স্বাধীনতার গল্পঃপর্ব ৪
আমরা যে আসলে কি চাই, তাই জানি না।গরমকালে গরম পড়ল, বৃষ্টি চাইলাম। বৃষ্টি এমন শুরু হল যে তিন দিন ধরে থামেই না।আমার ত বেশ মজাই হল। জল-কাদা ডিঙ্গিয়ে বাইরে বেরতে মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না।তোমার মত যখন ছোটো ছিলাম, তখনকার কত স্মৃতি এসে ভিড় করে। তোমারও নিশ্চয়ই ও ক’দিন আর ইস্কুলে যাওয়া হয় নি!সারাদিন-রাত ধরে ব্যাঙেদের ডাক শুনতে খারাপ লাগে না বল? আমাদের পাশের বাড়িতে আবার একটা সাপ বেরিয়েছিল, জান! কি সুন্দর দেখতে! কতকরে বললাম সব্বাইকে যে বনদপ্তরে খবর দিলে ওরা নিশ্চয়ই ওটার একটা ব্যবস্থা করে দেবে, ওটাকে মারার দরকার নেই। কিন্তু কেউ আমার কথাই শুনল না, মেরে পুড়িয়ে দিল।
নবাব সিরাজদ্দৌলা
প্রায় এরকম ভাবেই বাঙ্গলার নবাবীকে ইংরেজরা গ্রাস করেছিল তাদের পরিকল্পনা চরিতার্থ করার জন্য। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের নৃশংস প্রতিশোধ ছিল পলাশীর যুদ্ধ। নবাব সিরাজকে কোনো ক্ষমা-ঘেন্না না দেখিয়ে খুব নৃশংস ভাবে হত্যা করল ইংরেজরা। ইংরেজদের মোহে অন্ধ মীরজাফর ক্লাইভ আর তার অনুচরদের সাহায্য করল মুর্শিদাবাদের নবাবের কোষাগার ভেঙ্গে বিপুল ধনরত্ন অবাধে লুন্ঠন করতে।সারা দেশের মানুষ সেদিন ইংরেজদের নৃশংসতা আর তান্ডব দেখে বুঝতেই পারল যে দেশের ভবিষ্যত সুবিধের নয়। একশোখানা নৌকা লেগেছিল সেই ধন-সম্পদ কলকাতায় আনতে। ক্লাইভ আর কোম্পানীর কর্তারা রাতারাতি সেই লুটের সম্পদ ভাগাভাগি করে দেশের নতুন নবাব হয়ে গেলেন। ছিল আ আইনের কন শাসন বা ন্যায়-নীতির বালাই। মীরজাফর নবাব হলেন বটে কিন্ত হয়ে রইলেন কোম্পানীর হাতের পুতুল।
বাংলার সিংহাসনে মীরজাফরকে বসিয়েও বৃ্টিশ বণিকদের ক্ষমতা অ বিত্তলাভের বাসনা কমল না। মীরজাফরের বিরূদ্ধে অপদার্থতার অভিযোগ এনে ১৭৬০ সালে তাঁকে গদিচ্যুত করল কোম্পানী। দেশের নবাব কে হবে তার নির্ধারকও হয়ে উঠল বৃটিশ বণিকরা। বুঝতেই পারছ, শাসনদন্ড আসলে তাহলে কার হাতে। মীরজাফরের জামাই মীরকাশেম বেশ ভালো লোক ছিলেন। কোম্পানীর গভর্নর হেনরী ভ্যান্সীটার্ট আর তাঁর কাউন্সিল তাঁকেই বাংলার নবাব হিসেবে বসান। তবে বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ তিনটি অঞ্চল বর্ধমান, মেদিনীপুর, আর চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের অধিকার তিনি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বৃটিশ বণিকরা যেন অজগরের মত নিঃশব্দে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকল আমদের দেশকে।
মীরকাশিম কিন্তু বৃটিশ বণিকদের স্বেচ্ছাচারীতা বরদাস্ত করেন নি। কোম্পানীর হাতের পুতুল হয়ে থাকার বাসনাও তাঁর ছিল না। মোগ্ল সম্রাটের দেওয়া দস্তকের অপব্যবহার তার বেয়াইণি প্রয়োগ, ব্যবসার দালালি-এ সবকিছু আমাদের দেশীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা উতপাদন, আমদানী ও রপ্তানী কে বেশ জোর ধাক্কা দিয়েছিল। নতুন পাওয়া সম্পদ ও ক্ষ্মতার আবেশে ইংরেজ বণিকেরা ধরা কে সরা জ্ঞান করছিলেন।মীর কাশিম দেশীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য তাদের সব শুল্ক মকুব করে দেন।কিন্তু বাংলার বণিকদের আর পণ্য উতপাদকদের ভাতে মারার জন্য বৃটিশ বণিকদের দুর্নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে মীরকাশিম নিজের বিপদ ডেকে আনলেন। ইংরেজ্ রা সোজা তাঁর বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীরকাশিম, সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লীর মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের যৌথ বাহিনী ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়।ইংরেজদের ক্ষমতা বিস্তারের পথে যতটুকু বাধাও বা ছিল, তা আর রইল না। শাহ আলম বন্দী হলেন।মীরকাশেম রোহীলখন্ডে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। বন্দী শাহ আলমকে দিয়ে জোর করে ইংরেজরা ফরমাণ লিখিয়া নিল যে বাংলার দেওয়ানীর সব দায়িত্ব তাদেরই।১৭৫৭ সালে যে পরাধীনতার সূত্রপাত ১৭৬৫ যে গভর্ণর হলেন লর্ড ক্লাইভ।দেওয়ানী লাভের ফলে
সারা বাংলার সব রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পেল ইংরেজরা।
দেশে যে গভীর অন্ধকার নামল তার বিরূদ্ধে প্রথম গর্জে উঠেছিলেন বাংলার নবাব মীরকাশিম।চেয়েছিলেন আসন্ন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করতে। বাংলা তথা ভারতের মাটিতে যেমন বৃটিশ শাসন সত্যি, থিক সেরকম ভাবেই সত্যি হল যে বাংলার মাটি থেকেই ধ্বনিত হয়েছিল প্রথম প্রতিবাদ। তাই ইতিহাস যেমন মনে রেখেছে, তুমি ও মীরকাশিমের কথা মনে রেখ।
আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা
ছবিঃ
ক্যালকাটাওয়েব
- বিস্তারিত
- লিখেছেন আর্য চ্যাটার্জি
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
উত্স সন্ধানে
পৃথিবীর অন্যতম বৃহদাকার প্রাণী হাতির উদ্ভব ও জীবনযাপনকে ঘিরে নানা দেশে নানা সময় বিবিধ জনশ্রুতি প্রচলিত আছে । ছোট বড় এইসব অজস্র কাহিনিমালার ভিড়ে কোথাও হয়তো মেলে সামান্য সত্যের আভাস,বাকিটা মূলত কল্পনা আর অলৌকিক বিশ্বাসের হাত ধরে উঠে আসা সাধারণ মানুষের চিরন্তন চাওয়া পাওয়ার কিছু নিটোল ছবি । যেমন ধরা যাক সুদূর আফ্রিকা মহাদেশের কথাই!যেখানে হাতিকে কেন্দ্র করে গড়া ওঠা আঞ্চলিক গল্পগুলো কোনো অংশেই বৃটেনের জাদুকর দেবতার কীর্তিকলাপের চেয়ে কম রোমহর্ষক নয় ।
অরণ্য রাজ্যের সর্বেসর্বা,দুর্বল প্রাণীকুলের উদ্ধারকারী ও পশুসমাজের সেনাপতি হাতির পদমর্যাদা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আজও সর্বোচ্চ । শুধু দৈহিক বলের প্রতাপে নয় বরং চমত্কার স্থিতধী বুদ্ধি ও তত্পরতায় প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে নাকি হাতির জুড়ি মেলা ভার । প্রায় সাড়ে সাত কোটি বছর আগে সামগ্রিক প্রতিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে কত শক্তিশালী প্রাণীর দোর্দণ্ড অস্তিত্ব ভূপৃষ্ঠ থেকে মুছে গেছে চিরতরে; সেখানে হাতি নামক বিরাটবপু জন্তুটির বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকা জীবজগতে এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত অবশ্যই । মানুষের বুদ্ধিমত্তার কথা ছেড়ে দিলে আর কোনো প্রাণীর এমন মস্তিষ্ক সঞ্চালনের চেষ্টা স্বভাবতই পুরাতত্ত্ববিদদের মনেও প্রশ্ন জাগায় । আর এই জিজ্ঞাসার সূত্র ধরেই জন্ম নেয় সহজ অবৈজ্ঞানিক কিছু গল্পের কাঠামো । যুগ যুগ ধরে তিলে তিলে বাহারি রূপে রঙে সেজে আকার নেয় শত শত বিস্ময়কর কাহিনির।
আফ্রিকার লোককথা :
চ্যাড দেশের গপ্প:
গভীর জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে ব্যাধ আরাম্পই একদিন কুড়িয়ে পায় কোনো এক অতিকায় প্রাণীর ধূসর রঙের চামড়া!কুটিরে ফিরে সে চামড়াটিকে লুকিয়ে রাখে গোপন কোথাও ।
এই ঘটনার প্রায় বেশ কিছুদিন পর চ্যাড জলাশয়ের তীরে যুবক ব্যাধের সঙ্গে আলাপ হয় সুন্দরী স্বাস্হ্যবতী বহ্লালের । বহ্লাল তাকে করুনকন্ঠে জানায়, নাইতে নেমে তার প্রিয় পোশাকটি প্রবল জোয়ারে ভেসে গেছে । বহ্লালের অসহায় অবস্থা দেখে আরাম্পইয়ের মনে দয়ার সঞ্চার হয় । সে তখনই মেয়েটিকে প্রয়োজনীয় পোশাক বানিয়ে দেয় । এমনকি বিয়ে করে নিজের কুটিরেও আশ্রয় দান করে ।দেখতে দেখতে বছর কয়েকের মধ্যে তাদের ছ’সাতটি বিশাল আকৃতির শক্তিমান পুত্রসন্তান জন্মায় । সুখে শান্তিতে বেশ ভালই দিন কাটছিল সকলের । কিন্তু হঠাতই একদিন সব কেমন যেন ওলোট পালোট হয়ে গেলো!
আরাম্পই সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে শিকারে বের হলে প্রতিদিনের মত এইদিনও ঘরের কাজে মন দিয়েছিল বহ্লাল । ধানের গোলা ঝাঁট দিতে গিয়ে হঠাতই সে আবিষ্কার করে ফেলে আরাম্পইয়ের লুকিয়ে রাখা সেই ধূসর রঙের চামড়াটা!বিস্ময় আনন্দে কেঁপে ওঠে বহ্লাল!এই তো তার হারিয়ে যাওয়া পোশাক!তার ধারণা হয় নিশ্চয়ই স্বামী আরাম্পই পোশাকটি চুরি করে লুকিয়ে রেখে দিনের পর দিন তার সাথে মিথ্যাচার করেছে! রাগে দুঃখে অভিমানে পোশাকটি গায়ে জড়িয়ে বহ্লাল আবার বনে ফিরে যায় ।পরবর্তীকালে আরাম্পই বহ্লালের ভুল ভাঙিয়ে তাকে সংসারে ফিরে আসতে বারবার অনুরোধ জানালেও সে আর ফেরেনি । কারণ ততদিনে আবার বন্য জীবনের স্বাদ ফিরে পেয়েছে সে । অতএব শূণ্য হাতে ঘরে ফেরে আরাম্পই ।
বাবার তত্ত্বাবধানেই ধীরে ধীরে বহ্লালের সন্তানরা বড় হতে থাকে । তাদের চেহারা হুবহু হাতির মত না হলেও হাঁটা চলা খাদ্যাভ্যাস মা হাতি বহ্লালের মতই ।
শোনা যায় বড় হয়ে আরাম্পই-বহ্লালের সন্তানরা মহা বলশালী যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল । যে কোনো কঠিন বিপদে দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াত এরা। এমনকি অত্যাচারী রাজাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতেও পিছপা হতো না । মানুষ পশু নির্বিশেষে হাতিকে সবাই ভয় পেলেও বহ্লাল-সন্তানদের সঙ্গে হাতিগোষ্ঠির সম্পর্ক ছিলো বেশ মধুর । প্রচলিত আছে বহ্লাল-সন্তানদের মৃত্যুর পর তাদের উত্তরসূরীরা হাতিকেই বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে । যেহেতু বর্তমান হস্তিকুলের পূর্বসূরী রূপে মানবপিতা আরাম্পই-র নাম প্রাচীন লোককাহিনিতে উল্লেখ করা হয়,অতএব সহজ সমীকরণে বলা যেতেই পারে যে মানুষের মত হাতির বিচক্ষণ বুদ্ধিবৃত্তি সম্ভবত আদিপিতা আরাম্পই-এরই অবদান!
কাম্বা জাতির উপকথা :
কেনিয়ার প্রায় প্রতিটি প্রদেশেই হাতির উদ্ভব ও মহিমা বিষয়ে নানান অলৌকিক গল্প মানুষের মুখে মুখে চালু আছে । তার মধ্যে কিকাম্বা ভাষায় সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় গল্প হলো এটি ।
প্রাচীনকালে কেনিয়ার উকাম্বানি অঞ্চলে বাস করতো বুত্নআজিবা নামে এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ । দুই স্ত্রী ও সন্তান সন্ততি মিলিয়ে তার মোট পরিবার সংখ্যা সতেরো । অথচ বুড়োর এমন আর্থিক সঙ্গতি নেই যে তাদের দু'বেলা পেট ভরে খেতে দেয় । দিনের পর দিন প্রায় অনাহারে থাকতে থাকতে একে একে তার প্রথম স্ত্রী ও নয় সন্তানের মৃত্যু হয় । বৃদ্ধ বুত্নআজিবার পক্ষে এই শোক ছিলো দুঃসহ । সেই সঙ্গে বাকি আটটি সন্তান ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় ভেবে না পেয়ে তার মানসিক ভারসাম্য যখন প্রায় নষ্ট হতে বসেছে, ঠিক সেই সময় তার কানে পৌঁছয় ধনী ব্যবসায়ী ইভগানগিয়ার দানশীলতার কাহিনি ।
ইভগানগিয়া একজন সৎ সরলমনা বৃদ্ধ । কঠোর পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা ও উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে নিজের ভাগ্য নিজে হাতে তৈরী করেছে । সম্পত্তিস্বরূপ তার রাজপ্রাসাদের মতন সুবিশাল অট্টালিকা, অগুন্তি শস্যের গোলা, হাজার হাজার একর উর্বর জমির মালিকানা; এইসব দেখে আপাতভাবে মনে হতেই পারে পৃথিবীতে এমন সুখী ক’জন আছে! কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত! বাস্তবে তার এই বিপুল সম্পত্তি ভোগ করার বিশেষ কেউ ছিল না!পরিবার বলতে শুধু চিররুগ্ন স্ত্রী আর এক বোবা ছেলে । অতএব শেষ বয়সে পৌঁছে ইভগানগিয়া সিদ্ধান্ত নেয় তার সমস্ত সম্পত্তি সে গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেবে।
কেনিয়ার দূর দূরান্তে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে । দলে দলে দুঃখী মানুষ জড়ো হয় ইভগানগিয়ার আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকার সদর চাতালে । ইভনের প্রাসাদ থেকে কখনো কাউকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে শোনা যায় নি । বিচক্ষণ দাতার মত হাসি মুখে সে সাধ্যমত চেষ্টা করতো প্রত্যেকের অভাব দূর করতে ।
লোকমুখে ইভগানগিয়ার দানকর্মের গল্প শুনে বুত্নআজিবার মনে ক্ষীণ আশা জাগে । যেভাবেই হোক ইভগানগিয়ার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে । শেষে পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি অক্লান্ত হেঁটে বুত্নআজিবা হাজির হয় ইভগানগিয়ার বাড়ি । বুত্ন'র মুখে তার চরম দুর্দশার বিবরণ শুনে ইভগানের ভারি কষ্ট হয়! সে তত্ক্ষনাত কর্মচারীদের আদেশ দেয় বৃদ্ধের সঙ্গে অনেক ফসল ও গবাদি পশু পাঠিয়ে দেবার । কিন্তু বুত্নআজিবা কিছুতেই কোনো দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করে । বরং সে ইভনের কাছে জানতে চায় ধনী হবার গোপন রহস্য! যাতে তাকে বা তার পরিবারকে কখনো কারোর কাছে হাত না পাততে হয়। বোকা বুত্নর কথা শুনে মনে মনে হাসে ইভগানগিয়া । শেষে অনেক বিবেচনা করে বুড়োর হাতে একটা মলম দিয়ে বলে,
‘‘এই মলমটা তোমার স্ত্রীর ওপরের মাড়ির দাঁতে ঘষে দিও । কিছুদিন পর দেখবে দাঁত লম্বায় বাড়তে শুরু করেছে । বেশ খানিকটা বড় হলে ওটাকে কেটে বাজারে বিক্রি কর । অনেক দাম পাবে । তোমার নিত্যদিনের যন্ত্রণা ঘুচবে ।’’
মনের আনন্দে ঘরে ফেরে বুত্নআজিবা ।
ইভনের পরামর্শ মত সেই মন্ত্রপূত মলমটা স্ত্রী খায়ার দাঁতে যেই না লাগানো,অমনি দিন কয়েকের মধ্যে তার মাড়ির দাঁত অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেতে শুরু করে । সেই দাঁত কেটে বাজারে বিক্রি করে সত্যিই অনেক রোজগার হয় তাদের। কথায় বলে মানুষের লোভ আগুনের শিখার মতই দুর্দান্ত। একবার প্রকাশের সুযোগ পেলে তাকে বশ করা খুব মুশকিল! কিছুদিন যেতে না যেতেই আরো বেশি টাকা রোজগারের লোভে বুত্নআজিবা আরো একবার খায়ার মাড়ির দাঁতে মলম ঘষে । এবার প্রায় চোখের নিমেষে সেই দাঁত দৈর্ঘ্যে বেড়ে যায় কয়েক গুন । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এইবার খায়া কিছুতেই দাঁত কাটতে রাজি নয় । শুধু দাঁত কেন, দেখা গেলো পরবর্তী দু'তিন দিনে তার শারীরিক গঠন পাল্টাতে শুরু করেছে । তার গায়ের চামড়া ধারণ করেছে ধূসর বর্ণ, দু’পায়ের বদলে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে চার পা’য় । এমনকি খাদ্যগ্রহনের জন্য হাতের পরিবর্তে শুঁড় ব্যবহার করতেই সে বেশি উত্সাহী । অত বড় চেহারা নিয়ে এমন ছোটো একটা মাটির ঘরে থাকা একসময় খায়ার পক্ষে অসহ্য হয়ে দাঁড়ালো! তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন সে বনে পালিয়ে গেলো । বনে থাকাকালীন সে অনেকগুলি সন্তানের জন্ম দেয় । শাবকগুলিকে দেখতে হুবহু আমরা যে প্রাণীটিকে বর্তমানে হাতি নামে সনাক্ত করি, তার মত । কেনিয়ার কাম্বা জাতির মানুষ আজও বিশ্বাস করে পৃথিবীতে হাতি নামক প্রাণীটির উদ্ভব এভাবেই ঘটেছিলো।
আফ্রিকার নানা দেশে আচার ভাষা ও কৃষ্টিতে যত বৈচিত্র্যই থাকুক না কেনো, যে পৌরানিক তথ্যটির প্রতি সকলের আস্থা আজও অটুট সেটি হলো;
‘‘হাতির পূর্বপুরুষ ছিলো মানুষ!’’
শর্মিষ্ঠা খাঁ
বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শর্মিষ্ঠা খাঁ
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
তোত্তো-চান
ওইমাচির ট্রেনটা জিয়ুগায়োকা স্টেশনে পৌঁছলে ওরা প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়লো। মা তোত্তো-চানের হাত ধরে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। গেটে সব যাত্রীকে টিকিট জমা দিয়ে দিতে হয়, কিন্তু জীবনের প্রথম ট্রেনের টিকিটটা হাতছাড়া করার মোটেও ইচ্ছা ছিল না তোত্তো-চানের।
'আমি এটা রাখতে পারি না?' টিকিট চেকারের কাছে জানতে চাইলো ও।
'না, এটা রাখা যাবে না,' বলে চেকারবাবু ওর টিকিটটা নিয়ে নিলেন।
পাশেই রাখা ছিল টিকিট ভর্তি একটা বাক্স। সেটার দিকে দেখিয়ে তোত্তো- চান বললো, 'সব তোমার?'
'আমার নয়, সব এই রেল স্টেশনের,' বাকি যাত্রীদের হাত থেকে টিকিটগুলো প্রায় ছিনিয়ে নিতে নিতে চেকারবাবু বললেন।
'ও!' তোত্তো-চান খানিকক্ষণ বাক্সটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর বললো, 'বড় হয়ে আমি ট্রেনের টিকিট বিক্রি করবো।'
এতক্ষণে চেকারবাবু একটু চোখ তুলে তাকালেন। ' আমার ছোট ছেলেও তো স্টেশনে কাজ করতে চায়! ভালই হবে, তোমরা তাহলে একসঙ্গে কাজ করতে পারবে!'
তোত্তো-চান একটু সরে দাঁড়িয়ে ভাল করে চেকারবাবুকে দেখে নিলো। গোলগাল, চোখে চশমা, বেশ ভাল মানুষ, ভাল মানুষ চেহারা। 'তা---,' কোমরে হাত দিয়ে ও কী যেন ভাবতে লাগলো। 'তা, তোমার ছেলের সঙ্গে আমি কাজ করতেই পারি, কিন্তু সেসব নিয়ে পরে ভাবা যাবেখন। এখন আমার খুব তাড়া, আমি এখন নতুন স্কুলে যাচ্ছি কি না!'
মা একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। 'বড় হয়ে আমি টিকিট বিক্রি করবো,' দূর থেকে চিৎকার করে মা'কে খবরটা জানিয়ে দিলো তোত্তো-চান। তারপর একছুটে মায়ের কাছে পৌঁছে গেলো। ওর কথায় মা একটুও অবাক হলেন না। কেবল বললেন, 'তুমি না গুপ্তচর হবে বলেছিলে?'
-----------------------
বড় হয়ে তোত্তো-চান কি হয়েছিল? টিকিট বিক্রেতা, না গুপ্তচর, নাকি অন্য কিছু? আর তার নতুন স্কুল - কেমন ছিল সেই স্কুল? ছোট্ট মেয়ে তোত্তো-চানের স্কুল-বন্ধু-পড়াশোনা-খেলাধুলা- সব কিছুর খবর পাবে তেতসুকো কুরোয়ানাগির লেখা বই 'তোত্তো-চান' -এ। মূল বইটি জাপানি ভাষায় লেখা। পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত এই বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সঙ্গীতশিল্পী মৌসুমী ভৌমিক।
তোত্তো-চান
তেতসুকো কুরোয়ানাগি
অনুবাদঃমৌসুমী ভৌমিক
ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট,ইন্ডিয়া
৫৫ টাকা।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন বইপোকা
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
বৃষ্টিভেজা স্মৃতি
কেমন আছ ইচ্ছামতীর বন্ধু? একটু দেরিতে হলেও হাঁসফাঁস গরমের শেষে এসেই গেছে বর্ষা। বর্ষা বললেই তোমার কি মনে আসে? ঝম্ঝম্ বৃষ্টি, রথ, খিচুড়ি আর ইলিশভাজা? উপ্স্, ভাবতেই জিভে হল! বর্ষা বলতে মনে আসে আমাদের প্রাণের ঠাকুর, রবি ঠাকুরকেও। 'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে...' বা 'গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে...' - বর্ষাবন্দনার অনবদ্য গীতি। আজ কলকাতা বা যেকোন শহরেই মাটির সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় হওয়ার সুযোগ তো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে। তবু, ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট্ট জানালা দিয়েও কালো মেঘের বুকে বিদ্যুতের খেলা দেখার সুযোগ কিন্তু ছেড় না।
আমার ছোটবেলা কেটেছে কলকাতাতেই। যখন মর্নিং স্কুলে পড়তাম, বর্ষায় বেশ মজা হত। ধর, সারা রাত মুষলধারে বৃষ্টির পর পথঘাট জলে থৈ থৈ। সকালে উঠে রেনকোট চাপিয়ে হাঁটুজল ভেঙে স্কুলে পৌঁছানোটা বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের মত মজা ছিল। পড়া-টড়া তো সেদিন হবার প্রশ্নই নেই। অর্ধেক ছাত্র আসত না, অনেক মাস্টারমশাইও আসতেন না।অনেক সময়ে দুটো ক্লাসের ছেলেদের একটা ঘরে বসিয়ে স্যারেদের আদেশেই চলত গল্প বলা, ক্যুইজ কন্টেস্ট বা ছবি আঁকা। স্যারেদের মন মেজাজ সেদিন ভাল হয়ে যেত। স্কুলে গিয়েও সমস্ত পিরিয়ডগুলি ধরে ছুটির মজা। বরং খুব বেশি বৃষ্টির জন্য কখনো কখনো 'রেনি ডে'র ছুটি হয়ে গেলেই মনটা খারাপ হত।
বর্ষায় স্কুলের সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ জলে ভরে উঠলে কোথা থেকে ছোট্ট ছোট্ট গেঁড়ি -গুগলি এসে যেত। বড়দের বকাবকির তোয়াক্কা না করে জলের বোতলে করে গুগলি ধরে এনে বাড়িতে একটা বড় বাটির মধ্যে জল ভরে ছেড়ে দিতাম। খাদ্য - পেয়ারা, জবা গাছের পাতা। তারা বেশ খোলোস থেকে লালচে শুঁড় বের করে গপাগপ পাতাগুলো খেয়ে নিত। আর মাঝে মধ্যেই বাটিটা তাদের সীমানা বুঝতে না পেরে ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক দেশভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ত শুম্বুকগতিতে।
গ্রামে বর্ষা দেখার সুযোগ মিলেছে বারকতক। আমাদের দেশের বাড়ি নদীয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে আষাঢ় মাসে বেশ বড় করে অম্বুবাচী মেলা হয়। অনেক দূর দূরান্তের লোক আসে। একটানা বৃষ্টিতে মাটির রাস্তা জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে ভয়ানক পিছল হয়ে যায়। নানা রঙের আর চেহারার কুনোব্যাং, সোনাব্যাং, গেছোব্যাং, কোলাব্যাং মনের আনন্দে উঠোন-বারান্দা-বসার ঘর- শোবার ঘর-পড়ার ঘর-খাট-টেবিল-চেয়ার সব দখন করে নেয়। তাদের 'মত্ত দাদুরী' গণসঙ্গীতে কান ঝালাপালা! আমাদের মত নগন্য জীবকে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না মোটেই।
একটা মজার কথা বলে শেষ করি। একবার দেখি- আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনের দিকে বাঁশঝাড়ে কিছু ডানপিটে ছেলেপুলে কই মাছ ধরেছে! পুকুরের জল ভর্তি হয়ে ডাঙায় ছাপিয়ে উঠতেই কইমাছগুলো কানে হেঁটে বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েছিল। সে বেচারিদের যাত্রা বোধ হয় ওই বাঁশঝাড়ে এসেই থেমে যায়, কারণ কইমাছ ভাজা খাওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার মত নির্লোভ মুখ অন্তত ছেলেগুলোর ছিল না!
আজকের মত আমার বর্ষার গপ্পো এখানেই শেষ করি। ভাল থেকো আর প্রাণ ভরে বর্ষার আনন্দ উপভোগ কর।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জ্যোতির্ময় দালাল
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
বর্ষার আড্ডা
এই জন্য টিকলির ভুডুলমামাকে ভাল লাগে, পিসিমনির মতো দেখলেই গাল টিপে দেয় না কিম্বা ছোটকার মতো চুল ঘেঁটে দেয় না। দেখা হালেই ভুডুলমামা হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক কারার জন্য। বলিষ্ঠ হ্যান্ডশেক। টিকলির হাত ভুডুলমামার পাঞ্জার মধ্যে কয়েক মুহূর্তর জন্য হারিয়ে গিয়ে যখন বেড়িয়ে আসে তখন আত্মবিশ্বাসে টিকলির চোখ দুটো জ্বল জ্বল কারতে থাকে। তারপর ওই বিরাট চেহারাটা দেখে টিকলির আর ভয় কারে না।
কফিতে চুমুক দিয়ে ভুডুলমামা শরীরটা এলিয়ে দেয় দাদুর আরাম কেদারায় আর টিকলি পা ঝুলিয়ে বাসে তার হাতলে। শুরু হয় নানা আলোচনা।
কি নিয়ে আলোচনা? মনে এই প্রশ্নটা জাগা স্বাভাবিক। তবে তা জানতে গেলে আড়ি পেতে শুনতে হয়, তা তো সম্ভব না। ভুডুলমামা ধমক দিতে পারে। পাশেই আমার পড়ার ঘর তাই দু-এক টুকরো আলোচনা আমার কানে আসে, তাই তোমাদেরকে শোনাই।
*
ভুডুলমামা :
ভূত পেত্নী,
আর শাঁকচুন্নি।
টিকলি :
সে তো সেই-ই দাদাঠাকুরের কালে,
বাস করতেন - খালে বিলে মগডালে।
ভুডুলমামা :
হুঁ।
এখন কে কোথায় আছেন?
কোথায় যে ওঁরা আড্ডা গেড়েছেন?
তার খবর কেউ রাখে না।
নাই দুশ্চিন্তা, নাই ভাবনা।
উল্টে ধমকে ওঠে -
বলে, "অবান্তর প্রশ্ন করে -
মাথার ঘিলু দিলি তো ঘেঁটে!"
'ডোনটো কেয়ার' ভাবটা দেখে!
গাটা আমার রি রি জ্বলে!
টিকলি :
দেখেছো কি 'গুগুল' কারে?
হদিস মিললেও মিলতে পারে !
**
ভুডুলমামা :
মুরগি না ডিম, আবির্ভাব আগে কার?
নিতান্ত সরল প্রশ্নটি।
তবে,
ফিরে ফিরে গোঁত খাবি -
উত্তর খুঁজতে যাস যদি।
মগজ ঘিলু কারে তোলপাড়
হার মেনেছেন স্কলার প্রফেসার?
বাক বিতণ্ডা তর্কযুদ্ধ -
অথচ, উত্তর মেলেনি -
পরিণাম শূন্য!
টিকলি :
স্কলার প্রফেসার!?
ফার্স্ট-হ্যান্ড অভিজ্ঞতা যে চাই।
এ ব্যাপারে ওনাদের তা বোধহয় নাই।
তাই, উত্তর ভাসাভাসা।
তবে, উপায় আছে।
মুরগিকে ডেকে কাছে -
কারো জিজ্ঞাসা।
তারপর মনে হল, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়য়ে ভুডুলমামা হাত বাড়িয়ে দিলো টিকলির দিকে - হ্যান্ডশেক কারার জন্য।
ভুডুলমামা :
তোর দেখছি - ধারালো ব্রেন !
প্রাপ্য - যুতসই পুরস্কার ।
ডিনার প্লেটে -
এগ-স্টাফড আস্ত চিকেন !
শিব শঙ্কর বসু
এপেক্স, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সৃজন বিভাগ
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত