সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

'কিসোয়াহিলি' বা 'কেচুয়া' - শব্দগুলি চেনা চেনা কি? না না বাপু,'কেচুয়া' হল গিয়ে ব্যাগ-জ্যাকেট-জুতো তৈরির সংস্থা বলে বোসো না যেন! আমি বরং খুলেই বলি।

'কিসোয়াহিলি' বা 'সোয়াহিলি' হল বান্টু ভাষাগোষ্ঠীর একটি ভাষা, যেটি মধ্য এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যবহৃত হয়। তান্‌জানিয়া, উগান্ডা এবং কেনিয়ার সরকারি ভাষা হল কিসোয়াহিলি।এছাড়াও বুরুন্ডি, মোজাম্বিক, ওমান, সোমালিয়া, কঙ্গো ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় ৯.৮ কোটি (৯৮ মিলিয়ন) মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন।

আর 'কেচুয়া'? সে ভাষার খোঁজ পেতে হলে এক লাফে অতলান্তিক সমুদ্র পেরিয়ে চলে যেতে হবে দক্ষিণ আমেরিকা। কেচুয়া বা রুনাসিমি ভাষা ব্যবহার করেন পেরু, চিলি, আর্জেন্টিনা,কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়াডোর জুড়ে বিস্তৃত আন্দিজ পর্বতমালা অঞ্চলের মানুষেরা। সবমিলিয়ে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ এই কেচুয়া ভাষায় কথা বলেন। কেচুয়া এক সময়ে ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের মূল ব্যবহারিক ভাষা। স্পেনীয়রা .দক্ষিণ আমেরিকা অধিগ্রহণ করতে শুরু করে কেচুয়া ভাষাও ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছিল, কারণ স্থানীয় মানুষের ভাষায় কথা না বলতে পারলে তাদেরকে নিজেদের কাজে লাগাবে কী করে? দক্ষিণ আমেরিকার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ তাই স্বচ্ছন্দে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন কেচুয়া এবং স্প্যানিশ, দুই ভাষাই ব্যবহার করেন। আজকের দিনে পেরু, বলিভিয়া এবং ইকুয়াডোরে কেচুয়া সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃত।

আজ চাঁদের বুড়ি এমন দুটি আলাদা মহাদেশের দুটি প্রচলিত ভাষা নিয়ে কথা বলছে কেন? কারণটা বুঝেই গেছ এতক্ষণে। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর এই বছরে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ইউনেস্কোর থীম হল 'সীমান্তহীন ভাষা' ( Language without borders)। ইউনেস্কো মনে করে, স্থানীয়, সীমানাহীন ভাষা প্রতিবেশীদের একে অপরের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে ('Local, cross-border languages can promote peaceful dialogue and help to preserve indigenous heritage.')। এবং এই থীমের কথা মাথায় রেখেই ,আজ সারাদিন ধরে ইউনেস্কোর সদর দফতরে কেচুয়া এবং কিসোয়াহিলি ভাষাদুটির ব্যবহার নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।

এই কথাটা সহজ প্রয়োগ বোধ হয় ভারতীয় উপমহাদেশের উদাহরণ সবথেকে বেশি ভালোভাবে আমরা বুঝব। এই ধর বাংলা ভাষা। বাংলা হল বাংলাদেশের, এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ - এই রাজ্যগুলির এবং আসামের বরাক উপত্যকার সরকারী ভাষা। এছাড়া, ঝাড়খন্ড এবং কর্ণাটকে বাংলা দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। আমাদের, মানে বাঙালিদের মাতৃভাষা হল বাংলা। কাগজে -কলমে বাংলাদেশে এবং ভারত, দুটি আলাদা দেশ হলেও, আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা দৃঢ় যোগসূত্র হয়ে রয়ে গেছে আমাদের এই ভাষা। এই দুই দেশে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ২২.৮কোটি (২২৮ মিলিয়ন) মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। সেই হিসাবে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত স্থানীয় ভাষা হিসাবে বাংলা রয়েছে পঞ্চম স্থানে - ম্যান্ডারিন চাইজিন,স্প্যানিশ, ইংলিশ আর হিন্দির পরেই। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে মোট ব্যবহারের ভিত্তিতে বাংলা রয়েছে সারা পৃথিবীতে সপ্তম স্থানে।

বাংলার যত লোককথা,উপকথা, প্রবাদ-প্রবচনের খোঁজ নিলে দেখতে পাবে, একই প্রবাদ, একই গল্প কেমন ভাবে দুই দেশের মানুষেরই জানা। জায়গা ভিত্তিতে হয়ত নাম বদলে গেছে, বা বলার ধরন বদলে গেছে, কিন্তু বিষয়বস্তুটা একই রয়ে গেছে। যেমন ধর বাংলার অতি জনপ্রিয় রূপকথার বই 'ঠাকুরমার ঝুলি'। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের লেখা এই বইটি এপার বাংলা-ওপার বাংলা, দুই জায়গাতেই সমান জনপ্রিয়। বইয়ের মলাট বদলে যায়, প্রকাশক বদলে যায়, ভাষা পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু মূল গল্পগুলি একই থেকে যায়।

ঠিক তেমনি রয়ে গেছে আমাদের প্রাচীন জ্ঞানভান্ডার- খাওয়া-দাওয়া, কৃষিকাজ, জলসঞ্চয়, হস্তশিল্প, স্থানীয় ওষুধপত্র ইত্যাদির নানা বিবরণ, যেগুলির বেশিরভাগই এখনও কোথাও লিখে রাখা নেই। এইসমস্ত হাজার হাজার বছরের প্রাচীন জ্ঞান আমরা আজও নিজেদের অজান্তে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করি- বড়দের মুখ থেকে শুনে শুনে, একে অন্যকে দেখে দেখে -যেমন আমাদের নিজস্ব আলপনা দেওয়ার শৈলী, বড়ি-আচার বানানোর পদ্ধতি, নানারকমের পালা-পার্বনের নিয়মকানুন বা ধর শাড়ি পরার ধরন। আর একে অপরের সঙ্গে কাজে এবং ব্যবহারে মিল খুঁজে পাই বলেই তো একে অপরের সঙ্গে সহজে কথাবার্তা এগোতে পারি, বন্ধুত্ব হয়, একে অপরের দুঃখে দুখী, আনন্দে সুখী হতে শিখি। বাংলা আমার -তোমার মাতৃভাষা বলেই তো বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিরাও একই সুরে গেয়ে উঠতে পারেন,"আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?"

আজকের গল্প শেষ হবে অন্য একটা ভাষার কথা নিয়ে। ঊর্দু। প্রায় ৬.৯ কোটি (৬৮.৬২ মিলিয়ন)মানুষের মাতৃভাষা ঊর্দু।এছাড়াও , ঊর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ব্যবহার করেন আরও প্রায় ১০ কোটি মানুষ। ইদানীং এই ভাষা হঠাৎই আমাদের নিত্যদিনের আলোচনার মধ্যে ঢুকে গেছে। এমন এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, যে ঊর্দু নাকি ভারতীয় ভাষাই না, তাই ঊর্দু ভাষায় লেখা গান গাওয়া বা কবিতা বলা নাকি দেশের বিরুদ্ধে কথা বলা। কেউ যদি তোমাকে এমন কথা বলে, মোটেও বিশ্বাস কোরোনা। জেনে রাখো এবং সেইসব মানুষদের জানিয়ে দিও, বাংলা এবং হিন্দির মতই, ঊর্দু ভারতের ২২টি স্বীকৃত সরকারি ভাষাগুলির মধ্যে একটি। ভারতে উত্তর প্রদেশ, বিহার,ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, তেলেঙ্গানা, জম্মু ও কাশ্মীর এবং রাজধানী দিল্লিতে ঊর্দু সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। এছাড়াও ঊর্দু আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্থানের সরকারি ভাষা।এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য,নেপালে এবং বাংলাদেশেও ঊর্দুর ব্যবহার আছে। যদি কখনও বড় হয়ে ভাষার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করা সুযোগ হয়, তাহলে দেখবে, বাংলা,হিন্দি, এবং ঊর্দু এবং আরও একাধিক উত্তরভারতীয় এবং এশীয় ও ইউরোপীয় ভাষার একই উৎস থেকে নির্মিত হয়েছে। এই মূহুর্তে খুলে দেখতে পারো এই লিঙ্ক, যেখানে গ্রাফিক্সের সাহায্যে সরলভাবে বিভিন্ন ভাষার বিবর্তন বোঝানো হয়েছে।

মা তার শিশুর সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন, সেটাই সেই শিশুর মাতৃভাষা। আর মায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলেই, মাতৃভাষা আসলে আমাদের প্রত্যেকের কাছে মায়ের মতই ভালোবাসার, মায়ের আদরের মতই জরুরী। আমি যেমন নিজের মাকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, তেমনি যদি আমার বন্ধুর, বা এমনকি কোনও অপরিচিত , অচেনা মানুষের মাকে ভালো না বাসি, শ্রদ্ধা না করি, তাহলে কিন্তু আসলে আমরা নিজের মা'কে, নিজেকে অপমান করি। তেমনই নিজের ভাষা এবং অন্যের ভাষা, দুটিকেই সমান ভালোবাসা, সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে জানা এবং চেনার চেষ্টা করা উচিৎ। নইলে দেখা যাবে, অনেক কিছু জানা বাকি রয়ে গেল, অনেক কিছু বোঝা বাকি রয়ে গেল,অনেক কিছু ভাগ করে নেওয়া বাকি রয়ে গেল।

তোমার জন্য রইল পলাশ রাঙা ভালোবাসা।

চাঁদের বুড়ির চরকা

*সরকারী ভাষাঃভারতের সংবিধান অনুযায়ী ভারতের কোনও সরকারী ভাষা নেই। ভারতের দাপ্তরিক ভাষা বা অফিশিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ হল হিন্দি এবং ইংরেজি। ভারতের রাজ্যগুলি নিজস্ব সরকারি ভাষা বেছে নিতে পারেন। ভারতে এমন ২২ টি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা