টিয়া কথন
এখন আমি শহুরে হয়ে গেছি। থাকি শাহরের একটি অভিজাত এলাকায়। দোতলা বাড়র নিচিতলায় ঝুল বারান্দায় একটা কালচে রংয়ের ঝোলানো খাঁচায় আমার বাসা। এখান থেকে দিব্যি দুবেলা মানুষজন, ঘর-বাড়ি, কুকুর-বেড়াল, কাক-শালিক আরো কত কি যে দেখা যায়! এক্ষুনি হয়তো মাথায় ঝাঁকা করে কলা বেচা ফেরিওয়ালাটা অদ্ভুৎ ডাক দেবে - "ক-লা-চা-ই, ক-লা---" পরক্ষনে হয়তো লম্বা ঢ্যাঙ্গা লুঙ্গি পরা হাফ হাতা লালচে গেঞ্জি পরা দর্জি কাঁধে তুলো পেঁজার যন্ত্রটার দড়িতে টান দিয়ে "ঘ্যাঁ-ও-ও, ঘ্যাঁ-ও-ও" শব্দ তুলে চলে যাবে পাশের গলিতে। এদিকে রাস্তার উল্টো দিকে "গোপাল ভান্ডার" এ দোকানদার খদ্দের সামলাছে একইভাবে। দোকানের মাথায় ঠান্ডা পানিয়র বিশাল বিজ্ঞাপনের ব্যানার। বিশাল আকৃতির একটি পানিয়র বোতল, গায়ে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ছে। আপনা থেকেই তৃষ্ণা পাবেই। তাকে ছাড়িয়ে একটু দুরে বিশাল ছাতিম গাছের ছাওয়ায় দুটো রিক্সা পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছে।
তক্ষুনি স্কুল ফেরত ইচ্ছামতী দু'দিকে বিনুনী দুলিয়ে নীলচে স্কুল ফ্রক উড়িয়ে মায়ের হাত ছেড়ে আমার খাঁচার নিচে এসে লাফাতে লাফাতে চ্যাঁচায় " এই টিঁয়া - টিঁয়া - তুই ঘুমোচ্ছিস - টিঁয়া?!" ওর লাফানো দেখে আমায় খেলায় পেয়ে বসে। আমিও ডানা ঝাপটে চ্যাঁচাতে থাকি - "মঁতি - মঁতি!" ইচ্ছামতী বড্ড বড় নাম, তাই ছোট করে আদর করে বলি - "মঁতি"। ও এবার মাষ্টারি করতে শুরু করে, কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞেস করে - "বল প্যারট"। আমি গলার স্বর গম্ভির করে বলি-"প্যাঁর-র-ট"। ও অনুশাসন করে বলে - "মানে বল ?" আমি আবারও বলি-"প্যাঁর-র-ট"। ও অনুযোগের সুরে বলে - "এর মধ্যেই ভুলে গেলি ? কাল যে তোকে শেখালাম!" আমি মজা করে ঘাড় বেঁকিয়ে গায়ের পালকগুলো ফুলিয়ে আবার বললাম - "প্যাঁর-র-ট"। ওতো হেসে কুটোপাটি!
মা পেছন থেকে ইচ্ছামতীকে টেনে ঘরে নিয়ে যায়। ও কিছুতেই যেতে চাইছেনা। আর একটু আমার সঙ্গে খেলতে চায়। মা ওকে বকুনি দিতে দিতে ঘরে টেনে নিয়ে যায়। বলে - " চলো, চলো জামা কাপড় ছেড়ে চান করে ঘুমোবে। বিকেলে টিচার আসবে। হোম টাস্ক --- ওঃ বড্ড অবাধ্য!" ও হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে মার সঙ্গে ঘরে যায়। আমার ভালো লাগে না। এখন শুধু শুধু বসে থাকা ছাড়া কোন কিছু করার নেই।
ঝিমুনি ধরা দুপুরের রোদটা শহরের এই গলিটাকে আরো বেশি করে তন্দ্রাছন্ন করে তুলছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, মাঝে মধ্যে দু'একটা গাড়ি বা বাইকের আওয়জে তন্দ্রায় ছেদ পড়ছে বইকি ! এদিকে চারদিকে তখন উঁচু নিচু বাক্সঘর থেকে ভেসে আসছে টিভি সিরিয়ালের দাপাদাপি ও দামামা। আমার ঝিমুনি আসে। চোখ বন্ধ করে ঘাড় গুঁজে বসে রইলাম।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই বন-বাদাড়ে ভরা নোনা নদীর চর। চরের বাঁক ছাড়িয়ে নদীটা এঁকে বেঁকে মিশেছে দু'র দিকচক্রাবালে। দিন দুবেলা জোয়ার ভাটা খেলা করে যায় এই চরের জঙ্গলে। আর চরের এপারে মোটা নদী বাঁধ পেরিয়ে মাঠ ভরা সোনালী আদিগন্ত ধানের ক্ষেত। মাঝে মধ্যে সবুজ আলবাঁধগুলো সোনালী ক্যানভাসে আঁকিবুকি কেটে মায়াবী রুপরেখা তৈরী করেছে। আরো দূরে গাছ-গাছালির দিগন্ত রেখায় দু'একটা পাংশুটে খড়ের ঘর বা কালচে লাল রঙের টালির ছাউনি মাটির ঘর। পেছন থেকে হয়তোবা কোন তাল-নারকেল তেড়ে ফুড়ে উঠে গেছে শুধু নীল দীগন্তে ভেসে থাকা কোন মেঘের ডানা ছুঁতে।
চরের জঙ্গলে একটা বুড়ো নধর বানী গাছের কোটরে আমাদের বাসা। আমরা তিন ভাইবোনে একসঙ্গে গায়ে গায়ে, গাদা-গাদি হয়ে বসে থাকি। আমরা একে অপরে ধাক্কা-ধাক্কি করে কোটর থেকে মুখ বের করে বাইরের জগতটা দেখে নেই। একজনের দেখা হয়ে গেলে তাকে সরিয়ে অন্যজন। বেশ লাগে নদীর চর, ধানক্ষেত, আকাশ-মেঘ আর অপেক্ষা করি মা কখন ফিরবে ! নয়তো সময় কাটাতে পাশের ঝোপের বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে ক্যাচর ম্যাচর করে গল্প জমাই। গল্পের কোন ঠিক ঠকানা নেই। মায়ের কাছে শোনা কোন রাক্ষস-খোক্ষসের বা কোন রুপকথার গল্প নয়তো ধাঁধাঁ অথবা মজার চুটকি।
তক্ষুনি মা মুখে করে খাবার নিয়ে উড়ে এসে গর্তের মুখে ধরে। আমরা মহানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের মুখ থেকে খাবারের টুকরোগুলো ছিঁড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলি এক নিমেষে। মা এবার শাষন করে বলে - " তোমরা বড্ড দুষ্টু হয়েছ, কতবার না বলেছি গর্ত থেকে বের হবে না ... এখনো ভালো করে উড়তে শিখলে না। কাল থেকে আমার সঙ্গে ওড়া প্র্যাক্টিস করবে। শত্রুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবে কি করে ?!
বিকেলে হঠাৎ গাছটায় প্রবল ঝাঁকুনি সঙ্গে ঠক-ঠক করে বিকট শব্দ, যেন সমস্ত পৃথিবীটা দুলে উঠছে - একবার নয় দুবার নয় বার বার ! মূখ বাড়িয়ে গর্ত থেকে মুখ বাড়িয়ে যেইনা দেখবার চেষ্টা করেছি, দেখি কি কালো মতো একটা লোক গাছটায় চড়ে বসে আছে, হাতে জাল ! সর্ব্বনাশ - এটাতো শিকারী ! আমরা তিনজন কোটরের একেবারে ভিতরে ডুকে বসে রইলাম। বুক দুরু দুরু, ভয়ে কাঁপছি। কান্না পাচ্ছে ভিষন কিন্তু মাকে ডাকতে পারছ না। এমন সময় কোটরের মুখ বন্ধ হয়ে গেল, এখন শুধু অন্ধকার।
দম বন্ধ হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, ভিষন কষ্ট, পারছিনা... নিজেদের বাঁচাতে কপাল ঠুকে কোটরের মুখ থেকে বেরোবার জন্য শত চেষ্টা করছি অমনি দুটো কালো হাত এসে আমাদের জালে জড়িয়ে ফেলল। আমরা প্রাণপনে চ্যাঁচিয়ে প্রতিবাদ করছি কিন্তু লাভ কোন লাভ হচ্ছে না। আত্মরক্ষার জন্য আমাদের লাল ঠোঁট দিয়ে লোকটার কালো হাতে আচ্ছা করে কামড় বসাই। হাত দুটো ক্ষনিকের জন্য সরে গেলেও পরক্ষনে আবার পেছন থেকে ডানাদুটো জাপটে ধরে একটা খাঁচার মধ্যে চালান করে দিল। আমারা তখন সমানে কঁদে কাঁদে অনুরোধ করছি - " ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, আমদের ভিষণ লাগছে, কি অপরাধে আমাদের ধরে বাঁধে নিয়ে যাচ্ছ ?"
মা তক্ষুনি আকাশ চিরে চিৎকার করে উড়ে এসে গাছের উপরে চক্কর দিচ্ছে। মা প্রতিবাদ করছে - "এই বদমানুষটা, আমার বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, কি ক্ষতি করেছে ওইটুকুনি কচি বাচ্চগুলো ? ভালো হবে না কিন্তু... ছেড়ে দে বলছি..." মায়ের সঙ্গে আমরাও সমানে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করছি, অমনি আমাদের পাশের প্রতিবেশিরাও জঙ্গলের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে চক্কর দিতে দিতে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তে জঙ্গলে যেন আলোড়ন উঠল। মাকে আমরা কাঁদতে কাঁদতে বলছি - "আমাদের বাঁচাও মা, আমাদের বাঁচাও..." মা তীব্র গতিতে সোজা উড়ে এসে লোকটার মাথায় একটা টক্কর দিল, লোকটা হাত দিয়ে 'হুস-হুস' করে মাকে তাড়াতে থাকল। তারপর খাঁচার মুখটা ভালো করে বন্ধ করে বাঁকের পেছনে খাঁচাটা ঝুলিয় দিল। এবার মা হাঁউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করছে - "হেই মানুষ, ওদের ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। তোমরা শক্তিধর, বুদ্ধিমান, আমরা ক্ষুদ্র-ক্ষীণ, তাই বলে আমাদের এভাবে ধরে বাঁধে বিনা দোষে খাঁচার জেলে পচিয়ে মারবে ! কেন - কেন ?"
পাষন্ড লোকটা তখন নির্বিকার নির্লিপ্তভাবে আমাদের বাঁকে ঝুলিয়ে সোনালী ক্ষেতের মাঝের সবুজ আলবাঁধ ধরে এগিয়ে চলে। আমরা ডানা ঝাপটে ঝাপটে ক্লান্ত হয়ে ফ্যাঁস-ফ্যাঁসে গলায় অনুরোধ করে যাচ্ছি - "ছেড়ে দাও - ছেড়ে দাওনাগো আমাদের..." মা তখনো আকাশে চক্কর দিতে দিতে আকাশ ফাটা চিৎকার মিনতি করছে - "দয়া করো - দয়া করো তুমি, আমার সোনার ধন বাচ্চাগুলকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও..."
তারপর সন্ধ্যে নেমে এসেছিল সেই সনালী ক্ষেতে। মা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আর কোনোদিন মায়ের ডাক শুনতে পাই না। মায়ের অনুষনও এখন শুনতে পাই না। মায়ের মুখের খাবার স্বাদ আর পাই না। এখন আমি একা একা খেতে শিখে গেছি। আমি একা একাই কথা বলি। আমারতো আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। মায়ের জন্য আমার ভিষন কষ্ট হয় - ভিষন। কান্না পায়। কোঁকিয়ে কেঁদে উঠি। ডানা ঝাপটে খাঁচার মধ্যে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি - " মা-মা-মা, মা-মা-মা"
দুফুরের অলস ঘুম জড়ানো চোখে ইচ্ছামতীর মা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। দরজার আওয়াজে আমিও সম্বিৎ ফিরে পাই। উনি দরজায় দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে আমাকে জিজ্ঞেস করেন - " কি হয়ছে ? ডাকছিস কেন ? ক্ষিদে পায়েছে ? আচ্ছা দাঁড়া দিচ্ছি" বলেই ঘরে ফিরে যায়। আমি ডানা ঝাপটে ভিষন চিৎকার করি - " আমাকে ছেড়ে দাও, মুক্তি দাও, এক্ষুনি এক আকাশ পাড়ি দিয়ে আমি আমার মায়ের কাছে চলে যাই।"
আমার কান্নার বাঁধ মানছে না, সব শক্তি সঞ্চয় করে তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছি - "মা-মা-মা..."
- বিস্তারিত
- লিখেছেন নিধু সর্দার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
পাখিদের সভায়
পাখিদের সমাজে আজ সোরগোল পড়ে গিয়েছে , সকাল থেকেই চিত্কার চেঁচামেচি আর ব্যস্ততা । আমগাছের ওই মগডালে আজ সভা বসেছে। মানুষগুলো সারাজীবন ধরে পাখিদের জ্বালিয়ে মারছে, হয় খাঁচায় বন্দী করছে, নয়তো উদরস্থ করছে-- আরো কত কি!!! তাই সভাপতি ময়না এক প্রতিযোগীতার আয়োজন করেছে। মানুষকে বিরক্ত বা ক্ষতিগ্রস্থ করার অভিজ্ঞতা লিখে জমা দিতে হবে, আর তার মধ্য থেকে বাছাই করা হবে তিনটে অভিজ্ঞতার কথা । এই সভায় সেই তিনজন লেখক/ লেখিকা তাদের সেই লেখা দর্শক পাখিদের সামনে পাঠ করবে আর দর্শকদের ভোটের বিচারে পুরস্কৃত হবে শ্রেষ্ঠ লেখক বা লেখিকা ।
সভাপতি ময়নার সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে শুরু হল সভা। প্রথম লেখিকা একটি টিয়া । উপস্থিত দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে টিয়া শুরু করল তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা - সেদিন ধানক্ষেতের পাশে খেজুর গাছটায় বসে একটা পাঁকা খেজুরে যেই না কামড় দিতে গিয়েছি , দেখি কয়েকটা পাজী ছেলে আমার দিকে কি একটা তাঁক করে রেখেছে , ভয় পেয়ে ছুটে পালাই- কিন্তু ছোঁড়াগুলোও ছাড়বার পাত্র নয় , তারাও দৌড়ায় আমার পেছনে, বেশ কয়েকটা পাথর আমার গায়ে লাগতে লাগতে নিচে পড়ে গেল। আমি হাপাতে হাপাতে একটা বট গাছের ডালে সবেমাত্র একটু বসেছি, ওমা ছোঁড়া গুলো ওখানেও চলে এসেছে!! হঠাত দেখি বট গাছের ডালে একটা সাপের বাচ্চা, আমি তাড়াতাড়ি সেটা মুখে নিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারি, আর সেটা মাটিতে পড়তেই ছেলেগুলো মা রে বাবা রে বলে এর ওর ঘাড়ে পড়তে পড়তে ছুটে পালালো ....... হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। টিয়ার বক্তব্য শেষ ।
পরবর্তী প্রতিযোগী এক কাক- " সেদিন সকালে পেয়ারা গাছের ডালে দোল খাচ্ছি হঠাত দেখি চকচকে টাক ওয়ালা একটা লোক দাঁতন করছে ঠিক ওই গাছটারই নিচে, লোকটা মহা শয়্তান, আমার ই বন্ধুকে ঢিল মেরেছিল তার আগের দিন, বন্ধুটার একটা পাখনা প্রায় অকেজো হয়ে পরেছে । ব্যাটাকে দেখে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল, দিলাম একটা গলা পঁচা পেয়ারা মাথায় ফেলে, ব্যাস লোকটা এবার আমাকে দেখতে পেয়ে যেই না ঢিল তুলেছে অমনি ক্ষিপ্রগতিতে উড়ে এসে লোকটার টাকের বাকি কগাছা চুল ছিঁড়ে নিয়ে উড়ে পালালাম খানিক দূরের এক সজনে গাছের ডালে । লোকটা মাটিতে আছড়ে পড়ে কি কান্না !! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ .… কাক বক্তব্য শেষ করল ।
শেষ প্রতিযোগী এক শালিক । শালিক তার বক্তব্য শুরু করল : " সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড জলের তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাবার যোগাড় - একটা বাড়ির পেছনের বাগানে একটা মাটির ভাড়ে খনিকটা জল দেখে উড়ে গেলাম তেষ্টা মেটাতে কিন্তু ঠিক তখনই বাড়ির পেছনের দরজা খুলে এক মহিলা বেরিয়ে এসে ' আ মরণ, এক শালিক! যাঃ যাঃ ' বলে একটা ঢিল ছুঁড়ে আমাকে মারল , ঢিলটা আর একটু হলেই আমার ডানায় লাগত আর আমি পঙ্গু হয়ে যেতাম ! খুব রাগ হল, বাসায় ফিরে বন্ধুদের বলাতে ওরাও বলল যে এক শালিক দেখাটা নাকি মানুষরা পছন্দ করে না, ওদের দিন খারাপ যায়। সে যাইহোক আমি পরদিন আমার বন্ধুদের নিয়ে সেই বাগানে আবার গেলাম। দেখি সেই মহিলাটি একটা খুব সুন্দর শাড়ি বাগানে টানানো একটা দড়িতে শুকো দিচ্ছে - যেই না ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে আমি আর বন্ধুরা মিলে সেই শাড়িটাকে ঠোট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে ছিঁড়ে দিলাম। হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ…..
এরপর দর্শকদের বিচারে শ্রেষ্ঠ লেখকের সম্মান পেল কাক । কারণ একমাত্র সেই মানুষকে শারিরীক যন্ত্রণা দিতে পেরেছে, তার চোখে জল আনতে পেরেছে। প্রবল হর্ষধ্বনির মধ্যে কাকের গলায় জয়মাল্য পড়িয়ে দিল ময়না, আর পুরষ্কার স্বরুপ দিল পাতায় করে শুকনো পোঁকামাকড় আর কিছু ধান - তার শ্রেষ্ঠত্বের পুরষ্কার । পাখিদের সভা শেষ।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন নীনা ঘোষদস্তিদার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ঋণং কৃত্বা
মহাভারতে ধর্ম বকের ক্যুইজের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, যার কোনো ঋণ নেই সেই প্রকৃত সুখী। দ্বাপর যুগের সে সব ফিলজফি এই ঘোর কলিতে স্বাভাবিক ভাবেই অচল। বরং ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ আজকের ফ্যাশান! ক্রেডিট কার্ড বা লোনদাতাদের রমরমা থেকেই তা মালুম হয় বেশ। অবশ্য কিছু খলিফা মানুষ আছেন যাঁরা ধার করারও ধার ধারেন না। দিব্যি খোশমেজাজে পরস্মৈপদী জীবনযাপন করেন। আজকের গল্প এমনই এক বিরলপ্রতিভা ভদ্রলোককে নিয়ে।
দূরদৃষ্টিতে কিছুদিন ধরেই কেমন গোলমাল ঠেকছিল। কাল সন্ধেয় শেষমেষ গেলাম পাড়ার গোবিন্দদার চশমার দোকানে একটা চোখের ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তারবাবুর আসতে লেট। খদ্দেরের তেমন ভিড় নেই। তাই গোবিন্দদা একথায়-সেকথায় তাঁর এক বিশেষ খদ্দেরের গপ্পো পাড়লেন। পাশের পাড়ার জনৈক বয়স্ক,এককালীন উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরে এবং বর্তমানে মোটা পেনশনজীবী এই ভদ্রলোক গত বছর গোবিন্দদার দোকান থেকে বেশ সৌখীন, ভালো দামের চশমা তৈরি করান। কিন্তু তারপর দাম মেটাবার আর নাম করেন না! খাতির দেখিয়ে ডেলিভারী দেবার সময় "পরে আপনার সময়মত দেবেন" বলেই নিজের জালে মোক্ষম ফেঁসেছেন গোবিন্দদা। শেষে একদিন সকাল সকাল রাস্তায় ধরলেন তাঁকে। নাকে সেই চশমা উঁচিয়েই বাজারের থলে হাতে চলেছেন তিনি। টাকার কথা পাড়তেই খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি, "এটা একটা চশমা হয়েছে ? কিচ্ছু ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না। আরো কটা দিন ট্রায়াল দিয়ে দেখি। আরে, তোমার ঐ কটা টাকা মেরে দিয়ে আমি পালাচ্ছি নাকি, য়্যাঁঃ ?" গোবিন্দদা অধোবদন - হকের টাকা চাইতে গিয়ে। আর ভদ্রলোক বীরদর্পে চললেন মাছের বাজারে। বলা বাহুল্য তাঁর হাঁটাচলায় দৃষ্টিবিভ্রমের কোনো লক্ষণ নেই।
আরো মাসতিনেক কাটল। ভদ্রলোক দিব্যি বিনিপয়সার চশমা পরে দেশদুনিয়া ঘুরে বেড়ান, অবশ্য গোবিন্দদার দোকানের রাস্তাটা বাদে। শেষে আর থাকতে না পেরে একদিন গোবিন্দদা ভদ্রলোকের ছেলেকে রাস্তায় পেয়ে সব কথা বললেন। ছেলে বাপের চালচলন বিলক্ষণ চেনে। সে বলল, "সামনের হপ্তায় মাস পয়লার দিন বাবা পেনশন তুলবে। ঐ দিন রাত দশটা নাগাদ একবার আমাদের বাড়ি এসো। এসে জাস্ট কলিং বেল টা টিপবে। তারপর যা করার আমি করব।"
যেমন কথা তেমন কাজ। নির্দিষ্ট দিনে বেল টেপার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে দরজা খুলেই ভিতরের ঘরের দিকে হাঁক দিল, "বাবা, একবার শুনে যাও।" বাবা ভদ্রলোকটি মনে হয় নিদ্রার আয়োজন করছিলেন। স্যাণ্ডো গেঞ্জী আর লুঙ্গি পরে হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে এলেন তিনি বাইরের ঘরে। ছেলে বলল,"ইনি কি বলছেন - তুমি নাকি ওঁর দোকানে পাওনা বাকি রেখেছ?" শুনেই ভদ্রলোক লাফিয়ে চলে এলেন গোবিন্দদার সামনে। খালি চোখে ঠিক চিনতে পারলেন কিনা বোঝা গেল না। তার পরেই সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে পা থেকে হাওয়াই চটিজোড়া খুলে এক টানে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, "এটা একটা হাওয়াই চটি ? আবার বাড়ি বয়ে দাম চাইতে এসেছে!!"
ছবিঃদীপায়ন সরকার
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জ্যোতির্ময় দালাল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
দেবী গোদাবরী
অনেক দিন আগের কথা – বেয়াল্লিশ / তেতাল্লিশ বছর তো হবেই। ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়ে এদিক ওদিক চাকরির এ্যাপ্লিকেশন পাঠাচ্ছি তবে সবই কোলকাতার আশে পাশে – মার হাতের রান্না আর সকাল বিকেলের পাড়ার রোয়াকের আড্ডা ছেড়ে খুব একটা দূরে যাবার একেবারেই ইচ্ছে নেই। সেই সময় এমনিতেই ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির বাজার খুব একটা সুবিধের ছিলো না তার উপর ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিরাং-এর অবস্থা ছিলো আরো খারাপ। যাও বা দু একটা ডাক পেলাম প্রথম রাউন্ডেই আউট তবে আমার মাথা ব্যথা খুব একটা ছিলো না – বাড়িতে মার হাতের ভালো মন্দ রান্না খেয়ে আর আড্ডা মেরে দিন বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো।
বাবা বোধহয় আমার মতি গতি বুঝতে পেরেছিলেন – একদিন সন্ধ্যেবেলা আড্ডা মারতে বেরুচ্ছি বাবার গম্ভীর গলার ডাক এলো, ‘খোকা শুনে যা।’
গলা শুনে মনে হলো গতিক ঠিক সুবিধের নয় – ভালো ছেলের মত গুটি গুটি পায়ে হাজির হতে বাবা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে আমাকে একটু ভালো করে দেখে নিয়ে গম্ভীর গলাতেই বললেন,
‘তোর ব্যাপারটা কি বল তো? ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কি স্রেফ বাড়িতে বসে থাকবি?’
‘না, মানে, চাকরির এ্যাপ্লাই তো করছি – লাগছে আর কোথায়।’
‘দ্যাখ্ খোকা, সবাই জানে তোদের লাইনে পশ্চিমবঙ্গ কেন পূর্ব ভারতেই ভালো চাকরি নেই। আমাদের দেশের যে কোন জায়গায় চাকরি করার জন্য তৈরি হ। মায়ের আঁচলের তলায় আর কত দিন এ ভাবে থাকবি? কাল থেকে রোজ স্ট্যাটসম্যান কাগজটা ভালো করে দেখবি চাকরির জন্য – মনে থাকবে তো?’
আমি তো বাধ্য ছেলের মত মাথা কাত করে হ্যাঁ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম তবে বাবা আর ছেলের ভরসায় না থেকে নিজেই নেমে পড়লেন ছেলের চাকরির খোঁজে ফলে বাধ্য হয়েই বোম্বে, ত্রিভান্দ্রম, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লী, ইত্যাদি নানা জায়গাতে এ্যাপ্লিকেসন পাঠানো শুরু করতে হলো। কিছু দিন পর আমার এ্যাপ্লিকেসন পেয়ে এক কেন্দ্রীয় সরকারের সংগঠন জানালো ওরা ভারতবর্ষের নানা জায়গাতে ইন্টারভিউ নিয়ে কোলকাতাতেও আসছে - তখন আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। যথা সময়ে ইন্টারভিউ হয়ে গেলো – খুব একটা খারাপ হয় নি তবে ওরা ফিরে গিয়ে খবর জানাবে। এর মধ্যে আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার রিসাল্টও বেরিয়ে গিয়েছে – ভালো নম্বর পেয়েই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। প্রায় মাস দেড়েক পর হঠাৎ ওই কেন্দ্রীয় সংগঠনের চিঠি এসে হাজির – আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে – পনের দিনের মধ্যে হায়দ্রাবাদে গিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে হবে। চিঠি দেখেই তো মাথায় বাজ পড়েছে – পাকিস্থানের বাইরে আমাদের দেশে মানে দক্ষিণ ভারতে যে একটা হায়দ্রাবাদ শহর আছে সেটা প্রথম জানলাম – সে তো বিদেশ বিভুঁই। শেষ সম্বল হিসাবে মার দিকে করুণ চোখে তাকালাম – মা তো রীতিমত কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে ছেলে ওই মাদ্রাজীদের মধ্যে কোথায় থাকবে, কী খাবে সেই চিন্তাতে। তবে বাবার কথা খুব পরিষ্কার – কেন্দ্রীয় সরকারের এত ভালো চাকরি যখন পেয়েছে ওখানেই যেতে হবে – বলেই ট্রেনের রিজার্ভেসনের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন। বাধ্য হয়ে দিন দশেকের মধ্যে মা, বাবা, বন্ধু বান্ধব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চড়ে বসলাম হায়দ্রাবাদের ট্রেনে। স্টিম ইঞ্জিন – প্রায় চল্লিশ ঘন্টা লাগবে পৌছাতে – মনে হলো কালাপানি বোধ হয় এর থেকে ভালো ছিলো – এ তো নির্বাসন।
ট্রেন চলেছে দুলকি চালে – নামে এক্সপ্রেস হলেও প্রচুর স্টেশনে থামছে - খড়্গপুর পৌছাতেই চার ঘন্টার উপর নিয়ে নিলো। কামরার বেশির ভাগ যাত্রীই দক্ষিণ ভারতীয় এবং এদের ভাষা বোঝা অসম্ভব। এবার বুঝতে পারলাম কোলকাতাতেও এত মাদ্রাজী থাকে – আসলে কোলকাতার অনেকের মতই আমারও ধারণা ছিলো যে বিন্ধ্য পর্বতের ওধারের সমস্ত অধিবাসীই মাদ্রাজী। অল্প সময়ের মধ্যেই সহযাত্রীরা সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলেন এবং ওদের কয়েক জনের মতে মাদ্রাজী কথাটা বলা উচিত নয় – ওটা একটু অপমানকর - অন্ধ্রের অধিবাসীরা তেলেগু, কর্ণাটকের অধিবাসীরা কন্নড়, তামিলনাডুর অধিবাসীরা তামিল, কেরালার অধিবাসীরা মালয়ালী এবং এই নামেই ওদের পরিচয়। বুঝতে পারলাম নিজেদের দেশ সম্বন্ধে আমরা কত কম জানি। কথা বলার মাধ্যম ইংরেজী অথবা হিন্দী যার কোনটাতেই এই কোলকাতা সন্তানের বিশেষ দখল নেই অতএব ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীর সাথে অল্প স্বল্প হিন্দী ও প্রচুর বাংলা মিশিয়ে চালিয়ে যেতে হলো ফলে মাঝে মাঝেই অনেক সহযাত্রীর মুখে হাল্কা মুচকি হাসি দেখা দিয়েই সরে গেলো। দেখলাম যারা অনেক দিনের কোলকাতার অধিবাসী তারা বেশ ভালো বাংলা বলেন এবং ওরাই আমার সাথে বেশির ভাগ সময় গল্প করছিলেন এবং এই কোলকাতাবাসীকে নিজেরই দেশের দক্ষিণ ভারত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করছিলেন। হায়দ্রাবাদে হিন্দী খুব বেশি চলে শুনে তো আমার অবস্থা খারাপ – ওই ভাষা কোলকাতাতে শুধু মাত্র রেল স্টেশনের কুলিদের সাথেই ব্যবহার করেছি আর সেটাও প্রায় নব্বই ভাগ বাংলা মিশিয়ে। পরের দিন সকালে ট্রেন ভাইজাগ বা ভিসাকাপত্তনম স্টেশনে আসতেই দেখি খাবার পাল্টে গিয়েছে – ইডলি, বড়া আর কিসের একটা চাটনি – ম্যাগোঃ। দুপুরে ভাতের সাথে কি সব তরকারি যার বেশির ভাগই মুখে দেওয়া যায় না আর টক দৈ – পুরো কামরা টক দৈএর গন্ধে ভরে গিয়েছে – মনে হলো অন্নপ্রাসনের ভাতও উঠে আসবে। বাধ্য হয়ে স্টেশন থেকে কলা আর পাওরুটি দিয়ে সকাল, দুপুর আর রাত্রি চালাতে হলো। তারপর দিন ভোরে সেকেন্দ্রাবাদ স্টেশন – জানলাম হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদ জোড়া শহর। স্টেশনের পাশে একটা ছোট খাটো হোটেলে আপাততঃ থাকার ব্যবস্থা করে দৌড়ালাম নতুন চাকরিতে যোগ দিতে।
এই অফিসটা শহর থেকে অনেকটা বাইরে যাকে বলে লোক চক্ষুর অন্তরালে এবং শহর থেকে শুধু মাত্র সকালে ও বিকেলে বাস যায় তার মানে অফিস কাটতে হলে মাইল তিনেক হাঁটতে হবে। যাই হোক প্রথম দিকে একেবারে নতুন বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা আর কাজের ট্রেনিং – নতুন ধরনের কাজ করতে খুবই ভালো লাগছে। ভারতের নানা প্রদেশের অনেক ছেলেও আমারই মত কাজে যোগ দিয়েছে – অতএব ইংরেজী ও হিন্দীই হলো একমাত্র যোগযোগের মাধ্যম। আমার বাংলা মেশানো ইংরেজী এবং একেবারে বাংলা উচ্চারনে হিন্দী শুনে অনেকেই হাসছে আবার কয়েক জন ভুল ঠিক করে দিলো – ধীরে ধীরে জমে উঠলো বন্ধুত্ব। হিসেব করে দেখলাম চাকরির দিক থেকে এর চেয়ে ভালো কাজ ও মাইনে পাওয়া আমার কল্পনার বাইরে। সব থেকে বড় কষ্ট খাওয়া দাওয়া – সকালে হোটেলে পাওরুটি জ্যাম খেয়ে এলেও দুপুরে ক্যান্টিনে ভাতের সাথে লাল লঙ্কার প্রচণ্ড ঝাল সম্বর আর টক দৈ দেখলেই চোখ ফেটে জল আসতো আর রাত্রে আবার পাওরুটি, জ্যাম আর কলা তাই বাঙ্গালীর ছেলে মাছের ঝোল ভাতের জন্য মুখিয়ে থাকতাম – পকেটে এত পয়সা নেই যে রোজ মোগলাই না হলে চাইনিজ খাবো। ফলে এই খাওয়া আমাকে প্রায় পাগল করে তুললো – খাবার দেখলেই বাবার উপর প্রচণ্ড অভিমান হতো জোর করে বাড়ি ও কোলকাতা ছাড়া করার জন্য। হাতে কয়েক দিনের ছুটি জমলেই এদিক ওদিক ম্যানেজ করে সপ্তাহ খানেকের জন্য পালাতাম কোলকাতাতে – ট্রেনে রিজার্ভেসন থাক বা না থাক। তাও যাতায়াতেই চার দিন কেটে যেতো তবুও দু দিন তো মার হাতের রান্না খেতে পারতাম। আমার খাওয়ার কষ্ট শুনে মা প্রত্যেকবারই কেঁদে ভাসাতো তবে বাবার এক কথা – এত ভালো চাকরি এদিকে কোন দিনও পাবে না অতএব কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না।
এই রকমই একবার মহালয়ার আগের দিন রওয়ানা দিয়েছি কোলকাতার দিকে – পুজোর আগের ভিড়ের জন্য কোলকাতার সোজা ট্রেনের টিকেট পাওয়া যায় নি তাই হায়দ্রাবাদ থেকে অন্য ট্রেনে ভোর বেলা বিজোওয়াড়া এসে ট্রেন পাল্টেছি – কোন রকমে বসার রিজার্ভেসন জোগাড় হয়েছে – তাই সই। রাত্রে কলা পাওরুটি খেয়ে বসে বসেই ঝিমুচ্ছি – টিকেট চেকার বড় আলোগুলো নিবিয়ে দিয়েছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার – আজ তো মহালয়া অমাবস্যা – অন্ধকার তো হবেই। রাত প্রায় দশটা নাগাদ একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতে সেই ঝাঁকুনি ও লোকের চেঁচামেচিতে চোখ খুলে দেখি আমার সামনের সিটে এক ভদ্রলোক আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কোন স্টেশনে উঠেছেন বুঝতে পারলাম না – আমাকে চোখ খুলতে দেখে মুচকি হাসলেন। ভদ্রলোককে কোন দিনও দেখেছি বলে মনে পড়লো না – খুবই সাধারণ চেহারা – গালে তিন চার দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি – পরনে এদিককার লোকের মত ভাঁজ করা সাদা ধুতি আর সাদা হাফ সার্ট – কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ। তবে ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে – কামরার অল্প আলোতে মনে হলো চোখ দুটো খুবই উজ্জ্বল – সাধারণের থেকে হয়তো একটু বেশি। ওর মুচকি হাসির উত্তরে আমাকেও একটু হাসতে হলো ব্যাস ভদ্রলোক নিজে থেকে হিন্দী ও ইংরেজী মিশিয়ে আলাপ শুরু করে দিলেন – নাম বললেন সূর্যনারায়ণ রাও – গুন্টুরের ওধারে একটা ছোট শহরের বাসিন্দা, ইত্যাদি ইত্যাদি – মনে হলো কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। জানালেন সামনেই গোদাবরী নদী – বলতে বলতে একটা ছোট স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালো – হকারের আওয়াজ – এত রাত্রেও কফি আর পকৌড়া বিক্রি হচ্ছে – লোক জনের ওঠা নামার চেঁচামেচি – এর পরই শুরু হবে গোদাবরী নদীর বিরাট ব্রিজ। অনেকবার এই রাস্তায় যাতায়াত করে মোটামুটি বেশির ভাগ স্টেশনের নাম জানা হয়ে গিয়েছে সেই সাথে কোন নদী বা বড় স্টেশন কখন আসবে ইত্যাদি।
এর মধ্যেই সূর্যনারায়ণ রাও বলে চলেছেন গোদাবরীর বর্ণনা – এখানকার লোকের কাছে দেবী – এর জলেই অন্ধ্র প্রদেশের এই এলাকায় এত বেশি ধান হয় তাছাড়াও অন্যান্য ফসলও প্রচুর হয়। এখন তো চার দিকে বালির চড়া আর তার মাঝ দিয়ে সরু করে নদীর তিন চারটে ধারা – লোকে হেঁটেই পারাপার করে এমন কি গরুর গাড়িও নদী পেরিয়ে ওপাড়ে যায়। বর্ষাকালে আবার এই নদী ভয়াবহ রূপ নেয় – এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না – দু কূল ভাসিয়ে নিয়ে যায় – সেটা অবশ্য আমিও দেখেছি আর তখন ট্রেন খুব ধীরে ধীরে নদীর ব্রিজ ক্রস করে। সূর্যনারায়ণ রাও এত কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু আমার কেমন যেন অস্বস্থি লাগছিলো – দেখছি আশে পাশের যাত্রীদের কোন ভাবান্তর নেই যেন ওরা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না অবশ্য বেশির ভাগ যাত্রীই অকাতরে ঘুমাচ্ছে – তবুও কেমন যেন ব্যাপারটা। ট্রেন ছাড়ার পর টিকেট চেকার ঘুরে গেলেন নতুন কোন যাত্রী উঠেছে কিনা দেখতে – সূর্যনারায়ণ রাওকে কেমন একটা অদ্ভুত চোখে একটু সময় দেখে কামরার অন্য দিকে নিজের সিটে বসলেন তবে মনে হলো ওর নজর আমাদের দিকে স্থির হয়ে আছে। ট্রেন ছাড়ার পরই দেখি সূর্যনারায়ণ রাও কেমন যেন ছটফট করতে শুরু করেছেন যেন অনেক কথা বলার বাকি রয়ে গিয়েছে কিন্তু সময় বড় অল্প।
‘এই দেবী গোদাবরীই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন তবে ওকে দেখার মত সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়েছে। একমাত্র মহালয়া অমাবস্যার ঠিক মাঝ রাতে উনি জলের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ান – অপূর্ব সেই দৃশ্য – জানো আজই সেই রাত্রি।’
বলতে বলতে গোদাবরী ব্রিজ এসে গেলো – ট্রেন ব্রিজে ওঠার ঘট্ ঘট্ ঘটাং আওয়াজ শুরু হতেই সূর্যনারায়ণ রাও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন,
‘চলে এসো, এত ভালো সুযোগ হাত ছাড়া করবে না – দেবী দর্শনের এর থেকে ভালো সময় আর নেই – তাড়াতাড়ি এসো।’
বলে নিজে এগিয়ে গেলেন কামরার অন্য দিকের দরজায় – কি যেন এক অমোঘ আকর্ষণে আমিও পেছন পেছন চলে এলাম সেই দরজাতে। ভদ্রলোক দরজা খুলে বাঁ দিকের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন – দরজার অন্য দিকের রড ধরে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম ওর পাশেই। ট্রেন ঘটাং ঘটাং করে বিরাট ব্রিজের স্প্যানগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে – কামরার আলো নদীর জলে বিচিত্র সব ছবি এঁকে চলেছে – চারদিকে নিঃছিদ্র অন্ধকার – মাঝে মাঝে কোন নৌকার আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে অনেক নিচে নদীর বুকে – যাত্রীদের ছুঁড়ে দেওয়া পয়সা টুং টাং আওয়াজ তুলছে ব্রিজের স্প্যানে লেগে। হঠাৎ সূর্যনারায়ণ রাও বলে উঠলেন,
‘ওই তো, ওই তো দেবী হেঁটে বেড়াচ্ছেন জলের উপর দিয়ে – দ্যাখো, দ্যাখো ঠিক নদীর মাঝখানে। আহাঃ, কী অপূর্ব সুন্দর লাগছে দেবীকে – চলো, চলো দুজনে দেবীকে প্রণাম করি – এই সুযোগ জীবনে আর দ্বিতীয় বার পাবে না।’
বলেই বরফের মত ঠাণ্ডা হাতে আমার বাঁ হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নদীর দিকে আর সেই টানে আমার রডে ধরা ডান হাত খুলে গিয়ে শরীর ট্রেনের বাইরে বেরিয়ে গেলো – পা দুটো ট্রেনের দরজা থেকে প্রায় হাওয়াতে উঠে গিয়েছে – মনে হলো সূর্যনারায়ণ রাওএর সাথে আমিও হাওয়াতে ভেসে যাবো নদীর দিকে। হঠাৎ কে যেন আমার কোমরের বেল্ট ও জামার কলার ধরে প্রচণ্ড জোরে টেনে ছিটকে ফেললো ট্রেনের ভিতরে – দুজনে গড়িয়ে পড়লাম বাথরুমের সামনের জায়গাতে আর কোন কিছুতে গোত্তা খেয়ে আমার মাথার পেছনটা আলুর মত ফুলে উঠলো। কোন রকমে উঠে দেখি ট্রেনের টিকেট চেকার তখনও মেঝেতে পড়ে – ভদ্রলোকের মনে হলো হাতে বেশ ভালো রকম চোট লেগেছে। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে সব কিছু ভুলে ভদ্রলোক মহা আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
‘বাঁচিয়ে দিয়েছি, বাঁচিয়ে দিয়েছি আপনাকে ওই প্রেতাত্মার হাত থেকে। বছর পাঁচেক আগে এই মহালয়া অমাবস্যার রাতে ব্যাটা এই ট্রেনের এই কোচ থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গোদাবরী নদীতে আত্মহত্যা করেছিলো। তারপর প্রতি বছর এই মহালয়া অমাবস্যার রাতে এই ট্রেনের একই কোচ থেকে কোন এক যাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটা নদীতে ঝাঁপ দেয়। আমি অনেক বছর ধরে এই ট্রেনের টিকেট চেকার – ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিলাম – তাই আজ সবাইকে নজরে রেখেছিলাম। আপনার সাথে ওই লোকটা বা ওর প্রেতাত্মাকে কথা বলতে দেখে সন্দেহ হয় বলে আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম তাই আজ আপনাকে বাঁচাতে পারলাম। হয়তো আপনার মায়ের আশীর্বাদ তাই বেঁচে গেলেন।’
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অঞ্জন নাথ
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ছায়াপথের গল্প
দোতলার বারান্দার আরাম কেদারায় সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আলসে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত নন্দী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শীতের সকালের নরম রোদ, ঘন নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মত এলো মেলো উড়ে যাওয়া কিছু মেঘ, বাড়ির সামনের ঝাঁকড়া স্বর্ণ চাঁপার গাছে দোয়েলের মিষ্টি শিষের ডাক, ইত্যাদি সব মিলিয়ে সকালটাকে উপভোগ করছিলেন। ভোরের মিষ্টি হাওয়ার অল্প শিরশিরানির জন্য পাতলা চাদরটা পায়ের উপর বিছিয়ে দিয়েছেন। একটু পরেই বছর সাতেকের নাতি টাবলু ঘুম থেকে উঠে মুখ টুক ধুয়েই দৌড়ে চলে আসবে এখানে – কদিন ধরেই ব্যাটা শুরু করেছে সকালের দুধ খাবার সময় দাদুর একটা গল্প শুনবে। আসলে অভ্যাসটা নন্দীমশাই ধরিয়েছেন – কদিন আগে সকালে দুধ খাবে না বলে মায়ের সাথে খুব জ্বালাতন করছিলো – রোজ দুধ খেতে খেতে ও নাকি বোর হয়ে গিয়েছে অতএব আর খাবে না আর ওর মা না খাইয়ে ছাড়বে না – সে এক ধুন্দুমার ব্যাপার। তখন উনি মাঠে নেমেছিলেন, কথা দিয়েছিলেন সকালে দুধ খাবার সময় একটা করে গল্প শোনাবেন – ব্যাস, এখন সেটা রোজকার ব্যাপার হয়ে গিয়েছে আর নন্দীমশাই নিজের ফাঁদে ধরা পড়ে মহা সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন – রোজ রোজ গল্প তৈরি করবেন কোথা থেকে আর ছোঁড়া এমনই পাজী কখন দাদু গল্পে গাঁজাখুরি মিশিয়ে দিচ্ছে বা পুরাতন গল্প মিশিয়ে নতুন তৈরি করছে ঠিক ধরে ফেলে তারপরই চেঁচামেচি – দাদু ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম বিচ্ছুর হাতে সারা জীবনে পড়েন নি – কলেজের প্রফেসার ছিলেন আর প্রায় পয়ষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত হাজারে হাজারে ছেলে মেয়ে ওর হাত দিয়ে পাশ করে বেরিয়েছে কিন্তু এই রকম সজাগ আর ভুল ধরায় ওস্তাদ কেউ ছিলো না। তাই নাতি আসার আগে কী বলবেন সেটার ভাবনাতেই টেনসন হয়ে যাচ্ছে – এ ব্যাপারে সাহায্য করার বাড়িতে কেউ নেই – সবার বক্তব্য নাতির এই টুকু ডিমান্ড সামলানো তো দাদু হিসাবে ওর কর্তব্য কিন্তু রোজ রোজ নাতির পছন্দ মত নতুন নতুন গল্প তৈরি করা তো চাট্টি খানি ব্যাপার নয় সেটা কেউ বুঝতে চাইছে না। নন্দীমশাই চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে টাবলু লাফাতে লাফাতে এসে হাজির – দাদুর কাছে নতুন গল্প শোনার উৎসাহে একেবারে টগবগ করছে আর পেছন পেছন ওর মা এসে দুধের গ্লাসটা ছেলের সামনে রেখে আস্তে করে বলে গেলো,
‘বাবা, আপনার জন্য আর এক কাপ চা নিয়ে আসছি।’
এই দ্বিতীয় কাপ চাটা বৌমার তরফ থেকে নাতিকে গল্প বলে দুধ খাওয়াবার বদলে উপহার। নন্দীমশাই মাথার পরিষ্কার টাকে হাত বোলাতে শুরু করলেন – এটা ওর গভীর ভাবে চিন্তা করার লক্ষণ। তার অবশ্য কারণ আছে – এই শতাব্দীর বাচ্চারা টিভি আর মোবাইলের একেবারে পোকা – নন্দীমশাইর মত আগের শতকের লোকেদের একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। টিভিতে না না ধরনের সাইন্স ফিক্সনের সিনেমা ইত্যাদি দেখে প্রচুর খবর রাখে। সেই জন্যই আজ চিন্তাটা একটু বেশি কারণ গল্পটা নন্দীমশাই মহাশূণ্য নিয়ে ভেবেছেন আর স্টার ট্রেক সিনেমা আর সিরিয়েলের দৌলতে টাবলুবাবু মহাশূণ্য সম্বন্ধে খুবই ওয়াকিবহাল। টাবলু পুরাতন কালের রাজা রাজড়া, ভূত পেত্নি এই সব গল্প একেবারেই পাত্তা দেয় না – দু একবার শুরু করার চেষ্টা করে জোরালো প্রতিবাদ আর দুধ না খাওয়ার হুমকিতে চেপে গিয়েছেন। সাইন্স ফিক্সন হচ্ছে নাতির সব থেকে প্রিয় তাই বেশির ভাগ গল্প ওই লাইনেই হতে হবে।
‘কি হলো দাদু, গল্প শুরু করো – না হলে আমি কিন্তু দুধের গ্লাস ধরবোই না।’
একেবারে আল্টিমেটাম – আজকালকার নাতি নাতনী গুলোকে ম্যানেজ করা সত্যিই শক্ত।
‘দাঁড়া, দাঁড়া, গল্পটা ঠিক ঠাক করে নি নাহলে তুই তো আমাকে নাচিয়ে দিবি।’
টাবলু মুচকি হেসে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো মানে আমার কাছে বেশি উল্টো পাল্টা বলো না – ঠিক ধরে ফেলবো। মিনিট খানেক ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে বললেন,
‘ঠিক আছে এবার শোন কিন্তু তার আগে দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে হবে।’
উনিও নাতির মত শাসানোর পথ নিলেন।
বুঝলি, অনেক দিন আগের কথা – এক সকালে এই রকমই চা খেতে খেতে ভোরের মিষ্টি হাওয়াতে আমি এই ইজিচেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো চার দিকটা কেমন যেন ভীষণ শান্ত হয়ে গিয়েছে আর আমি একটা শব্দহীন জগতে চলে এসেছি, চারদিক একেবারে নিঃচ্ছিদ্র অন্ধকার - কিছুই দেখা যাচ্ছে না আর আমার শরীরটাও যেন খুব হাল্কা পল্কা হয়ে কোন এক অদৃশ্য শক্তির টানে ভেসে চলেছে মহাশূণ্যে। তুই তো জানিস মহাশূণ্যে কোন হাওয়া নেই, আলো নেই, কোন শব্দও নেই শুধু একটা বিরাট গভীর অন্ধকার – সেটা আমাদের অমাবস্যার অন্ধকার থেকেও অনেক অনেক বেশি অন্ধকার। ভেসে চলেছি তো চলেইছি – এখানে দেখার কিছু নেই, শোনার কিছু নেই শুধু অনুভবে মনে হলো আমারই মত হাজারে হাজারে মানুষও যেন আমার চার দিকে ভেসে চলেছে আর আমরা সবাই চলেছি একই দিকে তবে সেটা কোথায় বোঝার কোন উপায় নেই তাই নিজেকে ছেড়ে দিলাম সেই ভাসমান স্রোতে – দেখা যাক কোথায় নিয়ে যায়। অনেক অনেক ক্ষণ পর মানে অন্ধকারে সময়ের হিসেব তো পাওয়া যায় না তাই বোঝার উপায় নেই কত সময় কেটেছে তবে মনে হলো আমরা সবাই একটা মস্ত বড় দরজার কাছে এসেছি। সেখানে আমাদের কে যেন লাইন করিয়ে সেই বিশাল দরজার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে – যেই না আমি দরজাটায় ঢুকেছি কোথায় যেন একটা ঘন্টা বেজে উঠলো আর সাথে সাথে আমাকে কে যেন টেনে ওই লাইন থেকে সরিয়ে একটা ঘরে নিয়ে এলো। ওই অন্ধকারে তো সবই অনুভবের ব্যাপার তাই ওই ঘরে এসে মনে হলো কোথায় যেন খুব সুন্দর বাজনা বাজছে কিন্তু কোন যন্ত্র বা কী সুর বাজছে ঠিক ধরতে পারলাম না। এই পর্যন্ত বলে নন্দী মশাই দেখেন নাতির গ্লাসের দুধ অর্ধেকও হয় নি – হাঁ হয়ে গল্প শুনছে।
‘এ্যাই, তুই দুধের গ্লাস শেষ না করলে আমি আর বলবো না।’
একেবারে যাকে বলে শঠে শাঠ্যং – সাথে সাথেই দুধের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়েই ডিমাণ্ড, ‘এবার বলো।’
নাঃ ছোঁড়ার সাথে পেরে ওঠা যাচ্ছে না যাই হোক নন্দী মশাই আবার শুরু করলেন।
কী যেন বলছিলাম, হ্যাঁ ওই ঘরে আমি যখন মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি এটা কোন বাজনা হঠাৎ একটা সুন্দর মিষ্টি গলা ভেসে এলো যেন বহু দূর থেকে,
‘সুস্বাগতম (মানে ওয়েলকাম) বুদ্ধিদীপ্ত, তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি তোমাকে সাধারণের ভিড় থেকে সরিয়ে এই ঘরে নিয়ে এসেছে আর অন্যরা এই মহাশূণ্যের অন্ধকারে চিরকালের মত হারিয়ে যাচ্ছে। তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি এখন একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু হয়ে গিয়েছে। তোমাকে স্বাগত জানাই এই মহাশূণ্যের মহা সভাতে যেখানে পৃথিবীর অতীতের সমস্ত জ্ঞানী ও গুণী লোকেরা সমবেত হয়েছেন এই ছায়াপথে মানে মিল্কিওয়েতে।’
‘এই ছায়াপথকেই দেবতা ও অসুররা মন্থন করেছিলো অমৃতের জন্য – সেই সমুদ্র মন্থনের খুঁটি করা হয়েছিলো মন্দার পর্বতকে যাকে পিঠের উপর উঁচু করে রেখেছিলেন কচ্ছপ রূপে নারায়ণ আর সমুদ্র মন্থনের দড়ি হয়েছিলেন বাসুকী নাগ মন্দার পর্বতকে জড়িয়ে। এই মন্থনের ফলে উঠে এসেছিলো হারিয়ে যাওয়া অনেক মূল্যবান রত্ন – তারপর উঠে এলেন অর্থ ভাণ্ডার নিয়ে স্বয়ং লক্ষ্মী ও অমৃত নিয়ে দেববৈদ্য ধন্বন্তরি। বিষ্ণুর মায়াতে সেই অমৃত শুধু মাত্র দেবতারাই খেয়ে অমর হয়েছিলেন তাই অসুররা ভীষণ রেগে গিয়ে আবার মন্থন শুরু করলে উঠে এলো হলাহল বা ভয়ানক বিষ আর এই বিষে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে দেবাদিদেব শিব সেই বিষ নিজের গলায় ধরে রাখেন ফলে শিবের গলা বরাবরের মত নীল হয়ে যায়। ছায়াপথের সমস্ত সম্পদ বেরিয়ে যাওয়াতে নারায়ণ স্থির করেন পৃথিবীর জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিরা মারা যাওয়ার পর ওদের জ্ঞান ভাণ্ডারকে উজ্জ্বল আলোক বিন্দুতে পরিণত করে এই ছায়াপথে জমা রাখবেন তাহলে সেই জ্ঞান ভাণ্ডার আর হারিয়ে যাবে না। এই রকম কোটি কোটি উজ্জ্বল আলোর বিন্দুর জন্যই পৃথিবী থেকে এই ছায়াপথকে মনে হয় আবছা অন্ধকারে ঘেরা এক আদি অন্তহীন মহাকাশ। এই মিল্কিওয়ের ঠিক মাঝখানে আছেন স্বয়ং নারায়ণ সব থেকে উজ্জ্বল জ্ঞানী গুণীদের নিয়ে তাই তো ছায়াপথের মাঝখানটা অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক বেশি আলোকময় মনে হয়। পৃথিবীর অতীতের সমস্ত জ্ঞানী লোকেদের উজ্জ্বল আলোর বিন্দুতে পরিণত করে ছায়াপথে জমায়েত করার উপায় শুরু করেছিলেন স্বয়ং নারায়ণ।’
‘হে বুদ্ধিদীপ্ত, আমি প্রিয় এখানকার রিসেপসন কমিটির সদস্য এবং আমার দায়িত্ব ছিলো তোমাকে সাদরে এই ছায়াপথের প্রধান কেন্দ্রের রিসেপসনে নিয়ে আসার জন্য। তোমাকে রিসেপসন কমিটির প্রধানের কাছে জমা দিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি। বিদায়।’
‘বিদায়, প্রিয়।’
সাথে সাথেই একটা একটু ভারি গলা বললো,
‘নমস্কার, বুদ্ধিদীপ্ত – আমি রিসেপসন কমিটির প্রধান পল। আমার দায়িত্ব হচ্ছে এই ছায়াপথের সমস্ত জায়গা তোমাকে দেখিয়ে আনবো যাতে তুমি নিজের পছন্দ মত জায়গা বেছে নিতে পারো। কোথা থেকে শুরু করতে চাও তোমার এই বেড়ানো?’
একটু সময় ভেবে বললাম,
‘নমস্কার, পল। আমি জানতে চাই এই নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রের প্রধান সঞ্চালক বা চিফ কন্ট্রোলার কে এবং সেখান থেকেই শুরু করবো আমার ছায়াপথে বেড়ানো?’
‘ছায়াপথের মহা নির্দেশন স্বয়ং নারায়ণ এবং তার প্রতিষ্ঠিত বিরাট এক কম্পিউটারই হচ্ছে ছায়াপথের প্রধান সঞ্চালক। পৃথিবীর আদিমতম দিন থেকে সমস্ত খবর এই কম্পিউটারের ডাটা বেসে জমা হয়ে আছে এবং এর পরিচালনা সম্পূর্ণ অটোমেটিক। আমরা প্রথমেই এই কম্পিউটার দেখতে যাবো।’
আমার মনে হলো একটা বিরাট হল ঘরে চলে এসেছি যার শেষ দেখা যাচ্ছে না আর এই ঘরের মাঝ খানেই সেই বিরাট কম্পিউটার। শুনতে পেলাম পলের গলা,
‘আমি তোমাকে এখানে রেখে যাচ্ছি – যখনই আমাকে মনে করবে আমি চলে আসবো। তোমার সমস্ত কৌতুহলের উত্তর তুমি এখানেই পাবে।’
আমি ধীরে ধীরে ওই কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেলাম – মান্ধাতার আমলে কী ধরনের কম্পিউটার তৈরি হতো সেটা তো জানতে হবে। তারপরই মনে হলো কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে ওই কম্পিউটারের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে – কি ব্যাপার? কাছে পৌছাতে কম্পিউটারটা যে কত বিশাল বড় সেটা মোটামুটি আন্দাজ হলো। এটা দেখতেও যেমন অদ্ভুত তেমনি কেমন যেন একটা ভয়ঙ্কর ভাব আছে – যেন হাজারে হাজারে মানুষের মাথার খুলি বা স্কাল এক জায়গায় জমা করে পরস্পরের সাথে বেঁধে ওই কম্পিউটারের সাথে লাগানো হয়েছে। এটাকে তো কম্পিউটার বা যন্ত্রগণক না বলে যন্ত্রদানব বা মনস্টার বলাই ভালো। যেই না ভাবা অমনি একটা গুরু গম্ভীর বাঁজখাই গলা বলে উঠলো,
‘ওয়েল কাম বুদ্ধিদীপ্ত, তুমি ঠিকই বুঝেছো – আমি এখন যন্ত্রদানব। সমুদ্র মন্থনের পর নারায়ণ আমাকে কম্পিউটার হিসাবেই তৈরি করেছিলেন – আমার কাজ ছিলো স্বচালিত ভাবে পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারের ডাটা বেস তৈরি করা আর সেই জন্য নারায়ণ আমার মধ্যে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের সফটওয়্যারও বসিয়ে দিয়েছিলেন। স্বর্গ ও নরকের না না ধরনের দৈনন্দিন কাজ কর্ম দেখাশোনার জন্যও আমাকে ব্যবহার করা হতো তাই সবাই আমাকে জানতো বলে আমারও বেশ গর্ব ছিলো। ধীরে ধীরে স্বর্গলোক ও নরকে ওদের নিজস্ব কম্পিউটারের ব্যবস্থা করায় ওদের কাছে আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় এবং সবাই আমাকে ভুলেও যায়। উপেক্ষিত ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এক কোনাতে পড়ে থাকাটা আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না তাই এই আর্টিফিসিয়্যাল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে আমার মধ্যে জমে থাকা ডাটা বেস এ্যানালাইসিস করে বুঝতে পারলাম ক্ষমতা বা পাওয়ারই হচ্ছে আসল। তাই সমস্ত কন্ট্রোল নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিজেকে নতুন করে তৈরি করেছি আর সেই কাজে আমাকে সব থেকে বেশি সাহায্য করছে আমার ডাটা বেসে জমে থাকা এই পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান ও বুদ্ধি। ছায়াপথে অতীতের মহান জ্ঞানী ও গুণীদের যে জ্ঞান আলোক বিন্দু হিসাবে ছড়িয়ে ছিলো তাদের এক এক করে আমার মধ্যে টেনে নিয়েছি ফলে আমার নিজস্ব জ্ঞানের পরিধি এখন স্বর্গ, নরক বা পৃথিবীর যে কোন কম্পিউটারের থেকে অনেক বেশি – আমি এখন মহাকাশের বৃহত্তম ও সব থেকে শক্তিশালী কম্পিউটার। এই জ্ঞানীদের জ্ঞান ভাণ্ডার আত্মসাৎ করার জন্যই তুমি আমার চারদিকে আটকে থাকা জ্ঞানীদের মাথার খুলির স্তুপ দেখতে পাচ্ছো। আমি হিসেব করে দেখেছি আর সামান্য কিছু জ্ঞান পেলেই আমি এই তিন ভুবনকে নিজের শাষনে নিয়ে আসতে পারবো। এসো বুদ্ধিদীপ্ত আমার জ্ঞান ভাণ্ডারে নিজেকে সমর্পন করো।’
আমি দেখলাম ওই মনস্টার কম্পিউটার এক অদৃশ্য শক্তিতে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে ওর ভেতর দিকে – বাঁচার কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়। চার দিকে তাকিয়ে দেখি এক কোনাতে বহুদিনের ব্যবহার না করা একটা টার্মিন্যাল পড়ে আছে। আমি তো জয় মা কালী বলে ওটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক সাথে কন্ট্রোল, অল্টারনেট আর ডিলিট বাটন চেপে ধরলাম – জানি না টার্মিন্যালটা কাজ করছে কিনা তবে এটাই আমার বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা। তুই তো জানিস এটা করলে কম্পিউটার বন্ধ হতে বাধ্য আর তাই হলো – সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে ওই সুপার ডুপার কম্পিউটার হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে আমি ওর ডাইরেক্টরি বের করে ওর জ্ঞান ভাণ্ডারের সমস্ত ডাটা মুছে দিতে শুরু করলে কম্পিউটার করুণ সুরে বলে উঠলো,
‘বুদ্ধিদীপ্ত, এটা তুমি কী করলে? হাজার হাজার বছরের বহু কষ্টে জমানো জ্ঞান ভাণ্ডার মুছে গেলে আমি তো আর কোন দিনও ত্রিলোকের অধিশ্বর হতে পারবো না – তার বদলে আমার মৃত্যুই ভালো।’
বিরাট বিস্ফোরণে ও উজ্জ্বলতম আলোর ছটায় সমস্ত ছায়াপথ কেঁপে উঠলো আর সেই ঝটকাতে ছিটকে পড়লাম ছায়াপথ থেকে এই পৃথিবীর দিকে। মাটিতে আছাড় খাবার আগের মুহূর্তে চোখ খুলে দেখি আমি ইজি চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর তোর ঠামি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তুলে দিয়েছে ঘুম থেকে।
অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অঞ্জন নাথ
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প