সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কী মজাই না করত ওরা

মার্গি জিনিসটার বিষয়ে সেই রাতে নিজের ডায়রিতেও লিখে রাখল। মাথার ওপর মে ১৭, ২১৫৭ তারিখ ছাপা পাতাটাতে, সে লিখল, " আজ টমি একটা সত্যিকারের বই খুঁজে পেয়েছে!"

বইটা খুব পুরনো। মার্গির দাদু একবার বলছিলেন যে তিনি যখন ছোট্ট ছিলেন, তখন তাঁর দাদু তাঁকে জানিয়েছিলেন যে এক সময়ে সব গল্প কাগজে ছাপা হত।

ওরা হলুদ, কুঁচকে যাওয়া পাতাগুলো উল্টেছিল, আর সরে সরে যাওয়ার বদলে — স্ক্রীনে যেমন হয়, জানোই তো — শব্দগুলো সব স্থির রয়েছে দেখতে অদ্ভূত মজা লাগছিল। আর তারপরে, যখন ওরা আগের পাতা উল্টালো, দেখল সেই প্রথমবার পড়া শব্দগুলোই রয়ে গেছে সেখানে।

"ধুস", টমি বলল, " কী বাজে ব্যাপার। বই একবার পড়া হয়ে গেলে নির্ঘাত ফেলেই দিত, মনে হয় । আমাদের টেলেভিশন স্ক্রীনেই তো কয়েক লক্ষ বই আছে, আর ওটার মধ্যে আরও রাখা যাবে। আমি তো ওটাকে কোনোদিন ফেলে দেব না। "

" আমারটাও ওইরকমই," বলল মার্গি। ওর এগারো বছর বয়স বলে ও টমির মত অতগুলো টেলিবুক দেখেনি। টমির তেরো বছর বয়স।

" তুমি এটাকে পেলে কোথায়?" মার্গি জিজ্ঞাসা করল।
"আমাদের বাড়িতে," চোখ না তুলেই আঙুল তুলে দেখাল টমি। "ছাদের ঘরে"।
"কী নিয়ে লেখা আছে?"
"স্কুল।"
মার্গি মুখ ব্যাঁকালো। "স্কুল? স্কুল নিয়ে আবার লেখার কী আছে? স্কুল আমার বাজে লাগে।"

মার্গির কোনোদিনই স্কুল পছন্দ ছিল না, এখন তো আরও বেশি খারাপ লাগে তার। তার যান্ত্রিক শিক্ষক তাকে একের পর এক ভূগোলের পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছিল আর সে ক্রমশঃ খারাপ থেকে আরও খারাপ পরীক্ষা দিচ্ছিল। শেষ অবধি মা ব্যাজার মুখে মাথা নেড়ে কাউন্টি ইন্সপেক্টরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

কাউন্টি ইন্সপেক্টর একজন লালচে মুখের ছোটখাটো, গোলগাল মানুষ, তাঁর সঙ্গে থাকে একগাদা ডায়াল আর তার ভর্তি একটা যন্ত্রপাতির বাক্স। তিনি মার্গিকে দেখে একগাল হেসে তার হাতে একটা আপেল দিয়েছিলেন , আর তারপরে তার শিক্ষককে খুলে ফেলেছিলেন। মার্গি ভেবেছিল উনি যদি ওটাকে আবার জোড়া লাগাতে না পারেন তো বেশ হয়, কিন্তু তেমন আর হল কই ! ঘন্টাখানেক পরে সেটা আবার খাড়া হয়ে গেল, বিরাট, চৌকো, বিচ্ছিরি এক যন্ত্র, যার সামনে একটা বিশাল স্ক্রীন যাতে সব লেখাপড়ার বিষয় দেখানো হয় আর প্রশ্ন করা হয়। সেটা তাও ভালো। মার্গির কাছে সবথেকে বিরক্তিকর হল হোমওয়ার্ক আর টেস্ট পেপার জমা দেওয়ার স্লটটা। তাকে সবসময়ে ছয় বছর বয়স থেকে শেখা একটা পাঞ্চ কোড ব্যবহার করে সব উত্তর লিখতে হয় আর তার যান্ত্রিক শিক্ষক মূহুর্তের মধ্যে নম্বর যোগ করে মার্কস্‌ জানিয়ে দেয়।

নিজের কাজ শেষ করে ইন্সপেক্টর অল্প হেসে মার্গির মাথা চাপড়ে দিয়েছিলেন। তিনি ওর মা কে বলেছিলেন, "মিসেস জোন্‌স্‌, এই ছোট্ট মেয়েটা কোনো ভুল করেনি। আমার মনে হয় জিওগ্রাফি সেক্টরটা একটু বেশি তাড়াতাড়ি চলছিল। এরকম হয় মাঝে মাঝে। আমি ওটাকে কমিয়ে মোটামুটি দশ বছর বয়সীদের যেমন দরকার, তেমন করে দিয়েছি। সত্যি বলতে গেলে, ও কিন্তু ভালোই পড়াশোনা করছে।" এই বলে তিনি আবার মার্গির মাথা চাপড়ে দিয়েছিলেন।

মার্গি খুবই হতাশ হয়েছিল। ও ভেবেছিল উনি ওর টিচারকে একেবারে নিয়ে চলে যাবেন। ওরা একবার টমির টিচারকে প্রায় এক মাসের জন্য নিয়ে চলে গেছিল, কারণ সেটার হিস্ট্রি সেক্টর একেবারে খারাপ হয়ে গেছিল।

তাই ও টমিকে জিজ্ঞেস করল, " স্কুল নিয়ে আবার কেউ কেন লিখতে যাবে?"

টমি বেশ বিজ্ঞের মত চাহনি দিল। " কারণ এটা আমাদের মত স্কুল নয় রে বোকা। এটা সেই পুরনো সময়ের স্কুল, যেমন থাকত আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে।" তারপরে খুব গলা খাঁকরে, সাবধানে উচ্চারণ করল, " বহু শতাব্দী আগে।"

মার্গির একটু খারাপ লাগল।" সেই অতদিন আগে কেমন স্কুল হত সেসব তো আমি কিছুই জানি না।" সে পেছন থেকে মুখ বাড়িয়ে টমির কোলে রাখা বইটা খানিকক্ষণ পড়ল। তারপরে বলল, " ওদের দেখছি একজন টিচার থাকত।"

"অবশ্যই ওদের একজন করে টিচার থাকত,কিন্তু সেটা কোনো সাধারণ শিক্ষক না, সে হত একজন মানুষ।"
"একজন মানুষ? একজন মানুষ আবার কী করে টিচার হতে পারে?"
"আরে, উনি সব ছেলেমেয়দের নানারকম বিষয়ে জানাতেন, আর তারপরে তাদের হোমওয়ার্ক করতে দিতেন আর প্রশ্ন করতেন।"
"মানুষ মোটেও অত স্মার্ট হয় না।"
" কেন হবে না। আমার বাবা তো আমার টিচারের মতই সব জানেন।"
"হতেই পারে না। একজন মানুষ একটা টিচারের সমান সব কিছু জানতেই পারে না।"
" আমি বলছি প্রায় ততটাই জানে রে।"

মার্গি আর তর্ক বাড়াতে চাইল না। সে বলল, " আমি মোটেও চাইব না একটা অচেনা লোক বাড়ি এসে আমাকে পড়িয়ে যাক।"

এবারে টমি জোরে হেহে করে হেসে উঠল। "তুই কিছুই জানিস না মার্গি। সেই সময়ে টিচাররা বাড়িতে থাকতেন না। একটা আলাদা বাড়ি হত, আর সব বাচ্চারা সেখানে যেত।"
" আর সব বাচ্চারা একই জিনিস শিখত?"
"হ্যাঁ, যদি তারা সবাই এক বয়সী হত।"
" কিন্তু আমার মা বলেন টিচারকে প্রতিটা ছেলে বা মেয়ের বুদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবহার করা উচিত আর প্রত্যেক বাচ্চাকে আলাদাভাবে শেখাতে হয়।"
" ওই একই হল, কিন্তু সেই সময়ে ওরা এরকম করে পড়াত না। তোর যদি সেটা পছন্দ না হয়, তাহলে তোকে আর এই বইটা পড়তে হবে না।"
"আমি মোটেও বলিনি  যে আমার পছন্দ হয় নি।" তাড়াতাড়ি বলল মার্গি। ও সেই মজার স্কুলগুলোর সম্পর্কে পড়তে চাইছিল।

ওদের অর্ধেকটাও পড়া হয়নি, এমন সময়ে মার্গির মা ডাক দিলেন, " মার্গি ! স্কুল !"
"এখনও সময় হয়নি , মা।" মার্গি চোখ তুলে জানাল।
" এখনই!" মা বললেন, " আর আমার মনে হয় টমিরও সময় হয়ে গেছে।"
"স্কুলের পরে তোর সঙ্গে বাকি বইটা আমায় পড়তে দিবি?" টমিকে জিজ্ঞেস করল মার্গি।
" দেখা যাবে," টমি পাত্তা দিল না। ধুলোমাখা পুরনো বইটাকে বগলে গুঁজে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে চলে গেল সে।

কী মজাই না করত ওরা

মার্গি ক্লাসঘরে গেল। এই ঘরটা ওর শোবার ঘরের ঠিক পাশেই। ওর যান্ত্রিক শিক্ষক চালু করা ছিল, সেটা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। শনি আর রবিবার ছাড়া প্রতিদিন একই সময়ে ওটাকে চালু করা হয়, কারণ মার্গির মা বলেন ছোট্ট মেয়েরা যদি নিয়ম মেনে পড়াশোনা করে তাহলে বেশি ভালো শেখে।

স্ক্রীনে আলো এল, আর যান্ত্রিক শিক্ষক নির্দেশ দিল, " আজ আমরা অংকের ক্লাসে ভগ্নাংশ যোগ করতে শিখব। গতকালের হোমওয়ার্ক সঠিক স্লটে জমা দাও।"

মার্গি একটা দীর্ঘশাস ফেলে নির্দেশ মানল। ও তখন মনে মনে ভাবছিল দাদুর দাদুর ছোট্টবেলার সেইসব পুরনো স্কুলগুলোর কথা। সারা এলাকার সমস্ত বাচ্চারা হইহই, হাসাহাসি করতে করতে স্কুলে পৌঁছাত, এক সঙ্গে ক্লাসে বসত, দিনের শেষে এক সঙ্গে বাড়ি ফিরত। ওরা একইভাবে পড়াশোনা করত, যাতে ওরা দরকারে একে অপরকে হোমওয়ার্কে সাহায্য করতে পারে আর সেসব নিয়ে কথা বলতে পারে।

আর সব টিচাররা মানুষ ছিল...

ওদিকে যান্ত্রিক শিক্ষকের স্ক্রীনের ওপরে ফুটে উঠছিল, " যখন আমরা ১/২ আর ১/৪ যোগ করি..."

মার্গি মনে মনে ভাবছিল,সেই-ই অনেক পুরনো দিনে, বাচ্চারা নিশ্চয় স্কুলে যেতে খুব ভালোবাসত; ভাবছিল কী মজাই না করত ওরা।

( আইজ্যাক আসিমভ-এর The Fun They Had - এর অনুবাদ)

আইজ্যাক আসিমভ ( ০২ জানুয়ারি, ১৯২০ - ০৬ এপ্রিল, ১৯৯২ )

প্রায় বারো বছর বয়স থেকে আইজ্যাক আসিমভ গল্প লিখতেন। আঠেরো বছর বয়সে তিনি একটা গল্প সম্পূর্ণ করে এক প্রকাশকের কাছে নিয়ে যান, আর সেই গল্প তখনই বাতিল হয়। চার মাস পরে, আরও আটবার বাতিল হওয়ার পরে তিনি একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প লেখেন যেটা প্রকাশকের পছন্দ হয় আর ছাপাও হয়। তারপর থেকে তিনি বড়দের আর ছোটদের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক অসংখ্য বই লিখেছেন।

ডঃ আসিমভ সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু তিন বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ক্লাসের পরে নিজের বাবার ক্যান্ডির দোকানে কাজ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মাঝে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে কাজও করেন। তিনি বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। সারা জীবনে তিনি প্রায় পাঁচশোর বেশি বিজ্ঞানভিত্তিক বই লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন।

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা