সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

তোচন ছোটোর থেকেই কেমন জানি অন্যরকম, আর সব্বার থেকে আলাদা! তোচন ওর বয়েসী আর পাঁচটা ছেলেপুলের মত হই হই করে ফুটবল ক্রিকেট খেলে না, বিকেলবেলায় ছাতে গিয়ে ঘুড়ি ওড়ায় না, সাইকেল চালায় না, দোলনায় ওঠে না, ফুচকা, ঝালমুড়ি খেতে ভালোবাসে না, সার্কাস দেখতে যায় না... তোচন নিজের মতন থাকে, নিজের মতন ঘুরে বেড়ায়, গুনগুন করে গান করে, জানলার কার্নিশে পিঁপড়ের সারি, পাঁচিলে বসা হুলো বেড়াল, দুর আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি, পুকুরের ধারে নেচে বেড়ানো জল-ফড়িং, কুনো ব্যাঙ, শামুক… তোচন মন দিয়ে খালি এইসব দেখে। তোচনের স্কুলেও বেশী বন্ধু নেই, অবশ্যি তোচনের কিছু যায় আসে না তাতে… তোচন আসলে পড়াশুনা করতে, স্কুলে যেতে, স্কুলে কারুর সাথে কথা বলতে ভালোইবাসে না তেমন। তোচন ছবি আঁকে, মা'র দেওয়া একটা হিজিবিজি খাতায় ও সারাদিন সময় পেলেই পেন দিয়ে, পেনসিল দিয়ে, রং-তুলি দিয়ে, কখনো বা আধপোড়া ধুপকাঠি দিয়ে নানান রকম ছবি আঁকে। সেই ছবি যে ঠিক কিসের তা কেউ সহজে বুঝতে পারে না, কেবল ও'র মা ছাড়া। তোচনের তাই ওর মা'র সাথে খুব ভাব। মা ছাড়া তোচনের একটুও চলে না। গেল মাসে ন'বছরে পা দেওয়া তোচনকে মা চুল আঁচড়ে দেন, খাইয়ে দেন, ঘুম পাড়িয়ে দেন, ঘুমের আগে রূপকথার গল্প বলেন, রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে তোচন মা'কে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। মা'র গায়ে তোচন কেমন সুন্দর ভিজে ভিজে চাঁপা ফুলের মত গন্ধ পায়। তোচনের ভারি ভালো লাগে...

তোচনের বাবা অনেক দুরে অফিসে কাজ করেন, মাসে দু'মাসে একবার আসতে পারেন কি পারেন না... তবে বাবা এলে তোচন খুব খুশী হয়। বাবা তোচনকে পার্কে নিয়ে যান, খেলার মাঠে নিয়ে যান, তোচন বাবার পাশে বসে চুপ করে খেলা দেখে। তোচন বাবাকে কোত্থাও যেতে দিতে চায় না, কিন্তু না গেলেই বা হবে কি করে! তোচন তবু প্রত্যেকবার ভাবে পরেরবার বাবা এলে সে আর কিছুতেই বাবাকে কাজে যেতে দেবেনা, জড়িয়ে ধরে ঠিক ওর কাছে রেখে দেবে। কাছে থাকলে বাবার অমন ঘুসঘুসে কাশি, জ্বর, মাথা যন্ত্রণা, কিচ্ছু হবে না। সত্যিই তো বাবা সবসময় কেমন যেন ক্লান্ত থাকে, চোখ মুখ শুকনো, বসা... বাবা আগের থেকে রোগাও হয়ে গিয়েছে কত্ত! না না, এইবার এলে বাবাকে আর কিছুতেই বাইরে কাজ করতে যেতে দেওয়া যাবে না...... তোচন মনে মনে ঠিক করে রাখে এ'সব।

যাই হোক, পরের মাসে ছুটিতে বাড়ি এলে, মা তোচনের সব আঁকার খাতা গুলো খুলে খুলে তোচনের বাবাকে দেখালেন, "আচ্ছা, আমি বলি কি, ছেলেটাকে একটু আঁকার ক্লাসে দিয়ে দিলে হয় না? ছেলেটা আঁকতে ভালোবাসে, ওই নিয়েই পড়ে থাকে সারাদিন, ভাল কারুর কাছে শিখলে, আঁকার হাতখানা খুলত।" "বেশ তো, দাও না, আমি বারন করেছি নাকি শিখতে? আঁকা শেখা তো ভালো।" তা এর কদিন পর বাবা তোচনকে সঙ্গে করে নিয়ে যেয়ে পাড়ার আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এলেন। সপ্তাহে তিনদিন খাতা, পেনসিল, রাবার নিয়ে তোচন মা'র সাথে আঁকার স্যারের কাছে নিয়ম করে যেতে শুরু করল। স্যারও খুব আদর করে, ভালোবেসে, তোচনকে আঁকা শেখাতে শুরু করে দিলেন। স্যারের কাছে যেতে যেতে তোচন মেঘ আঁকতে শিখল, মেঘের ভিতর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি, নিচে বড় বড় পাহাড়, পাহাড়ের ফাঁকে উঁকি দেওয়া সূর্য, রামধনু, পাহাড়ের কোল ঘেঁসে আঁকাবাঁকা নদী, ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর, দুরে ধান ক্ষেত, ধান ক্ষেত ছাড়িয়ে জঙ্গল, জঙ্গল ছাড়িয়ে ট্রেন লাইন, ট্রেন লাইন ধরে ছুটে যাওয়া ছেলে মেয়ে, গরুর পাল, বাবা মায়ের সাথে হাত ধরাধরি করে একসাথে স্কুলে যাওয়া ভাই-বোন ...... কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের একরত্তি তোচন এই সব কিছু কী সুন্দর আঁকতে শিখে গেল। পেনসিল, মোম রং, জল রং, সব কিছু দিয়ে ছবি আঁকা শিখে ফেলল ঝটপট। চারদিকে যা দেখে তাই খাতা পেনসিল নিয়ে বসে আঁকতে শুরু করে, আর সেই আঁকার সাথে সামনের আসল জিনিসটার কী অদ্ভুত মিল, নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যায় না! তোচনের আঁকা দেখে সবাই প্রশংসা করে বলে, "এইটুকু বাচ্চার আঁকার হাতখানা একবার দেখেছ তোমরা? কী চমৎকার... কী নিখুঁত!" অবশ্যি আড়ালে আবডালে অন্য কথা বলতেও লোকে ছাড়ে না - "ছবি টবি আঁকছে সে ভালো, তবে সাথে সাথে লেখাপড়াতেও একটু যদি মন দিত! ছবি এঁকে কি আর বয়েসকালে বুড়ো বাপ-মা'কে খাওয়াতে পারবে? অতই সোজা? হ্যাহ!!" তোচনের মা চুপ করে শোনেন, কিছু বলেন না, মাঝে মধ্যে চোখের কোণায় জল চিকচিক করে ওঠে, তোচন দূর থেকে ঠিক দেখতে পায়।   
 
***      

এমনি করে তোচনের দিনগুলো একরকম কেটে যাচ্ছিল, গোলটা বাধল এর ক'মাস পর। নিজের মনে একলা থাকা তোচন, হঠাৎ করেই আরো কেমন জানি গুটিয়ে যেতে শুরু করল। কথা বলা কমিয়ে দিল, স্কুলে যাওয়া কমিয়ে দিল, নিজের ঘর থেকে বেরোনোও কেন জানি বন্ধ করে দিল আস্তে আস্তে। প্রাণের থেকে প্রিয়, বুক দিয়ে আগলে রাখা আঁকার খাতা গুলো নিয়ে বসাও ছেড়ে দিল প্রায়। কিন্তু সেটা যে কেন, সেই কথাখানা তোচন হাজার চেষ্টা করেও কাউকে বলে উঠতে পারল না! তোচনকে নিয়ে তাই দিন দিন মা'র দুশ্চিন্তা বাড়ছিল।
এরপর একদিন রবিবার বিকেলবেলা সব বাড়িতে সবাই যখন খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিচ্ছে, তোচনদের বাড়ির দরজায় হঠাৎ কলিং বেল!... মা তো দরজা খুলে অবাক, "স্যার, আপনি?"
-"হ্যাঁ, এই খবর নিতে চলে এলাম... অনেকদিন হয়ে গেল, তোচন আঁকার ক্লাসে আসছে না, শরীর টরির খারাপ, না কি?"
-"আসুন স্যার, আপনি ভিতরে আসুন... কী যে ভীষণ সমস্যায় পড়েছি না এই ছেলেকে নিয়ে!!" তোচনের মা স্যারকে বসতে দিয়ে সব ঘটনা খুলে বললেন।  
-শুনে স্যারেরও দুশ্চিন্তা হল, "এ তো ভারি অদ্ভুত! এমনিতেই তোচন চুপচাপ, তেমন একটা কথা বলে না কারুর সাথে, তার মধ্যে এমন ভাবে যদি নিজের মধ্যে আরো গুটিয়ে যায়! তা সে কোথায়? বাড়ি আছে তো?" স্যার তোচনের ঘরে ওর সাথে দেখা করতে গেলেন।  ঘরের ভেজান দরজা আলতো করে খুলে স্যার ভিতরে ঢুকলেন যখন, তখন তোচন ওর খাটে চুপ করে শুয়ে। চারদিকে ছড়ানো ছিটনো আঁকার খাতা, গোল করে মোড়া সাদা কাগজ, কোনা-ভাঙ্গা পুরনো চায়ের কাপে রাখা রং পেনসিল… অগোছালো বিছানা বালিশের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা তোচনের চেহারাটা এই ক'দিনেই কেমন শুকনো লাগল ।
-"তোচওওওন??…  কেমন আছ তুমি?"  
-"স্যার?..... আপনি?" তোচন ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল।
-"কী ব্যাপার তোমার তোচন, আঁকার ক্লাসে আসছ না কেন? আমি প্রত্যেকদিন ভাবি, আজ বুঝি তুমি এলে, আজ বোধ হয় তোমাকে দেখতে পাব, কিন্তু নাহ, তোমার কোন খবর নেই। দেখ দিকি, আমায় নিজেই তাই তোমার সঙ্গে আজ দেখা করতে আসতে হল"। স্যার গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
-তোচন চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল, আর তার খানিক পর ধরা গলায় আস্তে আস্তে বলল, "আমি আর আঁকা শিখব না স্যার, আমার আর আঁকতে ভালো লাগে না"।
-স্যার আকাশ থেকে পড়লেন… "সে কি কথা তোচন? আঁকতে ভালো লাগছে না!! কেন? কি হয়েছে? দেখ তো, তুমি এত তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে ফেললে, এইটুকু বয়েসে এত চমৎকার আঁকা তোমার, সবাই এত প্রশংসা করছে। তোমার আঁকা ছবি নিয়ে শীতকালে আমি এক্সিবিশন করব ভেবে রেখেছি, আর তুমি এখন বলছ যে তুমি আর আঁকবে না! হঠাৎ করে আঁকা শেখা এমনভাবে কেউ বন্ধ করে দেয় নাকি??"  -- স্যার তোচনকে নিজের পাশে এনে বসালেন।
-"না না স্যার, আমি আর কিছুত্তেই আঁকব না"। তোচন দু হাতে মুখ ঢাকল।
-"এরকম করে না তোচন, এইরকম করলে বাবা মা ভীষণ কষ্ট পাবেন। কীসে অসুবিধে হচ্ছে তোমার? কেন আঁকতে চাইছ না? কী নিয়ে সমস্যা? খুলে বল দেখি আমায়!"
তোচন কিছুক্ষন গুম হয়ে বসে,  তারপর এক এক করে ওর আঁকার খাতাগুলো এনে স্যার কে খুলে দেখালো। খাতার প্রতিটা পাতা জুড়ে পেনসিলে আঁকা অনেক রকমের ছবি, তাতে অনেকগুলো মানুষ… অনেকগুলো মুখ… অনেক রকমের ঘটনা। স্যার সেই ছবিগুলোতে যা দেখলেন… যা শুনলেন, তা ওনার নিজেরই কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না!!     
 
স্যার তোচনের আঁকার খাতার প্রথম পাতা খুলে দেখলেন, ঝোপঝাড় মতন অন্ধকার একটা জায়গার ছবি, চারদিকে বড় বড় গাছ, পিছনে একটা পুরনো দিনের বাড়ি, স্যারের জায়গাটা কেমন চেনা চেনা লাগল।
- "এটা কী এঁকেছ তোচন?"  
- "স্যার আমাদের স্কুলের পিছনে যে জঙ্গলটা রয়েছে, সেখানকার ছবি।"
- "ওহ হ্যাঁ, তাই তো... সেইজন্যই খালি মনে হচ্ছিল, জায়গাটা কোথায় যেন দেখেছি। তা এই ছেলে দুটো কে? ওরা অমন মারামারি করছে এঁকেছ কেন?"
- "স্যার, ও আমাদের ক্লাসের আবীর, সৌমাভ কে মারছে!"
- "তুমি সে সময় ওখানে ছিলে? ওদের মারামারি করতে দেখেছ? সেটা দেখে পরে এঁকেছ?"  
- "না স্যার, আমি সেদিন স্কুলে যাই নি। পরের দিন যেয়ে খালি খবর পেয়েছিলাম, সৌমাভর শরীর খুব খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে, নাক মুখ দিয়ে খুব রক্ত বেরিয়েছে নাকি!"
- "তাহলে আবীর বলে ছেলেটি তোমার বন্ধুকে মারছে, এমন একটা ছবি তুমি কেন আঁকলে? তোমার কি মনে হয়, যে ওদের মধ্যে মারামারি হয়েছিল বলেই সৌমাভর অমন লেগেছে? তাই ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল? সৌমাভর সাথে আবীরের কি প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয়? সেইজন্যই কি তুমি এটা কল্পনা করলে?"
- "না স্যার... সেরকমও ঠিক নয়। আমরা সবাই জানতাম, সৌমাভ স্কুলের পিছনে ওই ঝোপ জঙ্গল জায়গাটায় পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে... কিন্তু ওইখানটায় আমরা তো কেউ যাই না, তাহলে ও যে কেন ওখানে একা একা যেতে গেল, বুঝতে পারছিলাম না!! জানেন স্যার, এর কয়েক সপ্তাহ পরে না সৌমাভ একদিন কাকু কাকীমার সাথে আমাদের বাড়ি এসেছিল" ......
- "সৌমাভ তোমাদের বাড়িতে এসেছিল? আচ্ছা… তারপর?"   
- "হ্যাঁ স্যার, ও তখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি, আর আমাদের স্কুলও ততদিনে ছেড়ে দিয়েছিল! আমি ওকে কত জিজ্ঞেস করলাম, তুই সেদিন জঙ্গলের মধ্যে কি করছিলি? হঠাৎ অন্য স্কুলে ভর্তি হলি কেন? ও কিছুতেই আমাকে কিছু বলছিল না। তারপরে আমরা এঘরে এসে বসলাম, সৌমাভ আমার আঁকার খাতাটা উল্টে পালটে দেখছিল। দেখতে দেখতে কোনসময় এই আঁকাটায় চোখ পড়ে যেতে কেন জানিনা ও খুব অবাক হয়ে আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, সেইদিনকার সেই ঘটনার আসল সত্যিটা আমি নাকি ঠিক ধরে ফেলেছি!"
- "মানে?"
- "স্যার, সৌমাভ পরে আমাকে বলেছে, আগের সপ্তাহে ক্লাসের পরীক্ষার সময় খাতা দেখে টুকতে দেয় নি বলে আবীর নাকি সত্যি সত্যিই সেদিন ছুটির পর সৌমাভকে জোর করে স্কুলের পিছনে নিয়ে যেয়ে খুব মারধোর করেছিল, ও কনোরকমে আবীরের হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালিয়েছে... কিন্তু এই মারামারির কথাখানা সৌমাভ কাউকে বলতে পারে নি... আমাকেও এই ঘটনাটা স্কুলে বলতে বার বার বারন করে দিয়েছিল" ।
- "কিন্ত সৌমাভ এই কথাটা স্কুলে জানালনা কেন? আবীরের তো শাস্তি হওয়া উচিত ছিল! এরকম ভাবে কেউ কাউকে মারে!! কী অন্যায়!"
- "স্যার, আবীর যে আমাদের হেডস্যারের কোন এক আত্মীয়ের ছেলে। আর তিনি তো খুব বড় নাকি কে একজন, খুব ক্ষমতা, সবাই ওনাকে খুব ভয় পায়। আবীরকে তাই কেউ কিছু বলে না!"
স্যার সব শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন... অনেকগুলো কথা মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছিল। মনে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে স্যার তোচনের আঁকার খাতার পাতা ওলটালেন ----
 
-"এটা কাকে এঁকেছ তোচন? তোমার বাবার মতন লাগছে! সামনে বসে ইনি কে?"
-"হ্যাঁ স্যার, বাবা। তবে এই ভদ্রলোককে আমি চিনি না, আগে দেখি নি।
-"তোমার আঁকা দেখে কেন মনে হচ্ছে বলত যে এই সামনের ভদ্রলোক খুব রেগে আছেন? কেমন যেন চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছেন তোমার বাবার উপর!"
-"তাই তো স্যার... কেন যে এমন একখানা ছবি আঁকলাম। পরে ভেবেছিলাম, মা কে একবার জিজ্ঞেস করব, কিন্তু আবার মনে হলে, মা ছবিটা দেখে যদি দুঃখ পান, তাই আর আমি যাই নি!!" তোচন মাথা নিচু করে বসে রইল।

স্যার কিছুক্ষন চুপ করে থেকে পরের পাতায় গেলেন -----
-"আরে আরে!! এ কি!! এতগুলো বিড়াল... এমনি করে বস্তায় বাঁধছে কেন!!... আচ্ছা, এই ইনি আমাদের পাড়ার নিতাই বাবু না?"
-তোচন ফুঁপিয়ে বলল, "স্যার, এগুলো আমাদের মিনুর ছেলেপুলে, আঁকতে আঁকতে আমি ঠিক চিনতে পেরেছি... গত বছর আমাদের মিনুর একসাথে এরকম অনেকগুলো বাচ্চা হয়েছিল... কত টুকু টুকু সব ছানা, চোখ ফোটে নি, সাদার উপর কালো কালো ছোপ, নরম তুলতুলে, সারাদিন পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত, কাউকে বিরক্ত করত না। তারপর একদিন সবকটা একসাথে কোথায় যে হারিয়ে গেল! আমি কত জায়গায় খুঁজলাম, কোত্থাও পেলাম না! বাচ্চাগুলোকে না পেয়ে মিনু সারা রাত কাঁদত... তারপর একদিন মিনুটাও সেই যে সেই চলে গেল, আর কোনোদিন ফিরে এল না। আচ্ছা, স্যার, মিনুকেও কি নিতাই কাকু এমনিভাবে...!!" তোচন ডুকরে কেঁদে উঠল।

মনের মধ্যে তৈরী হওয়া প্রশ্নগুলোর একটু একটু করে উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন যেন এইবার... তোচনের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে স্যার পরের পাতায় গেলেন---
- "মা কে এঁকেছ নাকি তোচন? ...বাহ!"
- চোখ মুছতে মুছতে তোচন বলল "দেখুন না স্যার, মা কেমন গয়নার দোকানে হাতের বালা দুটো খুলে দিয়ে দিচ্ছেন!"
- "হম... সেইরকমই তো কিছুটা..."
- "জানেন স্যার, আমি বহুদিন মা'র হাতে ঠাম্মার দেওয়া এই বালা দুটো দেখিনি, জিজ্ঞেস করলে বলেন তুলে রেখেছি। মা'র অমন খালি খালি হাত দেখতে আমার ভালো লাগে না, কত বলি বালা দুটো পরতে, মা তাও পরেন না!"
স্যারের চশমাটা ঝাপসা হয়ে আসছিল বড়, ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। আঁকার খাতাটা বন্ধ করে স্যার তোচনকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে বসলেন। "তোচন, একবার তোমার মাকে ডাক তো, আমার কিছু কথা আছে।" মা হাত মুছতে মুছতে তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন--
-"সংসারে যে এমন বিপর্যয় চলছে, একবারও বলেননি তো আপনারা!"
-"বিপর্যয় ... মানে?!... আমি তো কিছু..."
-"তোচনের বাবা'র চাকরীতে সমস্যা, আপনি নিজের গয়না বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন ... এ বিপর্যয় নয় তো কি? এত কিছু ঘটে গিয়েছে আপনাদের সাথে, আমাকে একবারটি জানালে আমিও তো আমার মতন করে চেষ্টা করতে পারতাম। তোচনের বাবা, সুবিমলকে আমি সেই ছোটর থেকে দেখছি, এত বছর হয়ে গেল এক পাড়ায়, ও আমার ভাই'এর মত, তোচনকে আমি আমার সন্তানের মত স্নেহ করি... এ সবই তো আপনারা জানেন"...

তোচনের মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, "তোচনের বাবাকে ওরা মাস দুই আগে কী একটা মিথ্যে দোষ চাপিয়ে চাকরীটা থেকে বার করে দিল। ওর বাবা হন্যে হয়ে অনেক চেয়ে চিন্তে যে কাজটা জোগাড় করে উঠতে পারলেন, সেই কাজের টাকায় সংসার চলে না... গয়না বিক্রি করা ছাড়া আর উপায় ছিল না স্যার! সংসারের খরচ চালাতাম কী ভাবে? ছেলের পড়াশোনা? ...... কিন্তু স্যার, আপনি? এত কিছু ... কী ভাবে?!"

স্যার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। "তোচনের আঁকা ছবি... ওতেই ঘটনা গুলো বলা রয়েছে মিসেস রায়... ওগুলো দেখেই সব আন্দাজ করতে পারলাম!"
- "ছবি দেখে?... মানে?" -- তোচনের মা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
"প্রথমে আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না জানেন তো, কিন্তু ভালো করে তোচনের আঁকা ছবি দেখে, ওর সাথে কথা বলে বুঝলাম, বাস্তবিকই ওর জীবনে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, ঘটে চলেছে। সত্যিই কোন এক অদৃশ্য শক্তির জোরে তোচন ওর জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা অতীতের এমন অনেক কিছু অজান্তেই এঁকে ফেলতে পারছে, যা ও নিজের চোখে দেখেনি, শোনে নি, জানে না। আর তারপর সেই না জানা ভয়ংকর সত্যি গুলো ওকে কষ্ট দিচ্ছে, তাড়া করে বেড়াচ্ছে, ওর বাস্তবের সুন্দর জীবনের সাথে ওর আঁকা ছবির সত্যিটা ও মেলাতে পারছে না, কেন আঁকছে, কিসের জন্য আঁকছে, তা বুঝতে পারছে না! এটা একটা প্রবল মানসিক চাপ, এইটুকুন একটা ছেলের পক্ষে এই কঠিন বাস্তবটা মেনে নিতে পারা সত্যিই শক্ত! আর ঠিক এই কারনেই তোচন ভিতরে ভিতরে ক্রমশ এমন গুটিয়ে যাচ্ছে । -- কি তোচন, তাই তো? আমি ঠিক বলছি?"
তোচনের মা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন--- তোচন সোফায় মাথা নিচু করে বসেছিল, ফুলে ফুলে উঠছিল ছোট্ট শরীরটা।
- স্যার তোচনকে আদর করে নিজের কাছে টেনে নিলেন, মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, "কিন্ত তোচন, অতীত থেকে পালালে তো চলবে না, যা ঘটে গিয়েছে, যা সত্যি, তাকে তো পালটানো যায় না তোচন, সেটাকে মেনে নিতে হয়, অতীতকে সামনে রেখে, তার থেকে শিক্ষা নিতে হয়, সেই শিক্ষায় নিজেদের বর্তমান, নিজেদের ভবিষ্যৎ তৈরী করতে হয়। অতীতকে ভয় পাবে কেন? তোমার এই অতীত-দর্শন ক্ষমতা ঈশ্বর প্রদত্ত, এই অন্তরদৃষ্টি ইশ্বরের আশীর্বাদ। এতে তো ঘাবড়ানোর কিছু নেই, ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। তোমার এই ক্ষমতাকে অবহেলা কোরো না তোচন, জীবনে কষ্ট থাকবে, দুঃখ থাকবে, অবিশ্বাস থাকবে, লড়াই থাকবে... কিন্তু সেই সাথে ভালোবাসাও তো থাকবে তোচন, ভালো মানুষও থাকবে, তাঁদের কে চিনে নিতে শিখতে হবে তো? যা কিছু খারাপ, যা কিছু কষ্টের তা দেখে ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলে ভালোকেও তো আর তুমি দেখতে পাবে না, সেটা কি ঠিক?"--- তোচন মাথা নাড়ল।
স্যার তোচন কে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বললেন, "আজ থেকে আর ভয় পাবে না, যা ভাবছো, যা আঁকতে ইচ্ছে করছে, সব আঁকবে। সে আঁকা তোমাকে কষ্ট দিলে, মনে প্রশ্ন তুললে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে, তার জন্য যুদ্ধ করতে হলে যুদ্ধ করবে, কিন্তু তা বলে ধৈর্য হারাবে না, সত্যি যতই কঠিন হোক, যতই যন্ত্রণার হোক, তার থেকে পালিয়ে আসবে না। শুধু জানবে, দুঃখ যেমন আছে, তেমন আনন্দও আছে, আর এই দুই নিয়েই জীবন, এই দুজনকে নিয়েই জীবনে এগিয়ে যেতে হয়, চলতে শিখতে হয়, পিছন ফিরে তাকাতে নেই...হেরে যেতে নেই। আমি আশীর্বাদ করছি তোমায় তোচন, তুমি একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে, পৃথিবী জোড়া নাম হবে তোমার, দেশে বিদেশে তোমার আঁকা ছবি ছড়িয়ে পড়বে... আর সেই ছবি শুধু অতীত নয়, মানুষকে তার ভবিষ্যৎ দেখতেও সাহায্য করবে, তাদের সঠিক দিক নির্দেশ করতে সাহায্য করবে, তাদের নিজেদের ঠিক ভুল চিনিয়ে দিতে সাহায্য করবে, তাদের আরো গঠনমূলক চিন্তা করতে বাধ্য করবে। শুধু প্রথাগত পড়াশোনা দিয়ে নয় তোচন, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প, খেলাধুলো, নাটক, সিনেমা... এইসব কিছু দিয়েও সমাজকে পালটে দেওয়া যায়... পালটানোর চেষ্টা করা যায়। তোমার পড়াশোনা ভালো লাগে না, তাতে কী? তুমি ছবি আঁকবে... নিজের মতো ছবি আঁকবে... অনেক ছবি আঁকবে। আর একদিন তোমার আঁকা সেই ছবিই সমাজকে আরো উন্নত, আরো সভ্য, আরো সহনশীল করে তুলবে। তুমি দেখে নিও..."     

তোচন মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালো, অবাক হয়ে দেখল, সন্ধ্যের নিভু নিভু আলোয় স্যারের মুখটা কেমন আশ্চর্য রকম জ্বলজ্বল করছে! স্যারের কথাগুলো খুব অন্যরকম শোনাচ্ছিল আজ, কেন জানি মনে হচ্ছিল সেই কোথায় কত্তদুর.. ওই আকাশ থেকে স্যারের শেষের কথাগুলো যেন ওর কাছে ভেসে ভেসে আসছে। বাগানে ফোঁটা কামিনী, বেল, জুঁই'এর ভেসে আসা মিষ্টি গন্ধ, ধূপের ধোঁয়া, শাঁখের ফুঁ, ঠাকুরের বেদী থেকে আসা ঘণ্টার আওয়াজ, আর সামনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা তোচনের খুব প্রিয়, খুব কাছের একজন মানুষ, তোচনের স্যার... সব কেমন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল সে সময়। তোচন, স্যারের দু'পায়ে প্রণাম করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার মনে আজ আর কোন চিন্তা নেই, কোন কষ্ট নেই ........  ভয় না পেয়ে, সত্যিকে সামনাসামনি দেখতে, সত্যির মুখোমুখি হতে আজ তোচন শিখে গিয়েছে।  

ছবিঃ শিল্পী ঘোষ

জন্ম, স্কুল-কলেজ, কর্মজীবন মূলতঃ কলকাতায়। ভেষজবিদ্যায় পি.এইচ.ডি.। মুম্বাই’এ ভাবা এ্যটমিক রিসার্চ সেন্টার'এর পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপে কাজ করার পর, ভারত সরকারের ডিপার্টমেণ্ট অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি'র পক্ষ থেকে ইয়ং-সাইন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়ে পুনরায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে প্রত্যাবর্তন। যদিও আপাতত গবেষণা থেকে উনি আংশিক স্বেচ্ছা-অবসর গ্রহণ করেছেন।    

ছোটোবেলায় 'সন্দেশ' পত্রিকায় ছড়া, ছবি, গল্প ইত্যাদি দিয়ে লেখক জীবন শুরু। মাঝের বহু বছরের বিরতির পর আবার লেখালিখিতে হাত পাকানো ও ফিরে আসা। আগের কিছু গল্প প্রকাশিত হয়েছে কিছু অনলাইন পত্রিকায়। নাচ, সেলাই, রান্না, বাগান করা, দাবা খেলা... এইসব নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। 

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা