সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

নমস্কার বন্ধুরা। আমি গেছোদিদি। আমার ভাইকে হয়ত তোমরা চেনো, সে যেখানে খুশি যেতে পারে। আর আমি? আমি যখন খুশি যেতে পারি। যেমন ধর এখন আমি এসেছি তোমাদের সময়ের প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে। সময় সোজাপথ ধরে চলে না, নয়তো বলতাম ব্যাকগিয়ার দিয়ে পিছিয়ে গেছি। যাই হোক, বল দেখি সাড়ে চারশো কোটি বছর, বা সাহেবদের ভাষায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে কী হচ্ছিল আমাদের এই পৃথিবীতে? তখন কি ডাইনোসর ইত্যাদি ছিল? নাকি শুধু পাথরের পৃথিবী একা একমনে সূর্যের চারদিকে বনবন করে ঘুরে যাচ্ছিল?

তোমাদের মধ্যে যাদের হাতে মুঠোফোন তৈরি তারা একপলকে গুগুলচাচা আর উইকিপিডিয়ামিঞা ঘেঁটে পট করে উত্তর বলে দেবে। হেসে বলবে, আরে গেছোদিদি, ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী কই? জন্মই তো নেয়নি আমাদের এই পেয়ারের গ্রহখানি।

হক কথা। মানে পুরোপুরি নয়, আংশিকভাবে ঠিক। তখন পৃথিবী জন্ম নিচ্ছে। সূর্যের চারদিকে গ্যাস ধুলোবালি ইত্যাদি সব পাঁইপাঁই করে দৌড়চ্ছে, একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে, আস্তে আস্তে গ্রহগুলো তৈরি হচ্ছে। সে তুলনায় ডাইনোসর এসেছে মাত্র ২৫ কোটি বা ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে।

বিশাল এক সময়সমুদ্র আগে পৃথিবীর জন্ম। আমি জানি কবে জন্ম, আমি গেছোদিদি। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা বললে ৪.৫ বিলিয়ন বছর, তোমরা জানলে কী করে? গুগুল বা উইকিপিডিয়া ঘেঁটে, বুঝলাম। কিন্তু ইন্টারনেটে এই তথ্য এল কোত্থেকে? উইকিপিডিয়া তো আর সবজান্তা নয়, যে যা প্রশ্ন কর তারই উত্তর পটাস করে উগড়ে দেবে। কাউকে না কাউকে কোনও এক সময়ে নিশ্চয়ই গবেষণা করে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হয়েছে? কে সে ব্যক্তি?

হিরো বিজ্ঞানী, ভিলেন বিজ্ঞানী
হ্যারিসন ব্রাউন (বাঁদিকে), জর্জ টিলটন (মাঝখানে), ও ক্লেয়ার প্যাটারসন (ডানদিকে)

চল যাই ১৯৪৮ সালে। স্থান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিনমুলুক। প্রফেসর হ্যারিসন ব্রাউনের (Harrison Brown) ল্যাব। ছাত্রের সংখ্যা দুই। একজন জর্জ টিলটন (George Tilton), অন্যজন ক্লেয়ার ক্যামেরন প্যাটারসন (Clair Cameron Patterson)। টিলটনের কাজ হল জারকন (Zircon) স্ফটিকে কতটা ইউরেনিয়াম (Uranium) আছে সেটা মাপা। প্যাটারসনের কাজ হল জারকনে কতটা সীসা (Lead) আছে সেইটা মাপা। ইউরেনিয়াম যে তেজস্ক্রিয় মৌল সেটা নিশ্চয়ই জানো, পরপর বিক্রিয়ার ফলে ইউরেনিয়াম ধীরে ধীরে পরিণত হয় সীসায়। মাঝে অনেকগুলো ধাপ আছে অবিশ্যি, তবে এখানে সেটা বিবেচ্য নয়। শুরুতে ইউরেনিয়াম হলে শেষে সীসা হবে, এটা জানলেই হবে। আর সীসা তেজস্ক্রিয় নয়, অতএব সেখানেই বিক্রিয়া শেষ। ইউরেনিয়ামের আবার দুটো আইসোটোপ (Isotope) আছে সেটাও নিশ্চয়ই জানো। ইউ-২৩৫ আর ইউ-২৩৮। এদের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের হার কিন্তু আলাদা। ধর ১ গ্রাম ইউ-২৩৫ ও ১ গ্রাম ইউ-২৩৮ নিয়ে তোমার এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলে। ৭০৩ মিলিয়ন বছর পরে আধ গ্রাম (১/২ গ্রাম, ০.৫ গ্রাম) ইউ-২৩৫ পড়ে থাকবে, আর থাকবে আধ গ্রাম সীসা। ইউ-২৩৮ আরও ধীরগতিতে চলে। আজ ১ গ্রাম ইউ-২৩৮ পালটে ১/২ গ্রাম ইউ-২৩৮ ও ১/২ গ্রাম সীসা হতে সময় লাগে ৪.৫ বিলিয়ন বছর।

হিরো বিজ্ঞানী, ভিলেন বিজ্ঞানী
ইউরেনিয়াম-২৩৮ তেজস্ক্রিয় ক্ষয় সারণী, ধাপে ধাপে গিয়ে শেষে সীসা (বাঁদিকে), ও জারকন (Zircon) স্ফটিক (ডানদিকে)

৪.৫ বিলিয়ন বছর! হুম! বেশ কাকতালীয় ব্যাপার তো।

আসলে ব্রাউন, টিলটন ও প্যাটারসন পৃথিবীর বয়স মাপার চেষ্টা করছিলেন। বাইবেলের সময়ে পৃথিবীর বয়স ধরা হত হাজার ছ’য়েক বছর। তারপর বৈজ্ঞানিক উপায়ে সেই বয়স ধাপে ধাপে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩.৩ বিলিয়ন বছরে। কিন্তু তাতেও প্রচুর অনিশ্চয়তা ছিল। ব্রাউন চেয়েছিলেন নিশ্চিতরূপে পৃথিবীর বয়স বের করতে। এর জন্য একটা ইকোয়েশনও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয় ক্ষয় থেকে সীসা কতটা কতদিনে হয় এই তথ্য তখন জানা। সেই তথ্য ব্যবহার করে পৃথিবীর একদম আদিম সময়ের কিছু পাথর দরকার, সেই পাথরে কতটুকু ইউরেনিয়াম ও কতটুকু সীসা আছে মেপে সেই তথ্য ব্রাউনের ইকোয়েশনে ফেললেই বোঝা যাবে কতদিন পূর্বে সেই পাথরের সৃষ্টি হয়েছিল। কেল্লা ফতে!
কাজটা বলতে যতটা সহজ, আদপে করতে ততটাই কঠিন। পৃথিবীর একদম প্রথম সময়ের পাথর কোথায় পাওয়া যাবে? কীকরে বোঝা যাবে সে পাথর আদিম পাথর? পৃথিবী অত্যন্ত ব্যস্ত গ্রহ, সারাক্ষণ আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত ঝড় ভূমিকম্প জলবাতাস সূর্যের তাপজনিত ক্ষয় (erosion) লেগেই রয়েছে। আদিম পাথর যদি থেকেও থাকে, হয় সে এতদিনে রূপ পালটে ফেলেছে, নয়তো পৃথিবীর এমন কোন কোণায় লুকিয়ে আছে যে তাকে খুঁজে পাওয়া ইন্দ্রের অসাধ্য।
অতএব উপায়?

উপায় বাতলে দিলেন প্যাটারসন। বললেন, পৃথিবীর পাথর নিয়ে টানাটানি করে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং শান্তস্থির স্থানজাত কোনও পাথর নিয়ে গবেষণা হোক। এমন কোন গোপালসুলভ স্থান এই দুনিয়ায় নেই বটে, কিন্তু মহাকাশে আছে বৈকি। পৃথিবী এবং তার ভাইবোন গ্রহদের জন্মের সময় যারা বাড়তি ছিল, সেই পাথুরে উল্কাপিণ্ড নিয়ে গবেষণা করতে হবে। কোটি কোটি বছর মহাকাশে কাটালেও সেই পাথরের নিজের আদিম সত্ত্বা ধরে রাখতে পারবে। এবং যেহেতু সেই উল্কাপিণ্ডর জন্ম মোটামুটি পৃথিবীরই সঙ্গে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, অতএব সেই উল্কাপাথরের বয়স বের করতে পারলে অটোমেটিকালি পৃথিবীর বয়সও বেরিয়ে আসবে।

যেমন ভাবা তেমনি কাজ। উল্কাপিণ্ড বাজেয়াপ্ত হল, তার ভেতরের জারকন স্ফটিক বের করা হল। সেই জারকন স্ফটিক গুঁড়ো করে মাস স্পেক্ট্রোমিটার (Mass Spectrometer) যন্ত্র দিয়ে তার মধ্যে কতখানি ইউরেনিয়াম ও কতখানি সীসা আছে সেটা মেপে ফেলা গেল। এবং সেখান থেকে ব্রাউনের আবিষ্কৃত ইকোয়েশনে ফেলে পৃথিবীর বয়স মেপে ফেলা গেল।

ব্রেক্কে ব্রেক্কে। উঁহু, অত সহজ নয়। গবেষণা যদি এতই সহজ হত তাহলে তো এতদিনে মানুষ গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সিতে পাড়ি দিচ্ছে, সব অসুখের চিকিৎসা বেরিয়ে গেছে, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ লুপ্ত পেয়েছে।

গোলমাল দেখা গেল গোড়াতেই। আসল পরীক্ষা শুরু করার আগে টেস্ট করার জন্য টিলটন ও প্যাটারসন চেনা পাথরের ওপর যন্ত্র চালিয়েছিলেন। চেনা অর্থাৎ তাতে কতটা ইউরেনিয়াম কতটা সীসা থাকার কথা সেটা আগে থেকে জানা। পাতি গ্র্যানাইট (granite) পাথর। যতটা থাকার কথা, পাওয়া গেল তার চেয়ে অনেক বেশি। ক্যালিব্রেশন (Calibration) করতে গিয়েই এরকম গলদ বেরোলে তো আসল গবেষণার কপালে দুঃখ আছে। কী উপায়?

উপায় বাতলালেন টিলটন। বললেন, ল্যাবে নিশ্চয়ই অন্য কোন উৎস থেকে ইউরেনিয়াম ও সীসা এসে পাথরের সাম্পেল দূষিত করছে, তাই পরীক্ষার ফলাফল ভুলভাল আসছে। ওই ল্যাবে আগে ইউরেনিয়াম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে, আর সীসা আসছে নিশ্চয়ই কাঁচের গবেষণার পাত্র ও জল থেকে। টিলটন নতুন একটা ল্যাবে গিয়ে ফের এক্সপেরিমেন্ট করলেন, এবার একদম ঠিকঠাক রেজাল্ট এল। প্যাটারসন ডিস্টিলড ওয়াটার ব্যবহার করলেন, কাঁচের পাত্র বারংবার রাসায়নিক উপায়ে পরিষ্কার করলেন, করে ফের এক্সপেরিমেন্ট করলেন। উঁহু। সীসার পরিমাণ প্রত্যাশার চেয়ে অনেকাংশে বেশি। প্যাটারসন ছাড়বার পাত্র নয়। পিএইচডি শেষ করে ব্রাউনের সঙ্গে শিফট করলেন ক্যাল্টেকে। সেখানে নিজের হাতে তৈরি করলেন বিশ্বের সর্বপ্রথম ক্লীন রুম (clean room) ল্যাব, নিশ্চিত করলেন যে কোনওভাবেই যেন বাইরে থেকে সীসা না আসতে পারে। এতসব করে শেষে ঠিকঠাক ক্যালিব্রেশন হল। ক্যানিয়ন ডিয়াব্লো (Canyon Diablo) নামক উল্কাপিণ্ড থেকে জারকন স্ফটিক বের করে সীসার পরিমাণ সঠিকভাবে মাপা গেল, ব্রাউনের ইকোয়েশনে ফেলে পৃথিবীর বয়সও বেরল। ৪.৫৫ বিলিয়ন বছর, ৭০ মিলিয়ন বছর এদিকওদিক হতে পারে। গল্প শেষ।


ক্যানিয়ন দিয়াব্লো (Canyon Diablo) উল্কাপিণ্ড

শেষ? কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর তো পাওয়া গেল না। গ্র্যানাইট সাম্পেলে অত সীসা এল কোত্থেকে। পৃথিবীর বয়স মেপে প্যাটারসন তখন মোটামুটি বিখ্যাত, কিন্তু ছাড়ার পাত্র তিনি নন। বাড়তি সীসার উৎস খুঁজতে পাড়ি দিলেন সমুদ্রে, মাপলেন সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতায় সীসার পরিমাণ। তারপর পাড়ি দিলেন অ্যান্টার্ক্টিকা (Antarctica) মহাদেশে। সেখানে মাটির তলায় সুড়ঙ্গের মধ্য থেকে বরফ কেটে সীসার পরিমাণ মাপলেন। ফলাফল যা পেলেন তা মারাত্মক। গত কয়েক দশকে পৃথিবীতে সীসার পরিমাণ কয়েকশোগুন বেড়েছে।

বেড়েছে তো কী হয়েছে? অতি ক্ষুদ্র পরিমাণেও সীসা মানুষের পক্ষে বিষ। প্যাটারসনের মত পোড় খাওয়া বৈজ্ঞানিক সীসা নিয়ে কাজ করার সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেন, যাতে শরীরে সীসা না ঢুকতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর মাটিতে জলে বাতাসে এত সীসা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। এমন কী ঘটেছে ১৯২০ সাল থেকে যাতে পৃথিবীতে সীসার পরিমাণ এত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে?

১৯০৮ সাল। মার্কিনমুলুকের ডেট্রয়েট শহর। গত দশ বছরে ঘোড়াবিহীন শকটের (horseless carriage) সংখ্যা বেশ বেড়েছে। ঘোড়াবিহীন শকট মানে বুঝলে তো? এখন যাকে আমরা মোটরগাড়ি বলে চিনি, তাকেই তখন অনেকে হর্সলেস ক্যারেজ বলত। ঘোড়া নেই, রেললাইন কয়লাও নেই, তাও সে দুমফট দুমফট করে চলতে থাকে, বেশ মজার ব্যাপারই বটে।

এমনই এক মোটরগাড়ি চালিয়ে ব্রিজ পেরোচ্ছিলেন এক মহিলা। ব্রিজের মাঝখানে গাড়িটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। স্টার্ট বন্ধ, তো কী এমন মুশকিল বাপু? গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে ফের স্টার্ট দিলেই মিটে যায়। একী! স্টার্ট দেওয়ার চাবি কই? সেরেছে। এ গাড়ি তো ভেতরে বসে চালু হয়না। বাঁকানো একটা রড নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গায়ের শক্তি প্রয়োগ করে ইঞ্জিন চালু না করলে গাড়ি যে চলবে না। এ কী গেরো রে বাবা?

মহিলা পড়েছেন মুশকিলে। সেই দেখে আরেক মোটরচালক এসে মহিলাকে সাহায্য করেন। বাঁকানো রড ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করেন সেই ভদ্রলোক, নাম বায়রন কার্টার (Byron Carter)। দুঃখের বিষয়, ইঞ্জিন সম্ভবত সম্পূর্ণ থেমে যায়নি, বা গেলেও কোনও মামুলি যান্ত্রিক গোলোযোগের জন্য হঠাৎ করে চালু হয়ে যায়। রডটা তখনও লাগানই ছিল, হঠাতে সেটা ঘুরে গিয়ে কার্টারের চোয়ালে সজোরে আঘাত করে। জ্ঞান হারান কার্টার, দিনকয়েক বাদে মারাও যান।
কার্টার মামুলি লোক ছিলেন না। হলে হয়ত প্যাটারসনকে সীসা নিয়ে চিন্তা করতে হত না। কার্টার নিজে মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারক ছিলেন তো বটেই, তাঁর কাছের বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন ক্যাডিলাক (Cadillac) মোটরগাড়ি কম্পানির কর্ণধার ও প্রতিষ্ঠাতা হেনরি লীল্যন্ড (Henry Leland)। ভবিষ্যতে কার্টারের মত দুর্ঘটনা এড়াতে তিনি আবিষ্কারক চার্লস কেটারিংকে (Charles Kettering) ক্যাডিল্যাক কোম্পানিতে নিযুক্ত করলেন। কেটারিঙের তত্ত্বাবধানে ১৯১২ সালে নতুন সেলফ-স্টার্টার ক্যাডিলাক মডেল বেরল। স্টিয়ারিং হুইলে বসেই স্রেফ পায়ের আলতো চাপে গাড়ি চালু হবে। লীল্যন্ড খুশি, কেটারিঙও খুশি।

হিরো বিজ্ঞানী, ভিলেন বিজ্ঞানী
বায়রন কার্টার (বাঁদিকে), হেনরি লীল্যন্ড (মাঝখানে), ও চার্লস কেটারিং (ডানদিকে)

অবশ্য এই জিত বেশিদিনের নয়। হেনরি ফোর্ড (Henry Ford) ততদিনে মুভিং অ্যাসেম্বলি লাইন (moving assembly line) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১৫ মিনিট অন্তর একটা করে মডেল টি (Model T) মোটরগাড়ি প্রস্তুত করছেন। তার ওপরে তখনকার চার সিলিন্ডার ইঞ্জিনওয়ালা পেট্রলের মোটরগাড়িতে আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছে — ইঞ্জিন নকিং (engine knocking)।

হিরো বিজ্ঞানী, ভিলেন বিজ্ঞানী
হেনরি ফোর্ড (বাঁদিকে), ১৯২৫ সালের ফোর্ড মডেল টি (Ford Model T) (মাঝখানে), ও ১৯১৩ সালে হাতল ঘুরিয়ে গাড়ি চালুর চেষ্টা (ডানদিকে)

পেট্রলের অন্তর্দহন ইঞ্জিন (Internal Combustion engine) কীভাবে কাজ করে সংক্ষেপে দেখা যাক। ইঞ্জিনের ভেতরে কয়েকটা সিলিন্ডার, তাতে একটা করে পিস্তন (piston) রয়েছে। পিস্তন আবার ক্র্যাঙ্কশ্যাফট দিয়ে গাড়ির চাকার সঙ্গে যুক্ত। পিস্তন ওঠানামা করলে চাকাও ঘুরবে, এমন ভাবেই ডিজাইন করা গোটা ব্যাপারটা। কিন্তু পিস্তন ওঠানামার জন্য শক্তি ও বল কে জোগাবে? সে কাজ পেট্রল ও অক্সিজেনের। কার্ব্যুরেটরে পেট্রল ও বায়ুর মিশ্রণ ঘটবে, সেখান থেকে সেই মিশ্রণ এসে পৌঁছবে সিলিন্ডারে। পিস্তন নামলে প্রবেশদ্বার খুলে যাবে, মিশ্রণ সিলিন্ডারে প্রবেশ করবে। এটা প্রথম ধাপ। পিস্তন তারপর উঠবে, মিশ্রণের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে, মিশ্রণ সঙ্কুচিত হবে। এটা দ্বিতীয় ধাপ। তৃতীয় ধাপে স্পার্ক প্লাগ বিদ্যুতের ফুলকি ছাড়বে, সঙ্কুচিত মিশ্রণে বিস্ফোরণ ঘটবে। বিস্ফোরণের চাপে পিস্তন ফের নীচের দিকে নামবে, বর্জ্য মিশ্রণ ধোঁয়ারূপে সিলিন্ডার ত্যাগ করবে। এটা চতুর্থ ধাপ। পুরো ব্যাপারটা মিলে ফোর স্ট্রোক (four stroke) ইঞ্জিনের কাণ্ডকারখানা।

হিরো বিজ্ঞানী, ভিলেন বিজ্ঞানী
অন্তর্দহন ইঞ্জিনের ফোর স্ট্রোক সাইকেল

চার সিলিন্ডারের গাড়ি হলে তাতে চারটে পিস্তন আছে, স্পার্ক প্লাগ ঠিক ঠিক সময়ে ফুলকি ছাড়বে, চার পিস্তন তাল বজায় রেখে ওঠানামা করবে, তাতে গাড়িও মসৃণভাবে চলবে। মুশকিল হল, তৃতীয় ধাপে স্পার্ক প্লাগ ফায়ার করার আগেই পিস্তনের চাপেই যদি মিশ্রণে বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে তালের ঠিকও থাকবে না, আর যথেষ্ট শক্তি উৎপাদনও হবে না। তার সঙ্গে হবে বেতাল বেলয় কানফাটা আওয়াজ। এরই নাম ইঞ্জিন নকিং। এই নকিঙের চোটে মোটরগাড়ি ব্যবসা যথেচ্ছ ফুলেফেঁপে উঠতে পারছে না। ওইরকম সাংঘাতিক শব্দশকটে কেই বা চড়তে চাইবে?

সমস্যার সমাধানের ভার পড়ল কেটারিঙের কাঁধে। কেটারিং বুঝলেন, বেশ গম্ভীর মামলা, একা পারবেন না, চাই এক দক্ষ সহকারী। ডাক পড়ল টমাস মিজলি জুনিয়রের (Thomas Midgely Jr)। ১৯১৬ সালে কেটারিং ও মিজলি কাজ শুরু করলেন। লক্ষ্য, পেট্রলে এমন একটা কিছু মেশাতে হবে যাতে পিস্তনের চাপে বিস্ফোরণ না ঘটে। পরের পাঁচ বছর পেট্রলে মেশানো হল হাজারখানেক রাসায়নিক। কিছুতেই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হল না। সবচেয়ে কাছাকাছি গিছল টেলুরিয়াম (Tellurium) মৌল। নকিং থামল বটে, কিন্তু দুঃখের বিষয়, টেলুরিয়ামের বিকট রসুনরসুন গন্ধটা এড়ানো গেল না। অতএব বাতিল।

৯ ডিসেম্বর, ১৯২১। সমস্যার সমাধান হল! এমন এক রাসায়নিক যৌগের খোঁজ পাওয়া গেল যাতে নকিঙও বিদেয় নিল, গন্ধসমস্যাও দেখা দিল না। কেটারিং মিজলি মিলে এই যৌগমিশ্রিত পেট্রল বাজারে ছাড়লেন, নাম দেওয়া হল এথিল (Ethyl)। মোটরগাড়ির বিশ্বে এথিল এক বিপ্লব আনল। শুধু নকিং গেল তা নয়, ইঞ্জিনের আওয়াজ কমল, শক্তিও বাড়ল। মোটর যুগ শুরু হল।

এইসব উৎসবের মধ্যে মিজলি চুপিচুপি ফ্লোরিডা গেলেন, ছুটিতে। সবাইকে বললেন বটে, ছুটিতে যাচ্ছেন, আসলে গেলেন স্বাস্থ্য ফেরাতে। শরীর খারাপ হতে শুরু করল, গায়ের তাপমাত্রাও কমতে লাগল। গরম রৌদ্রোজ্জ্বল ফ্লোরিডায় মাসখানেক ছুটি কাটিয়েও সম্পূর্ণ সুস্থ হলেন না মিজলি। হবার কথাও নয়। সব উপসর্গই যে সীসার বিষক্রিয়ার ফল!

মানবদেহে ক্যালশিয়াম অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌল। হাড়ের জন্য, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য, এমনকি মস্তিষ্কে নিউরন থেকে নিউরনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্যও ক্যালশিয়াম একান্ত প্রয়োজন। মুশকিল হল, আমাদের শরীর ক্যালশিয়াম আর সীসার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আরও মুশকিল হল, ক্যালশিয়াম যে দরকারি কাজগুলো অত্যন্ত সুষ্টভাবে করে, সীসা তার একটাও পারে না। উলটে ক্ষতি করে। শরীরের সীসার সংক্রমণ ঘটলে বেশিরভাগ মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সংক্রমণের পরিমাণ বেশি হলে মৃত্যু অবধারিত।

কিন্তু মিজলির শরীরে সীসা এল কোত্থেকে? মিজলি তো এথিল নিয়ে গবেষণা করতেন। এক মিনিট! এথিল? এ’তো ব্র্যান্ডনেম। ঠিক যেমন প্যারাসেটামলকে আমরা ক্রোসিন ক্যালপল বা ডোলো নামে চিনি, এথিলের নিশ্চয়ই একটা আসল রাসায়নিক নাম আছে। এমন একটা নাম, যেটা কেটারিং ও মিজলি ইচ্ছে করে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন। এথিলের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের একটাতেও এই রাসায়নিক নাম উপস্থিত নয়। থাকবে কীকরে? থাকলে তো মুশকিল। কেননা এথিল যে আসলে টেট্রাএথিল লেড (Tetraethyl Lead)। চারপাশে চারটে এথিক গ্রুপ, মাঝে একটা সীসার পরমাণু।

সীসা। সব মোটরগাড়ি এখন এই সীসাযুক্ত পেট্রলে চলছে। পেট্রল পুড়ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে সীসাও গ্যাসীয় যৌগরূপে আকাশেবাতাসে ছড়াচ্ছে। ১৯২২ সাল থেকে কত গাড়ি যে সীসাযুক্ত বা লেডেড পেট্রলে চলেছে তার ইয়ত্তা আছে? প্যাটারসন কেন অত সীসা পেয়েছিলেন এবার বোঝা গেল। সারা পৃথিবীটাই সীসার বিষক্রিয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।

এ গল্পে হিরো বিজ্ঞানী ক্লেয়ার প্যাটারসন, আর ভিলেন বিজ্ঞানী টমাস মিজলি জুনিয়র। এদের হিরোগিরি বা ভিলেনগিরি এখানেই সমাপ্ত নয়। মিজলিকে দিয়েই শুরু করি। বিশ শতকের বিশ দশক। এথিল তৈরির কারখানায় একের পর এক কর্মী হয় পাগল হয়ে যাচ্ছেন, নয়তো মারা যাচ্ছেন, নয়তো দুটোই হচ্ছে। প্রথমের দিকে ধামাচাপা থাকলেও পরে খবর বেরিয়ে পরে। জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে ১৯২৪ সালে প্রেস কনফারেন্স ডেকে মিজলি নিজের হাতের এথিল ঢালেন, তারপর এথিলের বোতল খুলে সেটাকে এক মিনিট ধরে শোঁকেন। বলেন তিনি নাকি কোনও কুফল ছাড়াই রোজ এই কাজ করতে পারবেন। এর পরেও অবশ্য কারখানায় সীসার বিষক্রিয়া চলতেই থাকে। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মিজলি নিজেই কাজ থেকে অস্থায়ী অবসর নিতে বাধ্য হন। পরে ১৯৩০ সালে মিজলি আবিষ্কার করেন ফ্রিয়ন গ্যাস। ফ্রীজ ঠান্ডা রাখার ব্যাপারে এক্সপার্ট নাকি এই গ্যাস। ফ্রিয়ন ক্লোরোফ্ল্যুরোকার্বন (Chlorofluorocarbon, CFC) গোত্রের রাসায়নিক। এই হাল্কা রাসায়নিক গ্যাস বায়ুমন্ডলের ওপরের স্তরে পৌঁছে ওজোন গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটায়, ওজোন ভেঙে অক্সিজেন তৈরি হয়। ওজোন স্তর ধ্বংস হতে শুরু করে, সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি (Ultraviolet) রশ্মি এসে পৌঁছয় পৃথিবীর মাটিতে। ত্বকের ক্যান্সারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সৌভাগ্য, ১৯৮৭ সালে সাক্ষরিত মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল (Montreal Protocol) সিএফসির ব্যবহার থামায়। পৃথিবীর ওজোন স্তরও ধীরে ধীরে মেরামত হয়।

আর প্যাটারসন? চিরকাল পেট্রলে সীসার ব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন প্যাটারসন। পেট্রল কম্পানিগুলো এতে খুব একটা খুশি হয়নি বলাই বাহুল্য। তেলকম্পানিরা প্রভাব খাটিয়ে বহু রিসার্চ কন্ট্র্যাক্ট থেকে প্যাটারসনের নাম হটিয়ে দিয়েছে। কেরিয়ারের প্রতিপদে বাধা সৃষ্টি করেছে বিগ অয়েল (Big Oil)। কিন্তু প্যাটারসন দমেননি। একমনে একাগ্রচিত্তে নিজের লড়াই লড়ে গেছেন। ফলস্বরূপ মার্কিনমুলুকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে সীসাযুক্ত পেট্রল প্রায় উধাও হয়, আর মার্কিনদের শরীরে সীসার পরিমাণ পরের দশ বছরে ৮০% কমে। বিশ্বে জাপান ১৯৮৮ সালে প্রথম সীসাযুক্ত পেট্রলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারত করে ২০০০ সালে। আশা করা যেতে পারে বায়ুমন্ডল ও পৃথিবীর বুকে সীসার পরিমাণ ভবিষ্যতে কমতেই থাকবে।

সিএফসি যে ওজোন স্তর ধ্বংসের কারণ হবে এটা টমাস মিজলি জুনিয়রের জানার কোনও উপায় ছিল না। মিজলি মারা যান ১৯৪৪ সালে। ওজোন স্তর নিয়ে মানুষের সচেতন হতে তখনও বেশ কিছু বছর বাকি। কিন্তু সীসাযুক্ত পেট্রল যে কতটা মারাত্মক জিনিস, সেটা বিলক্ষণ জানতেন মিজলি। জেনেশুনেই রাখঢাক করে এথিল বিক্রী করতে বাজারে নেমেছিলেন। জেনেশুনেই সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্য ১৯২৪ সালের প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন। জেনেশুনেই এই জঘন্য ঘৃণ্য অন্যায় অপরাধ করেছিলেন টমাস মিজলি জুনিয়র। কেন করেছিলেন? উত্তর খুবই সহজ। প্রফিট। লাভ। টাকা। ভিলেন, সন্দেহ নেই।

হিরো বিজ্ঞানী, ভিলেন বিজ্ঞানী
টমাস মিজলি জুনিয়র (বাঁদিকে), এথিল ব্র্যান্ডনেমে বিক্রী হওয়া টেট্রাএথিল লেডের (TetraEthyl Lead) বিজ্ঞাপন (মাঝখানে), ও ২০০৬ সালে অ্যান্টার্ক্টিকার ওপরে ওজোন স্তরে ক্ষত (ডানদিকে)

আর প্যাটারসন? বড়তেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিছলেন, সাধারণ মানুষের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। এ থেকে অর্থোপার্জন তো হয়ই নি, বরং ক্ষতি হয়েছে। তাও লড়ে গেছেন। কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। বিজ্ঞানীর ধর্মই যে তাই। সত্যের উন্মেষ করা। মানুষ ও প্রাণের রক্ষা করা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।

হিরো।

সোঘো যাঁর সিক্রেট আইডেন্টিটি তিনি পদার্থবিদ্যার লোক। থিওরেটিকাল ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করেটরে এখন ইংরিজি ও বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করেন। জীবনে প্রচুর টেনিদা, জটায়ু , টিনটিন , অ্যাস্টেরিক্স পড়ার সুবাদে সিরিয়াস থাকার ও লেখার প্রাণপণ চেষ্টা করেও প্রবলভাবেই ব্যর্থ হন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা