বীরপুরুষ ও কাপুরুষ
ভূত পেত্নী,দত্যি দানায়
করি না কো ভয়,
ভীরু যারা,কাপুরুষ তারা,
বীরপুরুষ জয়ী হয়।
মনের যে ভয়,সে বড় হয়,
এসবের নেই অস্তিত্ব,
অন্ধকারের দুর্বল মন,
অজ্ঞানে ভরা চিত্ত।
সেদিন দেখি আঁধার রাতে
আবছা চাঁদের আলো ছায়ায়--
দাঁড়িয়ে আছে কে যেন ওই
ঘোমটা মাথা দোলা হাওয়ায়!
যদি ভীরু জন,দেখত এমন
নির্ঘাত পড়তো ফিট্,
আমি কিন্তু নয়,দূরে ফেলে ভয়
এগিয়ে করলাম মিট্।
কিচ্ছুটি নয়,কলার পাতা,
বাতাস দোলায় আধ-আঁধারে,
নিঝুম রাতের মনের ভ্রমে
যেন ঘোমটা বৌ বনবাদাড়ে!
দুষ্ট ছেলের ঘুম পাড়ানির
ঠাকুমার এ গল্প গাঁথা,
ভালই শুনতে,মনের একান্তে,
আসলে সব কল্প কথা !
তাপসকিরণ রায়
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তাপস কিরণ রায়
- ক্যাটfগরি: ছড়া-কবিতা
চিড়িয়াখানা
আমার ছোট্ট চিড়িয়াখানায়,
আছে বাঁদর, বেজি, কাঠবিড়ালি।
আছে হরেক রকম পাখি।
তোতা, ময়না, কাকাতুয়া
কি নেই আর বাকি?
বাড়ির সব অতিষ্টপ্রায় বকাবকি চলতে থাকে।
ভালবাসার এ সংসার, বল’ত ভাই বোঝাই কাকে?
মজা লাগে যখন পোষা
কুকুর কেউ রাখতে আসে।
যাচ্ছে হয়ত দিল্লি –আগ্রা
কিম্বা কলকাতার আশেপাশে।
এত বড় জন্তু দেখে,
চেঁচায় পাখি সব তারস্বরে।
বেজি, বাঁদর ভয় পায়না
অচেনা কুকুর ভয়ে মরে।
মা –জ্যেঠিদের ঘুম হয়না
গাল দেয় ওটা বদ্ধ পাগল
আমি তখন খেলছি স্কুলে
আমার কোন নেই হেল দোল।
মজার ব্যাপার শুনবে তবে;
দিন কতক যেই পার হয়ে যায়
বেজি, বাদঁর, কুকুর খেলে
রাগ- ভয় যেন কোথায় পালায়।
অচেনা সব জন্তুগুলো
ক’দিনে কেমন মিলে মিশে যায়।
চেনা মানুষ মরছে লড়ে
কোন সে স্বার্থে, কিসের দায়?
সমর চট্টোপাধ্যায়
গড়িয়া গার্ডেন্স, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সমর চট্টোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: ছড়া-কবিতা
ছড়ার দেশ
মনে মনে লিখছি ছড়া
ছড়ার ছ্যাকড়া ছুটছে জোরে
হঠাৎ দেখি পৌঁছে গেছি
স্বপ্ন রাজ্যে ছড়ার ঘোরে।
ভারি সুন্দর ছড়ার এ দেশ
সেথা শিশু মেলার হট্টগোল
কচি-কাঁচা, তোমার আমার
(শুধু) সবুজ মনের কলরোল।
ভাষার কোন নাইকো বাধা
ছন্দ মিলের গলা সাধা
সেথা লাল সবুজের নেই কো দ্বন্দ্ব
সবাই আপন, পর তো নয়
ছড়ার দেশে সবাই রাজা
ছড়া ছড়াক বিশ্বময়।
সমর চট্টোপাধ্যায়
গড়িয়া গার্ডেন্স, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সমর চট্টোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: ছড়া-কবিতা
সিড়িঙের সমস্যা
সিড়িঙের খুব মনখারাপ। পেট চন্ চন্ করছে খিদেতে। সকাল থেকেই পেটে তেমন কিছু পড়েনি। সেই কাকভোরে পিড়িং, সিড়িঙের মা কতগুলো মাছি ধরে এনে দিয়েছিল। মরা মাছি। মাছি দিয়েই জলখাবার হয়েছে আজ। তাতে কি আর খিদে যায়? পেট টন্ টন্, কন্ কন্ করছে। পিড়িং এরও অনেকক্ষণ পাত্তা নেই। সেই কখন খাবারের যোগাড়ে গিয়েছে। এখনও ফেরেনি সে। সিড়িঙের তেমন করে খাওয়া হয়নি আজ। তাই পিড়িং পণ করেছে ছেলের জন্য খাবার এনেই একেবারে ফিরবে। কিন্তু গেছে সে অনেকক্ষন! কখন ফিরবে? সিড়িঙ খিদেতে আর পারে না যে!
গাছের ডালে বসে সিড়িঙ তাক্ করে মানুষের বাচ্চাগুলোকে। বাচ্চাগুলো চালাক হয়ে গেছে আজকাল। দূরে ঘুরছে, ফিরছে, খেলছে, হাসছে। এদিকে আসছে না একেবারেই। একবার নিম গাছের তলায় এলেই চুলের মুঠি ধরে সরাৎ করে ওপরে। তারপর কপাৎ করে জ্যান্ত গিলে ফেলা। কিন্তু কাঁহাতক্ আর এভাবে বসে থাকা যায়?
সিড়িঙের মানা আছে নিমগাছের দশ হাতের চৌহদ্দি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার। পিড়িং মানা করে গেছে। মানুষগুলো আজকাল নাকি সাহসী হয়ে গেছে। সেদিন পিড়িং ওই কোণের বাড়ি থেকে খাবার চুরি করতে গিয়েছিলো। এখন তো গোটা আস্ত মানুষ আর পাওয়া যায় না। তাই মানুষের এঁটোকাঁটা, ব্যাঙ, মাছি, মশা, মরা সাপ – এসব খেয়েই থাকতে হয়। তা সেদিন রাত্রে পিড়িং তার প্রাত্যহিক খাবারের চৌররযবৃত্তিতে গিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়েছিল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, মানুষের বাচ্চাগুলো হাঁ করে একটা কালো বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। বাক্সটার ভিতরে আবার লোকজন চলাফেরা করছে, কথা বলছে। পিড়িংও খাবার চুরি ভুলে গিয়ে হাঁ করে দেখছিল। দেখে বাক্সটার মধ্যে একটা সবুজ ভূত লাল চোখে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের বাচ্চারা সব আতঙ্কিত। এমন সময় কোথা থেকে একটা ঝাঁটাচুলের লোক এসে কিসব অং, বং বলতে বলতে চারদিকে ঘুরতে লাগলো আর বাচ্চা ভূতটার দিকে কিসব দানা দানা জিনিস ছূঁড়তে লাগলো। দানাগুলো ভূতটার গায়ে লাগামাত্রই পিড়িং এর চোখের সামনেই বাচ্চা ভূতটা কেমন নির্জীব হয়ে গেল। আর ঝাঁটাচুলো লোকটা ভূতটাকে একটা বোতলে পুরে ফেলে বোতলের মুখটা আটকে দিল একটা ছিপি দিয়ে। তারপর একটা মানুষের বাচ্চা বোতলে পরা ভূতটাকে টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রাখলো। এসব দেখে শুনে পিড়িং এর চোখ গোলগোল, বুক ধরাস্ ধরাস্। পিড়িং বুঝলো ভূতে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, মানুষেরা এখন বোতলে ভূত পোষে। এসব দেখে পিড়িং মানা করেছে সিড়িঙকে নিম গাছের দশ হাতের চৌহদ্দি ছেড়ে কোথাও যেতে। একবার মানুষের কবলে পড়লে বোতলে পুরে রাখবে। কুকুর, বিড়াল, ছাগলের মত ভূতও পুষবে।
বসে বসে সিড়িঙ এসবই ভাবছিল। খিদেতে পেটের মধ্যে চুঁইচুঁই, কুঁইকুঁই। সিড়িঙের এখন এতো খিদে পেয়েছে যে গোটা দুই মানুষের বাচ্চা খেলে মনে হয় শান্তি হবে। সে তার কালো কালো সরু সরু প্যাংলা প্যাংলা পা দুটি নিয়ে ঝুপ্ করে নামলো গাছ থেকে। এখনও অন্ধকার দানা বাঁধেনি তেমন করে। জম্পেস করে চেপে বসেনি। কিন্তু সিড়িঙ মরীয়া। এখন খাবারের যোগাোড় না করলে মা নির্ঘাৎ সেই ব্যাঙাচি ভাজা নিয়েই ফিরবে। রোজ রোজ কাঁহাতক আর ব্যাঙাচি ভাজা খেতে ভালো লাগে!
খুব ভালো করে চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েই, এক পা এক পা করে সে এগোলো। নিমগাছ থেকেই সে গন্ধ পেয়েছে। রাস্তার ধারের ওই কোণের বাড়িতে আজ খিচুড়ি আর ডিমভাজা হয়েছে। অনেকদিন আগে, মা একবার চুরি করে এনেছিল। সেদিন মা আর ছেলেতে খুব মজা করে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেয়েছিল। সেই স্বাদ সে এখোনও ভোলেনি। কিন্তু খানিকটা এগিয়েই সে থমকে দাঁড়ালো। দশ হাতের চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার তার মানা আছে। তাই সে একটু ইতস্তত, বিচলিত বোধ করে। কিন্তু গন্ধটা এখন আরও ঘন, আরও তীব্র, আরও লোভনীয়। সিড়িঙ পা রাখলো ধীরে ধীরে। দশ হাতের চৌহদ্দির বাইরে।
সন্তর্পণে পা ফেলে সে এগোয়। বাতাস আজ হাল্কা। ভারী নয় মোটেও। সিড়িঙ ভাবলো আজ সে ভাসবে। হাঁটবে না। তার পাগুলো তো কাঠির মতো সরু, সুতোর মতো ট্যাংলা প্যাংলা! তার হাঁটতে তাই অসুবিধে হয়। বাতাস ভারী হলে, বাধা বেশী। তখন সিড়িঙের ভাসতে অসুবিধে হয়। তখন সিড়িঙকে তার প্যাংলা প্যাংলা সূতোর মতো পাগুলো দিয়ে হাঁটতে হয়। সে মজা করে ভাসতে ভাসতে আর চলতে পারে না। আজ বাতাস হাল্কা থাকাতে সিরিঙ ভেসে মজা পাচ্ছে। সিড়িঙের ভাসতে তাই অসুবিধে হচ্ছে না কোনও। ভাসতে ভাসতে যত সে বাড়িটার কাছাকাছি যাচ্ছে, ততোই গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সুরুৎ করে মুখে আসা জলটাকে সিড়িঙ গিলে ফেলে।
আস্তে আস্তে ভাসতে ভাসতে সে বাড়িটার একেবারে কাছাকাছি চলে এল। মার নিষেধের কথা ভুলে গেছে সে তখন। তার চোখের সামনে এখন শুধুই খিচুড়ি আর ডিমভাজা! সিড়িঙ বাড়িটার জানালা দিয়ে উঁকি দিল। সে জানে সে নিজে থেকে দেখা না দিলে তাকে দেখা যায় না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে এ বাড়ির ছোট ছেলেটি তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে খিচুড়ি আর ডিমভাজা। চাকুম্ চুকুম্, চাকুম্ চুকুম্। সলাৎ করে মুখে আসা জলটাকে টেনে নেয় সে আবার! আহ্। ব্যাঙাচি ভাজা আর খাবেই না সে আর!
সিড়িঙ তার শরীরটাকে পাতলা করে জানালা দিয়ে সুরুৎ করে ঢুকে পড়ে। খিদেতে পেটের মধ্যে চুঁইচুঁই, কুঁইকুঁই। সে ছোট ছেলেটির উল্টোদিকে তার ট্যাংলাম্যাংলা পাতলা পা দুটিকে ভাজ করে গুটিয়ে সুটিয়ে বসে। ছেলেটি টের পায় না। ভূতেদের তো আর দেখা যায় না, ইচ্ছে করে দেখা না দিলে! সিড়িঙ খেতে শুরু করে ছেলেটির পাত থেকে। সলাৎ। আহ্! কি স্বাদ! আবার নেয় সে। এবারে ছেলেটির খানিকটা যেন টনক নড়েছে। সে চোখ গোল গোল করে দেখে, সে খাওয়ার আগেই তার খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিড়িঙ ভাবলো ছেলেটি বোধহয় বেজায় ভয় পাচ্ছে। কিন্তু ভয় পাওয়া তো দূরের কথা! ছেলেটি চেঁচিয়ে তার মাকে ডাকছে। “মা, তাড়াতাড়ি এসো। আরেকটা ভূত এসেছে। শিগগীরী সর্ষেদানা আনো।“ সিড়িঙ ভাবে, আরেকটা ভূত মানে? এখানে কি খিচুড়ি, ডিমভাজার জন্য ভূতের মেলা বসে? ছেলেটির মা ছুটে আসেন, “কি হয়েছে বুবুন্?” বুবুন্ নামের ছেলেটি উত্তর না দিয়ে তার থালার দিকে মার দৄষ্টি আকর্ষণ করে। সিড়িঙের অবশ্য কোনও দৃকপাত্ নেই তাতে। সে গোগ্রাসে খাচ্ছে। বুবুনের মা ছুটে যান রান্না ঘরে। যখন ফিরে আসেন হাতে একটা ছোট বোতল। তাতে ছোট ছোট কালো কালো, গোল গোল দানা। এই বুঝি সর্ষেদানা? সিড়িঙ ভাবে মনে মনে। বুবুনের মা কৌটোটা খুলে ছড়িয়ে দিলেন বুবুনের থালার চারিপাশে। কয়েকটা দানা সিড়িঙের শরীরে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই সিড়িঙের সারা শরীর জবলতে লাগলো। সিড়িঙের খুব ঠান্ডা বোধ হতে থাকলো। সিড়িঙ গলে যেতে থাকলো। সিড়িঙ বুঝলো, ওই দানার মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে সিড়িঙ অদৃশ্যেও গলে যাচ্ছে। আর তখনি সিড়িঙের মনটা হু হু করে উঠলো তার মা পিড়িং এর জন্য। মার মানা ছিল। সে শোনেনি। সে বুঝলো সে মরে যাচ্ছে। মরে যাওয়ার আগে তার আর মার সঙ্গে দেখা হলো না।
মিলিয়ে যেতে যেতে, গলে যেতে যেতে, সে হঠাৎই উপলদ্ধি করলো তার জায়গা আর পরিবেশ বদল হয়ে গেছে। সে শুয়ে আছে একটা পুরু নরম সরম বিছানায়। তার মুখের ওপর আরো পাঁচটা মানুষের মুখ ঝুঁকে আছে। তাদের মধ্যে কেউ একজন বললো, “ও ময়না, এতো একদম তোর মুখ রে! আবার দেখ কেমন পিট্ পিট্ করে চাইছে।“ ময়না নামের মেয়েটি তার গাল দুটো জোরে চেপে ধরে চকাস্ করে একটা চুমু খেলো। সিড়িঙের তা খুব একটা মন্দ লাগলো না। সিরিঙ তার হাতটা বাড়িয়ে ময়নাকে ছূঁতে গেল ধীরে ধীরে। কিন্তু এ কি? এ তো আর ভূতের হাত নেই! ভূতের কালো সূতোর মতো হাত আর নয়। কেমন গোল, গোল, পুরুষ্টু। নধর, নধর হাত। এ তো পুরোপুরি মানুষের বাচ্চার হাত! আর তখনই হঠাৎ খুব পরিচিত গন্ধ নাকে এলো তার। এই গন্ধ সিড়িঙের খুব চেনা! খিচুড়ি, ডিমভাজা, আর আরও কিছুর। সিড়িঙের মুখে এক চিলতে পাতলা হাসি ফুটে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কে আবার বলে উঠলো, “ময়না রে! তোর মেয়ে তো জন্মেই হাসছে! এ কি পাকা মেয়ে রে!” ময়না নামের মেয়েটি আবারও সিড়িঙের দুই গাল চেপে চকাস্ চকাস্ করে আরো দুটো চুমু খেলো। কিন্তু সিড়িঙের ভাবনা এখন অন্যখানে! সে অপেক্ষায় আছে। খিচুড়ি ডিমভাজার জন্য। সে জানে তাকে একটু পরেই বুবুনের মতোই খিচুড়ি, ডিমভাজা দেবে তার নতুন মা, ময়না। আর সে তারিয়ে তারিয়ে খাবে। সিড়িঙের মন ভালোলাগায় ভরে উঠছিল। হঠাৎই তার চিন্তায় ছেদ পড়লো। ময়না নামের মেয়েটি কি একটা ঢুকিয়ে দিল তার মুখে! জিনিষটা খানিকটা লম্বাটে, সরু, স্বচ্ছ! তাতে সাদা রঙএর তরল পদাথ! কি বিচ্ছিরি খেতে! সেইসময় কে বললো, “ও ময়না রে! তোর মেয়ে দুধের বোতল বের করে দিল যে! ও খিচুড়ি ডিমভাজা খেতে চায়!” এতক্ষণে সিড়িঙের কান্না পেল খুব। এর থেকে তার ব্যাঙাচিভাজা অনেকই ভাল ছিল। হঠাৎই অনেকক্ষণ পর তার ভূত মা পিড়িং এর জন্য মন কেমন কেমন করে উঠলো। মানুষ মরে ভূত হয়, তা মানুষেরা জানে। কিন্তু ভূতেরাও যে মরে, মানুষের তা জানা নেই। আর তারা এটাও জানেনা, মানুষেরা কখনো যেমন জাতিস্মর হয়, ভূতেরাও কখনো কখনো মরে ভূতেস্মর হয়! সিড়িঙেরও ভূত জন্মের কথা খুব মনে আছে। চেনা গন্ধটা যতো তীব্র হচ্ছিল, পরিবেশটা ততোধিক্ অপরিচিত হয়ে উঠলো তার কাছে। হঠাৎ করেই সিড়িঙের কান্না পেল খুব। তার মা পিড়িং এর জন্য।
ঊর্মি ঘোষদস্তিদার (দত্তগুপ্ত)
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ঊর্মি ঘোষ দস্তিদার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ঘুম নেই হরিমোহনবাবুর
ঘুম নেই হরিমোহনবাবুর চোখে। সারা পাড়া ঘুমে কাদা। কেউ জেগে নেই। শুধু এইচ এম দে ছাড়া। হরিমোহন ঘড়ি দেখলেন, রাত একটা। তিনি বাথরুম গিয়ে চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা নিলেন। তারপর খোলা ছাদে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন যদি এতে করে ঘুম আসে। কিন্তু না ঘুম আর আসে ন।
সকালে তিনি ছুটলেন ডাক্তার পাকড়াশির কাছে। হরিমোহনকে দেখে ডাক্তারবাবু বললেন, কি হরিবাবু ওষুধে কাজ দিচ্ছে? নাকি মাত্রা একটু বাড়িয়ে দেব। হরিমোহনবাবু বললেন একটু নয় ডাক্তারবাবু বেশ কড়া ডোজ দিন। ওষুধে কোন কাজ দেয়নি। কালকেও সারারাত জেগে কাটিয়েছি। ডাক্তারবাবু হরিমোহনের নাড়ি টিপলেন, চোখ দেখলেন, জিভ দেখলেন। তারপর এক সপ্তহের কড়া ডোজ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। হরিমোহনবাবু বাড়ি ফিরে এলেন।
হরিমোহনবাবু সম্প্রতি কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। পাক্কা তেত্রিশ বছর অডিট সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত শুধু যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ-শতকরা এই নিয়ে ছিল তার কাজ কারবার। আয়ের সঙ্গে ব্যায়ের হিসেব মেলানো বড় সহজ কাজ নয়। দুটোর পাল্লা সমান করার লক্ষ্যে হরিমোহনকে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হত। সবই তিনি করতেন নিজের হাতে। পাশে রাখা ক্যালকুলেটার মেশিনটায় ঝড় উঠত। খট খট শব্দের কোন বিরাম ছিল না। বাঁধানো মোটা রেজিস্টারের প্রতি কলমে আলাদা আলাদা হিসেব। সেই হিসেব নেমে আসে পাতার একেবারে নীচে। সেই হিসেবর জের টেনে নিয়ে যেতে হয় অন্য পাতায়। এইভাবে জের টানার কোনো ইতি নেই। এক বছরের হিসেবের জের গিয়ে ওঠে নতুন বছরের রেজিস্টারে। অফিসের রেজিস্টার বদল হলেও হরিমোহনের চেয়ার বদল হয় না কোনদিন। রুটিন মাফিক কাজ করে যান তিনি। তবে তার ফাঁকে তিনি ঘন্টা দেড়েক সুন্দর ঘুমিয়ে নেন। সেই ঘুমের স্বাদই আলাদা। অনেকটা ভাত ঘুমের মত। ছুটি হলে বাসে বা ট্রেনে হাফ-ঘুম দিতে দিতে দিব্যি বাড়ি ফিরে আসেন। হাফ-ঘুম জিনিসটা বেশ মজার। হরিমোহনবাবু হয়তো বাসে বা ট্রেনে উঠে বসার জায়গা পেলেন না, তা বলে খামতি থাকবে কেন? বাসের রড ধরে চোখ বন্ধ করে আধো জেগে দোল খেতে খেতে সুন্দর করে ঘুমানো যায়। এটাই তার হাফ-ঘুম। ড্রাইভার কোন কারণে হঠাৎ ব্রেক কষলেও হরিমোহনবাবুর হাত রডের সঙ্গে সেঁটে থাকে। হাত কখনো ঘুমোয় না। বাড়ি ফিরে তিনি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। রাতের খাবার খেয়েউঠতে না উঠতে তাঁর ঘুম পেয়ে যায়। তো সেই হরিমোহনবাবুর আজ এ কি দশা! এত সুন্দর ফুলের মত নরম ঘুমটা তার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এটা কি কম কষ্টের!
ভগীরথবাবুর বাড়িতে প্রতিদিন যে দাবার আড্ডা বসে সেটা এ পাড়ার একটা মিনি ক্লাব। ভগীরথবাবুর রাঁধুনি কাম হেল্পার ধরণী সকাল থেকে স্টোভ জ্বলিয়ে আদা দিয়ে লাল চা সাপ্লাই করে যায়। প্রথম দাবার আসর বসে সকাল আটটায়। খেলা চলে সাড়ে নটা পর্যন্ত। যাঁরা দশটা পাঁচটা অফিস করেন তাঁরা এই খেলায় অংশ নেয়। এরপর ধাপে ধাপে খেলা চলতে থাকে। হরিমোহনবাবু আগে মাঝেমধ্যে এই মিনি ক্লাবে উঁকি-ঝুঁকি মেরে গেছেন কয়েকবার। তবে এক দান যে বসে খেলেন সে সময় পাননি। আজ ভাবলেন একবার ভগীরথবাবুর বাড়ি থেকে ঘুরেই আসি।
হরিমোহনবাবুকে দেখা মাত্রই সকলে হৈ - হৈ করতে করতে দলে নিয়ে নিল। তারাশঙ্করবাবু হরিমোহনের থেকে দ-বছর আগে রিটায়ার করেছেন।তিনি বললেন, কি ভায়া এরই মধ্যে চোখের নীচে কালসিটে পড়ে গেল যে! অফিসে পাতার পর পাতা যোগ বিয়োগ করেই তো জীবন কাটিয়ে দিলেন। এবার বেশ আয়েশ করে খান আর ঘুমোন। আর মাঝ্যেমধ্যে আমাদের দর্শন দিয়ে যান। তারাশঙ্করবাবুর এই 'ঘুমোন' শব্দটা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে গেল।
লাল চা খেতে খেতে এই 'ঘুম বৃত্তান্ত' বর্ণনা করতেই সকালে দাবার চাল ভুলে তাকে নিয়েই পড়লেন। ব্যানার্জীবাবু বললেন, এ আর নতুন কথা কি? চাকরি জীবনের ইতি টানা কি সহজ কথা। একটানা কয়েক হাজার মাইল ছুটে এসে ঝট্ করে দাঁড়ানো সহজ কাজ নয়। তা একটু সময় লাগবে বৈকি। ঘুমের ব্যপার স্যাপার বোঝা অত সহজ নয়। তাকে যতই পায়ে ধরে সাধবেন ততই দূরে দূরে সরে যাবে। তার চেয়ে আমি বলি কি, একটা ফুলের বাগান করুন। মাটি কোপান, চারা বসান। বাগানের পরিচর্যা করুন। এতে শরীর ও মন দুইই ভালো থাকবে। আর মন ভালো থাকলে ঘুম যাবে কোথায়? সেও সুড় সুড় করে এসে হাজির হবে।
প্রণবেশ ভটচায একটু সেকেলে মানুষ। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় তাঁর ভরসা নেই। সব রোগের তিনি কবিরাজি ঔষধ-পথ্যের পথ বাতলে দেন। ব্যানার্জীবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন, ঘুম আছে। ঘুম আপনার কাছে পিঠেই ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। বায়ু-পিত্ত-কফ এই তিন প্রকার জিনিসের মধ্যে বায়ু যখন কুপিত হয় তখনই এই ঘুমের ব্যঘাত হয়। বায়ু ঘুমকে কাছে ঘেঁষতে দেয়না। এর দাওয়ই হল ভোরে উঠে ত্রিফলার জল খেয়ে এক ঘন্টা পরে এক চামচ মধু ও তুলসী পাতার রস সেবন করে থান্ডা জলে স্নান করবেন। তিন দিন পরে নিদ্রাদেবী হাজির হবেন।
বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় শৈলেন দাসের সঙ্গে দেখা। কি ভাবে যেন তাঁর ঘুম-কাহিনি তিনিও জেনে গেছেন। হরিমোহনকে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা ধরিয়ে বললেন, ঘুমের সাথে মাথায় টাক পড়ার একটা সম্পর্ক আছে মাশাই। চুল একটা করে ঝরতে শুরু করলে দুশ্চিন্তায় ঘুম চলে যায়। তখন কেউ যদি বলেন মাথায় টাক পড়েছে কেন? তখন হয় বলতে হবে রাতে ঘুম হচ্ছেনা বলেই টাক পড়ছে অথবা টাক পড়ছে সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছেনা। শৈলেনবাবুর কথা শুনে হরিমোহনের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল। তিনি মাথায় একবার হাত বুলিয়ে অবশ্য অনেকটা নিশিন্ত হলেন, কেননা টাক জিনিসটা এখনো তাঁকে দর্শন দেয়নি।
বাড়িতে বসেও কি রেহাই আছে। পাড়া-প্রতিবাশীরা ঘরে এসে ঝুড়ি ঝুড়ি উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। কি করতে হবে আর কি করা চলবেনা। তার লম্বা ফিরিস্তি শুনিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে ভাত খেয়ে যেই একটু নিদ্রা দেবীর আরাধনায় বসবেন অমনি ভুপেন চক্কোতি এসে হাজির। বললেন, কি হে হরিমোহন, তুমি কি দিবা-নিদ্রার আয়োজন করছো নাকি? ভুলেও ও পথে যেও না যেন। তাহলে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারবেনা। তারচে সারাদিন হাওয়া খেয়ে আর গল্প গুজব করে কাটানই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এই সব উপদেশ শুনে হরিমোহনবাবুর কান পচে গেছে। তিনি আর পেরে উঠছেন না। এরপর যেদিকে দু-চোখ যায় তিনি চলে যাবেন। তার ঘুম হচ্ছে না বলে পাড়া পড়শিদেরও ঘুম হচ্ছেনা এমন তো নয়। তারা তো বেশ খাচ্ছে দাচ্ছে, হরিমোহনকে দেখতে পেলেই ঘুম-বিষয়ক বিস্তর আলোচনায় ডুবে যাচ্ছে আর রাতে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে।
তো হরিমোহনবাবু সত্যি চললেন। কোথায় চলেছেন নিজেও জানেননা। লোকালয় ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে ছোট্ট একটা নদী। নদীর উপর বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা সাঁকো। হরিমোহন সাঁকোটা পেরিয়ে গেলেন। তারপর একটা গাছের নীচে বসে পড়লেন। সূর্য্য অনেকখানি পশ্চিমে ঢলেছে। বকের ঝাঁক ইংরাজির 'ভি' আকার নিয়ে পূব দিকে উড়ে যাচ্ছে। এক একটা ঝাঁকে অনেকগুলো করে বক থাকছে। রোদ পেয়ে বকের ডানা ঝিকমিক করে উঠছে। হরিমোহন প্রতিটি ঝাঁকে মোট ক-টি বক থাকছে তার হিসেব করতে লাগলেন। প্রথম ঝাঁকে মোট চৌদ্দটা বক ছিল। ঝাঁকটা দূরে মিলিয়ে যেতেই আবার এক ঝাঁক বক উড়ে এল। তিনি দ্রুত গতিতে গুনতে লাগলেন এক-দুই-তিন। মোট এগারোটি। চৌদ্দ আর এগারোর যোগ করলেন মোট পঁচিশ। যোগটা শেষ করতে না করতেই এক সঙ্গে দু-ঝাঁক বক হাজির। এই বুঝি হিসেবে ভুল হয়ে গেল। কিন্তু না, তিনি চোখ চালিয়ে সব কটাকে পাকড়াও করলেন। একটাও পালাতে পারল না। তারপর পঁচিশের সঙ্গে যোগ করে মোট বকের সংখ্যা কত হল তার হিসেব কষতে না কষতেই তাঁর মস্ত একটা হাই উঠল। তবে হাইটা তাঁর নিজের হলেও তিনি সেটা খেয়াল করলেননা। পঁচিশের পাঁচ আর উনিশের নয় যোগ করলে ডান দিকে বসল চার আর হাতে থাকে এক...। ব্যাস অঙ্কের দাওয়াই সোজা ধাক্কা মারল হরিমোহনের ব্রহ্ম তালুতে। মগজ থেকে ঘুমের বার্তা এসে গেল দ-চোখের পাতায়। তিনি ঘাড় কাত করে ঘুমে কাত হয়ে পড়লেন। ঠিক যেমনটি এতদিন অফিসের চেয়ারে বসে ঘন্টা দেড়েক সুখ-নিদ্রায় মগ্ন হয়ে যেতেন তেমনটি। হরিমোহনের মাথার উপর দিয়ে অনেক বক উড়ে যাচ্ছিল। তবে সে সবের হিসেব রাখার মত আর কেউ ছিল না।
তরুণ কুমার সরখেল
আমডিহা, পুরুলিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তরুণ কুমার সরখেল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প