সাত ইঁদুর কন্যার কাহিনী
গল্প-কথকঃ শুক্তি দত্ত
অনে—ক দিন আগের কথা, সে কত্তো—দিন আজ আর মনে নেই। জার্মানির এক গ্রামে এক বিধবা মহিলা তার সাতটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। এই মেয়েরা সকলেই এক রকম পোষাক পড়ত। উজ্জ্বল ছাপার জামা, তার ওপর কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন ও মাথায় টুকটুকে লাল রঙের ছোটো টুপি – এই ছিল সাত বোনের পোষাক। চকচকে সুন্দর চুলগুলিকে পরিষ্কার একটা বেণীতে বেঁধে এই রকম পোষাক পরে তাদের ভারী সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন দেখাত।
একবার এক গুড-ফ্রাইডে’র দিনে মেয়েদের মা তাদের একলা বাড়ীতে রেখে কাছের এক গির্জাতে গেলেন কাজ করতে। যাবার আগে সাত বোনকে সাবধান করে গেলেন, “শোনো মেয়েরা, বাড়ী ফিরে যেন না দেখি কোন দুষ্টুমি করেছ। আর খবরদার, উনুনের পিছন দিকের ঘরে উঁকি মারবে না।”
মা চলে গেছেন অনেকক্ষণ হল। খালি বাড়িতে বাচ্চারা গোল হয়ে বসে তাদের বড় দিদির কাছে গল্প শুনছিল। তারপর তারা একসঙ্গে গান করল, খানিকক্ষণ খেলল; কিন্তু সময় যেন আর কাটেনা। “উঃ, মা তো আসছে না, কি যে করি!” জাতীয় কথা শুরু হল। “হ্যাঁরে মা কেন উনুনের পিছনের ঘরে তাকাতে বারণ করল রে? এই, চুপ করে বসে থাক, এসব কথা একদম নয়। সত্যিই তো ওখানে কি আছে রে?” – এরকম নানা কথা তাদের মধ্যে ঘুরতে লাগল, আর ক্রমশই তারা আরো অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। কৌতূহল আর বাধা মানে না।
শেষ পর্যন্ত তারা আর নিজেদের সামলাতে পারল না। একজন গিয়ে পিছনের ঘরটাতে চুপি দিল। “ওরে, এখানে না একটা ঝোলা রয়েছে,” সে সবাইকে বলল। তার পিছনে আরেকজন উঁকি দিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা দেয়ালে একটা পেরেক থেকে ঝুলছে।” ব্যস, বাকিদের আর আটকানো গেল না। মা’র বারণ ভুলে সবাই হুড়মুড় করে বাকি পাঁচজনই ঢুকে পড়ল সেই ঘরে।
ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে তারা ঝোলাটাকে খোঁচা দিয়ে বুঝতে চাইল ভিতরে কি আছে। প্রতি মুহূর্তেই তাদের কৌতূহল এত বাড়ছিল যে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মেয়েটি ঝোলাটাকে দেয়াল থেকে নামিয়েই ফেলল। সাত জোড়া ছোট্ট হাত ঝটিতি ঝোলার বাঁধন খুলে ফেলল; বের করে আনল একটা খয়েরী কাগজের মোড়ক, তাতে ভর্তি বাদাম আর আপেল। আসলে তাদের মা সামনের ঈস্টারের ভোজে খাবার তৈরী করার জন্য এগুলি জমাচ্ছিলেন।
সাতটা ছোট মেয়ে মেঝের উপর গোল হয়ে বসে পেট পুরে বাদাম আর আপেল খেয়েছে। মা ফিরে দেখলেন মেয়েরা শান্ত হয়ে চুপ করে বসে আছে, আর তাদের সামনে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে বাদামের খোলা আর আপেলের খোসা। খালি ঝোলাটা দেয়ালের গায়ে পেরেক থেকে তেমনি ঝুলছে।
রাগে দুঃখে মা চীৎকার করে উঠলেন। ভুলে গেলেন যে পবিত্র দিনগুলিতে কোন কিছু হঠাৎ বলে ফেলা উচিত নয়। “ওরে নচ্ছার মেয়েরা, ইঁদুরের মত ছিঁচকে চোরের স্বভাব তোদের। তোরা তাই হলিনা কেন?” যেই না এ কথা বলা, উজ্জ্বল ছাপার জামা পরা, তার উপর কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন লাগানো, বিনুনী করা চুলে ছোট্ট লাল টুপি পরা সাতটা ছোট মেয়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সাতটা নেংটি ইঁদুর হয়ে গেল। প্রত্যেকটা ইঁদুরের পিঠটা উজ্জ্বল রঙের, পেটের কাছে বড় সাদা দাগ আর মাথার উপর লাল টুকটুকে ছোট দাগ।
বেচারা মা এই দেখে দুঃখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি একদৃষ্টে ইঁদুরছানাগুলিকে দেখতে লাগলেন। তারাও সব ভুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। দুঃখে মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কতক্ষণ যে তাঁরা এইভাবে ছিলেন বলা যায় না। ইতিমধ্যে একজন পড়শী এসে দরজায় ঠক্ঠক্ করে তাদের ডাকছিলেন। কিন্তু কেউই দরজা খুলছিল না দেখে দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে তিনি ভিতরে উঁকি মারলেন। যেই না উঁকি দেওয়া, অমনি সাতটা ইঁদুর একে একে ফুড়ুৎ করে বাড়ির বাইরে দৌড়ে পালাল। গাঁয়ের পথ দিয়ে, মাঠের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা একটা ছোট বনের ভিতর ঢুকে পড়ল। থামল এসে একটা পুকুরের ধারে। তাদের পিছনে দৌড়ে আসছিলেন তাদের মা। তিনিও এসে পৌঁছলেন সেখানে। সাত ইঁদুর তাদের মায়ের মুখের দিকে একবার দেখল, তারপর একে একে সেই পুকুরে ঝাঁপ দিল।
মা এই দৃশ্যটা চুপ করে দেখলেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি সেই পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, একটুও নড়লেন না। আস্তে আস্তে মা এক পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলেন। এর পর বনের ভিতর দিয়ে যাবার সময় যে কেউ সেই পুকুরের পাড়ে আসত, দেখতে পেত পাষাণপ্রতিমা মা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ কেউ বলে যে, মধ্যরাতে যখন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, তখন তারা দেখেছে সাতটা ছোট ইঁদুর এক এক করে জল থেকে উঠে আসে আর চাঁদের আলোয় সেই পাষাণমূর্তি মায়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে।
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ছোট্ট সোনারা বলোতো, এইরকম দুঃখের মধ্য দিয়ে গল্প শেষ হলে কি মন ভাল লাগে? তাই ভাবছি, শেষের ঘটনাটাও তোমাদের জানিয়ে দিই। একদিন এক মহিলা সেই বনের পথে সাত ছেলেকে নিয়ে যাবার সময় ক্লান্ত হয়ে পুকুরপাড়ে বসলেন। ছেলেদের বয়স সেই সাতটি মেয়ের থেকে একটু হয়তো বড়। পুকুরের পাশে মূর্তিটি দেখে কিছু না ভেবেই ছেলেদের মা তার গায়ে যেই না হাত দিয়েছেন, অমনি কী আশ্চর্য! মূর্তিটা নড়ে উঠল, চোখে পলক পড়ল আর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মূর্তিটা সজীব হয়ে গেল।
ভয় পেয়ে ছেলেদের মা দু-পা পিছিয়ে এলেন। তারপর সব কথা ধীরে ধীরে শুনলেন। এদিকে আরেকটি ঘটনা ঘটল। মা যেই পাথর থেকে মানুষ হলেন, অমনি পুকুরের ভিতর থেকে সাত ইঁদুর একে একে উপরে উঠে এল। ইঁদুরের খোলস থেকে বেরিয়ে এল সাতটি ফুটফুটে মেয়ে – পরণে উজ্জ্বল ছাপার জামা, জামার উপরে কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন আর মাথায় টুকটুকে লাল রঙের ছোট্ট টুপি। সবার মনেই খুশীর হাওয়া। প্রত্যেকটা মেয়ের সঙ্গে একটি করে ছেলের বিয়ে হল। তারা জোড়ায় জোড়ায় সেখান থেকে রওনা হল। পিছনে চললেন দুই মা।
(জার্মানীর উপকথা থেকে)
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শুক্তি দত্ত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
সন্দেশ
এবারের বই পোকার দপ্তরে আলোচনা হবে কোন বই নিয়ে জান? এই বইয়ের নাম -'সন্দেশ'!
তুমি কি 'সন্দেশ' এর নাম শুনেছ? বা 'সন্দেশ' পড়েছ? যদি শুনে থাক, তবে খুব ভাল। আর না শুনে থাকলে বলি, 'সন্দেশ' হল 'ছেলেমেয়েদের জন্য সচিত্র মাসিক পত্র'। প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৩২০ (১৯১৩) সালে। মানে ঠিক ১০০ বছর আগে। আর সেই পত্রিকা শুরু করেছিলেন কে জান? -উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এই বছর তাঁর জন্মের ১৫০ বছর পালিত হচ্ছে। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন একাধারে শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক, চিত্রকর, অলংকরণ শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ এবং মুদ্রন শিল্প বিশারদ।
১৯১৩ সাল থেকে প্রকাশিত সেই পত্রিকায় থাকত ছড়া, গল্প, পুরাণ, আবিষ্কারের গল্প, লোক কথা...উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা আর লেখায় ভরা সন্দেশের প্রতিটা সংখ্যায় ছিল বিপুল জনপ্রিয়। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সন্দেশ পত্রিকার ভার হাতে নেন তাঁর পুত্র সুকুমার রায়। তাঁর অকাল মৃত্যুর পরে সেই পত্রিকা কিছুদিন বন্ধ থাকে। অনেক পরে আবার সন্দেশ প্রকাশিত হতে থাকে সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার এবং নলিনী দাশের হাত ধরে। কিছুদিন আগে অবধিও সন্দেশ নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। এই মূহুর্তে খুব সম্ভবতঃ মাসিক সন্দেশ আর প্রকাশিত হয় না।
পারুল প্রকাশনী প্রকাশ করেছে সন্দেশের প্রথম বর্ষের সবকটি সংখ্যাকে একত্র করে এক অখন্ড সংস্করণ। এই বইতে আছে ১৩২০ সালের বৈশাখ থেকে চৈত্র অবধি প্রকাশ হওয়া সবকটি সংখ্যা। রয়েছে উপেন্দ্রকিশোরের নিজের হাতে আঁকা ছবি। আর সাথে রয়েছে বিনামূল্যে একটা সিডি, যাতে রয়েছে প্রদীপ ঘোষের কন্ঠে ১৮টি নির্বাচিত কবিতা ও গল্প পাঠ।
এর থেকে ভাল আর কি হতে পারে , তাই না?
এই বইয়ের দাম ৪০০ টাকা।
বইপোকা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন বইপোকা
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মেঘ বৃষ্টির দেশে-পর্ব ৩
সিরাজুল,
সুন্দর বনের গন্ধ মেখে একটা নীল খামের চিঠি আমার পড়ার টেবিলে অপেক্ষা করছে। এখোনো আমি হাত দিয়ে ধরিনি পর্যন্ত চিঠিটাকে। কারণ আমি জানি ওই চিঠিতে আছে আমার সিরাজুল, আনন্দী, আর পাখিরালার অনেকের অনেক অনেক গল্প। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে মাঝে মাঝে এমন সারপ্রাইজ পেতে বেশ ভালো লাগে আমার। দিনের শেষ ডানকুনি লোকালে ফিরছি যখন, ঝিরঝরে বৃষ্টি জানলার মধ্যে দিয়ে এসে আমার কপাল...চুল...মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর আমি যেন চোখ বুঁজে দেখতে পাচ্ছি অনেক রাতের সেই হরিণভাঙা নদীটাকে। আমি যেন কান পাতলে শুনতে পাচ্ছি গফুর চাচার নামাজ পড়া। আমি যেন শুনতে পাচ্ছি চাচি তালের বড়া ভাজতে ভাজতে গুনগুন করে গান গাইছেন। জানি, এইসব কথা বলে তোমার রাগ বাড়ছে বই কমছে না। অনেকদিন যে যাওয়া হয়না ওই পথে। অনেক দিন আনন্দীর সাথে পুকুরে নেমে তুলি না কলমী শাক। কিম্বা তোমার আর পান্তুর সাথে ছোট ডিঙি বেয়ে যাওয়া হয়নি অনেক দিন ছোট ছোট লাল কাঁকড়ার ডেরায়। আচ্ছা এবার আর প্রমিস করবো না। এক্কেবারে তোমার বাড়ির সামনে ভ্যান থেকে নেমে পড়ে হাঁক-ডাক দেবো। সারপ্রাইজ দেবো তোমাকে সিরাজুল। এবার খুশি তো? লীলা মজুমদারের রচনাবলী পড়ছো শুনে খুশি হলাম। শেষ হলে জানিও। দ্বিতীয় খন্ডটা যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো। আচ্ছা রহিম কী এখোনো রাতের আঁধারে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় ভূতের গল্প বলে? ওকে বোলো সব গল্প জমিয়ে রাখতে সারা রাত ধরে আমরা শুধু নৌকা বাইবো আর ভূতের গল্প শুনবো সিরাজুল।
মেঘালয়ের গল্প শুনতে শুনতে তুমি আর আনন্দী যে ছবি গুলো এঁকেছো সেগুলো যখন তোমার বাড়ি যাবো তখনি দেখবো। চুপি চুপি বলি কিছু ছবি চাঁদের বুড়ির জন্য তুলে রেখো কিন্তু। বুড়ির আবার ছবি জমানোর নেশা আছে ভারী। ও জানতে চাইছো, সেই ছবি দিয়ে বুড়ি কী করে? এমা তুমি জানো না? সেই ছবি চাঁদের বুড়ি ইচ্ছামতীর জলে ভেলা করে ভাসিয়ে দেয়। আর ঠিক তোমার আর আনন্দীর মতো অনেকে সেই ছবি দেখে। মজা পায়। ঠিক আছে বাবা...বুঝতে পেরেছি। আমার বকবকে তুমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছো তো? কিন্তু এক্ষুনি তোমাকে যাদের ছবি দেখাবো, তাদের দেখলে তোমার বেশ আনন্দই হবে। হাতে ফুল নেওয়া এই পুঁচকে দুটোকে আমি দেখতে পাই চেরাপুঞ্জির রাস্তায়। ওদের কাজ ফুল বিক্রি করা। আর সেই টাকায় মা-বাবাকে ওরা কিনে দেয় চাল, আলু, ডিম। তাই বলে ভেবো না ওরা স্কুলে যায় না। পড়াশুনো করে না। এমনি করেই সারাদিন ফুল বিক্রি করে। মোটেই না। সকালের স্কুলে ভাত দেয়, ডাল দেয়, কখোনো কখোনো ওরা খেতে পায় স্কোয়াশের তরকারী। তারপর রাস্তার ধারে ফুটে থাকা ঘাস ফুল তুলতে যায় সবাই মিলে। সেই ঘাসফুল ছোট ছোট বান্ডিল করে ওরা বিক্রি করে।
হ্যাঁ ঠিক বলেছো...পুরুলিয়ার অনিল শবর যেমন বিক্রি করে ঘাসের বানানো নৌকা, কুচবিহারের আন্দু রাভা যেমন বিক্রি করে সুপারীর খোসা দিয়ে তৈরী মুখোশ ঝাড়গ্রামের সোনালী হেমব্রম যেমন বিক্রি করে পিঁপড়েদের ফেলে যাওয়া বাসা ঠিক তেমনি এরা ফুল বিক্রি করে। আমিও ওদের কাছ থেকে অনেক অনেক ফুল কিনে গাড়ির সামনে আমার বসার জায়গায় রেখে দিলাম। ওদের কথা খুব একটা বুঝতে পারিনি সিরাজুল। ভাঙা হিন্দিতে কি আর অনেকক্ষণ গল্প করা যায়? ওদিকে আকাশে যে মেঘ করে আসছে। আর আমার ড্রাইভার বন্ধু বাপী তাড়া দিচ্ছে প্রচন্ড। এরপর যেখানে গেলাম সেটা তুমি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। পাহাড়ী ঝরনার তীব্রতা যে কি...তুমি যখন এখানে আসবে নিজেই জানতে পারবে।
দেখলাম অনেক স্কুল আর কলেজের ছেলে মেয়েরা এসেছে। মজা করছে। তাদের মধ্যে দুজনকে তো আমার মেক্সিকোর কাউবয়ের মতো মনে হলো। ওরা নিজেরাই ডাকলো আমাকে। আমার হাতে ক্যামেরা দেখে খুব শখ হলো ছবি তোলার। আমি ওদের ছবি তুলে দিলাম। শুনলাম পাশের কোন এক কলেজ থেকে এডুকেশানাল ট্যুরে এসেছে।
যাইহোক। এবার এই ছবিটা দেখো। এটা কী তোমার ব্রিজ বলে মনে হচ্ছে সিরাজুল? ঠিক ধরেছো...এটা গাছের শিকড় দিয়ে তৈরী করা একটা ব্রিজ। আপনা থেকেই এমন হয়ে গেছে। অনেক দূর থেকে মানুষরা এখানে আসে এই প্রাকৃতিক উপায়ে নির্মিত ব্রিজটা দেখতে।
আরে আরে দাঁড়াও দাঁড়াও...অত হড়বড় করলে হয়? আনারস দেখে থমকে দাঁড়াতেই হলো সিরাজুল।
এরা সবাই ট্যুরিস্টদের আনারস বিক্রি করে। জঙ্গলের আনারস, আর মধু খেয়ে আমরা ফিরলাম হোটেলে।
মন খারাপ সিরাজুল। বিকেলের উড়োজাহাজে ফিরতে হবে কলকাতা। আর ফিরেই তোমাকে একটা বড় চিঠি লিখতে হবে। তোমার পাঠানো সহজ পাঠের কবিতাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। প্লেনে উঠে, জানলার ধারে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর মেঘ দেখতে দেখতে সেই কবিতাটার কথাই ভাবছিলাম।
"কত দিন ভাবে ফুল/ উড়ে যাবে কবে/ যেথা খুশি সেথা যাবে/ভারী মজা হবে/ তাই ফুল একদিন মেলে দিল ডানা/ প্রজাপতি হল তারে/ কে করিবে মানা..."। আমাকে কেউ এখন আর মানা করে না সিরাজুল কোনো কিছুর জন্য। আমি এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে বেড়াই। আর যখন খুব মন কেমন করে তখন ফিরে আসি উত্তরপাড়ার খেয়াঘাটে। লিখতে বসি তোমাকে একটা বড় চিঠি। আর ঠিক তখনি কোথা থেকে পাল তোলা নৌকা করে মন কেমনেরা পালিয়ে যায় দূর দেশে। অনেকদিন তাদের আর খোঁজও পাই না। খুব ভালো থেকো সিরাজুল। এবারে রহিমচাচার তাল পাটালী খেয়ে কেমন লাগলো জানিও। আর একটা লম্বা চিঠি লিখো। আবার যেন অনেক রাতে বাড়ি ফিরে আমি আমার পড়ার টেবিলে সোঁদা মাটির নোনা গন্ধ পাই তোমার হাতের লেখায়। তোমার মিষ্টি করে লেখা চিঠিতে। অনেক ভালোবাসা।
লেখা ও ছবিঃ
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া খেয়াঘাট, হুগলী।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
আমের আচার, কালবৈশাখী আর মোরগ লড়াই...
ভাবছ, এ কিরকম নাম এই লেখার? আমের আচারের সাথে মোরগ লড়াই-এর কি সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে। এইরকম আরো অনেকগুলি শব্দ বলতে পারি পরপর - জামরুল, লেড়োবিস্কুট, রেল-কাম-ঝমাঝম, মনিপিসি...
আসলে এই সব শব্দগুলি জড়িয়ে আছে আমার ছোটবেলার গ্রীষ্মের ছুটির সাথে। গরমের ছুটি বা সামার ভেকেশন বললেই এই সব স্মৃতিগুলি ফিরে ফিরে আসে। আজকে সেই সব গল্প, একটু, একটু, তোমার সাথেঃ
কালবৈশাখীঃ গরম পড়বে, আর কালবৈশাখী হবে না তা কি হয়? আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন এইরকম করে গরমে ঘামতে ঘামতে আকাশের দিকে তাকিয়ে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হত না, যে কবে একটা কালবৈশাখী হবে। নিয়মিত ভাবেই দুই -তিন দিন পর পরই বিকেলের দিকে আকাশ কালো করে এসে, হাঁক-ডাক করে, জল-টল ঢেলে ঠাণ্ডা করে দিয়ে যেত। তার পরে বিকেলটা কি সুন্দর হয়ে যেত। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, তাপমাত্রা কমে গেছে, পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার সাত রঙে আকাশ পুরো রঙিন। গাছের পাতা থেকে জল ঝরছে টুপটাপ, বেল-যুঁই-মাধবীলতারা বৃষ্টিতে স্নান সেরে হাল্কা সুগন্ধ বিলোতে শুরু করেছে। রাস্তা ঘাট ভিজে গেছে, সেই ভেজা রাস্তা ছেয়ে আছে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া - রাধাচূড়া-জারুলে। আমার ছোটবেলা কেটেছে লাল মাটির দেশে, তাই বলতে বাধ্যই হচ্ছি, কলকাতা, বা বলা চলে এঁটেল মাটির দেশের মত বৃষ্টি হলেই কালো ঘোলা জলে রাস্তা ভরে যেত না, অথবা, জামাকাপড়ে কাদার বিচ্ছিরি দাগ লাগত না।
মোরগ লড়াইঃ কালবৈশাখীর কথা বললে মোরগ লড়াইটা বলতেই হয়! এটা মোটেও সত্যিকারের মোরগ লড়াই ছিল না। ঝড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে খসে পড়ত অনেক ফুল, এবং আধফোটা কুঁড়ি। এই আধফোটা কুঁড়ি গুলিকে খুব সাবধানে খুললে, পাওয়া যেতে একগোছা পরাগদন্ড। তার মাথায় ছোট্ট দানার মত একটা আবরণ, যার মধ্যে আছে পরাগ। এই পরাগদন্ড দুই আঙুলে তুলে নিয়ে , দুই বন্ধুতে চেষ্টা করা হত, কে আগে অন্যের পরাগধানীটা ছিঁড়ে দিতে পারে। এ ছিল আমাদের নিরীহ, নির্ভেজাল, রক্তপাতহীন মোরগ লড়াই।
আমের আচারঃ গ্রীষ্মের ছুটি হবে, আর আমের আচার হবে না, এ তো হয় না! কাজেই গ্রীষ্মের ছুটি মানেই বাড়িতে গুড়েপাক দিয়ে আমের আচার তৈরি হত। মা তৈরি করতেন। সেই আচার আবার চুরি করে না খেলে কোন আনন্দই নেই। মানে, দুপুরের খাওয়ার সময়ে শেষ পাতে দেওয়া হল ঠিকই, কিন্তু মন ভরল না। তাই, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, শেষ বিকেলে উঠে, চুপিসারে রান্নাঘরে গিয়ে বেশ খানিকটা আচার চেটে চেটে খেতে না পারলে তো গ্রীষ্মের ছুটির কোন মানেই হয় না!
রেল-কাম-ঝমাঝমঃ গরমের ছুটি মানেই ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে দাদু-ঠাকুমা- কাকা-পিসিদের সাথে দেখা করতে চন্দননগর চলে যাওয়া। গরমের দুপুরে, ঠা-ঠা- রোদ্দুরে, ট্রেনের জেনারেল কামরায় বসে, ঘামে ভিজতে ভিজতে সেই যাত্রার মজাই আলাদা। যেতে যতটুকু কষ্ট, একবার গিয়ে পড়তে পারলেই- ব্যস - বাবার বকাবকি নেই, এন্তার আদর , আর সারাদিন খেলাধুলা করার অফুরন্ত সুযোগ। পড়ার বই সাথে থাকত বটে, তবে সে ওই নামেই... আর হ্যাঁ, এই রেলযাত্রার বেশ কিছুটা পথ আমরা যেতাম স্টিম ইঞ্জিনে টানা রেলগাড়ি চেপে। এখন বাষ্পচালিত স্টিম ইঞ্জিন আর প্রায় দেখাই যায় না। এক চলে দার্জিলিং এর টয় ট্রেন। আর হয়ত চলতে পারে কোন দূর গ্রামাঞ্চলের পথে, সে আমি ঠিক জানি না। আমি জানি, তুমি স্টিম ইঞ্জিনের ছবি দেখেছ, হয় কোন মিউজিয়ামে গোটা একটা স্টিম ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখেছ, কিন্তু, সেই ঘসঘস আওয়াজ করতে করতে, কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে চলা , আর পোড়া কয়লার সেই অদ্ভূত এক গন্ধ...ইঞ্জিনের কাছাকাছি কামরায় বসলে চোখে কয়লার গুঁড়ো এসে পড়া...এইসবের অভিজ্ঞতা মনে হয় হয়নি, তাই না?
জামরুলঃ চন্দননগরের বাড়ির একটা বিশাল বাগান ছিল। সেখানে একটা বড় জামরুল গাছ ছিল। তাতে গরমের সময়ে থোপা থোপা সাদা সাদা জামরুল হত। সেই জামরুল কি মিষ্টি। পাড়ার ছেলেরা চুরি করে নিয়ে যেত কত, তাই জামরুল শেষ হত না। আর জামরুল খাওয়াও শেষ হত না।
লেড়োবিস্কুটঃ বিকেলবেলা সবাই মিলে গোল হয়ে বসে চা খেতাম। আমরা ছোট ছিলাম, তাই আমাদের ভাই বোনেদের ছোট ছোট চায়ের কাপ ছিল। চায়ের সাথে দারুণ লাগত খেতে কড়মড়ে লেড়ো বিস্কুট। ভাবছ লেড়ো বিস্কুট কি? আজকের দিনে সুন্দর প্যাকেটে মোড়া 'রাস্ক' বিস্কুটই হল আমাদের সেই ছোট বেলার লেড়ো বিস্কুট।
মনিপিসিঃ আমার গরমের ছুটি মানেই মনিপিসি। আমার সব থেকে ছোট পিসি। আমার থেকে বছর ছয়-সাতেকের বড়। সে ছিল গ্রীষ্মের ছুটির সব থেকে বড় আকর্ষণ। আমার পুতুল খেলার , রান্নাবাটির সাথী। রোজ সকালে এক ঝুড়ি খেলনার হাঁড়ি-কড়াই নিয়ে আমার সাথে খেলতে বসত। মনিপিসিও তখন স্কুলে পড়ত। তাই তার স্কুলেও গরমের ছুটি। তাই আমাদের দুজনের এক সাথে খেলায় কেউ বাধা দিত না।
তুমি বলবে - বড়রা খালি বলে - "আমাদের সময়ে সব কিছু ভাল ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি ..." আসল কথাটা হল, বড়রা যতই বড় হোক না কেন, তারাও আসলে মনে মনে ছোটবেলাটাকে ভুলতে চায় না। তাই তারা ফিরে ফিরে যায় ছোটবেলার গল্পে। এই যেমন আমি ফিরে গেলাম আমার ছোটবেলার গল্পে।
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
ছবিঃ
প্রকৃতি গুপ্ত
ষষ্ঠ শ্রেণী
অক্সিলিয়াম কনভেন্ট, ব্যান্ডেল, হুগলি
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মজার পাতা
মজার পাতা:
বলো তো দেখি কী—
১. অন্তহীনে দেখি সেথা, ধানের বসত,
মধ্যহীনে জাতি এক, তিনে সুরভিত।
নাম খুঁজে দেখ দেখি, কি তা’র বাহার,
অর্থহীন পুষ্পগুচ্ছ বিহনে যাহার।।
২. খেচর বলিয়া জানে, সবে তিন অক্ষরে,
পেট কেটে দিলে আশা, থাকিবার করে।
দেখিতে নিকষবর্ণ, নিত্য দেখা মেলে
ভেবেচিন্তে নাম তা’র, ফেল ভাই বলে।।
৩. তিনটি অক্ষরে খ্যাত, মিষ্টান্ন মাঝারে, .
অন্তহীনে দেখি শ্রেষ্ঠ, বিবাহ বাসরে।
পরিচিত রূপ তার, অনেকেই চায়,
তাড়াতাড়ি নাম তুমি, বলতো আমায়।।
৪, দেখা তা’র মেলে, কেহ মনোকষ্ট পেলে,
গোলাপের মাঝে দেখ, যা’র মধ্য মেলে।
জয়হীন হয়, যদি বিজয়ের কালে,
ধাঁধা কি কঠিন কিছু, সংকেত মানিলে?
৫. মাঝের অক্ষর ছেড়ে, জলাশয় রূপ,
প্রথম বিহনে রঙ, দেখ বসে চুপ।
এস সবে এই কালে, খেলি মন ভরে,
শেষে তো বসিতে হবে, পড়িবার তরে।
উত্তর মালাঃ---
. ১. গোলাপ
. ২. বায়স
. ৩. বরফি
. ৪.বিলাপ
. ৫. বিকাল
অধ্যাপক ( ডঃ ) জি০ সি০ ভট্টাচার্য,
বারাণসী, উত্তর প্রদেশ, ভারতবর্ষ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জি সি ভট্টাচার্য্য
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত