সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
 তুষার সঙ্গীতের দুনিয়ায়

সে এক বরফে ঢাকা দেশ। যেদিকে দুচোখ যায়, শুধু দুধ- সাদা বরফ। কোথাও পাথরের মত কঠিণ বরফ, কোথাও বা গুঁড়ো গুঁড়ো সাদা তুষারের পরত। অবশ্যই প্রচন্ড ঠাণ্ডা। তার মধ্যে বরফের তৈরি এক মঞ্চ। সেখানে রাখা আছে নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্র। এই বাদ্যযন্ত্রগুলির বিশেষত্ব কি? এগুলি সমস্ত তৈরি হয়েছে বরফ দিয়ে। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।কঠিণ বরফে তৈরি হার্প, পারকাশন, গিটার, ফিড্‌ল্‌ , হর্ন, এবং আরো অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রগুলি শুধুমাত্র সাজিয়ে রাখার জন্য নয়, সেগুলিকে রীতিমত বাজানো যায়। আর সেইসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের সমাহারে সেজে উঠছে বিশ্বের এক মাত্র আইস মিউজিক ফেস্টিভ্যাল - তুষার সঙ্গীতের উৎসব।

সেই বরফে ঢাকা দেশ হল নরওয়ের হ্যালিংডল উপত্যকায় গেইলো নামের উপনিবেশ, যা মূলতঃ শীতকালের ৭-৮ মাস স্কি করার জায়গা হিসাবে বিখ্যাত। এই গেইলোতেই ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় আইস মিউজিক ফেস্টিভ্যাল।

 তুষার সঙ্গীতের দুনিয়ায়

নরওয়ের বাসিন্দা তেরিয়ে ইসাংসেট (Terje Isungset)-এর মাথায় এই উৎসবের ভাবনা প্রথম আসে । ইসাংসেট প্রায় ২০ বছর ধরে স্ক্যান্ডিনেভিয় সঙ্গীত এবং জ্যাজ সঙ্গীত নিয়ে কাজ করে আসছেন। দ্য আইস ম্যান নামে পরিচিত এই মানুষটি সঙ্গীত নিয়ে নানাধরনের পরীক্ষা -নিরিক্ষায় মেতে থাকতে ভালবাসেন। বহুদিন ধরেই তিনি নরওয়েতে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়, এমন নানাধরণের জিনিষ থেকে সঙ্গীত সৃষ্টি করার চেষ্টা করে আসছেন। বরফ থেকে সঙ্গীত সৃষ্টি করাও তাঁর অনেকদিনের উৎসাহের কাজ। সেই ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি বিশুদ্ধ বরফ থেকে সঙ্গীত সৃষ্টি করা নিয়ে কাজকর্ম করে আসছেন।

কিন্তু একলা তেরিয়ের পক্ষে তো এই অসাধারণ প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে চলা সম্ভব ছিল না । বরফ দিয়ে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে সেই যন্ত্র বাজিয়ে সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করা- সে তো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাহলে এই চ্যালেঞ্জকে সফল করতে হলে তো আরো অনেক সৃষ্টিশীল সাহসীর দরকার হয়, তাই না? যাঁরা সব ধরণের কঠিণ সমস্যাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ঠিক নিজের কাজটা করে ফেলেন। তেরিয়ের সাথে জুটে গেলেন এইরকমের আরো বেশ কিছু মানুষ।তাঁদের মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হলেন পল মেডহাস। তিনি বহুদিন ধরেই গেইলোর পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। আইস মিউজিক ফেস্টিভ্যাল নিয়ে তাঁর সাথেই প্রথম কথা বলেন তেরিয়ে ইসাংসেট। দুজনের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ২০০৬ সালে গেইলোর কাছাকাছি উঁচু পর্বতের ওপর অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আইস মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। তারপর থেকে তাঁর নিজস্ব সংস্থাই শীতের নরওয়েতে এই সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করে থাকেন।

 তুষার সঙ্গীতের দুনিয়ায়

বিল কোভিত্‌জ্‌ চলে এলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট থেকে। বরফের চাঙড় থেকে সমস্ত রকমের বাদ্যযন্ত্রের আকার কেটে বার করাটা তাঁর কাছে কিছুই নয়। কাজের সময়ে তাঁকে দেখা যাবে নানা ধরনের বরফকাটার যন্ত্র নিয়ে। নিয়মিত পরীক্ষা নিরিক্ষা করে প্রায় দশ বছর ধরে তিনি একটু একটু করে আরো নিখুঁত করে তুলছেন তাঁর বরফে তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলিকে।

কিন্তু বরফ দিয়ে বাদ্যযন্ত্র বানাব বললেই তো আর হল না। সমস্ত রকমের বরফ দিয়ে তো আর সবকিছু বানানো যাবে না। সঠিক সময়ে জমাট বাঁধা ঝিল বা জলাশয় থেকে কেটে তুলে আনতে হবে বরফের চাঙড়।সব থেকে ভাল মানের বরফের চাঙড়ের তাপমাত্রা হবে খুব কম, অনেক মাস ধরে সেটা একইরকম থাকতে হবে, যাতে তা দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ খুব পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ হয়। এবং এই ধরণের বরফ খুঁজে বের করতে ওস্তাদ হলেন ইভেন গ্র্যু রিগ। তিনিও প্রথম থেকে তেরিয়ের সাথে কাজ করছেন। ইভেনের কাজ হল, ভাল বরফ পাওয়া যাবে- এইরকম সব গুপ্ত স্থান বা জলাশয় খুঁজে বার করা এবং সেখান থেকে ঠিক সময়ে বরফ আনার ব্যবস্থা করা।

 তুষার সঙ্গীতের দুনিয়ায়

তেরিয়ের সাথে এসে আরো হাত মেলালেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম না করলেই নয়। তর ম্যানে হ্যালিবাকেন হলেন একজন শব্দ প্রকৌশলী, বা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। বরফের বাদ্যযন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা শব্দকে কিভাবে রেকর্ড করা হবে, কতদূরে মাইক্রোফোন থাকলে শব্দ সঠিকভাবে সব দর্শক-শ্রোতা শুনতে পাবেন, সেইসবের হিসাব-নিকাশ-পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে স্থির করা তাঁর কাজ। আরেকজন হলেন আদতে পর্তুগীজ, এখন নরওয়ের বাসিন্দা হেল্ডার নেভেজ। তিনি পেশায় একজন স্থপতি। এতবড় এক সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হবে, সে কি হবে খোলা মাঠে? তার জন্যেও তো চাই ঠিকঠাক এক বরফের তৈরি মঞ্চ, যা হবে আশাপাশের পরিবেশের সাথে মানানসই। সেইরকমই এক মঞ্চ তিনি তৈরি করে দেন প্রথম ২০০৮ সালে। তারপর থেকে তিনি নিত্যনতুন মঞ্চ তৈরি করে চলেছেন এই বিশেষ সঙ্গীত উৎসবের জন্য।

 তুষার সঙ্গীতের দুনিয়ায়

এঁরা ছাড়াও, প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানকে সফল করতে হাজির থাকেন দেশ বিদেশ থেকে আসা অনেক স্বেচ্ছাসেবক। স্পেন, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, হল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল , ইটালি- এই সব দেশ থেকে আসা এই স্বেচ্ছাসেবকেরা নানা ধরণের কাজ করেন- তাঁরা মঞ্চ তৈরি করতে সাহায্য করেন, রান্না-বান্না করেন, অনুষ্ঠানের প্রচারকাজে লেগে পড়েন। প্রতিবছর স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নাম লেখাতে বেশ হুড়োহুড়ি পড়ে যায় কিন্তু উৎসাহীদের মধ্যে।

 তুষার সঙ্গীতের দুনিয়ায়

তারপরে আসে সেই যাদুকরী সন্ধ্যা। পূর্ণ চাঁদের আলোয়, দুধ সাদা বরফের গালিচায়, হুহু বইতে থাকা হিমেল বাতাসের পরশ মেখে, জেগে ওঠে তুষারের বুকের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা সঙ্গীত। ইংরেজি নতুন বছরের শুরুতে, বছরের প্রথম হিমশীতল শুক্লপক্ষে, পর পর কয়েক সন্ধ্যা, গেইলোর আকাশে বাতাসে মূর্ছিত হয় সেই অপার্থিব সঙ্গীত। জলের আরেক নাম জীবন। সেই জমাট বাঁধা জলের বুকে লুকিয়ে ছিল এত কথা, এত সুর- আমাদের জানালেন তেরিয়ে ইসাংসেট আর তাঁর বন্ধুরা। এই অনুষ্ঠান শুধুমাত্র আরেকটা যেকোন সঙ্গীতের অনুষ্ঠান নয়। এ হল শিল্পের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, আর জীবজগতের প্রধাণ সম্পদ- জলের প্রতি এই শিল্পীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

এই উৎসব এখন এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেছে যে আগামি বছরের জন্য টিকিট বিক্রি শুরু হয়ে গেছে এই বছরের শুরু থেকেই। এখন এই উৎসবের সাথে জুড়ে গেছে বহু বাণিজ্যিক সংস্থাও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, বহু দেশে তেরিয়ে ইসাংসেট তাঁর দল নিয়ে তুষার সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করেছেন। ভারতে এসেও অনুষ্ঠান করে গেছেন তিনি।

তুমি যদি এই বিশেষ সঙ্গীত উৎসব সম্পর্কে আরো জানতে চাও, তাহলে ব্রাউজ করে নাও ওদের ওয়েবসাইট। আর ইউটিউবে গিয়ে খুঁজে দেখ আইস মিউজিক ফেস্টিভ্যালের ভিডিও।

 

ছবি ও তথ্যসূত্রঃ

http://www.icemusicfestival.no
http://icemusic.no/
http://isung.no/

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা