সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

(৯)

সূর্যের তাপবাহি যন্ত্রটা আজ আরেকটু শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আর এই ভিষণ তাপে একটি ছোট্ট ছেলে ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার সামনে একটা বড় জলাশয়। স্কুলের ব্যাগটা তার পাশেই পড়ে আছে অযত্নে। এই দুরন্ত রোদের মধ্যে সেই ছোট্ট ছেলেটি একটি রঙিন প্লাস্টিক বার বার পুকুরের কালো জলে ডোবাচ্ছে। প্লাস্টিক টা জল থেকে তুলে তার মধ্যে অর্ধেকটা মুখ ঢুকিয়ে কি যেন খুঁজছে। প্লাস্টিকের জল টা আবার পুকুরের জলের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। এই পদ্ধতিটা বেশ অনেকবার চলল।

রাতুল এবার তাড়াতাড়ি নিজের স্কুলের জুতো মোজা খুলতে শুরু করল। তাড়াহুড়ো তে পায়ের নীচে ঘাস গুলো একটু এলোমেলো হয়ে গেল।
কিছু কিছু হয়তো মূলসমেত উৎক্ষেপিত হয়ে এল। সূর্যের ফালা এখন একটু ভোঁতা হয়েছে। এখন আর চামড়া পুড়ছে না।

রাতুল এবার উঠে দাঁড়ালো। তার দুটো হাত জলে চকচক করছে। সে এক হাতে স্কুলের ব্যাগটা আরেক হাতে জুতো মোজা আর রঙিন প্লাস্টিক টা ঝুলিয়ে চলতে শুরু করল। রাতুল তার বাড়ির দিকে তাকাচ্ছিল না। তার চোখ ছিল পুকুরের আরেক পারে বেড়া দেওয়া জায়গাটার দিকে। সে দিকেই তার পা জোড়া এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই ছোট্ট পা দুটো কিছু ক্ষণেই সেই দূরত্ব অতিক্রম করে সেই বেড়া দেওয়া সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। সেখানে প্রায় ছুড়ে তার ব্যাগ আর জুতো জোড়াটা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। এখানেও সেই একই পদ্ধতি শুরু করল রাতুল। কিন্তু তার মুখে একবারের জন্যও একটা ছোট্ট হাসির রেখাও দেখা যায়নি।

আস্তে আস্তে চারিদিক দিয়ে সূর্যকে ঘিরে ফেলতে শুরু করল ধূমায়িত মেঘ। আকাশের চকচকানি এখন পুরোপুরি কমে গেছে। এই অনুজ্জ্বল আকাশের নীচে বসে থাকা ছোট্ট ছেলেটির এই ব্যাপারে কোন হুশ নেই। সে এই শেষ সিঁড়িতে উপুড় হয়ে বসে জলের উপরিভাগের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার খোঁজ এখনও সফল হয়নি। সে আবার রঙিন প্লাস্টিকটা হাতে তুলে নিল। তার শরীরটা যত এগোতে পারে সিঁড়িতে পা রেখে ততটা সম্ভব তার শরীর টাকে এগিয়ে দিয়ে প্লাস্টিকটা জলে ডোবাল। প্লাস্টিক টাকে একটু জলে ঘু্রিয়ে সেটাকে জল থেকে তুলে আনল। প্লাস্টিকের মুখটা হাঁ করে খুলে ধরল নিজের মুখের সামনে। বেশ অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করার পর তার নিরাশ মুখটা বেরিয়ে এল রঙিন প্লাস্টিকের ভেতর থেকে।

রাতুলের নিরাশ চোখ দুটো আবার নিহিত হল জলাশয়ের উপরিভাগে। কিন্তু সেই চোখ দুটো তে এখন লালের আভা দেখতে পাওয়া গেছে। চোখের জলে ভরে উঠছে। হাতের উলটো দিকটা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয় চোখের জলকে গায়েব করার চেষ্টা করল রাতুল। তখনি রাতুলের হাতের উপরে দু তিনটে ফোঁটা আঘাত হানল। রাতুলের নিরীক্ষণ করার আগেই ঝমঝম শব্দ নিয়ে অনেক গুলো বৃষ্টির দানা ধেয়ে এল মাটির দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে জলের তেজে ছোট্ট ছেলেটির শরীর ভিজে উঠল। রাতুলের তখনও ঘোর কাটেনি। সে তখন তার শরীরটা জলের উপর আরও এলিয়ে প্লাস্টিকটা ডোবাতে যাচ্ছিল। তার ছোট্ট পা দুটো ছাড়া পুরো শরীরটাই এগিয়ে গেছে জলের দিকে। আস্তে আস্তে তার পা দুটো সিঁড়ির একদম কোণায় চলে এসেছিল। বৃষ্টির জলে ভেজা সিঁড়িটা ছোট্ট পা দুটোকে আর ধরে রাখতে পারেনি।

রাতুলের শরীরটা একেবারে হুড়মুড়িয়ে জলের গভীরে ঢুকে যাচ্ছিল। তার ছোট্ট শরীরটা জলে গহ্বরে হারিয়ে যেত, কিন্তু তখনি তার একটা হাত সামনে বেড়াটাকে আঁকড়ে ধরল। সেটা তাকে পুরোপুরি তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নিল। কিন্তু তার অন্য হাতে এখনও সেই রঙিন প্লাস্টিকটা জলের তলায় ঝুলছে। রাতুল কোনোরকমে বেড়ায় ভর দিয়ে নিজের শরীরটাকে জল থেকে তোলার চেষ্টা করছিল। বার বার তার মনে হচ্ছিল জল হয়তো তার পুরো শরীরটাকে খেয়ে নেবে। কিন্তু একটু একটু করে সে সিঁড়ির উপর শরীরটাকে টেনে তোলায় সক্ষম হল। তখন তার অন্য হাতের মুষ্টিতে আবদ্ধ প্লাস্টিকটাও উঠে আসল জল সুদ্ধ। রাতুলের শ্বাস ঢেউ-এর মতো ফুলে ফেপে উঠছিল। সে তাড়াতাড়ি প্লাস্টিকটায় ছোট্ট একটা গিঁট তৈরি করে ব্যাগে চালান করল। আর অপেক্ষা না করে সে জুতো নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। বৃষ্টির তেজ আস্তে আস্তে নেমে আসছে। যতটা আওয়াজের সাথে শুরু হয়েছিল সেই হুঙ্কার আর নেই এই বৃষ্টিতে।

খালি পায়ে একটি ছোট্ট ছেলে ব্যাগ কাঁধে জুতো হাতে রাস্তায় চলছিল।

(১০)

বৃষ্টির প্রহার এখন অনেকটা ক্লান্ত। রাতুলের ভেজা শরীরটা বিছানার উপর বিরাজমান। তার প্যান্টস থেকে চুয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা গুলো সাদা মেঝের উপর একটা ছোট্ট প্রবাহি নদীর সৃষ্টি করেছে। এই রকম অনেকটা সময় চলে গেল।

বাইরেটা এখন অন্ধকার, সূর্যি মামা কাল আবার আসবে বলে এখন বাড়ি গেছে। নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটার নজর ফিরিয়েছে রাতুল। প্লাস্টিকটা বের করে তার নীল অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে এগিয়ে গেল। যে শেষ জলটুকু সে পুকুর থেকে তুলে এনেছিল সেটুকু সে অ্যাকুইরিয়ামে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। এই ভেবে হয়তো এইটুকু স্মৃতি তার কাছে থেকে যাবে তার প্রিয় বন্ধুটির।

জলটা ঢালতেই একটা টপ করে আওয়াজ হল। এতক্ষণ পড়ে রাতুলের নিষ্প্রাণ নজরে একটু প্রা্ণের সঞ্চার ঘটল। সে দেখতে পেল একটা গাড় লাল রঙের মাছ অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে দ্রুতগতিতে ঘুরে বেরাচ্ছে। তার পাখনা ঝড়ের গতিতে নাচছে জলের নীচে। রাতুল প্রায় দুহাত দিয়ে কাঁচের বাক্স টাকে জড়িয়ে ধরেছে। তার দুটো চোখ গেঁথে গেছে কাঁচের দেওয়ালে। যেখান দিয়ে পরিষ্কার জেলিকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ঠিক সেই জায়গাতেই রাতুল তার ঠোঁট দুটো চেপে ধরল। তার চোখের গরম জল গাল বেয়ে নেমে এসে ঠোঁটের উপর জমা হয়ে কাঁচে এক অদ্ভুত রেখার সৃষ্টি করছিল। রাতুল এবার উঠে দাড়িয়ে জলের ভেতর হাত দিয়ে একবার জেলির নরম শরীরটা ছুঁয়ে দেখল।

“আই অ্যাম সরি, আমি আর কোন দিন এইরকম করব না”। জেলি হয়তো জলের মধ্যে দিয়ে তার পাখনা গুলো ঝাপটে তার সম্মতি জানিয়েছে হবে। কিন্তু সেটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না। কিন্তু রাতুল ঠিক দেখতে পেয়েছে তার হাতের ছোঁয়ায় তার বন্ধুটি আনন্দে ভরে উঠছে।

রাতুল যখন তার আবার ফিরে পাওয়া সঙ্গীকে দেখতে ব্যস্ত, তখন তার চোখে হাজার পাওয়ারের ধাক্কা লাগল। সে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল তার পাপা ঠিক তার পাশেই দাড়িয়ে আছে। রাতুল আর অপেক্ষা না করে তার বিশ্বজয়ের কাহিনির সারাংশ বলতে চাইল।

“পাপা আমি জেলিকে পেয়ে গেছি”।
“এই দ্যাখ আমি তোর জন্য জেলি এনেছি”।

এই দুটো কথাই প্রায় একই সময়ে দুজনের মুখ থেকে বানের মতো বেরিয়ে এল। রাতুল তখন তার পাপার হাতে ছোট্ট প্লাস্টিকে লাল জিনিসটাকে দেখতে পেল। তার পাপা অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া লাল বস্তুটাকে চিনতে ভুল করল না। তার উপর রাতুলের ভেজা শরীর সব কাহিনি যেন খোলসা করে দিল। তারা দুজন দুজনকে আর কিছু বলল না। যেন তাদের মধ্যে অলিখিত এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। রাতুলের পাপা তার হাতের প্লাস্টিকটা পুরো খালি করে দিল ওই নীল অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে। এখন সেখানে একটা নয় দুটো প্রান শ্বাস নিচ্ছে।

দীপশিখা তরফদার পেশায় লেখক ও সাংবাদিক, সহ-সম্পাদক হিসেবে কলকাতার একটি প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরত। বইয়ের দুনিয়ায় বিচরণে সর্বদা আগ্রহী ও কল্পনার জগত সব সময় হাতছানি দেয় তাঁকে। ফাঁক পেলেই সাদা কাগজ লিখে ভরিয়ে দেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা