সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

বর্ষা কালে বৃষ্টিতে ভিজতে পাটুর ভাল লাগে। খুব।
সবাই ঘ্যান ঘ্যান করে বাড়িতে।
মা বলেন, " উফ কী করে শুকোই? এই যা ভারি ভারি প্যান্ট  তোমার  বাবার। তোর ইস্কুলের প্যান্টগুলোই বা শুকোবে কি করে। তার মধ্যে জামাকাপড় এত নোংরা করে আসিস,  পারি না আর। পাগল  হয়ে গেলাম।
সাদা শার্টটার চেহারা দেখেছো ?  ডান দিকের কাঁধটায় সব সময় ঘেমো মুখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুছিস। দেখো  দেখি পাকাপাকি কালো কালো কোঁচকানো দাগই হয়ে গেলো। যত ব্রাশ করো,  সাবান ঘষো,  কিছুতেই উঠতে চায় না। কী করি তোকে নিয়ে বাবা?  ছোট টাওয়েল দিই না কি রোজ পকেটে পুরে ?
ঘরে দু তিন দিনের জামা কাপড় দড়িতে ঝুলছে। আর পারা যায়? "

জেঠিমাদের হাঁটু ব্যথা বাড়ে। চার দিক স্যাঁতসেঁতে বলে নালিশ করেন কেবলই।
কাদা পায়ে বাড়িতে ঢুকে জেঠুরা বেদম বিরক্ত ।
ছোট কাম্মা খুঁজে খুঁজে সিনথেটিক শাড়ি বের করে আর মাকে বলে, " উফ আর পারি না দিদি। রোজ এই ভিজে চুব্বুড় হয়ে যাতায়াত,  ভাল্লাগে বল? সাধের মেকআপ গলে জল। "
মোদ্দা কথা সব্বাই বিরক্ত।
খালি পাটু বাদে। পাটুর কিন্তু ভারি ভাল লাগে।
মেঘলা করে কেমন ছায়া ছায়া হয়ে আসে চারদিক । স্বপ্ন  স্বপ্ন মনে হয় পাটু বাবু অর্চিস্মানের।
বাবা বাড়ি ফিরে ভারি গলায় যেই বলেন, " বহুদূরের অসীম আকাশ আজ বনরাজিনীলা পৃথিবীর শিয়রের কাছে -" পাটু বাবুর ছোট্ট বুকের খাঁচার ভেতর কে যেন দ্রিমি দ্রিমি করে মাদল বাজিয়ে দেয়।  বাবাকে বলে, " চালাও না, বাবি,  চালাও, সেই যে তোমার বর্ষামংগল ক্যাসেটটা।"
" বহুযুগের ওপার হতে" আর " আষাঢ় কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া "  শুনতে শুনতে পাটুর ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু দেবে না কেউ। বাড়ির ছাদে কোন বাচ্ছাকে কেউ কি আর বৃষ্টিতে নাচতে দেয়?
 দেখেছো কখনো ?
দেয় না।
পাটুর মায়ের মত বাচ্চার প্রতি যত্নবতী দায়িত্বশীলা, বাচ্চার মাথাখারাপ করে দেওয়া  ভাল মায়েরা ত বটেই, একটু কম খেয়াল করা মায়েরাও কেউ বাচ্চাকাচ্চাদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় না।
তবে?  কী করে ছোটরা?
যাদের বর্ষা গ্রীষ্ম সর্বদা কলাপের মত নানা রকম দুষ্টু বুদ্ধিদের মেলে ধরতে ইচ্ছে করে?  
তারা তখন পালায় ।
দুভাবে পালায় । এক , ইস্কুলে পালায় । মাকে বলে , আজ ক্লাস টেস্ট আছে , ইম্পোর্টান্ট আনসার লেখাবে আন্টি । যেতেই হবে । যেতেই হবে ।
তারপর ইস্কুলে যত জল জমে , সামনের রাস্তার নোংরা কাদা জল থই থই , তারমধ্যে ছপাস ছপাস করে লাফায় ।
ইস্কুলের সামনের রাস্তায় যেখানে ইস্কুল বাস আর কারপুলের গাড়িরা দাঁড়িয়ে থাকে সেইখানটা এখন নদী । কেউ একটা বল নিয়ে আসে । ব্যস । সবাই মিলে ওয়াটার পোলো খেলার মত সেই কোমর জলে বল নিয়ে দাপাদাপি ।জলে বল পড়লেই চারদিকে কাদা জল ছিটকে ওঠে । দুষ্টু ছেলেমেয়েদের কীইইই আনন্দ । নিজেরা তো ভিজে চান । অন্য লোকেদেরও ভেজাতে পারলে খুশি ।
এই জল ছপ ছপ করার আনন্দটা অবশ্য দিন দুয়েকের বেশি কোন গার্জেনই অ্যালাউ করেন না ।
অগত্যা দু নম্বর পালানোর উপায় ।
পাটু নাকি সুরে সর্দি টেনে নিয়ে বলতে থাকে , বাড়িতে বিশ্রী লাগছে , আমায় দাদাবাড়ি দিয়ে এস । এসো না আ আ ।
মা ভেজা ঘর ভেজা কাপড়জামা সামলাতে সামলাতে অতিষ্ঠ হয়ে দুই কিল দ্যান পিঠে । তারপর  বৃষ্টি একটু ধরলে রিকশা করে দিয়েই আসেন আম্মু দাদাইয়ের কাছে ।
ব্যস । আর পাটুকে পায় কে ?
দাদার বাড়িতে বর্ষা মানেই গরম গরম খিচুড়ি আর ঘিয়ের গন্ধ । ঘরের মধ্যে দাদার লংপ্লেয়িং রেকর্ডে , " হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু ।" আম্মুর সিল্কের কাঁথায় মুড়িশুড়ি দিয়ে দাদার গরম পিঠে হেলান । হাতে লুচিভাজা হওয়া সুকুমার সমগ্র বা হুকাকাশির গোয়েন্দাগিরি ।
সকাল হয় গরম গরম বোর্নভিটা আর গুড ডে বিস্কুটের সঙ্গে ।দাদা তখন সাদা পাতলা কাপপ্লেটে নেসক্যাফে ।পাটুর মাথাকান পেঁচানো নরম মাফলারে । পায়ে মোজা । আর ছোট্ট ছোট্ট রঙ্গিন হাওয়াই চপ্পল । আম্মু ঠাণ্ডা লাগার কোন জায়গা রাখেননা ।
দোতলার তিনদিকে বারান্দা । তার মাথায় ঢালু লাল টুকটুকে টালির বাহার । ঝোলানো বারান্দার নিচের দিকে সারি সারি সাদা পিল্পে । ওপরে মোজাইক করা চওড়া হাত রাখার জায়গা ।সেইখানে মাথা রেখে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়া দেখতে কি আরাম । দাদাই গলা খেলান, " মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে –"
মনটা ভীষণ খুসি হয়ে যায় পটলা- পাটু অর্চিষ্মানের ।

বারান্দায় ঝুঁকে থাকতে থাকতে কত কিছু দেখা যায় । জলের ফোঁটারা কিলবিল করে ছোট ছোট নদীর মত নালায় গিয়ে পড়ছে । জলে চান করে চকচকে হয়ে গেছে নিচের কাঞ্চন গাছের হরতনমার্কা পাতারা , সামনের বাড়ির জবা গাছ ,  পাশে ঋষিদের বাড়ির পাতাবাহার ।মুখোমুখি সেনেদের বাড়িতে চিকরি চিকরি কারিপাতাগুলোর কী আল্লাদে নাচানাচি। ওরাও পাটুর মতই খুশি হয় বৃষ্টি হলে ।
পিংলে , মানে দাদার বাড়ির ধবধবে সাদা  কালো মোটা লেজওয়ালা বিড়ালমশাই জল ভালবাসে না । দোতলায় ওঠার কায়দার ভাঁজ করা সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে পাপোশের ওপর পুঁটলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে । পাটু এদিকে এলে মুখ তুলে হালকা করে বলে 'ম্যাঁও' ।
বুলবুলি , শালিক , এমনকি পেয়ারাগাছের চিড়িকদাস কাঠবেড়ালিও ভিজে যাবার ভয়ে গাছের কোটরে , পাতার তলায় লুকিয়ে পড়েছে ।
হঠাৎ এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে পাটু অবাক হয়ে চেঁচায় , " ও আম্মু এইটা কী গো ? এই যে । বারান্দার হাত রাখার জায়গায় হেঁটে বেড়াচ্ছে --"
দাদা চটি গলিয়ে ঘর থেকে বারান্দায় আসেন ।
" কীরে ভাই ? ওহো ওকে চিনলে না ? তোমার সায়েন্স বইয়ে ছবি আছে যে । ওতো  শামুকবাবাজি । তোমাদের স্নেইল ।বরষায় ওর ভারি ফুর্তি । দেখো নিচের থেকে থাম বেয়ে দোতলা অবধি উঠে এসেছে ।পিঠে ওর খোলের বাড়িটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখছ ? "
পাটু দেখে ।কিন্তু বারান্দার কাছ ছেড়ে দাদার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় ।গিলগিল করে এগিয়ে যাওয়া বস্তুটাকে ভাল লাগে না ।
বারান্দা থেকে ঘরে গিয়ে আস্তে আস্তে ল্যান্ডিংয়ে নেমে যায় পটলবাবু ।পিংলের কাছে দাঁড়ায় । সিঁড়ির নিচে গ্যারাজ । সিঁড়ি থেকে দেখা যায় । ওপরটা খোলা।
এখন গাড়ি নেই । ওটা স্টোর রুম ।
হঠাৎ সেদিক থেকে আওয়াজ আসে , গ্যাঙো গ্যাঙো । একটু চমকে ওঠে পাটু ।
" আম্মু শোনো আওয়াজটা ।"
আম্মু পাটু আর দাদার জন্যে দুধ জ্বাল দিয়ে কিশমিশ ছড়ানো সুজির হালুয়া বানাচ্ছিলেন । কান খাড়া করে বললেন , " ব্যাঙ ডাকছে গোপাল । বৃষ্টি হলে ওদের খুব আনন্দ , তাই গান গাইছে ।"
বৃষ্টি হলেই আনন্দ । বাহ , তবে তো এরা পাটুর দলের লোক । সহমর্মীকে দেখার জন্যে পাটু এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে ।

মাঝামাঝি নেমে  মুন্ডু বাড়িয়ে ঝুঁকতেই কে যেন বলে , " এত উঁকিং ঝুকিং কেন ?"
ভাল করে তাকিয়ে দেখতে পেল মেঝের আলোয় লাফ দিয়ে এসে বসছে শ্যাওলা সবুজ ইয়া ব্বড় গোল গোল চোখওয়ালা ব্যাঙ ।
" পড়োনি বুঝি তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা ? "
পাটু বলে , " সেতো কোলা ব্যাঙের ছা ।"
" ধ্যুং !"
বিরক্ত হয়ে আরেকটা লাফ দেয় ব্যাঙ বাবাজি ।
" এতো আচ্ছা বোকা । ছানারা কি চিরকাল ছানাই থাকবে হেং? তুমি কি গ্যালিস দেওয়া পেন্টুলপরা খোকাই থাকবে চিরকাল ? "
" তুমি জানলে কী করে ?" ভ্যাবাচ্যাকা খায় পটলবাবু – পাটু ।
" হেঁ হেঁ নিচে জবা গাছেরা গোড়ায় তো থাকিং । দেখছি ত এত দিন ধরেং। কারপুলে ওঠাং তো আম্মু ।"
পাটুর ভয়টা কমেছে । নেমে আসে গুড়িগুড়ি ।
" তুমি বুঝি সেই কোলা ব্যাঙয়ের ছা ছিলে ? এখন কি বুড়ো ব্যাঙ ?"
চটে মটে চোখ পিটপিট করে ব্যাঙ বাবাজী ।
" বুড়োং ! কেনং ? মোটেই না । আমি জোয়াং । ওই শোনো আমার গান শুনে ব্যাঙ সুন্দরী সামনের বাড়ির নালা থেকে সাড়া দিচ্ছে । যাই গাং ।"
ওপর থেকে আম্মুর গলা ভেসে আসে ।
" ভাইয়া অন্ধকার সিঁড়িতে কোথায় নামছ ?"
পাটু বলে , " এই আসি । আম্মু ব্যাঙ বেরিয়ে গেল।"
চটি ফটাস ফটাস করে উঠে আসা পাটুকে গরম আদরের ওমে জড়িয়ে নিয়ে তিনটে পাঁচটা চুকুস করেন আম্মু ।
" ব্যাঙ ত ব্যাঙের বাসায় গেল গো ।গাছের তলায় ওর ঘরবাড়ি যে ।জল পেয়ে আল্লাদে গ্যাঙর গ্যাং করছে । "
আর একবার বারান্দার দিকে দৌড়োয় পাটু ।কাছাকাছি এসে রেলিঙে চোখ বোলায়। বসে আছে নাকি শামুক ব্যাটা ? নাহ । দেখা যাচ্ছে না ।
বারান্দা থেকে একটু ঝোঁকে পাটু । ব্যাঙকে দেখা যাচ্ছে কি আর ?
নাতো । গাছের তলায় সাদা সাদা কতগুলো কি ?
আম্মু এসে কাঁধে হাত রাখেন ।
" ঝুঁকো না ভাই ।"
" ও আম্মু , ওইগুলো কি ? গাছের তলায় –"
" ওহো ওইগুলো ব্যাঙের ছাতা গো ।"
" ব্যাঙের ছাতা ? ব্যাঙ কি করবে ছাতা দিয়ে ? "
" কেন বর্ষায় ছাতা মাথায় দিয়ে বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে যাবে । এইটাই ওদের পিকনিক করার সময় তো । চল সোনা , এখানে আর না । জলের ছাঁট লেগে জামা ভিজে গেলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে ।"
আম্মুর সঙ্গে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পিছন ফেরে পাটু।
দেখে গাছের তলায় ব্যাঙ আর তার ব্যাঙানি ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে টাটা করে দিচ্ছে তাকে ।

ছবিঃ মঞ্জিমা মল্লিক

পেশায় চিকিৎসক। বিভিন্ন মুদ্রিত এবং ওয়েব পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। বেশ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক কবিতা ও গল্পের বই।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা