড়াম করে পড়ছে। ঘুমচোখে মশারী তুলে জানলা বন্ধ করতে যাবো আর কোথা সেই অনেক চেনা ভালো গন্ধটা আমার মনটাকে খুশিতে মুড়ে দিলো।
আমার মুখে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো। চোখ কচলে দেখলাম জানলার পাশে কদম ফুলের গাছটা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে।
জানালার বাইরে কদম গাছ...
হঠাত মনে পড়ে গেলো আজ তো বৃক্ষরোপণ উতসব। অনেকদিন আগে কবিগুরু তাঁর শান্তিনিকেতনে গাছ লাগানোর মহোতসব শুরু করেছিলেন। আমাদের পাড়াতেও ছেলে মেয়েরা আজ রাস্তার ধারে গাছ পুঁতছে আর গান গাইছে "আয় আমাদের অঙ্গনে অতিথি বালক তরুদল/মানবের স্নেহ সঙ্গ নে/চল আমাদের ঘরে চল..."। আমিও ওদের সাথে এতোক্ষণ গাছ পুঁতেছি...গান গেয়েছি। কাদা জল,বৃষ্টিতে আমার হাত পা ঠান্ডা। বিকেলের ট্রেনে তিনু মাসি এলেন উত্তর চব্বিশ পরগণার আড়বেলিয়া গ্রাম থেকে। ঝোলার মধ্যে বড় বড় দুটো তাল। দিদা পাঠিয়েছেন। চুপি চুপি বলি মা এখন তালের বড়া ভাজছে। আর আমি হ্যাংলার মতো বাটি, চামচ নিয়ে রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। ওই বুঝি আবার টিপ টিপ বৃষ্টি এলো।...
লেখা
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া, হুগলী
ছবি
কল্লোল লাহিড়ী
ফ্লাওয়ার্সঅফইন্ডিয়া
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
প্রথম পাতাঃবর্ষা সংখ্যা ২০০৯
গরমের ছুটির পর স্কুল তো খুলে গেছে অনেকদিন, পরীক্ষাও হচ্ছে নিশ্চয় মাঝে মাঝে। স্কুলের গরমের ছুটি শেষ হয়ে গেলে কি হয়, গরমকালের যেনো আর ছুটিই হচ্ছিলো না। ক্যালেন্ডারের পাতায় আষাঢ় মাস তো কবেই এসে গেছে। অথচ আমার বাড়ির আশ-পাশ থেকে তো গ্রীষ্মকালটা যেতেই চাইছিল না! কি গরম, কি গরম - একেবারে ঘেমে-নেয়ে একশা! আমার বাড়ির পাশের কদম ফুলের গাছটা তো আর অত-শত ভাবেনি। সে যেই টের পেয়েছে আষাঢ় এসেছে, অমনি ওই গরমের মধ্যেই ডাল-পালা ভরিয়ে ফেলেছে গোল গোল হলুদ-সাদা ফুলে। ছাতের টবে একলা বেলফুলের গাছটাও দুইখানা মনমাতানো গন্ধে ভরা ফুল ফুটিয়ে ফেললো।
এদিকে আমি তো "আয় বৃষ্টি ঝেঁ-এ-পে-এ-এ, ধান দেবো মে-এ-পে-এ-এ" গানটা রোজ গাইছি। গাইতে গাইতে এইতো মাত্র কিছুদিন আগে শেষমেষ বর্ষারানী এলেন -ঝিরঝির,ঝুরঝুর,ঝমঝম - কত রকমের বাজনা বাজিয়ে, আকাশ ছাই ছাই রঙের মেঘে ঢেকে, শুকনো পৃথিবীকে ধারাস্নান করালেন। আর অমনি চারিদিকটা কেমন বদলে গেলো। মাটির থেকে উঠে এলো একটা মন-কেমন করা সোঁদা গন্ধ। যে গাছপালাগুলি এতোদিন ধুলোয় ঢাকা পড়ে ছিলো, সেগুলি ধুয়ে মুছে চকচকে হয়ে গেলো। আর তোমার স্কুলে যাওয়ার সঙ্গী হলো রঙচঙে রেইনকোট, বড়দের মাথায় উঠলো ছাতা। ইচ্ছামতীর গত সংখ্যার গল্প "ইস্কুলে ভূত" এর সমুর মতো তুমিও নিশ্চয় রাস্তায় জমা জলে লাফ-ঝাঁপ দিয়ে বাড়ি ফেরো? আমার কাছে লুকিও না - আরে, মা যতই বকুন, আমি তো জানি, মা নিজেও ছোটবেলায় একই কাজ করতেন। আর তোমাকে চুপিচুপি বলি, আমার ছোটবেলায় আমিও করতাম মাঝে মাঝে...আচ্ছা বলো, বর্ষাকালে যদি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হাতটাকে নাই ভেজালাম, তাহলে আর বৃষ্টি পড়ে লাভ কি হলো? আর রাস্তার ধারে বয়ে যাওয়া জলে যদি একটা কাগজের নৌকা না ভাসাও তাহলেই বা চলে কি করে? বড়রা এইসব কিছু বোঝেননা, খালি ঠাণ্ডা লেগে যাবে বলে বকাবকি করেন। তবে একটা কথা, যদি খুব জোরে জোরে বৃষ্টি হয়, তাহলে বেশি না ভেজাই ভালো। তবে যদি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হয়, তাহলে নাহয় একটু জল ঘাঁটাই যেতে পারে। আর তারপরে ইলিশমাছ ভাজার সাথে গরমাগরম খিচুড়ি হলে তো কথাই নেই - ঠাণ্ডা- সর্দি আর ধারকাছ ঘেঁষবে না।
তুমি নিশ্চয় এতক্ষনে ভাবছো- চাঁদের বুড়ি বেশ লোক! একে তো এত্তো দেরি করে বর্ষা সংখ্যা নিয়ে এলো, আর এসে থেকে খালি নানান গল্প করছে। আসলে কি জানোতো, আমার বাড়ির আশেপাশে তো বর্ষা অনেক দেরীতে এলো, আর ইচ্ছামতীও বললো বৃষ্টির হাত না ধরে যাবোনা...তাই আমরাও এলাম সময়ের কিছু পরে। গত কয়েকদিনের কয়েকটা ঘটনায় আমাদের মনও একটু খারাপ ছিল। সেই যে গত মে মাসে শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গে একদিন আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে এলো সাইক্লোন, যার নাম 'আয়লা' -ভেঙ্গে দিলো কত অসহায় মানুষের ঘর-বাড়ি, ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সবকিছু। সেই ঝড়ে ভেঙ্গে গেলো সুন্দরবন অঞ্চলের নদীর বাঁধ, আর চাষের জমিতে ঢুকে পড়ল নোনা জল। এর ফলে কি হল বলতো - ওই জমিগুলিতে আগামি কয়েকবছর আর চাষ করা যাবে না। ফলে আর ফসল ও ফলবে না, ফলে চাষীভাইদের উপার্জনও থাকবে না। নতুন নতুন উপার্জনের খোঁজে হয়ত বা ঘর ছাড়তে হবে তাঁদের। তারপর এইতো মাত্র কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সঙ্গীতজগতের দুইজন বিশ্ববিখ্যাত তারকা। প্রথমে গেলেন বর্ষীয়ান ভারতীয় সরোদ শিল্পী উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব। আর তারপরে চলে গেলেন পৃথিবীর সবথেকে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী - মাইকেল জ্যাকসন। তুমি কি আলি আকবর খাঁ সাহেবের সরোদ বাজানো শুনেছ? বা মাইকেল জ্যাকসনের সেই বিখ্যাত গান -'হিল দ্য ওয়ারল্ড'? - যে গানে তিনি বলেছিলেন সারাটা পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলতে হবে সবার ভালো থাকার জন্য - এখনকার প্রজন্ম, আগামি প্রজন্ম, সবার জন্য...।জানোতো- সঙ্গীত হল এমন এক শিল্প, যেটা কিন্তু ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে মানুষকে কাছাকাছি করে দেয়। উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব এবং মাইকেল জ্যাকসন - দুইজনে সঙ্গীতের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার সাধনা করতেন, কিন্তু দুজনেই ছুঁয়েছিলেন সারা পৃথিবীর মন। তাঁদের দুজনের উদ্দেশ্যে রইল আমাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
এবার আমার কলম থামাই। তুমি বরং ইচ্ছামতীর পাতাগুলিকে উল্টে-পাল্টে দেখো এবার। সব নিয়মিত বিভাগ গুলিই আছে এবারো। পড়তে ভুলোনা রাসকিন বন্ডের অনুবাদ গল্প। আর "ইচ্ছে মতন" বিভাগে অবশ্যই পড়ো ইচ্ছামতীর বন্ধু ঋদ্ধির লেখা গল্পখানা।
শেষ করার আগে ইচ্ছামতীর নতুন বন্ধুদের জন্য কিছু পুরানো দরকারি কথা আরেকবার বলে নিই। এই ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে Unicode font ব্যবহার করে। তোমার কম্প্যুটার এ Unicode font না থাকলে, বা ব্রাওজার বাংলা বর্ন ঠিক ভাবে দেখাতে না পারলে, এই পাতার ওপরের বাঁ দিকের দ্বিতীয় লিঙ্কটা ভালো করে পড়ে নাও। এই ওয়েবসাইট সবথেকে ভাল দেখা যাবে Firefox Browserএ। Internet Explorer 6 & 7 browser দুটি একটি অক্ষর ঠিক করে দেখাতে পারছে না। তাই আমরা "উত্সব", "হঠাত্" এই সব শব্দে 'খন্ড ত' এর বদলে 'ত ' ব্যবহার করেছি। না হলে দেখতে খারাপ লাগছে। যাঁরা সব খুব গম্ভীর চশমাআঁটা পাঠক, ভুল বানান দেখলেই রেগে যান, তাঁরা নিশ্চয় আমাদের ওপর এই কারণে রেগে যাবেন না।
ভালো থেকো। তোমার জন্য রইলো আমার আঁচলভরা স্বর্নচাঁপা, কাঁঠালীচাঁপা, কামিনী, যুঁই, গন্ধরাজ আর হাস্নুহানার সুগন্ধ।
চাঁদের বুড়ি
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
বেড়িয়ে এলাম ফুলিয়াপাড়া
'...রাজা এক দেশে এলেন। সে দেশে রাজকন্যের উপবনে নীল মানিকের গাছে নীল গুটিপোকা নীলকান্ত মণির পাতা খেয়ে, জলের মতো চিকন, বাতাসের মতো ফুরফুরে, আকাশের মতো নীল রেশমের গুটি বাঁধে। রাজার মেয়ে সারারাত ছাদে বসে, আকাশের সঙ্গে রং মিলিয়ে সেই নীল রেশমে শাড়ি বোনেন। একখানি শাড়ি বুনতে ছ-মাস যায়...'
বলতো কোন গল্পের অংশ এটা? - আচ্ছা, আমি বলে দিচ্ছি, এটা হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষীরের পুতুল' গল্পের একটা অংশ। সেই গল্পের রাজা নিজের সুয়োরানীর জন্য এই শাড়ি সাত জাহাজ সোনা দিয়ে কিনে এনেছিলেন!!
ভাবছো, একটা শাড়ির দাম সা-আ-আ-ত জাহাজ সোনা? তাই কখনও হয়? - আসলে ওটা তো রাজকন্যার শাড়ি, তাই মনে হয় অত দাম। তবে সত্যি কথাটা কি জানো, একটা সুন্দর নক্সা করা শাড়ি বুনতে কিন্তু সত্যি অনেক সময় লাগে - ছ-মাস না হলেও এক থেকে তিন মাস তো লাগতেই পারে। আর সেইজন্যই, হাতে বোনা শাড়ি, যাকে তাঁতের শাড়ি বা হ্যান্ডলুম [handloom] এর শাড়ি বলা হয়, সেগুলি কিন্তু মেশিনে বোনা শাড়ির থেকে বেশি দামী হয়।
ভাবছো , শাড়ি তো বড়দের ব্যাপার, তাই নিয়ে ইচ্ছামতীতে এতো গল্প কেনো? আসলে, আজকে আমি তোমাকে শোনাবো শাড়ি তৈরির গল্প। এই গল্পে কিন্তু কোন রাজকন্যা শাড়ি বোনে না, বোনেন হাজার হাজার দক্ষ কারিগর। আর কারিগরদের নানারকম ভাবে সাহায্য করার জন্য থাকেন আরোও নানা মানুষ। আমাদের দেশের প্রায় প্রত্যেক রাজ্যের কাপড় বোনার নিজস্ব ধারা আছে। কারোর কাপড় হয় ফুরফুরে হাল্কা, কেউ বোনেন জমকালো রঙ্গিন নক্সা, কোথাও আবার জরির কারিকুরি। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায় নানারকমের তাঁতের শাড়ি - শান্তিপুরি, ফুলিয়া, ধনেখালি - এগুলি কিন্তু একেকটা জায়গার নাম - একেক জায়গার শাড়ি একেকরকমের হয়, তাই জায়গার নাম দিয়ে বাহারের তফাত বোঝানো হয়। তবে আদতে মোটামুটি সব জায়গাতেই তাঁতের ব্যবহার প্রায় একইরকম।
আমি কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার ফুলিয়ায় বেড়াতে গেছিলাম। সেইখানে আমার এক পারিবারিক বন্ধুর সাথে আমি বেড়াতে যাই ফুলিয়াপাড়ায়। ফুলিয়াপাড়া হল এমন এক জায়গা, যেখানে প্রায় সবাই তাঁতী। প্রত্যেক বাড়িতেই তাঁত আছে। পুরুষরাই বেশিরভাগ তাঁতযন্ত্র চালান, আর বাড়ির মহিলারা নানাভাবে তাঁদের সাহায্য করেন, এমনকি ছোটরাও বাদ যায়না।ফুলিয়াপাড়ার একজন তাঁতীভাই আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন কিভাবে একটা তাঁতের শাড়ি তৈরি হয়।
শাড়ি তৈরি করতে কি লাগে? -অবশ্যই নানা রঙের সুতো এবং ইচ্ছা হলে নক্সা করার জন্য জরি। এই সুতো কিন্তু আসে গুজরাতের সুরাট থেকে, আর জরি আসে মহারাষ্ট্র থেকে। সেই কোরা সুতোর লাছিগুলিকে প্রথমে মনোমত রঙ করে নেওয়া হয়।
রঙিন সুতোর লাছি
নক্সা করার জন্য জরি
তারপর শুরু হয় সেই সুতোগুলিকে ঠিকমত করে গোটানো। এই কাজটি দুই ধাপে হয়, আর বাড়ির মহিলারাই এই কাজ বেশি করেন।
প্রথমে, সুতোগুলিকে এক বিশেষ পদ্ধতিতে গোটানো হয়
সুতো পাকানোর প্রথম ধাপ
তারপর সেইগুলিকে আবার দ্বিতীয়বার আরো মিহি করে চরকা কেটে গোটানো হয় আর ছোট ছোট তকলি বানানো হয়।
দ্বিতীয় ধাপে গোটানো সুতো থেকে কাটা হচ্ছে তকলি
তকলি
এরপর শুরু হয় শাড়ি তৈরির পালা। একটা সম্পূর্ন তাঁতযন্ত্রের অনেকগুলি অংশ থাকে। একদিকে থাকে একটি বিশাল রোলার। আরেকদিকে বসে থাকেন তাঁতীভাই। এর আগে যে তকলি গুলির কথা বললাম, সেই, তকলি গুলিকে ডিজাইন অনুযায়ী লাগানো হয় একটি লম্বা কাঠের ফ্রেমে। ফ্রেমে লাগানো তকলি থেকে সুতো ওই রোলার এর ওপর জড়িয়ে গিয়ে, আরো নানা পথ ঘুরে, পড়ে তাঁতীভাইয়ের হাতে। ব্যাপারটা যত সহজে বলে ফেললাম, মোটেও তত সহজ নয়। নিচের ছবিগুলি দেখলেই বুঝতে পারবে।
ফ্রেমএ লাগানো তকলি
তাঁতযন্ত্র - সামনে তাঁতীভাইয়ের বসার জায়গা
এর মধ্যেই আবার কোন এক জায়গায় থাকে কার্ডবোর্ডের পাঞ্চ কার্ড। এই পাঞ্চ কার্ডএর মধ্যে ফুটো , বা পাঞ্চ করে বানানো থাকে শাড়ির পাড়ের নক্সা। তকলির থেকে সুতো নানা কলকব্জার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়ে এই পাঞ্চ কার্ডের মধ্যে দিয়েও যায়। আর তাতেই , ঠিক যেনো ম্যাজিকের মত, শাড়ির পাড়ে ফুটে ওঠে নানান নক্সা।
শাড়ির পাড়ের নক্সা করার জন্য পাঞ্চ কার্ড
একজন দক্ষ তাঁতীর কিন্তু তাঁত চালানোর সময় হাত এবং পা দুই সমান ভাবে ব্যাবহার করতে হয়। আর আরেকটা জিনিষের কথা তো আলাদা করে বলতেই হবে। সেটা হলো মাকু।
মাকু
সেই যে একটা প্রবচন আছে-'মাকুর মত এদিক ওদিক করা ' -মাকু কিন্তু সত্যি সবসময় এদিক-ওদিক করে। তাঁতীভাইয়ের হাতের একটা খুব জরুরি যন্ত্র হল মাকু। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখো, একেকটি মাকুর মধ্যে জড়ানো আছে একেক রঙের সুতো আর জরি। এই মাকু ধরেই এপাশ- ওপাশ ক্রমাগত হাত নাড়িয়ে ধীরে ধীরে বুনে চলেন একটি শাড়ি। আর সেই হাত সে কত তাড়াতাড়ি নড়ে, সেটা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। কোন ছবি সেই গতিকে দেখাতে পারবে না।
তাঁতীভাই
একেকটা শাড়ি বানাতে সময় লাগে প্রায় একমাস। শাড়ির কারুকাজ যত বেশি হবে, বানাতে তত বেশি সময়ও লাগবে।
অর্ধেক বোনা শাড়ি
ফুলিয়ার শাড়ি খুব হাল্কা হয়, গরমকালে পড়তে খুব আরাম হয়। আজকাল অন্যান্য ভারতীয় হাতে বোনা কাপড়ের মত, ফুলিয়ার কাপড়ও দেশে বিদেশে খুব কদর পাচ্ছে। ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্সে, ফুলিয়ায় বোনা তাঁতের কাপড় এবং ওড়না/স্টোল নিয়মিত রপ্তানি হয়।
থাকদিয়ে রাখা তৈরি শাড়ি
কেমন লাগলো এই শাড়ি বোনার গল্প? এটা কিন্তু আমাদের দেশের এই বিশাল শিল্পের একটা খুব ছোট্ট গল্প। আমাদের রাজ্যের রেশমের শাড়ি বালুচরী আর বিষ্ণুপুরি, বাংলাদেশের জগতবিখ্যাত জামদানি - এদেরকে নিয়ে তো কোন গল্পই হল না। এদের প্রত্যেকের একেকটা নিজস্বতা আছে, আর প্রত্যেকটা শাড়ির পেছনে থাকে কোন একজন দক্ষ শিল্পীর পরিশ্রম। তুমি বরং এক কাজ করো - মা'কে বলো আলমারিটা খুলতে, আর মায়ের শাড়িগুলোর মধ্যে থেকে বেছে দেখতো - কোনগুলি হাতে বোনা আর কোনটা মেশিনে বোনা, বুঝতে পারো কিনা!
লেখা ও ছবি
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলী
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
শ্রী নিমাই সরকার, ফুলিয়াপাড়া
শ্রীমতি সোমা ঘোষ, কলকাতা
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে