সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
বাড়ির পথে কুহু

কুহুর যখন ঘুম ভাঙ্গলো, সে ভারি অবাক হয়ে দেখলো একটা অন্ধকার মাঠে একলা পড়ে আছে। কিছুক্ষন আগের মেলাভর্তি লোক, বেলুনওয়ালা, ফুচকাওয়ালা, দোকানী আর ওই নাচাগানা করা লোকগুলো কেউ নেই। উঠে বসে গোল গোল চোখ করে চারিদিক খুঁজে কুহু একটা কুকুরও দেখতে পেল না। এই তো সন্ধ্যাবেলা কত আলো জ্বলছিল সারা মাঠ জুড়ে। কত মানুষজন, হইচই, আনন্দের ঝরনায় ভেসে যাচ্ছিল চারিদিক। কিন্তু এখন দেখ মাঠ জুড়ে কি ঘুটঘুটে অন্ধকার!শুধু আকাশে এক গাল হাসি নিয়ে চাঁদবুড়ি বসে আছে। আর তার ফ্যাকাসে আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা মাঠ জুড়ে। আশেপাশের দোকানগুলো, এই কিছুক্ষন আগে অবধিও মানুষে মানুষে ভর্তি ছিল, গমগম করছিল, আর এখনদেখ সব ভারী ভারী গেট আটকে ইয়া বড় বড় তালা দিয়ে বন্ধ করা! আর কোথা থেকে যেন একটা আলো এসে পড়ছে গেটের উপর।মনে হচ্ছে ঐ বিশাল বিশাল লোহার গেটগুলো দৈত্যের মত কুহুকে ঘিরে ধরে রাশি রাশি ধারালো দাঁত বার করে হাসছে।

কুহুর বেজায় কান্না পেল। এমনকি তার চোখে জল চলে এল।এরকম হল কি করে? সে তো সবার সাথে এসেছিল মেলাতে।

তাহলে তাকে একলা ফেলে রেখে সবাই গেল কোথায়? সে বাড়ি যাবে কি করে? মা বাবার কাছে। দিদাই, দাদাই-এর কাছে?

ঠিক তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।

হঠাতই লোহার গেটগুলো ঝনঝন করে হেসে উঠল।সমস্বরে বলে উঠল, "এবার আমরা সবাই মিলে কুহুকে গপ করে গিলে ফেলবো।"প্রথমে কুহু ভেবেছিল সে বোধহয় ভয়ের চোটে ভুল শুনছে। ভালো করে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঝাঁকালো সে। কিন্তু তারপরেও সে শুনলো গেটগুলো খন খন ঝন ঝন করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে।

ভয়ের চোটে কুহুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল । পেটের মধ্যে সন্ধ্যেবেলাকার কুলফি বরফ যেন ডিগবাজী খেতে লাগলো। কানের মধ্যে ভেঁপু বাজতে লাগল ।নাকের ডগাটা শুরশুর করতে লাগল।

বুকের মধ্যে যেন ধরধর করে একটা রেলে ইঞ্জিন চলতে লাগল কুহুর। তারপর খুব ভয় টয় পাওয়া হয়ে গেলে কুহুর হাত পা আবার শক্ত হয়ে উঠল। কানের মধ্যে ভেঁপুর ডাকটা কমল। পেটের ভেতরে কুলফি বরফটাও শান্ত হয়ে বসল। রেল ইঞ্জিনটাও আর দৌড়াচ্ছিল না।

শুধু নাকের ডগাটা থেকে থেকে শুরশুর করছিল।

এমন সময় একটা রিনরিনে গলায় কে যেন বলল, "তোমরা সবাই ওর পিছনে পড়েছো কেন? ও ভালমানুষের মেয়ে বলি কি হয়েছে তোমার ? "

কুহু ভালো করে চোখ মুছে চারদিকেতে তাকাল কে বলল কথাটা দেখার জন্য।

" আমি এখানে গো ভালমানুষের ঝি। "

কুহু দেখল মঞ্চের কাপড়টা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে উড়ে ওকে ডাকছে। কুহু অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতেই নীল রেশমি কাপড়টা দুলে দুলে হেসে বলল – " ওদের কথায় ভয় পেয়োনা গো ভাল মানুষের মেয়ে। ওরা ওরকমই। ওরা তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না। শুধুমুধু ভয় দেখাবে। "

লোহার গেটগুলো ভয়ানক ঝন ঝন করে রাগ দেখাল রেশমী পর্দার কথায় কিন্তু কুহু দেখল ঝনঝন করা ছাড়া ওরা আর কিছুই করতে পারছে না।

কুহু এক ছুটে চলে গেল রেশমী পর্দার কাছে।
" ও পর্দা দিদি, পর্দা দিদি। আমি বাড়ি যাব কি করে? তুমি আমায় বলে দেবে? "
কুহুর কথায় রেশমী পর্দাকে দুঃখিত দেখালো।

সে উড়তে উড়তে কোন মতে বলল, " আমি তো ভাই মেলার বাইরে কোথাও যাইনি আমি কি করে বলব তোমায়। দেখোনা ওরা প্রতিদিন আমাকে যত্ন করে বেঁধে দেয় তাই আমি ঘুমাতে পারি। আর আজ দেখ ওরা আমায় বাঁধতে ভুলে গেছে, অমনি দস্যি হাওয়া আমায় ঠেলা মেরে মেরে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছুতেই ঘুমুতে দিচ্ছে না। "
" আচ্ছা আমি তোমায় বেঁধে দিচ্ছি। " – এই বলে কুহু একটা দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধে ফেলল পর্দা দিদিকে। বাঁধন পড়তেই দিদি শান্ত হয়ে বসল।
" আমি ঠিক জানতাম। তুমি সত্যি খুব ভালো মেয়ে। আচ্ছা শোন ঐ গেটগুলোর মাঝখান দিয়ে সোজা হেঁটে চলে গেলে তুমি দেখবে লাল কাপড়ের আকাশ ছোঁয়া বিশাল তোরণ । ওটাই মেলার বাইরে যাবার পথ। ঐ তোরণের তলা দিয়ে চলে গেলেই তুমি দেখতে পাবে বাইরে একটা ল্যাম্পপোস্ট। তারপরের রাস্তা তুমি ওকেই জিজ্ঞেস করো। আমি শুধু এইটুকুই জানি।"
" কিন্তু দিদি ওইগেটগুলো যে আমায় খেয়ে ফেলবে বলছে।"
কুহু ভয়ে ভয়ে বলল।
" আরে বোকা মেয়ে ওরা শুধু ভয় দেখায়। ওদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। তুমি নির্ভয়ে চলে যাও। " এই না বলে রেশমী নীল পর্দা দিদি টুপ করে ঘুমিয়ে পড়ল।

কুহু ভয়ে ভয়ে তাকাল খন খনে গেটগুলোর দিকে। তারা ওৎ পেতে বসে আছে কুহু কাছে আসবে বলে।কুহু ভয়ে ভয়ে রাস্তায় নামল।দস্যি হাওয়া একপাক ঘুরে কুহুর চুলগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল। কুহুর বুকটা দুর দুর করে উঠল।যেই না ভারী ভারী লোহার গেটগুলো ঝনঝন করে হাসতে শুরু করেছে কুহু অমনি চোখ কান বুঁজে এক দৌড়।

" আরে থামো থামো। " - কে একজন গম্ভীর গলায় কুহুকে থামতে বলল। কুহু হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ খুলে দেখল বিশাল আকাশ ছোঁয়া লাল তোরণের কাছে পৌঁছে গেছে সে।

" চোখ বুজে ওরকম ভাবে কেউ দৌড় দেয় ? পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গবে যে। "- লাল তোরণ গম্ভীর গলায় মিষ্টি করে বকল কুহুকে।
"আমি না খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।"
" ভয় ? ভয়ের কি আছে ? ভয় থেকে দৌড়ে কি পালানো যায়। ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালে দেখবে ভয় নিজেই পালিয়ে গেছে। ওরকম ভাবে আর দৌড়বে না কখনো। ঠিক আছে ? "

তোরণ পেরিয়ে ওপাশের অন্ধকার পথটা দেখে ভয়ে ভয়ে কুহু বলল। - " না না আর কোনদিন এমন করব না তোরণ দাদা। কিন্তু আমি বাড়ি যাব কি করে ? পর্দা দিদি বলেছিল এখানে আলো জ্বলা ল্যাম্পো আছে। সে আমায় সব বলে দেবে। কিন্তু কই আলো তোরণদাদা। "
" আলো জ্বলা ল্যাম্পপোস্ট! আজকে মানুষরা তো ওর আলো জ্বালতেই ভুলে গেছে। ঐ যে দূরে ঝুপসি মত খাড়া আছে। চলে যাও। তবে আলো না জ্বলা অবধি ও কোন কথা বলতে পারবে না।"
"ওরে বাবা ওই অন্ধকারে।" কুহু লাল তোরণের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
" আবারভয়পায়। " ধমকে উঠল লাল তোরণ। "
কিছু নেই ওখানে শুধুই ল্যাম্পপোস্ট একলা খাড়া আছে।কোন ভয় নেই।যাও,গিয়ে ওর আলো জ্বেলে দাও।সারারাত ও কত কথা বলে আমার সাথে।আর আজকে দেখএকা একা সারা রাত মুখ বুজে কাটাতে হবে। তুমি একটু সাহস করলেই আমাকে আর একলা কাটাতে হয় না। "– সারা রাত একলা থাকার দুঃখে লাল তোরণের গলা ধরে এলো। লাল তোরণের দুঃখ দেখে কুহুও তোরণদাদাকে জড়িয়ে ধরে বলল – "দুঃখু করো না তোরণদাদা। আমি গিয়ে আলো জ্বেলে দেব। স্কুল থেকে ফেরার পর যেদিন যেদিন দেখি মা বাড়ি ফিরছে না। বাবাও আসেনা। তখন তো আমিও একলা থাকি। মাত্তর দু এক ঘন্টা একলা থাকতেই আমার কি কষ্ট হয়। আর এতো সারা রাত্তির। তুমি দুঃখু কর না আমি গিয়ে ল্যাম্পোকে জাগিয়ে দিচ্ছি। আর তোমাকে একলা থাকতে হবে না। "

কুহু ভয়ে ভয়ে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কোনমতে ল্যাম্পপোস্টের কাছে গেল। ভয়ে তার হাতের তালু ভিজে গেছে ঘামে। চাঁদবুড়ির ফ্যাকাশে আলোয় কোনরকমে ঠাহর করে সে ল্যাম্পপোস্টের সুইচটা জ্বালাতে গেল। অমনি দস্যি হাওয়া শন শন করে বলে উঠল – " ওকি ? ও কী ! ভেজা হাতে কেউ সুইচ জ্বালে? আগে হাত মুছে নাও জামাতে ভালো করে। "

লক্ষ্মী মেয়ের মত হাত মুছে কুহু লাইটটা জ্বেলে দিল। দস্যি হাওয়া ঠা ঠা করে হাসতে হাসতে নেচে নেচে তোরণকে জড়িয়ে ধরল।

" ধন্যবাদ কুহুদিদি। " – আলো জ্বলা বুড়ো ল্যাম্পপোস্ট খনখনে গলায় আনন্দ আর ধরে না। আসলে সারারাত চুপ করে থাকতে হবে ভেবে তারো খুব দুঃখু হচ্ছিল কি না।

বাড়ির পথে কুহু

" ল্যাম্পোদাদু ল্যাম্পোদাদু। আমার বাড়ি কোনদিকে? পর্দা দিদি বলেছিল তুমি বলে দেবে। "
" তা তো বটেই বটেই। তুমি আমার এতবড় উপকার করলে। আর আমি তোমায় বাড়ির রাস্তা বলবনা? কিন্তু দিদি বাড়িতো এখনো অনেক দূর। আর কত গলিঘুঁজি টপকে ডাইনে বাঁয়ে এঁকে বেঁকে তোমায় যেতে হবে। সে কি তুমি মনে রাখতে পারবে? "
কুহু প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি। " তাহলে কি হবে ল্যাম্পো দাদু? "
"আচ্ছা দাঁড়াও। এই তো আমার কাঁধে দেখি একটা পালক পড়ে আছে। দস্যি হাওয়া এই পালকটা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আর তুমি চাঁদবুড়ীর আলোয় পালকটার পিছনে পিছনে যাবে। তাহলেই তুমি পৌঁছে যাবে বাড়ি।" – এই না বলে ল্যাম্পোদাদুর কাঁধ থেকে টুক করে একটা পালক ঝরে পড়ল। অমনি দস্যি হাওয়া সেটাকে নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে পাক দিয়ে ছুটল। তোরণদাদা আর ল্যাম্পোদাদুকে টা টা করে কুহু দৌড়ল পালকের পিছু পিছু।

পালকটাকে লক্ষ্য রেখে দৌড়তে দৌড়তে কুহু হঠাৎ শোনে কে যেন নাম ধরে ডাকছে তাকে। "এই কুহু, এই কুহু!"- ও মা, এ তো মায়ের গলা! বাড়িতো তাহলে এসেই গেল। আরো জোরে দৌড়তে গিয়ে কুহু একটা বেদম আছাড় খেল। ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে দেখলো, ওমা কোথায় পালক, চাঁদবুড়ী আর দস্যি হাওয়া? ও তো বিছানায় বসে আছে, সকালের আলোতে ঘর একেবারে ভেসে যাচ্ছে। মা বেশ রাগী রাগী গলায় বলছে –"এতো বেলা করে উঠলে স্কুলে যাবি কখন? তাড়াতাড়ি কর।"

কুহু দাঁত মাজতে মাজতে বারান্দায় এলো। অমনি সে দেখতে পেল কালকের সেই পালকটা সেখানে পড়ে আছে। যত্ন করে পালকটা তুলতেই দস্যি হাওয়া হো হো করে হাসতে হাসতে কুহুর চুল এলোমেলো করে দৌড়ে পালাল।


ছবিঃ চান্দ্রেয়ী সেন

অঙ্কিতা স্নাতকস্তরে অঙ্ক এবং পরে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বই পড়তে খুব ভালোবাসেন। বিভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ম কারুশিল্প এবং মূলত কাগজকারুশিল্পে তাঁর বিশেষ দক্ষতা আছে। এসবের পাশাপাশি লেখালিখি তাঁর একটা নেশা। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন আর লিটল্‌ ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা