সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
এস্কিমোদের দেশে

শীতকালটা যাই যাই করেও এখনো পুরোপুরি যায়নি। এই ঠাণ্ডায়, আমরা বরং একটু এস্কিমোদের দেশ থেকে ঘুরে আসি।

'এস্কিমো' নামটা তোমরা অনেকেই শুনেছ। এরা উত্তর মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলে থাকে। বছরের অধিকাংশ সময়েই এই এলাকা বরফে ঢাকা থাকে। এখানে দিন-রাত্রি দেখা যায় মাত্র চার মাস। বাকি আট মাসের চার মাস পুরো দিন। তখন চব্বিশ ঘন্টাই সূর্যের আলো দেখা যায়। আর বাকি চার মাস পুরো রাত্রি। এই সময় বরফ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। নদী, হ্রদ, সমুদ্র জমে একাকার হয়ে যায়। তখন বরফের উপর দিয়ে স্লেজে করে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সহজেই যাতায়াত করা যায়। এখানে কোনো গাছপালা নেই, নেই কোনো সবুজের চিহ্ন। আছে জলে ভেসে বেড়ানো প্রকান্ড প্রকান্ড বরফের পাহাড়, তুষার ঝড় আর রক্ত জমে যাওয়া কনকনে ঠান্ডা। এই বরফের দেশে গরমকাল আসে অল্প সময়ের জন্য। শীতকালই প্রধান। গরমকালে যখন বরফ গলে যায় তখন নদী, হ্রদ ও সমুদ্রের জলে ঢেউ খেলে। সেই জলে সাঁতার কাটে তিমি, সিল ও সিন্ধুঘোটকের সঙ্গে অফুরন্ত মাছ। সমুদ্রের নীল জলে হাজার হাজার ট্রাউট, স্যাল্‌মন্‌ প্রভৃতি মাছের ঝাঁক ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। আর দেখা যায় উত্তর মেরুর অন্যতম আকর্ষণ শ্বেত ভল্লুক। পৃথিবীর আর কোথাও এদের দেখতে পাওয়া যায় না। যেমন দক্ষিণ মেরুর পেঙ্গুইন। এদের অবশ্য আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণের কিছু এলাকায় দেখতে পাওয়া যায়। উত্তর মেরুতে আর আছে বল্গা হরিণ ও নানা প্রজাতির পাখি। যেমন, সি-গাল, কারমান ইত্যাদি। এই জীব বৈচিত্র নিয়ে সেখানে বাস করে এস্কিমোরা। যারা গরমের সময় শিকারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়। এই সময় এরা পশুর চামড়া দিয়ে অস্থায়ী ছাউনি বানিয়ে থাকে।


পুরনো দিনের শিল্পীর আঁকা ইগলু বসতি

আর শীতকালে যখন নদী, হ্রদ, সমুদ্র ইত্যাদির জল জমে শক্ত বরফ হয়ে যায়, সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না, শুধুই রাত তখন এরা বরফ দিয়ে এক ধরনের ঘর বানিয়ে তাতে থাকে। এই ঘরগুলিকে বলা হয় ইগলু। দেখতে অনেকটা উলটো কড়াইয়ের মতো। ইগলু বানাতে এরা দু'ধরনের বরফ ব্যবহার করে। অস্বচ্ছ বরফ দিয়ে দেওয়াল বানায় আর স্বচ্ছ বরফ ব্যবহার করে জানালা বানানোর জন্য। বাইরে যতই ঠান্ডা পড়ুক এই ঘরগুলির ভিতর কিন্তু তত ঠান্ডা হয় না। এছাড়াও সিলের চর্বি জ্বালিয়ে এরা ঘরের ভিতরে আলোর ব্যবস্থা করে। এদের পরনে থাকে পশুর চামড়ার পোষাক। এস্কিমোদের সম্পর্কে এমনই ধারণা বহুকাল ধরে চলে আসছে। সভ্যতা যত এগিয়েছে বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনধারণের মান তত পালটে গেছে। এস্কিমোরা কি এখনও যে তিমিরে ছিল সেখানেই পড়ে আছে? আজও কি তারা চিরতুষার দেশের যাযাবর? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের যেতে হবে উত্তর মেরু বা আর্কটিক সার্কেলে।


ইগলু তৈরির কাজ চলছে

উত্তর গোলার্ধে ৬৬০ দ্রাঘিমাংশ থেকে শুরু হয়েছে উত্তর মেরু। রাতে ধ্রুবতারা যেদিকে দেখা যায় সেদিক বরাবর হাঁটলে এক সময় পৌঁছে যাওয়া যাবে এই উত্তর মেরুতে। আজকাল অবশ্য সেখানে যাওয়া খুব সহজ। হাঁটার দরকার হয় না। হেলিকপ্টারে চেপে খুব সহজে সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়। তবে আড়াইশো-তিনশো বছর আগে এই অঞ্চল ছিল অজানা রহস্যে ঘেরা। কেমন দেখতে জায়গাটা, কারা থাকে সেখানে, কোন পথে গেলে সেখানে পৌঁছানো যাবে— এসব কিছুই জানা ছিল না তখন। দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা বারবার চেষ্টা করেছে সেখানে পৌঁছোতে। কখনো সমুদ্রপথে জাহাজে চেপে, আবার কখনো বরফের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে। এই দুর্গম পথে কেউ ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন, কেউ বা চিরকালের জন্য তুষার রাজ্যে হারিয়ে গেছেন। এখন অবশ্য হারিয়ে যাবার ভয় নেই। পথঘাট সব চেনা। তাই সাহস করে বেরিয়ে পড়তে পারো এস্কিমোদের খোঁজে।

আর্কটিক সার্কেল পৃথিবীকে যেখানে ঘিরে রয়েছে সেখানে এই রেখা বরাবর হাঁটলে এস্কিমোদের দেখা পাওয়া যাবে। এই রেখা বরাবর যে দেশগুলো রয়েছে সেইসব দেশেই এস্কিমোদের বাস। একে ঘিরে আছে গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, আলাস্কা, ফিনল্যান্ড, কানাডা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলি। আর্কটিক সার্কেলের আরও উত্তরে ৮০০ দ্রাঘিমাংশে আছে পোলার সার্কেল। গ্রিনল্যান্ডের উত্তরাংশ পোলার সার্কেলকে স্পর্শ করেছে। এইসব বিভিন্ন দেশে এস্কিমোরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বলে বলা যেতে পারে এস্কিমোদের নিজস্ব কোনো দেশ নেই। অতীতে ছিল কিনা জানা নেই। কারণ এব্যাপারে ইতিহাস নীরব। তবে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত বরফ দেশের এই বাসিন্দারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে কখনো স্থায়ী বসবাস করেছে বলে শোনা যায় না। শিকারের খোঁজে পুরো পরিবার বরফ রাজ্যে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়াত। ফলে আজ যারা গ্রিনল্যান্ডের বাসিন্দা তারাই হয়তো কাল নরওয়ের বাসিন্দা হয়ে যেত।


ইনুইট নারী

এস্কিমোদের মধ্যে অনেক সম্প্রদায় আছে। গ্রিনল্যান্ডে যারা থাকে তাদের বলা হয় 'ইনুইট'। এদের আরো দেখতে পাওয়া যায় উত্তর কানাডার ফাউন্ডল্যান্ডে। কানাডার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের এস্কিমোরা মূলত ডোগ্রিব, লুচো, চিপেউইয়ান এবং ইনুভিয়ালুইত। আলাস্কায় যে এস্কিমোদের দেখতে পাওয়া যায় তারা তাঁনানা কুচিল, কোইউকোন, ইউপিক, আলেউত এবং ইনুইপিয়াত সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এরপর বেরিং স্ট্রেট পাড় হলেই রাশিয়া। বেরিং স্ট্রেটের দক্ষিণাংশে বেরিং সাগর এবং উত্তরাংশে চুক্‌চি সাগর। পেনিনসুলাকে বলে চুক্‌চি পেনিনসুলা আর এই অঞ্চলের এস্কিমোদের বলা হয় চুক্‌চি। রাশিয়ার যে এলাকাগুলি উত্তর মেরুর কাছাকাছি সেইসব এলাকায় বাস করে ইউকাঘির , দল্যান, ইয়াকুট ও নেনেত সপ্রদায়ের এস্কিমোরা। এদের মধ্যে নেনেত এস্কিমোরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। সাইবেরিয়ার উত্তরাংশ থেকে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে এদের দেখতে পাওয়া যায়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উত্তর অংশকে বলা হয় ল্যাপল্যান্ড। এখানকার এস্কিমোরা সামি সম্প্রদায়ভুক্ত। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রায় সব সম্প্রদায়ের এস্কিমোদের বাস আর্কটিক সার্কেল বরাবর। তবে ব্যতিক্রম আইস্‌ল্যান্ড। এই ভূ-খণ্ড আর্কটিক সার্কেল স্পর্শ করলেও এখানে কোনো এস্কিমোদের বসবাস নেই। শোনাযায়, আগেও কোনোদিন ছিল না।


ইনুইট পুরুষ

এক সময় এস্কিমোরা পুরোপুরিই যাযাবর ছিল। শিকার করেই এদের জীবন কাটত। এইসব দুর্গম এলাকায় সে সময় শহুরে মানুষের তেমন যাতায়াত ছিল না। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে উত্তর মেরু যাওয়া এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। এখন আর কষ্ট করে পায়ে হেঁটে বা স্লেজে চেপে সেখানে যেতে হয় না। হেলিকপ্টারে সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। এখন আর অতীতের অভিযাত্রিদের মতো হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। সেখানেও পৌঁছে গেছে বেতার ও মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা। শহুরে মানুষের যাতায়াতও বেড়েছে। ফলে এদের জীবনেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে এরা এখন স্থায়ী বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। পড়াশোনা করে আজকাল অনেকেই শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে। শিকার জীবন ছেড়ে নিজেদের যুক্ত করছে নানা কাজকর্মে ও বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে। যেমন গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭৯ সাল থেকে সেখানকার আভ্যন্তরীন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সবটাই - বিশেষ করে মাছের ব্যবসা, গবাদি পশুর উৎপাদন, আমদানী ও রপ্তানী, বিভিন্ন ধরনের কারখানা ইত্যাদির দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সেখানকার এস্কিমোদের হাতে। গত পঞ্চাশ বছরে এস্কিমোদের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। সেইসঙ্গে উন্নতিও হয়েছে যথেষ্ট। ১৯৭০ সালে গ্রিনল্যান্ডের রাজধানীর নাম ছিল গত্‌স্‌হাভ্‌ (Gotshav)। এস্কিমোরা আন্দোলন করে তাদের পুরোনো এস্কিমো নাম নুউক্‌ (Nuuk) ফিরিয়ে এনেছে। সেখানকার ট্যাক্সির চালক এখন প্রায় সবাই এস্কিমো। এই নিবন্ধের একদম প্রথমে যে ছবিটি দেখা যাচ্ছে, সেটি নুউক্‌ শহরের ছবি।


আলাস্কার এক এস্কিমো পরিবারের ছবি, পুরনো অ্যাল্‌বাম থেকে

আলাস্কা ও কানাডার উত্তরাংশের বিভিন্ন তেলের খনি, পশুচাষ, মাছের ব্যবসা, বনজ ও খনিজ সম্পত্তিতে সেখানকার এস্কিমোদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। বেরিং স্ট্রেটের কাছাকাছি একটি দ্বীপের নাম লিটল ডিও মেডার্স। ভূ-তত্ত্ববিদ্‌দের মতে, অতীতে (প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগে) এখানকার সবকটি দ্বীপ জুড়ে একটাই বিশাল দ্বীপ ছিল। এই লিটল ডিও মেডার্সে তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। দ্বীপের প্রায় সব এস্কিমোরাই তেলের খনিতে কাজ করে। ফলে স্থায়ী বসবাসের সঙ্গে তাদের জীবনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

সাইবেরিয়ার এস্কিমোরা আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে নিজেদের এখনও অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছে। প্রাচীন জীবনধারা বজায় রাখতে এরা বেশি পছন্দ করে। শিকার করা এখনও এদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখানকার এস্কিমোরা দু'দলে বিভক্ত। একদল মাছ ও জলজ জীবজন্তু শিকার করে বেড়ায়। আর অন্য দল জীবনধারণের মূল উৎস রেইন্‌ডিয়ার অর্থাৎ বল্‌গা হরিণ রক্ষণাবেক্ষণ করে তার মাংস, চামড়া ও শিং-এর ব্যবসা করে। এদের মূলত দু'ধরনের ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়— দোলগান ও নেনেত্‌। বল্‌গা হরিণ পালনে সরকার এদের সাহায্য করে থাকে। তাই অনেকেই এখন তুন্দ্রা অঞ্চলে বড় বড় খামার তৈরি করে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। এই অঞ্চলে বিভিন্ন পদার্থের অনেক খনি আছে। বর্তমানে সেখানে অনেক এস্কিমো কাজ করে। এদের ছেলেমেয়েরা এখন অনেকেই স্কুলে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা নিয়ে কেউ কেউ উঁচু পদে চাকরিও করছে। সেইসঙ্গে যাযাবর বা শিকারি জীবন ছেড়ে ধীরে ধীরে স্থায়ী ও নির্বিঘ্নে, শান্তি ও আনন্দে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।


ছবিঃউইকিপিডিয়া

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সহ সভাপতি কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটদের এবং বড় দের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক বহু বই লিখেছেন। বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রপত্রিকা এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত লেখালিখি করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা