সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
 জ্যেঠু

রিখিয়া গল্পের বই পড়তে খুব ভালবাসে,যে কোন রকমের বই।মনীষী দের গল্প,রূপকথার গল্প,ভূতের গল্প,অ্যাডভেঞ্চার সব কিছু।যেটা পায় তা-ই পড়ে।ওর বন্ধুরাও ওর এই বই -প্রীতির কথা জানে,তাই ওর জন্মদিনেও বই উপহার দেয়।শো-কেস ভরে গেছে বিভিন্ন ধরনের বই-এ।আর রাখার জায়গা নেই।পরীক্ষার সময়টুকু বাদ দিয়ে রোজ গল্পের বই পড়ে ও,তবে একটা কথা মা জানেন না,ইতিহাস পরীক্ষার সময় কিন্তু ও চুপিচুপি গল্পের বই পড়ে রাতে,কী করবেই বা রিখিয়া,ইতিহাস পড়তে যে ওর একটুও ভাল লাগেনা! বই এর লেখা গুলো যেন ওকে গিলে খেতে আসে,ভাল লাগেনা একদম।

মা বলেন এবার যদি এক বছরের মধ্যে ও কোন বই কেনে তবে আগের সব বই পেপারওয়ালা কে দিয়ে দেবেন।রিখিয়ার খুব রাগ হয়,কেন মা অমন বলল!বই কী খারাপ নেশা?তারপর অবশ্য নিজেই বোঝে যে সত্যিই তো, মা'র-ই বা কী দোষ,বাড়িতে তো আর সত্যিই রাখার জায়গা নেই,চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।আসলে ওর এই বই এর নেশা হয়েছে বাবার থেকে,বাবা-ই ওকে ছোটবেলার থেকে বই পড়ার অভ্যেস করিয়েছে,একটু হলেও শোবার সময় বই হাতে নিয়ে শুতে হত ওকে বিছানায়।আর এখন তো বই ছাড়া ঘুমনোর কথা ও ভাবতেই পারেনা।ঘুমই আসবেনা ওর!

কিছুদিন হল রিখিয়া গিরীশ চন্দ্র স্মৃতি লাইব্রেরি তে ভর্তি হয়েছে।রোজ বিকেলে ওখানে যায়। বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে ওকে নিয়ে আসেন।লাইব্রেরী তে আধ ঘন্টা ও বই পড়ে,বাকি আধ ঘন্টা গল্প শোনে,একজন জ্যেঠুর কাছে।জ্যেঠুর নাম জানেনা। তিনি রিখিয়া কে কত্ত গল্প শোনান! মনে হয় গল্পের চরিত্র যেন সব জ্যান্ত হয়ে ওঠে,সব ওর চোখের সামনে ঘুরে বেরায়! মোহিত হয়ে শোনে ও।জ্যেঠুর যে স্টকে কত্ত গল্প আছে কেউ জানেনা,ইতিহাস এর পাতা থেকে উঠে সবাই যেন রিখিয়ার সঙ্গে গল্প করতে আসে। পলাশির যুদ্ধ, মুঘল আমলের সুলতান আর তাদের বেগমরা,চেংগিস খান,ঝান্সির রানী লক্ষ্মীবাঈ,এদের সবাইকে রিখিয়া যেন কতদিন ধরে চেনে,মনে হয় ওদের পাড়ায়ই থাকে।আর সতীদাহ প্রথার ভয়ানক দৃশ্য ভাবতে গিয়ে চোখ খুলে রাখতে পারেনা রিখিয়া,কান্না পেয়ে যায়। রাজা রামমোহন রায় না থাকলে কী যে হত!

গল্পের মত এই সত্যি ঘটনা গুলো রিখিয়া মন দিয়ে শোনে,বিভোর হয়ে।লাইব্রেরি কাকুরাও ওদের কিছু বলেনা,রিখিয়ারা ওপাশে জানালার ধারে গিয়ে বসে,কারো যাতে অসুবিধে না হয়।জ্যেঠু যখন গল্প শোনায় তখন ও একটাও কথা বলেনা,বলার প্রয়োজনই হয়না,জ্যেঠু এত সুন্দর ভাবে সব বুঝিয়ে দেন।গল্পের ফাঁকে জ্যেঠু ওনার ঝোলা থেকে একটা ডাইরি বের করে চোখ বুলিয়ে নেন।সূর্য অস্ত যাওয়া বিকেলের আকাশ লাইব্রেরির জানলা দিয়ে এক অদ্ভুত রঙ ছড়িয়ে দেয়,কমলা,গোলাপি মেশানো, তখন পুরনো দিনের গল্পের সঙ্গে রিখিয়ারও টাইম মেশিনে করে চলে যেতে ইচ্ছে হয়।

আজ চার দিন হল জ্যেঠু আসছেনা,কী যে হল! শরীর টরির খারাপ হল নাতো? লাইব্রেরি কাকুদের জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হচ্ছেনা,ওরা কিচ্ছু বলতে পারছেনা রিখিয়া কার কথা বলছে! আশ্চর্য ব্যাপার!কেন যে রিখিয়া জ্যেঠুর বাড়ির ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করেনি,তবে বাবাকে সঙ্গে করে বাড়িতে চলে যেত ও জ্যেঠুর খোঁজ নিতে।একদম ভালো লাগছেনা ওর।এভাবে এক মাস পার হয়ে গেল,জ্যেঠু এলনা।

আজ রিখিয়া কুইজ কম্পিটিশনের ফার্স্ট প্রাইজ নিতে সিস্টার নিবেদিতা বিদ্যায়তন-এ গেছে। ওই স্কুলেরই একশো বছর পূর্তি বলে ওরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল,নাচ,গান,কুইজ,আবৃত্তি ইত্যাদি।কুইজে ও খুব পারদর্শী, কেউ ওকে হারাতে পারেনা।মা বাবা দুজনেই এসেছেন ওর সাথে।চারিদিকে গিজগিজ করছে মানুষ, ছাত্র ছাত্রীই বেশি সংখ্যায়।বিভিন্ন স্কুল থেকে প্রচুর শিক্ষক শিক্ষিকারাও এসেছেন,সবাই নিজনিজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের সামলাতে ব্যস্ত,মোটকথা একটা সাজোসাজো রব। মঞ্চে বক্তৃতা দিতে উঠেছেন এই স্কুলেরই হেড দিদিমণি ।সবাইকে এখানে আসবার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে শুরু করলেন।প্রথমেই বললেন তিনি বেশি সময় নষ্ট করবেন না,"...তবে যাঁর কথা না বললেই নয় তিনি হলেন আমাদের স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক শ্রী অভয় মিত্র মহাশয়। আজকের এই অনুষ্ঠানের সমগ্র পরিকল্পনা তাঁরই ছিল।কিন্তু তাঁর অকস্মাৎ প্রয়াণ আমাদের শোকস্তব্ধ করেছে, তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় বন্ধুসম,দাদা,আর ছাত্র ছাত্রীদের খুব প্রিয় অভয় স্যার।কারো কোন অসুবিধে হলে সবার আগে ছুটে যেতেন তিনি,গরীব ছাত্র ছাত্রীদের আলাদা করে পড়া বোঝাতেন, আর তিনি যখন পড়াতেন তখন ক্লাসে কেউ একটা আওয়াজ করতনা,মন দিয়ে শুনত।একটা যাদু ছিল তাঁর বলার ভঙ্গিমায়।অফ টাইমে স্কুলে বসে একটা ডাইরিতে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে গল্পের আকারে লিখে রাখতেন।তাঁর সম্বন্ধে যত বলা হয় কম। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই,তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা পূরণ করার চেষ্টা করছি।তোমরা শান্ত হয়ে বস,এখুনি আমাদের পুরষ্কার বিতরণ শুরু হবে"।

রিখিয়া চুপ করে কথা গুলো শুনছিল এতক্ষণ। হঠাত ও কেমন জানি হয়ে গেল,এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল মা বাবা আর পাশের সবাই চুপ করে কথা শুনছে।ওর বসে থাকতে ইচ্ছে করছেনা। কিছু কী সন্দেহ করছে রিখিয়া?নাহ! ও ভুল ভাবছে,এরকম তো কত মানুষ আছে পৃথিবী তে,স্বভাবে মিল থাকতেই পারে,অযথা চিন্তা করবেনা ও।স্টেজের দিকে মন দিল আবার। ছোট ক্লাসের মেয়েটি গাইছে,'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে'।

***

অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে সকাল থেকে,থামার নাম নেই,একই ভাবে হয়ে চলছে,বিরামহীন।অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে।আজ যেমন করেই হোক রিখিয়া কে লাইব্রেরি যেতেই হবে,কেন জানি ওর মনে হচ্ছে আজ ওখানে যাওয়াটা খুব জরুরী, মা কে যেমন করেই হোক রাজি করাতেই হবে!

মা শেষমেষ রাজি হলেন, একটাই শর্তে মা রিখিয়ার সাথে যাবে্ন।অগত্যা দুজনে ছাতা নিয়ে রওনা দিল,রাস্তায় বেশ জল জমে গেছে,খুব দরকার ছাড়া কেউ বের হয়নি বিশেষ।সারাটা রাস্তা মা বকতে বকতে গেলেন ওকে।

লাইব্রেরিটা খোলাই আছে ভাগ্যিস। মা কে খবরের কাগজ দিয়ে বসিয়ে রাখল ও, মা যাতে যাওয়ার জন্য তাড়া না দেন।চার নাম্বার আলমা্রি থেকে 'চাঁদের পাহাড়'টা নিয়ে চলে এল ওপাশের ঘরে,যেখানে ও বসে,জানলার ধারে।প্রচণ্ড জোড়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার,জানালা দিয়ে ছাঁট এসে পড়ছে মাঝেমাঝে ওর গায়ে।ঘরে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি নেই,আলোর পরিমান আজকে একটু কমই অন্য দিনের তুলনায়।কেন রিখিয়া এত ঝড় বৃষ্টির মধ্যে এল ও নিজেই বুঝতে পারছেনা।'চাঁদের পাহাড়' তো ও কতবার পড়েছে,খুব একটা পড়ায় মন ও নেই।বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে আর আনমনা হয়ে যাচ্ছে। মুখ সরাতেই চোখ পড়ল দেওয়াল আর টেবিলের মাঝে একটা কিছু আটকে আছে।টেনে বের করে দেখল একটা ডাইরি,মাঝারি মাপের।ধুলো ঝেড়ে ডাইরির পাতায় চোখ বোলাতে গিয়ে দেখে প্রতিটি পৃষ্ঠায় একটি করে গল্প লেখা,একটি গল্প পড়ে ফেলল রিখিয়া।লেখার ধরনটা ঠিক যেন জ্যেঠুর গল্প বলার মত! ডাইরিটা ভাল ভাবে আর একবার দেখল ও,এটাতো জ্যেঠুরই ডাইরি! চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রিখিয়া।ডাইরিটা ব্যাগ এ ভরে মাকে নিয়ে ফিরে এল তাড়াতাড়ি, সারা রাস্তা ও একটা ও কথা বলেনি।

 জ্যেঠু

রাতের অপেক্ষায় আর থাকতে পারছেনা ও।পড়ার টেবিলে বসে ডাইরির সব গল্প এক নিমেষে পড়ে শেষ করে ফেলল। তারপর ডাইরির ওপর মাথা রেখে ঘুমের দেশে চলে গেল,ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে,"খাবিনা?"

শোবার সময় আবার ডাইরিটা নিয়ে শুল সে।এমনিই পাতাগুলো ওল্টাচ্ছিল।এত সুন্দর হাতের লেখা জ্যেঠুর যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।কিন্তু সেকি? দুটো গল্প তো এখনো পড়া বাকি ছিল,খেয়ালই করেনি।

পরদিন স্কুল থেকে ফিরে টিভিটা চালিয়ে চেয়ারে বসল রিখিয়া,পাশের টেবিলে চোখ পড়তে দেখল ওখানে ডাইরিটা।এখানে আবার কে আনল? হাতে নিয়ে এমনিই পাতা ওল্টাতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেল।দেখল আরো দুটো গল্প ও পড়েনি।কিন্তু ওর স্পষ্ট মনে আছে,নীল বিদ্রোহর পর আর কোন গল্প ছিলনা।

***

এভাবে রোজই দুটো করে গল্প বাড়তে থাকে জ্যেঠুর ডাইরিতে। ইতিহাস পড়তে এখন আর ভয় পায়না রিখিয়া,খুব ভাল নাম্বার পেয়েছে এবার।আর ওর এখন খুব মজা,রোজ নতুন নতুন গল্প পড়তে পারে, কারন এই ডাইরির গল্প কখনো শেষ হয়না,উল্টে বেড়ে চলেছে ক্রমশঃ।


ছবিঃ অর্কপ্রিয়া কোলে

ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো, সবে সবে লেখালেখি শুরু করেছেন,ছোট বড় সবার জন্য কলম ধরতে ভাল লাগে।ভাল লাগে বই পড়তে,অয়েল পেন্টিং করতে,আর মাঝে মাঝে সঞ্চালনার কাজে যেতে।নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতা খাতায় তুলে ধরতেও বেশ লাগে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা