মাল্লী
ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে চান করছে গাছগুলো, নিঝুম হয়ে ভিজছে হরিণ, কাঠবেড়ালী, রঙীন ডানার প্রজাপতি, হলুদ রঙের ছোট্ট পাখি, বড় পাতার লতানো গাছ... সবাই। ভিজছে এই বিশাল অরণ্য...আর এদের সাথে ভিজছে ছোট্ট মেয়ে মাল্লী।
ও তুমি বুঝি মাল্লীকে চেনো না? আচ্ছা একটু সবুর করো বাপু, আমি তোমাকে মাল্লীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তার আগে বলো তো, তুমি কি কোনোদিন জঙ্গলে বেড়াতে গেছো?
পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখেছো জঙ্গলকে?
সেই সব দেড়শো-দুশো বছরের পুরোনো গাছ গুলোর কাছে গিয়েছো?
ছুঁয়ে দেখেছো তাদের?
ভাবছো এই এতো প্রশ্ন করছি কেনো আমি। তার একটা কারণ আছে। যদি সত্যি এরপর কোনোদিন জঙ্গলে যাও...যদি সত্যি তুমি পায়ে হেঁটে মা, বাবা, কিম্বা দিদির সাথে জঙ্গলে ঘোরো তাহলে কিন্তু অনেক পুরোনো গাছ গুলোর কাছে যেও। তাদের গায়ে হাত দিও। আর তোমার কেমন লাগলো ফিরে এসে জানিও আমাকে। ইচ্ছে করলে কথাও বলতে পারো তাদের সাথে। হ্যাঁ, গাছ বুঝবে তোমার কথা। সত্যি।
অন্তত মাল্লী সেই কথা বিশ্বাস করে। মাল্লী গাছের সাথে, পাখির সাথে, মাছের সাথে, বয়ে চলা হাওয়ার সাথে কথা বলে...গল্প করে...সবাইকে ভালোবাসে। এই অরণ্য তার বন্ধু।
গাছ-গাছালিতে ঘেরা দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটা গ্রামে মাল্লী থাকে। তার খুব কাছের বন্ধু ফরেস্ট অফিসারের ছোট্ট মেয়ে, যে কানে শুনতে পায়না, কথা বলতে পারেনা। অথচ মাল্লীর সাথে টই টই করে সারাদিন জঙ্গলে ঘোরে আর গাছের সাথে, পাখির সাথে, হরিণের সাথে বন্ধুত্ত্ব পাতায়।
মাল্লীর আরো বন্ধু আছে ডাকঘরের পিয়ন, দুজন ফরেস্ট গার্ড আর গ্রামের সেই প্রাচীন বুড়ি যে তাকে ময়ূর ঠাকুরের গল্প বলেছিলো। যে ঠাকুর জঙ্গলে থাকেন আর কেউ যদি ভালো কাজ করে তাহলে তার ইচ্ছে পূরণ করেন। ঠাকুর তার ইচ্ছাপূরণের নীল রঙের পাথর দিয়ে যান। মাল্লীর ইচ্ছে তার শহর থেকে আসা বন্ধুটি যেন কথা বলতে পারে, শুনতে পারে।
কিন্তু কবে আসবে ময়ূর ঠাকুর? মাল্লী প্রতীক্ষা করে।
এদিকে জঙ্গলের মধ্যে বাড়ছে চোরা শিকারীদের উতপাত। তারা অবাধে মেরে ফেলছে ছোট্ট পাখি, কাঠবেড়ালী, কেটে ফেলছে অনেক পুরোনো সব গাছ যারা মাল্লীর বন্ধু। এইসব দেখে মাল্লী্র খুব দুঃখ হয়, কান্না পায়, কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। শুধু সেই প্রাচীন বুড়ি বলে, এদের সবাইকে ময়ূর ঠাকুর শাস্তি দেবে। একদিন মাল্লী জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে পায় তার প্রিয় হরিণ ছানাকে, যার পায়ে গুলি করেছে শিকারী আর ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে ছানাটি ।
মাল্লী হরিণ ছানাকে ভালো করতে লুকিয়ে রেখে আসে ডাক্তার কাকুর বাড়ি আর ঠিক সেই রাতে মাল্লীর স্বপ্নে আসেন ময়ূর ঠাকুর।
কি সুন্দর পেখম ছড়িয়ে দিয়ে নাচেন ঠাকুর। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে ফুল, সুন্দর আলো। তিনি মাল্লীকে দেন নীল রঙের একটা পাথর। এই পাথর পেলে মাল্লীর বন্ধু কি সত্যি ভালো হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেন না পরিচালক সন্তোষ শিবন। তাঁর ক্যামেরা শুধু ঘুরে বেড়ায় মাল্লীর সাথে জঙ্গলের ভেতরে... লতায়...পাতায়...নদী আর ঝরনার জলে... তাদের গ্রামে। যে গ্রাম গুলোর কথা তুমি বা আমি খুব কম জানি, যাদের কথা কেউ খবরের কাগজে লেখে না, টিভিতে দেখায় না। যে গ্রামের লোকেরা খুব গরীব কিন্তু যারা প্রাণ দিয়ে আগলে রাখে জঙ্গলকে।
এমন গ্রামের কথা, মানুষের কথা, সবার কথা খুব সুন্দর করে বলেন সন্তোষ শিবন তাঁর ছবিতে। তাহানের কথা মনে আছে তো? সেই কাশ্মীরের ছেলেটা। মাল্লীও তেমনই। যদি কোনোদিন ছবিটা দেখো, যদি তোমার লিখতে ইচ্ছে হয় তাহলে ইচ্ছামতীকে জানিও। ইচ্ছামতী তোমার ছবি দেখার, তোমার লেখা পাওয়ার আশায় রইলো। আর এই বর্ষায় আমার তরফ থেকে তোমার জন্য রইলো জল ছপছপে অনেক শুভেচ্ছা। ভালো থেকো।
কল্লোল
উত্তরপাড়া
ছবিঃ
ইউটিউব
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
চীনে-পটকা
আমাদের রামপদ একদিন এক হাঁড়ি, মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল! টিফিনের ছুটি হওয়া মাত্র আমরা সকলেই মহা উতসাহে সেগুলি ভাগ করিয়া খাইলাম। খাইল না কেবম 'পাগলা দাশু'।
পাগলা দাশু যে মিহিদানা খাইতে ভালোবাসে না , তা নয়। কিন্তু, রামপদকে সে একেবারেই পছন্দ করিত না- দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলিত! আমরা রামপদকে বলিলাম,"দাশুকে কিছু দে!" রামপদ বলিল," কি রে দাশু, খাবি নাকি? দেখিস, খাবার লোভ হয়ে থাকে তো বল আর আমার সঙ্গে কোনদিন লাগতে আসবি নে- তাহলে মিহিদানা পাবি। " এমন করিয়া বলিলে তো রাগ হইবারই কথা, কিন্তু দাশু কিছু না বলিয়া গম্ভীরভাবে হাত পাতিয়া মিহিদানা লইল, তার পর দারোয়ানের কুকুরটাকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে সেই মিহিদানা খাওয়াইল! তারপর খানিকক্ষণ হাঁড়িটার দিকে তাকাইয়া কি যেন ভাবিয়া মুচ্কি মুচ্কি হাসিতে হাসিতে স্কুলের বাহিরে চলিয়া গেল। এদিকে হাঁড়িটাকে শেষ করিয়া আমরা সকলে খেলায় মাতিয়া গেলাম- দাশুর কথা কেউ আর ভাবিবার সময় পাই নাই।
তারপর কি হল? দাশু রামপদ'র মিহিদানার হাঁড়িটাকে নিয়ে কি করেছিল? ইস্কুলে সেদিন কি ভয়ানক কান্ড হয়েছিল? জানতে হলে পড়ে ফেল 'সুকুমার সমগ্র রচনাবলী' থেকে 'চীনে পটকা' নামের ইশকুলের গল্পটা।
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী
তুলি-কলম
ছবিটি নেওয়া হয়েছে সুকুমার সমগ্র রচনাবলী থেকে।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন বইপোকা
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
সুকুমার রায়
আচ্ছা, সেদিন তুমি যখন বাবার কাছে বকুনি খেয়ে মুখ গোমড়া করে বসে ছিলে, তখন কি মা তোমাকে আদর করে গাল টিপে বলেছেন -'গোমড়াথেরিয়াম' বা দিদি তোমাকে আরো রাগিয়ে দিয়ে বলেছে 'রামগড়ুরের ছানা' ? বলেনি? আচ্ছা, সে নাহয় নাই বা বলল, কিন্তু তুমি এখন কি ভাবছ - গোমড়াথেরিয়াম মানে কি? আরে, গোমড়াথেরিয়াম হল এমন এক প্রানী, যে কিনা সব সময় মুখ গোমড়া করে থাকে! তার খবর আমরা জানতেই পারতাম না, যদি না প্রফেসর হেঁশোরাম হুঁশিয়ার তাঁর ডায়রিতে তার সম্পর্কে লিখে রাখতেন। আর প্রফেসর হুঁশিয়ার সম্পর্কেই বা জানলাম কি করে? - তারঁ সম্পর্কে আমাদের জানালেন তিনি, যিনি আমাদের সাথে আরো পরিচয় করালেন সব নানারকম মজাদার চরিত্রের - হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কাঠবুড়ো, কুমড়োপটাশ, কাক্কেশ্বর কুচকুচে, ন্যাড়া আর অবশ্যই সেই খুব দুষ্টু ছেলে দাশুর। তুমি এদের কাউকে কাউকে , বা সবাইকেই হয়ত চেন। যদি চেন, তাহলে তো জানই এদের স্রষ্টার নাম। আর যদি নিতান্তই না জান, তাহলে, বলি, এইসব অদ্ভূত নামের চরিত্রগুলির সৃষ্টিকর্তা ছিলেন -সুকুমার রায়। তিনি, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির বড়ছেলে, সত্যজিত রায়ের বাবা, লীলা মজুমদারের বড়দাদা।
সুকুমার ছিলেন ছয় ভাই বোনের মধ্যে মেজ। তার আগে ছিলেন তার দিদি সুখলতা। ছোটবেলায়, ছয় ভাই বোনের মধ্যে সুকুমার, যার ডাক নাম ছিল তাতা, সে ছিল সবথেকে হই হুল্লোড়ে। সব ভাই বোনেদের নিয়ে নানারকম মজার মজার খেলা আবিষ্কার করত সে। তার বাবা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন ভারতীয় মুদ্রনশিল্পের জনক। তাদের বাড়ি থেক প্রকাশিত হত ছোটদের জন্য রঙিন মাসিক পত্রিকা - সন্দেশ। বড় হওয়ার পরে, বাবার ইচ্ছায়, সুকুমার বিলেত যান মুদ্রনশিল্প এবং ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করতে। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ইউ রায় অ্যান্ড সন্স এর কাজকর্ম দেখতে শুরু করেন।
এই সব কিছুর মধ্যেই চলতে থাকে লেখালিখি। সুকুমার শুধু মজার মজার কবিতা ও গল্প লিখতেন না, তার সাথে সাথে আবার সব মজাদার চরিত্রগুলির ছবিও আঁকতেন। সেইসব কবিতা গুলি সেইসব মজাদার ছবির সাথে ছাপা হত।
এই সব মজাদার, উদ্ভট, আজগুবি, অসম্ভব কবিতাগুলিকে একসাথে করেই প্রকাশ করা হয়েছিল 'আবোল তাবোল'। 'আবোল তাবোল' যদি এখনও না পড়ে থাকো, তাহলে শিগগির পড়ে ফেল।
আরেকটা মজার বই হল হ-য-ব-র-ল। হ-য-ব-র-ল এর মত আজগুবি কিন্তু মজাদার গল্প আর দুটো হয়না। এই গল্পে নানারকম পাখি এবং পশুরা কথা বলে, এবং নানারকমের অসম্ভব ঘটনা ঘটায়। এই বইয়ের বিভিন্ন চরিত্র গুলির মধ্যে কাক্কেশ্বর কুচকুচে ব্যা-করণ সিং বি এ, খাদ্যবিশারদ , ন্যাড়া, হিজিবিজবিজ - এদের নাম তো করতেই হয়।
পাগলা দাশুর গল্প পড়েছ কি? যদি না পড়ে থাক, তাহলে আর দেরি না করে পড়ে ফেল। দাশু এক খুব মজাদার চরিত্র। সে ইশকুলে এমন এমন সব কান্ড ঘটায়, যে হেডস্যার পর্যন্ত মাঝে মাঝে ভেবে পান না দাশুকে বকবেন কি ছেড়ে দেবেন! কেউ কেউ বলে, দাশুটা একটা পাগল ছেলে; কেউ বলে, না, ও আসলে একটা দুষ্টূ ছেলে; এদিকে তাই বলে ভেব না, দাশুর মাথায় বুদ্ধি নেই; দাশু কিন্তু মাঝে মধ্যে পড়াশোনাটাও বেশ মন দিয়ে করে। পাগলা দাশু পড়ার পর দেখবে, দাশুকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কেন বলতো? কারন, ভাল করে ভাবলেই বুঝতে পারবে, তোমার ক্লাসের কোন একটা বন্ধুর সংগে দাশুর ভারি মিল! কোন বন্ধুটা, সেটা অবশ্য তোমাকে খুঁজে নিতে হবে।
ছোটদের মধ্যে তিনি বিলিয়েছিলেন অনাবিল হাসি আর স্ফূর্তির খোরাক। তাই বলে ভেব না, খালি হাসি-মজার গল্পই লিখতেন তিনি। দেশ বিদেশের নানারকমের আবিষ্কারের গল্প, মনিষিদের গল্প, রূপকথার গল্প, সরস ভাষায় ছোটদের জন্য লিখতেন তিনি। শুধু ছোটরা কেন, বড়রাও পেত তাদের ভাগের হাসির খোরাক। তাঁর বন্ধুদের নিয়ে তিনি প্রথমে গঠন করেছিলেন 'ননসেন্স ক্লাব' , এবং পরে 'মন্ডা ক্লাব'; সেই দলের সদস্যরা সোমবার (অর্থাৎ মনডে) একসঙ্গে দেখা করতেন, দেশ-সাহিত্য-সমাজ-শিল্প- এইসব বিষয়ে নানা রকম গুরুত্বপূর্ন আলোচনা করতেন আর প্রচুর হই-হুল্লোড় খাওয়া দাওয়া করতেন। এই সংগঠন গুলিতে যোগ দিয়েছিলেন সেই সময়ের প্রচুর বিখ্যাত মানুষ।
এত আনন্দ যিনি অকাতরে বিলিয়েছিলেন, আমাদের সেই মনের মানুষটি কিন্তু আমাদের ছেড়ে চলে যান খুব অল্প বয়সে। সেই সময়ে কালাজ্বর নামে এক অসুখ হত, যার কোন ওষুধ তখনও আবিষ্কার হয়নি। সেই কালাজ্বরের প্রকোপে, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, আঁকতে আঁকতে, লিখতে লিখতে, গল্প বলতে বলতে, আশেপাশের সব মানুষকে ছেড়ে চলে যান সুকুমার রায়। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন মন ভাল করা গল্প-কবিতা-নাটকের এক বিশাল ভাণ্ডার। তোমার - আমার সবার জন্য।
মহাশ্বেতা রায়
কলকাতা
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
আমার ছোট্টবেলাঃপর্ব ৮
পর্ব-৮
লিখছি বর্ষার কথা আর খাচ্ছি আম, লিচু, জাম--এই সব।তোমরাও নিশ্চয়ই মজা করে খাচ্ছ! তবে গরমখানা যা পড়েছে ! সাবধানে থেক
সবাই।
দেখ, এখন জৈষ্ঠ্য মাসের শেষের দিক। আজ কালের মধ্যেই বর্ষা আসার কথা। কিন্তু দেখছ'ত, তার আসার নাম গন্ধ পর্য্যন্ত নেই, ভ্যাপসা গরমে প্রাণ আইঢাই! আম পাকা গরম কিনা! অবশ্য এ লেখা যখন পড়বে তখন'ত সে এসে যাবেই, কদ্দিন আর না এসে পারবে!
চল আমার ছোটবেলার গ্রীষ্মবর্ষা দেখে নিই। গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু করি,কি বল।
তোমরা যারা শহরে থাক তারা বোধ হয় কোকিলের ডাক শোন নি। কিন্তু গ্রামের ছোটরা চৈত্র-বৈশাখের রাতে এডাক নিশ্চয়ই শুনেছ,কি বল।
কতদিন 'চোখ গেল' বা 'বৌ কথা কও'-- এমন সব ডাক শুনে ঘুম ভেঙে যেত এই সময়!
গ্রীষ্ম নিয়ে কথা, সুতরাং কালবৈশাখীর কথা ত বলতেই হবে। কবিগুরুর 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটা পড়েছ ত? এ লাইনটা মনে কর-- 'সেই মনে পড়ে জৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিক ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।'
শুধু জৈষ্ঠ্য নয়, চৈত্র- বৈশাখেও ছিল একদম তাই। জৈষ্ঠ্যতে পাকা আম আর চৈত্র-বৈশাখে কাঁচা পাকা মিলিয়ে। সব সময়েই আম কুড়াবার ধুম ! এখন ত ঝড় হতেই চায় না, কিন্তু সে সময় দু'একদিন পর পরই বিকেলের দিকে উত্তর-পশ্চিম আকাশ কালো করে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি ধেয়ে আসত, আর সংগে আসত ভয়ধরানো বজ্র-বিদ্যুত। ভয় পেয়ে দিয়ানির কোলে সেঁধিয়ে যেতাম। বাজ পড়ার সে ভয় আজ বুড়ো হয়েও কাটে নি। দাদুর কথায় বুঝতে পারতাম যে তাঁরও চিন্তা থাকত ঘুর্ণিঝড় নিয়ে, কেন না এটা হলে প্রায়ই শোনা যেত কারও না কারও বাড়ির চালা উড়ে গেছে ঘুর্ণিঝড়ে আর না হয় বজ্রপাতে কারও অপমৃত্যু হয়েছে। সে যে কি ভয়ের কথা, তা বলে বোঝানো যাবে না।
ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে মেঘ উড়ে গিয়ে বিকেলের রোদ উঠে পড়ত। আর আমাদের শুরু হয়ে যেত আম কুড়াবার পালা! ধামা ধামা কাঁচা আম
জড়ো হত। কি হত অত আম দিয়ে? দিয়ানি আর মামিমা সব আম কেটে রোদে শুকোতে দিতেন। শুকিয়ে কালো হয়ে কুড়মুড়ে হয়ে যেত আমের টুকরো গুলো, একে বলা হয় 'আমচুর', তোমরা বোধ হয় আমসি বল, তাই ত ? পরে অবশ্য সেগুলো আর কুড়মুড়ে থাকত না। বর্ষা বা অন্য কোন সময় যখন আম থাকত না তখন আমের স্বাদ পাবার জন্য ঐ আমচুর ব্যবহার হত।
আমাদের পাঠশালার সামনে যে মাঠটা ছিল তাতে এই গরমের সময় খুব জমিয়ে ফুটবল খেলা হত, মানে একটা প্রতিযোগিতা হত । নানা জায়গা থেকে নানা দল খেলতে আসত। হারজিত নিয়ে যেমন হৈ হল্লা হত, তেমনি ঝগড়াঝাঁটিও চলত খুব।
জৈষ্ঠ্যের এই সময় প্রতিদিন বিকেলে জলখাবার কি খেতাম বলত? কাসুন্দি দিয়ে মাখা নানা ধরনের পাকা আম। দিয়ানির আম কেটে মাখা হয়ে গেলে মামারা কেউ হাঁক দিতেন আমার নাম ধরে। রান্নাঘরের পেছনেই ছিল পাঠশালা আর তার পরেই মাঠ। আমি ত কান খাড়া করে ডাকের অপেক্ষাতেই থাকতাম! কোন কোনও দিন কাসুন্দি দিয়ে জাম মাখাও থাকত তার সাথে। কাসুন্দি কাকে বলে জানত ? বাজার থেকে নিশ্চয়ই কিনে আনেন বাবা, তাই না ? কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় ত কাসুন্দি বাজারে কিনতে পাওয়া যেত না কিনা, দিয়ানি বাড়িতেই বানাতেন। যাতে তাড়া তাড়ি সেটা খারাপ হয়ে না যায়,অনেক দিন ধরে খাওয়া যায়, সে জন্য অনেক নিয়ম মেনে শুদ্ধাচারে বানাতে হত।
আমের কথা বলছিলাম, সেটা বলি। কত রকম স্বাদের আম যে ছিল ! আর তার কি বিচিত্র সব নাম! শুনবে নাকি কয়েকটা ? ছোট তিল্যা, বড় তিল্যা (যে আমের গায়ে তিলের মত দাগ; তিল থেকে তিল্যা এসেছে), কানাই বাঁশি, পলান্যা(এ নামটা কেন হয়েছিল তা জানি না), গোপাল ভোগ, সিঁদুর্যা( পাকলে আমের রঙ সিঁদুরের মত রাঙা হত), চুকারি (এর কথা ত আগে বলেছি),ঝাঁপড়ি (এর আবার ছোট আর বড় দুটো গাছ ছিল)--এমন আরও কত নাম যে ছিল! সব মনে নেই।
আম পাকতে শুরু করলে প্রতিদিন সকালের দিকে ফুলমামা আর সোনামামা হরিশদাকে নিয়ে আম পাড়তে বেরতেন। আমিও যেতাম সংগে। মামারা গাছে উঠতেন হাতে 'কোঁটা' (আঁকশি) নিয়ে আর আমরা নীচে আম কুড়োতাম।
ওঁরা গাছে উঠে পাড়তে পাড়তেই হাতের নাগালে থাকা আম পেড়ে খেতে শুরু করতেন। প্রতিদিনই বড় এক ঝুরি করে আম হত। রোজ দু'বেলা পেট ভরে খেয়েও অত আম শেষ করা যেত না, একে ওকে দিয়ে দেওয়া হত, আর না হয় আমসত্ত্ব করতেন দিয়ানি। তোমরা যেরকম আমসত্ত্ব কিনে খাও তেমন মোটা মত নয়, বাড়িতে বানান আমসত্ত্ব পাতলা আর একটু কালচে মত হত, আর স্বাদটাও হত অনেক আলাদা। পাথরের থালা, কুলো বা পরিষ্কার কাপড়ের
ওপর পুরু করে আমের রস ছড়িয়ে রোদে শুকোতে দিতেন দিয়ানি। প্রথম পরত শুকিয়ে গেলে তার ওপরে আর এক পরত ছড়ান হত। এভাবে কয়েকবার করে, একটু পুরু হয়ে একেবারে শুকোনো হয়ে গেলে কাপড়ের মত ভাঁজ করে হাঁড়ির ভেতর রেখে দিতেন দিয়ানি। আমের দিন শেষ হয়ে গেলে আমের স্বাদ পেতে আমসত্ত্বের জুড়ি আর নেই।
কাঁঠালের গাছও ছিল অনেককটা, তাদেরও নানা নাম ছিল। তাদের মধ্যে একটা গাছের কথা বেশ মনে আছে। সেটার নাম ছিল 'মাথাভাঙা'। সেটা যখন ছোট ছিল কোনও কারনে মাথাটা ভেঙে গেছিল, তাতেই ওই নাম।
গাছটা ছিল লম্বা শিড়িংগে মত। তাতে অসংখ্য ছোট বড় কাঁঠাল ধরত কান্ড বেয়ে--একেবারে গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত। অনেক সময় গোড়ার দিকের কাঁঠাল পাকলে রাতের আঁধারে শেয়ালে খেয়ে যেত। সোনামামা খেতে পারতেন খুব। অনেক সময় ওই গাছে চড়ে কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে কোন পাকা কাঁঠাল হাতের কাছে পেলে সেখানে বসেই গোটাটা খেয়ে ফেলতেন। দাদু বা দিয়ানি দেখে বকাবকি করলে হো হো হেসে পাড়া কাঁপাতেন।
পাকা আমের যেমন রং ধরে, পাকা কাঁঠালের কিন্তু রং ধরে না।গন্ধে বোঝা যায় পাকল কিনা। তবে আমের মত পেকে মাটিতে পড়লে সেটা ছেতরে যাবে, খাওয়া যাবে না। তাই আধপাকা কাঁঠাল পেড়ে ঘরে রেখে পাকাতে হয়।
গাছে থাকা অবস্থায় হাত দিয়ে চাপড়ালে শব্দ শুনে বোঝা যায় আধপাকা হয়েছে কিনা আর নামানো যাবে কিনা। কাঁঠাল গাছ থেকে পেড়ে দাদুর ঘরের বারান্দায় সার দিয়ে রাখা হত বোঁটা থেকে আঠা ঝরে যাবার জন্য। এমন ভাবে রাখা হত যাতে আঠা মাটিতে পড়ে, বারান্দায় না পড়ে।
এর পর দেওয়া হত 'কচি'। নামটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে ত! কি আর করা যাবে, যেমন নাম তেমনই ত বলতে হবে। আসলে কচি দেওয়ার অর্থ কাঁঠাল পাকাবার ব্যবস্থা করা।
বাঁশের একটা সরু বাখারিকে ফুটখানেক করে কেটে একটা মুখ ছুঁচল করা হত। ওই সরু মুখটা ঠুকে ঠুকে বোঁটার ভেতর দিয়ে কাঁঠালের ভেতরে অনেকটা ঢুকিয়ে দিয়ে একটা গর্ত করা হত। এবার ওই গর্তের মধ্যে ঠেসে ঠেসে ভরা হত নুন। এই অবস্থায় রেখে দিলে দু'এক দিনের মধ্যেই পেকে যেত কাঁঠাল।
আর পাকলেই চারদিক গন্ধে একেবারে ম ম ! ঘন দুধ আর পাকা আম বা কাঁঠাল দিয়ে ভাত, একবার যে খেয়েছে সে ভুলতে পারবে না।
তোমরা আম দিয়ে দুধভাত নিশ্চয়ই খেয়েছ, কিন্তু কাঁঠাল দিয়ে খেয়েছ কি ? না খেয়ে থাকলে মা'কে বলে দেখ না একবার।
কাঁঠাল খাওয়া মুশকিলই বটে! যা বড়, খেয়ে শেষ করা যায় না। তা ছাড়া আঠার ঝামেলাও কি কম ?
কবিগুরুর আর একটি ছড়ার কথা মনে পড়ল, সেটা হল--
আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে।
হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।।
বুঝতেই পারছ কেমন স্বাদ খাবারের! পিঁপড়ে কাঁদবে, এতে আর আশ্চর্য্য কি!
আমি অবশ্য এতগুলো জিনিষ একসাথে দুধে ফেলে খাইনি, তবে আমসত্ত্ব দুধে ফেলে খেয়েছি। আর আম কাঁঠালের কথা ত বলেইছি।
এই ভাবে গ্রীষ্ম শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে বর্ষা এসে পড়ত। শুরু হয়ে যেত আর এক মজা।
প্রচন্ড গরমের মাঝে একদিন দেখা যেত দক্ষিণ-পুর্ব আকাশে ঘন কাল মেঘ। ক্রমে সে মেঘ সমস্ত আকাশ ঢেকে ফেলত, শুরু হত প্রথমে টিপি টিপি , আর তারপর ঝমঝমিয়ে প্রবল বৃষ্টি। অত গরমের পর বৃষ্টি দেখে আনন্দে সবাই উঠোনে বেরিয়ে পড়তাম জলে ভেজার জন্য। দাদু-দিয়ানি বকাবকি শুরু করে দিতেন, পাছে জলে ভিজে অসুখ-বিসুখ করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
বর্ষার প্রাথমিক আনন্দ কেটে যাবার পর শুরু হয়ে যেত ঘ্যান-ঘ্যানানি বৃষ্টি, এতে খারাপ লাগলেও একটা ব্যাপারে খুব উতসুখ থাকতাম।
চারিদিকে শোনা যেত বন্যার খবর, এখন শুনতে খারাপ লাগে, কিন্তু সে সময়ে অতটা বুঝতাম না। বন্যার খবর পাওয়ার পরই উতসুক থাকতাম এই ভেবে কবে আমাদের দিকে ওই জল আসবে, আর বড় 'পাগারে' পড়বে!
'পাগার' কথাটার মানে ত' নিশ্চয়ই জান না। এর অর্থ হল একটা বড় ডোবার মত গর্ত। গ্রামের বাড়িঘর বন্যার জলের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বাড়ি তৈরীর সময় ভিটে উঁচু করতে হত। সে সময় কোন জায়গা থেকে মাটি কেটে নেওয়া হত। অনেক মাটি লাগত কিনা। তাই বড় বড় গর্ত তৈরী হয়ে যেত, তাদেরই কোনটার নাম হয়ে যেত 'বড় পাগার' আবার কারও নাম হত 'ছোট পাগার'।
বিশাল বড় নদী যমুনা খুব কাছে না থাকলেও ঐ নদীর জন্যই বোধ হয় বন্যা হত প্রতি বছর। বৃষ্টির জলে ওই নদী ফুলে ফেঁপে উঠে ভীষনাকার হয়ে যেত। উপচে পড়া নদীর জল ঢুকে পড়ত আশ পাশের ডাঙা জমিতে, গ্রামে-গঞ্জে। আমাদের গ্রামে আসত একটা নালা পথ দিয়ে যাকে বলে 'জোলা'।
জোলাপথের থেকে পাগারগুলো সাধারনত একটু বেশী গভীর হয়। তাই জোলাপথের জল পাগারে পড়ার সময় জোর শব্দ হয় ঝরণার মত। সে শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়।
কোন বছর সে শব্দ দিনে দুপুরে শোনা যেত, আবার পরের বারই হয়ত ঘুমভাঙা ভোরে শুনতে পেতাম। সে শব্দের অনুভুতি, আনন্দ তোমাদের বোঝান আমার কম্ম নয়।
এই খানে একটা কথা বলে নি। সেই যে আমার ঘুম ভাঙানোর কথা বলেছিলাম একেবারে শুরুতে-- সেই যে ঘুঘুর ডাক বা হেমন্তের ভোরের শিশিরের শব্দে ঘুম ভাঙার কথা, সে রকম বর্ষার কোন কোনও ভোরে ঘুম ভাঙত বৃষ্টির মিষ্টি শব্দে! টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ ভারি মিঠে, তা সে ঝিরঝির করেই হোক আর মুষলধারেই হোক। এমন শব্দ শুনেছ কখনও? কেউ কেউ শুনে থাকতে পার যারা টিনের চালওয়ালা বাড়িতে থাক।
যে কথা বলছিলাম।
পাগারে জল এলেই গ্রামের সব ছেলেরা, এমনকি বড়রাও, এসে ভিড় জমাত পাগারের ধারে। অতি উতসাহে ছোটরা কেউ কেউ আবার নেমে পড়ত জলে, বার বার সাঁতরিয়ে এপার ওপার করত।
আমি সাঁতার জানতাম না বলে আমার জলে নামা প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। এছাড়াও ছিল নতুন জলে স্নান করে অসুখ-বিসুখ হওয়ার ভয়ও।
বন্যার জল ক্রমশঃ বাড়তে বাড়তে সমস্ত ডাঙা জমি ডুবিয়ে দিত। চারিদিক জলে জলময় হয়ে যেত, উঁচু ভিটেওয়ালা বাড়িগুলো জলের মধ্যে দ্বীপের মত দাঁড়িয়ে থাকত শুধু।
খেলা ধুলা, পাঠশালা, বন্ধুদের সাথে দেখাশোনা সব বন্ধ একদম। বড়রাই শুধু নৌকা করে এখানে ওখানে যাওয়া আসা করতেন।
যাদের নৌকা ছিল না তারা বানিয়ে নিত কলাগাছের ভেলা। চার পাঁচটা কলা গাছ পাশাপাশি রেখে আড়াআড়ি দু'তিন জায়গায় বাঁশ বেঁধে নিলেই হয়ে যেত ভেলা। দু'একজন মানুষ সহজেই যাতায়াত করতে পারত।
বাড়ির দক্ষিন দিকে একটা স্বর্নচাঁপার গাছ ছিল। একটা দুটো কালবৈশাখী হয়ে গেলেই গাছ ফুলে ফুলে ভরে যেত। আর বর্ষায় সংখ্যাটা দ্বিগুন হত, আর তার গন্ধে চারি দিক ম ম করত। গন্ধরাজ ফুলও চাঁপার সাথে পাল্লা দিয়ে একই কায়দায় ফুটত।
ওর পাশেই ছিল একটা কদম ফুলের গাছ, শ্রাবণ মাসে ফুটত কদম ফুল, গাছ ভরে। ভারি সুন্দর দেখতে ছিল ফুলগুলো, আর কি তার মাতাল করা গন্ধ !
বর্ষার জল পেলে বা তারও আগে থেকে বাগানের মাটি ফেটে বেরত ভুঁইচাঁপা ফুল। হ্যাঁ, ফুল আগে ফুটত, তারপর গাছ বেরত।
আরও নানা ধরনের লিলি ফুলের গাছ ছিল বাগানে, কত তার রঙ, কত তার গন্ধ !
জোলার পথে যেখান দিয়ে জল ঢোকে তার মুখে বাঁশের একটা ত্রিকোনাকার ফ্রেমের মত বানিয়ে তাতে বাঁধা হত খুব বড় মাছধরা জাল। বাঁধত জেলে ভাইয়েরা। এর নাম ছিল 'খরাজাল'। স্রোতের টানে ছুটন্ত জলে থাকা মাছেরা সব আটকে যেত জালে। নানা ধরনের ছোট বড় মাছ ধরা পড়ত, মামারা কিনে আনতেন মাঝে মাঝে।
জেলেভাইরা নানা রকমের জাল ব্যাবহার করতেন মাছ ধরার জন্য। টানা জাল, খ্যাপলা জাল- এমন সব নাম ছিল জালের। সব মনে নেই।
অনেক সময় মাছ কিনতেই হত না, কেননা মামারা নানা কায়দায় মাছ ধরতেন নিজেরাই। সে সব বলি দু'একটা। প্রথমেই বলতে হয় 'দোয়ার'-এর কথা। এটা ছিল বিশেষভাবে তৈরী একটা খাঁচার মত, বাঁশের সরু সরু কাঠি দিয়ে তৈরী। ভেতরে যাবার রাস্তা থাকে, কিন্তু বেরোবার রাস্তা মাছেরা খুঁজে পায় না, এমন ভাবে বানানো সেটা। খাবারের লোভে একবার ভেতরে ঢুকলে মাছ আর বেরতে পারে না। হ্যাঁ, খাবার ত দিতেই হত। ধান গাছের মধ্যে থাকত ফড়িং এর মত এক ধরনের পতংগ। সেগুলোই ছিল মাছেদের খাবার। যেখানে জলের স্রোত আছে এমন জায়গায় দোয়ার পাতা হত। সন্ধ্যাবেলায় পাতা হলে পরের দিন ভোরে অনেক মাছ পাওয়া যেত। সবই ছোট মাছ।
বড় মাছ ধরার জন্য ছিল 'জেয়ালা' দেওয়া। এটা একটা মাছধরা ছিপই, তবে তার হাতলটা ছিল মোটা কঞ্চি বা বাঁশের ডগা দিয়ে বানানো আর সুতোও ছিল বেশ মোটা। আর বঁড়শিটা ? সেটাও ছিল বড়সড়, যাতে আর, বোয়াল বা রিঠার মত বড় মাছেরা টোপ গিলতে পারে।
তার টোপ ছিল কি বলত ? একটা আস্ত জ্যান্ত ব্যাঙ বা ছোট মাছ! এর পিঠে বঁড়শি গেঁথে ছিপটা গাড়া হত মাটিতে এমনভাবে, যাতে ব্যাঙ বা মাছ জলের ঠিক ওপরে ভেসে ছটফট করতে থাকে আর জলে খলবল করে আওয়াজ তোলে।
বুঝতেই পারছ অল্প জলেই বড় মাছ ধরার জন্য এই জেয়ালা দেওয়া হত। অল্প জল না হলে মাটিতে ছিপ গাড়া হবে কি করে বল ? জ্যান্ত ব্যাঙ বা মাছের শব্দ পেয়ে বড় মাছেরা এসে খপ করে টোপটা গিলে ফেলত বঁড়শি শুদ্ধ । সন্ধ্যায় পেতে রাখলে সকালে প্রতিদিনই কোন না কোনও মাছ ধরা পড়ত।
বড়মামা আর ছোটমামা ছিপে মাছ ধরতেন। বর্ষার শুরুতেই তৈরী হত সেই ছিপ।আমাকেও দিতেন একটা ছোট ছিপ, ছোট মাছ ধরার জন্য। বঁড়শিতে কেঁচো গেঁথে ছিপ ফেললে একটু পরেই ফাতনা নড়ে উঠত, আর মওকা বুঝে টান মারতেই উঠে পড়ত মাছ- ট্যাংরা, পুঁটি বা চ্যালা-- এমন মাছই উঠত সব।
ফুলমামা আর সোনামামা আবার গামছা দিয়েও মাছ ধরতেন! কিভাবে বলত? বর্ষায় অনেক মা মাছই ছোট ছোট অসংখ্য বাচ্চা নিয়ে জলে ভেসে বেড়ায়। মামারা দুজনে আড়ি পেতে থেকে সেরকম মাছ গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতেন।একবার এমন করে মাছ ভেবে ব্যাঙের বাচ্চা তুলে দাদুর কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলেন মামারা। ব্যাঙাচিরা অবিকল মাছের বাচ্চার মত দেখতে কিনা!
মাছ ধরা ছাড়া মামাদের কি আর কোনও কাজ ছিল না ? থাকলেই বা কি ! নৌকা ছাড়া ত কোথাও যাওয়া যেত না, তাছাড়া তাওত মোটে একখানা! একজন নিয়ে বেরিয়ে গেলেই হল আর কি! চারিদিকে এমন জল দেখতে দেখতে শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম।
দাদুও মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তেন মাছ ধরতে, অবশ্যই নৌকা নিয়ে। আমাকে ডেকে নিতেন মাঝে মাঝে। হরিশদা নৌকা বাইত।
ধানক্ষেতের মজা কি বলত ? জল দাঁড়িয়ে যত উঁচু হত, ধান গাছগুলো তত বাড়ত। দাদু হরিশদাকে ধানক্ষেতের মধ্যে নৌকা নিয়ে যেতে বলতেন। দাদুর হাতে থাকত একটা অস্ত্র যা দিয়ে মাছ ঘায়েল করা যায়। তার নামটা হল 'কোঁচ'। এমন নাম শুনেছ কখনও? অদ্ভুত না?
এটা দেখতেও অদ্ভুত। একটা লম্বা বাঁশের ডগায় ঝাঁটার মত করে আঙুলের মত মোটা মোটা আটদশটা লাঠি বাঁধা। লাঠির মাথায় আবার বর্শায় যেমন থাকে তেমনি লোহার সরু সরু ফলা লাগানো। লাঠির ডগা গুলো আবার গোলাকার করে ছড়ানো থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন লম্বা হাতলওয়ালা একটা বিরাট ঝাঁটা।
ধানক্ষেতের মধ্যে ঢুকে খুব ধীরে ধীরে নৌকা চালাত হরিশদা যাতে শব্দ না হয়, আর তীক্ষ্ণ নজর রাখত ধানগাছগুলোর দিকে। দাদুও খুব নজর করতেন। কি দেখতেন বলত ? কোনও গাছ নড়ছে কিনা !
গাছ নড়া মানেই হল ওর গোড়ায় কোনও মাছ আছে। গাছের গোড়ায় জমে থাকা প্রিয় খাবার শেওলা খাচ্ছে। হরিশদা দেখতে পেলে ইশারা করত দাদুকে বা তিনি নিজে দেখতে পেলেও, কোনও শব্দ না করে ছুঁড়ে মারতেন কোঁচখানা। অতগুলো বর্শা কিনা, একটা না একটা মাছের গায়ে বিঁধে যেতই। সেখানা বিঁধে গিয়ে মাছ ছটফট করত। মাছ গেঁথেছে বুঝলে হরিশদা ঝাঁপিয়ে পড়ত জলে আর তুলে আনত মাছটা কোঁচ থেকে ছাড়িয়ে। এভাবে অনেক বড় বড় মাছ ধরতে দেখেছি।
কোনও দিন শুধুই নৌকা করে ঘুরতে যেতেন দাদু অনেক দূরে দূরে। একদিনের কথা মনে আছে। এক চাষিভাইয়ের বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় দাদু তার নাম ধরে হাঁক পাড়লেন। সে এলে হাঁসের ডিমের দাম জিজ্ঞেস করলেন। টাকায় বিশটা না আঠারটা, তা নিয়ে বিস্তর দর কষাকষি হয়েছিল সেদিন। শেষ পর্যন্ত টাকায় বিশটা রফা হয়েছিল।
খুব অবাক হচ্ছ হয়ত, কিন্তু তখন একটাকা রোজগার করতে কালঘাম ছুটে যেত! টাকার দাম এখন কমে গেছে, তাই এখন একটা হাঁসের ডিমের দাম টাকা পাঁচেকের মত বোধ হয়!
পাট কি তা নিশ্চয়ই জান। ওখানে অনেক পাট চাষ হত। খুব সম্ভব বর্ষার শেষের দিকে পাট বড় হয়ে গেলে, সেটা কাটা হত। পাট কেটে আঁটি বেঁধে বেঁধে, সেই আঁটি গুলো জলে ডুবিয়ে পচানো হত। পাটকাঠি দেখেছ ত ? খুব হালকা। পাট গাছগুলোও হালকা। জলে ডুবতে চাইত না। অনেকগুলো আঁটি পাশাপাশি জলে ভাসিয়ে তার ওপর বাঁশ বা গাছের ডাল-- এই সব চাপিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া হত।
ক'দিন পর জলে ডুবে থেকে গাছগুলো পচে গিয়ে ভারি দুর্গন্ধ ছড়াতো। হরিশদা, আর আরও অনেকে ওই পচা গাছ থেকে পাটের আঁশ ছাড়াতো। পাটগাছের ছালটাই হল পাটের আঁশ। ছাল ছাড়াবার পর যেটা পড়ে থাকে, সেটাই হল পাটকাঠি। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করতে হত এসব। দিনভোর কাজ করত ওরা। কি কষ্ঠ বল! পাট ছাড়িয়ে গোছা বেঁধে বেঁধে কাপড় মেলার মত করে রোদে শুকতে দিত ওরা।
শ্রাবনের শেষের দিকে জলটা বেড়ে গিয়ে কেমন যেন শান্ত হয়ে যেত, জলে ভেসে আসত নানা ধরনের জলজ গাছ আর শেওলা। অদ্ভুত দেখতে সে সব। আর ছিল কচুরীপানা। তাতে ফুটে থাকত অজস্র হালকা নীল রঙের ফুল। দূর থেকে ভারি ভাল লাগত দেখতে। এটা কি জান যে কচুরীপানার ফুলের ব্যাসনভাজা খাওয়া যায় আর সেটা সুস্বাদু ? ঘাটে নৌকা বাঁধা থাকলে তার গলুইয়ের ওপর উপুর হয়ে শুয়ে শুয়ে এই সব দেখতাম। একদিনের কথা খুব মনে আছে। জলে পচে মরে যাওয়া একটা ঝোপের একটা কাঠি কি করে যেন জলের ওপর সোজা দাঁড়িয়ে ছিল আর একটা ফড়িং সেই কাঠিটার মাথায় বসার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একবার করে বসছে আবার পরক্ষণেই উড়ে যাচ্ছে! কিছুতেই আর বসা হচ্ছিল না! এরকম ভাবে কতবার আর কতক্ষণ যে করেছিল সে বলতে পারব না। শেষে আমিই অধৈর্য্য হয়ে সেখান থেকে চলে গেছিলাম!
আশ্বিনে, কোন কোনও বার ভাদ্রের শেষের দিকে, জল নামতে শুরু করত। তখন বাড়ির পেছন দিকের জমিতে জল কমে যেত। এখানে নৌকা বাঁধা থাকত অনেক সময়। একদিন সাহস করে দড়ি খুলে হাতে ছোট একখানা লগি নিয়ে নৌকা বাইবার চেষ্টা করেছিলাম। দু'এক বারের চেষ্টায় পেরেছিলাম নৌকা চালাতে। দেখলে মনে হতে পারে এটা সোজা কাজ, কিন্তু মোটেই সহজ নয়। ভারি শক্ত নৌকা বাওয়া। দাদু কিন্তু সেদিন দেখেছিলেন, তবে কিছু বলেন নি। কেন বল দেখি ?
তোমাদের মত ছোটরা এটা কখনও না কখনো নিশ্চয়ই ভাব, 'ধ্যাত, কিচ্ছু ভাল লাগে না। কবে যে বড় হব!' কোনও সময় হয়ত বড়দের মত কোন কাজ করেও ফেল সাহস করে। বাবা-মা সেটা দেখেও না দেখার ভান করেন। কেন বল দেখি ? কারন তাঁরা জানেন, তোমাদেরও ত বড় হয়ে একা একাই সব কাজ করতে হবে একদিন!
আমার দাদুও একই কারনে কিছু বলেন নি, কেন না আমাকেও কোন দিন নৌকা বাইতে হতেও ত পারে একা একাই!
অবশ্য তেমন কাজ করতে হয় নি। কলকাতায় আর নৌকা বাইব কি করে ?
ঠিক ধরেছ! আমার যখন বছর দশেক বয়স তখন এমনই এক শ্রাবণ মাসের থৈ থৈ জলের মধ্যে নৌকা করে মা ভাই বোনেদের সাথে পাড়ি জমিয়েছিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। আর কোনদিন ফিরে যেতে পারিনি মামাবাড়ির গ্রামে, অথবা পাবনা শহরে।
অনেক কিছু লেখা হল, আবার অনেক কিছুই লেখা হল না। কিন্তু কি আর করা যায়। একদিন ত থামতেই হয়। তাই না ?
(সমাপ্ত)
সন্তোষ কুমার রায়,
রুপনারায়নপুর।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সন্তোষ কুমার রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
আমার গরমের ছুটি
আমি মধুরিমা। এবারের গ্রীষ্মের ছুটি আমি একটু অন্যভাবে কাটিয়েছিলাম। প্রথমেই আমার স্কুলের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আমি নাচ করলাম। তারপর সত্যজিত রায় পার্ক থেকে আমাকে রবি ঠাকুরের জন্মদিনে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমি "সুরের গুরু" গানটি গেয়েছিলাম। এবারে আমার মায়ের স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে আমি নাচের ও ক্লে মডেলিং এর ক্লাস করেছিলাম। সেখানে মাটি দিয়ে নানারকমের পাখি, জন্তু আর অন্য অনেক জিনিষ তৈরি করেছিলাম। এছাড়া বি পি টাউনশিপের কো-অপারেটিভের ফোরাম, তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য , আমাকে নৃত্যে অংশগ্রহনের জন্য নির্বাচিত করে। আমি সেই অনুষ্ঠানে 'গীতাঞ্জলি' নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠানটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডঃ ত্রিগুনা সেন' হলে হয়েছিল। এছাড়া আমাদের বৈষ্ণবঘাটা উপনগরীতে প্রতিবছর লোকসংস্কৃতি মেলা বসে।সেখানে আমি গান ও নাচে অংশগ্রহণ করেছিলাম।
মাঝে মাঝে দুপুরবেলায় বসে অনেক ছবিও এঁকেছি। বিকেলবেলা বন্ধুদের সাথে খেলাধূলা করতেও ছাড়িনি। একদিন সব বাড়ির বন্ধুরা মিলে চাঁদা তুলে খাওয়া-দাওয়া করেছি। সব কিছুর মধ্যে পড়াশোনাও বাদ দিইনি। কারণ, ছুটির পর স্কুল খুললে আমার পরীক্ষা শুরু।
আঁকা ও লেখাঃ
মধুরিমা গোস্বামী
ষষ্ঠ শ্রেণী
ওয়েল্যান্ড গোল্ডস্মিথ স্কুল, পাটুলি
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মধুরিমা গোস্বামী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত