অদ্-ভূত প্রতিশোধ
আজ জমিদার চণ্ডীকা চরণ চৌধুরীর পারলৌকিক কাজ – হৈ হৈ ব্যাপার। দুই মেয়ে সপরিবারে এসেছে এ ছাড়াও দূর দূর থেকে আসা অনেক আত্মীয় স্বজনে এত বড় জমিদার বাড়ি একেবারে গম গম করছে। দুপুরে জমিদারির ছয় সাতটা গ্রামের প্রায় হাজার দুয়েক লোক পাত পেড়ে খাবে পাশের মাঠে – সেখানে বিরাট বিরাট সামিয়ানা খাটানো হয়েছে আর একদিকে কলাপাতার ঢাঁই – আশে পাশের গ্রামের কারুর বাড়িতে কলাপাতা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। শ খানেকের উপর গ্রামের লোক বেগার খাটছে মাঠে, রান্নার কাজে। রান্নার বিশাল আয়োজন – সে এক এলাহি ব্যাপার – সারা রাত ধরে হ্যাজাকের আলোতে গ্রামের জনা কুড়ি বৌ ঝি তরকারি কুটে পাহাড় বানিয়েছে আর সেই সাথে জোগালিরা মশলা বেঁটে পরাতের উপর স্তুপ করেছে – এখন পোস্ত বাটা চলছে। কাক ভোর থেকেই রান্না শুরু – জনা দশেক রাঁধুনী বিরাট বিরাট কাঠের উনুনে বড় বড় হাণ্ডা ও কড়াই চাপিয়েছে পোলাও, ফুলকপির কালিয়া, আলু পোস্ত, পায়েস, ইত্যাদি রান্নার জন্য – ওদের সাথে জনা পনের লোক খেটে চলেছে অবিরাম। সবার গলদঘর্ম অবস্থা – রান্না ভালো না হলে কারুর ঘাড়েই মাথা থাকবে না। দুদিন আগে থেকেই মিষ্টি তৈরির ভিয়েন বসেছে তিন চার ধরনের মিষ্টি, দৈ ও বোঁদে বানানোর জন্য তাই দূর শহর থেকে চার পাঁচ জন ময়রা এসেছে এই কাজে মানে ওদের ধরে আনা হয়েছে। বিরাট সব কাঠের পরাতে মিষ্টি ও বোঁদের পাহাড় হয়ে আছে আর শ দুয়েক গাড়িতে দৈ বসানো হয়েছে। জমিদারবাবুর বড় ছেলে কন্দর্প কান্তি চৌধুরী বাবার শেষ কাজ খুবই ধুমধাম করে করছেন যাতে জমিদারির সমস্ত লোক বলে, হয়েছিলো বটে খাওয়া দাওয়া জমিদারবাবুর শ্রাদ্ধে – জীবনে এত ভালো কোথাও খাই নি। জমিদারবাবুর পেয়ারের লেঠেলরা চার দিকে নজর রেখেছে – ওদের ভয়ে রাঁধুনী বা অন্যান্য কাজের লোক তটস্থ – কারুর মুখেই কোন কথা নেই – একটু এদিক ওদিক হলেই ঘাড় থেকে মাথা নেমে যাবে। জমিদারবাবুর দৌলতে এই লেঠেলদের সাত খুন মাপ – পুলিশের মুখ উপযুক্ত দক্ষিণাতে বন্ধই থাকে। অনেককে মেরে বিলের কাদায় পুঁতে দিয়েছে – গ্রামের কারুর টুঁ শব্দ করার উপায় নেই – বাড়ির লোক ভয়ে কাঁদতে পারে নি শ্রাদ্ধ তো দূরে থাক।
ভোর বেলা থেকে জমিদার বাড়ির বিরাট উঠানে সামিয়ানা খাটিয়ে চলেছে শ্রাদ্ধের কাজের আয়োজন – বড় বড় ঝুড়িতে ফুল, মালা আর তার সাথে কলা, আপেল, মুসাম্বি, বেদানা ইত্যাদি নানা রকমের ফল, সুগন্ধী বাসমতি চাল, জমিদারবাবুর পছন্দের সব রকম তরকারি ইত্যাদি – শ্রাদ্ধের দানের জন্য প্রচুর কাপড়, ধুতি ও অন্যান্য জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। শ্রাদ্ধের কাজ করছেন নর নারায়ণ তর্করত্ন মশাই – এই এলাকার সব থেকে বড় পণ্ডিত ও খুবই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ছোট বেলায় নবদ্বীপের টোলে পড়াশুনা করে অনেক বছর বারাণসীতে শাস্ত্র চর্চা করেছেন – বেদ উপনিষদ একেবারে কণ্ঠস্থ। গ্রামে ফিরে এসে নিজের একটা টোল খুলেছেন ওখানে জনা দশেক ছেলে বিনা পারিশ্রমিকে শাস্ত্র পড়ে। খুবই সাধারণ জীবন যাত্রা – কোন রকম অহংকার বা বাহুল্য নেই – বিয়েও করেন নি – স্বপাকেই খান। রোগা ছিপছিপে ফরসা চেহারা, মাথায় বেশ মোটা টিকি – বাকি চুল কামানো, কপালে শ্বেত চন্দনের ফোঁটা – শীত গ্রীষ্ম বারো মাস পরনে সাদা ধুতি আর গায়ে একটা চাদর – সাধারণতঃ খালি পায়ে নয়তো খড়ম পরেই থাকেন তবে দূরে কোথাও যেতে হলে ক্যানভাসের জুতো। জমিদারবাবুর শ্রাদ্ধের কাজটা নিতে ওকে প্রায় বাধ্য করা হয়েছে – জলে থেকে তো আর কুমিরের সাথে বিবাদ করা যায় না – সকালে লেঠেলদের সর্দার নিজে এসে ওকে নিয়ে এসেছে। আজ কাজের জন্য উপবাস করেছেন – একেবারে বাড়ি ফিরে খাবেন। শ্রাদ্ধের কাজটা অবশ্য খুবই নিষ্ঠার সাথেই করছেন – শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো। জমিদারবাবুর প্রেতাত্মার শান্তি ও অক্ষয় স্বর্গ লাভের ব্যবস্থা করে শ্রাদ্ধ শেষ করলেন। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান থেকে কিছুই নেবেন না – শেষে কন্দর্প কান্তি জোর করে এক বিঘা জমি ওর নামে দেবোত্তর করে দেওয়ার দলিলটা ধরিয়ে দিলেন। ওদিকে দুপুর থেকেই মাঠে খাওয়া দাওয়া চলেছে – যত খুশি খাও – পেট পুরে খেয়ে গ্রামের লোকজন ছেলে মেয়েদের হাত ধরে প্রয়াত জমিদারবাবুর জয়ধ্বনি দিতে দিতে বাড়ির পথ ধরেছে সঙ্গে বাড়ির মেয়েদের জন্য খাবারের পোঁটলা। যারা লোভে পড়ে অতিরিক্ত খেয়ে নিয়েছে তারা আশে পাশের গাছের ছায়াতে শুয়ে পড়েছে – হেঁটে বাড়ি ফেরার অবস্থায় নেই। থানার দারোগাবাবু ও সেপাইরা আজ বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত – খাওয়া দাওয়ার পর সবাইকে উপযুক্ত ভেটও দেওয়া হয়েছে।
গোধূলির শেষে অন্ধকার হয়ে আসার মুখে তর্করত্ন মশাই রোওয়ানা দিলেন নিজের গ্রামের দিকে। পথে পেরুতে হয় মস্ত বড় ঠগীর মাঠ – প্রায় মাইল খানেকের উপর চওড়া – পাথরের নুড়ি ভরা রুক্ষ উঁচু নিচু জমি – মাঝে মাঝে বহু পুরাতন বট ও অস্বত্থ গাছ বিরাট বিরাট ঝুরি নামিয়ে অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে – এদিক ওদিক শ্যাওড়া গাছ আর কাঁটা গাছের ঝোপ ঝাড়। মাঠের একধারে বিরাট একটা মজে যাওয়া বিল – শ্যাওড়া ও বাবলা গাছের জন্য ওদিকে যাওয়া প্রায় অসম্ভব – পুরো বিলটাই পচা কাদায় ভরা অনেকটা চোরা বালির মত – কিছু পড়লে ভুস্ ভুস্ করে কোথায় যে তলিয়ে যায় কেউ জানে না। রাত্রে বেলা মাঝে মাঝেই হুঁস হুঁস করে এদিক ওদিক আগুন জ্বলে ওঠে – আশে পাশের গ্রামের লোকের মধ্যে চলতি কথা যে বিলের কাদায় যাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিলো তেনারাই রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়ান। ঠগীদের সময় কেউই প্রাণ নিয়ে এই মাঠ পেরুতে পারতো না – কত লোককে যে মেরে এই বিলে ফেলে দিয়েছিলো তার হিসেব নেই – বড় দল করে দিনের বেলাতেই শুধু লোকে মাঠটা পেরুতো। এখন তো ঠগীদের দিন নেই তবে নামটা রয়ে গিয়েছে আর বদনামটা নানা মুখের গল্পে রং চং মেখে গ্রামের লোকের মনে ভিত গেড়ে নিয়েছে তাই সন্ধ্যের পর কেউই মাঠ পেরুতে সাহস করে না। তর্করত্ন মশাই অবশ্য এসব গল্প একেবারেই বিশ্বাস করেন না তবে সাপ খোপের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয় – বড় বড় কাল কেউটেরা এখানে স্বাধীন ভাবেই ঘোরা ফেরা করে। আজও নিজের মনে শ্রীবিষ্ণুর সন্ধ্যারতির স্লোকটা গাইতে গাইতে হন্হনিয়ে চলেছেন মাঠের ভেতর দিয়ে তবে দৃষ্টি সজাগ রয়েছে বাসুকী নন্দনদের জন্য। হঠাৎ মনে হলো অন্ধকারের মধ্যে ভুঁইফোড়ের মত ওর পাশে কে যেন হাঁটতে শুরু করেছে – কোথা থেকে এলো, কি ভাবে এলো ঠিক হিসেব পেলেন না – তর্করত্ন মশাই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
‘পেন্নাম হই পণ্ডিত মশাই, জমিদার ব্যাটার স্বর্গে যাবার ব্যবস্থা তো করে এলেন – তা ওকে কি স্বর্গে ঢুকতে দেবে? চিত্রগুপ্তের খাতায় অনেক গুলো পাতা তো ওর কীর্তি কাহিনীতে ভরে আছে।’
দোর্দন্ড প্রতাপ জমিদার চণ্ডীকা চরণ চৌধুরী – যার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো – তার নামে এই ভাবে অশ্রদ্ধার সাথে কথা বলা এই প্রথম শুনলেন – লোকটার বুকের পাটা আছে বলতে হবে – কে জানে কোথাকার লোক,
‘শাস্ত্রের যা বিধি সেই ভাবেই আমি করেছি – বাকিটা তো আমার হাতে নেই – ভগবানের যা বিধান সেটা তো হবেই। কেউই তা আটকাতে পারে না।’
‘তা অবশ্য ঠিক – আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত – আপনার কাজ আপনি করে দিয়েছেন। তা পণ্ডিত মশাই, আপনাকে যে একটু কষ্ট করে আমার সাথে যেতে হবে।’
‘এখন? কোথায়?? কেন???’
‘সেটা গেলেই বুঝতে পারবেন – ভয় নেই বেশী দেরি হবে না – আমি আপনাকে বাড়ি পৌছে দেবো।’
নর নারায়ণ এবার বিপাকে পড়লেন – একে তো অন্ধকার মাঠের মধ্যে লোকটা হঠাৎই কোথা থেকে এলো সেটাই চিন্তার বিষয় তার উপর কোথায় যেতে হবে, কেন যেতে হবে কিছুই বলছে না – লোকটার হাব ভাবও যেন কেমন ধরনের – অশরীরি আত্মা নয় তো?
‘দেখো ভাই, আমি সকাল থেকেই অভুক্ত – খুবই পরিশ্রান্ত – বাড়িতে গিয়ে স্বপাকে কিছু না খেলে যে আর চলতেও পারবো না। তাছাড়া বাড়িতে নারায়ণের সন্ধ্যারতিও তো করা হয় নি। তুমি না হয় কাল সকালে আমার বাড়ি এসো – তখন তোমার সাথে চলে আসবো।’
‘মাপ করবেন পণ্ডিত মশাই, সকালে যে আমি আসিতে পারবো না। এক কাজ করা যাক – এখন রাত তো বিশেষ হয় নি – আপনি বাড়ি গিয়ে পূজা আর্চা, খাওয়া দাওয়া করে নিন – তারপর আমি আপনাকে নিয়ে আসবো।’
নর নারায়ণ বুঝলেন এ ছাড়ার পাত্র নয় আর কি এমন দরকারি কাজ যে রাত্রে বেলাতেই যেতে হবে? ব্যাপারটা খুবই ঘোরালো মনে হচ্ছে – বেঘোরে প্রাণটা না গেলেই হয় তবে খুবই নম্র ভাবে কথা বলছে এই যা ভরসা।
‘ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছে মতই হবে।’
নর নারায়ণ বাড়ির কাছে আসতেই লোকটা হঠাৎ কোথায় যেন উবে গেলো।
সারা দিন অনিচ্ছার সাথে শ্রাদ্ধের কাজ করার পর নিজেকে কেমন যেন ক্লেদাক্ত মনে হচ্ছিলো – সোজা পুকুরে ডুব দিয়ে ভালো করে স্নান করে নিলেন তারপর নারায়ণের সন্ধ্যারতি করে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে বেশ সময় লাগলো – ভাবলেন দেরি দেখে হয়তো ব্যাটা চলে গিয়েছে। বাড়ির বাইরে আসতেই দেখেন লোকটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে,
‘চলুন পণ্ডিত মশাই, মাঠের পাশেই আপনার জন্য পালকি রাখা আছে।’
মাঠের কাছে এসে দেখতে পেলেন বট গাছের নিচে একটা চার বেহারার পালকি দাঁড়িয়ে কিন্ত আশে পাশে কোন পালকি-বেয়ারা নেই। এবার নর নারায়ণের ভয় হলো – সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন ভৌতিক। সাহস করে বললেন,
‘তোমার পরিচয় না দিলে বাপু তোমার সাথে যাওয়া তো সম্ভব নয়। তুমি কে? কোথা থেকে আসছো? কোথায় যেতে হবে? এর কিছুই তো বলো নি – তুমি যদি আমার প্রাণটা নিতে চাও আমার আপত্তি নেই – এই ত্রিসংসারে আমার কেউ নেই কিন্তু বিস্তারিত না জেনে আমি আর এগুচ্ছি না।’
‘ছিঃ ছিঃ পণ্ডিত মশাই, আপনি সবার পরম শ্রদ্ধার পাত্র – এসব কথা ভাবলেও পাপ। আপনি ভয় পাবেন বলেই এত সময় আমার পরিচয় দেই নি। আমার নাম ছিলো পরান – অনেকদিন আগে খাজনার টাকা সময় মত দিতে না পারায় জমিদারবাবুর লেঠেলরা পিটিয়ে আধমরা করে এই বিলের কাদায় ফেলে দিয়েছিলো আর আমিও ভুস্ করে নিচে তলিয়ে গেলাম। এখন বুঝতেই পারছেন আমি জীবিত মানুষ নই তবে ভয় পাবেন না – আপনাকে সুস্থ শরীরে বাড়ি পৌছে দেবার দায়িত্ব আমার। আপনার সাথে আমাদের একটু আলোচনা আছে – একটু তাড়াতাড়ি করুন – জানেনই তো দিনের আলোতে আমরা বেরুতে পারি না।’
নর নারায়ণ বুঝলেন ওঁর ধারনাই ঠিক – এ তো প্রেতাত্মা আর নিয়ে যাবে আরো অনেক প্রেতাত্মার সাথে আলোচনা করাতে। শরীরটা শিউরে উঠলেও ভাবলেন যা হবার তা তো হবেই – ভবিতব্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো – বাড়ি পৌছে দেবার কথা যখন দিয়েছে তখন দেখাই যাক। পালকিতে উঠে বসতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেলো তারপর ওটা ভীষণ জোরে চলতে শুরু করলো যেন চারটে ঘোড়া পালকিটাকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। হয়তো পরানের মতই আরো কিছু ছায়া পালকিটাকে নিয়ে চলেছে তবে কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বোঝা গেলো না। একটু পরে পালকিটা দাঁড়িয়ে পড়তে দরজা খুলে গেলো,
‘আসুন পণ্ডিত মশাই আমরা পৌছে গিয়েছি।’
পালকি থেকে বেরিয়ে নর নারায়ণ দেখলেন বিলের ধারে একটা খোলা জায়গাতে এসেছেন – চারদিকে পরানের মত অনেক ছায়ার ভিড় আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়াকে দেখিয়ে পরান বললো,
‘পণ্ডিত মশাই, ইনি হলেন ভূতনাথ – অনেক বছর আগে এই গ্রামের মোড়ল ছিলেন। অহেতুক খাজনা বাড়ানোতে জমিদারের কাছে প্রতিবাদ করে নতুন খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন। লাভের লাভ হলো এক রাত্রে ওর বাড়িতে লেঠেলরা আগুন ধরিয়ে দেয় আর সেই আগুনে পুড়ে ওর ছেলে মেয়ে ও স্ত্রী মারা যান আর ওর আধ পোড়া শরীরের জায়গা হয় এই বিলের কাদায়। এখানে যাদের দেখছেন সবাই আশে পাশের গ্রামের বাসিন্দা ছিলো কিন্ত লেঠেলদের দয়ায় এদের ঠাঁই মিলেছিলো এই বিলের চোরা কাদায়। অপঘাতে মৃত্যু ও ভয়ে শেষ কৃত্য কেউ করে নি বলে এই ভূত জন্ম থেকে আমাদের তো আর উদ্ধার নেই। কন্দর্প কান্তি তো বাপের উপর দিয়ে যায় আর ওর বৌ একেবারে যোগ্য সহধর্মিনী – বাড়িতে ঝি চাকরদের তো পান থেকে চুন খসার উপায় নেই – একটু এদিক ওদিক হলেই চাবকে পিঠের ঝাল চামড়া তুলে দেয় আর আধমরাদের লেঠেল দিয়ে এই বিলে পাঠিয়ে দেয়। এই অত্যাচারের একটা বিহিতের জন্য আজ আপনাকে এখানে কষ্ট দিয়ে নিয়ে এসেছি যাতে ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে এই ভাবে বিনা কারনে লেঠেলদের হাতে মরতে না হয় আর আশে পাশের সব গ্রামের লোক যেন সুখে সাচ্ছ্যন্দে বেঁচে বর্তে থাকতে পারে। আমরা সব চাষা ভূষো ছিলাম – আমাদের বুদ্ধিতে এই সমস্যার কোন সমাধান পাচ্ছি না।’
মানুষ যে কতটা অত্যাচারি হতে পারে তার কোন ধারনা নর নারায়ণের ছিলো না – আজ এক সাথে এত ঘটনা শুনে আর সেই অত্যাচারের ভুক্তভোগী এত প্রেতাত্মাদের দেখে মনে হলো মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। নর নারায়ণ নিজেকে সামলালেন – মাথা গরম করে কিছু করা যাবে না। গ্রামের লোকজনকে দিয়েও হবে না কারণ অত্যাচারের ভয়ে কেউই এগিয়ে আসবে না আর সরকারের আইন আদালতের সাহায্য চেয়েও কোন লাভ নেই – সবই জমিদারের হাতের মুঠোয়। ছায়ারা অনেক আশা নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে – ওদের কাছে নর নারায়ণ হচ্ছেন এক মাত্র সহায়। মাথা নিচু করে অনেক ক্ষণ ভেবে ধীরে ধীরে বললেন,
‘দেখো, আমি ব্রাহ্মণ – হিংসা বা খুন জখম আমার চিন্তায় আনাও পাপ। তবে চাণক্যও ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর জনতার স্বার্থে তিনিও কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমার মনে হয় এর ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে – আর কোন উপায় নেই। তোমাদের তো ভয়ের কোন কারণ নেই – নতুন করে আর কোন ক্ষতি তো কেউ করতে পারবে না। প্রথমে লেঠেলগুলোর ব্যবস্থা করো – ওরাই জমিদারের প্রধান শক্তি – ওদের এক এক করে তুলে এনে এখানে বেঁধে রাখো আর এমন ভয় দেখাও যে বাছাধনদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় – লেঠেলদের সর্দারকে সব থেকে আগে তুলবে।’
এর মধ্যে কোথা থেকে একটা ছায়া দৌড়ে এসে পরানকে বললো,
‘পরানদা, এক্ষুনি একজন রাঁধুনীকে লেঠেলরা ওপাশে বিলের কাদায় ফেলে দিয়েছে – বেচারির দোষ হলো পায়েসে মিষ্টি কেন কম হয়েছে।’
‘নাঃ, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না – আজ থেকেই তোমরা কাজ শুরু করে দাও। সব কটা লেঠেল যেন আজ রাত্রেই এখানে চলে আসে – তারপর জলবিছুটির ডাল দিয়ে ওদের আচ্ছা করে চাবকাবে। আগামী কাল রাত্রে এরপর কি করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।’
পর দিন সকালে সব কটা গ্রামে হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছে – একজন লেঠেলকেও পাওয়া যাচ্ছে না – এমন কি লেঠেলদের সর্দারও নেই। কন্দর্প কান্তি পেয়াদাদের সাথে বন্দুক নিয়ে চার দিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন – হুমকি দিয়েছেন আজকের মধ্যে লেঠেলদের বের করতে না পারলে গ্রাম কে গ্রাম পুড়িয়ে দেবেন। গ্রামের লোকেরা ভয়ে দরজা বন্ধ করে হরিনাম জপছে। নর নারায়ণ মনে মনে হাসলেন – ওষুধ ধরেছে – এবার দ্বিতীয় পর্বের শুরু। সেদিন সন্ধ্যের পর নর নারায়ণকে পালকিতে করে পরান বিলের ধারে নিয়ে এলে নর নারায়ণ আশে পাশে কোথাও লেঠেলদের দেখতে পেলেন না তবে দূর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ শুনতে পেয়ে পরানের দিকে তাকাতে পরান হাসলো,
‘পণ্ডিত মশাই, আপনার কথা আমাদের মনে সাহস জুগিয়েছে – মনে হচ্ছে অনেক দিন আগেই এটা করা উচিত ছিলো। লেঠেল ব্যাটাদের তুলে আনতে কোন অসুবিধা হয় নি – সব কটাকে উড়িয়ে নিয়ে বিলের মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে – ওখান থেকে কোন জ্যান্ত মানুষ চার দিকের চোরা কাদা পেরিয়ে জীবনেও এ পাড়ে আসতে পারবে না। আমাদের কয়েকজন জলবিছুটির চাবুক মেরে ওদের নাচ খুব উপভোগ করছে।’
‘ঠিক আছে, এবার দ্বিতীয় পর্ব। আজ রাতেই তোমরা ওই জমিদার বাড়িতে ঢিল পাটকেল মারতে শুরু করো তবে কাউকে প্রাণে মারবে না আর কোন বাচ্চা বা মেয়েদের যেন কিছু না হয়। বাড়ির ভেতরে ও বাইরে বিলের পচা কাদাতে বাড়ি যেন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় আর কন্দর্প কান্তিকে বিশেষ যত্নে ওর সাধের লেঠেলদের কাছে পৌছে দিও।’
মাঝ রাতে জমিদার বাড়িতে প্রচণ্ড গণ্ডগোল শুরু – চারদিক থেকে ইট পাটকেল পড়তে শুরু করেছে। দারোয়ানরা গেটের পাশে খাটিয়াতে ঘুমাচ্ছিলো – ওদের গোঁফ, টিকি আর চুলের মুঠো ধরে উঠিয়ে কারা যেন সমস্ত মুখে গায়ে পচা গোবর আর কাদা মাখিয়ে দিলো। দুর্গন্ধের চোটে ওরা দৌড়ালো পুকুরের ডুব দিতে – পুকুরে নামতেই শুরু হয়ে গেলো চোবানো – হাস্ফাস্ করে জল থেকে মাথা তুললেই আবার জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে – প্রায় আধ মরা অবস্থায় ছাড়া পেয়ে পুকুরের জলে পেট ফুলিয়ে কোন রকমে পাড়ে উঠে ওখানেই ওরা পড়ে রইলো। চেঁচামেচি শুনে পেয়াদারা বন্দুক নিয়ে ঘরের বাইরে এসে কিছুই দেখতে না পেয়ে ভয়ে এলো পাথারি গুলি চালাতে শুরু করতে হঠাৎ বন্দুকগুলো ওদের হাত থেকে বেরিয়ে উড়ে পুকুরের জলে ডুবে গেলো আর কারা যেন ওদের ধুতি লুঙ্গি টান দিয়ে খুলে হাওয়াতে ভাসিয়ে দিলো। পেয়াদারা প্রাণের ভয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে যেতেই কারা ওদের পেছনে জলবিছুটির চাবুক মারতে মারতে গ্রামের বাইরে বের করে দিলো। এর মধ্যে সবাই হতবাক হয়ে দেখলো কন্দর্প কান্তি হাওয়াতে ভেসে চলেছেন আর আগে আগে ওর সিল্কের লাল লুঙ্গি পতাকার মত চলেছে – রাতের অন্ধকারে কন্দর্প কান্তি কোথায় হারিয়ে গেলেন কেউ জানলো না। এদিকে বাড়ির সমস্ত দরজা জানালা ভেঙ্গে প্রত্যেকটা ঘরের জিনিষ পত্রের একেবারে লণ্ড ভণ্ড অবস্থা – পচা গোবর, কাদা আর আবর্জনাতে বাড়ি ভরে গিয়েছে – দুর্গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না। রান্না ঘরের সমস্ত বাসন কোসন পুকুরের জলে ডুবে গেলো – উনুন ও অন্যান্য জিনিষ ভেঙ্গে একাকার অবস্থা। জামা, কাপড়, বিছানা, ইত্যাদির ছেঁড়া টুকরো বাগানের গাছে ঝুলছে। বাচ্চারা ও মেয়েরা ভয়ে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে তবে এর মধ্যে জমিদার গিন্নীর বিলাপই সব থেকে বেশী। আধ ঘন্টা খানেক তাণ্ডব চলার পর হঠাৎ সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলো যেন কাল বৈশাখির ঝড় থেমে যাওয়ার ঠিক পরের অবস্থা। ঝি চাকররা সব ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে – বাড়ির বাকি লোকজন রাতটা বাইরের মাঠে বসে কাটালো। গোলমাল শুনে গ্রামের লোকেরা সব বেরিয়ে এসেছিলো কিন্তু ভয়ে দূর থেকেই দেখেছে – কাছে আসার সাহস কারুরই হয় নি।
ভোরের আগেই দারোয়ানরা পুকুর পাড় থেকে কোন রকমে উঠে পালিয়ে গেলো নিজেদের বাড়ি আড়া ছাপড়ার দিকে – এত বড় বাড়ি একেবারে শুনশান। সকাল বেলাতেই চণ্ডীকা চরণের মেয়েরা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা এক কাপড়ে রওয়ানা দিলো নিজেদের বাড়ির দিকে – টাকা পয়সা, সোনা দানা, কাপড় চোপড় সবই রয়ে গেলো বাড়ির ভেতরে পচা কাদা ও গোবরে মাখামাখি হয়ে। শুধু জমিদার গিন্নী একা বুক চাপড়ে কেঁদে গেলেন সারা দিন – ওকে সান্তনা দেওয়ারও কেউ রইলো না। বিকেলের দিকে নর নারায়ণ হাজির হলেন গ্রামে যেন এই মাত্র খবর পেয়েছেন। ওকে দেখে গ্রামের লোক ঘিরে ধরেছে – হাজার প্রশ্ন চার দিক থেকে। নর নারায়ণ ধীরে ধীরে বললেন,
‘সবই ভগবানের বিচার – বোধ হয় পাপের পাল্লা বেশী ভারি হয়ে যাওয়াতে স্বয়ং মহাদেব নিজের চেলা চামুণ্ডাদের পাঠিয়েছিলেন শাস্তি দেওয়ার জন্য না হলে এরকম ঘটনা তো ঘটতে পারে না। আমার মনে হয় কারুরই ও বাড়িতে ঢোকা আর উচিত হবে না।’
গ্রামের সাধারণ মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করে নিলো পণ্ডিত মশাইর কথা। বয়স্ক লোকেরা মাথা নেড়ে বললো,
‘পণ্ডিত মশাই সর্বজ্ঞ – উনি ঠিকই বলেছেন – এ রকম ভূতের নেত্যর কথা তো আমরা বাপের জন্মেও শুনি নি। ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় আমরা আর যাচ্ছি না।’
সেদিন রাত্রে বিলের ধারে আবার জমায়েত – ছায়ারা সবাই ভীষণ খুশি – ওদের আনন্দ দেখবার মত – অনেকে তো চারদিকে নেচে বেড়াচ্ছে। নর নারায়ণ সবাইকে থামিয়ে দিলেন।
‘এবার সব থেকে দরকারি কাজ – আমি ভূতনাথকে অনুরোধ করবো জমিদারির সমস্ত গ্রামে অরাজকতা শুরু হবার আগেই এক জন করে মোড়ল ঠিক করে দিতে – নাম পরিচয় জানালে আমি নিজে প্রত্যেকটা গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে মোড়ল নির্বাচন করে দেবো। জমিদার বাড়িতে যত টাকা পয়সা, সোনা দানা চার দিকে ছড়িয়ে আছে সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করে সিন্দুকে ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো কিছু সাহসী লোক টাকা পয়সার লোভে ওই বাড়িতে হানা দিতে পারে তাই তোমাদের কয়েকজনকে বাড়ি পাহারার জন্য ওখানে থাকতে হবে। এই সবের বিলি ব্যবস্থা কি ভাবে করা হবে সেটা ভূতনাথের সাথে বসে তোমরাই ঠিক করবে। চণ্ডীকা চরণ যাদের জমি জবর দখল করেছিলো তার সমস্ত দলিল সিন্দুক থেকে বের করে আসল মালিকদের ফেরৎ দিয়ে দাও। গ্রামের যারা এত দিন জমিদারের দালালি করতো ওদের জলবিছুটির কয়েক ঘা দিয়ে ছেড়ে দেবে তার বেশী দরকার হবে না। জমিদার বাড়িও যেন ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয় যাতে কেউ কোন দিনও ওখানে বসবাস করতে না পারে। এই সমস্ত কাজ শেষ হবার পরই তোমাদের ছুটি – পরানের কাছে সব কিছু ভালো ভাবে শেষ হবার খবর পেলে আমি বিশেষ পূজা এবং শ্রাদ্ধ করে তোমাদের সবার এই ভূত জীবন থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করবো।’
ছায়ারা নরনারায়ণের জয়ধ্বনি দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করলো – ওদের সবার মনে এই ভূত জীবন থেকে চিরতরে মুক্তির আশার আলো।
অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অঞ্জন নাথ
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
পটলবাবুর বিজ্ঞানচর্চা
১
কলকাতার রাস্তায়, থুড়ি আকাশে, পুরোদমে উড়ুক্কু ট্যাক্সি চালু হওয়ার পরেই নামল এক মহা বিপদ। এমন একটা বিপদ যা কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি।
প্রথমে যখন সেগুলোকে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছিল, তখন সবাই অবাক। পথচলতি মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে দেখত বৈজ্ঞানিকদের কান্ডকারখানা। গল্পে আড্ডায়, তর্কে বিতর্কে সবার মুখে এই একই কথা। সবাই বলতে লাগল এতদিন পরে ভগবান মুখ তুলে চাইলেন, এই প্রথম কলকাতায় একটা জিনিস চালু হতে চলেছে যা তাক লাগিয়ে দেবে দুনিয়াকে। সাহেবরা যা তৈরী করতে পারল না, তা করে ফেলল বাঙালী। কয়েকদিন এরকম চলার পর অবশেষে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো নতুন ট্যাক্সি। তাতে থাকবে একটা করে নতুন গিয়ার যা রাস্তা থেকে সোজা ওপরে উঠিয়ে নিয়ে যাবে গাড়ি।
লাইন পড়তে শুরু করল। এবার আর ট্রাফিক জ্যামে দাঁড়াতে হবে না, কষ্ট করতে হবে না। কেউ কেউ বলতে লাগল, ওপরটা তো একটু ঠাণ্ডাও। গরমে ঘামতে হবে না, ধুলো মাখতে হবে না। আরো কত কি। কিন্তু আদপে হল উল্টোটা। যে সমস্যাটার কথা কেউই ভাবেন নি।
বিজ্ঞানীরা গাড়িকে ওড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু রাস্তার কথাটা তো আর মাথায় রাখেন নি। আর রাখবেনই বা কেন? আকাশে কোন জিনিস উড়তে গেলে রাস্তার দরকারটাই বা কি। যেমন খুশি উড়ে গেলেই হল। আর সেইখানটাতেই বাধল গোলমাল। হু হু করে উড়ে যাওয়া ট্যাক্সির মধ্যে ধাক্কা লাগতে শুরু করল। ড্রাইভারদেরও কোন দোষ দেওয়া যায় না। তারা তো আর পাইলট নয়, তারা আজীবন গাড়ি চালিয়েছে ধুলোমাখা রাস্তায়। আর প্লেনের মত অগুনতি ট্যাক্সিকে রাডার দিয়ে কোনও নির্দিষ্ট পথে চালানোও সম্ভব নয় -আর সে কথা কেউ আগে ভাবেনও নি। বিজ্ঞানীরা আশ্বাস দিয়েছিলেন, ট্যাক্সির উড়ান সফল হওয়ার পরে ধীরে ধীরে চালু হবে উড়ুক্কু বাস। ধাক্কাধাক্কির বহর দেখে তাঁরা আর এই নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না। সকলেই বলাবলি শুরু করল যে এবার এই ট্যাক্সি বন্ধ না হয়ে যায়।
এদিকে উড়ুক্কু গাড়ির জন্য তো আর সিগন্যালও নেই। মাটিতে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিস যে তা উড়তি গাড়ি সামলাবেন সে গুড়ে বালি। এমনিতেই রাস্তা সামলাতেই হিমশিম। তার ওপরে আবার আকাশে নজর রাখবে কে? ফলে ধাক্কা লাগা যে কমিয়ে আনা যাবে তাও সম্ভব হল না। বিজ্ঞান কাউন্সিলে একজন পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আকাশ থেকে যখন ট্রাফিক সিগনাল দেখা যাচ্ছে না বা মানা যাচ্ছে না, তখন না হয় উড়ুক্কু ট্রাফিক পুলিস বহাল করা হোক। বলাই বাহুল্য, ধাক্কার বহর দেখে কেউ সে দায়িত্ত নিতে রাজি হননি।
শেষটায় অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে উড়ুক্কু ট্যাক্সির মালিকরা নিজেরাই নেমে এলেন মাটিতে। কেউ আর রাজি হলেন না গাড়ি নিয়ে ওপরে উঠতে।
ক্যান্টিনে, রাস্তার মোড়ে, পান দোকানে আবার একরাশ জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে গেল - এবার বৈজ্ঞানিকরা কি করবেন? বাঙালীর গর্বের উড়ুক্কু ট্যাক্সি কি বন্ধ হয়ে গেল? এদিকে পূজো এগিয়ে আসছে। সেজন্য বিশেষ নোটিস জারি হল, যাদের উড়ুক্কু ট্যাক্সি আছে, তারা চাইলেও অক্টোবরের কটা দিন উড়তে পারবেন না।
অনেকে ভেবেছিলেন আকাশ থেকে রঙচঙে প্যান্ডেল গুলো দেখবে। তারা কেবলই হা হুতাশ করতে থাকলেন।
২
রিটায়ার করার পর সকলেই কিছু না কিছু করে। পটলবাবু ঠিক করলেন যে তিনি বিজ্ঞানী হবেন। ছাত্রজীবনে বিজ্ঞানসাধনা করতে চেয়েছিলেন। তখন কেউ পাত্তা দেয়নি। সকলেই চিরকাল তাঁকে অবজ্ঞা করে এসেছে, তাই এইবেলা একটা জবাব না দিলেই নয়। ঠিক করলেন রীতিমত গবেষণাগার গড়ে আবিষ্কার টাবিষ্কার করে সব্বাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন।
পটলবাবু যে এরকম মতলব ফাঁদছেন, এই ব্যাপারটাই কেউ আঁচ করে উঠতে পারেনি। ছেলেমেয়েরা তো নয়ই, নিদেনপক্ষে বউও না। এমনকি অফিসের বা পাড়ার বন্ধু বান্ধবরাও না। করবে কি করে? কেউ তাঁকে কোনদিন সায়েন্স ম্যাগাজিন পড়তে, খবরের কাগজে বিজ্ঞানের পাতা নিয়ে নড়াচড়া করতে বা নিদেনপক্ষে টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে ডিসকভারি কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে এসে থমকে যেতে দেখেনি। সবাই জানে পটলবাবু আর পাঁচটা সুখী, গৃহস্থ লোকের মতই। তাঁর মধ্যে যে সাংঘাতিক বিজ্ঞানস্পৃহা লুকিয়ে আছে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
তো এই পটলবাবু রিটায়ার করলেন। পরদিন সকালে বাল্যকালের বন্ধু গোবিন্দবাবু এসে বললেন, “ওরে, এবার ঘরে বসে কি করবি? কাল থেকে চল মর্নিং ওয়াক করি।” পটলবাবু খুব একটা উচ্চবাচ্য করলেন না।
“কেন রে? মর্নিং ওয়াকটা খারাপ কিসে? ও বুঝেছি। সকালবেলায় ঘুম থেকে ওঠার ভয়? ওতে কোন অসুবিধে নেই, আমি ফোন করে ডেকে দেবোখন।”
পটলবাবু একটু গলা পরিষ্কার করে বললেন - “না মানে ঠিক তা নয়। ভয় পাবো কেন? আসলে এই তো সবে রিটায়ার করলাম। তাড়াহুড়োর কি আছে? কয়েকটা দিন যাক, না হয়-”
“না না, তাড়াহুড়োর দরকার নেই মানে? আমি বলছি অবশ্যই আছে। একশো বার আছে। একবার বাড়িতে বসে আরামের জীবনে অভ্যেস হয়ে গেলে তোর কি অবস্থা দাঁড়াবে ভাবতে পেরেছিস? আমার মতে তোর একটা দিনও দেরী করা চলবে না”
পটলবাবু কিছু বললেন না। চুপ করেই রইলেন। ভাবলেন গোবিন্দ চিরকালই হম্বিতম্বি করে সব ব্যাপারে। ও রিটায়ার করেছে দুমাস আগে। এতদিনে সব ঠিক ঠাক করে ফেলেছে। গোবিন্দবাবু বলে চললেন, “আর হ্যাঁ, শুধু হাঁটতে গেলেই চলবে না। লাফিং ক্লাবে যেতে হবে, ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতে হবে। তারপরে লাইব্রেরীর মিটিং এ যেতে হবে।
পটলবাবু মাথা নেড়ে হুঁ বললেন বটে, কিন্তু ভেতর ভেতর তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন যে এই খপ্পরে পড়লে তাঁর বিজ্ঞানসাধনার ভরাডুবি হবে। সারাদিন হাঁটাহাঁটি, খেলাধুলো, আড্ডা এইসব করলে আর কোন সময় পাওয়া যাবে গুরুত্তপূর্ণ চিন্তার জন্য? নাঃ, ভূতোর কথায় সায় দিলে একদমই চলবে না। গোবিন্দবাবু দুটো শিঙ্গাড়া আর চা সাবাড় করে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে পড়লেন আর বলে গেলেন থ্রি কোয়ার্টারস সাদা প্যান্ট আর গেঞ্জি যোগাড় করে রাখতে। পটলবাবু ভুরু কুঁচকে খানিক ভাবলেন। তারপর বউকে ডেকে বললেন - “হ্যাঁ গো, তুমি বলছিলে না অনেকদিন নাতিকে দেখা হয় না। তা যাও না কয়েকটা দিন বেড়িয়ে এস? আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি।”
৩
দুটো দিন কেটে গেছে।
বেশ খুশী খুশী মনে চিলেকোঠার ঘরটায় এলেন পটলবাবু। পা মচকে গেছে বলে গোবিন্দকেও কয়েকদিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখা গেছে। গিন্নীকেও রওনা করে দিয়েছেন দিল্লীর পথে। রিটার্ন টিকিট কেটে দেওয়া নেই। কাজেই এখন কয়েক দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। নাতিকে পেয়ে প্রতিমা কয়েকটা দিন সুখেই কাটাবেন নিশ্চয়ই। যখন তাঁর ছেলে শ্যামল দিল্লীতে চাকরিটা পেয়ে গেল,তখন একদিক থেকে স্বার্থপরের মত একটু খুশিই হয়েছিলেন পটলবাবু। তারপরে মেয়ে নীলার বিয়েও হয়েছে পুনেতে। এখন বাড়ি ফাঁকা পেয়ে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। চিলেকোঠার ঘরটায় কেউ বড় একটা আসেনা। আসবেই বা কেন? এখানে তো তেমন কিছু নেই। থাকার মধ্যে পুরনো কাঠের একটা আলমারি, একটা চৌকি, একটা ইজিচেয়ার আর পুরনো কাগজ, ম্যাগাজিন এইসব। এই ঘরটাই গবেষনাগার তৈরী করার পক্ষে আদর্শ।
পুরনো কাগজের মধ্যে চাপা পড়ে থাকা একটা খাতা বের করে আনলেন তিনি। ছাত্রজীবনে যা নোটস ছিল তা অনেকদিনই হারিয়েছে। তবে সম্প্রতি নতুন করে প্ল্যান করা শুরু করেছিলেন তিনি। ল্যাব তৈরী করতে খরচ খরচা লাগবে আন্দাজ করে আগে থেকে কিছু টাকাপয়সাও জমা করে রেখেছিলেন। ইজিচেয়ারে বসে নোটসগুলো একটু ঝালিয়ে নিতে শুরু করলেন পটলবাবু। অনেক কিছু লাগবে এখানে। একটা পাথর বসিয়ে তার ওপরে বুনসেন বার্নার, টেস্ট টিউব, বকযন্ত্র, চারকোল এইসব তো লাগবেই। অন্যদিকে থাকবে একটা ব্ল্যাকবোর্ড। আরেক পাশে ড্রয়িং এর ব্যবস্থা। ইলেকট্রনিক্সের ছোটখাট সার্কিট বোর্ড, আইসি, রেসিস্টেন্স, ট্রান্সিটর, এলইডি আরও কত কি। যেমন ভাবা তেমন কাজ শুরু হয়ে গেল। ল্যাবরেটরি হই হই করে গজিয়ে উঠল।
প্রথমে কি নিয়ে কাজ শুরু করবেন একটা ঠিক করতে একটু অসুবিধেয় পড়লেন। একবার ভাবলেন একটা রোবটের প্রোটোটাইপ বানাবেন অর্থাৎ ছোটোখাট একটা মডেল রোবট। তবে রোবট তৈরী তো আর সহজ কথা নয়। যেমন মেকানিক্স বুঝতে হবে, তেমনি ইলেকট্রনিক্স।
ল্যাবরেটরিতে ঢুকলে যে বাবু আর বাবু থাকেন না সেটা প্রথম বুঝতে পারল বাড়ির চাকর খেঁদু। নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। কারো সাথে কথা বলেন না। দেখা করেন না। রাতেও অনেকক্ষন ধরে কাজ করতে থাকেন। শব্দ পাওয়া যায়। তাও আবার এক এক সময় এক এক রকম। কখনও আস্তে, কখনও জোরে। কখনও লোহা ঘষার, কখনো করাতের। আবার কখনো বা হাতুড়ি পেটার। তিনতলার ঘরে আবার একটা চিমনি হয়েছে। তাতে এক এক সময় এক এক রঙের সব ধোঁয়া বেরোতে দেখা যায়। গিন্নীমা নেই। আর খেঁদুর এত সাহস নেই যে সে বাবুকে গিয়ে কিছু বলে। সে কাজে নতুন বহাল হয়েছে। আগের লোকটিকে কেন ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেই নিয়ে তার ঠিক ধারনা নেই। আর গ্রামের বাইরে এই প্রথম সে এসেছে। শহরের গতিক ঠিক এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। এদিকে বাবুর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দাড়ি টাড়ি কামান তো উঠেই গেছে।
ওদিকে বাবুর এক বন্ধু এসে দিনে দুবার করে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা। তার ওপরে বুড়ো বয়সে শরীরের গঠন এক্কেবারে মজবুত। কথা শুনলে হাত পা গুলো যেন সেঁধিয়ে যায় পেটের ভেতরে। বাবু বলে রেখেছেন, যে কেউ এলেই যেন বলা হয় পুনেতে মেয়ের কাছে গেছেন। আর সকলকে তো না হয় সেই কথা শোনান যাচ্ছে, কিন্তু এই একটা লোকের সামনে মিথ্যে বলতেই যেন থরথর করে কেঁপে ওঠে খেঁদু। আর যেখানেই বাঘের ভয়, সেইখানেই সন্ধ্যে হয়। বেলা এগারোটা নাগাদ গোবিন্দবাবু এসে হাজির।
৪
“এই ছোকরা। তোর বাবু কোথায়?”
“আজ্ঞে, আপনাকে যে বললুম গতকাল। উনি তো সেই পুনা না কোথায় গেচেন, অনেক দূর শুনেছি। এর মধ্যেই কি আর ফিরবেন? ”
“বটে, তা তোর বাবু কোন খবর দিয়ে যায় নি কবে ফিরবে?”
“আজ্ঞে না বাবু। কিছু তো বলেন নি। ”
“ বটে!”
খানিক পায়চারি করে বসার ঘরের সোফায় ধুপ করে বসে পড়লেন গোবিন্দবাবু। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ রে, বাবু ক চামচ চিনি খেয়েছেন আজ সকালে?’
“এজ্ঞে, দু চামচ।”
গোবিন্দবাবু এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বাঘের মত চোখ বড় বড় করে বললেন, “তবে রে ব্যাটা। এতক্ষন আমার সঙ্গে চালাকি করছিলিস?”
“এজ্ঞে না বাবু”, খেঁদু তখনও বুঝে উঠতে পারেনি সে কি গোলমালটা করেছে।
গোবিন্দবাবু লাফিয়ে এসে একরকম জামার কলারটাই চেপে ধরলেন, “তবে রে। বুঝতে পারিস নি? তোর বাবু নাকি পুনে গেছে? তো সকালবেলায় কি ভূতের পিঠে চড়ে এসেছিল চা খেতে? আমি তখনই বুঝেছি একটা গড়বড় আছে। এখনও সময় আছে। ভালো চাস তো বল তোর বাবু কোথায় আছে আর কি করছে?”
খেঁদু আর থাকতে পারল না। হেঁচে কেঁদে একটা বৃত্তান্ত সে জাহির করলে। গোবিন্দবাবু খুব মন দিয়ে শুনলেন। তারপর দুদ্দাড় করে উঠে এলেন তিনতলায়। নিচু ছাত। মাথা আর একটু হলেই ছাতে ঠুকে যাবে।
“বলি তোর আক্কেল খানা কি রে? এসব কি?”
পটলবাবু একটা নকশা করছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিকপথে এগোচ্ছিল না। এখন বন্ধুর কাছে ধরা পড়ে গিয়ে একটু লজ্জিতই হয়ে পড়লেন। কি বলবেন কি করছিলেন? গোবিন্দ হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবে। নিরুপায় হয়ে সব কথা স্বীকার করতেই হল।
গোবিন্দবাবু সব শুনলেন। তারপর বললেন, “তা এখন কি নিয়ে গবেষনা হচ্ছে শুনি?”
“কি নিয়ে গবেষণা করব তাই নিয়েই -”
কথাটা শেষ করতে দিলেন না গোবিন্দবাউ, বললেন, “কালকে সকাল পাঁচটায়”
প্রবল অনিচ্ছা সত্তেও দু দিন পর সকালবেলা মর্নিং ওয়াকে বেরোতেই হল পটলবাবুকে। বাড়ি থেকে দু’পা এগিয়ে পার্কের এক কোনে একটা ভাঙা ট্যাক্সি দেখা গেল। নিঃসন্দেহে উড়ুক্কু ট্যাক্সিই হবে। ট্যক্সি ঘিরে লোকের জটলা। এই সক্কালবেলাতেও এমন ধাক্কা লাগবে কেউ কল্পনাতেও ভাবেনি। গোবিন্দবাবু মুচকি হেসে বললেন, “ওহে সায়েন্টিস্ট। এই সমস্যার একটা সমাধান করো দেখি কেমন পারো? মানুষ তো সেই কবে থেকেই পাখি হতে চেয়েছে, পেরেছে কি?”
পটলবাবু প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, “এ জিনিস কি আমি বানিয়েছি নাকি যে সারাবো, তৈরী করেছেন সরকারি বিজ্ঞানীরা, ওরাই বুঝবেন।” তারপর হঠাৎ করে কি মনে হওয়ায় থমকে গেলেন। সত্যিই তো! নিজের ল্যাবরেটরিতে বসে ঘষে মেজে রোবট বানিয়ে কি হবে? এর চেয়ে তো এত বড় সমস্যা রয়েছে হাতের সামনেই। ওদিকে গোবিন্দবাবু হাঁকালেন, “কিরে ব্যাটা এখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফাঁকি দিলে চলবে?”
পটলবাবুও পা চালালেন।
৫
সেই মর্ণিং ওয়াকে গিয়ে গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট দেখার পর দু মাস কেটে গেছে। উড়ুক্কু ট্যাক্সিতে চেপে কলকাতার পুজো প্যান্ডেল আর আলোকসজ্জা দেখতে বেরিয়েছেন দুই বন্ধু। এই সবটাই সম্ভব হয়েছে পটলবাবুর জন্য। এর জন্যই আজ সর্বত্র পটলবাবুর জয়জয়াকার।
“তুই একটা কীর্তি করলি বটে বুড়ো। আমি তো ভেবেছিলাম তোর দ্বারা এসব কিচ্ছু হবে না”
বন্ধুর কথায় মনে মনে সত্যিই বেশ গর্ববোধ করলেন পটলবাবু। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “ওরে বিজ্ঞানটাকে তো কোনদিন ভালোবেসে দেখলি না -যে কোনটা সম্ভব আর কোনটা নয়। তবে তোর কৃতিত্বও কম নয় রে গোবিন্দ। তুই না বললে আমিই কি কখনো এটা নিয়ে ভাবতাম।”
উড়ুক্কু ট্যাক্সি সমস্যার কিরকম সমাধান হতে পারে তা জানিয়ে পটলবাবু একটা চিঠি লিখেছিলেন বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধানকে আর তাতে বলেছিলেন - অনেক প্রাণী, প্রজাপতি, পাখি পৃথিবীর চুম্বকশক্তি অনুভব করতে পারে। তারা যখন দলে দলে কোন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় তখন এই ক্ষমতার প্রয়োগ করে। শহরের এক দিক থেকে অন্যদিকে উড়ে যাওয়া ট্যাক্সিরাও যদি এইভাবে পৃথিবীর চুম্বকশক্তির সাথে নিজের চুম্বকশক্তি সাজিয়ে নিতে পারে, তবে একদিকে উড়ে যাওয়া গাড়িগুলো একই সমতলে থাকবে। আর বেকায়দায় যদি কখনও দুটো গাড়ি সামনা সামনি এসে পড়ে? এ তো সব্বাই জানে যে চুম্বকের সমান মেরু একে অপরকে বিকর্ষণ করে।
বিজ্ঞানীরা সেই চিঠি একবার পড়লেন, দুবার পড়লেন। তারপর বললেন -সত্যিই তো। সঙ্গে সঙ্গে পটলবাবুর ডাক পড়ল। এত তাড়াতাড়ি আর এত সহজে যে এই সমস্যার সমাধান হবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি। কাউন্সিলও যারপরনাই খুশি কারন ট্যাক্সিতে খুব বেশি কিছু বদলাতেও হল না।
আজকে ২০৫০ সালে যে কলকাতার বাঙালি এই প্রথম ট্যাক্সিতে চড়ে দুর্গাপুজো দেখছে, সেসব পটলবাবুর জন্যেই। তবে পটলবাবু ঠিক করেছেন এখানে থামার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আরেকটা চিঠি লিখবেন। কি নিয়ে তাই নিয়েই ভাবনাচিন্তা করছেন। তবে দিনরাত ছুটোছুটি, ব্যাডমিন্টন, লাইব্রেরী এসব সামলানোর পর আর সময় কোথায়।
অভ্র পাল
কলকাতা
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অভ্র পাল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
কুং-ফু প্যান্ডা ২
এবারের ছবির খবরে আমাদের পছন্দের ছবি হল 'কুং-ফু প্যান্ডা ২'। এই ছবি হল ২০০৮ সালে তৈরি অ্যানিমেশন ছবি 'কুং-ফু প্যান্ডা'র দ্বিতীয় পর্ব। তুমি কি কুং-ফু প্যান্ডা দেখেছ? যদি না দেখেও থাক, তাহলেও 'কুং-ফু প্যান্ডা ২' দেখতে কোন অসুবিধা নেই। প্যারামাউন্ট পিকচার্সের নিবেদনে ড্রিমওয়ার্ক্স অ্যানিমেশনের তৈরি এই ছবিতে আছে একেবারে এক আনকোরা গল্প।
গংমেন নগরী
প্রাচীণ চীনদেশে, গংমেন নগরী শাসন করত ময়ূরবংশ। সেই রাজত্বে সবাই খুব আনন্দে ছিল কারণ ময়ূরেরা ঝলমলে আতশবাজী তৈরি করেছিল। কিন্তু ময়ূররাজার ছেলে, শেন, বুঝতে পেরেছিল যে এই আতশবাজীর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অস্ত্র তৈরি করে সারা দেশে শাসন করা যায়। সে একদিন শুনতে পেল রাজার ভবিষ্যতবক্তা ছাগল রাজাকে বলছে যে "সাদা-কালো এক যুদ্ধবাজ" শেন কে একদিন পরাজিত করবে। এই কথা শুনে শেন নিজের সাঙ্গোপাঙ্গোদের দিয়ে প্যান্ডাদের একটা পুরো গ্রাম ধ্বংস করে দিল। তার বাবা মা এই ঘটনায় খুব দুঃখ পেয়ে শেনকে গংমেন নগরী থেকে নির্বাসিত করলেন। শেন এই বলে চলে গেল যে সে প্রতিশোধ নিতে একদিন ফিরে আসবে।
ময়ূর রাজা ও রানী
তিরিশ বছর পরে, পো নামের প্যান্ডা হয়ে উঠেছে কুংফু মাস্টার এবং ড্রাগন ওয়ারিয়র খেতাব পেয়েছে। সে তার পাঁচজন কুংফু বিশেষজ্ঞ সংগীকে নিয়ে শান্তির উপত্যকাকে রক্ষা করে চলে। একদিন একদল নেকড়ে ডাকাতদের থেকে একটা গ্রামকে রক্ষা করতে গিয়ে সে তাদের নেতার বর্মে একটা চিহ্ন দেখে চমকে যায়। তার নিজের মা'কে মনে পড়ে। তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে নেকড়েগুলো পালায়। পো বাড়ি ফিরে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে সে কোথা থেকে এসেছিল।
পো আর তার পালক পিতা
তার বাবা বলেন তিনি তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর রেস্তোঁরার জন্য আসা মূলোর বাক্সে। যেহেতু কেউ তার খোঁজে আসেনি, তাই তিনি তাকে নিজের ছেলে বলে পালন করতে শুরু করেন।
এর পরে, পো এর শিক্ষক শিফু খবর পান যে সুদূর গংমেন শহরে শেন ফিরে এসেছে; সে তার আগ্নেয়াস্ত্র কামান দিয়ে শহরের রক্ষাকর্তাদের একজনকে মেরেও ফেলেছে। গংমেন শহরকে শেনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পো এবং তার পাঁচ বন্ধু যাত্রা করে।
শেন
সেখানে গিয়ে কি হল? পো আর তার সংগীরা কি পরাজিত করতে পারল দুষ্ট শেন কে? আর পো কি খুঁজে পেল তার নিজের আসল পরিচয়? সেটা জানতে হলে দেখে ফেলতে হবে 'কুং ফু প্যান্ডা ২'। অসাধারণ থ্রি-ডি অ্যানিমেশন আর বিভিন্ন চরিত্রে বিখ্যাত অভিনেতাদের স্বরক্ষেপণ এই ছবির এক বিশেষ পাওনা। খুব শিগ্গির এই ছবির ডিভিডি কিনতে পাওয়া যাবে। তখন কিনে দেখতে ভুলো না কিন্তু।
পো এবং তার সঙ্গী টাইগ্রেস
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
আঁকিবুকি
আঁকিবুকি পাতায় রয়েছে ইচ্ছামতীর বন্ধুদের আঁকা ছবি। তুমিও কি আঁকিবুকির পাতায় তোমার আঁকা ছবি দেখতে চাও? তাহলে তোমাড় আঁকা ছবি ইমেল করে পাঠিয়ে দাও ইচ্ছামতীর মেইল ঠিকানায়।
অহনা পাল
ষষ্ঠ শ্রেণী, শ্যামনগর বালিকা বিদ্যালয়, শ্যামনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা
অমিতৌজা ঐশী বসু
দ্বিতীয় শ্রেণী,
ফার্মিংটন উড্স্ ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকালরিয়েট এলিমেন্টারি স্কুল, কেরি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
অর্কদীপ পাল
দ্বিতীয় শ্রেনী, সেন্ট অগাস্টিন স্কুল, শ্যামনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা
চিন্ময়ী ভট্টাচার্যি
প্রথম শ্রেণী, অর্কলন স্কুল, উলানবাতার, মঙ্গোলিয়া
মধুরিমা গোস্বামী
সপ্তম শ্রেণী, দ্য ভবানীপুর গুজরাতি এডুকেশন সোসাইটি স্কুল, কলকাতা
নীলাগ্নি দাস
দ্বিতীয় শ্রেণী, আর্মি পাবলিক স্কুল, গুয়াহাটি
শুভম গোস্বামী
তৃতীয় শ্রেণী, দ্য ভবানীপুর গুজরাতি এডুকেশন সোসাইটি স্কুল, কলকাতা
স্বাগতাশ্রী মুখোপাধ্যায়
নার্সারি ওয়ান, গার্ডেন হাই স্কুল, কলকাতা
সুদীপা কুজুর
চতুর্থ শ্রেণী, বি.ডি. মেমোরিয়াল স্কুল, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সৃজন বিভাগ
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
কলেরা গবেষণায় দুই বাঙালির অবদান
কলেরা এক জীবনঘাতী রোগ। দূষিত জল আর খাবারের মাধ্যমে এই রোগের জীবাণু আমাদের শরীরে ঢোকে এবং অন্ত্রে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করে। জীবাণুকোষে এক ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয় যার প্রভাবে অন্ত্রের দেওয়াল থেকে প্রচুর পরিমাণ জল নিঃসৃত হয়। বিপুল পরিমাণ চাল ধোয়া জলের মত মল রোগীর শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। মলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু আয়ন-ও (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড) বেরিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ঘন ঘন বমি হতে থাকে। রোগী ক্রমশই অবসন্ন ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। শরীরে অতি তীব্র জলাভাব দেখা দেয়। রক্তের তারল্য কমতে থাকে। একটা সময় আসে যখন এত ঘন হয়ে যাওয়া রক্তকে পাম্প করে সারা শরীরের ছড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে আমাদের হৃদযন্ত্রের পক্ষে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়। রোগীর মলের সঙ্গে রোগ জীবাণুও বাইরে বেরিয়ে আসে এবং জলের মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কলেরা মহামারীর আকারে দেখা দেয়। ইতিহাসে, সাহিত্যে কলেরা মহামারীর অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। ২০১০ সালে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যার অনুসারে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হন এবং লক্ষাধিক মানুষ এই রোগে মারা যান।
কলেরার আর এক নাম বিসূচিকা রোগ। আবার ওলাউঠা নামেও এই রোগ পরিচিত। (ওলাঃ মল, উঠাঃ বমি)। এই রোগের প্রকোপ সেই সব জায়গাতেই দেখা যায় যেখানে জীবাণুমুক্ত পানীয় হল পাওয়া যায়না এবং স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই। এদেশে মানুষের মনে কলেরার বিভীষিকাময় প্রভাব ওলাইচণ্ডী, ওলাবিবি এইসব লৌকিক দেবীদের জন্ম দিয়েছে।
জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কখ্ কলেরা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করেন। কিন্তু এই জীবাণু , যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে সেটা ঠিক কিভাবে কাজ করে বহুদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের তা জানা ছিল না। অনেকেই বিশ্বাস করতেন জীবাণু কোষের অভ্যন্তরেই থাকে এই বিষাক্ত পদার্থ। জীবাণুর মাধ্যমেই তা রক্তের সঙ্গে মিশে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া অন্ত্রের দেওয়ালে সে আস্তরণ থাকে তারও ক্ষতি হয় এই বিষাক্ত পদার্থের প্রভাবে। কিন্তু প্রাণীদেহে কলেরার জীবাণু ইঞ্জেকশন করে ঢুকিয়ে কেউই গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে এই রোগ সৃষ্টি করতে পারেন নি।
এ ব্যাপারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করলেন ডাঃ শম্ভুনাথ দে। হুগলি জেলার গড়বাটিতে এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম হয় ১৯১৫ সালে। ব্যক্তিগত স্কলারশিপ আর কিছু ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় তিনি কলকাতা মেডিকাল কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে ডাক্তারি পাশ করেন। এরপর লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হসপিটাল মেডিকাল স্কুলে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি কলকাতা মেডিকাল কলেজের প্যাথলজি ও ব্যাক্টিরিয়লজি বিভাগে যোগ দেন এবং কলেরা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কলেরা সম্বন্ধে বিজ্ঞানী সমাজে সেইসময়ে প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় তাঁর আস্থা ছিল না। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন কলেরা রোগের জীবাণু অন্ত্রের আস্তরণের কোন ক্ষতি করে না। জীবাণু কোষের বাইরে এসে এই জীবাণুনিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থ অন্ত্রের মধ্যেই কাজ করে। এই ধারণা প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রের কিছুটা অংশ ওপর নীচে সুতো দিয়ে বেঁধে, মাঝে ইঞ্জেকশন করে কলেরার জীবাণু ঢুকিয়ে দিলেন। পরদিন দেখা গেল ক্ষুদ্রান্ত্রের ওই অংশ চাল ধোয়া জলের মত তরল পদার্থে (কলেরা রোগীর মলের মত দেখতে) ভরে গেছে। এর পর তিনি গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে কলেরা জীবাণুর বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে কোষ নিঃসৃত তরল পদার্থ খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রে ঢুকিয়ে একই ফল পেলেন। প্রমাণিত হল কলেরার জীবাণু যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে তা এক ধরণের exotoxin(exo:outside) এবং enterotoxin(enteron:intestine বা অন্ত্র)
খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রের অংশবিশেষ বেঁধে (rabbit ilieal loop) তাঁর পরীক্ষা পদ্ধতি জীবাণু বিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি নিজেও এই পদ্ধতির সাহায্যে প্রমাণ করেন আমাদের অন্ত্রে Escherichia coli নামে সে নিরীহ জীবাণু বাস করে তারই এক জাতভাই এক বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে। ঐ জীবাণু এখন Enterotoxigenic E coli নামে পরিচিত।
ডাঃ দিলীপ মহলানবিশ
কলেরা গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন আর এক বাঙালি বিজ্ঞানী। তিনি হলেন ডাঃ দিলীপ মহলানবিশ (জন্ম ১৯৩৪ সাল)। কলেরা রোগীকে বাঁচাতে শিরা দিয়ে স্যালাইন (সোডিয়াম ক্লোরাইডের জলীয় দ্রবণ) ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রক্তে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আয়নের মাত্রা বাড়ে, রক্তের তারল্য বৃদ্ধি পায়। হৃদযন্ত্র সহজেই তা পাম্প করে শরীরে ছড়িয়ে দিতে পারে। রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। ঠিক সময়মত স্যালাইন দিনে না পারলেই রোগী মারা যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় উদবাস্তু শিবিরে ব্যাপক হারে কলেরা দেখা দেয়। কলকাতা থেকে ডাক্তারী পাশ করে এবং ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় শিশু-চিকিতসায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ডঃ মহলানবিশ তখন কলকাতার জন হপকিন্স ইউনিভারসিটি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে এ গবেষণারত। বনগাঁ হাসপাতালে কলেরার মোকাবিলায় তাঁর ডাক পড়ল। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন স্যালাইনের সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। অনেক রোগীর মৃত্যু অনিবার্য। নিজের গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি রোগীদের জলে নুন আর চিনি দিয়ে মিশিয়ে খাওয়াতে লাগলেন। এই পদ্ধতির নাম Oral Redydration Therapy বা ORT. উদরাময় রোগে ভাতের মাড়, নারকোলের জল এসবের উপযোগিতার কথা এর আগে অনেকেই বলেছিলেন। গ্লুকোজের উপস্থিতিতে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আয়ন খাদ্যনালী থেকে শোষিত হয়ে রক্তে মেশে - এই তথ্য জানিয়েছিলেন পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা। কিন্তু শিরার ভেতর দিয়ে স্যালাইন দেওয়ার বহুল প্রচলিত পদ্ধতি বর্জন করে রোগীকে সরাসরি নুন চিনি মেশানো জল খাওয়ানোর ঝুঁকি কেউই নিতে পারেন নি। সঙ্কট মুহূর্তে দিশেহারা না হয়ে ডাঃ মহলানবিশ সেই কাজটাই করে ফেললেন সাহসের সঙ্গে। অবিশ্বাস্য ফল পাওয়া গেল। মৃত্যুর হার নেমে এল শতকরা কুড়ি- ত্রিশ ভাগ থেকে শতকরা তিন ভাগে। এরপরে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যোগ দিয়ে এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিলেন সারা পৃথিবীতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাঁর এই কীর্তিকে miracle cure for an old scourge আখ্যা দিল। বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যান্সেট (The Lancet) ORTকে potentially the most important medical advance of the 20th century বলে ঘোষণা করল। সারা পৃথিবীতে এখন ORT বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। সহকর্মী গবেষকদের সঙ্গে নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন ডাঃ মহলানবিশ।
অতি সামান্য জিনিষ নিয়ে গবেষণা করে যে কত বড় বৈজ্ঞানিক কীর্তি স্থাপন করা যায় তার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন ডাঃ শম্ভুনাথ দে এবং ডাঃ দিলীপ মহলানবিশ। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে ক'জন এঁদের কথা জানে? কথায় বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।
একটা জিনিষ তোমরা মনে রেখ। যদি কোন কারণে পেট খারাপ হয়, ঘন ঘন টয়লেটে যেতে হয়,প্রতিবার টয়লেট থেকে ফিরে নুন চিনি মেশানো জল খাওয়া অবশ্যই দরকার। নুন বা চিনি খাওয়ার ব্যাপারে যাঁদের বিধি নিষধ আছে তাঁদের উচিত এ ব্যাপারে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে জেনে নেওয়া তাঁরা ঐ পরিস্থিতিতে কি করবেন। মোট কথা শরীরে জলের অভাব কিছুতেই হতে দেওয়া চলবে না।
ডঃ মাধব চট্টোপাধ্যায়
সেন্টার ফর সেল্যুলার অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি
হায়দ্রাবাদ, অন্ধ্র প্রদেশ
ছবিঃ
বিভিন্ন ওয়েবসাইট
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ডঃ মাধব চট্টোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত