সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
গুপ্তধন

হাওয়াতেও আজকে নেমন্তন্ন বাড়ির গন্ধ। পায়েস হচ্ছে। টুকরো বাদাম। টুসটুসে কিশমিশ। আর সিমুই।

আজকে উনতিরিশ নম্বর দিন। নন্টে চট করে আর একবার গুণে নিল। কুড়ির পরেই গুণতিটা অন্য হাতে চলে গিয়ে সব গুবলেট হয়ে যায়। কালকেও অংক কেলাশে বকুনি খেয়েছে। কে-লা-শ। আহ, এটা বললেও তো বকুনি জুটবে। কেলাশ নয়, ক্লাশ। ক্লাস। কী খটমট রে বাবা। কেবলই জিবে হড়কে যায়। জিব নয়, জিভ। দুত্তোর। পায়েসের গন্ধে কি আর ইশকুলের পড়া হয়!

পেছনের দোর থেকে মাজুদের রান্নাঘরের ঘুলঘুলিটা দেখা যায়। মাঝের গলিটা এতখানি জলকাদায় ডুবে আছে যে ডিঙি মেরেও উঁকি দেওয়া মুশকিল।
- এ মাজু! ওইই মাজু?
এ পার থেকেই যতটা গলা চেপে ডাকা যায়, বেশি চিল্লালে মা দেবে ধরে।

চাঁদ বেরোনো নিয়ে প্রতিবছর একটা গড়বড় হয়। লাস্টের দিনটা। ইমামকাকার কাছে খবর আসে। একটা হইচই পড়ে যায় তার পর। এবারে তো কই কিছু হল না!
আরও দু একবার ডাকার পরেই নন্টে বুঝল গোলমাল করে ফেলেছে। কানের গোড়ায় বাবার প্যাঁচ।
- ভেতরে চ'! চ' বলছি শিগগির! বেহায়া ছেলে!
হিড়হিড় করে কান ধরে টেনে একেবারে সেলাইঘরের মেঝেতে। কড়া মবিলের গন্ধে ভোঁভোঁ করছে চারদিক। পায়েস নিমেষে হাওয়া।
বাবার গলা শুনে মাও ছুটে এসেছে। মা একটুতেই হাউমাউ করে। এমন কানপ্যাঁচানোয় কী হয় নন্টের! হুঁহ্! গেল হপ্তায় সেই সাইকেলের এস্পোকে পা ঢুকে গেল। একফোঁটা চোখে জল যদি দেখে থাকে কেউ নন্টের তাহলে এসে বলুক! ওই মস্ত মালের গাঁঠরিটা ফের চেপে ধরে বসে বাবার সঙ্গে মালিকের গদিতে পৌঁছে দিতে যায়নি নন্টে?

- আমি থোড়াই খেলতে যাচ্ছিলাম! চাঁদ বেরোচ্ছে কিনা জানতে মাজুকে ডাকছিলাম তো!
কানটা খুব করে ডলতে ডলতে বলেই ফেলল নন্টে।

বার মুখটা আরও গনগনে হয়ে গেল শুনে।
- কেন রে আহাম্মক? ওদের চাঁদ বেরোচ্ছে তো আমাদের কী? তোর কী?
মা ঠিকই গজগজ করে, রাগলে বাবার মাথার ঠিক থাকে না। চাঁদ তো একটাই। তার আবার আমাদের ওদের কী? কিন্তু এসব বললে আরও গোলমাল বাড়বে।
- তা-তাছাড়া রফিককাকার কোমরের যন্তন্নাটা নাকি খুব বেড়েছে, তাই ভাবলাম যদি পোড়া পিদ্দিমের তেলে..
- পোড়া পিদ্দিমের তেল কোমরের যন্তন্নায়! গোমুখ্যু চলল কবরেজি ফলাতে! তেল মাঙনা নাকি রে নবাবপুত্তুর? খবরদার যাবিনে ওদের বাড়ি। দমাদ্দম মারব গেলে।

আরও বেশ খানিক ধমকাধমকি করে বাবা দুমদাম করে বেরিয়ে গেল।

মা এসে গায়ে মাথায় হাত বুলোতে একটু কান্না কান্না পেল না তা নয়, কিন্তু সেসব গিলে টিলে মাকে জিজ্ঞেস করাটা দরকার। মাজু তো ইশকুলে ফাস্ট হয়। কেমন সুন্দর মেশিনে সুতোও ভরে। বাবা সব সময় ওকে দেখে শিখতে বলে।
- বাবা এমন বলল কেন? আমি তো নেমন্তন্নটা আজকে থাকবে না কালকে সেটা বুঝতে যাচ্ছিলাম! বাবা তো আর বছর নিজেই বলল, জেনে আয়তো চাঁদ কবে বেরোচ্ছে?

মায়ের বড়বড় চোখ। অল্পেই জলে টল টল করে।

- এবছর আমরা ওদের বাড়িতে খেতে যাবো না বাবা। দেখলি না সেদিন জীবনদা, সমীরদা, সীমাদি, সবাই এসে বারবার করে বলে গেল ওদের দিকে না যেতে। ওরা যে গরু খায়!
- তাতে কী? ঈদের নেমন্তন্নে তো খাসিও করে। আমরা তো খাসিই খাই ওদের বাড়ি গিয়ে! পরোটা দিয়ে।
ঢুক করে একটা ছোট ঢোঁক গিলে ফেলল নন্টে। লাচ্ছা পরোটার টুকরোটা খাসির ঝোলে ডুবলে যে কী একটা ব্যাপার হয়!

- গরু আমাদের মা যে। তাকে কেটেকুটে যারা খায় তারা কি ভালো লোক, বল?

এটা আবার কী অদ্ভুত কথা মা বলছে! মাজুর মা বাবা খারাপ লোক? রফিককাকা গুনগুন করে গান গায় আর সারাদিন চুপচাপ জিনসের প্যান্ট সেলাই করে। মুখে ভুরভুর করে মিষ্টি মশলার গন্ধ। নন্টেকে গত পুজোয় জিন্সের ফুলপ্যান্ট আর জ্যাকেট বানিয়ে দিয়েছে, সে খারাপ লোক?
আর মাজুর মা! মা কী করে খারাপ লোক হবে!

- গরু কী করে মা হবে আমাদের? গরু তো বাছুরের মা! আর জীবনকাকা কোন আক্কেলে ওদের খারাপ বলে? ক'দিন আগেই না বাবাকে টাকার জন্য কত কথা শুনিয়ে গেল? মেশিন উঠিয়ে নিয়ে যাবে বলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কত ভয় দেখালো? আর...

মা কেমন শিউরে উঠে নন্টের মুখটা চেপে ধরল।
- আর বলিসনা। ছোটদের অত বলতে নেই। তুই শুধু আর ওদের বাড়িতে যাসনা।

আজকের দুপুরটা যেন কাটতে চায়না। ইশকুল বাড়ির পেছনে পাঁচিলটা যেখানে ভেঙেছে সেখানে হাজারঝুরি বটটার একটা মোটা শেকড় এমন বাঁক খেয়ে ঢুকেছে, ঠিক যেন বড় আন্টির চেয়ার। পিঠ ঠেকিয়ে বসতে বেশ। হাওয়াও ভারি ঠান্ডা। কিন্তু তাতেও মনটা ভালো হচ্ছিল না নন্টের। কী যেন একটা হয়েছে সবার। কদিন ধরেই। মাজুটারও গতকাল মন খারাপ ছিল। দিনরাত এক করে মেশিনে বসে বসে নাকি রফিককাকার কোমরের হাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে, ডাক্তার বলেছে। কয়েক মাস মেশিন ধরা বারণ। কিন্তু সে হয় নাকি!

এদিকে জীবনকাকারা মাঝেমাঝেই এসে পড়ে আজকাল, সঙ্গে আরও লোকজন থাকে। তবে মেশিন নিয়ে যাওয়ার হুমকিটা আর দেয় না। মায়ের তবু মুখটা শুকিয়ে থাকে ভয়ে। ভয়ের কারণটা নন্টের জানা। সেলাইঘরের মেঝেটা বাঁধানোর সময় জীবনকাকা টাকা দিয়েছিল। বাবা এখন দিন রাত কাজ করে। টাকাটা শুধতে হবে যে। খুব শিগগির বড় হওয়া ছাড়া ওদের উপায় নেই। বড় হয়ে গেলে একটা কোনও মস্ত সুবিধে হবেই।

- এই কে রে?
হঠাৎ দুটো হাত পেছন থেকে নন্টের চোখদুটো চেপে ধরল।
মাজু খিলখিল করে হেসে ঘাড় হেলিয়ে হেলিয়ে ছড়া কাটে - লালকমলের আগে! নীলকমল জাগে! আর জাগে এই তলোয়ার!

তলোয়ার না কাঁচকলা! একটা কঞ্চি! সেই ইশকুলে যে নাটকটা হল তারপর থেকে মাজুটা এই করে যায়।

কঞ্চি নিয়ে হুটোপুটিটা বেশি জমল না। মাজু হঠাৎ একদৌড়ে পাঁচিলের পেছন গিয়ে ডেকে বলল,
- চোখ বোজ নন্টে! মজা হবে! ... এক দুই তিন! অ্যাই অ্যাই! তুই চুরি করে দেখছিলি! শয়তান পাজি ছেলে!

গুপ্তধন

গুমগুমিয়ে গোটা আষ্টেক কিল মেরে দিলো মাজু। আর নন্টে? নন্টে কি তখন আর এই দুনিয়াতে আছে! হাজারঝুরির গা ঘেঁষে যে থরেথরে সাজানো সাতরাজ্যের গুপ্তধন!

সন্ধ্যাবেলায় নন্টে যখন ঘরে ফিরল বাড়িময় তখন ভাত ফোটানোর গন্ধ। চৌকাঠের কোণ ঘেঁষে মা চুপ করে বসা। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কানে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল নন্টে,
- ভাতে জল দিয়ে রাখো কাল পান্তা খাব মা। লেবুপাতা চটকে। আজকে সিমুই আর পরোটা। অনেক দিয়েছে কাকি। তুমি তো বল অন্ন নষ্ট করতে নেই? তিনজনে পেট পুরে খাব। দরজা বন্ধ করে। সবাইকে জানতে হবে কেন আমাদের ঘরের কথা? গুপ্তধনের কথা, বল?

মাজুতে আর ওতে খুব শলা হয়েছে। গুপ্তধনের খবর কি কেউ পাঁচকান করে?

যেমন নন্টে আরও জানে, বাবা আজ রাত্তির ভর জেগে যে কাজগুলো শেষ করবে সেগুলো একটাও বাবার নিজের কাজ নয়। হাজারঝুরির আস্তানায় আসবার সময় মাজু যে বাবাকে চুপিচুপি রফিককাকার ঘরে ঢুকতে দেখেছে। পরবের খরচা তুলতে অনেকখানি কাজ নিয়ে ফেলেছিল রফিককাকা। ওদের চাঁদ, পরবও ওদের। নন্টের বাবার শুধু একটুখানি দায়িত্ব, জখম হওয়া কোমরটা নিয়ে রাতভর যেন রফিককাকাকে ঘাড় গুঁজড়ে মেশিনঘরে পড়ে না থাকতে হয়। একি আর কাউকে বলতে হয় নাকি!

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

মাতৃভাষা বাংলা। মানে শহুরে বাংলা। পড়াশুনো করেছেন অর্থনীতি নিয়ে। চাকরি করছেন প্রায় পনেরো বছর হল। গল্প ভালোবাসেন, পড়তে, শুনতে। এই বয়সে এসে কিছু কিছু বলবার মতো গল্পও জমেছে। তাই লিখে রাখছেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা