চুয়াড়, পাইক আর লায়েক বিদ্রোহ
কত্তদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা, বল!! এই গরমে হাঁস-ফাঁস। আমাদের ক্রান্তীয় অঞ্চলের জলবায়ু ও বদলাচ্ছে বোধ হয় জান! নাহলে এই গরমে কিন্তু ঘাম এখনও বেশ কম। তবে হ্যাঁ, রোদ্দুরে বেরোলে কিন্তু বেশ বিপদ। কোনো ক্ষমাঘেন্না দেখাচ্ছেন না সূয্যিমশাই।তাই সাবধান সাবধান সাবধান।
রাজনীতি বোঝার বয়েস তোমার এখনও হয় নি বটে, তবে বড়দের দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে একটা টানাপোড়েন চলছে।যদিও এই অস্থিতিশীলতা আজকের নয়, অনেকদিনের; শুধু এখানে নয়, পৃথিবী জুড়ে। মানুষের বুদ্ধি বেশি তো, তাই অদরকারেও নিজেদেরকেই মারে, একজনের সব থাকতেও আরো চাই, তাই। আমাদের ইস্কুলের ইতিহাসের মাস্টারমশাই ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন যে ‘ইতিহাস সবসময় বিজেতারাই লেখেন’। মানেই বুঝিনি সেদিন। বাড়িতে এসে বাবা-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কি সব জটিল উত্তর দিয়েছিলেন, এইটুকুই মনে আছে।যেমন ধর, এই যে স্বাধিনতার গল্প তোমরা পড়ছ, এখানে নায়ক কারা, যাঁরা ইংরেজদের, অর্থাৎ সরকারের বিরূদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছেন; আর খলনায়ক কে, ইংরেজ সরকার, শাসক।কারণ এই ইতিহাস আমরা নিজেদের দেশের দখল পাওয়ার পরে লিখেছি আমাদের চোখ দিয়ে।বীরগাথা লিখেছি আমরা। বিপ্লবীরা হলেন আমাদের কাছে মহামানব।কিন্তু ধর, আমরা যদি এখনও পরাধীন ই থাকতাম, তাহলে ইতিহাস বই-তে পড়তাম যে, আমাদের চোখে দেখা এই মহামানবরাই ছিলেন খলনায়ক, তাঁরাই ছিলেন উগ্রপন্থী।
আমরা এখনো নানা রকমের বিচ্ছিন্ন আব্দোলনের কথা শুনি, বর্তমান সরকারের বিরূদ্ধে। সেই সুবাদে জঙ্গলমহলের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ বড়দের কাছে বা টিভি-তে।সেই জঙ্গলমহলের মানুষ ইংরেজ সরকারের বিরূদ্ধেও কঠিন আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ১৭৯০ সাল নাগাদ।
আমেরিকাতেও তখন ইংরেজদের ঔপনিবেশিকতার বিরূদ্ধে চলছিল ঘোর আন্দোলন।তা গিয়ে দাঁড়ায় বিদ্রোহে, তারপরে উত্তর আমেরিকার মানুষ যুদ্ধ ঘোষনা করে, ইংল্যান্ডের অপশাসনের বিরূদ্ধে। ১৭৭৬ সালে সেই যুদ্ধী জয়ী হয়ে আমেরিকার বৃটিশ উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা ঘোষনা করে। জন্ম হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।ঠিক ওই দশকেই ইউরোপেও হয় আমূল পরিবর্তন ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে। অত্যাচারী রাজা ষোড়শ লুই ও সাম্রাজ্ঞী মারী আঁতোয়ানেতকে বিপ্লবী সরকার গিলোটিনে ঘ্যাচাং-ফু করে উচ্চারিত হল স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী-র বাণী। কিন্তু ঠেকে শেখে না অনেকে। শক্তির দম্ভে তখনো অন্ধ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ। ইতিহাস থেকে শিক্ষা হল না তাদের।চারিদিকে যখন অত্যাচারের জন্য বৃটিশ সাম্রাজ্য তার বিশাল উপনিবেশের জমি খোয়াচ্ছে, বাংলায় তখন যেন আরো বেশি করে শুরু হল বৃটিশ সামাজ্যবাদীদের নিষ্ঠুর শাসন।এক অনড়, পাষান অপশাসন, নির্বিচার, অত্যাচার শোষণ।
মেদিনীপুর আর বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের আদিবাসী আর কৃষকরা এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে লাঠি-সড়কি, তির-ধনুক নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।শ্রেনীবিদ্বেষবশতঃ আভিজাত্যগর্বী জমিদারেরা ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য ভরে এদের ‘চুয়াড়’ নামে ডাকত।এরা আসলে ছিল অরণ্যসন্তান।জঙ্গলের সম্পদের ওপরে ছিল এদের নির্ভরতা।চাষবাস ও করত তারা আদিম পদ্ধতিতে। চিরাচরিত ভাবে তারা যে জমি চাষ করে এসেছে এবং বনের ফল-মূল, কাঠ-পাতা সংগ্রহ করে এসেছে, সেখানেও ইংরেজরা তাদের থাবা বসাল নির্দ্বিধায়।আর জমিদাররা ইংরেজদের হুকুম তামিল করতে গিয়ে এই সব নিরীহ মানুষদের সব স্বাভাবিক অধিকার কেড়ে নিল আর গায়ের জোরে অতিরিক্ত খাজনাআদায় করতে লাগল।নিরীহ মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আত্ম্ররক্ষার চেষ্টা তো করবেই।তাই তথাকথিত চুয়াড়-রা এই ভয়ঙ্কর নির্বিচার অত্যাচারের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াল।তাই ইতিহাসে এই বিদ্রোহ ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
এদের সঙ্গে আবার যোগ দিল কর্মচ্যুত পাইকরা।মুঘল আমলে গ্রামে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ভার ছিল পাইকদের ওপর। ইংরেজরা ক্ষমতায় এলে পাইকদের বরখাস্ত করা হয়। ক্ষোভ আর অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে পাইকদের মধ্যে। তাই সুযোগ বুঝে চুয়াড়দের সঙ্গে পাইকরাও হাত মেলাল চুয়াড়দের সঙ্গে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে।
বিদ্রোহীরা দুর্জন সিং নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ১৭৯৮ সালে রায়পুর পরগণায় অন্ততঃ ত্রিশটি গ্রামে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সরকারী দপ্তরের অপর আক্রমণ চালায়।সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে দুই পক্ষের। শেষে চুয়াড়রা পরাজিত হয় ইংরেজ সৈন্যদের কাছে।কিন্তু আবার মেদিনীপুরের শালবনী অঞ্চলে বিদ্রোহীরা জয়ী হয়।চালায় তাণ্ডব। বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দেয় তারা ইংরেজদের ব্যারাক ধ্বংস করে, শোষক জমিদারদের কাছারী আক্রমণ করে দলিলপত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়ে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে কিছু জমিদারও বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।মুশকিল হল, দীর্ঘ সংরাম চালানোর মত সংগঠন বা রসদ কোনোটাই পর্যাপ্ত ছিল না।আবার সেই একই উপায় অবলম্বন করে ধূর্ত সাহেবরা।বিভেদ। কৌশলে গ্রামবাসীদের মধ্যে ধুকিয়ে দেয় বিভেদ। সঙ্গে রয়েছে উন্নত অস্ত্র। মাত্র এক বছরের মধ্যে চুয়াড়দের বিদ্রোহ দমন করে ফেলে বৃটিশরা।এবার তাদের পালা প্রতিশোধের। নৃসংশভাবে বিদ্রোহীদের হত্যা করে তারা।গাছের ডালে তাদের ফাঁসি দিয়ে মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে ত্রাস সৃষ্টি করে তারা গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যে।
তবুও ন্যায় বিচার আরা অধিকার দাবীর জন্য বাংলার ইতিহাসে চুয়াড়বীরদের দান স্মরনীয় হয়ে আছে।
গড়বেতা এখন রাজনৈতিকভাবে বহুচর্চিত জায়গা। তবে ১৮০৬ সালে সেই গড়বেতার কাছে গঙ্গানীর গভীর শালবন ঘেরা অঞ্চলে অচল সিংহ নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে লায়েকরা গেরিলা কৌশ্ল অবলম্বন করে ইংরেজ শাসকদের বিরূদ্ধে আক্রমণ চালায়।কারণ, কোনো কারণ ছাড়াই ইংরেজরা লায়েকদের সব জমি বাজেয়াপ্ত করে।বিদ্রোহের সূচনা সেখান থেকেই। তারাও চুয়াড়দের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল।। বিদ্রোহী চেতনা গোটা লায়েক সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ শাসকের ওপরে আঘাত হানতে প্রেরণা দেয়।কিন্তু জান, ইংরেজরা তাদের শায়েস্তা করার জন্য কামান দেগে গোটা শালবন জ্বালিয়ে দেয়।অচল সিংহ কিন্ত অটল। তাঁর নেতৃত্বে কিন্তু গেরিলা পদ্ধতিতে চলতে থাকে আক্রমণ ইংরেজদের ওপর।অসমশক্তি নিয়ে যদিও এই বিদ্রোহ সফল হয় নি। অচল সিংহ আত্মগোপন করেন।কিন্তু আমাদের দেশের বীরদের বিশ্বাসঘাতকের অভাব হয়নি কোনোদিন। ১৮১৬ সালে তাদের সাহায্য অচল সিংহ গ্রেপ্তার হন ইংরেজদের হাতে। বিনা বিচারে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।অচল সিংহের ২০০ অনুগামীদের নৃশংসভাবে ফাঁসী দেয় বৃটিশ সরকার।শেষ হয় ক্ষণস্থায়ী তিনটি সমসাময়িক বিদ্রোহ যা পরবর্তী বিদ্রোহীদের শিখিয়ে যায় যে সংগঠন আর শক্তি দুটোই দরকার ইংরেজদের বিরূদ্ধে লড়তে গেলে।
আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন আর্য চ্যাটার্জি
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মাৎসুয়ামার আয়না
অনেক অনেক দিন আগে, জাপানের এক দূর প্রান্তে এক দম্পতি বসবাস করতেন। তাঁদের ছিল এক ছোট্ট মেয়ে। সে ছিল তার বাবা মায়ের খুব আদরের। তার নাম ছিল মাৎসুয়ামা।একবার তার বাবাকে কাজের খাতিরে অনেক দূরে কিয়োটো তে যেতে হল। যাওয়ার আগে মেয়েটির বাবা তাকে বলে গেলেন সে যদি ভাল হয়ে থাকে আর মা'কে কাজে কর্মে সাহায্য করে, তাহলে তিনি তার জন্য এমন একটা উপহার নিয়ে আসবেন, যেটাকে সে খুব পছন্দ করবে। এই বলে তার বাবা তার মায়ের কাছ থেকেও বিদায় নিলেন। মা আর মেয়ে তাঁকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।
যখন তিনি বাড়ি ফিরে এলেন, তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে তাঁর বিরাট টুপি আর চটি খুলে নেওয়ার পরে, তিনি সাদা মাদুরে বসে একটা বাঁশের ঝুড়ি খুললেন। তিনি দেখলেন তাঁর ছোট্ট মেয়ে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছে ঝুড়ির দিকে। তিনি ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা দারুণ সুন্দর পুতুল আর একটা মিষ্টির বাক্স বার করে এনে তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে দিলেন। তারপরে তিনি আবার ঝুড়ির ভেতরে হাত দিলেন, আর স্ত্রীর জন্য বার করে আনলেন একটা ধাতুর আয়না। তার বাঁকানো তলটি ঝকঝক করছিল। তার পেছনে আঁকা ছিল পাইন গাছ আর সারস পাখিদের ছবি।
সেই মহিলা এর আগে কোনদিন আয়না দেখেন নি, আর তাই আয়নার দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন আয়নার ভেতর থেকে আরেকজন মহিলা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি অবাক হয়ে দেখতে থাকলেন। তখন তাঁর স্বামী তাঁকে রহস্যটা বুঝিয়ে বললেন, আর আয়নাটাকে খুব যত্নে রাখতে বললেন।
এই সমস্ত আনন্দের মূহুর্তগুলি বেশিদিন থাকল না। মাৎসুয়ামার মা হটাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মারা যাওয়ার কিছু আগে তিনি ছোট্ট মাৎসুয়ামাকে ডেকে বললেন, " সোনা আমার, আমি মরে গেলে তোমার বাবার খুব ভাল করে যত্ন নিও। আমি চলে গেলে তোমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু এই আয়নাটা নাও, আর যখন তোমার সবথেকে একা লাগবে, এটার মধ্যে দেখ - তুমি আমাকে দেখতে পাবে।" এই বলে মাৎসুয়ামার মা মারা গেলেন।
কিছুদিন পরে মাৎসুয়ামার বাবা আবার বিয়ে করলেন। তাঁর নতুন স্ত্রী নিজের সৎ মেয়ের ওপর একদম সদয় ছিলেন না। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা তার মায়ের কথা মনে রেখেছিল। তার খুব কষ্ট হলে সে এক কোনায় গিয়ে আয়নাটার দিকে ব্যাকুল ভাবে তাকিয়ে থাকত। তার মনে হত সে আয়নার মধ্যে তার প্রিয় মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছে । কিন্তু সেই মুখ মৃত্যুর সময়ের মত ব্যথায় ভরা ছিল না, সেটা ছিল এক অল্পবয়সী সুন্দর মুখ।
একদিন যখন সে এক কোনায় বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে মনে মায়ের সাথে কথা বলছিল, তার সৎমা তখন তাকে দেখে ফেলল। তার সৎমা মাৎসুয়ামার হাতের আয়নাটা দেখতে পাচ্ছিল না। সে এমনিতেই মাৎসুয়ামাকে ঘোর অপছন্দ করত, আর মনে মনে ভাবত যে তার সৎ মেয়েও তাকে ঠিক সেইরকমই অপছন্দ করে। তার কুটিল মনে সে ভাবল, মেয়েটা নির্ঘাৎ কোন জাদু করছে, নির্ঘাৎ তার ছবির গায়ে সূঁচ বেঁধাচ্ছে। এই সব ভেবে, সে তার স্বামীর কাছে গিয়ে নালিশ করল যে তাঁর হিংসুটে মেয়ে তাকে মন্ত্র-তন্ত্র দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে।
তার স্বামী এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি সোজা তাঁর মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তিনি হটাৎ ঘরে ঢোকায় তাঁর মেয়ে চমকে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার জামার আড়ালে আয়নাটা লুকিয়ে ফেলল। এই প্রথম তার স্নেহশীল বাবা তার ওপরে রেগে গেলেন, আর তিনি ভয় পেলেন, যে হয়ত, তাঁর স্ত্রী তাঁকে যা বলেছে, সে সব সত্যি। তিনি মেয়ের কাছে আসল কথাটা জানতে চাইলেন।
মাৎসুয়ামা যখন এই সমস্ত অদ্ভূত কথা তার বাবার মুখে শুনল, সে অবাক হয়ে গেল। সে তার বাবাকে বলল, সে তাঁকে খুবই ভালবাসে, তাই তার পক্ষে তাঁর স্ত্রীকে মারার কথা ভাবাও অসম্ভব, কারণ সে জানে তিনি তাঁর স্ত্রীকে কতটা ভালবাসেন।
"তুমি জামার ভাঁজে কি লুকিয়েছ?" তার বিস্মিত বাবা খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করলেন।
"তুমি মাকে যে আয়ানাটা দিয়েছিলে, যেটা মা আমাকে মারা যাওয়ার সময়ে দিয়েছিলেন। আমি যখনি এটার দিকে তাকাই, আমি আমার মায়ের সুন্দর , অল্পবয়সী মুখটা দেখতে পাই। আমার যখন খুব কষ্ট হয় ---হ্যাঁ! গত কয়েকদিন আমার খুব মন খারাপ হয়েছে --- আমি আয়নাটা বার করি, আর মিষ্টি, শান্ত হাসিতে ভরা আমার মায়ের মুখ আমাকে শান্তি দেয়, আমাকে কটু কথা আর রাগী দৃষ্টি সহ্য করতে সাহায্য করে।"
তখন মাৎসুয়ামার বাবা নিজের মেয়েকে আরো ভাল করে বুঝতে পারলেন আর তাঁর প্রতি তার দায়িত্ববোধ দেখে তাকে আরো ভালবাসলেন। এমনকি, তার সেই সৎমা, যখন সব কথা জানতে পারল, সেই খুব লজ্জিত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল। আর মাৎসুয়ামা, যে বিশ্বাস করত যে সে আয়নার মধ্যে তার মায়ের মুখ দেখেছে, সে তার সৎমাকে ক্ষমা করে দিল।
তাদের সংসার থেকে অশান্তি চিরকালের মত বিদায় নিল।
(জাপানের রূপকথা)
অনুবাদঃ
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
সাত ইঁদুর কন্যার কাহিনী
গল্প-কথকঃ শুক্তি দত্ত
অনে—ক দিন আগের কথা, সে কত্তো—দিন আজ আর মনে নেই। জার্মানির এক গ্রামে এক বিধবা মহিলা তার সাতটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। এই মেয়েরা সকলেই এক রকম পোষাক পড়ত। উজ্জ্বল ছাপার জামা, তার ওপর কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন ও মাথায় টুকটুকে লাল রঙের ছোটো টুপি – এই ছিল সাত বোনের পোষাক। চকচকে সুন্দর চুলগুলিকে পরিষ্কার একটা বেণীতে বেঁধে এই রকম পোষাক পরে তাদের ভারী সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন দেখাত।
একবার এক গুড-ফ্রাইডে’র দিনে মেয়েদের মা তাদের একলা বাড়ীতে রেখে কাছের এক গির্জাতে গেলেন কাজ করতে। যাবার আগে সাত বোনকে সাবধান করে গেলেন, “শোনো মেয়েরা, বাড়ী ফিরে যেন না দেখি কোন দুষ্টুমি করেছ। আর খবরদার, উনুনের পিছন দিকের ঘরে উঁকি মারবে না।”
মা চলে গেছেন অনেকক্ষণ হল। খালি বাড়িতে বাচ্চারা গোল হয়ে বসে তাদের বড় দিদির কাছে গল্প শুনছিল। তারপর তারা একসঙ্গে গান করল, খানিকক্ষণ খেলল; কিন্তু সময় যেন আর কাটেনা। “উঃ, মা তো আসছে না, কি যে করি!” জাতীয় কথা শুরু হল। “হ্যাঁরে মা কেন উনুনের পিছনের ঘরে তাকাতে বারণ করল রে? এই, চুপ করে বসে থাক, এসব কথা একদম নয়। সত্যিই তো ওখানে কি আছে রে?” – এরকম নানা কথা তাদের মধ্যে ঘুরতে লাগল, আর ক্রমশই তারা আরো অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। কৌতূহল আর বাধা মানে না।
শেষ পর্যন্ত তারা আর নিজেদের সামলাতে পারল না। একজন গিয়ে পিছনের ঘরটাতে চুপি দিল। “ওরে, এখানে না একটা ঝোলা রয়েছে,” সে সবাইকে বলল। তার পিছনে আরেকজন উঁকি দিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা দেয়ালে একটা পেরেক থেকে ঝুলছে।” ব্যস, বাকিদের আর আটকানো গেল না। মা’র বারণ ভুলে সবাই হুড়মুড় করে বাকি পাঁচজনই ঢুকে পড়ল সেই ঘরে।
ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে তারা ঝোলাটাকে খোঁচা দিয়ে বুঝতে চাইল ভিতরে কি আছে। প্রতি মুহূর্তেই তাদের কৌতূহল এত বাড়ছিল যে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মেয়েটি ঝোলাটাকে দেয়াল থেকে নামিয়েই ফেলল। সাত জোড়া ছোট্ট হাত ঝটিতি ঝোলার বাঁধন খুলে ফেলল; বের করে আনল একটা খয়েরী কাগজের মোড়ক, তাতে ভর্তি বাদাম আর আপেল। আসলে তাদের মা সামনের ঈস্টারের ভোজে খাবার তৈরী করার জন্য এগুলি জমাচ্ছিলেন।
সাতটা ছোট মেয়ে মেঝের উপর গোল হয়ে বসে পেট পুরে বাদাম আর আপেল খেয়েছে। মা ফিরে দেখলেন মেয়েরা শান্ত হয়ে চুপ করে বসে আছে, আর তাদের সামনে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে বাদামের খোলা আর আপেলের খোসা। খালি ঝোলাটা দেয়ালের গায়ে পেরেক থেকে তেমনি ঝুলছে।
রাগে দুঃখে মা চীৎকার করে উঠলেন। ভুলে গেলেন যে পবিত্র দিনগুলিতে কোন কিছু হঠাৎ বলে ফেলা উচিত নয়। “ওরে নচ্ছার মেয়েরা, ইঁদুরের মত ছিঁচকে চোরের স্বভাব তোদের। তোরা তাই হলিনা কেন?” যেই না এ কথা বলা, উজ্জ্বল ছাপার জামা পরা, তার উপর কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন লাগানো, বিনুনী করা চুলে ছোট্ট লাল টুপি পরা সাতটা ছোট মেয়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সাতটা নেংটি ইঁদুর হয়ে গেল। প্রত্যেকটা ইঁদুরের পিঠটা উজ্জ্বল রঙের, পেটের কাছে বড় সাদা দাগ আর মাথার উপর লাল টুকটুকে ছোট দাগ।
বেচারা মা এই দেখে দুঃখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি একদৃষ্টে ইঁদুরছানাগুলিকে দেখতে লাগলেন। তারাও সব ভুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। দুঃখে মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কতক্ষণ যে তাঁরা এইভাবে ছিলেন বলা যায় না। ইতিমধ্যে একজন পড়শী এসে দরজায় ঠক্ঠক্ করে তাদের ডাকছিলেন। কিন্তু কেউই দরজা খুলছিল না দেখে দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে তিনি ভিতরে উঁকি মারলেন। যেই না উঁকি দেওয়া, অমনি সাতটা ইঁদুর একে একে ফুড়ুৎ করে বাড়ির বাইরে দৌড়ে পালাল। গাঁয়ের পথ দিয়ে, মাঠের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা একটা ছোট বনের ভিতর ঢুকে পড়ল। থামল এসে একটা পুকুরের ধারে। তাদের পিছনে দৌড়ে আসছিলেন তাদের মা। তিনিও এসে পৌঁছলেন সেখানে। সাত ইঁদুর তাদের মায়ের মুখের দিকে একবার দেখল, তারপর একে একে সেই পুকুরে ঝাঁপ দিল।
মা এই দৃশ্যটা চুপ করে দেখলেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি সেই পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, একটুও নড়লেন না। আস্তে আস্তে মা এক পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলেন। এর পর বনের ভিতর দিয়ে যাবার সময় যে কেউ সেই পুকুরের পাড়ে আসত, দেখতে পেত পাষাণপ্রতিমা মা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ কেউ বলে যে, মধ্যরাতে যখন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, তখন তারা দেখেছে সাতটা ছোট ইঁদুর এক এক করে জল থেকে উঠে আসে আর চাঁদের আলোয় সেই পাষাণমূর্তি মায়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে।
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ছোট্ট সোনারা বলোতো, এইরকম দুঃখের মধ্য দিয়ে গল্প শেষ হলে কি মন ভাল লাগে? তাই ভাবছি, শেষের ঘটনাটাও তোমাদের জানিয়ে দিই। একদিন এক মহিলা সেই বনের পথে সাত ছেলেকে নিয়ে যাবার সময় ক্লান্ত হয়ে পুকুরপাড়ে বসলেন। ছেলেদের বয়স সেই সাতটি মেয়ের থেকে একটু হয়তো বড়। পুকুরের পাশে মূর্তিটি দেখে কিছু না ভেবেই ছেলেদের মা তার গায়ে যেই না হাত দিয়েছেন, অমনি কী আশ্চর্য! মূর্তিটা নড়ে উঠল, চোখে পলক পড়ল আর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মূর্তিটা সজীব হয়ে গেল।
ভয় পেয়ে ছেলেদের মা দু-পা পিছিয়ে এলেন। তারপর সব কথা ধীরে ধীরে শুনলেন। এদিকে আরেকটি ঘটনা ঘটল। মা যেই পাথর থেকে মানুষ হলেন, অমনি পুকুরের ভিতর থেকে সাত ইঁদুর একে একে উপরে উঠে এল। ইঁদুরের খোলস থেকে বেরিয়ে এল সাতটি ফুটফুটে মেয়ে – পরণে উজ্জ্বল ছাপার জামা, জামার উপরে কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন আর মাথায় টুকটুকে লাল রঙের ছোট্ট টুপি। সবার মনেই খুশীর হাওয়া। প্রত্যেকটা মেয়ের সঙ্গে একটি করে ছেলের বিয়ে হল। তারা জোড়ায় জোড়ায় সেখান থেকে রওনা হল। পিছনে চললেন দুই মা।
(জার্মানীর উপকথা থেকে)
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শুক্তি দত্ত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
সন্দেশ
এবারের বই পোকার দপ্তরে আলোচনা হবে কোন বই নিয়ে জান? এই বইয়ের নাম -'সন্দেশ'!
তুমি কি 'সন্দেশ' এর নাম শুনেছ? বা 'সন্দেশ' পড়েছ? যদি শুনে থাক, তবে খুব ভাল। আর না শুনে থাকলে বলি, 'সন্দেশ' হল 'ছেলেমেয়েদের জন্য সচিত্র মাসিক পত্র'। প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৩২০ (১৯১৩) সালে। মানে ঠিক ১০০ বছর আগে। আর সেই পত্রিকা শুরু করেছিলেন কে জান? -উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এই বছর তাঁর জন্মের ১৫০ বছর পালিত হচ্ছে। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন একাধারে শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক, চিত্রকর, অলংকরণ শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ এবং মুদ্রন শিল্প বিশারদ।
১৯১৩ সাল থেকে প্রকাশিত সেই পত্রিকায় থাকত ছড়া, গল্প, পুরাণ, আবিষ্কারের গল্প, লোক কথা...উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা আর লেখায় ভরা সন্দেশের প্রতিটা সংখ্যায় ছিল বিপুল জনপ্রিয়। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সন্দেশ পত্রিকার ভার হাতে নেন তাঁর পুত্র সুকুমার রায়। তাঁর অকাল মৃত্যুর পরে সেই পত্রিকা কিছুদিন বন্ধ থাকে। অনেক পরে আবার সন্দেশ প্রকাশিত হতে থাকে সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার এবং নলিনী দাশের হাত ধরে। কিছুদিন আগে অবধিও সন্দেশ নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। এই মূহুর্তে খুব সম্ভবতঃ মাসিক সন্দেশ আর প্রকাশিত হয় না।
পারুল প্রকাশনী প্রকাশ করেছে সন্দেশের প্রথম বর্ষের সবকটি সংখ্যাকে একত্র করে এক অখন্ড সংস্করণ। এই বইতে আছে ১৩২০ সালের বৈশাখ থেকে চৈত্র অবধি প্রকাশ হওয়া সবকটি সংখ্যা। রয়েছে উপেন্দ্রকিশোরের নিজের হাতে আঁকা ছবি। আর সাথে রয়েছে বিনামূল্যে একটা সিডি, যাতে রয়েছে প্রদীপ ঘোষের কন্ঠে ১৮টি নির্বাচিত কবিতা ও গল্প পাঠ।
এর থেকে ভাল আর কি হতে পারে , তাই না?
এই বইয়ের দাম ৪০০ টাকা।
বইপোকা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন বইপোকা
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মেঘ বৃষ্টির দেশে-পর্ব ৩
সিরাজুল,
সুন্দর বনের গন্ধ মেখে একটা নীল খামের চিঠি আমার পড়ার টেবিলে অপেক্ষা করছে। এখোনো আমি হাত দিয়ে ধরিনি পর্যন্ত চিঠিটাকে। কারণ আমি জানি ওই চিঠিতে আছে আমার সিরাজুল, আনন্দী, আর পাখিরালার অনেকের অনেক অনেক গল্প। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে মাঝে মাঝে এমন সারপ্রাইজ পেতে বেশ ভালো লাগে আমার। দিনের শেষ ডানকুনি লোকালে ফিরছি যখন, ঝিরঝরে বৃষ্টি জানলার মধ্যে দিয়ে এসে আমার কপাল...চুল...মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর আমি যেন চোখ বুঁজে দেখতে পাচ্ছি অনেক রাতের সেই হরিণভাঙা নদীটাকে। আমি যেন কান পাতলে শুনতে পাচ্ছি গফুর চাচার নামাজ পড়া। আমি যেন শুনতে পাচ্ছি চাচি তালের বড়া ভাজতে ভাজতে গুনগুন করে গান গাইছেন। জানি, এইসব কথা বলে তোমার রাগ বাড়ছে বই কমছে না। অনেকদিন যে যাওয়া হয়না ওই পথে। অনেক দিন আনন্দীর সাথে পুকুরে নেমে তুলি না কলমী শাক। কিম্বা তোমার আর পান্তুর সাথে ছোট ডিঙি বেয়ে যাওয়া হয়নি অনেক দিন ছোট ছোট লাল কাঁকড়ার ডেরায়। আচ্ছা এবার আর প্রমিস করবো না। এক্কেবারে তোমার বাড়ির সামনে ভ্যান থেকে নেমে পড়ে হাঁক-ডাক দেবো। সারপ্রাইজ দেবো তোমাকে সিরাজুল। এবার খুশি তো? লীলা মজুমদারের রচনাবলী পড়ছো শুনে খুশি হলাম। শেষ হলে জানিও। দ্বিতীয় খন্ডটা যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো। আচ্ছা রহিম কী এখোনো রাতের আঁধারে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় ভূতের গল্প বলে? ওকে বোলো সব গল্প জমিয়ে রাখতে সারা রাত ধরে আমরা শুধু নৌকা বাইবো আর ভূতের গল্প শুনবো সিরাজুল।
মেঘালয়ের গল্প শুনতে শুনতে তুমি আর আনন্দী যে ছবি গুলো এঁকেছো সেগুলো যখন তোমার বাড়ি যাবো তখনি দেখবো। চুপি চুপি বলি কিছু ছবি চাঁদের বুড়ির জন্য তুলে রেখো কিন্তু। বুড়ির আবার ছবি জমানোর নেশা আছে ভারী। ও জানতে চাইছো, সেই ছবি দিয়ে বুড়ি কী করে? এমা তুমি জানো না? সেই ছবি চাঁদের বুড়ি ইচ্ছামতীর জলে ভেলা করে ভাসিয়ে দেয়। আর ঠিক তোমার আর আনন্দীর মতো অনেকে সেই ছবি দেখে। মজা পায়। ঠিক আছে বাবা...বুঝতে পেরেছি। আমার বকবকে তুমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছো তো? কিন্তু এক্ষুনি তোমাকে যাদের ছবি দেখাবো, তাদের দেখলে তোমার বেশ আনন্দই হবে। হাতে ফুল নেওয়া এই পুঁচকে দুটোকে আমি দেখতে পাই চেরাপুঞ্জির রাস্তায়। ওদের কাজ ফুল বিক্রি করা। আর সেই টাকায় মা-বাবাকে ওরা কিনে দেয় চাল, আলু, ডিম। তাই বলে ভেবো না ওরা স্কুলে যায় না। পড়াশুনো করে না। এমনি করেই সারাদিন ফুল বিক্রি করে। মোটেই না। সকালের স্কুলে ভাত দেয়, ডাল দেয়, কখোনো কখোনো ওরা খেতে পায় স্কোয়াশের তরকারী। তারপর রাস্তার ধারে ফুটে থাকা ঘাস ফুল তুলতে যায় সবাই মিলে। সেই ঘাসফুল ছোট ছোট বান্ডিল করে ওরা বিক্রি করে।
হ্যাঁ ঠিক বলেছো...পুরুলিয়ার অনিল শবর যেমন বিক্রি করে ঘাসের বানানো নৌকা, কুচবিহারের আন্দু রাভা যেমন বিক্রি করে সুপারীর খোসা দিয়ে তৈরী মুখোশ ঝাড়গ্রামের সোনালী হেমব্রম যেমন বিক্রি করে পিঁপড়েদের ফেলে যাওয়া বাসা ঠিক তেমনি এরা ফুল বিক্রি করে। আমিও ওদের কাছ থেকে অনেক অনেক ফুল কিনে গাড়ির সামনে আমার বসার জায়গায় রেখে দিলাম। ওদের কথা খুব একটা বুঝতে পারিনি সিরাজুল। ভাঙা হিন্দিতে কি আর অনেকক্ষণ গল্প করা যায়? ওদিকে আকাশে যে মেঘ করে আসছে। আর আমার ড্রাইভার বন্ধু বাপী তাড়া দিচ্ছে প্রচন্ড। এরপর যেখানে গেলাম সেটা তুমি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। পাহাড়ী ঝরনার তীব্রতা যে কি...তুমি যখন এখানে আসবে নিজেই জানতে পারবে।
দেখলাম অনেক স্কুল আর কলেজের ছেলে মেয়েরা এসেছে। মজা করছে। তাদের মধ্যে দুজনকে তো আমার মেক্সিকোর কাউবয়ের মতো মনে হলো। ওরা নিজেরাই ডাকলো আমাকে। আমার হাতে ক্যামেরা দেখে খুব শখ হলো ছবি তোলার। আমি ওদের ছবি তুলে দিলাম। শুনলাম পাশের কোন এক কলেজ থেকে এডুকেশানাল ট্যুরে এসেছে।
যাইহোক। এবার এই ছবিটা দেখো। এটা কী তোমার ব্রিজ বলে মনে হচ্ছে সিরাজুল? ঠিক ধরেছো...এটা গাছের শিকড় দিয়ে তৈরী করা একটা ব্রিজ। আপনা থেকেই এমন হয়ে গেছে। অনেক দূর থেকে মানুষরা এখানে আসে এই প্রাকৃতিক উপায়ে নির্মিত ব্রিজটা দেখতে।
আরে আরে দাঁড়াও দাঁড়াও...অত হড়বড় করলে হয়? আনারস দেখে থমকে দাঁড়াতেই হলো সিরাজুল।
এরা সবাই ট্যুরিস্টদের আনারস বিক্রি করে। জঙ্গলের আনারস, আর মধু খেয়ে আমরা ফিরলাম হোটেলে।
মন খারাপ সিরাজুল। বিকেলের উড়োজাহাজে ফিরতে হবে কলকাতা। আর ফিরেই তোমাকে একটা বড় চিঠি লিখতে হবে। তোমার পাঠানো সহজ পাঠের কবিতাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। প্লেনে উঠে, জানলার ধারে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর মেঘ দেখতে দেখতে সেই কবিতাটার কথাই ভাবছিলাম।
"কত দিন ভাবে ফুল/ উড়ে যাবে কবে/ যেথা খুশি সেথা যাবে/ভারী মজা হবে/ তাই ফুল একদিন মেলে দিল ডানা/ প্রজাপতি হল তারে/ কে করিবে মানা..."। আমাকে কেউ এখন আর মানা করে না সিরাজুল কোনো কিছুর জন্য। আমি এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে বেড়াই। আর যখন খুব মন কেমন করে তখন ফিরে আসি উত্তরপাড়ার খেয়াঘাটে। লিখতে বসি তোমাকে একটা বড় চিঠি। আর ঠিক তখনি কোথা থেকে পাল তোলা নৌকা করে মন কেমনেরা পালিয়ে যায় দূর দেশে। অনেকদিন তাদের আর খোঁজও পাই না। খুব ভালো থেকো সিরাজুল। এবারে রহিমচাচার তাল পাটালী খেয়ে কেমন লাগলো জানিও। আর একটা লম্বা চিঠি লিখো। আবার যেন অনেক রাতে বাড়ি ফিরে আমি আমার পড়ার টেবিলে সোঁদা মাটির নোনা গন্ধ পাই তোমার হাতের লেখায়। তোমার মিষ্টি করে লেখা চিঠিতে। অনেক ভালোবাসা।
লেখা ও ছবিঃ
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া খেয়াঘাট, হুগলী।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত