সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

৪ঃ যাত্রা শুরু


আমাদের জাহাজ এম এস মিডনাৎসোল

আন্টার্কটিকা পৌঁছানোর জন্য আমার সামনে খোলা ছিল তিনটি পথ —দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আমেরিকা— এই তিন জায়গা থেকে আন্টার্কটিকা যাওয়ার জাহাজ ছাড়ে। ভারত থেকে সব থেকে কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রথম পথ। শুধু প্রথম না, সহজ এবং সব থেকে কম খরচায় যাওয়া যেত। কিন্তু সেখান থেকে ছাড়া জাহাজের সংখ্যা খুব কম। নিউ জিল্যান্ড থেকে ছাড়া জাহাজগুলি আন্টার্কটিকা পৌঁছতে সব থেকে বেশি সময় নেয় এবং আসল মহাদেশের থেকে যাত্রাপথে সময় কাটে বেশি। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ হল আন্টার্কটিকা থেকে সব থেকে কাছে, যার মানে হল,আমাদের পৌঁছতে সব থেকে কম সময় লাগবে, আর আন্তার্তিকাতে আমি বেশি সময় কাটাতে পারব। অবশ্য ভারত থেকে পৃথিবীর উল্টোদিকে দক্ষিণ আমেরিকা পৌঁছানোই প্রায় একটা অভিযানের সমান। কিন্তু সেই পথটাই আমার সব থেকে ঠিক মনে হল। বেশিরভাগ জাহাজগুলি ছাড়ে আর্জেন্টিনার উশুয়াইয়া থেকে কিংবা চিলির পান্টা আরেনাস বন্দর থেকে। আমি ১৩ দিনের আন্টার্কটিকা অভিযানের জন্য উশুয়াইয়া থেকে ছাড়বে, নরওয়ের ভ্রমণ সংস্থা পরিচালিত এমন একটি ক্রুজ লাইনারকে বেছে নিলাম ।


আর্জেন্টিনার দক্ষিণতম প্রান্তের বন্দর শহর উশুয়াইয়া

উশুয়াইয়া হল দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম প্রান্তে অবস্থিত এক বন্দর  শহর। একে ঘিরে রয়েছে তিয়েরা দেল ফিউগো ন্যাশ্‌নাল পার্ক। এই অদ্ভুত সুন্দর জায়গাতে এসে প্রাকৃতিক ভারসাম্য যেমন অনুভব করা যায়, তেমনি আন্দাজ করা যায়, মানুষ কীভাবে সেই ভারসাম্য নষ্ট করছে। আমাদের জাহাজ এম এস মিডনাতসোল একটা মাঝারি মাপের জাহাজ, যার যাত্রী সংখ্যা প্রায় সাড়ে চারশো। এক সূর্য-ডোবা বিকেল বেলায় যখন আমাদের  জাহাজ বিগ্‌ল্‌ চ্যানেল বেয়ে চলতে শুরু করল, আমি আরেকবার অনুভব করলাম, এটা আমার জীবনের জন্য কত বড় একটা ব্যাপার। আমার দুইবছরের পরিকল্পনা আমার চোখের সামনে বাস্তবায়িত হচ্ছে, এই অনুভূতি আমার মনের জোর অনেক বাড়িয়ে দিল।

আমাদের সঙ্গে ছিলেন এই ধরণের অভিযান সম্পর্কে অভিজ্ঞ এক বিশেষজ্ঞের দল। মেরু অঞ্চলের আবহাওয়া আর আমরা যে সব সাগর পেরিয়ে যাব, সেগুলির বিষয়ে তাঁরা আমাদের নানা তথ্যের যোগান দিলেন। প্রথম কয়েক ঘন্টায় আমি বিগ্‌ল্‌ চ্যানেল সম্পর্কে দারুণ সব তথ্য পেলাম।


বিগ্‌ল্‌ চ্যানেল

বিগ্‌ল্‌ চ্যানেলের নামকরণ হয়েছে HMS Beagle নামক এক প্রাচীন জাহাজের নামে। এই জাহাজের দ্বিতীয় অভিযানে তার যাত্রী ছিলেন চার্লস্‌ ডারউইন। ডারউইন তখন বাইশ বছরের এক স্নাতক, যিনি ধর্মযাজকের চাকরি শুরু করার আগে একবার ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলি ঘুরে দেখতে চেয়েছিলেন। এই যাত্রার সময়ে তিনি অবলুপ্ত স্তন্যপায়ীদের জীবাশ্ম খুঁজে পান। এই বিষয়ে তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়। তিনি গভীরভাবে গাছপালা-পশুপাখিদের ওপরে পড়াশোনা শুরু করেন ,যে পড়াশোনার ফসল হল তাঁর Theory of Evolution বা বিবর্তনবাদ। আমি কি কোনো দিন ভেবেছিলাম যে ডারউইন সাহেব যে পথে অভিযানে গেছিলেন, আমিও সেই পথেই একদিন আন্টার্কটিকা পাড়ি দেব!


জাহাজের ক্যাপ্টেন সবাইকে নৈশভোজে স্বাগত জানাচ্ছেন

এইসব যখন ভাবছি, তখন জাহাজে ঘোষণা করা হল যে সবাইকে ক্যাপ্টেন্‌স্‌ ডিনারে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। ক্রুজ জাহাজের এটা একটা নিয়ম যেখানে ক্যাপ্টেন নৈশভোজে সমস্ত যাত্রীদের স্বাগত জানান এবং জাহাজের সমস্ত কর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি সবে নিজের ওয়েলকাম ড্রিঙ্কের পাত্রটি হাতে নিয়ে বসেছি, অমনি সামনের টেব্‌ল্‌টি নড়তে শুরু করল। সে এমনই নড়া যে তার ওপরে কিছুই রাখা যাচ্ছে না। আমি ভাবছি নির্ঘাৎ জাহাজের কোনো বড় যান্ত্রিক গোলযোগ শুরু হল,এমন সময়ে লাউডস্পিকারে বেশ হাসি আর মজা মেশানো সুরে ঘোষণা হল, "বিশ্বের রুক্ষতম সাগরে আপনাকে স্বাগত জানাই!"

৫ঃ বিশ্বের রুক্ষতম সাগর

বিশ্বের রুক্ষতম সাগর - শুনে মোটেও ভেবো না মজা করছি। দক্ষিণ আমেরিকার কেপ হর্ন আর আন্টার্কটিকার সাউথ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের মাঝে পড়ে যে সাগর, তার নাম ড্রেক প্যাসেজ বা ড্রেক প্রণালী এবং এটি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আন্টার্কটিকা যাওয়ার সবথেকে কম দৈর্ঘ্যের পথ। ড্রেক প্রণালীর নাম হয়েছে ইংরেজ অভিযাত্রী স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক এর নামে। ১৫৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক প্রবল ঝড়ের রাতে , স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের জাহাজ ভেসে গেছিল দক্ষিণের গভীর সমুদ্রের দিকে। আর এইভাবেই দক্ষিণ আমেরিকার আরও দক্ষিণে আবিষ্কৃত হল এই নতুন জলভাগের। এটা একটা বেশ্ মজার ব্যাপার যে, বেশিরভাগ সমুদ্র আর জলভাগের আবিষ্কার এইভাবেই হয়েছে, নানারকমের দুর্ঘটনা কিংবা আবহাওয়ার গন্ডগোলের ফলে।

এদিকে সেই টেব্‌ল্‌ এর অল্পঅল্প দুলুনি ক্রমশঃ প্রবল হয়ে উঠল।মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল, দেখলাম ঘরের সমস্ত জিনিষ এদিক ওদিক পড়ে যাচ্ছে। আমি বিখ্যাত  ড্রেক শেকের কথা শুনেছি আগে, মনে মনে খুব ইচ্ছে ছিল সেই অভিজ্ঞতা চাক্ষুষ করার। আমি নিজের কেবিন থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু সোজা দাঁড়িয়ে থাকাই তো তখন একটা কঠিন কাজ হয়ে গেছে, কারণ আমাদের জাহাজ ভয়ানক দুলছে। আমি চারদিক থেকে টেব্‌ল্‌, চেয়ারের নড়াচড়ার আওয়াজ পাচ্ছি, জিনিষ পড়ে যাওয়ার ধুমধাম আওয়াজ পাচ্ছি। কোনোমতে রেলিং ধরে ধরে আমি খুব কষ্টে ডেকের কাছে পৌঁছে প্রবল ঝড়ের মত আওয়াজ আর ভয়ানক হাওয়ার তোড়ের সামনে পড়লাম । আমি আমার সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে, দম বন্ধ করে রেলিং শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক সময়ে আমার শরীরের কাঁপুনি কমে এল। আর আমি অবাক চোখে দেখলাম, প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু ঢেউ লাফিয়ে উঠে আমাদের জাহাজের চার তলার জানলাগুলিকে ধাক্কা দিচ্ছে। ফুলে ফুলে ওঠা ঢেউয়ের ওপরে, প্রবল হাওয়ার ধাক্কায় আমাদের জাহাজ ভয়ানকভাবে দুলে চলেছে। আমার মনে হল, এটা যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সেই শেষ মূহুর্ত হয়, তাহলে সেটা হবে এক বিরাট শক্তিশালী তান্ডব নৃত্যের অনুষ্ঠানের মাঝখানে।


ড্রেক প্রণালীর বিশাল উঁচু ঢেউ

শোনা যায়, ড্রেক প্রণালীর এই অভিজ্ঞতা মানসিকভাবে খুব শক্ত মানুষকেও দুর্বল করে দেয়। কেউ কেউ এই অভিজ্ঞতাকে মনে করেন এক দুর্দান্ত অভিযানের মত, কেউ কেউ আবার এই অভিজ্ঞতাকে কাব্যিক মনে করেন। যতক্ষণ ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারলাম, আমি সেইখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপরে সাবধানে ফিরে এসে এক কোণে বসে পড়লাম। এইমাত্র যা দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতা আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। সমুদ্রের ঐ ভয়ানক দাপট দেখার পরে আমার একটাই কথা মনে হয়েছিল, আমরা সবাই যেন জীবন সমুদ্রের ঢেউগুলিকে পার করে করে ভেসে চলেছি, আর আমাদের বেঁচে থাকা বা ডুবে যাওয়া, পুরোটাই ভাগ্যের ব্যাপার। তখন আমি জানতাম না, আর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আমাদের সভ্যতা, প্রতিদিনের জীবনে এই ভাবনাতেই কেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।

৬ঃ আন্টার্কটিক সারকাম্‌পোলার কারেন্ট

প্রতিটা আঁধার রাতের শেষেই ভোর হয়।কিন্তু এম এস মিডনাতসোলের যাত্রীদের জন্য সকালটা খুব অন্যরকম হল না। বেশিরভাগ যাত্রী সী-সিকনেস এ ভুগছিলেন। সকালে খাবার জায়গা প্রায় ফাঁকাই থাকল। যাঁরা নিজেদের শরীরকে নিয়ন্ত্রনে এনে জলখাবার খেতে এলেন, তাঁরা নিজেদের খাবার প্লেটকে সোজা রাখতে নাস্তানাবুদ হলেন। একমাত্র জাহাজের কর্মীরাই দেখলাম বেশ স্বাভাবিক আছেন। তাঁরা আমাদের জানালেন, সব কিছু ঠিক আছে আর এই ড্রেক শেক জাহাজের কোনো ক্ষতি করবে না। সামান্য প্রাতঃরাশ সারতে সারতে আমার বন্ধুত্ব হল নরওয়ের একজন ৬০ বছর বয়সী দিদিমার সঙ্গে! এই যাত্রার কয়েকদিনে আমার সঙ্গে ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নানা বয়সী মানুষের পরিচয় হবে।


আন্টার্কটিক সারকাম্‌পোলার কারেন্ট এবং আন্টার্কটিক কনভারজেন্স

ড্রেক শেক-কে মনের ভেতর থেকে দূর করার জন্য আমি 'আন্টার্কটিক সারকাম্‌পোলার কারেন্ট' এর ওপরে একটি আলোচনায় শ্রোতা হলাম। আন্টার্কটিকাকে প্রাকৃতিকভাবে , প্রায় বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে একটি সমুদ্রস্রোত বা 'কারেন্ট'। এটি হল আন্টার্কটিক সারকাম্‌পোলার কারেন্ট। তাকে ঘিরে রয়েছে সমুদ্রজলের একটি বিশেষ অঞ্চল, যার নাম আন্টার্কটিক কনভারজেন্স। আন্টার্কটিক সারকাম্‌পোলার কারেন্ট হল পৃথিবীর সবথেকে দীর্ঘ সমুদ্রস্রোত। আন্টার্কটিকার পুরো ভূখন্ডকে এই স্রোত ঘিরে রাখতে পেরেছে প্রায় বৃত্তাকারে,কারণ এইমহাদেশের সঙ্গে অন্য কোনো ভূখন্ডের যোগ নেই। উত্তরের উষ্ণ সমুদ্রজলকে,এই সমুদ্রস্রোত আন্টার্কটিকার কাছে ঘেঁষতে দেয় না, তার ফলে এই মহাদেশেকে ঘিরে এত মহাকায় আইস শেলফ্‌ বা ভাসমান বরফের গভীর পরত দেখতে পাওয়া যায়। আন্টার্কটিক সারকাম্‌পোলার কারেন্ট এর বাইরে, বা উত্তরের দিকে, যেখানে মেরু অঞ্চলের শীতল জল এসে মেশে উত্তরের সমুদ্রগুলির উষ্ণ জলের সঙ্গে, সেই পুরো এলাকাটি পরিচিত আন্টার্কটিক কনভারজেন্স নামে। আন্টার্কটিক কনভারজেন্স-ও প্রায় বৃত্তাকার এক সীমারেখার মত অঞ্চল । এই জায়গাতে মেরু অঞ্চলের শীতল জল চলে যায় উষ্ণ অতলান্ত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের জলের নীচে। এইসব বিভিন্ন জলরাশির মেলামেশার ফলে এই অঞ্চলে উৎপন্ন হয় বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, কোপেপড ইত্যাদি, যেগুলি মাছ, তিমি, সীল, পেঙ্গুইন, এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য পশুপাখিদের খাদ্য। এই প্রাকৃতিক নিয়মে বাঁধা কর্মযজ্ঞ দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের সমস্ত প্রাণীদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর আমাদের শেখায়, প্রকৃতি কত হিসেব করে নিজের সমস্ত সন্তান-সন্ততির খেয়াল রাখে।


অ্যালবাট্রসের দল

এইসব পড়াশোনা শেষ হলে, আমি আরেকবার ডেকে গেলাম। এখন চারদিকে ঝকঝকে দিনের আলো। নগরজীবন এখান থেকে অনেক দূর, তাই বাতাস অনেক বেশি পরিষ্কার। আমার মন এবং শরীর আস্তে আস্তে জাহাজের দোলার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে, আর সী-সিকনেস কমতে শুরু করেছে। এখন সমুদ্র রাতের মত অত ভয়াবহও নয় । আমি দেখলাম আকাশে ডানা মেলেছে অ্যাল্‌বাট্রসের দল। যতদূর চোখ যায়, শুধুই সমুদ্র, যার মানে হল জোর হাওয়ার গতিপথেও কোনো বাধা নেই। অ্যালবাট্রসগুলি সেই জোরালো হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাওয়ার সঙ্গে পেরে না উঠে মাঝ আকাশেই স্থির হয়ে আছে। মাঝে মাঝে হাওয়ার তোড়ে পিছিয়েও যেতে হচ্ছে, কিন্তু ওরা সবাই মিলে কিছুতেই হাল ছাড়ছে না। আমি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এইভাবে অ্যাল্‌বাট্রসদের এই সতেজ হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার শক্তি এল কোথা থেকে? এটা কি পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে, সন্তানদের জন্য খাবার যোগাড়ের তাগিদে? নাকি এটা ওদের কাছেও এক ধরণের রোমাঞ্চকর অভিযানের মত? নাকি এই পাখিরা শুধু এটাই করতে জেনে এসেছে প্রাকৃতিভাবে চিরকাল, আর তাই নিয়ম মেনে দামাল হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধে নামে?

৭ঃ জাহাজ ভরা দুনিয়া

দুই দিন সী-সিকনেস-এ ভোগার পরে, আমার যাত্রার তিন দিনের মাথায় একটু ধাতস্থ হয়ে আমি আবার একটু নিজের দিকে মন দিলাম। ভেবে দেখলাম জাহাজের ফিটনেস সেন্টারের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেখি। সে অভিজ্ঞতা নেহাত মন্দ হল না। ঢেউয়ে দুলতে থাকা জাহাজের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কাঁচে ঘেরা জিমের নিরাপত্তার ভেতর থেকে ট্রেডমিল ব্যবহার করতে করতে বাইরে উড়তে থাকা অ্যাল্‌বাট্রসের দল, দূরে জলে তিমি মাছেদের ফোয়ারার মত জল ছাড়া দেখতে দেখতে ভাবছিলাম,প্রাচীন নাবিকেরা কী এমন আরামের কথা স্বপ্নেও ভেবেছিলেন?


আমার এই সহযাত্রী ভারত-পাকিস্থান ভাগাভাগির সাক্ষী

প্রাতঃরাশ খাওয়ার সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে আলাপ হল। জাহাজের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে এত ধরণের মানুষ দেখতে পাওয়া যেন পুরো মানবসমাজকে এক গবেষণাগারের মধ্যে দেখতে পাওয়ার মত এক অভিজ্ঞতা। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে আর বেশিরভাগ মানুষ মোটামুটি পরিচিত ভাষা আন্দাজ করে একে অপরের সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করছিলেন। দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম, ভাষা আবিষ্কার আমাদের জন্য কত জরুরী একটা পদক্ষেপ ছিল। আর আমি এটাও বুঝলাম যে অচেনা ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারা গেলে, আমার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে এক জাহাজ গল্প। এইভাবে, ভাঙা ইংরেজি আর হাতের ইশারায় আমাকে এক ফরাসী ভদ্রলোক জানালেন, দশ বছর আগে এই একই জাহাজে চেপে তিনি সস্ত্রীক উত্তর মেরু বেড়াতে গেছিলেন। তাঁর স্ত্রী গতবছর মারা গেছেন, কিন্তু তিনি এবারে একাই দক্ষিণ মেরু এসেছেন, দুজনের স্বপ্ন পূরণ করতে। এক বিরানব্বই বছর বয়সী সুইডিশ বৃদ্ধা জানালেন, তিনি ভারত-পাকিস্থানের বিভাজন দেখেছেন। সেই সময়ে তিনি পাকিস্থানে বসবাস করতেন এবং তাঁর স্বামী ভারত -পাকিস্থান বিভাজনের শর্তাবলী তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। আমরা সবাই এটাও বুঝলাম যে আমাদের সবার লক্ষ্য যেহেতু এক - আন্টার্কটিকা ভ্রমণ - তাই নানারকমের ভাষায় কথা বলাটা আসলে কোনো সমস্যাই নয়।

সেদিন দুপুরের দিকে , আমরা যখন দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত লিভিংস্টোন দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমরা প্রথম সেই তুষারধবল মহাদেশ দেখতে পেলাম - নীল সমুদ্রের মাঝে, সাদা মেঘে ঢাকা একটুকরো সাদা পৃথিবী।

দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ছিল উইলিয়াম স্মিথের সাউথ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কারের কাহিনি। ১৮১৯ সালে চিলির ভ্যালপারাইজো যাওয়ার সময়ে,তিনি কেপ হর্ন পেরিয়ে, চেনা পথে না গিয়ে, দক্ষিণের দিকে অনেকটা এগিয়ে যান এবং লিভিংস্টোন দ্বীপের উত্তর-পূর্ব অংশটিকে দেখতে পান। এইভাবে, ৬০ ডিগ্রি অক্ষাংশের দক্ষিণে প্রথম আবিষ্কৃত ভূখন্ড হিসাবে চিহ্নিত এই লিভিংস্টোন দ্বীপ। এই আবিষ্কারের পরে, খুব দ্রুত আমেরিকান, বৃটিশ আর রাশিয়ার সীল শিকারিরা এই দ্বীপে এসে সীল শিকারের ঘাঁটি গড়ে তোলে। এই সীল শিকার ও বাণিজ্য খুব বেশিদিন না চললেও, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সীলেদের সমূহ ক্ষতি করে। সেই সময়ের প্রায় ১৯৭ টি সীল শিকার অভিযানের খবর পাওয়া যায়। আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম, সেই সময়ে সেইসব নাবিকেরা কেমন অনুভব করতেন। সেই সময়ে এই জায়গা নিশ্চয় খুব বড় বন্দর ছিল, অনেক জাহাজের যাতায়াত, জাহাজের শিঙ্গার আওয়াজে জায়গাটা গমগম করত, কোনো কোনো জাহাজ বড় ব্যবসা করত, কেউ কেউ করতে পারত না।


সাউথ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত লিভিংস্টোন দ্বীপ

আজকের দিনে, সাউথ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ একটি সংরক্ষিত অঞ্চল এবং শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরিক্ষার জন্য এখানে গবেষণাগার রয়েছে। অতীতের সেই কলরোলের বদলে রয়েছে এক অদ্ভূত নিঃস্তব্ধতা, যাকে শুধু মাঝেমাঝে ভাঙে আমাদের মত ভ্রমণার্থীদের টুকরো টুকরো গলার আওয়াজ আর ঢেউয়ের শব্দে। এই দ্বীপে সময় যেন থমকে আছে, আর তার শীতল নৈঃশব্দ্যের সামনে আমরাও চুপ করে যাই।

সময়ের কথায় মনে হল, এইবেলা বলে রাখি, আন্টার্কটিকা তো কোনো দেশের আওতায় পড়ে না, তাহলে এখানে সময় কীভাবে মাপা হয়? মাপা হয় সূর্যকে দেখে। সূর্য ডুবলে,ঘুমিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু গরমকালে এখানে সূর্য ডোবে রাত নয়টায়, তাই তুমি যদি তার আগে ঘুমিয়ে পড়তে চাও, তাহলে সহজ হিসেব হল, যে বন্দর শহর থেকে তোমার জাহাজ ছেড়েছে, সেই শহরের সময় মেনে চলো।

(ক্রমশঃ)

মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ মহাশ্বেতা রায়
ছবিঃ কীর্তি রাঠী, ডেভিড কাত্‌জ্‌ , সেবাস্তিয়েন প্যানাতিয়ের
অন্যান্য ঐতিহাসিক ছবিঃ উইকিপিডিয়া

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা