ঘুড়ি
রূপকথার বই পড়া আর ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছে অর্ক'র কাছে সব থেকে আনন্দের। আরব্য রজনী একবার হাতে পেলে ও নিজেকে হারিয়ে ফেলে রূপকথার চরিত্রগুলোর সাথে। যতক্ষণ না বইটা শেষ হচ্ছে , পড়তে বসা তো দুরের কথা খেতে বা ঘুমোতে পর্যন্ত পাঠানোর উপায় নেই তাকে। তবে অর সবথেকে ভালো লাগে যখন মা ওকে পাশে শুইয়ে গল্প বলে ঘুম পারিয়ে দেন । গল্প শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ও এমন সব প্রশ্ন করে যে ওর মা বিরক্ত হয়ে বলেন - "এখন ঘুমো তো, অনেক রাত হয়েছে, পরে বুঝিয়ে দেব।" বাধ্য হয়ে অর্ক চুপ করে যায়, আর তারপরে কখন যেন ঘুমিয়ে পরে। আসলে ওর মাথায় যে কত প্রশ্ন আসে, আর তা দিয়ে কত সব আজগুবি কল্পনার জাল বুনে চলে, তা ও মাকে বুঝিয়ে উঠতে পারে না। ওর এই কল্পনাই ওকে ঘুমন্ত অবস্থায়ও নিয়ে যায় রূপকথার দেশে। স্বপ্নের মধ্যে কখনো চলে যায় লাল-পরীর কাছে, কখনো আলাদীন, এলিস বা সিন্ডেরেলাদের কাছে। সকালে মা যখন ঘুম থেকে তোলার জন্য ডাকেন "...আমার অর্ক সোনা, ...ওঠো এবার, স্কুল যেতে হবে তো ?" এত সুন্দর স্বপ্ন গুলো কেমন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, ও চেষ্টা করে বালিশে নিচে মাথা ঢুকিয়ে স্বপ্নের রেশটাকে আর একটু ধরে রাখতে, কিন্তু মা যে কেন আর একটু শুতে দেয় না, অর্ক সেটাই বুঝতে পারে না। মনের দু:ক্ষে, কোনরকমে স্নানটা সেরে, গ্লাসের দুধটা শেষ করে ভারী ব্যাগটা পিঠে চড়িয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পরে স্কুলের উদ্দেশ্যে।
সারাটা দিন স্কুলে কাটে কিছুটা আনন্দ আর বিরক্তির সাথে। এতো বই আর খাতা সামলানো, ক্লাস ওয়ার্ক, হোম ওয়ার্ক, পরীক্ষা…….ওফ:, অর্ক আর পারে না সবকিছু সামলাতে। একমাত্র টিফিনের সময়টা ও একটু হাফ ছেড়ে বাঁচে, আর তখন মন খুলে গল্প করে সব থেকে প্রিয় বন্ধু সৌম্যর সাথে। যদিও পড়াশোনা করতে অর্কর ভালই লাগে, কিন্তু অঙ্ক আর মিউজিক মিস ছাড়া আর স্কুলে কাউকেই ভালো লাগে না, কারণ বাকি সব মিস'রা সবাই ক্লাসে বসে হয় রূপচর্চা অথবা মোবাইল ফোনে কথা বলেন, নিতো ওদেরকে ধরে বকাবকি করেন।
ক্লাসের শেষে অর্ক ব্যাগটা একটানে পিঠে চড়িয়ে ছোটে গেটের বাইরে সামনের বটগাছটার তলায়, যেখানে মা তার জন্য অপেক্ষা করেন। মাকে জড়িয়ে ধরে শুরু হয়ে যায় তার সব গল্প "জানো তো, আজকে ............।" মা'র হাত ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে, ভাবে কখন বাড়ি গিয়ে রজতদা'র সাথে ঘুড়ি উড়ানো শুরু করবে। নিজে ঘুড়ি ওড়াতে না পারলে কি হবে, ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখলে ও একটা অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করে। রজতকে ঘুড়ির ধোলাই দিয়ে অর্ক লাটাই'টা ধরে, আর রজত একটানে ঘুড়িটাকে পাঠিয়ে দেয় ওই নীল আকাশে। একটু করে সুতো ছাড়ার সাথে, ঘুড়িটা কেমন যেন ওদের থেকে অনেক দুরে চলে যায়। রজত অর্ককে বোঝাতে থাকে কেমন করে ঘুড়িকে বাড়াতে হয়, কেমন করে আবার তাকে বাগে আনতে হয়, কেমন করে আকাশে তাকে স্থির দাঁড় করিয়ে রাখা যায়, বা কেমন করে প্যাঁচ খেলতে হ্য়। অর্ক কিন্তু শুধু ভাবতে থাকে ঘুড়িটার কথা, মনে হয় আমারই এই ঘুড়িটা এখন কেমন আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে -কখনো তার মাথার ওপরে, কখনো বা নিচে, কখনো হারিয়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে, কখনো বা মিশে যাচ্ছে উড়ন্ত পাখির দলে। ওর শিশু মন ভেবে পায় না ঘুড়ি যদি এত সহজে উড়তে পারে, মানুষ কেন পারে না আকাশে উড়তে। ইচ্ছে করে এমন ভাবে যদি ও আকাশে যেতে উড়ে পারত, দেখতে পারত পৃথিবীটাকে ওপর থেকে, আর জানতে পারত মেঘের ওপারে লুকিয়ে থাকা কত অজানা রহস্যকে।
ছোট থেকেই অর্ক আকাশে মেঘ ভেসে যেতে দেখলে কেমন বিস্মিত হয়ে যেত, আর কেবল মাকে প্রশ্ন করত "মেঘেরা আসলে কি, ওরা কোথা থেকে আসে আর কোথায় বা যায় ? আমাকে নিয়ে চল না মেঘের কাছে ......"। মা শুনে বলতেন, "তুমি যখন অনেক বড় হয়ে বিদেশ যাবে, তখন এরোপ্লেনে চরে ওই মেঘের পেট চিরে আরো উঁচু আকাশ পথে যাত্রা করবে"। শুনে ছোট্ট অর্কর বিস্ময় আরো বেড়ে যেত আর শুরু হত তার প্রশ্নর পালা - " অনেক মানে কত উঁচু আকাশে আমি যাব ? আমি কি তা'হলে আকাশ ছুঁতে পারব ? আকাশে কারা থাকে ? আকাশের থেকেও উঁচুতে আর কি আচ্ছে ?........."। হঠাত রজতদা'র চিত্কারে ও সম্বিত ফিরে পায়, রজত'দা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে চিত্কার করে বলছে "......আরে ছাগল সূতোটা ছার, পেটকাটিটা আমাকে কেটে দেবে যে।" অর্ক আবার লাটাই'টা ঠিক করে ধরে, আর রজতদা প্রচন্ড ক্ষিপ্রগতিতে সুতোর টানে পেটকাটির সাথে প্যাঁচ খেলতে শুরু করে। অর্ক বুঝতে পারে না কি দরকার এই প্যাঁচ খেলার, তার থেকে তো অনেক ভালো আকাশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো, কথা বলা ওই উড়ন্ত পাখি গুলোর সাথে, আর চোখ মেলে আকাশ থেকে দেখা দুনিয়াটা কে। এমন সময় রজতদা আবার চিত্কার করে ওঠে "ভো - ও - কা - ট্টা, ভোকাট্টা". অর্ক তাকিয়ে দেখে যে পেটকাট্টি ঘুড়িটা এতক্ষণ অত্যন্ত গর্বের সাথে সারা আকাশে বিরাজ করছিল, রজত'দার এক সুতোর টানে তার সমস্ত দম্ভ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, আর ওই ঘুড়িটা যেন তার পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করে, শোকে মুজ্ঝমান হয়ে ধীরে ধীরে ওলট পালট খেতে খেতে ঝরে পড়ল আকাশ থেকে। রজত'দা বিজয়ের আনন্দে বলল "দেখলি, কেমন একটানে ব্যাটাকে কুপোকাত করে দিলাম। এবার লাটাই'টা ঢিলে কর, আমি এবার ঘুড়িটাকে অনেক দূরে বাড়াব।" দেখতে দেখতে লাটাইয়ের সুতো প্রায় শেষ, ঘুড়িটা অনেক দুরে চলে গিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে, ওকে আর এখন নিজের বলে মনে হচ্ছে না - কেমন যেন পরদেশী মনে হচ্ছে। রজত'দা বলছে "দেখেছিস, আমাদের ঘুড়িটা কত্ত দুরে চলে গেছে", অর্ক বলে "কত দুরে ? মেঘের ওপারে ? আকাশ ছুঁয়েছে কি ?"
এবার রজতদা হঠাত অত্যন্ত ভগ্নোত্সাহে হায় হায় করে ওঠে "কি করলি টা কি ? সুতোটা যে শেষ হয়ে লাটাই থেকে বেরিয়ে গেল, তুই দেখতে পেলি না? তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। মনটা কোথায় থাকে ?" অর্ক তাকিয়ে দেখে ঘুড়িটা এবার রজত'দার নিয়ন্ত্রণ থেকে ছাড়া পেয়ে মুহুর্তের মধ্যে মেঘের ওপারে চলে গেল।
রজত'দার বকুনি খেয়ে অর্ক ফিরে আসে বাড়িতে আর মা'র ধমকানী খেয়ে বসে পরে পড়তে, কিন্তু মাথায় ঘুরতে থাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন - ঘুড়িটা কি সত্যি মেঘের ওপারে রূপ কথার দেশে চলে গেছে ? অর্ক কি পারবে কখনো ওই রূপকথার দেশে যেতে ? যদি যেতে পারে, তবে কি কি করবে সেখানে গিয়ে ? খেতে বসে মা'কে বলে "আজকে রজতদা'র সাথে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে .............ঘুড়িটা আসতে আসতে মেঘের ওপারে চলে গেল। বলো না মা, মেঘের ওপারে কি আছে, কারা থাকে ওখানে ?" মা বলে "সে এক রূপকথা'র দেশ, আর সেখানে সব সুন্দর পরীরা থাকে।" অর্ক আবার তার কল্পনার গভীরে তলিয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে ওই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায় অর্ক, আর ভাবতে ভাবতে তার ক্লান্ত শরীর ঢলে পরে গভীর নিদ্রায়।
..........ধীরে ধীরে অর্কর চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল আকাশ, আর তার মধ্যে দিয়ে ভেসে যাওয়া সারি সারি সাদা মেঘ। ক্ষনিকের বিস্ময়তা কাটিয়ে অর্ক বুঝতে পারে যে সে এখন মাটি থেকে উড়ে আকাশ পথে চলেছে। নীচে তাকিয়ে দেখে রজত'দা চিত্কার করে বলছে "ডানা'টা ঠিক আছে ? ঠিক করে উড়তে পারছিস তো ?" সত্যি তো, অর্ক খেয়ালই করেনি যে তার পিঠে এখন দুটো ডানা রয়েছে, আর তাই দিয়েই ও আকাশে উড়ছে। অর্ক ভেবে পায় না কি ভাবে রজতদা'কে তার কৃতজ্ঞতা জানাবে, ত়ার এতদিনের আকাঙ্খা আকাশে ওড়ার আজ সত্যি হয়েছে শুধু রজত'দারই জন্য। "রজত'দা, তুমি ভীষণ ভালো, দেখো তোমার জন্য আমি কেমন আকাশে উড়ছি" - বলে অর্ক।
মাঝে মাঝে পাখির দল কিচিরমিচির করতে করতে অর্কর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। অর্ক খুব জোরে ডানা ঝাপটিয়ে আরও ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। এবার অর্ক পৌছে গেছে একটা বড় সাদা মেঘের কাছে। অর্ক দু'হাত সামনে বাড়িয়ে মেঘ ভেদ করে এগিয়ে চলে আরো ওপর আকাশে। এইতো, অর্ক এখন মেঘের গন্ডি ছাড়িয়ে পৌছে গেছে এক অন্য জগতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য, চতুর্দিক নীল্ আর নীল্, আর তার মধ্যে অসংখ্য আলোর রোশনাই। অর্কতো ঠিক এমনটাই ভাবতো। কিন্তু কই, কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। তা'হলে কি এখানে কি কেউ থাকে না ? অর্ক গতি বাড়িয়ে আরো এগিয়ে চলে। হঠাত শোনে পিছন থেকে সরু গলায় একটি পাখি তাকে ডাকছে "বন্ধু - তুমি কে, কোথা থেকে আসছো? এখানে তো মানুষের আসার কথা নই। কোথায় যাবে তুমি ?" অর্ক বলে "আমি এসেছি এই স্বপ্নের জগতটাকে দেখতে। তোমার নাম কি ? তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে তোমাদের দেশটা ঘুরে দেখতে ?" পাখিটা তাকে বলে "আমার নাম নীলা, আর আমি এই দেশে বন্দি হয়ে আছি। তুমি শিগগির এখান থেকে পালাও, নয়তো ওরা তোমাকেও বন্দি করে ফেলবে।" অর্ক প্রশ্ন করে "কারা তোমাকে বন্দি করেছে এবং কেন?" নীলা এবার বুঝিয়ে বলে যে মেঘের ওপারের এই দেশটার নাম হচ্ছে সুবর্ণলোক। এখানে শুধু পরীদের বাস। এখানকার রানীকে বন্দী করে এক দানবী পরীর রূপ ধারণ করে দেশটা কব্জা করেছে। আকাশপথে কেউ ভুল করে এখানে এসে পড়লে, তাকে চিরদিনের মত বন্দী করে ফেলা হয়, যেমন আমি গত পাঁচ'বছর ধরে এই দেশে বন্দিদশা ভোগ করছি। নীলা অর্ককে বলে "তুমি এখনই পশ্চিমের ওই রাস্তা ধরে পালাও, নয়তো ওরা তোমাকে ধরে ফেলবে।" কিন্তু অর্ক তো পালানোর জন্য আসেনি, ওর তো অনেকদিনের স্বপ্ন এই দেশে আসা, আর ঘুরে বেড়ানো দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, দু'চোখ মেলে উপভোগ করা এই নৈসর্গিক দৃশ্যকে। অর্ক বলে "নীলা, তুমি আমাকে নিয়ে চল ওই দানবীর কাছে।"
- তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ? তোমার ভয় নেই ? তুমি জানো তোমাকে ওরা কি করবে ?
- না নীলা, আমি ভয় পাই না। আমি তো মানুষ, তোমার মত ছোট্ট পাখি নই যে ভয় পাব। আমি ওই দানবীকে একবার দেখতে চাই, আর তারপর আমার কাজ হবে ওই পরীকে উদ্ধার করা।
নিরুপায় হয়ে নীলা বলে "ঠিক আছে, চল তবে আমার সাথে রাজপ্রাসাদে।" অর্ক আর নীলা এক ঝটকায় উড়তে শুরু করে আকাশে। পূর্ব দিকের এই আঁকাবাঁকা পথটাই গিয়েছে রাজপ্রাসাদের দিকে। উড়তে উড়তে দেখে, কি মনোরম এই দৃশ্য, চতুর্দিক থেকে ভেসে আসা রকমারী আলোর ঝলক কালিপূজোর চরকি, আর রবিদা'র তৈরী তুবড়িকেও হার মানায়।আলোর যে এত রং হয়, অর্কর জানা ছিল না। পথে আরো কিছু পাখির সাথে দেখা, আর প্রত্যেকেই অর্ককে মানা করে ওই প্রাসাদে যেতে, কিন্তু অর্ক তার সিদ্ধান্তে অনড়।
অবশেষে তারা এসে পৌছেছে রাজপ্রাসাদের ফটকে। বিশালদেহী পাহারাদাররা ঘিরে ধরে অর্ককে, আর শুরু করে নানা রকমের প্রশ্ন। অর্ক বলে "আমি এসেছি পৃথিবী থেকে মহারানীর উদ্দেশে এক বিশেষ সংবাদ নিয়ে, যা আমি শুধু তাকেই বলতে পারি।" পাহারাদাররা নিজেদের কিছুটা মধ্যে শলা পরামর্শ করে ওকে প্রাসাদের ভিতরে যেতে অনুমতি দেয়।
প্রাসাদে ঢুকে অর্কর বিস্ময় আরো কয়েকগুন বেড়ে যায়। কি অপূর্ব গঠন এই প্রাসাদটার। সমস্তটাই তৈরী সোনা, রুপো, হীরে, মনি, মানিক্য দিয়ে, আর তার ওপর থেকে ঠিকরে আসা আলোকমালার বিচ্ছুরণ দেখে চমকে যেতে হয়। দুরে দেখা যাচ্ছে সেই মহারানী (অর্থাত, সেই দুষ্টু দানবী) এক প্রকান্ড সিংহাসনে বসে আছেন। প্রাসাদের রক্ষীরা অর্ককে ধরে নিয়ে যায় মহারানীর কাছে। অর্ক এখন দাঁড়িয়ে সেই পরী রূপী দানবীর সামনে। দেখামাত্র এক অজানা ভয়ে তার শরীরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় শৈত্যপ্রবাহ, মনে হচ্ছে হাত আর পা'গুলো কেমন যেন ভয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। কোনক্রমে নিজেকে সামলে অর্ক বলে "আমার নাম অর্ক, আমি পৃথিবী থেকে এসেছি আপনার কাছে আমাদের রাজার বার্তা নিয়ে। আপনার এই অতীব সুন্দর দেশটা সম্মন্ধে আমদের রাজামশাই খুবই ওয়াকিবহাল, আর তাই উনি আপনাকে অনুরোধ করেছেন আমাকে এই দেশটা ঘুরে দেখাতে, আর উপদেশ দিতে যে কি ভাবে আমরা পৃথিবীটাকেও এমন সুন্দর করে তুলতে পারি।" শুনে ওই দানবী অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রাসাদের এক রক্ষী কে বলে "যাও, আমাদের এই প্রিয় অতিথিকে সারা দেশটা ঘুড়িয়ে দেখাও। দেখো, ওর যা কিছু দেখার ইচ্ছে, সব যেন দেখতে পায়।"
ঘুরতে ঘুরতে অর্ক দেখে, কত বন্দিরা কি অসহায় জীবন কাটাচ্ছে এই দেশে, আর কি পাশবিক অত্যাচার চলছে তাদের ওপর। আর অন্যদিকে রাজপ্রাসাদে কি বিলাসবহুল জীবন। একদিকে যখন বন্দিরা আধপেটা খেয়ে কাটাচ্ছে, অন্যদিকে প্রাসাদে চলছে খুশির জোয়ার। অর্কর মনটা ভেবে ওঠে, তাহলে কি আমাদের পৃথিবীতেও এমনই হয় ? আমার বাবা সারাদিন এত খেটেও কেন আমাকে স্কুলের একটা ভালো জুতো কিনে দিতে পারে না, অথচ আমাদের রাস্তার ওপারের চৌধুরী বাড়ির দুটো ছেলেই তো কত দামী জামা, প্যান্ট, টাই, জুতো পরে বড় একটা গাড়িতে চেপে স্কুলে যায়। মা'কেজিজ্ঞাসা করলেই বলে "ওদের অনেক টাকা, ওর বাবার খুব বড় ব্যবসা।" অর্ক কিছুই বুঝতে পারে না। তবে ওর মনে কোনো কোনো দু:ক্ষ নেই। ঘুড়ি উড়ানো আর রূপকথা পড়তে পারলেই ও খুশি।
সারাদিন ঘুরে ফেরার সময় দুরে একটা লালবাড়ি চোখে পরে অর্কর, আর বলে ওঠে "আমি ওই বাড়িতে যাব।" শুনে রক্ষীটা হায় হায় করে উঠে বলে "ওখানে আমাদের রাজবন্দী থাকেন, তাই কারও যাওয়া বারণ। আমরা এখন প্রাসাদে ফিরে যাব।"
- কেন যাওয়া বারণ ? তুমি শুনলে তো যে মহারানি আমাকে সব কিছু দেখার অনুমতি দিয়েছেন। তা'হলে কেন যাব না, আমি যাবই ওই বাড়িতে।
অগত্যা, রক্ষী তাকে বলে "ঠিক আছে, আমি এখানে অপেক্ষা করছি। তুমি চট করে গিয়ে দেখে এস, আমার যাবার অনুমতি নেই।"
অর্ক ছুট্টে চলে যায় ওই লালবাড়ির দিকে, আর গিয়ে দেখে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটার লোহার গেটটা তালা দিয়ে বন্ধ। দমে যাবার পাত্র নয় অর্ক, মনে পরে যায় পাশের বাড়ির অমন উঁচু পাঁচিল কতবার টপকেছে ঘুড়ি ধরার জন্য, যদিও একবার পরতে পরতে খুব জোর বেঁচে গিয়েছিল। এদিক, ওদিক তাকিয়ে অর্ক লোহার গেটটা বেয়ে উঠে পরে ওপরে, আর তারপর এক লাফে বাড়ির চত্ত্বরের মধ্যে। সোজা গিয়ে ঢুকে পরে সামনের প্রকাণ্ড ঘরটার ভিতর, আর সেখানে দেখা হয় বন্দিনী 'ভালো পরীর' সাথে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার ওই রূপ আর স্নিগ্ধ চেহারার দিকে। অর্কর মাও তো সুন্দরী, ভালো করে সাজলে কি ওই পরীর মতই লাগবে মাকে ?
পরী - "কে তুমি ? তুমি কি আমার বন্ধু না শত্রু ?"
অর্ক - "আমি অর্ক, পৃথিবী থেকে আসছি। আমি তোমার বন্ধু"
পরী - "তাহলে তুমি পারবে আমাকে মুক্ত করতে?"
অর্ক - "আমি তোমাকে মুক্ত করার জন্যই এসেছি। তবে এখন নয়, কাল আমি ওই দানবীকে প্রথমে হত্যা করব আর তারপর তোমাকে মুক্ত করে দেব। তুমি আমাকে পরামর্শ দাও কি ভাবে আমি ওই দানবীকে মারতে পারি।"
পরী - "তুমি প্রাসাদে গিয়ে ওখানকার এক পাহারাদার বিল্লা'র সাথে কথা বল। ও তোমাকে সবরকম সাহায্য করবে, কারণ ওই দুষ্টুটা বিল্লা'র ছেলে, মেয়ে, বউ সকলকে বন্দী করে অত্যাচার করে চলেছে।"
অর্ক খুঁজে বার করে বিল্লাকে আর বলে "আমি এই দানবীকে দিবালোকে রাজপ্রাসাদের মধ্যে সকলের সামনে হত্যা করতে চাই, আর তার জন্য আমার প্রয়োজন তোমার সাহায্য।"
পরদিন সকালে দানবী যখন সিংহাসনে বিরাজমান, অর্ক এসে ঢোকে প্রাসাদে আর প্রনাম জানিয়ে দানবী বলে "প্রনাম, আর এই দেশটা দেখতে দেওয়ার জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।"
দানবী - "আপনি আমাদের দেশে আসার জন্য আমি যথার্থই কৃতার্থ। আশা করি আপনার আমাদের এই সাজানো সুন্দর দেশটা ভালই লেগেছে। আপনি আমার শুভেচ্ছা নেবেন, আর ফিরে গিয়ে আপনার রাজামশাইকে আমার আমন্ত্রণ জানাবেন এই দেশে আগমন করার জন্য।"
অর্ক - "ধন্যবাদ। আপনার এই দেশ সাজানো ঠিকই, তবে সুন্দর নয়। সুন্দর করার উপায় আমার জানা আছে, আর তার ব্যবস্থাই আমি এখন করব।"
এই বলে, অর্ক দানবীর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্লাকে ঈশারা করে আর নিজে ডানদিকে সরে গিয়ে ওপর থেকে ঝোলানো দড়িটা চেপে ধরে। মুহুর্তের মধ্যে বিল্লা দড়ির ফাঁসটা পরিয়ে দেয় দানবীর গলায়, আর সঙ্গে সঙ্গে অর্ক ঠিক রজতদা'র মতো করে সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়িটা টানতে থাকে। ক্ষনিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে যখন সম্বিত ফিরে পায়, দেখে তার হাতে তখনও দড়িটা শক্ত করে ধরা আছে, আর দানবীর মুন্ডুটা দুরে পরে ছটফট করছে। তাকিয়ে দেখে প্রাসাদের সবাই আনন্দে মত্ত। অর্ক চিত্কার করে ওঠে "ভো - ও - কা - ট্টা, ভোকাট্টা। দেখো রজত'দা, আমি কেমন ওই দুষ্টু দানবীকে কেটে দিয়েছি, আর আমি কিন্তু এখনো দড়ি ছাড়িনি। আমি আর কক্ষনো অমন ভুল করব না।"
অর্কর মনে পরে যায় পরীর কথা। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যায় পরীর কাছে, আর তার গলা সজোরে জড়িয়ে বলে "তুমি আর এখন বন্দী নও, তুমি মুক্ত। তোমাকে আর কেউ কোনো কষ্ট দিতে পারবে না।" পরীও অত্যন্ত আনন্দের সাথে অর্ককে জড়িয়ে ধরে, আর বলে "আজ আমি খুব খুশি। বল তুমি কি চাও আমার কাছে?" অর্ক বলে "তুমি আমাকে একটা ভালো গল্প বলে শোনাও "
দূর থেকে অর্ক শুনতে পায় কে যেন বলছে "আমি আবার কবে বন্দী ছিলাম ? আর এখন সকালে স্কুল যাবার সময় কেউ গল্প বলে বাবা ? রাত্রে ঘুমোতে যাবার সময় আজ একটা খুব ভালো গল্প বলবো। এখন তারাতারি উঠে তৈরী হয়ে নাও, নয়তো স্কুলের দেরী হয়ে যাবে।
দিলীপ ঘোষ
সিঙ্গাপুর
- বিস্তারিত
- লিখেছেন দিলীপ ঘোষ
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
অচিনপুরের কল্পকথা
অচিনপুর গ্রামটাকে ম্যাপে খুঁজলে পাওয়া যাবে না – ছোট্ট নদী রঙ্গিনীর একটা বড় বাঁকের মধ্যে প্রায় লুকিয়ে আছে যেন রঙ্গিনী গ্রামটাকে নিজের বুকের মধ্যে ‘সাত রাজার ধন এক মানিকের’ মত আগলে রেখেছে। গ্রামের তিন দিক দিয়ে বয়ে চলেছে রঙ্গিনী তবে যত বর্ষাই হোক না কেন গ্রামকে কখনই ভাসিয়ে নিয়ে যায় না বরং মাটিকে সমস্ত বছর সরস রেখে গ্রামকে ফলে, ফুলে, ফসলে ভরিয়ে রাখে। তাই তো গ্রামের পঞ্চাশ খানেক ঘরের লোকের মুখে সব সময়ই হাসি – সারা দিন মাঠে খেটে ওরা সোনার ফসল তোলে। এছাড়াও চাষ হয় আখ, নানা রকমের ডাল ও সব্জির। গরু, মোষ, ছাগলরাও নদীর ধারের নরম সবুজ ঘাস খেয়ে বেশ নধর চেহারার তাই দুধ ঘির অভাব নেই। রঙ্গিনীর ওপাড়ে বসতি নেই - বেশ ঘন জঙ্গল কারণ বর্ষাতে ওদিকটা প্রায় প্রত্যেক বছর ডুবে যায়। গ্রামের অন্য দিকে অনেক দূর অবধি চাষের জমি তারপর জঙ্গলা নাবাল - এদিকে সব থেকে কাছের গ্রাম প্রায় দশ মাইল দূরে। একটা ঘাসে ঢাকা মাটির রাস্তা ধান ক্ষেতের ধার দিয়ে ঘুরে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছে ওই গ্রামের দিকে তবে লোকে জমির আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়াই পছন্দ করে কারণ তাতে রাস্তা মাইল দুয়েক কমে যায়।
এই রকমের সুখী গ্রামে নিয়ম মত সব রকমের লোকই আছে – আছেন জমিদার হিমাংশু লাহিড়ী বা ছোটবাবু। প্রায় দুশো বছরের পুরাতন জমিদার বাড়ি তো এখন ধ্বংস স্তুপ তাই থাকেন মোটামুটি একটা নতুন অংশে যেটা পরে বানানো হয়েছিলো আত্মীয় স্বজনদের থাকার জন্য তবে তাতেও অনেক জায়গাতে ফাটল ধরেছে, দেওয়ালের নানা জায়গায় বট গাছ, অস্বত্থ গাছ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। এখন তো আর জমিদারিও নেই তাই রোজগারও নেই – বাড়ি সারাই হবে কোথা থেকে! জমিদার বাড়ির সব সম্পত্তি গিয়ে হিমাংশুর আছে শুধু দাদুর আমলের এক বিশাল পালঙ্ক যাতে জনা ছয়েক লোক আরামে ঘুমাতে পারে। বার্মা থেকে সব থেকে ভালো সেগুন কাঠ আনিয়ে বানানো – চারটে পায়া যেন হাতির পা আর সমস্ত পালঙ্কে সূক্ষ্ণ কারুকার্য্য দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। যেমনি বড় তেমনি ভারি – চার / পাঁচ জন জোয়ান লোকের পক্ষেও নাড়ানো প্রায় অসম্ভব – তার উপরে প্রায় এক হাত মোটা গদি। মনে হয় দাদুরা পুরাতন বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে আসার পর এই ঘরের মধ্যেই পালঙ্কটা বানানো হয়। এছাড়া লাইব্রেরি বহু পুরাতন বইতে ঠাসা - এটা হিমাংশুর খুবই প্রিয় এবং রোজই কয়েক ঘন্টা কেটে যায় এখানে তবে বই গুলোকে পোকার হাত থেকে বাঁচাতে হিমসিম খেতে হয়। ধীরে ধীরে সমস্ত পুরাতন কাজের লোক এক এক করে চলে গিয়ে শুধু বিষ্টুকাকাই রয়ে গিয়েছে প্রাণের টানে - ওই হিমাংশুর দেখা শোনা করে।
গ্রামে আছে পর নিন্দা পর চর্চা করার জন্য অকর্মণ্য বুড়োদের দল যারা সারাদিন গ্রামের শিব মন্দিরের চাতালে বসে থেলো হুঁকোতে তামাক খেতে খেতে আর না হলে আফিমের মৌতাতে ঢুলতে ঢুলতে গ্রামের কার বাড়িতে কি হলো সেই সব হাঁড়ির খবর অথবা নিজেদের বাড়িতে বৌমারা কি রকম ঝগড়াটে এই ধরনের আলোচনায় ব্যস্ত থাকে। আছেন পূজারী নরহরি চক্কোত্তি, নায়েব শ্রীপদ সরকার, পাঠশালার পণ্ডিত সুদাম রায় – এরা যদিও বংশ পরম্পরা জমিদারের চাকুরে – এখনও মাসে দশ পনের টাকা মাসোহারা পান তবে তাতে তো আর সংসার চলে না তাই বাইরের কাজও করেন। জমিদার বাড়ির শিব মন্দির হলো পূজারী ঠাকুরের প্রধান দায়িত্ব এছাড়াও গ্রামের অন্যান্য বাড়িতে পূজো আচ্চা ইত্যাদি করে রোজগার খারাপ হয় না। সুদাম রায়ের একটা মনোহারী দোকান আছে - সেটার দেখা শোনা করতে করতে পাঠশালা সামলান। এমন কি আছে এক চোর শম্ভু যার ত্রিসংসারে আর কেউ নেই – থাকে এক ভেঙ্গে পড়া খড়ের বাড়ির দাওয়াতেই। বাবার কাছ থেকে সিঁধ কাটাও শিখতে পারে নি তাই রাত্রে গ্রামের লোকের ঘটি বাটি ইত্যাদি বাইরে পড়ে থাকলে তাই নিয়ে সটকে পড়ে তবে ওকে পেট ভরে খেতে দিলে সাথে সাথে জিনিষ ফেরৎ। যেদিন কিছুই জোটে না সেদিন বিষ্টুকাকাই শেষ ভরসা – এক থালা পান্তা ভাত দুটো কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সাঁটিয়ে টেনে ঘুম। আর আছে বিল্টু যাকে পণ্ডিত মশাই বছর চারেক চেষ্টা করেও অ, আ, ক, খ শেখাতে না পেরে বলেছিলেন,
‘তোর মত গন্ড মুর্খের দ্বারা কিচ্ছু হবে না – যা মাঠে ঘাটে চরে বেড়া।’
সেই থেকে বিল্টু সারাদিনই গ্রামের মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, গ্রামের লোকের গরু, ছাগল চরায় আর নানা ফাই-ফরমাস খাটে। থাকার মধ্যে ওর আছে একটা ভাঙ্গা ঘর যার দরজার আদ্ধেক পাল্লা নেই আর জানালা কখনই বন্ধ হয় না। সেটা নিয়ে অবশ্য বিল্টুর মাথা ব্যথা নেই – একা মানুষ, কোন রকমে রাত্রে মাথা গুঁজতে পারলেই হলো আর গ্রামের লোকের ফাই-ফরমাস খেটে খাওয়াটা এদিক ওদিক হয়েই যায়। নায়েব শ্রীপদ সরকারের মেয়ে সরলা বা সরু গ্রামের সব থেকে বেশী পড়াশুনা জানা মেয়ে – পাঠশালা পাশ করে ছোটবাবুর অবৈতনিক স্কুলে সাত ক্লাস অবধি পড়েছে। ভীষণ ডাকাবুকো মেয়ে – ভয় ডরটা নেই বললেই হয় - বাজি ধরে রাত্রে শ্মশান অবধি ঘুরে এসেছে। শম্ভু একবার ওদের বালতি বাইরে পড়েছিলো বলে সেটা নিয়ে পালিয়েছিলো - সরু আঁস বঁটি নিয়ে ওকে গ্রামের সীমানা অবধি তাড়া করে বালতি আদায় করে ছেড়েছিলো। তারপর থেকে শম্ভু ওদের বাড়ির ত্রিসীমানাতে পা দেয় না।
ছোটবাবুর বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে – ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছিলেন। বাবা প্রয়াত জমিদার সুধাংশু শেখর লাহিড়ী মশাই পাঠিয়েছিলেন বড় শহরে পড়াশুনা করতে তবে পড়াশুনার থেকেও বেশী নেশা ধরে গেলো গান বাজনা ও শরীর চর্চার। রক্তে ছিলো বলে দুটোই খুব ভালো ভাবে শিখলেন ফলে পড়াশুনাতে টেনে টুনে বিএ পাশটাই হলো। তারপর বাবার শরীর ভালো নেই বলে গ্রামে ফিরে আসতে হয়। রোজ নিয়ম করে কাক ভোরে উঠে বাড়ির ছাতে যোগাসন ও ব্যায়াম করেন, মুগুর ভাজেন। তারপর ছাতে পায়চারি করতে করতে উদাত্ত গলায় গান গাইতে থাকেন - ছোটবাবুর গান শুনেই গ্রামের লোক বিছানা ছাড়ে। রোজ সকালেই ওর প্রিয় ঘোড়া শ্বেতাতে চড়ে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে – শ্বেতার রাস্তা ঘাট একেবারে মুখস্ত তাই জমির আল ধরে যেতে কোন অসুবিধা হয় না – যেতে যেতে দেখেন কার জমিতে কেমন ফসল হচ্ছে, কে কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, এই সব। বিকেলে চওড়া পাড়ের ধুতির কোঁচা বাঁ হাতে নিয়ে পিরান পরে ডান হাতে চন্দন কাঠের কাজ করা লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ান সমস্ত গ্রামে – দাদু, জেঠা, খুড়ো সবার খোঁজ খবর নেন ফলে গ্রামের লোকের সাথে ছোটবাবুর একটা আত্বিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জমিদারি না থাকলে কি হলো গ্রামের রক্ষাণাবেক্ষনের দায়িত্বটা নিজের ঘাড়েই রেখেছেন।
কোথাও এই রকম জমিদার বাড়ির ধ্বংস স্তুপ থাকলে যেমন আপনা থেকেই গুপ্তধনের গল্প ছড়ায় অচিনপুরেও তাই। কেউ বলে ওই ধ্বংস স্তুপের ভেতরে এক বিরাট কাল কেউটে সেই গুপ্তধন আগলে রেখেছে আবার কেউ বলে শিব মন্দিরের ভেতরেই আছে সেই গুপ্তধন আর ওখানে হাত দেওয়া মানেই শিব ঠাকুরের রোষে পড়তে হবে। আবার অনেকের মতে মাটির নিচে লুকানো একটা ঘরে সেটা আছে আর সেখানে একজনকে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিলো সেই যক্ষ হয়ে ওটা পাহারা দিচ্ছে। এর কোনটাই সাধারণ গ্রামের লোককে গুপ্তধন খোঁজার ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহিত করে নি। হিমাংশু এ ব্যাপারে ওদের বাড়ির পুরাতন লোক মানে বিষ্টুকাকা, পূজারী ঠাকুর নরহরি চক্কোত্তি আর নায়েব মশাই শ্রীপদ সরকারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কিন্তু সবারই বক্তব্য হলো ওরাও শুনেছেন তবে এর বেশী জানেন না। তবে নরহরি চক্কোত্তি সবার আড়ালে শিব মন্দির তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গুপ্তধনের কোন হদিশ পান নি। এই গুপ্তধন গল্পের ধোঁয়া নিয়ম মতই অচিনপুর ছাড়িয়ে আশেপাশের গ্রাম ও শহরেও ছড়িয়েছে আর একে উড়ো খবর বলে কেউ পাত্তা না দিলেও শহরের বিশে গুন্ডাকে ভাবিয়েছে - প্রায় বিনা পরিশ্রমে যদি এই রকম একটা বিরাট দাঁও মারা যায় তবে তো বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাই দুই সাকরেদকে পাঠিয়ে দিলো গ্রামে একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে তারপর বাকিদের নিয়ে ও নিজেই আসবে।
সেদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দূর থেকে হিমাংশুর নজরে এলো ওদের ভাঙ্গা বাড়ির সিংদরজার কাছে দুটো লোক কেমন যেন ঘুর ঘুর করছে – এক নজরেই বোঝা গেলো এরা বাইরের লোক কারণ এদের চেহারা, চাল চলন, পোষাক অন্য ধরনের।
‘এই, তোরা কে রে? এখানে ঘুর ঘুর করিস কেন?’
মনে হলো লোক দুটো ওর কথার কোন পাত্তাই দিলো না। এবার হিমাংশু রেগেই গেলেন।
‘বলি কথা কি কানে যায় না? কান পট্টি দিতে হবে নাকি?’
দুজনের মধ্যে বেটে গাট্টা গোট্টা গলায় লাল রুমাল বাঁধা ছেলেটা তেড়িয়া ভাবে জবাব দিলো,
‘আরেঃ ছোঃ, তুমি কে হে যে উত্তর দিতে হবে? মানে মানে নিজের কাজে যাও, নয়তো - -’
হিমাংশু একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন – অচিনপুরের চৌহদ্দির মধ্যে কেউ এ ধরনের কথা বালার সাহস রাখে না। এগিয়ে এসে সপাটে ছেলেটার গালে এক থাপ্পড় মারতে ছেলেটা ছিটকে পড়লো রাস্তার ধারে। সঙ্গের রোগা লম্বা ছেলেটা সাথে সাথে পকেট থেকে একটা ছুরি বের করতেই হিমাংশুর লাঠের এক ঘায়ে সেটা উড়ে গেলো। বেঁটে ছেলেটা কোন রকমে উঠে টলতে টলতে প্রায় দৌড়ালো আর লম্বাটা আরো গোটা কয়েক লাঠি খেয়ে ‘ওরে বাবারে’ বলে দৌড় দিতেই হিমাংশু দেখেন কখন বিল্টু এসে হাজির হয়েছে।
‘এই বিল্টু, গ্রামের লোক নিয়ে ছোড়া দুটোকে ঢেলা মারতে মারতে তাড়িয়ে গ্রামের বাইরে করে দে তো – কোথা থেকে এসেছে নচ্ছার দুটো কে জানে। আর শোন, আধ ঘন্টা পরে গ্রামের সবাইকে চণ্ডী মন্ডপে আসতে বলিস।’
চণ্ডী মন্ডপে সবাই জমায়েত হলে হিমাংশু বিকেলের ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে বললেন,
‘এই গ্রামে বাইরের গুন্ডা আসার ঘটনা এর আগে হয় নি তাই মনে হচ্ছে এটা একটু চিন্তার ব্যাপার। এরা কেন এলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না – হয়তো আবার আসবে সেই জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তোমাদের কি মনে হয় এদের আসার কারণ?’
কারুর কাছ থেকেই কোন উত্তর না আসাতে হঠাৎ সরু গলা বাড়ালো,
‘ছোটবাবু, এরা তো আমাদের গ্রামে বেড়াতে আসে নি – নিশ্চয়ই কোন লোভে এসেছে। অচিনপুরে লোভ করার বা টাকা পয়সার কি আছে বলো? তবে গুপ্তধনের গুজবের খোঁজ খবর নিতে আসে নি তো? তাহলে কিন্তু আপনার কাছে মার খাওয়ার পর আরো দলবল নিয়ে আসতে পারে – এক ওই গুপ্তধন আর দুই আপনার মারের শোধ নেওয়া।’
‘তুই ঠিক বলেছিস সরু – আমারও তাই মনে হয়। আমাদের তা হলে দিন রাত পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার মনে হয় দিনের বেলা বিল্টু তো গ্রামের মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, ওই গ্রামে ঢোকার রাস্তার দিকে নজর রাখুক আর রাত্রে - -’
বলে একটু মুচকি হেসে শম্ভুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কিরে শম্ভু, তোর তো রাত্রেরই কারবার আর অন্ধকারে তুই বোধ হয় বেড়ালের মত দেখতে পাস, তোর চলাফেরাও তো বেড়ালের মত নিঃশব্দে – রাত্রের পাহারাটা তুইই দে – কারুর বাড়ি থেকে কিছু নিতে হবে না। দুবেলা আমার সাথে খাওয়া দাওয়া করবি আর ভোর বেলা আমাকে খবর দিবি। আর তোমরা সবাই যে যার বাড়িতে লাঠি, সড়কি যাই থাক সেগুলো তৈরি রাখো। রফিক চাচা তোমার বন্দুকটা পরিষ্কার করে নদীর ধারে দু চারটে পাখী মেরে দেখো ঠিক আছে কিনা। বিল্টু বা শম্ভু কোন খবর দিলে সবাই মিলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে আমার মনে হয় ওরা এলে রাত্রেই আসবে সবার অজান্তে।’
দু দিন দু রাত্রি বিল্টু কিংবা শম্ভুর কাছ থেকে কোন খবর আসে নি। এর মধ্যে হিমাংশু ওদের বহু পুরাতন দোনলা বন্দুকটা তেল দিয়ে ঠিক ঠাক করেছেন। রোজ রাত্রেই দোতলার ছাতে ঘুরে বেড়ান কারণ ওখান থেকে অনেক দূর অবধি কোন আলো জ্বলছে কিনা দেখা যায়। শ্রীপদ সরকার ওদের পূর্ব পুরুষের পাওয়া সেই তলোয়ারটা ঘষে মেজে চকচকে করে নিয়েছেন। রফিক মিঞার বয়স প্রায় সত্তরের কাছে তবুও মহা উৎসাহে বন্দুকটা ঘাড়ে করে গ্রামের রাস্তায় মিলিটারি কায়দায় প্যারেড করেন।
দিনের বেলা হিমাংশু নিয়ম মতই লাইব্রেরিতে সময় কাটান। সেদিন আলমারির বই গুলোকে ঝাড় পোঁছ করে তুলে রাখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত বইএর দিকে নজর গেলো – যেন সব কটা পাতাই চট লেগে গিয়েছে। একটু টানাটানি করতেই বইটা মাঝখান থেকে খুলে যেতে হিমাংশু দেখেন বইএর পাতা গুলোর মাঝ খানটা কেটে বের করে নিয়ে তার মধ্যে একটা ছোট্ট সুন্দর ডায়েরি ঢোকানো। হিমাংশ শিউরে উঠলেন – তাহলে কি সত্যিই গুপ্তধন আছে আর এই ডায়েরিতেই তার সন্ধান দেওয়া আছে না হলে ডায়েরিটাকে এ ভাবে লুকিয়ে রাখার মানে কি? ডায়েরিটা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে পালঙ্কের ওপর বসে ধীরে ধীরে খুললেন – সমস্ত পাতাই খালি শুধু মাঝ খানের পাতায় অদ্ভূত একটা কবিতা বা ছড়া - হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে এটা বাবারই লেখা।
কালাপানির ওধারেতে
গহীন নদীর ওপাড়েতে
মস্ত এক জঙ্গল হতে
চার পেয়ে এক বস্তু এলো।
টিকির টিকির টিক।।
গ্যাঁট হয়ে সে বসলো চেপে
ছয় জোয়ানে নাড়তে নারে।
হ্যাঁইও হো হ্যাঁইও।।
তোমরা সবাই খুঁজছো যারে
সে আছে তার পাহারাতে
বুদ্ধি তোমার খাটো যে তাই
ঘুরে বেড়াও খান্ডারেতে।
বকম বকম বক।।
বার কয়েক পড়েও হিমাংশু এটার কোন মানে পেলেন না – বাবা সত্যিই ধাঁধাঁ জানত তাই এ রকম এক কিম্ভূত কবিতা লিখেছে। শেষ প্যারাটা বুঝতে কোন অসুবিধা হলো না – গুপ্তধন ওই চার পেয়ে বস্তুর পাহারাতেই আছে আর সেটা খান্ডার মানে পুরাতন বাড়ির ধ্বংস স্তুপে নেই। দ্বিতীয় প্যারাটাও মোটামুটি বোঝা গেলো – ওই চার পেয়ে বস্তুটা প্রচণ্ড ভারী যাকে ছয় জন জোয়ানেও নাড়াতে পারে না – তাহলে কোথায় সেটা আর বস্তুটাই বা কি? অনেক ক্ষণ চিন্তা করে প্রথম প্যারার মানে বের করতে না পেরে হিমাংশু বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লেন। নাঃ, এটাকে ঠাণ্ডা মাথায় পরে চিন্তা করতে হবে। দ্বিতীয় দিন আবার ধীরে ধীরে ছড়াটা পড়লেন – কালাপানি মানে বোধহয় বঙ্গোপসাগর – আগে তো লোকে তাই বলতো। তাহলে কালাপানির ওধারেতে মানে কি আন্দামান – নাঃ, আন্দামানে তো গহীন নদী নেই। তাহলে? - - তাহলে কি বার্মার দিকে? এইবার হিমাংশু লাফিয়ে উঠলেন – বার্মার ইরাবতী নদীই হবে। তার মানে ওই চার পেয়ে বস্তুটা এসেছে বার্মার ইরাবতী নদীর ওপাড়ের জঙ্গল থেকে – তাহলে কি সেটা?? বার্মার জঙ্গলের কি বিখ্যাত? তাছাড়া শেষ লাইনটাও অদ্ভূত ‘টিকির টিকির টিক’ – এটাতো ছড়ার লাইন মেলানো নয় – তাহলে নিশ্চয়ই এর কোন মানে আছে। এই টিকির টিকির টিক হিমাংশুর মাথায় টিকটিক করতে লাগলো।
তৃতীয় দিন প্রায় মাঝ রাত্রে ছায়ার মধ্যে গা মিশিয়ে শম্ভু হাজির হলো অন্ধকারে - হিমাংশু চমকে উঠলেন।
‘ছোটবাবু, পাঁচ জন লোক এসেছে – তার মধ্যে একজনকে ভ্যান রিক্সাতে বসিয়ে ঠেলে ঠেলে এনেছে তার মানে ওই হয়তো নেতা। ওরা এখন আপনাদের ভাঙ্গা বাড়ির সিংদরজার পাশের একটা ছোট ঘরে আছে। সঙ্গে মনে হয় জিনিষ পত্রও আছে।’
হিমাংশু ছাতে উঠে দেখেন সত্যিই ওখানে একটা আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে - একটু সময় চিন্তা করলেন।
‘শোন শম্ভু, তুই ওই ঘরের পাশে মটকা মেরে ওদের কথা বার্তা শোন। ওদের কি উদ্দেশ্য আর বন্দুক টন্দুক কিছু আছে কিনা জানা দরকার। কাল সকালে সব জেনে তারপর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। মনে হয় কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থা নিয়েই এসেছে – আগের ওই দুই ছোঁড়াই ঘর টর পরিষ্কার করে গিয়েছে’।
পর দিন সকালে শম্ভু জানালো ওদের নেতার কাছে একটা রিভলবার আছে আর সেটা দিয়ে কটা খুন করেছে তার খুব গর্ব করছিলো। ওদের উদ্দেশ্য আজ রাত্রে এসে আপনাকে ধরবে তার কারণ দুটো – এক তো মার খেয়ে আপনি গুপ্তধনের হদিশ দিয়ে দেবেন আর দুই হলো সেদিন ওর দুই সাগরেদকে মারধোর করার শোধ তোলাও হবে। হিমাংশু বললেন,
‘হুঁ, তুই এক কাজ কর – বিল্টুকে বল দুপুরে গ্রামের সবাইকে চণ্ডী মন্ডপে আসতে।’
হিমাংশু পালঙ্কে বসে বালিসটা কোলের ওপর নিয়ে একটা কাগজে ছক করতে শুরু করলেন কি করে রাত্রে এই গুন্ডাদের মোকাবিলা করা যায়। লিখতে লিখতে আনমনে পালঙ্কের সূক্ষ্ণ কারু কাজের ওপর হাত বোলাচ্ছিলেন – এত সুন্দর কাজ তো এক মাত্র সেগুন কাঠের ওপরই করা যায়। মনে হতে হঠাৎ লাফিয়ে প্রায় মাটিতেই পড়ে যাচ্ছিলেন – সেগুন কাঠ মানে তো ইংরেজিতে টিক – সেই টিকির টিকির টিকের ‘টিক বা সেগুন কাঠ’ - তার মানে চার পেয়ে বস্তুটা সেগুন কাঠের তৈরি আর সেই কাঠ এসেছে বার্মার ইরাবতী নদীর ওপাড়ের জঙ্গল থেকে যেখানকার সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত আর এটা এত ভারি যে ছয় জন জোয়ানেও তুলতে পারে না। আরেঃ এই খাটও তো তাই আর এরও তো চারটে পায়া আছে। হিমাংশু উত্তেজনাতে খাট থেকে নেমে পড়লেন – তার মানে গুপ্তধন এই খাটের তলাতেই আছে। খাটের তলায় উঁকি দিয়ে অবশ্য কিছুই দেখতে পেলেন না আর ওর একার পক্ষে এই খাট নাড়ানো অসম্ভব।
দুপুরে চণ্ডী মন্ডপে সবাই জমায়েত হলে হিমাংশু বললেন,
‘তোমরা তো শুনেছো পাঁচটা লোক গতকাল রাত্রে গ্রামে এসেছে – আজ রাত্রে ওরা আসবে গুপ্তধনের খোঁজ নেওয়ার জন্য আমাকে ধরতে। আমার প্ল্যানটা শুনে তারপর তোমাদের মতামত দিও। দু তিন জনের গোটা ছয়েক দল পুরাতন জমিদার বাড়ির সামনের রাস্তার আশে পাশে লাঠি, সড়কি নিয়ে লুকিয়ে থাকবে গাছের আড়ালে। ওদের নেতার কাছে রিভলভার আছে সেই জন্য খুব সাবধান – আমার আওয়াজ না পেলে একেবারেই বেরুবে না। আমি বন্দুক নিয়ে রাস্তার বাঁ দিকটা দেখবো আর রফিক চাচা তুমি ডান দিকটা তবে তোমার সাথে আর কাউকে নিয়ে নিও সাহায্যের জন্য। দেখা যাক এই ফাঁদে ব্যাটারা ধরা পড়ে কিনা তবে ওই নেতাকেই প্রথমেই কাবু করতে হবে - দরকার না হলে কাউকে জখম করো না। শম্ভুর কাজ হবে নিঃশব্দে ওই লোক গুলোর ওপর নজর রাখা আর ও তো খুব ভালো প্যাঁচার ডাক ডাকতে পারে তাই ওরা বেরুলেই তিন বার শম্ভু প্যাঁচা ডেকে উঠবে।’
হিমাংশুর কথা শেষ হতেই সরু লাফিয়ে উঠলো,
‘ছোটবাবু, আমি রফিক নানার সাথে থাকবো।’
নায়েব মশাই কিছু বলতে যেতেই হিমাংশু থামিয়ে দিলো,
‘নায়েব মশাই ভয় পাবেন না – গ্রামে সরুর মত সাহসী মেয়ে আর নেই আর ওর উপস্থিত বুদ্ধিও খুব। রফিক চাচার সাথে ওর তো খুব ভাব ওরা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।’
হিমাংশুর কথা মত ছটা দল রাত্রের খাওয়া দাওয়ার পর রাস্তার দুধারের গাছের আড়ালে চুপচাপ গা ঢাকা দিয়ে বসলো। রফিক মিঞা গুলি ভরা বন্দুক নিয়ে সরুর সাথে রাস্তার ডান দিকে একটা খেজুর গাছের পেছনে বসলেন – সামনে রাস্তার এক পাশে বাঁশ বন আর অন্য দিকে বড় বড় গোটা কয়েক নারকেল গাছ। এর মধ্যে বিকেলেই সরু বন্দুকের ব্যাপারটা রফিক নানার কাছে বুঝে নিয়েছে। গ্রামের বাকি লোক জন উদগ্রীব হয়ে চণ্ডী মন্ডপে জেগে বসে আছে কি হয় জানার জন্য। সময় বয়ে চলেছে কিন্তু শম্ভু প্যাঁচা আর ডাকে না – যারা লুকিয়ে ছিলো এত সময় ধরে বসে থাকাতে হাতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে উসখুস করতে শুরু করেছে – রাজ্যের মশাও ছেঁকে ধরেছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর হঠাৎ শম্ভু প্যাঁচা ডেকে উঠতেই সবাই লাঠি সড়কি শক্ত করে ধরে টান টান হয়ে বসলো। হঠাৎ সরু দেখে রফিক নানা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছে – সরু আস্তে করে কনুইএর গোত্তা দিতেই নানা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘ওরে সরু, আমি পারবো নি রে – আমার শরীর যে কাঁপে। চল বাড়ি যাই।’
সরু ওর হাত চেপে ফিসফিস করে বললো,
‘আরে নানা ভয় পেও না – আমি তো আছি। শক্ত হয়ে বসো তো।’
একটু পরেই দেখা গেলো গুন্ডাদের দলটা এদিকেই আসছে – দেখেই তো রফিক মিঞার দাঁতে দাঁতে ঠকঠকানি শুরু হয়ে গিয়েছে – সরু ওকে রীতিমত চেপে রেখেছে না হলে বুড়ো হয়তো উঠে দৌড় দেবে আর তা হলে সমস্ত ব্যাপারটাই ভেস্তে যাবে। ওরা নারকেল গাছের কাছে আসতে সরু নানাকে খোঁচালো,
‘নানা, আকাশে গুলি করো তাড়াতাড়ি।’
নানাকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সরু তাড়াতাড়ি বন্দুকটা তুলে নিলো। উত্তেজনাতে হাত একটু কাঁপছে সেটা গুন্ডাদের দেখে না জীবনে প্রথম বন্দুক হাতে নিয়ে তা নিজেই জানে না। তবুও বন্দুকটাকে শক্ত করে ধরে ঘাড়ে নিয়েই ‘গুড়ুম’ আর বন্দুকের ধাক্কাতে সরু পেছন দিকে গড়িয়ে একেবারে রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে। ওদিকে বন্দুকের গুলিটা গিয়ে লেগেছে নারকেল গাছে আর গুলির ঘায়ে গোটা দুয়েক বড় নারকেল পড়বি তো পড় একেবারে বিশে গুন্ডার মাথায় ও পিঠে। ‘ওরে বাবারে’ বলে সে তো চিৎপাত আর হাতের রিভলভার ছিটকে গিয়ে পড়েছে জঙ্গলে। এদিকে গুলির আওয়াজ পেয়েই হিমাংশু ওদিক থেকে আকাশের দিকে গুলি করে চিৎকার করে উঠলেন,
‘ধর, ধর, ব্যাটাদের চেপে ধর।’
দুদিক থেকে বন্দুকের আওয়াজে আর নেতাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে গুন্ডাদের সব সাহস নিমেষে উবে গিয়েছে। হিমাংশুর চিৎকার শুনে সব কটা দল একেবারে রে রে করে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দমাদম পেটাতে শুরু করলো – হিমাংশু দৌড়ে এসে ওদের থামালেন,
‘ওরে আর মারিস না – দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে হাত পা বেঁধে চ্যাংদোলা করে চণ্ডী মণ্ডপে নিয়ে যা। আরে, রফিক চাচা গুলি চালিয়ে কোথায় গেলো দেখতো?’
ওদের আওয়াজ পেয়ে সরু উত্তর দিলো,
‘ছোটবাবু, আমি কাঁটাঝোপে আটকে গিয়েছি – উঠতে পারছি না।’
হিমাংশু তাড়াতাড়ি গিয়ে সরুকে বন্দুক সহ টেনে বের করলেন কাঁটা ঝোপ থেকে তারপর দেখেন রফিক মিঞা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। সবাই মিলে চণ্ডী মণ্ডপে ফিরে আসতে গ্রামের লোক একেবারে হৈ হৈ করে চারদিক থেকে হ্যারিকেন, পেট্রোম্যাক্স নিয়ে এসে হাজির – রফিক মিঞার মুখে জলের ঝাপটা দিতে বুড়ো ধীরে ধীরে উঠে বসে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলেন। হিমাংশু ওই পাঁচটা লোককে চণ্ডী মণ্ডপের খুঁটির সাথে ভালো করে বাঁধতে বলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আমাদের সরু আজকে কেল্লা ফতে করে দিয়েছে। ও বন্দুক না চালালে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে হয়ে যেতো। এই গুণ্ডাদের কাল সকালে ওদেরই ভ্যান রিক্সাতে বেঁধে আমি নিজেই নিয়ে যাবো পাশের গ্রামের থানাতে। আর একটা কথা – গুপ্তধনের খবরটা গুজব নয় – এটার হদিশ আমি আজই পেয়েছি। কালকে থানা থেকে ফেরার পর তোমরা আমার বাড়িতে এসো – ওখানে সবার সামনেই আমরা ওটাকে বের করবো তারপর ঠিক করা যাবে ওই গুপ্তধনের কি ব্যবস্থা করা যায়।’
শুনেই সবাই চমকে উঠেছে – চার দিকে উত্তেজনাতে ফিসফিসানি থেকে একেবারে হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। হিমাংশু ভাবলেন, আজ রাত্রে গ্রামের কারুরই ঘুম হবে না - ওর নিজেরও নয় - এত বছর ধরে নিজে ওই গুপ্তধনের ওপর চেপে বসে ছিলেন ভাবতেই কেমন লাগছে।
পর দিন ভোর বেলা পাঁচ গুণ্ডাকে ভ্যান রিক্সাতে শুইয়ে ভালো করে বেঁধে বিল্টু চালিয়ে নিয়ে গেলো আর পেছন পেছন হিমাংশু শ্বেতাতে চেপে চললেন পাশের গ্রামের থানাতে। ফিরে আসতে প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে – দেখেন ওর বাড়িতে পুরো গ্রামের লোকে একেবারে গিস গিস করছে। গ্রামের সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ – এমন কি বাড়ির বৌ ঝিরা পর্য্যন্ত রান্না বান্না ছেড়ে চলে এসেছে - বিরাট হৈ হট্টগোল চারদিকে। এদিকে রাতারাতি নানা রকম গল্প চালু হয়ে গিয়েছে গুপ্তধনের পরিমাণ নিয়ে – কেউ বলছে এক সিন্দুক হীরে মুক্তো আছে আবার কেউ বলছে, না রেঃ, এক সিন্দুক বাদশাহী মোহর আছে। মোহরের সপক্ষের লোকেরা আরো আশা করছে যে ছোটবাবু যে রকম দয়ালু লোক তাতে গ্রামের সব বাড়িতে একটা করে মোহর তো দেবেনই। আবার মহিলাদের মধ্যে আলোচনা চলেছে যে এক সিন্দুক অলঙ্কার আছে আর তা থেকে সবাই ভাগ পাবে। ঘোড়া থেকে নেমে হিমাংশু চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘আরেঃ, বাড়িটাকে তো মাছের বাজার বানিয়ে ফেলেছো দেখছি – সবাই একটু চুপ করো তো। শোন তোমাদের পুরো ঘটনাটা খুলে বলছি - -।’
ছড়া শুনে তো গ্রামের সবাই অবাক – সত্যিই বড় কর্তার বুদ্ধি ছিলো আর বড় কর্তার ছেলে ছোটবাবুর তো বুদ্ধি হবেই না হলে এই ছড়ার মানে কে বার করতে পারে। সব ঘটনা জানানো ও ডায়েরিটা দেখানোর পর হিমাংশু জানালেন ওর শোবার ঘরে এত লোক তো ধরবে না তাই গ্রামের মাথা এবং লাহিড়ী বংশের সাথে যুক্ত থাকার জন্য পূজারী ঠাকুর, নায়েব মশাই, পন্ডিত মশাই আর বিষ্টু কাকাকে ভেতরে নেবেন এ ছাড়া কালকে রাত্রে ভীষণ সাহস দেখানোর জন্য সরুও থাকবে সেই সাথে আট জন জোয়ান ওই পালঙ্ক সরানোর জন্য। গুপ্ত ধন পাওয়া গেলে সেটা বাইরে এনে সবার সামনেই খোলা হবে। সবাইকে বাড়ির উঠানে বসিয়ে গুপ্তধন বের করার দলকে নিয়ে হিমাংশু ঘরের মধ্যে এলেন। ঘরের ভেতরে বাইরে নিদারুণ উত্তেজনা – একটা ‘কি হয়, কি হয়’ ভাব চারদিকে। আট জন লোক ওই পালঙ্ক তুলতে ঘেমে গেলো – একজন তো বলেই বসলো,
‘ছোট বাবু এটা কি সেগুন কাঠের না পাথরের বানানো?’
হিমাংশু হাসলেন,
‘ওরে, এটা হলো আসল সেগুন কাঠ বার্মা মুলুক থেকে দাদু জাহাজে করে আনিয়েছিলেন। এর ওজন হবে না তো তোদের আম কাঠের ওজন হবে নাকি! নে, পালঙ্কটাকে ঠিক করে সরা।’
পালঙ্ক সরাতে দেখা গেলো মেঝেতে লম্বা চওড়াতে দুই হাতের মত একটা পাথর আলাদা করে বসানো। হিমাংশু একটা শাবল এনে চাড় দিতেও ঠিক নড়লো না তখন আর একটা শাবল নিয়ে দুজনে মিলে চাড় দিয়ে পাথরটা তুলতে ওটার নিচে একটা ছোট্ট কুঠরির মত চোখে পড়লো। ঘরের সবাই উত্তেজনাতে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ওই গর্তের ওপর – পাথরটা পুরোপুরি সরাতে দেখা গেলো ওই গর্তের মধ্যে সুন্দর কাজ করা সেগুন কাঠের একটা সিন্দুক। ওটার দুধারের হাতল ধরে দুজন লোক ওপরে তুলতে হিমসিম খেয়ে গেলো। এক জন থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
‘ছোট বাবু এত ভারী সিন্দুক মানে এটা তো ভর্তিই হবে?’
হিমাংশু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন – পূর্ব পুরুষের এই সম্পত্তির কি উপায় করবেন সেটাই ওকে ভাবিয়ে তুলেছে। আনমনে বললেন,
‘বাইরে উঠোনে তো নিয়ে চল – সবার সামনে খুললেই বোঝা যাবে।’
চার জন লোক সিন্দুকটাকে নিয়ে বাইরে আসতে চার দিক একেবারে চুপচাপ যেন গাছের পাতা ঝরে পড়লেও তার আওয়াজ শোনা যাবে – লোকে একেবারে দম বন্ধ করে বসে আছে সিন্দুকের ভেতর কি আছে দেখার জন্য। সিন্দুকটাকে উঠানের মাঝ খানে রাখতে দেখা গেলো ওটার পাল্লাতে একটা বিদঘুটে ধরনের তালা লাগানো। হিমাংশু শাবলের চাড় দিয়ে ওটাকে ভেঙ্গে ফেলে পাল্লার নিচে শাবলটা লাগিয়ে ধীরে ধীরে চাপ দিতে পাল্লাটা আস্তে আস্তে ওপরে ঊঠে এলো – গ্রামের লোকের তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার উপক্রম হয়েছে। হিমাংশু এক ধাক্কায় পাল্লাটা খুলে ফেললেন - ভেতরটা একেবারেই ফাঁকা। চারদিকে চরম হতাশার দীর্ঘশ্বাসের একটা ঝড় বয়ে গেলো। কত আশা ছিলো – বড় কর্তা এভাবে সবাইকে ভেলকি দেখালেন? কি দরকার ছিলো এই নাটক করার? তবে হিমাংশুর মনে হতাশার থেকেও স্বস্তি অনেক বেশী হলো – যাক মাথা থেকে একটা বিরাট দুঃশ্চিন্তা নামলো – গুপ্তধন থাকলে তার ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই অনেক বেশী ঝঞ্ঝাট হতো। ভেতরে ঝুঁকে বের করলেন একটা মোহর, একটা খুব সুন্দর সোনার বালা আর একটা প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ – খুলে দেখলেন চিঠিটা বাবার লেখা। ধীরে ধীরে সবাইকে শুনিয়ে হিমাংশু চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন।
বাবাজীবন হিমাংশু,
লাহিড়ী বংশের সম্পত্তির কিছুই তোমার জন্য রাখিয়া যাইতে পারিলাম না। তোমার দাদুর স্বর্গবাসের পর দেখিলাম আমাদের পূর্ব পুরুষের যথেচ্ছাচারের বিরাট দেনায় লাহিড়ী বংশ ডুবিয়া আছে। তাই বংশের শেষ সম্পদ এই সিন্দুকের সমস্ত মোহর ইত্যাদি ভাঙ্গাইয়া আমি সেই দেনা শোধ করিয়াছি। যদিও তোমার জন্য কিছুই রাখিয়া যাইতে পারলাম না তবুও আমি আনন্দিত – তোমাকে বংশ পরম্পরার ঋণ হইতে মুক্ত করিতে পারিয়াছি। এই মোহর দিয়া তোমার জন্মের পর তোমার দাদু তোমার মুখদর্শন করিয়াছিলেন তাই এইটা তোমার প্রাপ্য আর তোমার মা নিজের শেষ অলঙ্কার এই বালাটি রাখিয়া গিয়াছেন পুত্রবধূর জন্য অতএব তুমি এই বালার জিম্মাদার।
ইতি
আশীর্বাদক
তোমার পিতা
সুধাংশু শেখর লাহিড়ী
অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অঞ্জন নাথ
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
টেনশন, টেনশন
অভি একা বাড়িতে বসে টেনশন করছে। বাবার ফিরতে দেরি হচ্ছে, মা একটু শপিংয়ে বেরিয়েছে। কাজের মাসিও আজ ছুটি নিয়েছে। সুতরাং সে এই মুহূর্তে বিশুদ্ধ একা। তাতে অবশ্য তেমন কিছু নয়। সে এখন বড় হয়ে গেছে, একলা থাকতে হলে আর ঘন ঘন বাথরুম পায় না। তার টেনশনের কারণ অন্য।
ব্যাপারটা সেই চিরাচরিত, অর্থাৎ অঙ্ক। সে যে বোঝে না তা নয়। কিন্তু বিশেষ করে অজানা কোনো প্রশ্নের অঙ্ক সলভ করতে গিয়ে কীভাবে যেন খেই হারিয়ে ফেলে। তারপর দেবু স্যার যখন ক্লাসে “আরে এটা বুঝলিনা, গাধা!” বলে অঙ্কটা কষে দেন, তখন মনে হয় – ইস, এই সহজ ব্যাপারটা মাথায় এলো না! আত্মবিশ্বাসের অভাব, বলেন স্যার।
সেদিন অঙ্ক নিয়ে আর এক কাওতাল হলো। মা ভিসিডি প্লেয়ারে স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তার সম্পূর্ণ জন-গণ-মন গানটা চালিয়ে দিয়েছিলো। তার শেষদিকে ছিলো, “দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে, রক্ষা করিলে অঙ্কে।” শুনে অভি জিজ্ঞেস করেছিলো, “মা, কবিগুরু কি এখানে দেবু স্যারের মতো অঙ্ক টিচারদের কথা বলেছেন?” “না, তা নয়। এখানে অঙ্ক মানে –”, মা কী যেন বোঝাতে শুরু করেছিলো। কিন্তু বাবা এত জোর হেসে উঠেছিলো যে অভি মা’র কথা শেষ অবধি শুনতেই পায়নি।
তা, এখন সেই একগাদা প্রশ্নের অঙ্ক নিয়ে বসে সে মাথা চুলকোচ্ছে। বাবা-মা কেউ থাকলে একটু ধরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তারা ঢুকতে ঢুকতে অভির চোখ ঘুমে ঢুলে পড়বে। হোমওয়ার্ক কমপ্লিট না হলে দেবু স্যার যে মারধর করেন তা নয়, তবে তাঁর মিছরির ছুরি ব্যঙ্গ শুনতে শুনতে বন্ধু-বান্ধবদের সামনে লজ্জায় মুখ-কান লাল হয়ে ওঠে। বাবা-মা’কে এ নিয়ে বললে তারা হয়তো খুঁজেপেতে একজন টিউটর এনে লাগিয়ে দেবে – সে আর এক যন্ত্রণা।
সুতরাং অভি ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে ভেবে যায় আর টেনশন করে চলে। সাথে আবার টেনশন নম্বর দুই – গান। এটা অবশ্য অভি বেশ পারে। অনেকে বলে টিভিতে বাচ্চাদের সারেগামা-ফামা কীসব হয়, তাতে নাম দিতে। বয়ে গেছে অভির! গানে যেটুকু আনন্দ আছে, কম্পিটিশনের ঠ্যালায় দু’দিনে তাও উপে যাবে। অর্থাৎ আরো একটা সবুজ দরজায় কুলুপ।
তবে পাড়ার ক্লাবের ফাংশনে সে বাচ্চা গ্রুপে গায়। গতবারের ফাংশনে ‘ভূমি’ এসেছিলো আর অভির ওপর পড়েছিলো সৌমিত্র কাকুকে ফুল দেবার ভার। উনি একটু হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি আমাদের গান শোনো?”
“হ্যাঁ, তবে আপনাদের গান শুনলে আমার জ্বর এসে যায়।”
“ও, তাই?” অস্বস্তিভরে বলেছিলেন কাকু।
“আপনাদের গান তো নিঃশব্দে শোনা যায় না, সাথে গলা মেলাতে হয়। আর অত চড়া স্কেলে গাইতে গেলেই গলা ভেঙে যায়। তারপর গলাব্যথা, সর্দিকাশি, জ্বর –”
ওর পিঠ চাপড়ে কাকু বলেছিলেন, “এর চেয়ে ভালো প্রশংসা আমি এখনো পাইনি।”
তা, আবার কিছুদিন পর সেই পাড়ার ফাংশনে অভিকে গাইতে হবে। তবে কিছুদিন ধরে একটা বেয়াড়া কাশি। আগেও এমন হয়েছে। কিন্তু এবার অনেকদিন ধরে ভোগাচ্ছে, এদিকে ফাংশন এসে গেলো বলে।
বাবা অগত্যা ডাক্তার দাদুর কাছে নিয়ে গেলেন। উনি দেখেটেখে গম্ভীরভাবে বললেন, “ওর কোনো দোষ নেই। আসলে পাশের ঐ যে আকাশছোঁয়া বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকে ধুলোবালি, কংক্রিট-সিমেন্টের গুঁড়ো এসে বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। ইদানীং আমার কাছে গলা ও বুকের সমস্যা নিয়ে অনেক রোগি আসছে, তাদের বেশির ভাগই বাচ্চা। ঐ বিল্ডারকে সাবধানতা নিতে বাধ্য না করাতে পারলে কতজনের যে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে কে জানে!”
তা, বাবা পাড়ার আরো কয়েকজনকে নিয়ে বিল্ডারের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন, “আরে, বাচ্চা তো আমার বাড়িতেও রয়েছে – কই, তাদের তো কিছু হচ্ছে না!”
হচ্ছে না কারণ তিনি থাকেন ওখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কিন্তু তাঁকে সে কথা বোঝাবে কে? রোজ ধূলোবালি, সিমেন্টের গুঁড়ো উড়ছে আর বাচ্চারা কেশেই চলেছে। আর অভির টেনশন বেড়েই চলেছে।
“গম্ভীর হয়ে কী ভাবছো?”
অভি চমকে দেখে, পাশে চেয়ারে বসে প্রায় তার বয়েসী একটি ছোট্ট মেয়ে।
“সে অনেক জ্বালা, তুমি বুঝবে না।” বলেই অভির খেয়াল হলো, “কিন্তু তুমি কে? এখানে এলে কীভাবে?”
“আমি সলমা, আমি তো এখানেই থাকি।”
“ঢপ দেবার আর জায়গা পাও না – এটা তো আমাদের বাড়ি!”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি এখানেই অন্য এক খাঁজে থাকি।”
“খাঁজ?”
“ওঃ, তাও জানো না – একেবারে গাঁইয়া দেখছি!” সলমা হেসে বললো, “আরে বাবা, যেমন ধরো তোমরা যে জমির ওপর তিনতলায় রয়েছো, একই জমির ওপর দোতলায় অন্য লোক থাকছে। তেমন আমরাও তোমাদের সাথে একই জমিতে, একই তলায়, কিন্তু অন্য একটা খাঁজে আছি। যাকে ইংরেজিতে বলে Tier.”
“আমাকে অত বাচ্চা পাওনি যে ইঞ্জিরি-মিঞ্জিরি যাহোক কিছু পড়িয়ে দেবে! আমি ইস্কুলে পড়েছি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা – মাত্রা এই তিনটি। ওসব খাঁজটাজ তো বাপের জম্মে শুনিনি।”
“শোনোনি, এবার শুনলে। আর নিজের চোখেই তো আমাকে দেখছো। খাঁজ যদি না থাকে তো আমি এলাম কোত্থেকে?”
অভি ভেবেচিন্তে বললো, “ওঃ, তার মানে ওসব ভজখট ছেড়ে সংক্ষেপে, তুমি ভূত! আই মীন, পেত্নী। তবে আমি কিন্তু ভূতে-টুতে ভয় পাই না।”
“ভূত, পেত্নী!” সলমা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, “ভূত নয়। তুমি যেমন গবেট দেখছি, মনে হয় আমরা বরং তোমার তুলনায় ভবিষ্যৎ। তা, আমাকে দেখে কি পেত্নী-পেত্নী মনে হচ্ছে?”
“না।” অভি গম্ভীরভাবে বললো, “এত বাচ্চা না হলে বরং তোমাকে পরী রানি মনে হতে পারতো। তা, তুমি কি তাহলে ভিন গ্রহের বাসিন্দা, মানে এলিয়েন?”
“উঃ, বলছি না আমি এখানেই থাকি। পড়শি কখনো এলিয়েন হয়? তবে তোমাদের বিজ্ঞান যে মান্ধাতার আমলের, খাঁজ-ফাজ নিশ্চয়ই বুঝবে না। তাহলে মনের শান্তির জন্য এলিয়েনই ধরে নাও।”
“কিন্তু পড়শি হলে অ্যাদ্দিন তোমায় দেখিনি কেন?”
“আরে, এক খাঁজ থেকে আরেক খাঁজে আসা কি চাট্টিখানি কথা নাকি? তার জন্য চাবির দরকার হয়, যা সবার থাকে না। আমার বাবা সায়েন্টিস্ট – এবার অফিসের লম্বা ট্যুরে বাইরে গিয়েছে আর চাবিটা গিয়েছে ফেলে। আমি ঘরে বসে বসে সুপার-বোর হচ্ছিলাম, তাই চাবি দিয়ে চ্যানেল সার্ফের মতো সব খাঁজ খুঁজতে খুঁজতে দেখি এখানে বসে তুমি কী নিয়ে যেন ধ্যানে বসেছো। তা, ঋষিমশাইয়ের নামটা জানতে পারি? নাকি সেটা তোমাদের খাঁজের শিষ্টাচার নয়?”
অভি একটু লজ্জা পেয়ে বললো, “না, তা কেন! আমি অভি, মানে অভিমন্যু।”
দুষ্টু হেসে সলমা বললো, “তা, তুমি কোন ব্যুহে ঢুকে বেরোবার পথ পাচ্ছো না? অঙ্ক? একবার বলেই দ্যাখো না, যদি আমাদের কাছে কোনো সমাধান থেকে থাকে?”
অগত্যা অভিকে লজ্জার মাথা খেয়ে এই বাচ্চা মেয়েটার কাছে স্বীকার করতে হলো যে ব্যাপারটা তাই। তার কাছ থেকে সব শুনে সলমা কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, “ব্যাপারটা তো খুব সহজ। মনে মনে ভাবো তুমি অঙ্কটা না পেরে দেবু স্যারের সামনে এসেছো আর দেবু স্যার বলছেন – দুর গাধা, এটা পারলি না? অঙ্কটা তো খুব সহজ! এরপর তিনি বোর্ডে অঙ্কটা কষে দিচ্ছেন।”
“তো?” অভি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“তো এবার বোর্ড থেকে অঙ্কটা টুকে নাও!”
“কী ভাট বকছো!” বলতে বলতেই অভির মনে হয়, আইডিয়াটা তো মন্দ নয়। একটা আটকে যাওয়া অঙ্ক সে চোখ বুঁজে ভাবে, তারপর স্যার ঐ গাধা-টাধা বলার পর কীভাবে বোর্ডে অঙ্কটা কষে দিচ্ছেন সেটাও ভাবার চেষ্টা করে। আর সত্যি সত্যিই তার চোখের সামনে সমাধানটা ছবির মতো ভেসে ওঠে!
“ইউরেকা! থ্যাঙ্ক ইউ, সলমা!” অভি লাফিয়ে উঠে বলে, “কিন্তু কী করে হলো?”
“ওই যে তোমার স্যার যা বলেন – আত্মবিশ্বাসের অভাব! স্যারের ছবি ভাবলেই সেই বিশ্বাসটা তোমার মনে জন্মায়। এভাবে অঙ্ক কষতে কষতে একদিন তুমি নিজে নিজেই সমাধান খুঁজে পাবে।”
সত্যিই এভাবে অভি সেদিন দু-একটা বাঁদুরে অঙ্ক সহ সাত-আটটা দুর্ধর্ষ জিনিস নামিয়ে দিলো। সলমা তার মুখ দেখে বললো, “মনে হচ্ছে, তোমার টেনশন এখনো যায়নি?”
“না, মানে, সে এক অন্য ব্যাপার। একটা গানের প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু আমার গলাটা একদম ঠিক হচ্ছে না – আশেপাশে যা প্রদূষণ!” এরপর সে সলমার কাছে সব ব্যাপারটা খুলে বললো।
“হয়ে যাবে।” সলমা একটু ভেবে বললো, “তবে আজ নয়। আমাকে বাড়ি ফিরে একটা জিনিস নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া আওয়াজ পাচ্ছি, তোমার মা ফিরলেন বোধহয়। তার আগেই কেটে পড়ি, নইলে আবার একদফা খাঁজ-ফাজ বোঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হবে। কাল এই সময় আসবো। গুড বাই।”
পরদিন সলমা ঠিক সেই সময় যেন হাওয়ার থেকে এসে হাজির। হাতে তার একটা পুরিয়া।
“তোমরা কি ম্যাজিক জানো নাকি?” অভি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“আরে না না, ম্যাজিক-ফ্যাজিক নয়, সামান্য একটু প্রযুক্তি। আমাদের বাজারেই পাওয়া যায়। এটা তুমি যদি জ্বালিয়ে দাও, একটা ধোঁয়াহীন গ্যাস তৈরি হবে। তখন আশেপাশে যারা আছে, সব কাশতে শুরু করবে। তুমি এটা নিয়ে, পারলে কিছু দলবল জুটিয়ে বিল্ডারের বাড়ি যাবে আর কথা বলতে বলতে চুপি চুপি এটায় দেশলাই জ্বালিয়ে দেবে। তারপর মজা দেখবে। তোমরা নিজেরা অবশ্য গ্যাস মাস্ক পরে নিও। আমি আবার সামনের সপ্তাহে আসবো, কাজ নামলো নাকি জানতে।”
নামবে না আবার! অভি নিঃশব্দে প্রচার করে এক বাচ্চা ব্রিগেড জড়ো করলো, যাদের সব্বার কাশি চলছে আর যাদের অধিকাংশই ফাংশনে গাইবে। একদিন সন্ধেবেলা তারা গিয়ে বিল্ডারকাকুর বাড়ি হাজির, সবার মুখে সার্জিকাল মাস্ক। আগেই খোঁজ নেওয়া হয়েছে, তখন কাকুদের লোকজন সব বাড়িতে।
“এ কী, মুখোশ পরে সব আমার বাড়িতে? ডাকাতি করবে নাকি?” বিল্ডার কাকু মুচকি হেসে বললেন।
“না না, কাকু – আসলে আমাদের সবার সর্দিকাশি কিনা, হয়তো কারো টিবি-ব্রঙ্কাইটিসও হতে পারে। তাই আপনাদের যাতে ছোঁয়াচ না লাগে –”
“তা বাবা, তোমরা ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছো। এটা তো হাসপাতাল নয়।”
“না কাকু, আমরা ঠিক জায়গায়ই এসেছি। আপনি যে ‘পবিত্রধাম’ বহুতল বাড়িটা বানাচ্ছেন, তার থেকে ধুলোবালি, সিমেন্ট উড়ে এসে আমাদের পাড়ায় বায়ু বড়ই অপবিত্র করছে। তাই আমাদের এই অবস্থা। আপনার কাছে তাই আমাদের বিনীত নিবেদন –”
কাকুর ভুরু কোঁচকায়। বলেন, “দ্যাখো, এসব বাচ্চা ছেলেদের ব্যাপার নয়। তোমাদের বড়দের সাথে তো আমি কথা বলেইছি। যদি আমার বিল্ডিং তৈরির জন্যই প্রদূষণ হবে তবে তো আমাদেরও ঐ কাশি-ফাশি হতো। কিন্তু তেমন কিছু তো –”
অভি ইতিমধ্যে নিঃসাড়ে গুঁড়োটা সোফার পেছনে ঢেলে অলক্ষ্যে আগুন দিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথে বিল্ডারকাকু কথা শেষ না করেই কাশতে শুরু করে দিলেন। একটু পর ভেতর ঘর থেকেও শোনা গেলো কাশির আওয়াজ। এক-দুই-তিন – বাড়তে বাড়তে হঠাৎ শুরু হলো যেন কাশির মহা ঐকতান।
“আশেপাশে কেউ ধোঁয়া দিয়েছে – জানালা বন্ধ করো।” কাকু কাশতে কাশতে বললেন।
“সরি কাকু”, অভি বললো, “চারদিকে তাকিয়ে দেখুন – কোথাও কোনো ধোঁয়া নেই। এ হচ্ছে অদৃশ্য প্রদূষণ, নিঃশব্দ ঘাতক। কী যেন বলছিলেন – আপনার বাড়িতে কাশিফাশি নেই?”
“নেই – মানে, অ্যাদ্দিন তো ছিলো না। আজ হ্যাঁচকা কিছু একটা হয়েছে।”
“হ্যাঁচকা কিছু নয়। আসলে আপনার বাড়ি একটু দূরে বলে আপনি অ্যাদ্দিন টের পাননি। কিন্তু আজ বোধহয় বাতাস এদিকে, তাই সব প্রদূষক বাতাসে বয়ে হাজির হয়েছে। দাঁড়ান, দেখি –” বলে সে স্মার্টফোনে গুগল-ফুগল কীসব যেন দেখে একটু পর এক গাল হেসে বললো, “এই তো, আজ থেকে কলকাতায় ঘণ্টায় সতেরো কিলোমিটার বেগে হাওয়া উত্তর-পূর্বদিকে বইবে। অ্যাদ্দিন ছিলো উত্তর-পশ্চিম। আর এমনটা আর অন্ততঃ সাতদিন থাকবে। সেইজন্যেই!”
“তার মানে – আর সা-তদিন আমরা এভাবে কাশবো?” কাকু ভয়ার্তকণ্ঠে বললেন।
“না না, কাকু – সব সময় কি আর দমকা আসবে! তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই কাশি হবে। আর যখন হবে না তখনও তো ঐ বালি, সিমেন্ট, কংক্রিটের গুঁড়ো নিঃশব্দে এসে হাজির হচ্ছে আর নিঃশ্বাসের সঙ্গে গিয়ে জড়ো হচ্ছে আপনাদের ফুসফুসে। তার ফলে ব্রঙ্কাইটিস, টিবি, সিলিকোসিস, এমনকি লাং ক্যান্সারও হতে পারে। অর্থাৎ, নিঃশব্দ মৃত্যু।” অভি ‘নির্মল বায়ু’ এন-জি-ওর প্রোমোটা মুখস্থ ঝেড়ে দেয়।
“তাহলে আমি কী করবো? অ্যাদ্দুর এগিয়ে এখন –” কাকু ফ্যাকাশে মুখে বলেন।
“ছি ছি, বাড়ির কাজ বন্ধ করবেন কেন! তবে আপনারও তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘর – কিছু সাবধানতা নিন। যেমন, চট-ত্রিপল দিয়ে পুরো বাড়িটা ঘিরে দিন, যাতে ধুলো বাইরে বিশেষ না আসে। মিস্ত্রিদের বলুন কোনো বস্তা যেন অসাবধানে না ঢালে, যাতে সিমেন্ট বাতাসে ছড়িয়ে না পড়ে। আর ওরাও তো মানুষ – ওদের বলবেন এই আমাদের মত মাস্ক পরে কাজ করতে। এভাবে শুরু করুন, তারপর বাকি কী কী করতে হবে তা ‘নির্মল বায়ু’র কাকুরা আপনাদের বলে দেবে।”
“ওদের ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে? রেট কত ওদের?”
“ভাববেন না, আমি ওদের আপনার সাথে কনটাক্ট করতে বলবো। ওরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কোনো টাকা নেয় না। তবে প্রদূষণ-বিরোধী ব্যবস্থার জন্য আপনার কিছু খরচ হবে।”
“সে হোক। বালবাচ্চা নিয়ে ঘর করি – তাদের কিছু হবে না তো, অভিবাবু?” বিল্ডারকাকু এবার অভির হাত দুটো চেপে ধরলো।
“ছি ছি কাকু, অমন করবেন না – আমি আপনার ভাইপোর মতো। কারো কিছু হবে না। শুধু আসুন ঐ কচি কচি মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে আপনি-আমি সবাই একজোট হয়ে বাতাসকে নির্মল রাখতে সহায়তা করি।” অভি আবার এক বিজ্ঞপ্তি থেকে ভাষা ঝেড়ে দেয়। তারপর হাতজোড় করে বেরিয়ে আসে।
কাম ফতে – অভি বলতে পারে, সাতদিনের মধ্যে তাদের পাড়ায় বায়ু প্রদূষণ কমতে আরম্ভ করবে। ফাংশনের আগেই বাচ্চা ব্রিগেডও সুস্থ হয়ে উঠবে।
“থ্যা-ঙ্ক ইউ, সলমা। তুমি বোধহয় আমার চেয়ে ছোট। তবু বলবো – আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।”
“আরে এটা কোনো ব্যাপারই নয়।” সলমা উড়িয়ে দেয়, “আমাদের ওখানে এসব মুস্কিল আসান তো বলতে পারো রেডিমেড পাওয়া যায়। পাছে কারো মুখে কালো ছায়া পড়ে, তাই কোনো সমস্যা আমরা জমতে দিই না।”
“তবু সলমা আমার খুব বড় উপকার করলে।”
“আর ভবিষ্যতেও দরকার হলে আমি পাশে আছি। তোমার গোমড়া মুখে আমি হাসি ফোটাতে চাই।”
“ধন্যবাদ, তবে বোধহয় আর অত সাহায্যের দরকার হবে না। তুমি আমাকে সবচেয়ে বড় যা দিয়েছো তা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। দেখিয়েছো যে সমস্যার বিরুদ্ধে কলজে শক্ত করে দাঁড়ালে তারা পালাবার পথ পায় না। এবার থেকে অনেক সমস্যারই আমি নিজে সমাধান করতে পারবো। আর না হলে তো তুমি আছোই।”
“বেশ, তবে এখনকার মতো যাই।”
“যাচ্ছো? তবে তোমার কি আমাদের থেকে কিছু চাই? একটু কিছু প্রতিদান দিতে পারলে ভালো লাগতো।”
সলমা কিছুক্ষণ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললো, “আমাকে একটা জিনিস দেবে?”
“সাধ্যের মধ্যে হলে – অবশ্যই দেবো। নাও, লজ্জা না করে বলেই ফেলো।”
“আমাকে – আমাকে একটু টেনশন দেবে?”
মেয়েটা বলে কী! অভি হাঁ হয়ে গেলো – “টেনশন!”
“হ্যাঁ। জানো তো, আমাদের ওখানে একদম টেনশন নেই। হবার উপক্রম হলেই মুশকিল আসান এসে হাজির, সব ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার জন্যে। এর থেকে বেরোবার উপায় নেই। কী বলবো – লাইফটা স্রেফ আলুভাতে হয়ে গেলো। তোমায় দেখে এক এক সময় আমার হিংসে হয়।”
“তা বলে কেউ সেধে টেনশন চায়? যেন তুমি যেচে ইঁদুর, আরশোলা, ছারপোকা চাইছো।”
“ওসব কি আর কোনো টেনশন! সংরক্ষণ ব্রিগেড সাথে সাথে সাকশনে করে বস্তায় পুরবে, তারপর হাজার মাইল দূরের অভয়ারণ্যে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবে। কী করি বলো তো?”
অভির মাথায় যেন ব্যাপারটা একটু একটু ঢুকছে। সামান্য ভেবে বললো, “দ্যাখো, তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার মনে হচ্ছে আমাদের উল্টো। যেমন, ভূতেদের পছন্দ-অপছন্দ মানুষদের ঠিক উল্টো। তাই তো গু-গা-বা-বার বিটকেলে গানবাজনা শুনে খুশি হয়ে ভূতের রাজা তিন বরই দিয়ে ফেললো। তেমন আমরা টেনশন দূর করার জন্য যা করি, এবার দেখি তা দিয়ে তোমার যদি টেনশন তৈরি হয়।”
“কী দেবে?”
“গল্পের বই আর গান।” বলে অভি একটা বই আর একটা ডিভিডি বের করে বললো, “বইটা তো বাংলা, মনে হচ্ছে পড়তে পারবে। কিন্তু আমাদের ডিভিডি কি তুমি বাজাতে পারবে?”
একটু দেখে সলমা বললো, “আমি সায়েন্টিস্টের মেয়ে – হয়ে যাবে। তা, কী দিলে?”
“ফাটাফাটি জিনিস! বইটা হচ্ছে হরি পোদ্দার বলে এক অনাথ বালকের গল্প। কিন্তু সে ম্যাজিক জানে। তারপর সে এক রাজ্যে হাজির হলো সেখানে আদ্ধেক ম্যাজিশিয়ান আর আদ্ধেক –”
“পাগল না ছাগল কী যেন বলে! হ্যাঁ, আমি শুনেছি এই বইটার কথা। দাও দাও, মনে হচ্ছে এতে কাজ হবে। আর গান?”
“ওটায় আছে আমার চয়েসের দুই গান – টেনশন হলেই আমি ব্যাকগ্রাউন্ডে চালিয়ে দিই। প্রথমটা – ঝোলাভরা ঘি।”
“অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ! হোয়াই নট ঝো-লা-ভ-রা-ঘি-ই-ই? ইস্টুম-খিস্টুম – রাইফেল-মাইকেল – আগডুম-বাগডুম – বোঁচকা বেঁ-ধে-ছি-ই। হোয়াই নট ঝো-লা-ভ-রা-ঘি-ই-ই?”
“ইন্টারেস্টিং! আর দ্বিতীয়টা?”
“ওটা হচ্ছে – শুঁ-ট-কি শ্যামলী-ই! বোধহয় শোনোনি। তবে ফাটাফাটি হিট! জানো, একটা হোটেলে এই গানদুটোর কোনটা বাজবে তাই নিয়ে ঝগড়া করতে করতে দুটো লোক গোলাগুলি চালিয়ে দিয়েছিলো।”
“জবাব নেই – তবে মনে হচ্ছে এতেই হবে। বা-ই, আবার আসবো।” হাত নেড়ে ভ্যানিশ হয়ে যায় সলমা।
সলমা আবার এসেছিলো। আর খুশি হয়ে জানিয়ে গেছে – সে দারুণ টেনশনে আছে। হরি পোদ্দার তার অ্যাদ্দিনের শিক্ষার গোড়া অব্দি ঘুলিয়ে দিয়েছে। এখন কিছু ভাবতে গেলেই টেনশন হয়। আর ঝোলাভরা ঘি ইত্যাদি তার মাথার ঘিলু অব্দি নড়িয়ে দিয়েছে। সুপার-বোর হবার উপক্রম হলেই সে ডিভিডি চালিয়ে উদ্দাম নাচতে শুরু করে আর প্রায়ই টেনশনে মুচ্ছো যায়। অভিও কথা দিয়েছে এগুলো শেষ হলে সে আবার নতুন নতুন টেনশনের জোগান দেবে।
অভি শিখেছে – জীবনে টেনশন আসবে, কিন্তু তা নিয়ে টেনশন নিতে নেই। কারণ, জিরো টেনশন মানে লাইফ আলুভাতে। এই ব্রহ্মজ্ঞান হবার পর সে দিব্যি আছে, মস্তিতে আছে।
অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অনিরুদ্ধ সেন
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ -পর্ব ৪
ফুরফুরে হাওয়ায় খুশির রেশ নিয়ে অনিফিশ ঘুমিয়ে পড়েছিল পাপাঙ্গুলের হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে। ভোরের একটা মিষ্টি নরম আলো এসে পড়েছে সেই অনিফিশের সোনালি পাখনার ওপর। চারিদিকে একটা নতুনের গন্ধ। নতুন দিন। নতুন বছর।। কাল পাপাঙ্গুলের দেশের লোকেরা সারা রাত ধরে অনেক আনন্দ উৎসব করে অনিফিশকে নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে। এটাই পাপাঙ্গুলের দেশের নিয়ম। এরা ছেলে-বুড়ো কচি-কাঁচা সব্বাই একসাথে সেই দুরের টিলার কাছে যায় নতুন বছরকে স্বাগাত জানাতে। যে যেমনটি পারে নাচ-গান করে একসাথে মজা করে সারা রাত ধরে। পরদিন সক্কাল বেলা সবাই নতুন সবুজ হোগলা পাতায় তাদের ঘর ছায়, উঠোনে নানান রঙের ছবি আঁকে। সবাই নতুন পালক দিয়ে সাজে, আর আনেক খাওয়া দাওয়া, আনন্দ করে।
অনিফিশ তার সোনালি পাখনায় একটা ছোট্ট আড়মোড়া ভেঙ্গে তাকাল পাপাঙ্গুলের দিকে। সে দেখে পাপাঙ্গুল তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। হাতে তার একটা সবুজ রঙের খাতা। সেটাই পাপাঙ্গুল খুব সুন্দর একটা ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখছে। অনিফিশ একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে পাপাঙ্গুলের পাশে এসে খাতাটার দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বলে “পাপাঙ্গুল এটা কি?”
পাপাঙ্গুল বলে, "সুপ্রভাত অনিফিশ। কাল তোমার ঘুমোতে আনেক দেরি হয়ে গেছিল তাই আর তারাতারি তোমাকে ডাকিনি। কাল ঘুম কেমন হল, পাপাঙ্গুলের এই ছোট্ট হোগলা পাতার ঘরে?"
অনিফিশ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল "যাহ্ কি যে বল তুমি পাপাঙ্গুল , আমি তো আনেক দিন বাদে এমন সুন্দর একটা রাত কাটালাম কাল রাত্রে। আমি যে কি খুশি হয়েছি তোমার দেশে এসে কি বলবো। এমন সুন্দর নির্ভেজাল ভালবাসার দেশ আমি আগে কখন দেখিনি।"
পাপাঙ্গুল হেসে বলল "দেখবে দেখবে। দেখার কি আর শেষ আছে বন্ধু? কত দেশ, কত মানুষ, কত অজানা জিনিস, এসব দেখব বলেই তো ছাঁকনি চরে দেশ ছেড়ে দেশে বিদেশে ঘোরা। ঘরে থাকতে আমার একটুও ভাললাগে না অনিফিশ...জীবনটা কত ছোটো বলো। এইটুকু জীবনে কত কি দেখার জানার আছে বাকি।"
পাপাঙ্গুলে দেখে অনিফিশ তার ছোট পাখনাটা দিয়ে পাপাঙ্গুলের সবুজ খাতায় নরম করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পাপাঙ্গুল বলল –"অনিফিশ তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না এটা কি?...এইটা আমার দিনলিপির খাতা। যখন যেখানে যা দেখি, আমার ভাললাগা খারাপ লাগার কথা, আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, আমি এই খাতায় লিখে রাখি রোজ। অবশ্য সত্যি বলতে রোজ লিখতে পারিনা। তবে যখন যেমন সময় পাই আমি এই খাতা খুলে বসি। বলতে পার এটা পাপাঙ্গুলের বন্ধু - তোমারই মতো। খুব কাছের বন্ধু।"
অনিফিশ তো কোন দিন দিনলিপির কথা শোনেনি, তাই সে ভারি খুশি হল পাপাঙ্গুলের কথা শুনে। সে ভাবল সত্যি তো, এ তো ভারী ভাল জিনিস। এভাবে যদি কেউ সব কথা লিখে রাখে দিনলিপিতে তাহলে মাঝে-মধ্যে গল্পের মত এই খাতা পরে খুব ভাল লাগবে। এই ভেবে সে আনন্দে একটা ছোট্ট ডিগবাজি খেয়ে নিল । অনিফিশ তো এমনি অল্পে খুশি, অল্পে দুখী, মনের মাঝে কিছু চেপে রাখতে পারে না। শরীরটার মত মনটাও সোনালি আর নরম। অনিফিশ পাপাঙ্গুলকে বলল, “আচ্ছা অনিফিশ আমি এবার একটু সাঁতার কেটে আসি।” তোমাদের তো আগেই বলেছি সাঁতার কাটা অনিফিশের শখ। তা ছারা অনিফিশ তো জলের দেশের প্রাণী, তাই জল ছাড়া সে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না, মন খারাপ করে।
তাই সে সাগরপারে চলে গেল একটু সাঁতার কাটতে। পাপাঙ্গুলের ঘর থেকে সমুদ্র বেশি দূরে নয়, তাই তার পথ চিনতে কোন অসুবিধা হলনা। এদিকে পাপাঙ্গুল ঘোরের বশে ভাবছিল অনিফিশকে কি দাওয়াত খাউয়াবে। অনিফিশ তার দেশের অতিথি বলে কথা। কাল তো না হয় ডাকপুলি খেয়ে সবারই পেট ভর্তি ছিল। যেই না এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘর থেকে বেরিয়েছে, দেখে কয়েক জন পাপাঙ্গুল দিদি এসেছে। সাথে চটপটি দাদু। চটপটি দাদু তো পাপাঙ্গুলের দেশের সবচেয়ে বড়। দাদুকে পাপাঙ্গুলের দেশের সবাই খুব ভালবাসে আর মানে। তাই তারা সব কাজে দাদুর অনুমতি নেয়। তো সেই চটপটি দাদু বলল – "পাপাঙ্গুল আজ আমার বাড়িতে তোমার আর অনিফিশের দাওয়াত। আজ আমরা সবাই মিলে একসাথে খাব। তোমাকে তাই সকাল সকাল বলতে এলাম।" এই কথা তা শুনে পাপাঙ্গুলের মন তো খুশিতে ভরে উঠল। চোখের কোণে এক চিলতে জল। পাপাঙ্গুল বুঝে পেল না দাদু কে কি বলবে। মাঝে মাঝে এমনও হয় যখন সব কথা গলার কাছে এসে আটকে যায়, খুশির আবেগে। কিভাবে একজন আর একজনের না বলা কথা বুঝে যায়, ভালবাসায় সবাই বুঝি এভাবেই একে অন্যকে কাছে টেনে নেয়। নাহলে কত বছর সে দেশছাড়া, সে কি ভেবেছিল এতো বছর পর দেশে ফিরে তাকে সবাই এমনি করে আপন করে নেবে? এভাবে আবার আদর-ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে! পাপাঙ্গুল মুখে কিছু বলতে পারল না খালি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
অনিফিশ সমুদ্রের নিল জল দেখে খুশীতে নেচে উঠল। পারের থেকে তাই লম্বা একটা লাফ দিয়ে পরল অনেক দূরের নিল জলে। আঃ! কি আরাম! অনিফিশ তার পাখনাটা এদিক-ওদিক করে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটল জলে। কিছুক্ষণ পড়ে বাইরে আওয়াজ শুনে মাথা তুলতে দেখে একদঙ্গল বাচ্ছা পাপাঙ্গুলের ছানা হুল্লোর করতে করতে আসছে সমুদ্রের দিকে। কালকে এই ছোট্ট ছানাগুলোই তো ওকে ঘিরে নাচ করছিল। অনিফিশ সাঁতরে পারে এসে ডাক দিল তাদের। অনিফিশকে দেখে তারা তো হই-হই করতে করতে এলো অনিফিশের কাছে। অনিফিশ বলল - "তোমরাও বুঝি সাঁতার কাটতে এসেছ?" ওদের মধ্যে একজন বলল "আমরা তো প্রায়ই আসি সমুদ্রে। তবে, আজ এসেছি আনন্দ-স্নান করতে। মানে নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা সবাই এক সাথে সমুদ্রে স্নান করে নতুন জামা পড়ে বড়দের নমস্কার করে আসি। তারপর আজ তো ভীষণ মজা। তুমি জান না? আজ দুপুরে আমাদের সবার চটপটি দাদুর বাড়িতে দাওয়াত। তুমিও তো যাবে সেখানে।" এই শুনে অনিফিস বেজায় খুশি হয়ে চোখ বড় করে বলল - "সত্যি?" তখন সবাই মিলে বলে উঠল - "সত্যি...সত্যি...সত্যি। আহা আলঙ্গুশ...আহা আলঙ্গুশ...আজকে মোদের মেজাজ বড় খুশ।"
অনন্যা দত্ত
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অনন্যা দত্ত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ভীতু ছোটনের গল্প
বুবুন আর ছোটনের খুব মজা এবার বড়োদিনের ছুটিতে। দিন ছয়েকের জন্যে পুরী যাচ্ছে যে মা বাবার সঙ্গে। ছোটনের তো পুরী মনেই নেই, সমুদ্রও নয়। সেই কোন ছোটবেলায় গিয়েছিল, দু আড়াই বছর বয়েসে আর তখন নাকি ঢেউ দেখে খুব ভয় পেয়েছিল, নামতেই চায় নি, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিল নাকি। ছোটন এখন ক্লাস ওয়ানে উঠে গেছে অথচ ওর দাদা বুবুন এখনো ওকে ওই কথা বলে ভীতু ভীতু বলে খেপায়। আসলে সাত বছরের বড়ো তো, তাই ভাইকে একদম পাত্তাই দেয় না। এবার তাই ছোটন ভেবেই এসেছে ও অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্রে চান করে দেখিয়ে দেবে যে ও মোটেই ভীতু নয়।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অদিতি ভট্টাচার্য্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প