সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
সবকিছুই সম্ভবঃ জেনিফার-এর গল্প

ছোট্ট মেয়ে জেনিফার। তার বড় বড় কালো চোখের মণি, মাথা ভরতি ঝামুর-ঝুমুর কালো চুল, আর মুখে একগাল হাসি। জেনিফার খেলাধুলো করতে খু-উ-ব ভালোবাসে। তিন বড় দাদার সঙ্গে ট্র্যাম্পোলিনে হুটোপুটি, গাছে চড়া, স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে বল খেলা, সবেতেই জেনিফারের সমান উদ্যম। টিভিতে খেলার অনুষ্ঠান দেখালে জেনিফার মন দিয়ে সব খেলা দেখে। তবে সবথেকে ভালো লাগে জিমন্যাস্টিক্স দেখতে। ১৯৯৬ সালে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া প্রদেশের আটলান্টা শহরে। এই অলিম্পিকে জেনিফারের মন কাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদের অলিম্পিক টিমের এক প্রতিযোগী - চৌদ্দ বছরের ডমিনিক মোচিয়ানু (Dominique Helena Moceanu) ।

১৯৯৬ এর আটলান্টা অলিম্পিকের সম্প্রসারণ টিভিতে দেখতে দেখতে নয় বছরের জেনিফার মুগ্ধ হয়ে ভালোবেসে ফেলে ডমিনিককে। না ভালোবেসে উপায় কী? ইলিনয় প্রদেশের ছোট্ট জনপদ হার্ডিনভিলের দম্পতি, শ্যারন এবং জেরাল্ড ব্রিকারের দত্তক সন্তান জেনিফার। তিন ছেলের পরে একটি মেয়ে চেয়েছিলেন শ্যারন। প্রাণবন্ত ছোট্ট মেয়ে জেনিফারকে তাঁরা দত্তক নেন। কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকেই তাঁরা জেনিফারকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সে তাঁদের দত্তক নেওয়া সন্তান, সে আসলে জন্মসূত্রে পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়ার মানুষ। এবং সেই কারণেই, তার পরিবারের বাকিদের সঙ্গে তার চেহারার মিল নেই। তাই হার্ডিনভিলে বেড়ে ওঠা জেনিফার যখন টিভিতে দেখে জানল যে প্রায় তারই মত দেখতে, কালো চুল কালো চোখের ছোট্টখাট্টো জিমন্যাস্ট ডমিনিক মোচিয়ানু-ও আদতে রোমানিয়ান বাবা-মায়ের সন্তান, তখন ডমিনিকের সম্পর্কে তার কৌতূলহল আর ভালোবাসা অনেক বেড়ে গেল। ডমিনিককে নিজের আইডল মেনে, জেনিফার ঠিক করল, সেও জিমন্যাস্টিক শিখবে।

জেনিফার পাওয়ার টাম্বলিং করা শুরু করল। দশ বছর বয়সেসে জুনিয়র অলিম্পিক্স-এ অংশগ্রহণ করল। আর এগারো বছরের মধ্যে সে হয়ে উঠল পাওয়ার টাম্বলিং-এ ইলিনয় এর স্টেট চ্যাম্পিয়ন।

কেটে গেল কয়েক বছর। কিশোরী জেনিফার একদিন তার মাকে জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি জানো আমার আসল বাবা-মায়ের পদবী কী?" আসলে জেনিফারের আর এক বন্ধুও ছিল দত্তক নেওয়া সন্তান। সেই মেয়ে তার নিজের আসল বাবামায়ের খোঁজ কোনোভাবে জানতে পেরছিল। তাই ষোলো বছর বয়সী জেনিফার নিছক কৌতূহলেই তার মায়ের কাছে জানতে চাইল একই কথা। জেনিফার ভেবেছিল, তার মা হয়ত দুঃখ পাবেন, বা উত্তর নাও দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটল অন্য এক ব্যাপার। মা তাকে কাছে বসিয়ে বললেন, "তুমি তোমার মা-বাবার কাছে থাকলে তোমার পদবী হত মোচিয়ানু।"

মায়ের উত্তরের আসল অর্থ বুঝতে জেনিফারের দেরী হল না। স্তম্ভিত জেনিফার বুঝত পারল, সে আর ডমিনিক মোচিয়ানু আসলে একই পরিবারের মেয়ে! ডমিনিক তার বড় দিদি! শ্যারন আর জেরাল্ড ব্রিকারের কাছে এই তথ্য থাকার কথা নয়, কারণ যেকোনো দত্তক প্রক্রিয়াতে এই ধরনের তথ্য গোপন রাখাই নিয়ম। কিন্তু জেনিফারকে দত্তক নেওয়ার সময়ে পাওয়া কাগজপত্রের মধ্যে কোনোভাবে তাঁর প্রকৃত মা-বাবা নামের উল্লেখ থেকে যায়। ১৯৯৬ সালে যখন ডমিনিক মোচিয়ানু অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছেন, সেই সময়ে তাঁর মা-বাবাকে নামসহ টেলেভিশনের পর্দায় দেখানো হয়। সেই নাম মিলিয়ে শ্যারন আর জেরাল্ড সেই সময় থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, জেনিফার আর ডমিনিক দুই বোন। কিন্তু তাঁরা অপেক্ষা করেছিলেন, জেনিফার যথেষ্ট বড় হয়ে ওঠার আগে তার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে চাননি তাঁরা ।

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে,জেনিফারের মনের মধ্যে যে কতরকমের ঝড় উঠেছিল, আমরা শুধু সেটা আন্দাজই করতে পারি। কিন্তু জেনিফার দিদির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তাড়াহুড়ো করেন নি। আরও চার বছর পরে, জেনিফার নিজের দিদিকে একখানা চিঠি লেখেন। সঙ্গে নিজের কতগুলি ছবি এবং অন্যান্য প্রামাণ্য কাগজপত্র। তিনি দিদিকে জানান, "তুমি আমার জিম্‌ন্যাস্টিক শেখার আইডল। আমি একজন পেশাদার জিমন্যাস্ট। আমার প্রকৃত মা-বাবার পদবী মোচিয়ানু। আমি তোমার বোন। " এই চিঠি লেখার আগে আরও খোঁজ খবর নিয়ে জেনিফার নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন যে তাঁকে তাঁর মা-বাবা সত্যিই দত্তক দিয়েছিলেন।

এইরকম একটা চিঠি পেয়ে ডমিনিক খুবই অবাক হন। চিঠির সঙ্গে ছবিতে যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাঁর নিজের ছোট বোন ক্রিস্টিনার কী ভীষণ মিল! এটা কী করে সম্ভব? জীবনে সত্যি এইরকম রুপকথা বা সিনেমার মত ঘতটা ঘটে নাকি? তাঁর মা-বাবা সত্যিই তার এক বোনকে দত্তক নেওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন? ডমিনিক সরাসরি প্রশ্ন করেন তাঁর মাকে। চোখের জলে ভেসে মা উত্তর দেন - হ্যাঁ।

ডমিনিক-জেনিফার-ক্রিস্টিনার মা ক্যামেলিয়া এবং বাবা দুমিত্রু ছিলেন রোমানিয়ার পেশাদার জিমন্যাস্ট। ১৯৮১ সালে তাঁরা রোমানিয়া থেকে আমেরিকাতে চলে যান। তাঁদের দ্বিতীয় সন্তানটির জন্মের পরে তাঁরা বুঝতে পারেন, এই শিশুর দেখভাল এবং চিকিৎসা করার মত আর্থিক অবস্থা তাঁদের নেই। ক্যামেলিয়ার সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করেই দুমিত্রু শিশুটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য দান করেন।


বোনেদের সঙ্গে জেনিফার ব্রিকার, দাঁড়িয়ে ডমিনিক, বসে বাঁদিকে ক্রিস্টিনা, ডান দিকে জেনিফার

ডমিনিক স্থির করেন তিনি ছোট বোনকে নিয়ে তাঁর এই হারিয়ে যাওয়া মেজ বোনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। এই বিষয়ে কথা বলার জন্য তিনি প্রথমে একটি ফোন করেন। সেই ফোনে দুই বোনে কথা বলতে বলতে জেনিফার এক সময়ে ডমিনিক কে প্রশ্ন করেন, "তুমি নিশ্চয় জানো, আমার দুটো পা নেই?"

 

হ্যাঁ, অ্যাক্রোব্যাট, এরিয়ালিস্ট এবং মোটিভেশনাল স্পিকার জেনিফার ব্রিকারের দুটো পা নেই। তাঁর জন্মের পরে, সন্তানের এই চেহারা দেখেই তাঁরা বাবা শিশুটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য দান করে দেন। জেনিফারকে দত্তক নেন শ্যারন ও জেরাল্ড। ডাক্তারেরা তাঁদের পরামর্শ দেন, বাচ্চাটিকে বালতির মত একটি জিনিষে বসিয়ে ঘুরে বেড়াতে। শ্যারন ও জেরাল্ড প্রথম থেকেই ঠিক করে ফেলেন, এই শিশুটিকে তাঁরা আলাদা করে দেখবেন না, তাকে তার অন্য ধরনের শরীর নিয়ে আলাদা করে সচেতন করে তুলবেন না। তাই ছোট্ট জেনিফার পা ছাড়াই, শুধু হাতের সাহায্যেই চলাফেরা করতে শেখে, গাছে উঠতে শেখে, ট্রাম্পোলিনে লাফাতে শেখে। সে আর পাঁচটা বাচ্চার মত স্কুলে যায়, এবং সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে সফ্‌টবল, ভলিবল, বাস্কেটবল খেলে।বেড়ে ওঠার বছরগুলিতে সে অনেকবারই নকল একজোড়া পা পরে এবং ক্রাচের সাহায্যে হাঁটার কিংবা জন্মদিনে বন্ধুদের সঙ্গে নাচ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নকল পায়ে জেনিফার একেবারেই স্বচ্ছন্দ ছিল না। বরং হাতের সাহায্যে চলাফেরা, খেলাধুলো করেই সে বেশি খুশি ছিল। এইরকম 'স্বাভাবিক'ভাবেই বড় হয়ে ওঠে সে। যখন সে পাওয়ার টাম্বলিং শিখতে শুরু করে এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করে, তখন থেকেই কিন্তু সে একটা বিষয়ে সতর্ক থাকত । তাকে যেন আলাদা করে কোনো সুযোগ দেওয়া না হয়, তার বিচার যেন অন্যদের সঙ্গে সমান নিয়ম মেনেই করা হয়।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন পাওয়ার টাম্বলিং প্রতিযোগিতায় জেনিফার একাধিক খেতাব জেতেন। ২০০৯ সালে ব্রিটনি স্পিয়ার্স এর 'সার্কাস ট্যুর' -এ ফিচার্ড পারফর্মার হিসাবে অংশগ্রহণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে নিজের প্রতিভা প্রদর্শন করেন।

সবকিছুই সম্ভবঃ জেনিফার-এর গল্প
জেনিফার ব্রিকার

জেনিফারের দুটো পা-ই নেই, এই কথা জেনে তুমি যেমন অবাক হচ্ছ, ঠিক তেমনি অবাক হয়েছিলেন তাঁর দিদি ডমিনিক। যে মেয়ে জিমন্যাস্টিক করে, তার পা নেই? এও কি সম্ভব? তাঁর এই হঠাৎ ফিরে পাওয়া বোনের কী অদম্য জীবনীশক্তি! ২০০৮ সালে ডমিনিক আর ক্রিস্টিনার সঙ্গে দেখা হয় জেনিফারের। ক্রিস্টিনার সঙ্গে জেনিফারের চেহারার বড়ই মিল। কিছুক্ষণের মধ্যে বোঝা যায়, তিন বোনের মধ্যে মিল আরও অনেক- একই রকম ভাবে হেসে ওঠা, হাত নাড়া এইরকম নানারকম ছোট্ট ছোট্ট ইঙ্গিতে ধরা দেয় জন্মগত মিল। জেনিফার জানিয়েছেন, দেখা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা একে অপরের সঙ্গে এমন গল্পে মেতে ওঠেন, যে মনেই হয়না তাঁদের সদ্য পরিচয় হয়েছে। কিছুদিন পরে জেনিফার নিজের জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গেও দেখা করেন।

২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে জেনিফারের আত্মজীবনী, 'এভেরিথিং ইজ পসিব্‌ল্‌'। বর্তমানে জেনিফার এরিয়াল ডান্স শিল্পী রূপেও পরিচিত, এবং মোটিভেশন্যাল স্পিকার রূপে বিশ্বের বিভিন্ন আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করেন।

সবকিছুই সম্ভবঃ জেনিফার-এর গল্প
পরিবারের সঙ্গে জেনিফার

জেনিফারের অদম্য মানসিক জোরের পেছনে বিরাট অবদান রয়েছে তাঁর পালক মা এবং বাবার। জেনিফারের দিদি ডমিনিক আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত জিমন্যাস্ট হলেও, তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল একেবারে অন্যরকম ভাবে। সেরা জিমন্যাস্ট হওয়ার তাগিদে ছোট্ট ডমিনিককে অসম্ভব কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে অনেক সময়েই খুব বেশি শাসনে থাকতে হত , সর্বদা অন্যদের সঙ্গে চেহারা বা ক্ষমতা নিয়ে তুলনার মধ্যে থাকতে হত। অন্যদিকে জেনিফার বড় হয়ে উঠেছিল একেবারে অন্য পরিবেশে।তার তিন দাদা - ব্রায়ান, গ্রেগ আর ব্র্যাড-এর সঙ্গে হই-হুল্লোড় করে কাটছিল তার শৈশব। তার বাবা-মা তার কোনো ইচ্ছেতেই বাধা দেন নি। কখনও বলেন্ নি - না , এটা তুমি পারবে না, তুমি বরং অন্য কিছু করো। তাই পা না থাকলেও জেনিফার রোলার স্কেট কিনে হাতে সাহায্যে স্কেটিং করেছে। আবার ইচ্ছে হল নকল পা লাগিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে বন্ধুর হাত ধরে নাচ ও করেছে।

কেমন লাগল, জেনিফার ব্রিকারকে নিয়ে এই গল্প? বিশ্বাস হয় না, তাই না? নীচে একটা ছোট্ট ভিডিওর লিংক দেওয়া রইল। জেনিফার ব্রিকারকে নিয়ে তৈরি ই এস পি এন এর এই ভিডিওটি জেনিফারের এক সংক্ষিপ্ত জীবনী। এই লেখার সঙ্গের ছবিগুলি নেওয়া হয়েছে জেনিফার ব্রিকারের নিজের ওয়েবসাইট থেকে। সেখানে গেলেও তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যাবে।

পড়ার চাপে চুকিয়েছ কি খেলাধুলোর পাট? হোমওয়ার্ক আর প্রোজেক্ট ভরা একঘেয়ে সব রুটিন? পড়ার ফাঁকে 'এক্কা-দোক্কা'- রাত কিম্বা দিন- খেলার খবর নিয়ে এবার এল খোলা মাঠ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা