সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
সিরকো নামের কুকুর আর তার নেকড়ে বন্ধু

অনেক অনেক দিন আগের কথা, কতদিন আগের যে কথা, সেটা তোমার-আমার হাতের আঙুল গুণেও বুঝি শেষ হবে না। তো সেই অতদিন আগে এক গ্রামে এক লোক বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করতো। তার সাথে থাকতো সিরকো নামের এক কুকুর। সিরকো অনেক বছর তার মনিবের সাথে ছিল। বয়সের ভারে সে এখন আর আগের মতো বাড়ি পাহারার কাজ ঠিকঠাক করতে পারে না। কাজ করতে না পারার শাস্তি হিসেবে, একদিন সিরকো কে তার মনিব দিলো বাড়ি থেকে বের করে। বেচারা সিরকো পড়লো মহা বিপদে! এখন সে কোথায় যায়? বিষন্ন সিরকো মনের দুঃখে পথ চলতে চলতে ভাবে,

"কত্তগুলো বছর আমি মনিবের খেদমতে ছিলাম। তার বাড়ির দেখাশোনা করেছি।" সে বিড়বিড় করে, আর পথ চলতে থাকে, "এখন আমার বয়স হয়েছে, শরীরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগের মতো কাজকর্ম হয় না আমাকে দিয়ে। সেজন্যেই কপালে এমন ভোগান্তি। দয়ামায়ার ধার না ধেরে, মনিব আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিলো! মানুষ এত্ত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে! আরে বাবা, বের করে দেবার সময় দু’ এক টুকরো রুটি কী দেয়া যেত না আমায়! ক্ষিদেয় এদিকে পেটে নাড়িভুঁড়ির ডনবৈঠক চলছে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে খুব।"

এসব ভাবতে ভাবতে আপন মনে সিরকো পথ চলছিল, হঠাৎ কোত্থেকে এক হোৎকা নেকড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।

"বলি এভাবে ঘুরাফেরা করছো, তোমার কাহিনিটা কী বলো দেখি বাপু?" কৌতূহল নিয়ে নেকড়েটা সিরকোকে প্রশ্ন করলো। হাজার হোক জ্ঞাতিসম্পর্কীয় হালকা পাতলা একটা আত্মীয়তা তো আছে কুকুর জাতটার সাথে। হয়ত সেটার তাগিদেই সিরকো কে অনেকক্ষণ ধরে এলোপাথাড়ি ঘুরতে দেখে নেকড়ের কেমন একটু মায়াই হয়।

"এছাড়া আর কীইবা করার আছে আমার বলো নেকড়ে ভায়া? আমি আর কাজে লাগবো না ভেবে, আজই মনিব আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমার কোত্থাও যাওয়ার নেই।" দুঃখী দুঃখী গলায় উত্তর দিলো সিরকো।

সিরকোর কাহিনি শুনে নেকড়ের মনটা গলে গেল।

" তুমি চাইলে, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। নেকড়ে, সিরকো কে বললো, "আমি যেভাবে বলবো, যদি সেভাবে কাজটা করতে পারো তবে নিশ্চিত থাকো, তোমার মনিব তোমাকে আবারও বাড়িতে আশ্রয় দেবেই দেবে।”

"দয়া করো নেকড়ে ভায়া! দয়া করে আমাকে এই উটকো বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ বাতলে দাও।" সিরকো প্রায় কেঁদে ককিয়ে ওঠলো, "এ উপকারটা করলে, বিনিময়ে আমিও নিশ্চয়ই তোমায় একদিন প্রতিদান দেবার চেষ্টা করবো।"

"বেশ, তবে শোনো মন দিয়ে, খুব শীঘ্রই ফসল তোলার জন্য তোমার মনিব আর তার স্ত্রী মাঠে যাবে। স্বামীর কাজে সাহায্য করতে মনিবের স্ত্রীও তাদের ছোট্ট বাচ্চাটাকে খড়ের গাদায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে যাবে। তোমাকে কিন্তু বাচ্চাটার আশেপাশেই ঘাপটি দিয়ে থাকতে হবে, যেন আমার বুঝতে সুবিধা হয় বাচ্চাটা ঠিক কোথায় ঘুমোচ্ছে। মনিব আর তার স্ত্রীর ব্যস্ততার সুযোগে আমি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে উপস্হিত হবো, তারপর বাচ্চাটাকে খপ করে মুখে তুলে নেবো। তুমি তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে বাচ্চাটাকে আমার মুখ থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করবে। আমাকে একটু ভয় দেখাবার ভান ধরবে। আমিও ভয় পেয়েছি এমন একটা ভান করে মুখ থেকে বাচ্চাটিকে ফেলে পালিয়ে যাবো।"

মাঠের ফসল পেকে ওঠলে যথা সময়ে সিরকোর মনিব বউ বাচ্চা নিয়ে মাঠে গেলো। মাঠের কাছাকাছি জায়গাতে ছোট্ট বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে, ফসল তোলার কাজে স্বামীকে সাহায্য করতে স্ত্রীও মাঠে নামলো।

ওদিকে নেকড়ের কথা মতো খড়ের গাদার ওপাশে ঘাপটি দিয়ে থাকা সিরকোর উঁকি দেয়া কান দেখে নেকড়ের বুঝে নিতে দেরি হলো না বাচ্চাটা কোথায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ফন্দি মাফিক নেকড়ে সেখানে উপস্হিত হয়ে বাচ্চাটিকে মুখে তুলে মাঠ পেরিয়ে দিলো ভোঁ দৌঁড়। নেকড়ের পিছু পিছু ঘেউ ঘেউ করতে করতে সিরকোও ছুটলো। এমন সব্বোনাশে কাণ্ড দেখে মনিব সব ভুলে সিরকো কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, "ধর, ওকে ধর সিরকো!"

সিরকো ছুট্টে গিয়ে নেকড়ের মুখ থেকে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিয়ে তার মনিবকে ফিরিয়ে দিলো। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে মনিব সিরকো কে একটুকরো রুটি আর গোশত বকশিশ দেয়।

"এই যে ধর সিরকো, এগুলো খেয়ে নে। আমাদের বাচ্চাকে রক্ষার জন্য এই রুটি-গোশত্ তোর পুরস্কার।"

মনিব আর মনিবপত্নীর কাজ গুটাতে গুটাতে সন্ধ্যা নেমে আসে। বাড়ির পথে রওনা দেবার সময় সিরকোকেও তাদের সাথে নিতে ভুলে না।

বাড়ি ফিরেই মনিব স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে, "বেশ জম্পেশ করে রাতের খাবার তৈরি করো দেখি।" স্বামীর কথা মতো মনিবের স্ত্রী চটপট রান্না বসিয়ে দেন। চট জলদি রান্না হয়েও যায়। সিরকো কে পাশে বসিয়ে মনিব গরম খাবার বাটিতে নিয়ে সিরকোর সামনে রাখা মাত্র সে হুটোপুটি করে গরম খাবারে মুখ দিতেই জীভ্ যায় পুড়ে। সবাই সেটা নিয়ে হাসাহাসি করে।

মনিবের বাচ্চাকে নেকড়ের হাত থেকে বাঁচানোর পুরস্কার স্বরূপ সিরকো আবার মনিবের বাড়িতে আশ্রয় পায়। আর এটা সম্ভব হয় বন্ধু নেকড়ের জন্যই, সে কথাটা সিরকো ভুলে না মোটেও। কিভাবে বন্ধুর উপকারের প্রতিদান দেয়া যায় সেটা নিয়ে সে ভাবতে থাকে।

এদিকে মনিবের বাড়িতে মনিবের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়। সব কিছু চুপচাপ দেখেটেখে সিরকো একদিন টুক করে বেরিয়ে মাঠে গিয়ে নেকড়ের সাথে দেখা করে আসে। শলাপরামর্শ চলে দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ। সিরকো নেকড়েকে উদ্দেশ্যে করে বলে,

"শোনো ভাই, আগামি রবিবার সন্ধ্যায় তুমি আমাদের সব্জি বাগানে এসে ঘাপটি দিয়ে বসে থেকো। সময় মতো এসে আমি তোমায় ভেতর বাড়িতে নিয়ে যাবো চুপি চুপি। খাসা আয়োজন হয়েছে খাওয়া-দাওয়ার। কব্জি ডুবিয়ে খেও ভায়া! ভরপেট খাইয়ে তোমার দয়ার প্রতিদান দিতে পারবো আশা করি।"

নেকড়ে অপেক্ষায় থাকে। শনিবারের সন্ধ্যাটা এসে গেলে সে সিরকোর উপদেশ মতো সব্জি বাগানে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে তখন সাজ সাজ রব চারিদিকে। এরই ভেতর সিরকো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি নেকড়েকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। তারপর টেবিলের তলায় লুকিয়ে রাখে। অতিথিদের জন্য সাজিয়ে রাখা মজাদার সব খাবার থেকে কিছু খাবার নিয়ে টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাকা নেকড়েকে দেয়।

গপাগপ সব খাবার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নেকড়ে সাবাড় করে ফেলে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সিরকো আবারও তাকে খাবার যোগান দেয়। আবারও সে গপাগপ করে সবটা খেয়ে ফেলে। নেকড়েকে খাবার যোগাতে গিয়ে এক পর্যায়ে সিরকোর নিজের পিঠেই অতিথিদের পিটুনি পড়তে যাচ্ছিল আরেকটু হলে! মনিব সেটা দেখে তাদের বিরত করে বলে, "দয়া করে ওকে কেউ আঘাত করবেন না। আমার বাচ্চাটাকে নেকড়ের মুখ থেকে বাঁচিয়ে সিরকো আমাদের কৃতজ্ঞতায় বেঁধে ফেলেছে। ওকে এ পরিবারেরই একজন সদস্য হিসেবে দেখার অনুরোধ থাকলো সবার প্রতি।”

সিরকো নামের কুকুর আর তার নেকড়ে বন্ধু

মনিবের কাছ থেকে ইচ্ছে মতো খাবার চাখার অনুমতি পেয়ে সিরকোর তো পোয়াবারো। সে ভালো ভালো গোশতের টুকরো, পিঠা, কেক, মিষ্টি সমানে টেবিলের তলায় চালান দিতে থাকলো। এত এত খেয়ে নেকড়টার শুধু পেটই ভরে উঠলো না, মনটাও খুশিতে বাগ বাগ হয়ে গেল। খুব খুশিতে থাকলে নেকড়ের আবার গান গাইবার ঝোঁক চাপে। কাজেই সে গান গাইবে আব্দার করে সিরকোর কাছে। চারদিকে মানুষজন, টেবিলের তলায় লুকিয়ে গান করতে গেলে নির্ঘাৎ ধরা পড়ে বেদম পিটুনি জুটবে। সেকথা বলে সিরকো নেকড়েকে সাবধান করে। গানের কথা নেকড়ে যেন ভুলে যায়, সে জন্য ঘুষ হিসেবে এবার সিরকো ঠাণ্ডা এক বোতল শরবত টেবিলের নীচে পাচার করে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই নেকড়ে সে বোতল খালি করে ফেলে। খাওয়া শেষ হতেই নেকড়ে এবার সিরকো কে জানায়, গান সে করবেই, করবে। সিরকো কাতি মিনতি জানায়। তাতে তাদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে, আর তার পরিণতি দুজনের কারো জন্যই ভালো হবে না। নেকড়ের তখন অতশত শোনায় মন নেই। গান গাইবার জন্য তার গলা কেমন চুলবুল করছে! নিজের মনেই বিড়বিড় করে নেকড়ে,

“গান না করে চুপ থাকা আর সম্ভব না, যা হবার হোক।"

যে মাত্র গান গাইবে বলে নেকড়ে মুখ খুলেছে, সুরের বদলে, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বেসুরো বিকট চিৎকারে অতিথিরা চমকে ভয়ে লাফ দিয়ে, আতঙ্ক নিয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। অনেকেই নেকড়েকে মারবে বলে লাঠিসোটা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। মতিগতি সুবিধার না বুঝে সিরকো নিজেই লাফ দিয়ে নেকড়ের উপর গিয়ে পরে। ভাবখানা তার এমন যে ব্যাটাকে আজ মেরে আর আস্ত রাখবে না! ওদিকে রাগে-ভয়ে অস্হির অতিথিদের শান্ত হবার অনুরোধ করে মনিব বলে, "সবাই শান্ত হোন দয়া করে। কেউ নেকড়েকে মারতে যাবেন না, তাতে সিরকোর পিঠেই ঘা পড়ার সম্ভাবনা। বদের হাড্ডি নেকড়েকে শায়েস্তা করতে সিরকো একাই যথেষ্ট।"

সিরকো নেকড়েকে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে মাঠে নিয়ে যায়। বলে, "একবার তুমি আমার উপর সদয় হয়ে ভারী উপকার করেছিলে। আজ সেই উপকারের প্রতিদান দিলাম বন্ধু। তুমি পালাও জলদি।" এরপর, দুই বন্ধু একে অন্যকে বিদায় জানিয়ে আলো ঝলমল বিয়ে বাড়ির দিকে একজন, অন্যজন মাঠ পেরিয়ে দূরের বনের দিকে হাঁটা দেয়।

(মূল কাহিনি: সিরকো দ্য ডগ এণ্ড দ্য উলফ : ইউক্রেন-এর উপকথা)

ছবিঃ মিতিল

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা