সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
আন্টার্কটিকা ডায়রীজঃ পর্ব ০৪

১১ঃ মুখের খাবার, মনের খোরাক

অনেক পুরনো গল্প আছে, আন্টার্কটিকা অভিযানে যাওয়া প্রাচীন যুগের নাবিকদের, যারা শুধুমাত্র পেঙ্গুইন ব্লাবার খেয়ে দিন গুজরান করত। কিন্তু আমরা সেদিক থেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান। আমাদের জাহাজে সারাদিনে ছয় বার বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেড়াতে আসা বেশিরভাগ যাত্রীদের বয়স ছিল ষাট- এর থেকে বেশি (মনে আছে, শুরুতেই বলেছিলাম, সময় এবং অর্থ, দুটো জমানোই খুব শক্ত? )। তাই আমাদের জন্য গ্লুটেন-বিহীন, ভিগান ইত্যাদি নানা ধরনের খাবারের সঙ্গে ছিল দারুণ সব সামুদ্রিক প্রাণী আর অচেনা নানারকমের শাকসব্জি — সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক গুণমানের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। অবশ্য এ সবকিছুই জাহাজ ছাড়ার আগেই মজুত করে নেওয়া হয়েছিল, কারণ আন্টার্কটিকায় তো আর বাজার নেই।

আমি একলা বেড়াতে গেছি, সঙ্গে সবসময়ে কথা বলার লোক নেই, তাই খাওয়ার সময়গুলোর জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম। সহযাত্রীদের যাদের সঙ্গে ভালো আলাপ হয়ে গেছিল, তাদের সঙ্গে গল্প করার সময় ছিল ওই খাওয়ার সময়গুলো।

আমাদের কথাবার্তার মাধ্যমে আমি তাঁদের ভারত সম্পর্কে নানা ভুল ধারণা বদলে দিতে পেরেছি। আমার কোনোদিন মনে হয়নি আমি খুব একটা পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে এসেছি। যেখানে বরং আমার মনে হত আমি পিছিয়ে আছি, সেটা হল শারিরীক এবং মানসিক উদ্যম। পশ্চিমের উন্নততর দেশগুলির একজন ষাটবছরের মানুষের যা পরিশ্রম করার ক্ষমতা, আমাদের দেশের ত্রিশ বছরের মানুষের সেই ক্ষমতা নেই। আমার সহযাত্রীরা সেই উদ্যম নিয়ে অনেক বেশি ঘোরাঘুরি করছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আন্টার্কটিক সাগরে কায়াক বাইতে চলে গেলেন।

আন্টার্কটিকা ডায়রীজঃ পর্ব ০৪
লা মেয়ার চ্যানেল

একলা থেকে থেকে আমার বাড়ির জন্য একটু মনখারাপ হচ্ছিল, বাড়ির খাবার খাওয়ার জন্য, নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য খুব মনকেমন করছিল। এইরকম যখন অবস্থা, সেই সময়ে আমাদের জাহাজ গিয়ে ভীড়ল ড্যাময় পয়েন্ট-এ। এইখানে এসে আমি আন্টার্কটিকার আসল আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হলাম- শীতল, প্রতিকূল, আমাদের স্বাগত জানাতে একেবারেই অনিচ্ছুক। তুষারপাত হচ্ছিল, সঙ্গে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া, সব মিলিয়ে হিমশীতল পরিবেশ। আকাশ ঢেকে ছিল গাঢ় ধূসর মেঘে , আর সামনে ছিল সাদা বরফ ঢাকা পর্বতশ্রেণি। দেখতে দেখতে আমার মনে হল—এমন বিশুদ্ধতার মধ্যে এমন প্রতিকূল ভাব কী করে থাকতে পারে? এই শীতল , সাদা পর্বতমালা কোন রহস্য লুকিয়ে রাখতে চাইছে?

আন্টার্কটিকা ডায়রীজঃ পর্ব ০৪
চারদিকে শুধুই শ্বেতশুভ্র পাহাড়

 

আন্টার্কটিকা ডায়রীজঃ পর্ব ০৪
লেপার্ড সীল

 


ওয়েডেল সীল

প্যারাডাইস বে -তে যেন জীবন থইথই করছে — দিনের বেলা ঘুরতে বেড়িয়ে এমনই আমার মনে হল। উত্তরের ভূখন্ডগুলিতে এখানকার বেশিরভাগ প্রাণীদের দেখা মেলে না। জেন্টু আর চীন্‌স্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনেরা ডিম পাড়তে আর আগামি দীর্ঘ শীতের জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। ওকরাদের দল সমুদ্রে গা ভাসিয়েছে। ফার, ক্র্যাব ইটার আর লেপার্ড সীলেরা এই বছরের মত শেষ রৌদ্রস্নান সেরে নিচ্ছে। যেদিকে চোখ যায়, শুধু দেখা যায় জীবনের হাতছানি।

আন্টার্কটিকা ডায়রীজঃ পর্ব ০৪
হাম্পব্যাক-এর মুখোমুখি

জোডিয়াকে করে ঘোরার সময়ে আমাদের সঙ্গে দুই ফুটের দূরত্বে এক হাম্পব্যাক তিমির দেখা হল । সে একটু পাখনা নাড়ালেই, কুড়িজন সহ আমাদের জোডিয়াক উল্টে যেত বরফঠান্ডা জলের মধ্যে। কিন্তু আমাদের অভিযান পরিচালনাকারী দলের অভিজ্ঞ ক্র্যু এই বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দিলে। পরিকল্পনা করে আন্টার্কটিক সমুদ্রে সাঁতার কাটা এক ব্যাপার, আর এই অভিজ্ঞতা একেবারেই এক অন্য মাত্রার।

আন্টার্কটিকা ডায়রীজঃ পর্ব ০৪
দূর থেকে তিমি চেনা অভ্যাস হয়ে গেছিল আমাদের

এইবছর তিমিদের জন্য খুব ভালো ছিল। আমরা অভিযানের পুরো সময়ের মধ্যে, তিমিদের ছয়টি প্রজাতির প্রায় ৭৮টি তিমি দেখলাম। যতদিনে আমরা প্যারাডাইস বে তে পৌঁছেছি, ততদিনে আমরা সবাই দূর থেকে তিমি চিনতে শিখে গেছি, আমাদের ক্যামেরা ভরে গেছে তিমির লেজের ছবি আর 'হোয়েল ব্রিচ' এর ছবিতে।আমি অবশ্য ততদিনে ছবি তোলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম, আমি চাইলেই জাহাজের অভিজ্ঞ ফোটোগ্রাফারদের থেকে ছবি কিনে নিতে পারি। আমি তাই হাতের ক্যামেরার বদলে আমার মন ক্যামেরায় চোখের সামনে দেখা সব কিছু ধরে রাখছিলাম।

১২ঃ সহ্যশক্তির গল্প, 'Endurance'-এর গল্প


জলে ভাসমান বরফের চাঙড়

চিলির আন্টার্কটিকা বেসের গবেষকদের সঙ্গে আর পোর্ট লক্‌রয়-এর পোস্ট অফিসের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। পোর্ট লক্‌রয়-এর পোস্ট অফিস আন্টার্কটিকার একমাত্র পোস্ট অফিস।ওই প্রবল শীত উপেক্ষা করার সহ্যশক্তির নানারকমের গল্প-স্বল্পের মধ্যে ফিরে ফিরে এল আন্টার্কটিকা অভিযানগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি চর্চিত —'এন্‌ড্যুরান্স' নামক জাহাজ নিয়ে সার আর্ন্‌স্ট শ্যাক্‌ল্‌টন এর অভিযানের গল্প। ১৯১৪ সালে অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া এই অভিযানের যাত্রীরা প্রায় দুই বছর ধরে ভয়ানক সহ্যশক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আবার সভ্য সমাজে ফিরে আসতে পারেন, কিন্তু তাদের অভিযান অসফলই থেকে যায়। এই অভিযান নিয়ে একটা ছোট্ট ভিডিও নীচে দেওয়া রইল।

সেই কষ্টকর, ভয়াল অভিযানের একটা আন্দাজ পাওয়া যায় লা মেয়ার চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়ে। এই চ্যানেলটি বেশিরভাগ সময়ে বিশাল ভাসমান হিমবাহ দিয়ে আটকানো থাকে। আমরা এই চ্যানেল দুইবার পার করেছি। প্রতিবারই দুইপাশে বিরাট উঁচু , প্রায় দৈত্যের মত বড় আইস শেল্‌ফ্‌ দেখে সত্যিই একেক সময়ে মনে হত , 'এন্‌ড্যুরান্স' জাহাজের মত, আমরাও এই বরফের দেওয়ালের মাঝে বোধ হয় চাপা পড়ে যাব।

শেষ ভাবনাগুলি

আন্টার্কটিকা ডায়রীজঃ পর্ব ০৪
পেঙ্গুইন-এর দেশে, পেঙ্গুইনই পথ দেখাক

আমাদের এই যাত্রায়, এমন অনেক সময় গেছে, যখন আমি একটা বিরাট আইস শেল্‌ফ্‌ বা পর্বত বা জলরাশির দিকে তাকিয়ে থেকেছি, আর চুপকরে বসে থেকেছি। মুখে একটাও কথা না বলে, আমি সেই তথাকথিত নির্জীব বস্তুর সঙ্গে অনেক কথা বলে গেছি। আমার মনের যত কথা সব বলা হয়ে গেলে, আমি এক অদ্ভূত আনন্দ পেয়েছি, আমার মনে হয়েছে ওরাও যেন আমার সঙ্গে কথা বলছে। আমি বুঝতে পেরেছি, প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলার আনন্দটা ঠিক কেমন হয়।

আমি বুঝতে পেরেছি, একটা একলা পাথরের ওপর সন্ধের মুখে চুপচাপ রোদে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকার আরেক নাম রোমাঞ্চ। চোখের সামনে একটা বিরাট পাহাড়ের গা থেকে হিমবাহ খসে সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার আরেক নাম নতি স্বীকার। একটা পেঙ্গুইনকে পথে ছেড়ে দেওয়ার আরেক নাম সম্মান। তোমার ভেলার নীচে একটা হাম্পব্যাক তিমি অবলীলায় ভেসে রয়েছে, কিন্তু তোমার ক্ষতি করছে না—এর আরেক নাম ক্ষমতা।

আমাদের ফিরে আসার সময় হয়ে গেছিল। আমি আবার বাড়ি ফেরার জন্য উতলা হয়েছিলাম। আমার খুব ভালো লাগছিল। নিজেকে এক নতুন মানুষ মনে হচ্ছিল। উশুআইয়ার তটভূমি যখন আবার দেখতে পেলাম, আলো, বাড়িঘর, গাড়িঘোড়া সব চোখে পড়ল প্রায় পনেরোদিন পরে, তখন আমি বুঝতে পারলাম , আমার এই ভ্রমণ ছিল একেবারেই আলাদা, একেবারেই বিশেষ।

(সমাপ্ত)

মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ মহাশ্বেতা রায়
ছবিঃ কীর্তি রাঠী, ডেভিড কাত্‌জ্‌ , সেবাস্তিয়েন প্যানাতিয়ের

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা