সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

তিতিরদের গ্রামটা খুব সুন্দর। চারিদিকে গাছপালা আর জমি দিয়ে ঘেরা। এখানে সারাবছর প্রচুর ধান আর আলুর চাষ হয়। এখনও তো আমন ধান রোয়ার সময় কিন্তু সব জমি- পুকুর- ডোবা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কোনকিছুকেই আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছেনা । চক্রবর্তী পাড়ায় গিয়ে তিতির দেখল সেখানে প্রায় সব বাড়িই ভেঙ্গে পড়ে আছে। তবুও তারই মধ্যে যাদের ইটের পাঁচিল তাদের বাড়িগুলো না ভাঙ্গলেও খরের ছাউনিগুলো সব উড়ে গেছে। গোয়ালবাড়ি ভেঙ্গে পড়ে আছে আর গরুগুলো ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছে । গরুগুলোকে দেখে খুব মায়া হয় তার। বাবাকে প্রশ্ন করে---' আচ্ছা বাবা গরুগুলোর জন্যও একটা ঘর খুলে দিলে হয় না?' মেয়ের কথায় বাবা হেসে বললেন ---' হ্যাঁ সে তো তুই দিতেই পারিস । তুই আর তোর মা না হয় তোদের ঘরটা ছেড়ে দিস । ' বাবার কথা সত্যি ভেবে তিতির বলে উঠল --' তাহলে আমি আর মা কোথায় শোবো ? ' 'সে তুই জানিস। বারান্দায় শুয়ে নিবি না হয়'। তিতির এবার বুঝল যে বাবা তার সাথে এতক্ষন ঠাট্টা করছিল। আর কিছু বলল না সে কিন্তু অনুমান করল চক্রবর্তী পাড়ারই যদি এই হাল হয় তাহলে মুচি পাড়া, নায়েক পাড়ার কি দুর্দশা হয়েছে।

তিতিরদের পাড়ার পড়েই চক্রবর্তী পাড়া পেড়িয়েই নায়েক পাড়া পড়ে । এই এলাকাটা সবথেকে নিচু তাই এখানে জলও অনেকবেশি দাঁড়িয়েছে ---প্রায় তিতিরের বুক অবধি । বাবা বললেন --- ' তিতির আমার হাতটা শক্ত করে ধর, এখানে জলের খুব স্রোত '। তিতির দেখল বাবা ভুল বলেননি, সত্যিই জলের টানে তারাও অনেকদুর এগিয়ে গেছে। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় এইভাবে পা ডুবিয়ে হাঁটতে পেরে মনে মনে ভীষণ মজা পেল সে। 'আচ্ছা বাবা এই জলে মাছ পাওয়া যাবে না?' 'হুমমম পাওয়া যেতেই পারে। পাকড়ে , মজুমদার সব পুকুরের মাছই তো বেরিয়ে গেছে। হয়ত দেখবি তোর হাতের নাগালের মধ্যে দিয়েই একটা মাছ চলে গেল।' ' তাহলে তো দারুন হবে' তিতির বলে উঠল। তারপর আর একটু এগিয়ে যেতেই দেখল রাস্তাতেই কিছু লোক ছাকনিজাল দিয়ে মাছ ধরছে, কোথাও কোথাও আবার ফাঁস জাল লাগানো ---- -যেন গোটা রাস্তাটাই একটা আস্ত পুকুর। নায়েক পাড়া পেরিয়েই গ্রামের প্রাইমারি স্কুল। বাইরে থেকে সেখানে দেখা গেল রীতিমত মোচ্ছব বসে গেছে। স্কুলের মিড ডে মিলের রান্না যেখানে হয় সেখানে একটা বড় কড়াইয়ে রান্না হচ্ছে। স্কুলের বারান্দায় বড় আলনা খাটানো হয়েছে আর তাতে সবাই যে যার গামছা, লুঙ্গি, কাপড়জামা মেলে দিয়েছে। তিতির দেখল স্কুলের সঙ্গে লাগোয়া যে মাঠটা যেখানে প্রতিদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে সে ঘানি, বুড়িব বসন্ত খেলে সেই মাঠটাতেও একগলা জল। সেখানে কেউ কেউ গামছা পড়ে নিমকাঠি দিয়ে দাঁত মাজছে আর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে জলের মধ্যে হেঁটে চলেছে আবার মাঝেমাঝে কানে আঙ্গুল দিয়ে ঢুস ঢুস করে ডুব দিচ্ছে। চারিদিকের পরিবেশটাই যেন অন্যরকম--কারোর যেন কোন তারা নেই। আর একটু এগিয়ে গিয়েই তিতির দেখতে পেল তাদের গ্রামের সকলের সাধের 'পঞ্চার চায়ের দোকান'টাও ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে। অবশ্য দোকানের সঙ্গে লাগোয়া পেরেক আর নারকেল দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা বাঁশের মাচাটা ডুবু ডুবু হলেও অক্ষত আছে। তিতির দেখল শুধু সে একা নয় তার মতো আরও অনেকেই বাবার হাত ধরে জল দেখতে বেড়িয়েছে । এমনকি পাশের গ্রামের দত্তদের ছেলেপুলেরাও এসেছে । তারা আবার জলে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে মিলে হাসিমুখে বিভিন্ন পোজ দিয়ে ফোটো তুলছে ---যেন দিঘার সমুদ্রে স্নান করতে এসেছে। তিতিরের বাবাকে দেখে একজন দূর থেকে বলে উঠল --' কাকু পাহাড়পুরের বন্যা দেখতে এলাম'। তিতিরের বাবা হাসিমুখে ছেলেটিকে হাত নেড়ে সম্মতি দিলেন। আসলে আশেপাশের গ্রামগুলোর থেকে তিতিরদের গ্রামটাই সবথেকে নিচু এলাকায় তাই এখানে জলও অনেকবেশি দাঁড়িয়েছে আর সেটা দেখতেই পাশের গ্রামের অনেকে ভিড় জমিয়েছে। সব দেখেশুনে বিস্মিত তিতির প্রশ্ন করে--- 'আচ্ছা বাবা বন্যা হলে তো সকলে দুঃখ পায় কিন্তু এখানে তো সবাই আনন্দ করছে'। ' ঠিক বলেছিস রে মা , আসলে যাদের একটু টাকাপয়সা আছে তারা সবাই আনন্দ করে নিচ্ছে। এই যেমন তুই। তোদের বাড়িটা ভেঙ্গে পড়েনি বলেই তো তুই আমার সাথে হাত ধরে মজা করে জল দেখতে বেড়িয়েছিস ' । বাবার কথা শুনে তিতির বিজ্ঞের মত ভাবে সত্যিই তো বর্ষা , কাবেরি, দীপক এদের কেওই তো জল দেখতে বেড়য়নি। ওরা তিনজনেই মুচিপাড়ায় থাকে। তাহলে কি ওদের সবার বাড়ি ভেঙে গেছে! ওরা সবাই কি এখন স্কুল ঘরে!

' বাবা চল না একবার ইসকুলে যাই ' তিতির আবদার করে।

স্কুলের ভিতরে গিয়ে দেখল সত্যি সত্যিই সেখানে বর্ষা , কাবেরি,দীপক সবাই রয়েছে। বর্ষা বটিতে আলু কাটছিল , তিতিরকে দেখে বলল ---'কি রে তিতির তুই এখানে?' তিতির কোন উত্তর দিল না শুধু বর্ষার পাশে এসে বসল । তারপর তিনজনের মুখেই শুনল কিভাবে কাল রাতে ওদের বাড়ি ভেঙ্গে গেছে। এমনকি কাল রাতে কাবেরির প্রিয় ছাগল 'দুষ্টু'ও টালি চাপা পড়ে মারা গেছে। সে বুঝতে পারল ওদের কারোর কাছেই এক দানা খাবারও নেই, কাল রাত থেকে ওরা কিছু খায়ওনি । কথায় আছে কারোর সর্বনাশ তো কারোর পৌষমাস --- গ্রামে জল ঢুকেছে বলে কেউ কেউ ক্যামেরায় সেটাকে বন্দী করে রাখছে আবার কারোর কারোর ক্যামেরার প্রয়োজন হয়না, মনের ক্যানভাসে এমনিই বন্দি হয়ে যায় সর্বস্ব হারানোর ছবিটা । বন্ধুদের ঘর হারানো ,স্বজন হারানোর যন্ত্রণা এক লহমায় তিতিরের মনের সমস্ত পুলককে স্তিমিত করে দেয় । চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার । কানে মায়ের সেই কথাগুলোই বারবার বাজতে থাকে--' এত এত পাচ্ছিস তো তাই নষ্ট করছিস......।' কোন কথা না বলে বাবার হাত ধরে ধীরেধীরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় সে । পাশে কড়াইয়ে তখনও টগবগ করে ফুটছে খুদ মেশানো চালের খিচুড়ি ।।


ছবিঃমহাশ্বেতা রায়

নিবেদিতা মন্ডল কর্ণাটক স্টেট ওপেন ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছেমতন লেখালেখিতে হাত পাকাচ্ছে সে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা