সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
দুখু মিয়াঁ

তুমি হয়ত কবির লড়াই শব্দটা শুনেছ, তাই না? শব্দটা শুনলেই কেমন মনে হয়... দু'জন বা তার থেকেও বেশি কবি দল বেঁধে লড়াই করছে? লড়াই বটে... তবে তাকে মোটেই হাতাহাতি ভেবে বস না! সে হ'ল কবিতার লড়াই। কবিতা বলতে, এখন তুমি যে কবিতা যেমন ভাবে পড়... দু'শ বছর আগে তো তার চেহারা, উপস্থাপনা বা পরিবেশন সেরকম ছিল না। তখন এমন অনুষ্ঠান করে, সেরা কবিয়ালরা মুখোমুখি আসত। কবিতার জবাবে কবিতা শোনানো হ'ত... তাও সুর করে গানের মত ছড়া বলে বলে। এমন কবিতার জবাবে কবিতা চলতে... লড়াইয়ের রূপ নিয়ে নিতো এই পালটা উত্তর... শ্রোতাদেরও রীতিমত গা গরম হয়ে উঠত মাঝে মাঝে। আর অবশেষে যে আর পালটা উত্তর দিতে পারত না সে পরাজিত হ'ত। জয়ী কবিয়ালকে উপযুক্ত সাম্মানিক দেওয়া হ'ত। এটা অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত বাঙালী সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ মনোরঞ্জনের অঙ্গ ছিল। তা যে সব সময় খুব ভাল কিছু হ'ত তা অবিশ্যি নয়... তোমাদের বয়সীরা সে সময় থাকলে, বাড়ির বড়রা হয়ত তোমাদের সেখানে যেতেই দিতো না এই ছোট্টবেলাতে। কিন্তু এই কবির লড়াইয়ের সামাজিক জায়গা তো একটা ছিল। বড় বড় জমিদার বাড়িতেও যেমন আয়োজিত হ'ত... তেমনই পাড়া প্রতিবেশীরাও একসাথে এখন যেমন জলসার ব্যবস্থা করে, তখন কবির লড়াইয়ের ডাক দিতো। কোনও কোনও কবি এমন কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে করতে রীতিমত নামডাক-ওলা কবিয়াল হয়ে যেতেন... এই যেমন ধর ভোলা ময়রা (তার কথা অন্য কোনওদিন বলব ক্ষণ)। আর এমন বড় নাম না হলেও... ছোট-বড়-মাঝারি কবিয়াল গ্রামে গঞ্জে থাকতেন অনেকেই। বলতে পার, ভক্তিগীতি (শাক্ত-বৈষ্ণব) কাব্যের বাইরে কবিতা-গানের যে 'কমার্শিয়াল এন্টার্টেনমেণ্ট'... কবিয়ালরাই তাকে ধরে রেখেছিলেন। বেশ তালেবর হয়ে উঠতেন এদের কেউ কেউ... নিজেদের দল তৈরী হয়ে যেত। সেই দল নিয়ে এক গ্রাম থেকে এক গ্রাম গিয়ে কবির লড়াইয়ে কবিতা-গান করা... মনোরঞ্জন করা শ্রোতা-দর্শকদের... গানের তালে তালে খোল-করতাল বাজছে, সঙ্গে নাচ... আর শেষে হাততালি-পুরস্কার পাওয়া। টাকার নোট, মেডেল, ব্যাজ... সব ঝুলত তাদের পোষাকে। এগুলো তাঁদের সাম্মানিক... অর্জিত পুরষ্কার।

তো, একবার হয়েছিল কি... এক গ্রামে একজন এমন বয়স্ক কবিয়ালের বেশ নামডাক ছিল... আর অহঙ্কারও ছিল স্বাভাবিক ভাবেই। এমন তালেবর কবিয়ালদের নিজের দল থাকত... আগেই বলেছি। সেই বুড়ো তার দলবল নিয়েই কবির লড়াইয়ে নামত। আর তৈরী থাকত কখন হারতে বসা অন্য কবিয়ালকে নাকানি-চোবানি খাওয়াবে সদলবলে কবি-গানের আসরে। এমন দজ্জাল কবিয়াল বুড়োকে একদিন হঠাৎ একটা বারো বছরের ছেলে চ্যালেঞ্জ করে বসল। বুড়ো প্রথমে তাজ্জব, তারপর মনে মনে ভাবল 'হুঁ হুঁ বাবা... এবার তোকে ঘোল খাওয়াবো'। ছোট ছেলে এমন ওস্তাদি করলে কার আর সহ্য হয়ে বল? কিন্তু সেই ১২ বছরের 'ছেলেমানুষ' কবিয়াল আর পাঁচটা ছেলের মত ছিল না মোটেই... প্রথম কবিতার জবাবেই সে সুরেলা গলায় তার উত্তর শোনাল -

ওরে ছড়াদার, ওরে ‘দ্যাট’ পাল্লাদার
মস্তবড় ‘ম্যাড’
চেহারাটাও ‘মানকি’ লাইক
দেখতে ভারী ‘ক্যাড’
‘মানকি’ লড়বে বাবরকা সাথ
ইয়ে বড় তাজ্জব বাত
জানে না ও ছোট্ট হলেও
হামভি ‘লায়ন ল্যাড’।

ইংরেজ আমলে এমন ইংরেজী শব্দ দিয়ে গান বেঁধে মশকরা করার প্রচলন ছিল... কবি গানেও মানুষ বেশ মজা পেত। একটা বাচ্চা ছেলের কাছে এমন পালটি জবাব শুনে বুড়ো কবিয়ালের যে কি অবস্থা হয়েছিল... তা যদি তোমরা দেখতে পারতে!

সেই কবিয়ালদের লড়াইতে কে জিতেছিল খুব জানতে ইচ্ছে করছে তাই তো? আমারও করছে। কিন্তু কি জানো... ঐ একটা লড়াইতে অবশেষে কে জিতল... সেটা বড় কথা নয়। এই ছোট্ট কবিয়ালের কথা, সেদিনের কবির লড়াইয়র কথা... এই ছড়াটি... সব কিছু আমরা মনে রেখেছি, ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একেবারে অন্য কারণে। কারণটা হ'ল সেদিনের সেই বারো বছরের কবিয়াল... দুখু মিয়াঁ। সেদিনের সেই বাচ্চা ছেলেটির শব্দ চয়ন, ইংরেজী শব্দের প্রয়োগ, ছন্দবোধ থেকে হয়ত সেই প্রবীন কবিয়ালও বুঝেছিলেন... এ ছোকরা আর পাঁচটা এলেবেলেদের মত নয়। দুখু মিয়াঁর স্বপ্নময় চোখদু'টো হয়ত ওনাকেও টেনেছিল। যেমন আমাদের টেনে রাখে তাঁর ছবিগুলিতে ওই আয়ত নেত্রর দৃষ্টি, এত বছর পরেও।

তুমি বোধহয় ভাবছ 'দুখু মিয়াঁ' আবার কেমন নাম? একটা দশ-বারো বছরের ছেলের আবার কী এমন দুঃখ যে তার নাম দুখু মিয়াঁ? আমিও তোমাদের মতই ভাবতাম, সত্যি বলতে... এখনও ভাবি। বাবা-মা এমন নাম রাখেন কেন? শোনা যায়, ছেলেটির বাবা-মা এমন নাম রেখেছিলেন, কারণ তার আগে চারজন সন্তান জন্মের পরেই মারা যায়। ফকির আহমেদ আর জাহেদা খাতুনের প্রথম সন্তানের জন্মের পর... চারটি সন্তান জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই বাবা-মা কে ছেড়ে চলে গেল এক রাশ দুঃখ দিয়ে। তারপর এই ছেলেটি... বাবা-মা'র বড় বেশি প্রিয়... অনেক দুঃখের পর জন্ম, তাই নাম দুখু। আর দেখ কেমন হয়... দুখুর বয়স যখন আট, তখনই তার বাবা চলে গেলেন চিরকালের জন্য। ওই অল্প বয়স থেকেই দুঃখ চেনা আর কঠিন সময়ে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার শিক্ষা শুরু। গ্রামের মসজিদে ইমামের সহকারী হিসেবে কাজ করত। পাড়ায় মিলাদ পড়াত একটু বড় হয়ে। এ সব করে করে যে সামান্য পয়সা রোজগার হতো, তাই দিয়ে তাদের সংসার চলত। জমি-জায়গা তাদের কিছুই ছিল না। এরপর একসময় কিশোর দুখু মিয়া আসানসোলের এক কয়লা খনিতে কাজ জুটিয়ে নেয়। তাতেই বা রোজগার কত? যা করে তা দিয়ে সংসার চলে না। তা ছাড়া কাজ করতে গিয়ে তার পড়াশোনারও ক্ষতি হয়ে গেল। তাই, এসব ছেড়ে আবার দুখু গ্রামে এসে পাড়ার মক্তবে লেখাপড়া শুরু করল। বছর দুই পরে মক্তবের পরীক্ষায় পাসও করল সে। সেই সময় তার সংসারে সকলের যে কি কষ্টে দিন কাটত, তা হয়ত তোমরা বুঝতেই পারছ।

অসম্ভব মেধাবী বলে দুখু যে ক্লাসে পড়ত সেই ক্লাসের ছাত্রদের অনায়াসে পড়াতে পারত। তার হাতের লেখা যেমন সুন্দর ছিল, তেমনি সুন্দর ছিল তার পাঠ করার ক্ষমতা। যেমন দক্ষতার সঙ্গে বাংলা পড়ত, তেমন সুন্দর করে পড়ত আরবি। গ্রামের মানুষরা যারা অত পড়াশুনো করেনি, তারা অবাক হ'ত ছেলেটির মেধা দেখে, তাকে খুদে পণ্ডিত ভাবত। এই সময়েই মেধাবী দুখু মিয়াঁর সঙ্গে আলাপ হ’ল তার দূর সম্পর্কের কাকা মুন্সী বজল-এ-করিমের। মন্সী করিম ছিলেন গ্রাম্য কবি, আরবি-ফারসিতে গজল লিখতেন। চাচার কবিতা বা গানের পদ মিলিয়ে লিখতে গিয়ে নিজের কবি প্রতিভার মুখোমুখি হ'ল দুখু। মুন্সী করিমও বুঝলেন, এ ছেলের খ্যামতা আছে। ছোট ছেলে মনের খুশিতেই গজল লেখায় হাত দিলো, এ আর এমন কি ব্যাপার? কিন্তু তার সঙ্গে শুরু হ'ল আরবি-ফারসী-বাংলায় পড়াশুনো। সব কিছু চেনা এবং জানার অদম্য কৌতূহল তাকে মহাভারত থেকে আরব্য-রজনী তাড়িয়ে নিয়ে চলল। এর পাশাপাশিই চলল তার অর্থ-উপার্জন আর সংসারের প্রতি দায়িত্ববোধের সংগ্রাম... কখনও লেটোর দলে গান-বাজনা, কখনও রুটির দোকানের কাজ। আসানসোল থেকে ময়ম সিংহ, আবার আসানসোলে ফিরে আসা... দুখুর জীবনে একজায়গায় থাকা বলে কিছু নেই। ক্লাস টেন-এর পরীক্ষা দেওয়ার সময়তেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ! ভাবো... একটা ক্লাস টেনের ছেলে ব্রিটিশ সরকারের ডাকে জমায়েত হওয়া ভারতীয় যুবকদের মাঝে চলে গেল যুদ্ধ করতে! দেশের জন্য? নাকি সংসারের জন্য? নাকি কিশোর বয়সের অদম্য দুঃসাহসে? না জানি দুখুর বাড়ির লোকের মনের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল চোদ্দ-পনেরো বছরের ছেলেকে বন্দুক ঘাড়ে যুদ্ধে যেতে দেখে। কিন্তু এই যুদ্ধের সময়, সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা, দেশ এবং দেশের মানুষকে আরও বিশাল ব্যাপ্তিতে চেনার অবকাশ... দুখুকে অনেক বড় করে দিলো ওই ক'টা বছরেই। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে দেখা গেল, দুখু আর সেই দুখু নেই... পরিণত মন নিয়ে কবিতা রচনা করছে... অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল তার কবিতা।

এরপর তো দুখু'র জীবন নিজেই এক বিরাট গাথা... একের পর এক পরীক্ষা জীবনে। তার মধ্যে দিয়ে দুখু বিদ্রোহী, দুখু ব্রিটিশ সরকারের চক্ষুশূল, দুখু বাঙালীর গজল-সম্রাট, দুখু কালীভক্ত, দুখু হিন্দু-মুসলমানের চোখের মণি... আর কত কি! কিন্তু কি জানো... ওই যে ছেলেটা সেদিন কবিয়ালদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিলো... যে ছেলেটাকে জীবন একদম ছোট্টবেলায় পরীক্ষার মুখে ফেলে শৈশব কেড়ে নিয়েছিল... সে মনের কোণায়, কোথাও একটা বার বার চেয়েছিল ছোট দুখু কে খুঁজে পেতে।

দুখু তাঁর পূর্ণবয়সেও ছিলেন অপূর্ব প্রাণশক্তির প্রতীক। তাঁর অদ্ভুত ভালবাসা আর শ্রদ্ধা ছিল প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য, তোমাদের মতো ফুল আর কুঁড়িদের জন্য। তোমাদের কথা মনে করে যখন তিনি লিখতেন, একেবারে তোমাদের বন্ধু হয়ে উঠতেন। তাই - ওনার ছড়া, কবিতা, গান, নাটিকা তোমাদের মতো ছোট শিশু-কিশোরদের ভাবনায় কাণায় কাণায় ভরপুর।

দুখু মিয়াঁ বড় হওয়ার পর, একাধিক কারণে নিজের লেখার জগতে তোমাদের বেশি সময় দিতে পারেন নি, একথা সত্যি... কিন্তু তার মধ্যেও তিনি - পুতুলের বিয়ে, ঝিঙেফুল, সাতভাই চম্পা, সঞ্চয়ন, ঝড়, পিলে পটকা, ঘুম জাগানো পাখি... এমন সৃষ্টি রেখে গেছেন শুধু তোমাদের কথা মনে রেখেই। তুমি যদি তাঁর শিশু সাহিত্য রচনার শুরু গল্প শোন, মনে হবে এক একটা নিজেই মনে রাখার মত গল্প। কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামের আলী আকবর খান ছিলেন কলকাতার স্কুল পাঠ্য বই-এর প্রকাশক ও একজন পুস্তক ব্যবসায়ী। দুখু মিয়াঁর সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। এই আলী আকবর খান এক সময শিশুদের উপযোগী কবিতা লিখে নজরুলকে শোনাতেন। কিন্তু ওসব কবিতা ভাল লাগত না বলে দুখু মিয়াঁ নিজেই শিশুদের নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তিনি শিশুদের উপযোগী কবিতা লেখা শুরু করেন তখন তিনি লেখেন ‘লিচু চোর'। লিচু চোর পড়েছ তুমি? - সেই যে - বাবুদের তালপুকুরে, হাবুদের ডাল কুকুরে... মনে পড়ছে? তাহলে বোধহয় দুখু মিয়াঁকেও চিনে ফেলেছ!

বিশেষজ্ঞরা বলেন এই দুখু মিয়াঁর লেখা ছড়াগুলোর পেছনেও অনেক গল্প আছে। এই যেমন ধর, খাদু দাদুকে নিয়ে লেখা ছোড়াটি যেমন খান বাহাদুর আনোয়ার হোসেন বলে এক ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা। খান বাহাদুর আনোয়ার হোসেন ছিলেন বৃটিশ সরকারের কর্মচারী। কিন্তু এই দুখু মিয়াঁ ছিলেন ভীষণ ভাবে বৃটিশবিরোধী। তিনি সঙ্গত কারণেই পছন্দ করতেন না আনোয়ার সাহেবকে। একবার কোনও এক কারণে আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া করে ওনার মেয়ে পরিচিত দুখু মিয়াঁর কাছে চলে আসে তার শিশু কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। ছোট্ট মেয়েটির একদিন খুব মন খারাপ। দুখু মিয়াঁ ঠিক বুঝলেন, এতদিন দাদুর থেকে দূরে, আনোয়ার সাহেবের আদরের নাতনীর তাই মন খারাপ। সেই ছোট্ট মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতেই উনি লিখলেন 'খাদু দাদু' ছড়াটি। ছড়াটির মূল বিষয় ছিল খান বাহাদুর সাহেবের নাক। তার নাকটি ছিল একটু খাড়া। ধরা যায়, সেই নাক নিয়ে মশকরা করেই দুখু মিয়াঁ লিখলেন-
‘তোমার দাদুর নাকে কে মেরেছে ল্যাং...’

১৯২১ সালে দুখু মিয়াঁ একবার কুমিল্লায় বেড়াতে গেলেন ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের অতিথি হয়ে। ইন্দ্রকুমারের ছোট্ট মেয়ে অঞ্জলি খুব শিগগিরি দুখু'র বন্ধু হয়ে ওঠে। দুখু মিয়াঁ তখন কবি হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। তবুও মনে কোণে সেই বালক দুখু এই মেয়েটির খেলার সাথী হয়ে যায়। প্রায়েই বিকেল হলে, মেয়েটি পেয়ারা খাওয়ার জন্য গাছতলায় গিয়ে গাছের ডালে কাঠবিড়ালি দেখত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। রোজ মেয়েটির এমন কাঠবিড়ালি থেকে নজরুল লিখলেন- ‘খুকী ও কাঠবিড়ালি' কবিতাটি।

‘কাঠবিড়ালি! কাঠবিড়ালি!
পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও?
দুধ-ভাত খাও?
বাতাবি-নেবু? লাউ?
বিড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?’

এরপর একসময়, কিছু দিন মোগলপুর লেনের বাসিন্দা ছিলেন দুখু মিয়াঁ। সেখানেও পাশের বাড়ির একটি ছেলে দুখুর বন্ধু হয়ে গেল। তাঁর বাড়িতে খেলতে এসে রোজ ঘুমিয়ে পড়ত ছেলেটি। সেই ছেলেটির প্রিয় ফুল ছিল ঝিঙেফুল জেনে দুখু মিয়াঁ লিখে ফেললেন -

‘ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল
সবুজ পাতার দেশে
ফিরোজিয়া ঝিঙেফুল।’

দুখু মিয়াঁ দু'তিনবার চট্টগ্রামে যান। সেখানে গেলে হাবিব-উল্লাহ বাহার ও তাঁর ছোট বোন শামসুন্নাহারদের বাড়িতেই থাকতেন কবি। শামসুন্নাহার মাহমুদের জ্যেষ্ঠ সন্তান তিন মাসের ছেলের জন্য লিখলেন- ‘শিশু যাদুকর' কবিতাটি। একদিন বাহার সাহেব কবিকে বললেন, এবার শিশুদের জন্য কিছু লিখুন না। পরদিন সকাল বেলায় কবির খাতায় পাওয়া যায় ‘সাত ভাই চম্পা' নামক বিখ্যাত কবিতাটি।

শিশুদেরকে দুখু মিয়াঁ সত্যিই খুব ভালবাসতেন। তাদের সাথে খেলা করতেন। গল্প করতেন। তাই তিনি ভাবতে পেরেছিলেন-

‘খোকার মনে ঠিক মাঝখানটিতে
আমি যদি পারি বাসা নিতে।’

বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত, নজরুল স্মৃতি বইতে সুখলতা রাও 'প্রভাতী' কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, “মানুষের জীবনে প্রত্যেক দিনই প্রভাত আসে। ভোর হয়। সুন্দর একটি সকাল দিয়ে প্রতিটি দিনের কাজ হয় শুরু। তা নজরুল তাঁর 'প্রভাতী' কবিতা দিয়ে সব শিশুদের সম্মুখে যেন এক চির-চেনা প্রভাতকে নতুন সাজে এনে মেলে ধরেছেন। তার এই কবিতায় নানা রঙে রাঙা প্রভাতের ছবিটি কী মনোমুগ্ধকর! পাহাড়ী ঝর্ণার মতো শীর্ণ, অথচ চঞ্চল গতিতে চলছে এগিয়ে-

ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি উঠো রে!
ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুল খুকি ছোটো রে!
রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান গায় গান শোনো ঐ, রামা হৈ।.

এবারে, আমাদের দুখু মিয়াঁর বিখ্যাত শিশু-সাহিত্যগুলো কখন প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো তোমার জন্য এক এক করে নিচে রেখে দিই -

ঝিঙেফুল - কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল-১৯২৬
পুতুলের বিয়ে - কবিতা ও নাটিকা। প্রকাশকাল-১৯৩৩
সঞ্চয়ন - কবিতা ও নাটিকা। প্রকাশকাল-১৯৫৫
পিলে পটকা - কবিতা ও নাটিকা। প্রকাশকাল-১৯৬৩
ঘুম জাগানো পাখি - কবিতা। প্রকাশকাল-১৯৬৪
ঘুম পাড়ানী মাসী পিসী। প্রকাশকাল-১৯৬৫
সাত ভাই চম্পা। প্রকাশকাল-১৯৮২
ফুলে ও ফসলে। প্রকাশকাল-১৯৮২
ভোরে পাখি। প্রকাশকাল-১৯৮২
তরুণের অভিযান। প্রকাশকাল-১৯৮২
মটকু মাইতি। প্রকাশকাল-১৯৮২
জাগো সুন্দর চির কিশোর। প্রকাশকাল-১৯৮২
(১৯৮২ সালে প্রকাশিত বইগুলি সব মরণোত্তর প্রকাশিত)

এছাড়াও ১৯৩০ সালে নাটক 'ঝিলিমিলি' প্রকাশিত হয়। এতে 'সেতুবন্ধন' ও 'ভূতের ভয়' নামে যে দু'টি রূপক নাটিকা আছে তা ছোটদেরও ভালো লাগবে।

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনকে এক চিঠিতে দুখু মিয়াঁ লিখেছিলেন, 'আমি দখিনা হাওয়া। ফুল ফুটিয়ে যাওয়া আমার কাজ... শিশু কুসুমগুলোকে যদি আমি উৎসাহ দিয়ে আদর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার বড় কাজ। তারপর আমি বিদায় নিয়ে চরে যাব আমার হিমগিরির গহবর বিবরে।' সত্যিই ওনার ঘটনা প্রবল জীবন, ব্যক্তিগত জীবনের শোক, মানসিক পরিস্থিতি... এ সব কিছুর মাঝে, এই ভাবে দুখু মিয়াঁ নিজের কলমে বার বার আসে পাসে দেখার মত ছোট্ট দুষ্টু-মিষ্টির মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে ছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন সেই শৈশবের দুখু মিয়াঁর হয়েই।

এতক্ষণ যার কথা তোমায় শোনালাম, উনি কে বুঝতে পেরেছ তো? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ... কাজী নজরুল ইস্‌লাম-ই বটে। মূলত কবি পরিচিতিতেই শ্রদ্ধেয় কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উনিই ছিলেন সকলের প্রিয় দুখু মিয়াঁ। ওনার স্বদেশপ্রীতি, মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা এবং আস্থা, প্রকৃতি প্রেম, ন্যায়-পরায়ণ মনোভাব, সাম্প্রদায়িক প্রীতির সদিচ্ছা, একই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের জন্য ভক্তিগীতি রচনা, চলচ্চিত্র জগতে অবদান... এই নিয়ে তুমি অনেক অনেক কিছু জানতে পারবে। যদি নজরুলের মত মনীষী সম্বন্ধে পড়াশুনো কর। বুঝবে, ওনার মত মানুষ সত্যিই আজ সমাজে কত প্রয়োজন। বড়দেরও জিজ্ঞেস করবে, জানতে চাইবে ওনার সম্বন্ধে। আমি শুধু তোমাকে দুখু মিয়াঁর গপ্পো বললাম একটু... তোমাদের জন্য ওনার ভালবাসার কথা মনে করে।


ছবিঃ উইকিপিডিয়া

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা