বিশ্বকবি রবি ঠাকুর
সে আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। কলকাতার চিতপুর এলাকার ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবথেকে ছোট ছেলে ছিল রবি। ছোট্ট রবির ইস্কুলে যেতে বা বাঁধাধরা নিয়মে পড়শোনা করতে কিছুতেই ভাল লাগত না। বরং বাইরের দিকের বারান্দার এক কোনে পড়ে থাকা ঠাকুরমার আমলের পাল্কিটা ছিল অনেক বেশি পছন্দের জায়গা। তার ভেতরে ঢুকে বসলেই রবি চলে যেত অন্য এক জগতে। সেখানে সে যেন একলা দ্বীপে আটকা পড়া রবিন্সন ক্রুসো, কখনও বা সে চলে যাচ্ছে বিশ্বনাথ শিকারীর সঙ্গে বাঘ ধরতে, আবার কখনও সে চলেছে উত্তাল নদীর ওপর আব্দুল মাঝির সঙ্গে কুমির ধরার গল্প শুনতে শুনতে...। আরেকটা খেলা খেলে চলে যেত ছুটির দিনের অনেক সময়। বারান্দার রেলিংগুলো হত ছাত্র, আর পড়াশোনা করে না বলে রবি মাস্টার দিত তাদেরকে আচ্ছা করে বকুনি, এমনকি মাঝে মাঝে পিটুনিও পড়ত তাদের পিঠে ।
কি ভাবছ? আরে- এরকম তো আমিও মাঝে মাঝেই পড়াতে বসি আমার পুতুলগুলোকে! পড়া না পারলে কত বকেও দি, ঠিক স্কুলের ম্যাডামের মত...
কিশোর রবি
অবশ্য রবি যে একেবারেই পড়াশোনা করত না তা কিন্তু নয়। রবি স্কুলে নিয়মিতই যেত, আর বাড়িতেও নানারকম বই পড়ত। তার সাথে চলত গান শেখা, আর নিয়ম করে কুস্তি শেখা...সারাটাদিন ছিল একদম রুটিন বাঁধা, প্রায় তোমারি মতন। কিরকম শুনবে?
শীত হোক কি গ্রীষ্ম, দিনের আলো ফোটার আগেই ঘুম থেকে উঠে কুস্তি লড়তে হত শহরের ডাকসাইটে কুস্তিগীর কানা পালোয়ানের সাথে। সেখান থেকে ফিরে এক ডাক্তারি পড়া ছাত্রে কাছে শিখতে হত মানুষের হাড় কিভাবে চিনতে হয় -একেবারে একটা আস্ত কঙ্কাল নেড়েচেড়ে! সকাল সাতটায় আসতেন নীলকমল মাস্টার, শেখাতেন অঙ্ক; সঙ্গে 'সাহিত্য' আর 'প্রাকৃত বিজ্ঞান'। এছাড়া মাঝে মাঝেই অন্য অনেকে নানা বিষয়ে পড়াতে আসতেন। ন'টা বাজলে স্নান আর সাড়ে ন'টায় ভাত খাওয়া। দশটায় পাল্কি-গাড়ি চেপে স্কুলে যাওয়া। সাড়ে চারটের পর স্কুল থেকে ফিরে এসে অভ্যাস করতে হত জিমনাসটিক। তারপর আসতেন ছবি আঁকার মাস্টারমশাই। সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠলে ইংরাজি পড়াতে আসতেন অঘোর মাস্টার। সেই পড়াশোনা শেষ হতে না হতেই চোখ ঢুলে আসত ঘুমে...
এরকম ভাবেই ছোটবেলাটা কেটেছিল ভারতবর্ষের জাতীয় কবি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছোটবেলার এই সব ঘটনাগুলিকে মনে রেখে আর শাসনে বাঁধা নিয়ম কানুনগুলোকে নিয়ে নানারকমের সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে তাই শুরু হয় অন্য রকম পড়াশোনা- গাছের নিচে, খোলা মাঠের মধ্যে, চারিপাশে প্রকৃতিকে নিয়ে।
তুমি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা পড়েছ? যদি তুমি স্কুলে 'সহজ পাঠ' পড়, তাহলে তো কিছুটা তুমি তাঁকে চিনেই গেছ। আবার 'শিশু' এবং 'শিশু ভোলানাথ' নামের দুটি সঙ্কলনে যেসব কবিতাগুলো আছে, সেগুলি যেন সব একদম তোমারি মনের কথা। একটা কবিতার একটুখানি শুনবে নাকি?-
শেষ যদি হয় চিরকালের মতো,
তখন স্কুলে নাই বা গেলেম; কেউ যদি কয় মন্দ
আমি বলব,'দশটা বাজাই বন্ধ।'
তাধিন তাধিন তাধিন।
(সময়হারা, শিশু ভোলানাথ, পৃঃ২৫)
-কি, এক্কেবারে মনের কথা না? সত্যি যদি সময় গোনাটা শেষ হয়ে যায়, আর স্কুলে না যেতে হয়, তাহলে কেমন হয়?
খালি ছোটদের জন্যই কবিতাই না, বড়দের জন্যও কত কিছু লিখেছেন তিনি - গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক। খুব ভাল ছবি আঁকতে পারতেন তিনি। এছাড়া লিখেছেন প্রায় কয়েক হাজার গান, যেগুলি পরিচিত 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' নামে। তার মধ্যে কয়েকটা অন্ততঃ গান তো তুমি জানই -
'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি...' বা 'ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল...'। কবিগুরুর লেখা দুটি গান - "জন-গণ-মন-অধিনায়ক-জয় হে" আর "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি" -যথাক্রমে ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এরকম আরো অনেক অনেক গান আছে, আর জানো কি - অনেক গানের পেছনেই একটা করে গল্প আছে। ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয়, তখন রাখী উতসব পালন করার জন্য কবিগুরু লিখেছিলেন -
পূণ্য হউক, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক হে ভগবান..."
আবার ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ডের রানী তাঁকে "নাইট" উপাধি দেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে যখন বৃটীশ সরকার পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে অনেক নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলেন, তার প্রতিবাদ করে কবিগুরু সেই "নাইট" উপাধি ফিরিয়ে দেন। আর লেখেন একটি গান -" এ মনিহার আমায় নাহি সাজে..."
কবিগুরুর এই চেহারাটাই আমরা বেশি চিনি
১৮৬১ সালের ৭ই মে, বাংলার ২৫শে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। তাই প্রতি বছর এই দিনটিকে আমরা নানারকম অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে কবিগুরুকে স্মরন করি।
শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রিরা ভালবেসে রবি ঠাকুরকে ডাকতো 'গুরুদেব' নামে। আর যখন তিনি 'গীতাঞ্জলি' বইটির জন্য এশিয়া মহাদেশের থেকে প্রথম সাহিত্যে 'নোবেল' পুরষ্কার পেলেন ১৯১৩ সালে, তখন থেকে তিনি হয়ে গেলেন 'বিশ্বকবি'।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভাল করে জানতে হলে তাঁর লেখা পড়তে হবে। সব লেখা তো আর এখনি পড়ে বুঝতে পারবে না, কিছু কিছু লেখা বড় হয়েই পড়তে হবে। বরং এখন তোমাকে আরেকটা মনের মতন কবিতার হদিশ দিয়ে দিইঃ
আসে তাড়াতাড়ি,
এদের ঘরে আছে বুঝি
মস্ত হাওয়া -গাড়ি?
রবিবার সে কেন , মা গো,
এমন দেরি করে?
ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে
সকল বারের পরে।
আকাশ-পারে তার বাড়িটি
দূর কি সবার চেয়ে?
সে বুঝি, মা, তোমার মতো
গরিব-ঘরের মেয়ে?
(রবিবার, শিশু ভোলানাথ, পৃঃ২৩)
এই কবিতার বাকিটুকু নাহয় নিজেই খুঁজে পড়ে নাও না, কেমন?
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য
গতবারের পড়ে পাওয়া কি পড়েছিলে তুমি? তাহলে নিশ্চই এতক্ষণে পিঁপড়েদের সঙ্গে তোমার বেশ খানিকটা ভাব হয়ে গেছে। আর যদি এখনো পড়া না হয়ে থাকে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পড়ে নাও। আমি জানি তুমি ভাবছো- যে পিঁপড়ে কামড়ালে এতো জ্বালা করে, মা কোনো মিষ্টি খাবার রাখলেই লোভীদের মতো চারিদিক ঘিরে ধরে...নাছোড় হয়ে হামলা করে বার বার তাদের নিয়ে এতো আদিখ্যেতা কেন বাপু? আর কি কেউ নেই? সেই সুন্দর পাখাওয়ালা প্রজাপতি...সেই বদখত দেখতে কেঁচোটা আর সেই বেজারমুখো গঙ্গা ফড়িং যে কাকার গাড়ির উইন্ড স্ক্রিন থেকে কিছুতেই উড়ছিলো না...হাঁ করে চেয়েছিলো সবার দিকে তাদের নিয়ে লিখলেই তো হয়।
সত্যি এদের সবাইকে নিয়ে লিখেছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। তোমরা যদি কোনোদিন তাঁর 'বাংলার কীট-পতঙ্গ' বইটা পড় তাহলে সব জানতে পারবে। কি ধৈর্য ধরে এদের নিরীক্ষণ করতেন গোপালচন্দ্র তা যেন এক গল্প কথার মতো। অনেকে ভাবতো তিনি পাগল...খামখেয়ালী। কিন্তু যারা তাঁর কাজের সাথে পরিচিত ছিলেন তাঁরা জানতেন কি কঠিন বিষয়ের ওপর গবেষণা করে চলেছেন মানুষটি।
এই সময়ে 'ইথোলজি' বা 'অ্যানিম্যাল বিহেভিয়ার' একটি সুপরিচিত বিজ্ঞানের শাখা। ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি আর এনিমেল প্ল্যানেট ইত্যাদি টেলিভিশন চ্যানেলের সুবাদে আমরা খুবই পরিচিত এইসব শব্দ গুলো আর তাদের কর্মকান্ডের সাথে। সমুদ্রের তলায় ছোট্ট ছোট্ট মাছ থেকে শুরু করে বায়ুতে ভাসমান অদৃশ্য পোকার জীবন কান্ড আজ আমরা সহজেই বসে দেখে নিই রাতের খাবার খেতে খেতে। কিন্তু গোপালচন্দ্র যখন তাঁর কাজ শুরু করেন তখন কিন্তু এত সুগম ছিলো না তাঁর পথ। অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নিজের মতকে নিজের পথকে। মনে রেখো তখন কিন্তু দেশ পরাধীন। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন না থাকায় কাজের এবং গবেষণায় এগিয়ে থাকলেও তাঁর সাথে কাজে অস্বীকার করেন এক বিজ্ঞানী। কিন্তু ফিরে আসেননি গোপালচন্দ্র। নিজে ভেঙে পড়েননি। কাজে পেয়েছেন আরো উতসাহ ও উদ্দীপনা। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে এক সামান্য চাকরী থেকে অর্জন করে নেন গবেষকের পদমর্যাদা। হাজারের ওপর প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলায়। মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান চর্চার যে সূত্রপাত করেছিলেন তাঁর পূর্বসূরীরা তাকেই খুব সার্থক ভাবে বহন করে নিয়ে গেছেন গোপালচন্দ্র।
জন্ম হয়েছিলো অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরের এক অখ্যাত গ্রাম লনসিঙে ১৮৯৫ সালের ১১ আগষ্ট। বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। দারিদ্রের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছেন গোপালচন্দ্র। বাবা অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য পুজো আর স্থানীয় জমিদারের খাতা লিখে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে কোনোক্রমে সংসার চালাতেন মা শশিমুখীদেবী। খুব তাড়াতাড়ি কাজে ঢুকতে হয় গোপালচন্দ্রকে। মাঝপথেই থেমে যায় পড়াশুনো। স্কুল শিক্ষকের চাকরী নেন। এই সময় বিশেষভাবে সাহিত্যের দিকে আগ্রহ বাড়ে তাঁর। লিখতে থাকেন সারি গান, জারি গান,পালা গান। আবার চাকরী বদল এইভাবে ১৯১৮ সালে যখন তিনি এক বিদেশী কোম্পানীর টেলিফোন অপারেটর সেই সময় নামকরা 'প্রবাসী'পত্রিকায় প্রকাশিত হয় 'জৈবদ্যুতি'নামে তাঁর লেখা এক বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। সেই লেখা চোখে পড়ে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর। তিনি গোপালচন্দ্রকে নিয়ে আসেন তাঁর সদ্য প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে আজ যা বোস ইনস্টিটিউট নামে বিখ্যাত। খুব সাধারণ কাজ দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করেন জীবনটাকে। প্রকৃতি অন্ত প্রাণ ছিলো যে মানুষটার তিনি পেলেন গবেষণার নতুন বিষয়। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথম তাঁর গবেষণা পত্র পেশ করেন। ১৯৫১ সালে অংশ গ্রহণ করেন প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে ন্যাচারাল হিস্ট্রির মতো আন্তর্জাতিক পত্রিকায়। ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরষ্কার আর ১৯৭৫ সালে রবীন্দ্র পুরষ্কার।
কিন্তু পুরষ্কার দিয়েই কি মানুষটাকে চেনা যায় নাকি? কখোনোই নয়। এমনটা কখোনো মনেই এনো না। যিনি রোদে পুড়ে, জলে ভিজে পরম মমতায় লিখলেন পিঁপড়দের সমন্ধে, প্রজাপতিদের সম্বন্ধে। জানালেন মৌমাছিদের রকম সকম...ঘরকন্না...পঙ্গপালের ছবি তুললেন অভাবনীয় দক্ষতায়, লিখলেন তাদের কথা এবার সময় এসেছে তাঁকে ফিরে দেখার। তাঁকে নিয়ে পড়াশুনোর। এই লেখাটা পড়তে পড়তেই একটা প্রমিস করো না নিজের মনে মনে যে খুব তাড়াতাড়ি তুমি পড়ে ফেলবে 'বাংলার কীট পতঙ্গ' বইটা। এতো সহজ সরল ভাষায় কেই বা আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন এক অচেনা অদেখা জগতকে। কেই বা বন্ধুতা পাতাবেন পিঁপড়ের সাথে...পঙ্গপালের সাথে। তুমি কি বন্ধু হবে? তাহলে সেই মতো তৈরী হও এখন থেকে।
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
যখন ছোট ছিলাম
তিনতলার দক্ষিণের ঘরে থাকতেন আমার মেজোকাকা বা কাকামণি- সুবিনয় রায়। বাবা মারা যাবার পরে ছাপাখানার তদারকি কাকামণিই করতেন। জার্মানি থেকে তখন নানারকম কাগজের নমুনার বই আসত আমাদের অফিসে। মোটা, পাতলা, রেশমী, খসখসে, চকচকে, এবড়োখেবড়ো, কতরকম যে কাগজ তার ঠিক নেই। কাকামণির ঘরে গেলে তিনি আমার হাতে ওই রকম একটা বই দিয়ে বলতেন- দেখ তো এর মধ্যে কোনটা চলবে। আমি বিজ্ঞের মতো পর পর কাগজের উপর হাত বুলিয়ে বুলিয়ে চলবে কি চলবে না বলে দিতাম। আমার ধারণা ছিল আমার বাছাই করা কাগজই আসবে জার্মানি থেকে...
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
আমার ছোট্টবেলাঃপর্ব ৩
শীতের দুপুরে পাঠশালা থেকে ফিরে কোন কোন দিন দেখতাম 'মলন' দেওয়া হচ্ছে। উঠোনের মধ্যে বৃত্তাকারে ধানশুদ্ধ গাছগুলোকে উঁচু করে সাজিয়ে ফেলা হত। তারপর এর ওপর দিয়ে একজোড়া বলদ হাঁটানো হত। এর নামই 'মলন' দেওয়া।
কেন দেওয়া হত বলতো? তখন তো গ্রামের দিকে গাছ (খড়) থেকে ধান ছাড়ানোর মেশিন ছিল না। তাই এই পদ্ধতি। ক্রমাগত হাঁটার ফলে বলদের পায়ের চাপের গাছ থেকে ধান আলাদা হয়ে তলায় পড়ে যেত। এর পর ওপর থেকে খড় ঝেড়ে তুললেই হল। হাঁটার সময় গরুদের মখে দড়ির তৈরি জাল এঁটে দেওয়া হত যাতে ধানে মুখ দিয়ে কাজে ফাঁকি না দেয়।
খড় ঝেড়ে তোলার পর উঠোনে যে ধান পড়ে থাকত তাতে অনেক খড়ের টুকরো থাকত। কি বলে এগুলোকে? কুড়ো বলে বোধ হয়!
পরে এইসব টুকরো বা কুড়ো গুলোকে ঝাড়তে হত। তারও আবার একটা বিশেষ পদ্ধতি ছিল। সেটা পরে বলছি।
একদিন মলনে উঠে বলদগুলির পিছন পিছন খুব ছুটেছিলাম। বড়দের নিষেধ শুনিনি, ফলে শাস্তিও পেতে হল হাতে হাতে। সারা গায়ে কুড়ো লেগে কি চুলকানি, বাপরে! সেই প্রথম আর সেই শেষ। ন্যাড়া কবার আর বেলতলায় যায় বল!
দু'জন মহিলা ঐ সময় আসতেন ধান থেকে খড়ের কুড়ো বা টুকরো গুলোকে আলাদা করার কাজে। যেখানে খুব বাতাস বয় সেরকম খোলামেলা কোন জায়গায় কুলোতে করে কুড়ো শুদ্ধু ধান মাথার উপর নিয়ে অল্প অল্প করে নীচে ফেলা হত। ধান ভারি হওয়ায় সোজা নীচে পড়ত। কিন্ত কুড়োগুলো তো হালকা। সেগুলো হাওয়ায় উড়ে গিয়ে কিছু দূরে পড়ত। ফলে দুটো স্তূপ হত - যার একটায় ধান আর অপরটায় কুড়ো থাকত। বেশ মজার বলে মনে হত ব্যপারটা।যাঁরা একাজ করতেন তাঁদের একজনের নাম আমার মনে আছে। তাঁর নাম খুশি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মজার মজার কথা বলতেন আর আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর চুলগুলি ছিল পেকে একেবারে সাদা আর কোঁকড়ানো। আর সারা মুখের চামড়ায় ছিল বয়সের ভারে কাটা আঁকিবুকি। নাম খুশি বলেই বোধহয় সর্বদাই হাসি খুশি থাকতেন।
হরিশের কথা আগেও বলেছি। আমার থেকে বয়সে বেশ বড়। কখনও বলতাম হরিশভাই, কখনও হরিশদা আবার কখনও শুধু নাম ধরে বলতাম। সে ছিল বাড়ির কাজের মানুষ। কিন্ত তাহলেও ছিল আমার বন্ধুর মত।
শীতের এক দুপুরে আমাকে বলল, চল, বেড়িয়ে আসি। কোথায় জিজ্ঞেস করতে সে বলল, গেলেই দেখতে পাবে।
সেদিন একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে চললাম ধানকাটা হয়ে গেছে এমন সব ক্ষেতের আল ধরে। দূরে দূরে ক্ষেতের মধ্যে একরকম ঘর দেখতে পেলাম যেগুলো এস্কিমোদের বাড়ি 'ইগলু'র মত দেখতে। ওদের বাড়িগুলো বরফ দিয়ে তৈরি হয়, কিন্তু এগুলো খড় আর বাঁশ দিয়ে।
এরকম একটা ঘরের কাছে থেমে হরিশদা বলল- এখানে দাঁড়াও আমি আসছি।
ঘরের দিকে ভাল করে নজর দিলাম। ঘরটা খড় আর বাঁশ দিয়ে তৈরি বটেই এমনকি মেঝেতেও পুরু করে খড় বিছানো। গদির মত নরম। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরটা বেশ গরম। দুজনে আরাম করে শোয়া যায়। হরিশদার কাছ থেকে পরে জানতে পারি যে ক্ষেতে রাত পাহারা দরকার হলে এখানে রাতে শোয়া হয়।
যাই হোক একটু পরেই হরিশদা এল শুঁটি সুদ্ধ এক গোছা মটর গাছ নিয়ে। ঘর থেকে একটু দূরে খানিকটা খড় যোগাড় করে আগুন তৈরি করল আর মটর গাছগুলো তাতে ফেলে দিল।
কিছুক্ষনের মধ্যেই পট পট শব্দ করে সবটা পুড়ে কালো ছাইয়ে পরিনত হল।
কালো পোড়া মটরশুঁটিগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে আমাকে দিয়ে বলল -খাও।
ছাইমাখা পোড়া সেই মটরশুঁটি যে কি সুস্বাদু কি বলব। একবার সুযোগ পেলে খেয়ে দেখ। ভুলতে পারবে না।
শীতের বিকেলে বড়রা একটা খেলা খেলতেন। সেটা ছিল কতকটা ক্রিকেট আর কিছুটা বেসবল মিলিয়ে একটা খেলা। এটার নাম ছিল 'তেকাঠি' খেলা। বেশ ভাল লাগত খেলাটা দেখতে। ওরা মাঝে মাঝে ফুটবল অথবা হাডুডু এসবও খেলতেন। আমারও একটা ছোট্টমত ফুটবল ছিল। ছোটমামা বলতেন এক নম্বর বল। এর চাইতে ছোট বল নাকি হয় না। বাবা শিলং থেকে পাঠিয়েছিলেন সেটা। ছোটমামা হাওয়া ভরে দিতেন তাতে। আমি আমাদের উঠোনে খেলতাম।
বিকেল হলেই দেখতাম মামি, মাসিরা পাঁচ ছটা লন্ঠণ নিয়ে বসতেন। লন্ঠনে তেল ভরা, পলতে ঠিক করা, ময়লা চিমনিগুলো ছাই দিয়ে ঘষে ঝকঝকে করে তোলা - এইসব কাজ থাকত রোজ রোজ। তখন, মানে আজ থেকে বছর ষাটেক আগে মামার বাড়ির গ্রামে বিদ্যুতের আলো আসেনি। পাবনা জেলার সেই জামিরতা গুধিবাড়ী গ্রামে আজও বিদ্যুতের আলো এসেছে কিনা জানিনা।
কখন যে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যেত বোঝাই যেত না। সন্ধ্যা নামলে আমার ভালোও লাগত আবার ভয়ও করত।
বিকেল হলেই কাজের লোক এসে গরু দুইয়ে যেত। সন্ধ্যায় দিয়ানি সেটা জ্বাল দিতেন আর সবার জন্য বাটিতে বাটিতে ভাগ করে রাখতেন। শেষে কড়াইটা চেঁছে চাঁছি বের করতেন। সে চাঁছির কি স্বাদ- এখনোও মুখে লেগে আছে।
ছোটমামা খেলাধুলা করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে একটা লন্ঠণ জ্বালিয়ে পড়তে বসতেন। আমাকেও তাঁর সঙ্গে বসতে হত দাদুর হুকুমে- তা পড়ি আর না পড়ি। না বসলে একটা শাস্তি মজুদ থাকত - সেদিন রাতে দাদুর কাছ থেকে আর গল্প শোনা যেত না।
ছোটমামা আমার থেকে সাত-আট বছরের বড় ছিলেন। পড়তে বসলে তিনি আমার উপর নানাভাবে 'মামাগিরি' ফলাতেন। পড়ায় ফাঁকি দিলে দাদুর কানে সটান চলে যেত।
দাদুর কাছে কত গল্পই যে শুনেছি। টুনটুনির গল্প, রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প, শিয়াল পন্ডিতের গল্প- আরো কত কি!
এর পরই খাওয়ার ডাক পড়ত।
শীতকাল হলে খাওয়ার শেষে হাত মুখ ধুয়ে এক ছুটে দিয়ানির খাটে একেবারে লেপের তলায় ঢুকে যেতাম।
সন্ধ্যাবেলার ভয়টা নিয়ে যে আর বলা হলনা। আচ্ছা সেটা যাক এখন। পরের সংখ্যায় বলব সেটা।
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
নববর্ষের গল্প
বাংলা বছর , বা বঙ্গাব্দ অনুযায়ী , বৈশাখ হল বাংলা বছরের প্রথম মাস, আর পয়লা বৈশাখ হল বছরের প্রথম দিন। এই দিনটিতে আমরা 'নববর্ষ' পালন করি। 'নববর্ষ' বাঙ্গালিদের একটি সার্বজনীন উতসব। নববর্ষের দিন কি হয় বলতো? প্রথমেই বলতে হয় নতুন জামার কথা। এছাড়া নববর্ষের দিনে বাড়িতে ভালো ভালো খাওয়াদাওয়া ও হয়। ছোটরা বড়দের প্রণাম করে। বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করেন। নানারকমের গান-বাজনার অনুষ্ঠান হয়। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা অনেকেই এইদিনে 'হালখাতা' করেন, অর্থাৎ নতুন বছরের ব্যবসার জন্য নতুন একটি হিসাবের খাতা ব্যবহার করা শুরু করেন। এই দিন সন্ধ্যাবেলা পরিচিত দোকান গুলিতে গেলেই হাতে পাওয়া যায় মিষ্টির বাক্স আর নতুন ক্যালেন্ডার। সবাই একে অপরকে 'শুভ নববর্ষ' বলে সম্বোধন করে।
বাড়িতে কেনা হয় নতুন পঞ্জিকা। পঞ্জিকা কি জানতো?
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত