সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
আমার শৈশব

ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য, বার্দ্ধক্যে পৌঁছে শৈশবের স্মৃতিচারণ করছি। প্রথমে বলি খেলাধুলোর কথা।

আমাদের শৈশব কাটত বয়স্ক পরিজনদের সান্নিধ্যে। সকলেরই তাই কাটে। তবে তখন বাড়িতে বিভিন্ন বয়সী মানুষের মধ্যে আমরা বড় হয়েছি।

একটু বড় মানে, তিন-চার বছরে আমাদেরও বাড়িতে সমবয়সী ভাইবোন আর পাড়ার সমবয়সীদের নিয়ে একটা খেলার দল তৈরি হয়ে যেত। মাঠ ছিল। সেখানে চোর চোর, গাদী, বুড়ি বসন্ত, লুকোচুরি প্রভৃতি বিভিন্নরকম খেলা খেলতাম আমরা। অবশ্যই সেটা অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত। বেশ অনেকখানি সময়। খেলার সময় জোচ্চুরি তো আমরা সকলেই ছোটবেলায় করেছি। অনেকভাবেই নিজেকে জিতিয়ে দেওয়ার পন্থা।

আমাদের খেলার মাঠের পাশেই ছিল আমগাছ লিচুগাছ প্রভৃতি। আমের সময়, আমরা কয়েকজন খেলছি, তার মধ্যে একজন হঠাৎ বলে উঠল, 'দাঁড়া আসছি' বলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে আম কুড়িয়ে নিয়ে এল। মানে, ও একাই খেয়াল করেছিল, আম যে পড়েছে। মজাই মজা।

এছাড়া আমরা খেলতাম ড্যাংগুলি, গুলি, প্রভৃতি। সেখানে ড্যাংগুলির গুলিটা লুফতে না পারলেও, যে কোন প্রকারে প্রমাণ করার চেষ্টা গুলিটা লুফেছে। অর্থাৎ যে মারছিল সে আউট হয়ে গেল। এইভাবে যে কোন খেলাতেই শুধু মজা। একটা খেলাতে কী যেন বিঘৎ মাপার, মানে বুড়ো আঙুলের মাথা থেকে কড়ে আঙুলের মাথা পর্যন্ত মাপার ব্যাপার ছিল, হাতটাকে একটু সরিয়ে দিতে পারলে, মাপটা বেড়ে যেত। সকলেই হাতটাকে একটু সরিয়ে দেওয়ার চুরিটা করতে চেষ্টা করত, আর বাকিরা খুব কড়া নজর রাখত।

এরপরে আসি গুলি খেলার কথায়। আমরা সাধারণতঃ তিনরকমভাবে গুলি খেলতাম।

নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে অনেকগুলো গুলি চালতে হবে। এবার সেখান থেকেই একটা গুলি দিয়ে, প্রতিপক্ষ যে গুলিটাকে বলবে, সেটাকে মারতে হবে। ঠিক সেটাকে মারতে পারলে জিৎ হলো, না হলে হার। জিতলে, যত গুলি চালা হয়েছিল, সবই যে জিতেছে তার – ফলে, সে এক হই হই ব্যাপার।

গুলি খেলতে একটা ছোট্ট গর্তের প্রয়োজন। যেটাকে বলা হতো পিল। খেলার একটা ধরণ ছিল, দূর থেকে চেলে, পিল-এ গুলি ফেলা। আরেক ধরণে, পিল-এ বুড়ো আঙুল রেখে ঐ হাতেরই মাঝের আঙুলে একটা গুলি নিয়ে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে টেনে ছেড়ে দিয়ে যদি প্রতিপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া গুলিকে মারা যায় তাহলে জিৎ।

সবসময়ে খেলা যে নিখাদ খেলাই হতো এমন নয়। খেলার চলে একরকম ছোট বনভোজন হতো প্রায়ই। জঙ্গল থেকে কিছু শুকনো গাছের ডাল যোগড় করা হত। এরপর যার যার বাড়ির রান্নাঘর থেকে চেয়ে আনা আলু, অথবা ওই জঙ্গলের থেকেই আমরুলশাক তুলে, সেগুলো ভাল করে ধুয়ে কচুপাতায় মুড়ে ঐ ডালপালায় আগুন লাগিয়ে পোড়ানো হত। বন্ধুরা সকলে মিলে, আলুপোড়া, পেঁয়াজ পোড়া, টকটক আমরুল শাক পোড়ার স্বাদ কী যে ভাল লাগতো!

আমাদের বন্ধুর দলটা বেশ বড় ছিল। কয়েকজন ছেলে, বেশির ভাগই মেয়ে। অনেকের সঙ্গে আজকে আর যোগাযোগ নেই, কারো কারো সঙ্গে আছে। এদের মধ্যে গৌরী আর দুর্গা ছিল দুই বোন। ওদের আরও অনেক ভাই-বোন ছিল। আমাদের বাড়িতে, আমি ছোট বলে, আমার দিদি আমাকে সংসারের কোন কাজই করতে দিত না, আর আমাকে লেখাপড়া করতেই হতো, ওদের বাড়িতে তেমন ছিল না। চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীর পরেই ওদের আর স্কুল যেতে হতো না, মায়ের সংসারে, সবধরণের গৃহস্থালীর কাজ করত। আর সেই কাজে কোথাও ভুল হলে ওদের মা খুব মারতেন। আর, আমি তো তখন এসব কাজ কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু আমাকে কখনও তার জন্য দিদির কাছে বকুনি বা মার খেতে হয়নি। কিন্তু গৌরীদের সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসতে হতো না। তাই, আমাদের বাড়িতে এসে দিদিকে সংসারের কাজে সাহায্য করত। তখন পাড়ায় সকলে মিলে একটা পরিবারের মতই থাকতাম।

দিদি আমাকে অনেক খেলনা, পুতুল এইসব কিনে দিতো। আমরা সব বন্ধুরা মিলে দিদির তত্ত্বাবধানে খেলতাম। কখনও পুতুলের বিয়ে হচ্ছে, কখনও খিচুড়ি, বড়াভাজা খাওয়া হচ্ছে, এরকম মজা করে দিন কাটত।

গৌরী দু্র্গাদের সব বোনদেরই ষোলো বা সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। তাই দু-তিন বছর পরে পরেই ওদের বাড়িতে বিয়ে লেগে থাকত। আমাদের বাড়িতে তো তেমন হওয়ার সুযোগ ছিল না। ওদের বন্ধু হওয়ার কারণে আমিও ওদের বাড়ির উৎসবগুলোতে খুব আনন্দ করতাম। মনে হত আমাদের বাড়িরই উৎসব।

এবারে বলি পড়াশোনার কথা।

আমাদের ছোটবেলায়, বিদ্যালয়ে ভর্ত্তির জন্য আজকের মতন প্রতিযোগিতা ছিল না। প্রথম শ্রেণী বা তার আগে স্কুলে ভর্ত্তি করাতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না। বাড়িতে পড়াশুনো চলত। বাড়ির বড়রাও, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্ত্তি করানোর ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করার জন্য কিছুটা সময় পেতেন।

দিদি নিজে কখনও স্কুলে পড়েনি। খুব ছোটবেলা থেকেই দিদিকে সংসারের সব কাজ সামলাতে হতো। দিদি রান্না করতে করতে আমাকে পাশে বসিয়ে পড়াতো। রুটি করার সময় মাটিতে যে আটা পড়ত তার মধ্যে আঙুল দিয়ে লিখে দিদি আমার অক্ষরপরিচয় করিয়েছিল। তারপরে শ্লেটে প্রতিটা অক্ষর বুলিয়ে বুলিয়ে অভ্যাস করতে হত। বড় বড় লাইন টানা খাতা। রোজ দুপুরে সেই পাতা ভর্তি করে হাতের লেখা অভ্যাস করতে হতো। না হলে সেইদিন বিকেলের খেলা বন্ধ।

এইভাবে নিয়মের বাঁধনে বাড়িতে পড়িয়ে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্ত্তি করার জন্য কর্পোরেশন স্কুলে পাঠানো হল। দিদি নিজে যায়নি আমার সঙ্গে, বাবার সঙ্গে আমাকে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে পরীক্ষা হলো। আমি পরীক্ষা দিলাম। যিনি পরীক্ষা নিলেন, তিনি বাবাকে বললেন, আমি সব পেরেছি। কিন্তু আমাকে ভর্ত্তি নেওয়া হলো না। আমি আজও জানিনা, সেদিন আমি কেন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্ত্তি হতে পারিনি।

পরের বছর দিদি আমাকে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্ত্তি করার জন্য পড়ালো। স্কুলে ভর্ত্তির পরীক্ষার দিন সকালে, দিদি নিজের সব কাজ সেরে, আমাকে একটা বই থেকে 'ডালকুত্তার রচনা' পড়তে দিল। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি, প্রশ্ন এসেছে, 'কুকুরের রচনা'। আরও তাছাড়া অঙ্কের প্রশ্ন ছিল। আরও কিছু প্রশ্ন ছিল, সবগুলো এখন আর মনে নেই। এবারেও আমি পরীক্ষায় সব পেরেছিলাম। আর এবারে ভর্ত্তি-ও হয়ে গেলাম তৃতীয় শ্রেণীতে।

স্কুলজীবন শুরু হলো। আমাদের ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়া আসার জন্য বাড়ির বড়দের বিশেষ চিন্তা করতে দেখিনি। স্কুলে যাওয়ার সময় একটা বাসরাস্তা পেরোতে হতো। সেটা আমরা বন্ধুরা মিলেই বন্দোবস্ত করতে পারতাম। আর, বাস-এর চালকরাও নিশ্চয়ই বুঝেই চালাতেন।

এখন যেমন বেশিরভাগ ছোটরাই পড়াশুনোর পাশাপাশি আরও কিছু শেখে, নাচ-গান, ছবি আঁকা, বাজনা বা সাঁতার, আমাদের ছোটবেলাতেও কেউ কেউ স্কুলের পড়াশুনোর পাশাপাশি এরকম কিছু শিখতো। সকলে শিখতে পারতো না। মূলতঃ আর্থিক সংগতি ছিলনা বলেই। তাই আমরা পড়াশুনোর বাইরে সেসবই করতাম, খেলতাম, যাতে আলাদা করে কোন প্রশিক্ষকের প্রয়োজন হতো না।

তাই ইচ্ছে থাকলেও, পড়াশুনো ছাড়া আর অন্য কিছু শেখা হয়ে ওঠেনি। তাই নিয়ে কোন অভিযোগও তৈরি হয়নি। পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার শিক্ষাটা সম্ভবতঃ আমাদের হয়েছিল।

একটু বড় হতে, খেলাধুলোর জন্য মাঠে যাওয়ার সুযোগও কমে এল। পড়াশুনোরও চাপ বাড়ছিলো। আর একটু একটু করে দিদিকে সাহায্য করার জন্য গৃহস্থালীর কাজও করতাম। আর এসবের মধ্য দিয়েই কলেজ পর্যন্ত পড়াশুনোটা যে চালিয়ে যেতে পারেছিলাম, দিদি সেটা শুরু করিয়ে দিয়েছিল বলেই। আমি আর আমার আর এক বন্ধু দুজনে যখন কলেজ যেতাম, পাড়ারই মোড়-এ, কয়েকজন মানুষ বসে থাকতেন। আমরা জানতাম তার ঢোল বাজিয়ে নাম-গান করতেন। আমরা যখনই সেখান দিয়ে যেতাম, তখনই তাঁদের গান বদলে যেত। তাঁরা ধরতেন,

'যে মেয়েরা চাকরি করে
জনম জাতি তারাই মারে
মেয়ের চাকরি ভীষণ পাপ
বিপর্যস্ত শ্বশুড় বাপ'।

অস্বস্তি হতো, কিন্তু কীভাবে যেন আমরা জেনে গিয়েছিলাম, এইগুলো উপেক্ষা করেই, কলেজ যেতে হবে। পাশ করে, তারপর চাকরি করতে হবে।

আর অন্য সম্ভবানাগুলো জানা ছিল বলেই, এগুলো উপেক্ষা করাও সহজ হয়েছিল। দিদি আমার থেকে ঊণিশ বছরের বড়। দিদিও ছোটবেলায় স্কুলে ভর্ত্তি হয়েছিল। কিন্তু ক্লাস ফোর-এর পরে আর পড়াশুনো করা সম্ভব হয়নি। সেসময় দিদিদের স্কুলে নিয়ম ছিল, স্কুলের মহিলা দপ্তরী স্কুল ছুটির পরে ছোট মেয়েদের বাড়ি পৌঁছে দিতেন। একদিন কোন কারণে মহিলা দপ্তরী স্কুলে আসতে পারেননি বলে, স্কুলের পুরুষ দপ্তরী দিদি-কে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর সেটা আমাদের বাবা-র জ্যেঠামশাই-এর চোখে পড়েছিল। তিনি এসে বাবাকে নিদান জানিয়ে গিয়েছিলেন, ফলে তারপরের দিন থেকে আর দিদিকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি।

সেদিন সম্ভবতঃ বাড়িতে দিদিকে স্কুল পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কেউই ছিলো না। আমার সৌভাগ্য, আমার জন্য দিদি ছিল।

ছবিঃ মিতিল

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা