কুসুম আর শী-দের গল্প
স্কটল্যান্ড জায়গাটা ভারী সুন্দর। এখানে ঝোপে ভরা পাহাড়চূড়াগুলি ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ে বসে থাকে; সবুজ ফার্ণগাছগুলি মানুষের সমান লম্বা হয়ে নদীবহুল উপত্যকাগুলিকে ঢেকে রাখে। এরকম জায়গা পরীদের খুব প্রিয়, বেশ মানুষের চোখের আড়ালে গোপনে থাকা যায়। আর সত্যিই, সেজন্যই স্কটল্যান্ডের পার্বত্য প্রদেশগুলিতে পরীদের বেশ ভীড়। পরীরা কেউ দয়ালু, কেউ পরশ্রীকাতর, আর একদল আছে, যাদের স্কটরা ‘শী’ বলে ডাকে, তারা জ্ঞানী, বৃদ্ধ ও অনেক ক্ষমতার অধিকারী।
অনেকদিন আগে একবার দুজন শী মহিলা এইরকম পরিবেশে রাংচিতার বেড়া দেওয়া গ্রামের বাড়িগুলির আশে-পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বড় বড় বাদাম গাছের তলায় তাদের লুকোচুরি খেলা বেশ জমে উঠেছিল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। খুঁজে পেতে দেখা গেল, একটা বড় গাছের তলায় ভাল করে পশমী শালে জড়ানো এক ছোট্ট মানবশিশু, শুয়ে শুয়ে চিৎকার করছে। ধারে পাশে কেউ নেই। তারা যখন বাচ্চাটিকে দেখার জন্য নিচু হয়েছে, বাচ্চাটি তাদের দেখে আনন্দে খিল্খিল্ করে হেসে উঠল।
পুঁচকে বাচ্চাটাকে দেখে পরী মেয়েরা তো একেবারে মোহিত হয়ে গেল। একজন বলল, “ধারে পাশে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় বাচ্চাটাকে কেউ ফেলে দিয়ে গেছে।” আরেকজন বলল, “কেউ যখন দাবি করতে আসছে না, তখন ও আমাদেরই হল।” তারা চট্ করে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে শী-দের দেশে চম্পট দিল।
একটু পরেই বাচ্চার মা, ধরো তার নাম কুসুম, এসে হাজির। সে রান্নাঘরের জন্য কিছু ডালপালা কুড়োবার জন্য সামান্য একটু দূরে গিয়েছিল। ফিরে এসে বাচ্চাকে না দেখে সব জায়গায় আতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না। অন্ধকার নেমে এল; কাঁদতে কাঁদতে সে বাড়ি ফিরে এল। প্রতিবেশীদের সমস্ত ঘটনা জানালে পরদিন ভোর হতেই সকলে শিশুটিকে খুঁজতে তরুণী মায়ের সঙ্গে বেরোল। তারা ঝোপে ঝাড়ে, লম্বা ফার্ণের জঙ্গলে, সর্বত্র খুঁজল; চেনাশোনা সমস্ত পথিককে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু শিশুটি যেন একেবারে উবে গেল। এক সপ্তাহ ধরে দিন-রাত্রি এক করে খুঁজেও শিশুটির কোনো চিহ্ন পাওয়া গেলনা। ক্রমে সবাই আশা পরিত্যাগ করল; শুধু মায়ের মন তার হারাধনের আশায় অতন্দ্র হয়ে রইল।
সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, কুসুম ঠিক করল তাকে একাই যেতে হবে বাচ্চার খোঁজে; প্রয়োজন হলে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে সে যাবে। কোথাও, কখনও সে খুঁজে পাবেই তার জীবনের একমাত্র অবলম্বনকে। এ পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কে আছে মায়ের, স্বামীও তো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। গ্রাম থেকে শহরে, তার থেকেও দূরে দূরান্তরে শুরু হল বেচারী মেয়েটির একা পথ চলা, জনে জনে জিজ্ঞাসা করা; কিন্তু কেউই হারিয়ে যাওয়া শিশুটির কথা বলতে পারল না।
শেষ পর্যন্ত সে এসে পৌঁছাল ভবঘুরে বেদেদের শিবিরে। সে জানত এইসব লোকেরা দেশ-দেশান্তর ব্যাপকভাবে ঘুরে বেড়ায়। তাই হয়ত জানতেও পারে, এই আশায় তাদের জিজ্ঞাসা করল তার হারিয়ে যাওয়া শিশুর সংবাদ। কিন্তু তাদের কাছেও তো এর জবাব নেই। তবে এই দয়ালু লোকগুলি যখন তার কাহিনী শুনল, তাদের কুসুমের জন্য খুবই দুঃখ হল। তাই তারা যখন উত্তর দিকে যাত্রা করল, তখন তাকেও সেই বেদেদলের সঙ্গে নিয়ে গেল। আশা, তাদের দলের অন্য একটি শিবিরে যে এক অতি প্রাচীন বৃদ্ধা থাকেন, যাঁর কাছে পৃথিবীর সব জ্ঞান গচ্ছিত রয়েছে, তিনি যদি কোনো হদিস দিতে পারেন।
অনেকদিন ধরে চলে বেদের দল উত্তরের শিবিরে পৌঁছাল। মেয়েটিও আশায় বুক বেঁধে এল সেই প্রাচীনার সঙ্গে দেখা করতে। লক্লকে আগুনের পাশে এক বৃদ্ধা গুঁড়িসুড়ি মেরে বসেছিলেন। বয়সের ভারে তাঁর শরীরটা কুঁচকে গিয়েছিল, চামড়া হলুদ হয়ে আঁকিবুকি রেখায় পুরোন ভূর্জপত্রের মত দেখাচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটি কাঁদ্তে কাঁদ্তে যখন তার ইতিহাস শোনাচ্ছিল, তখন তাঁর বলিরেখা ভরা মুখে চোখদুটি বুদ্ধিতে উজ্জ্বল হয়ে ঝক্ঝক্ করছিল।
সব কথা শুনে তিনি দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। মেয়েটির মনে হতে লাগল, হয় তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন নয়তো বহুবিলম্বিত মৃত্যু অবশেষে তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছে। শেষপর্যন্ত তাঁর নীরবতা ভাঙ্গল, মনে হল যেন বহুদূর থেকে তাঁর কন্ঠ ভেসে এল।
“বেচারা খুকুমনি, তোমার বাচ্চাকে শী-পরীরা চুরি করে নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। সেখানে যারা একবার যায়, তারা প্রায়শই আর ফিরে আসে না। তাকে পাবার আশা ত্যাগ করো।”
চিৎকার করে কেঁদে কুসুম বলে উঠল, “আমার প্রাণ থাকতে আমি তার খোঁজ করা ছাড়ব না। আমি জানি, শী-রা খুব শক্তিশালী। কিন্তু আপনার কাছেও তো আছে বহু বছরের সঞ্চিত জ্ঞান। তাদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য আমায় কিছু জাদুশক্তি দিন না?”
দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বৃদ্ধা বললেন, “শী-দের বিরুদ্ধে আমার কোন জাদুশক্তিই কাজে লাগবে না। তবে একটা মাত্র উপায় আছে, যার দ্বারা তুমি তোমার সন্তানকে ফিরে পেতে পার।”
সবাই উৎসুক হয়ে উঠল। তারপর বৃদ্ধা বেদেনী সেই মেয়েটিকে শী-দের কথা বললেন। খুব শীঘ্রই শী-দের দেশে এক বিরাট সম্মেলন হবে। দেশের প্রতিটি কোন থেকে সেখানে পরীরা জমায়েত হবে পরবর্তী একশ বছরের জন্য তাদের নেতা নির্বাচনের জন্য। এসব শুনে বিভ্রান্ত মেয়েটি বলে উঠল, “কিন্তু এর সঙ্গে আমার বা আমার বাচ্চার সম্পর্ক কি?”
“ধৈর্য ধরো মা, শী-দের একটা দুর্বলতার কথা তোমায় বলি শোনো। কোনো মানুষ কিন্তু এখবর জানে না,” খল্খল্ করে হেসে বৃদ্ধা বললেন, “শী-দের সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান ও ক্ষমতা থাকলেও তারা নিজেদের জন্য কিছুই তৈরী করতে পারেনা। তাই কোনো কিছু পেতে গেলে তারা হয় সেটা ভিক্ষা করে পায় বা চুরি করে। এই পরীগুলো খুব দাম্ভিক আর তারা খালি সেই সব জিনিষ পেতে চায় যেটা পৃথিবীতে আর কারো কাছে নেই। যদি তুমি এই পৃথিবীতে তেমন কিছু পাও তবে সেটার বদলে তুমি বাচ্চাকে ফিরে পাবার চেষ্টা করতে পার।”
দুঃখী মেয়েটি করুণ মিনতি করে বলে উঠল, “হে প্রজ্ঞাময়ী, দয়া করে আমাকে বলুন, কোথায় পাবো এমন জিনিষ। আর জিনিষটা যদি বা পাই, কিভাবে সেদেশে পৌঁছাব?”
“বাছারে, সেটা তো আমি বললে হবে না। এই অসামান্য জিনিষটা কোথায় পাবে, তা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। এছাড়াও শী-দের দেশে ঢুকবার রাস্তা জানতে গেলেও এইরকমই আরেকটা অনবদ্য বস্তু উৎকোচ হিসেবে দিতে হবে তোমাকে। তবে এখানে আমি তোমায় একটু সাহায্য করতে পারি। যাত্রাপথে তোমার যে কোনো রকম বিপদ থেকে রক্ষার উপায় আমি করব” – এই বলে বৃদ্ধা বেদেনী মেয়েটির মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। এভাবেই তিনি তাকে এমন এক জাদু রক্ষাকবচ দিলেন যেটা তাকে জল, স্থল, আগুন বা বাতাস থেকে আসা যেকোন বিপদ থেকে বাঁচাবে।
এবার বেদের দল যে যার পথে রওনা হয়ে গেল। কুসুম একা একটি মেয়ে, এক সন্তানহারা মা, আকাশের তলায় বসে ভাঙা শিবিরের অগ্নিকুন্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবতে বসল এবার তার কি করণীয়। দুটো জিনিষ তার চাই – একটি তাকে দেবে পরীর দেশে ঢুকবার পথের সন্ধান, আর দ্বিতীয়টি তাকে এনে দেবে হারানো সন্তানকে। কত অদ্ভুত জিনিষের কথা তার মনে পড়ল, যেগুলির কথা সে আগে শুনেছিল। তার মধ্যে দুটির কথা তার মনে এল, যেগুলিকে সত্যিই দুর্লভ বলা যায়; একটি নেক্টান-এর সাদা ঢিলে কোট আর অন্যটি রাড-এর সোনালী তারযুক্ত বীণা। কিন্তু তার মত এক সামান্য কৃশকায় মেয়ে কিভাবে এসব দুর্লভ বস্তু জোগাড় করবে যাতে এত ক্ষমতাশালী পরীরাও তাকে হিংসা করবে? তারপর তার মনে এল তার বাচ্চার কথা। ওঃ, সে যে সোনা-রূপোর থেকেও দামী! কুসুম আবার শক্ত হল আর দৃঢ়ভাবে কাজে এগোল।
প্রথমে সে এল সমুদ্রের তীরে। সেখানে খাড়াই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে নরম পালকের জন্য বিখ্যাত আইডার হাঁসদের বাস। পাথরগুলো জল লেগে লেগে ধারালো হয়ে গেছে। সেই পাথর ধরে উঠে সে খুঁজে ফিরল হাঁসেদের বুক থেকে ঝরে পড়া কোমল সাদা পালকগুলি। কতবার তার পা কেটে রক্তাক্ত হয়ে গেল, সাগরের ঢেউ তার পোষাক বারবার ভিজিয়ে দিল, সে ভ্রূক্ষেপও করল না। সূর্যের তাপে সে ক্লান্ত হল না, বৃষ্টি তাকে দমাতে পারল না। সমুদ্রের ঝড়ও তার কাছে মৃদুভাবে বয়ে গেল। বেদেনীর জাদু তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করছে, এই ভাবনাটা তাকে সাহস দিল।
অবশেষে তার প্রয়োজনীয় হাঁসের পালক জোগাড় হল। এবার কুসুম তা দিয়ে এমন একখানা কোট বানালো যেটা গরম কালের আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের মত নরম আর সাদা। সেই সুন্দর কোটের পাড় ধরে সে নিজের সোনালী লম্বা চুল দিয়ে ফুল, ফল, পাতাভরা নক্সা তৈরী করে দিল। কোটটাকে ফুলগাছের ঝোপের ভিতর লুকিয়ে রেখে এবার সে দ্বিতীয় কাজ শুরু করল। সমুদ্রের তীর বরাবর খুঁজে খুঁজে সে জোগাড় করল কতগুলি সামুদ্রিক প্রাণীর হাড়। সূর্যের কড়া রোদে সেগুলির নিজের রং জ্বলে সাদা হয়ে গেছে, সমুদ্রের তীব্র জলোচ্ছ্বাসে তাদের গা হয়ে গেছে মসৃণ। এখন তাদের দেখলে মনে হয় হাতির দাঁত। নানা কসরৎ করে সেগুলি দিয়ে সে প্রথমে তৈরী করল একটা বীণার কাঠামো। তাতে আবার নিজের সোনালী চুল দিয়ে তার বেঁধে দিল শক্ত করে। এবার সে তাতে এত চমৎকার করে সুর বাঁধল যে সে সুর শুনে আকাশ থেকে পাখিরা নেমে এল, বনের পশু খাওয়া ভুলে মুখ তুলে সুর শুনতে লাগল।
কাঁধে সেই ঢিলে নরম কোট আর হাতে সোনালী তারের বীণা নিয়ে শী পরীদের দেশের দিকে কুসুম রওনা হল। দিনের আলোয়, চাঁদের আলোয় সে পথ চলতে লাগল। খোলা উঁচু রাস্তা, ছায়াঢাকা নিচু পথ পার হয়ে গেল সে; শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল লক্ষ্যের দরজায়। সিংহদরজার পাশে লুকিয়ে থেকে সে সমাগত শী-দের খেয়াল করতে লাগল। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে তারা সকলেই দেখতে একরকম; ছোটোখাটো চেহারা, কালো চোখ আর চুল, একদম সাধারণ মানুষের মত। শুধু অন্যান্য পরীদের মত তাদেরও কান লম্বা আর ছুঁচলো। আর ওঃ, তাদের চোখগুলো হেলে পড়া আর বাদামের আকারের।
সমস্ত পরীরা দু’তিনজনের ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে ঢুকে গেল। কুসুম ভাবছে কি করা যায়; হঠাৎ দেখল একটা মেয়েপরী একা তাড়াতাড়ি আসছে কারণ তার দেরী হয়ে গেছে। কুসুম দেখল এই সুযোগ। সে চট্পট্ কোটটা পরে সেটাকে এমন ভাবে ছড়িয়ে দিল যে দিনের আলোয় কোটটার সমস্ত শুভ্রতা আর সোনালী সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এইভাবে সে সোজা পরীমেয়েটির সামনে তার পথ আটকে দাঁড়াল।
বাধা পেয়ে পরী রেগে গিয়ে বলল, “একি, তোমার মত একটা নশ্বর মেয়ে এখানে কি করছে?” তারপর তার চোখ পড়ল সেই কোটটার উপর, যেটা জড়িয়ে মেয়েটিকে লাগছে অপরূপা সৌন্দর্যময়ী। মনে মনে সে তারিফ না করে পারল না। তার হেলে পড়া চোখ লোভে আর ঈর্ষায় চক্চক্ করে উঠল। কোটটা সে তক্ষুনি নিজের করে পেতে চাইল। “এই কোটটার জন্যে কত দাম চাও?” সে জিজ্ঞাসা করল।
কুসুম বলল, “এটা বিক্রির জন্যে নয়।”
“মাটির উপর কোটটা বিছিয়ে দাও, আমি এটাকে সোনার টুকরো দিয়ে ঢেকে দেব। সব তোমার, বদলে কোটটা আমার।”
“পৃথিবীর সব সোনা দিলেও এটি কিনতে পারবে না,” কুসুমের দৃঢ়স্বর শোনা গেল, “তবে এটারও একটা দাম আছে।”
“যে দামই হোক না কেন, আমি দেব,” পরী বলল। কুসুমের নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোটটির নরম ভাঁজগুলি নড়ছিল আর তার থেকে যে দ্যুতি ঠিকরে পড়ছিল তা দেখে পরীর চোখের সীমাহীন লোভ আর বাঁধ মানছিল না।
এবার কুসুম তার আসল কথাটা প্রকাশ করল, “আমি তোমায় এই কোটটা দিতে পারি, যদি তুমি আমাকে ভিতরে নিয়ে যাও।”
ব্যগ্রভাবে পরী বলল, “তবে ওটা আমায় দাও!”
কুসুম জানতো যে শী-রা প্রতারক হয়। তাই সে বলল, “না, এখনই নয়। আগে তুমি আমায় ভিতরে নিয়ে যাও, তারপর এটা তোমার হবে।” পরীর আর তর সয় না। সে খপ্ করে কুসুমের হাত ধরে দৌড় দিল। ভালভাবে ভিতরে ঢুকে কুসুম কোটটা তাকে দিয়ে দিল।
ভিতরে ঢুকে কুসুম দেখল সেই সমাবেশের একদম সামনে একটা সিংহাসনের উপর শী-দের নতুন রাজা বসে রয়েছেন। সে পরীদের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে রাজার সামনে এগোতে চেষ্টা করল। পরীরা তাদের মধ্যে এরকম একজন মানুষকে দেখে এতই হতবাক হয়ে গেছিল যে তারা তাকে কিছুই বলতে পারল না। কুসুম সামনে এসে তার বীণাটা রাজাকে দেখাবার জন্যে তুলে ধরল। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার হাতে ওটা কি, মানুষ?”
“একটা বীণা, রাজা,” কুসুম উত্তর দিল। “কিন্তু এরকম বীণা আপনার কাছে তো নেই-ই, আগে কেউ চোখেও দেখেনি।” এই বলে সে সেই সোনালী তারে টান দিল। তাতে সেই বীণা থেকে এমন সুন্দর সুর সৃষ্টি হল যে সভায় প্রশংসার এক হিল্লোল বয়ে গেল।
সুর থেমে গেলে রাজা দাঁড়িয়ে উঠে হাত প্রসারিত করে বললেন, “বীণাটা আমায় দাও।”
কুসুম বলল, “কক্ষনো নয়। এই বীণাটা আমি নিজের হাতে তৈরী করেছি। আমার নিজের সোনালী চুল দিয়ে এর তার বাঁধা হয়েছে। সমস্ত পৃথিবীতে এই জিনিষ আর দ্বিতীয়টি নেই।”
শী রাজা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বললেন, “যদিও আমি নিশ্চিত যে এটা তোমার দাবিমত বিস্ময়করও নয় বা অদ্বিতীয়ও নয়, তবু আমার এটা ভাল লেগেছে। তাই কতো দাম চাও বল।”
“মনে হয় এটা আমি বিক্রি করব না।”
রাজা হিসেবে শী-নেতা যে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন, সীমাহীন লোভের বশে তিনি সেটাকে পেরিয়ে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, “তোমার যা খুশী চাও, আমি তোমায় সব দেব। কিন্তু বীণাটা আমার চাই।”
কুসুম এখন রাজাকে তার হাতের মধ্যে পেয়ে গেছে। একটুও উত্তেজিত না হয়ে সে ধীরে ধীরে বলল, “আমার সন্তানকে তোমার শী-পরীরা চুরি করে নিয়ে এসেছে। তাকে ফেরৎ চাই।”
কিন্তু এই দাম দিতে রাজা চান না। তাই তিনি বড় বড় থলি ভর্তি করে সোনা আনতে হুকুম করলেন। সব সোনা কুসুমের পায়ের কাছে উজাড় করে ঢেলে দিয়ে বললেন, “এগুলি দিয়ে তুমি পৃথিবীতে সবচেয়ে ধনী হয়ে উঠবে। সব সোনা নিয়ে যাও আর বীণাটা আমায় দাও।”
দৃঢ়ভাবে কিন্তু ধীরে আবার মায়ের জবাব ফিরে এল, “আমি শুধু আমার শিশুকেই ফিরে পেতে চাই।”
এবার রাজা সেই সোনার সঙ্গে আরও মণি-মুক্তা, হীরা-জহরৎ এনে দিলেন। তার আলোকের ছটায় যে কোনো মহিলারই হৃদয় আহ্লাদে পূর্ণ হবে। কিন্তু কুসুম, আমাদের সন্তানহারা মা, সেসব ফিরেও দেখল না। সে তার দাবিতেই অটল হয়ে রইল।
কোনো কিছুতেই তাকে টলানো গেল না দেখে রাজা শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে আনার হুকুম দিলেন। কিন্তু তাকে তিনি তক্ষুনি মায়ের হাতে দিলেন না। দাবি করলেন, আগে বীণা চাই তবে তিনি শিশুকে ফেরৎ দেবেন। কিন্তু কুসুম তো পরীদের স্বভাব জানে। তাই সে কিছুতেই বীণাটি হাতছাড়া করল না। সে কেবলই বলতে লাগল, “আগে শিশুটিকে নিরাপদে ফেরৎ দিন।”
আর কোনো গত্যন্তর নেই দেখে রাজা শিশুকে মায়ের হাতে তুলে দিলেন, বদলে পেলেন সেই বীণা। এতক্ষণে রাজার মনে শান্তি এল। মনের আনন্দে তিনি বীণাটি বাজাতে লাগলেন। বীণার সুমধুর সুরে সমস্ত পরীজনতা এত মোহিত হয়ে গেল যে কুসুম কখন তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল, কেউ খেয়ালই করল না।
হয়তো এখনও শী পরীরা সেখানেই আছে, আর সেই সুমধুর সুর শুনছে। সেই সুর কি বলছে জানো? সুর গাইছে এক মায়ের ভালোবাসার কথা, যে তার বাচ্চার জন্য সর্বস্ব পণ করেছিল।
গল্পের উৎসঃ
স্কটল্যান্ডের উপকথা – মে ব্রডলী-র, “ফেয়ারী টেল্স্ অ্যান্ড লেজেন্ড্স্ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”
ভাবানুবাদঃ
শুক্তি দত্ত
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শুক্তি দত্ত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
ওয়াহাবি-ফরাজী আন্দোলন
এই যে ছোট্ট বন্ধু, কেমন আছ তুমি? গরমে হাঁস-ফাঁস তো?বৃষ্টির জন্য হা-পিত্যেস করে বসে থাকতে থাকতে আবার ঘুরে গ্রীষ্মকাল ফিরে এল যেন। বৃষ্টি হল যা দু চার ফোঁটা, তাতে শুধু রাত্তির টুকুই ভাল করে ঘুমনো গেল। সকাল হলেই আবার সেই একই রকম ব্যাপার—চটচটে অস্বস্তি। তবে হ্যাঁ, এইতুকুই যা রক্ষা, যে গরমের ছুটিটা বেশ লম্বা হয়ে গেল। আমার বেশ মনে পড়ে, জানো, মামারবাড়িতে ছোটোবেলায় প্রতিবছর গরমকালে যখন থাকতে যেতাম, বাবা-মা এর শাসনের কোনো বাঁধন ছিল না। গ্রামের চাষীদের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে খেলা করতাম। এখন না হয় গরমের দুপুরে রোদ্দুর-এর তেজে বাইরে বেরনোর কথাআ ভাবলেই ভয় লাগে, আর তখন খেলার নেশায় সে সব অনুভূতি-ই ছিল না।কত্ত নতুন নতুন অভিযান! নতুন নতুন শেখা!কলাপাতা-কে পানের মত করে মুড়ে তার মধ্যে কাঁচা আম থেঁতো করে নুন, চিনি আর লঙ্কাপোড়া দিয়ে মেখে তার রস ওই কলাপাতার খিলির গোড়া দিয়ে টেনে টেনে খেয়েছ কোনোদিন? পৃথিবীর কোনো রেঁস্তোরা বা আচারের দোকানে এ জিনিস পাবে না! পাকা আম কে ‘বেলো’ করে খেয়েছ কোনোদিন? বঁটি-ছুরি ছাড়াই একটা আমের ভিতরের শাঁস খোসা না ছাড়িয়েই হাপিস; পড়ে থাকবে শুধু খোসা আর আঁটি।– খেয়েছ কোনদিন?মহাত্মা গান্ধির খুব প্রিয় খাবারের মধ্যে একটা ছিল এই বেলো করা আম।মহাত্মা গান্ধির কথাটা বললাম কেন জান? না হলে তোমার বাড়ির বড়রা আবার ভাববেন কি সব বদ গেঁয়ো শিক্ষা দিচ্ছি তোমাকে!যাই হোক তবু আমার ছেলেবেলার আনন্দ-টা শুনেও তো তুমি কিছুটা আনন্দ পাবে, আর আমার তাতেই বেশি আনন্দ।তবে ওই সব বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম, যা কোনো স্কুলে শেখা যায় না। একদম মাটির শিক্ষা, হাতে নাতে শিক্ষা, ধৈর্যের শিক্ষা, অনেক কিছু ছাড়াই খুশিতে বাঁচার শিক্ষা, একজোট হয়ে কাজের শিক্ষা, সব রকম মানুষ-কে সম্মানের শিক্ষা – যা সিলেবাসের বাইরে।শেখার মূল মন্ত্রটা তোমার কানে কানে বলে দিই আজ – তোমার সঙ্গে যিনিই থাকুন না কেন, যদি তাঁর কাছ থেকে শেখার কিছু থাকে, তাহলে তাঁর বয়েস আর শ্রেনী বিচার না করে বরং তাঁর জানা আর তোমার অজানাকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দিও। ব্যাস। দেখবে, কাম খতম।
আধুনিকতার মায়াজালে এক আশির্বাদ দুর্ভিক্ষ সে ভাবে না হওয়া।তবে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলা তথা পুরো উত্তর ভারতে প্রতি দশকে গড়ে একবার করে বড় রকমের দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। কারণ – বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের আগ্রাসী অপশাসন, বাণিজ্যের নামে দুর্ণীতি ও জুলুমবাজি, মুঘল আমলের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণশ খাজনা আদায়, বাংলার কৃষিব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেয়।তার মধ্যে আবার গোদের অপর বিষফোঁড়া, লর্ড কর্নওয়ালিশের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’।
আচ্ছা তুমিই বল এরকম অবস্থায় কোন গরীব সাধারন মানুষটা আর স্বাভাবিক থাকতে পারে।কৃষ্কদের মনে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটল ওয়াহাবি বিদ্রোহের মাধ্যমে। ফরাজী তার অনুসারী হয়।
বৃটিশ শক্তি তখন প্রায় সারা ভারতেই প্রসারিত। শেষ ভরসা টিপু সুলতান পরাজিত হয়ে বীরের মত ইংরেজদের হাতে নিহত হয়েছেন।মারাঠা শক্তি তখনো জ্বলছে তুষের আগুনের মত।দাবানল হওয়ার শক্তি তার আর নেই।শুধু রণজিত সিংহ তখনও পাঞ্জাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ঠিক সেই সময়ে হোলকারের এক প্রাক্তন সেনাপতি সৈয়দ আহমেদ বারলেচী-র (১৭৮৬-১৮৩১) আবির্ভাব হয়।। তিনি ভারতের সকল মুসলিমদের ওয়াহাবি আন্দোলনের ডাক দেন। ওয়াহাবি শব্দের মানে জান? এর অর্থ হল ‘নবজাগরণ’। তাঁর আহ্বান ছিল ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা করা। এটা ত’ সত্যি কথা যে ওয়াহাবি আন্দোলনে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ছিল। তবে নিঃস্ব রিক্ত কৃষকদের মধ্যে এবং বেশ ভালভাবেই জনসাধারনের মধ্যে এই আন্দোলন বিপুল সাড়া জাগায়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলায় যে জমিদার শ্রেনির উদ্ভব হয় তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। আর বাংলার অধিকাংশ কৃষকই ছিল মুসলমান।সাম্প্রদায়িকতার ছাপ স্পষ্ট হলেও যেহেতু ইংরেজদের অন্যায় অত্যাচারের বিরূদ্ধে এই ওয়াহাবি আন্দোলন সংগঠিত হয়, তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।কেন জান? দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধা জাত-ধর্ম বিছার করে আসে না। কৃষক সমাজে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল। বৃটিশদের সৃষ্ট ‘মারী মন্বন্তরে’ যে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাতে স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিমদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ওয়াহাবির ডাক তাই তখন মুসলিমদের খুবই বেশি করে উদবুদ্ধ করেছিল।সাপ্রদায়িক আন্দোলন হওয়া সত্বেও হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ও বিবাদ এর মধ্য এক্কেবারেই ছিল না।বরং সবাই একজোটে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল সব জমিদার, জোতদার ও তাদের পরম পৃষ্ঠপোষক বৃটিশদের বিরূদ্ধে।
বাংলায় ওয়াহাবিদের নেতা ছিলেন মৌলবী শরিয়তুল্লাহ। সৈয়দ আহমেদ বাংলায় এসে ওয়াহাবির আদর্শ প্রচার করেন। মক্কায় বহুদিন থাকার পর দেশে ফিরে তিনি ধর্ম-সংস্কারের উদ্দেশ্যে কৃষক জনসাধারণের মধ্যে তাঁর আদর্শ প্রচার করেন।তাঁর সংস্কার ছিল পরশাসন ও শোষণ বিরোধী।পরশাসনের ছাতার নিচে থাকা সমস্ত সমর্থক, জোতদার, জমিদার, সামন্ত, গোমশ্তা, তহশিলদারেরা শ্বাভাবিকভাবেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
শরিয়তুল্লাহ এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী গোপন সংগঠন ‘ফরাজী’ সম্প্রদায় গঠন করেন।বাংলায় ফরাজীরাই হল ওয়াহাবি আন্দোলনে্র সংগঠক ও প্রচারক। ফরাজীরাই হল তার সদস্য ও যোদ্ধা। তাদের মূল শ্ত্রু হল ইংরেজ এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার সমর্থক শ্রেনী।কিন্তু দুঃখের কথা কি জান, এই আন্দোলন ভালোভাবে সংগঠিত হওার আগেই শরিয়তুল্লার মৃত্যু হয়। তাঁর যোগ্য পুত্র দুদু মিঞা বাংলায় ওয়াহাবি-ফরাজী বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। পুর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যোগ দেয়।
শ্বেতাঙ্গ নীলকরেরাও কম ছিল না অত্যাচারের দিক থেকে। বাংলার শিক্ষিত শ্রেনী নীল্কর সাহেব্দের অত্যাচারে প্রতিবাদ শুরু করারা আগেই দুদুমিঞা-নেতৃত্বে ওয়াহাবিরা নীলকুঠির ওপর অত্যাচার চালায়। সাহিত্য যে সমকালীন সমাজের ঐতিহাসিক দর্পন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, দীনবন্ধু মিত্রের কালজয়ী নাটক ‘নীলদর্পন’। হরিশচন্দ্র মুখার্জীর তত্বাবধানে প্রকাশিত হিন্দু পত্রিকায় নীলকরদের বিরূদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলা হয়। অনেক ব্রিটিশ সাহেবও কিন্তু ছিলেন যাঁরা এই দেশকে ভালবাসতেন। রেভারেন্ড জেমস লং এর কথা এই প্রসঙ্গে তমাদের না বললেই নয়।‘নীলদর্পণ’ ইংরেজি-তে অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর তা হরিশচন্দ্র তা তাঁর পত্রিকার প্রকাশ করেন জেমস লং এর সহায়তায়। ফলে লং সাহেবের এক মাসের জেল ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়। কালিপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় তক্ষুনি সেই টাকা আদালতে জমা দেন।
ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবী সুস্পষ্টভাবে ঘোষণার অনেক আগেই ওয়াহাবিরা কৃষকদের একভাবে সংগঠিত কর ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল।বাংলার বহু জায়গায় তারা মুক্তাঞ্চল গড়তে পেরেছিল। কিন্তু দুদুমিঞা ছাড়া এই আন্দোলনে দ্বিতীয় আর কোনো নেতা না থাকায় তার গতি ও তেজ বেশীদিন স্থায়ী হতে পারে নি।সুসংগঠিত বিরোধীদের প্রতিআক্রমনে তাদের প্রতিরোধ আন্দোলন হারিয়ে যায়। তবে সিপাহী বিদ্রোহের সম্য পর্যন্ত ওয়াহাবিদের আন্দোলন ও ইংরেজ শাসন নির্মূল করার সংগঠিত চেষ্টা বেশ সক্রিয় ছিল।
ওরে বাবা!!! অনেকটা লিখে ফেললাম যে!!! তুমি আবার যেন রাগ কোরো না বাপু!আর এটা তো গল্প, পড়া তো আর নয়! তাই না!
আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন আর্য চ্যাটার্জি
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
স্থির তড়িতের কথা
একখানা চুম্বককে লোহার তৈরী কোন কিছুর ( যেমন সেফটিপিন বা আলপিন) কাছে আনলে চুম্বক তাকে আকর্ষন করে, এটা তোমাদের সাধারন অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটাকি জান যে কাগজের টুকরোকেও কোন কিছু দিয়ে আকর্ষিত করা যায়! দেখেছ কখনও ? দেখ নি ? তাহলে যা যা বলি করে দেখ, কি হয়। শীতের দিন হলে ভাল হয়, কেননা এই পরীক্ষা করতে গেলে শুকনো আবহাওয়া প্রয়োজন। কেন শুকনো আবহাওয়ার দরকার তা পরে বলছি।
একদিন মাথায় ভাল করে শ্যাম্পু কর, যাতে চুলে তেল না থাকে। আর চিরুনীটাকেও সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে নাও।
এবার কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দাও। চুল, চিরুনী সব শুকিয়ে গেলে ভাল করে মাথা আঁচড়ে চিরুনীটাকে কাগজ-টুকরোগুলোর কাছে নিয়ে যাও। কি দেখবে বল দেখি ? আলপিন যেমন চুম্বকের দিকে আকর্ষিত হয়, কাগজ টুকরোগুলোও তেমনি চিরুনীর দিকে ছুটে যাবে বা আকর্ষিত হবে। অথচ দেখ চিরুনীটাও চুম্বক হয়নি বা কাগজের টুকরোগুলোও আলপিন হয়ে যায় নি। অবাক ত' হলেই, না কি ?
অবাক করা আরও এক আধটা উপমা দিই তাহলে। একটা ছোট বেলুন ভাল করে ফুলিয়ে মুখটা বেঁধে নাও যাতে হাওয়া বেরিয়ে না যায়। এবার ঐ ফোলান বেলুনটা কোন নাইলন বা টেরিলিন কাপড়ে ভাল করে ঘসে নাও।দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারের গায়ে বেলুনের ঘসা দিকটা ঠেকিয়ে হাত সরিয়ে নাও। দেখ অবাককান্ড, বেলুনটা পড়ে গেল না, ক্যালেন্ডারের গায়ে সেঁটেই রইল!
এমন উদাহরন অনেক দেওয়া যায়। ব্যাপারখানা বুঝতে পারলে কিছু! এসব আসলে তড়িতের খেলা, যাকে ঠিক করে বললে বলতে হয় 'স্থির তড়িৎ' এর খেলা। স্থির তড়িৎ তাহলে কি রকম ?
যখন কোন দু'টি বস্তুকে পরস্পর ঘসা হয় তখন স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়, যেমন এখানে চুলের মধ্যে চিরুণী, কিংবা বেলুনকে নাইলন কাপড়ে ঘসা হল।
এমন ঘর্ষনে উৎপন্ন তড়িৎকে বলে 'স্থির বিদ্যুৎ', আর এই ব্যাপারকে বলে 'তড়িতাহিত করণ'। এখানে যেমন কাগজ আর চিরুণী দু'টিই তড়িতাহিত হয়ে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করেছে।
আর দু'চারটে কথা বলে নি । তাহলেই সব বুঝতে পারবে।
তাপ সম্পর্কে বলার সময় বলেছিলাম দু' রকম পদার্থের কথা, যারা কিনা 'সুপরিবাহি' আর 'কুপরিবাহি'।
যারা তাপ পরিবহন করে তারা সুপরিবাহি আর যারা করে না তারা কুপরিবাহি। তেমনি যারা তড়িৎ পরিবহন করে তারা 'পরিবাহী'(conductor) আর যারা তা পারে না তারা 'অপরিবাহী' (non-conductor)। সব চেনা ধাতু এবং অন্যান্য কিছু পদার্থ তড়িতের পরিবাহী। মানুষের দেহ কিন্তু এই পরিবাহীদের দলে, জলীয় বাষ্পও তাই। বেশীরভাগ অধাতু অপরিবাহী। ঐযে চিরুণীর কথা বললাম, সেটা কিন্তু অপরিবাহী। কাগজ, বেলুনও তাই।
যদি ঐ চিরুণীটা যা দিয়ে তৈরী সেই প্ল্যাস্টিক, পলিথিন বা সেলুলয়েডের না হয়ে পিতল বা আলুমিনিয়মের তৈরী হত (চুল কাটার সেলুনে যেমন থাকে), তাহলে কি কাগজকে টানত ? একেবারেই না। কারণটা কি জান ? কারণ হল, ধাতু পরিবাহী। চুলের সাথে ধাতব চিরুণীর ঘসায় স্থির বিদ্যুৎ তৈরী হয় ঠিকই, কিন্তু সেই বিদ্যুৎ, পরিবাহী চিরুণী আর তোমার শরীরের মাধ্যমে (শরীরও পরিবাহী) সোজা মাটিতে চলে যাবে, অর্থাৎ নিস্তড়িৎ হয়ে পড়বে। চিরুণী যদি তড়িৎ হারিয়েই ফেলে তাহলে আর আকর্ষণ করবে কি করে!
প্লাস্টিকের চিরুণী অপরিবাহী বলে আমাদের দেহের মাধ্যমে তড়িৎ মাটিতে যায় না, যেখানকার তড়িৎ সেখানেই থাকে। তাই ত' সে চিরুণীর মধ্যে থেকে কাগজের টুকরোকে আকর্ষন করে। তাই বলে কি ঐ তড়িৎ চিরকালই থেকে যাবে নাকি! মোটেই না। একটু পরেই চিরুণী নিস্তড়িৎ হয়ে যাবে, কেননা তড়িৎ বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্পের মাধ্যমে বাতাসে চলে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলে 'তড়িৎ মোক্ষণ' হওয়া (leakage of electricity)। ঠিক এই কারণেই ক্যালেন্ডারের সাথে বেলুনও চিরকাল ঝুলে থাকবে না।
ধাতব চিরুণীর যদি একটা অপরিবাহী হাতল থাকে তাহলেই, মানুষের দেহের সাহায্যে তড়িৎ মোক্ষণ হবে না, তড়িৎ চিরুণীতেই থেকে যাবে। তবে একটু পরেই তা নিস্তড়িৎ হয়ে যাবে বাতাসে তড়িৎ মোক্ষনের জন্য। বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্প এই মোক্ষনের জন্য দায়ী।
অপরিবাহী পদার্থকে আমরা অন্তরকও বলি। বাড়িতে যে বিদ্যুতের তারের সাহায্যে আলো জ্বালানো হয় (সুইচ আর বাল্বের মধ্যে তারের সংযোগ থাকে), সেই তার রবার, সুতো বা প্লাস্টিক জাতিয় অন্তরক দিয়ে মোড়া থাকে, যাতে অসাবধানে বৈদ্যুতিক তারে হাতের ছোঁয়া না লাগে। তারে হাত লাগলে 'শক' লাগে এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। রাস্তার পাশে যে বিদ্যুৎবাহী তার থাকে সেটা কিন্তু অন্তরক দিয়ে মোড়া থাকে না। তাহলে যে স্তম্ভগুলোর সাহায্যে তারকে একস্থান থেকে আর এক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেগুলো ঐ তারের সংস্পর্শে বিদ্যুতবাহি হয়ে পড়ে। আর সেগুলোয় হঠাৎ ছোঁয়া লাগলে শক লেগে যেতে পারে। তাই লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে যে এক ধরনের অন্তরক পর্সিলিনের বাটির সাহায্য নেওয়া হয়, যাতে তারের সাথে আলোকস্তম্ভের সংযোগ হয়ে না যায়। অবশ্য এভাবে খোলা পরিবাহী দিয়ে তড়িৎ পাঠালে একটা ক্ষতি হতে থাকে, অন্তরকবিহীন তার থেকে তড়িৎমোক্ষণ আটকানো যায় না।
এ ব্যাপারে উঁচু শ্রেণীতে উঠে আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।
* * * * * *
একটা মজার খেলা দিয়ে লেখাটা শেষ করি।
টেবিলের ওপর দু'খানা বই ১০-১২ সেমি দুরে রাখ। সে দু'খানা যেন ২ সেমির মত উঁচু হয়। এর ওপর একখানা কাঁচের প্লেট রাখ। তবে তার আগে টেবিলের ওপর বই দু'খানার মাঝখানে কিছু কাগজের টুকরো, থার্মোকলের ছোট ছোট বল, সুতোর টুকরো---এই সব রাখতে হবে। এবার নাইলন বা টেরিলিন কাপড় দিয়ে কাঁচের ওপরটা ঘষতে থাক। (সিল্ক বা পশমের সোয়েটার দিয়েও ঘষতে পার, তাতেও হবে)।বন্ধুদের সামনে
এটা কর, দেখ না কেমন মজা হয়। ওরা দারুণ অবাক হয়ে যাবে। কি হবে বলতে পার ? টেবিলে ছড়ানো ঐ সব জিনিষগুলো ঝট পট উঠে কাঁচের গায়ে সেঁটে যাবে, একেবারে ম্যাজিকের মত।
কেন হল তার কারণটা ত আগেই বলেছি।
সন্তোষ কুমার রায়
অ্যাটলাস মোড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সন্তোষ কুমার রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মেঘ-বৃষ্টির দেশে... (পর্ব-১)
ছোট্ট ছোট্ট শাদা মেঘের নৌকা আমার পাশ দিয়ে, হাতের কাছ ঘেঁষে নীল আকাশে ডিঙি বেয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি চুপটি করে প্লেনের জানলার কাছে বসে ভাবছি তোমার কথা সিরাজুল। ভাবছি তুমি আর আমি এমনি এক বর্ষার দিনে সুন্দরবনের হরিণভাঙা নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। তাও কতদিন আগে তাই না? হ্যাঁ তখন তোমার এখনকার মতো গোঁফের রেখা ওঠেনি সিরাজুল। ওমা, ওকি লজ্জা পেলে নাকি? ধুর বোকা, আমি তো গল্প করছি তোমার সাথে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলবো না তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার সদ্য ওঠা গোঁফে কেমন করে তা দাও। আর তোমার বোন আনন্দি লুকিয়ে সেটা দেখে ফেললেই তার ওপর তর্জন গর্জন করো। ওকি...চললে কোথায়? আচ্ছা ঠিক আছে এই কান ধরছি সিরাজুল আর বলবো না। সত্যি আর বলবো না দক্ষিণ রায়ের মিশ কালো গোঁফের মতো তোমার গোঁফটাও বেশ হৃষ্ট পুষ্ট হবে আর আমার সেই ছোট্ট সিরাজুল, যে আমাকে শোনাতো কুমীরের গল্প তার গোঁফ দেখতে আমার মনটা উড়তে চাইবে আকাশে। এই বর্ষার সকালে ছুট্টে চলে যেতে চাইবে সুন্দর বনে। ওই দেখ আবার রাগ করে! বুঝতে পারছো না এটা গল্প...আরে বাবা আমি সত্যি সত্যি তো উড়ছি আকাশে।
এর আগে আমি কোনোদিন প্লেনে উঠিনি জানো। অনেক দিন আগে থেকেই মনটা খুশিতে নেচে উঠছিলো, তারপর আবার কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছিলো। অতো ওপর দিয়ে যেতে যেতে তোমার সুন্দর বনের সেই দুষ্টু ঈগলটার সাথে যদি দেখা হয়ে যায়। পাইলট মানে যিনি প্লেন চালান, তাঁর গুরু গম্ভীর কন্ঠে বলে দিলেন বাইরের আবহাওয়া খুব খারাপ, বৃষ্টি পড়ছে, তাই কেউ দুষ্টুমি করবে না, সবাই প্লেনের সিট বেল্ট বেঁধে চুপটি করে বসে থাকবে। তুমি জানো সিরাজুল একটু পরেই প্লেন দৌড়োতে শুরু করলো সাঁ সাঁ...আমি ভাবলাম ওমা, এটা আবার দৌড়ায় কেনো? উড়বে তো! পাশের বন্ধু বিরক্ত হলো। আর ঠিক তোমার মতো বকে দিলো সিরাজুল। আমি দেখলাম এক ঝাঁকুনিতে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্লেন...। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, অনেক নীচে... আমার পায়ের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে আমার প্রিয় শহর, আমার মন কেমনের সব কিছু। আচ্ছা সিরাজুল এই যে এতোক্ষণ আমি বক বক করে তোমার মাথা ধরিয়ে দিলাম তবুও কি তুমি আমায় বলবে না এই বছরে খলসি ফুলের মধু রেখেছো কিনা আমার জন্যে? বলবে না তো আনন্দি এখোনো তার সেই ছোট্ট ডিঙাতে মাছ ধরতে যায় কিনা? রাতের বেলায় কুপি জ্বালিয়ে তোমরা দুই ভাই বোন পড়তে বসো কিনা দাওয়ায়? এখোনো কি সেই দুষ্টি বাঘটা এসে গ্রামের বাইরে হালুম হালুম করে ভয় দেখায়? ও আচ্ছা রাগ হয়েছে? অনেকদিন চিঠি লিখি না তাই? কী করবো বলো? আমিও তো অনেকদিন কোথাও বেরোয়নি। সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি দিয়ে আমাকে কে যেনো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলো অনেক দিন। আমার পোষ্ট বক্সে অনেকদিন কেউ বেড়ানোর চিঠি রেখে যাইনি যে সিরাজুল। তাই একদিন সকালে আমার মোবাইলের ইনবক্সে যখন মেঘালয় থেকে উড়ে এলো নেমনতন্নের চিঠি তখন আনন্দে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বাইরের কদম ফুলের গাছা হাওয়ায় পাতা নেড়ে বলেছিলো এবার তুমি বেরিয়ে পড়ো টুকনু। খেয়াঘাটের বুড়ো মাঝি বলেছিলো থেমে থেকোনা বাবু...নদী কি থেমে থাকে? সে কেমন আপন মনে একা একা বয়ে চলে সবাইকে নিয়ে। আমিও আপন মনে বয়ে চলছি সিরাজুল। হ্যাঁ এই তো দেখো না, আমাদের প্লেন নামবে এবার গৌহাটি বিমান বন্দরে। এই তো আমি ওপর থেকে দেখতে দেখতে পাচ্ছি বহ্মপুত্র নদীকে। মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে আমি এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে। ঝির-ঝিরে বৃষ্টি আমার জানলা ধুয়ে দিচ্ছে। আর আমার কানের কাছে শিরশিরে হাওয়া বলে যাচ্ছে, মেঘ বৃষ্টির দেশে তোমাকে স্বাগত টুকনু।
তুমি কি বিরক্ত হয়ে পড়ছো সিরাজুল? আমি জানি তুমি যত রাগ করেই থাকো না কেনো আমার নীল খামের চিঠিটা তুমি এতোক্ষণে রফিকুল, আনন্দি এদের সবাইকে পড়ে শুনিয়ে দিয়েছো। গৌহাটি থেকে নেমে আমরা যাবো শিলং। বাইরে অপেক্ষা করে আছে আনন্দ। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। সেই আমাদের নিয়ে যাবে শিলং। গাড়িতে চেপে বুঝতে পারলাম ক্ষিদে পেয়েছে। একটু পরেই শহর ছাড়তেই পথের ধারে পাহাড় আর জঙ্গল আমার অনেক অনেক চেনা কিছু ছবি মনে করিয়ে দিলো।
আমার মনে পড়ে গেলো উত্তরবঙ্গের চিলাপাতার কথা। জঙ্গলে ঘেরা গ্রামের কথা। আন্দু রাভা, জয়ন্তী মেচ, সুনীল নার্জিনারিন, হেমবং টোটো, ফুলমণি মেচ সবার কথা। মনে মনে ঠিক করলাম আর আমি সোনার কাঠি-রুপোর কাঠির ছোঁওয়ায় ঘুমিয়ে থাকবো না সিরাজুল... বেরিয়ে পড়বো আমার পিঠের সেই বড় বোঁচকাটা নিয়ে। আবার সবার সাথে দেখা করবো। আবার তিস্তার চরে সবার সাথে কাশ ফুলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে বেড়াবো। আনন্দ গাড়ি থামালো। আনারস বিক্রি হচ্ছে। খুব মিষ্টি আনারস খেলাম আমরা। এখানে আনারস খুব শস্তা। বর্ষার যেসব ফল হয় আনারস তার মধ্যে প্রধান।
রাস্তার চারপাশে জঙ্গল, পাহাড় দেখতে দেখতে আর আনন্দের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে চলে এসেছি শিলং বুঝতেই পারিনি। টিপটিপ বৃষ্টি আর শীত শীত ঠান্ডা হাওয়া আমাদের নিয়ে চললো পুলিশ বাজারের দিকে। ওকি আবার পুলিশের কথা শুনে ভয় পাচ্ছো। নানা সিরাজুল পুলিশ বাজার নাম শুনেই ভেবো না সব কিছু পুলিশদের। আসলে এটা শিলংয়ের সবচেয়ে বড় বাজার। অনেক কিছু বিক্রি হয় এখানে। আর এখানেই হোটেল পাইন বোরোতে আমরা কিছুদিন থাকবো। আনন্দকে ফিরতে হবে গৌহাটি...অনেক খানি রাস্তা। চলে গেলো সে। কথা থাকলো আবার দেখা হবে, গৌহাটিতে, মাত্র কয়েকদিন পরেই।
কে যেনো একটা ঠান্ডা হাত পিঠে রাখলো। পেছন ফিরে দেখি, এখানকার খাশিয়াদের মতো সুন্দর দেখতে বাপী। হ্যাঁ এবার তার ট্যাক্সিতেই আমরা শিলং দেখবো। বাপী আমাদের নিয়ে গেলো ইন্টারন্যাশানাল গলফ মাঠে। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার বাড়িতে। এখানে বেশ কিছুদিন কবি ছিলেন। লিখতে শুরু করেছিলেন শেষের কবিতা। বড় হয়ে সে না হয় তুমি পোড়ো। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলো সিরাজুল। তারপর থেকে একটুও ঘুম এলো না আর। কারণ কাল সকালে উঠেই যে আমরা যাবো চেরাপুঞ্জি। সেই কবেকার ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি...। বাইরে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে আমার ঘরের কাঁচের জানলায়। সেই তুমুল বৃষ্টি আর বিদ্যুতের মধ্যে হঠাত ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভুল শুনছি না তো? না, ওই তো আবার। ঠক ঠক...। এতো রাতে দরজায় আওয়াজ করছে কে? শরীরের মধ্যে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। হোটেলে ভূত-টুত নেই তো? বালিশের পাশ থেকে হাতড়ে টর্চটাকে খুঁজে বের করলাম। ধুর ছাই, কাজের সময় বিগরোবে। জ্বলছে না। আবার আওয়াজ, ঠক...ঠক...ঠক...। শরীরের মধ্যে দিয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। আস্তে আস্তে উঠে দরজার দিকে যাবো আর ঠিক সেই সময় কড়কড় করে বাজ পড়লো। দমকা হাওয়ায় খুলে গেলো দরজা। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো আমার মুখে। সেই আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম তালগাছের মতো লম্বা একটা কি যেনো। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। (চলবে)
লেখা ও ছবি
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া, হুগলী
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
বর্ষার আড্ডা
আবার মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে । এখন চলবে কিছুক্ষণ । তেলেভাজার অর্ডার দিলো ভুডুলমামা । আই-ফোনটা টেবিলে রেখে, সোফায় গা এলিয়ে ভুডুলমামা টিভিটা খুলে দিলো । মা বলে, 'এল সি ডি স্ক্রিনে'র আলো - 'এল সি ডি স্ক্রিনে'র বাংলা কি 'তরল স্ফটিক প্রদর্শন পর্দা' ? যাই হোক - তার আলো চোখের রেটিনায় ধরা পড়লেই টিকলির আর আমার মাথাটা নাকি সেদিকে ঘুরে যায় । তাই হল । টিভিতে প্রোগ্রাম, 'রিফ্লেকসন' । পর্দায় চলছে দুই নেতার মধ্যে ... একে কি তর্ক-বিতর্ক বলা যায় ? বেচারা 'হোস্ট্' কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না । না ! আর দেখা যায় না ! ভুডুলমামা রিমোটের বোতাম টিপল ।
ভুডুলমামা একটু অদ্ভুত লাগবে শুনতে ।
তবুও -
বলতো দেখি, ভেবে চিন্তে ।
হায়েনা ।
হ্যাংলা, জিব তার
ঝোলে মুখ থেকে বেড়িয়ে ।
আয়নায় দেখে তা
লজ্জায় মুখটাকে
কেন ফেলে না সে লুকিয়ে ?
গিরগিটি ।
হরদম রঙ সে তার
বাদলায় ।
মুশকিল হয় কি
চিনতে নিজেকে,
যখন প্রতিচ্ছবি
ধরা পড়ে আয়নায় ?
বাদুর।
রক্ত চোষে, কদাকার ।
অন্য কিছুই
মুখে তার রোচে না ।
আয়নায় দেখে নিজেকে,
আতঙ্কে মূর্ছা
কেন সে যায় না ?
বিছে ।
বিষাক্ত দাঁড়া
সর্বদা উঁচিয়ে ।
হঠাৎ দেখে যদি নিজেকে
আয়নার পিছনে
বুকটা কি কাঁপে তার,
সটকান -
দাঁড়াটা নামিয়ে ?
টিকলি জঙ্গলেতে আয়না !
কোথায় পাবে হায়েনা ?
তাছাড়া - ওরা বন্য ।
তবে, [একটু ভেবে] সহজ নয় উত্তর ।
আসল প্রশ্নটা যে অন্য ।
এই মুহূর্তে ভুডুলমামার মোটা গোঁফে তলায় একটা হাসি কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে । টিকলির দিকে তাকায়, উত্তর দেয় না । দরজায় ঘণ্টা । নিশ্চয় গরমা-গরম ডেলিভারি নিয়ে হাজির তেলেভাজার দোকানের ঘেঁটু । ভুডুলমামা পকেট থেকে 'ওয়ালেট'টা বার কারে আমার দিকে ছুড়ে দেয় ।
শিব শঙ্কর বসু,
এপেক্স, নর্থ ক্যারোলাইনা
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শিব শঙ্কর বসু
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত