সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
দুমকার সেই জঙ্গলে

পড়াশুনো শিকেয় তুলে মুমু ল্যাপটপ খুলে বসল। গুগুলে টাইপ করল "দুমকা"। মিনিট পাঁচেক ঘাঁটাঘাটি করে বলল " এই তো সব ব্যবস্থা প্রায় হয়ে গেল। এই উইকেন্ডেই আমরা দুমকা যাব।" যবে থেকে লীলা মজুমদারের 'হলদে পাখির পালক' গল্পটা পড়েছে মুমুর বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়েছে দুমকা গেলেই ও ঝগড়ুর গল্পের আশ্চর্য সব জিনিস দেখতে পাবে। মুমুর মুখে গল্প শুনে তার মামাতো দাদা পিকুও আজকাল দুমকা নিয়ে মেতেছে। অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করা সত্বেও তাদেরকে বিরত করা গেল না। অবশেষে উইকেন্ডে দুমকা যাওয়া ঠিক হল। মনে মনে বাচ্চাগুলোর খুব আশা, যদি ঝগড়ুর সাথে দেখা হয়ে যায়। জঙ্গলের পাশেই ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের বাংলো বুক করা হয়েছে। দুপুরবেলা জমিয়ে মাংস ভাত খেয়ে বড়রা যখন নাক ডেকে ঘুমোতে ব্যস্ত, দুই ভাই বোনে বেরিয়ে পড়ল অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে। পিকু দাদার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে মুমু। বড়দের ছাড়া জঙ্গলে ঢুকতে একটু ভয় ভয় করলেও পিকু দাদার ধমক খাওয়ার ভয়ে মুখে কিছু বলছে না মুমু।

শাল আর মহুয়ার জঙ্গল ক্রমে ক্রমে ঘন হতে লাগল। জঙ্গল যত ঘন হচ্ছে, আলো তত কমে আসছে। হঠাৎ মুমুর হাতে টান পড়ল। পিকু ফিসফিস করে বলল "ওই সামনে বাঁদিকে দেখ।" তাকিয়েই উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠছিল মুমু, নেহাত পিকু ওর মুখটা চেপে ধরেছিল তাই। সোনালী চুল, নীল রেশমি পোশাক পরা ছোট ছোট কতগুলো মেয়ে গোল হয়ে নাচছে। পিঠে তাদের ছোট ছোট ডানা। এরাই কী তাহলে কাঠপরী? মুমুরা আরেকটু এগোতেই দুই পরী এগিয়ে এসে ওদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ওদের তালে তালে মুমু আর পিকুও বেশ মজা করে নাচতে লাগল। মুমু আর উত্তেজনা চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলল " তোমরা কী কাঠপরী? তোমরা কোথায় থাকো?" "আমরা থাকি শুকনো গাছের ভেতরে।।দেখবে আমাদের বাড়ি?" এই বলে ওদের দুজনের হাত ধরে হুশ করে গিয়ে ঢুকে পড়ল শুকিয়ে যাওয়া এক বিশাল শিশু গাছের ভেতরে।

গাছের ভেতরটা কীরকম যেন টিউবের মত। পিকু বলল "বনু, এর ভেতরেই থাকে জাইলেম আর ফ্লোয়েম টিস্যু, যা দিয়ে গাছেরা নিজেদের শরীরে খাবার আর জল আদান প্রদান করে।" সদ্য স্কুলে এসব শিখেছে পিকু। তাই সুযোগ পেয়েই বনুকে জ্ঞান দিয়ে ফেলল। সেই টিউবের মধ্যে ছোট ছোট ঘর ওদের। ঠিক যেন পুতুলের বাড়ি। ছোট ছোট কাঠের গ্লাসে করে ওদের সরবত জাতীয় কী একটা খেতে দিল। কী ভালো যে খেতে! পিকু তো বলেই ফেলল "এরপরে আর কোনোদিন পেপসি আর কোকা কোলা খাব না।" মুমুর কিন্তু একটু একটু ভয় করছে। এই গাছের ভেতর থেকে যদি আর বেরোতে না পারে? ওর মনের কথাটা যেন বুঝতে পেরেই কাঠপরীদের রাণী বললেন "এই ওদের বাড়ির পৌঁছে দিয়ে আয়।" শুনে পিকু বলল "না না বাড়ি পৌঁছতে হবে না, আমাদের শুধু গাছের বাইরে বার করে দিয়ে এসো।" চোখের পলকে ওরা মুমু আর পিকুকে নিয়ে গাছের বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে ওদের বিদায় জানিয়েই নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

দুই ভাই বোনে হাত ধরাধরি করে জঙ্গলের মধ্যে আরো খানিক এগিয়ে চলল। সূর্য এখনো অস্ত যায়নি, গাছের ফাঁক দিয়ে যে আলো আসছে তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে এখন সবে বিকেল হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকাতেই মুমুর চোখ এক জায়গায় আটকে গেল। দেখল ওদের ঠিক মাথার ওপরেই দুটো পাখিতে ঝটাপটি করছে। সোনালি রঙের পাখি, আর কী আশ্চর্য, ওদের পা নেই। ঠিক যেমন গল্পে ঝগড়ু বলেছিল। ওদের পা নেই, তাই ওরা মাটিতে বা গাছের ডালে বসতে পারে না, উড়ে উড়ে ফল খায়। এই ফল খাওয়া নিয়েই বোধহয় দুটোতে মারপিট করছে। ওদের ধস্তা ধস্তিতে কারুর গা থেকে গোটা কতক পালক ঝরে এসে পড়ল মুমু আর পিকুর গায়ে। পালকগুলো গা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই বুকের ভেতরটা কিরকম ছ্যাঁত করে উঠল। পরিষ্কার মনে আছে গল্পে পড়েছে হলদে পাখির পালক যার গায়ে লেগেছে তার আর দেশে থাকা হয় না।

দুমকার সেই জঙ্গলে

একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়াল এক সাদা ধবধবে ঘোড়া, পিঠে দুটো ডানা। নির্ঘাত পক্ষীরাজ! ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের চড়িয়ে নিল নিজের পিঠে। বলল "বলো কোথায় যেতে চাও, কী দেখতে চাও?" মুমুর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল "কিং সলোমন'স মাইন্স"। এই সদ্য বইটা পড়ে শেষ করেছে, মাথায় তাই এখন ওটাই ঘুরছে। পক্ষীরাজ ওদের পিঠে নিয়ে উড়ে চলল সুদূর আফ্রিকার কুকুয়ানা প্রদেশে। ইগ্নসির ছেলে এখন সেখানকার রাজা। বাবার মত সেও সেখানে সুষ্ঠ ভাবে রাজ্য পরিচালনা করছে। স্যার হেনরি কার্টিস, ক্যাপ্টেন গুড আর আল্যান কোয়াটারমেনকে ওরা আজও ভগবানের মত পুজো করে। দুদিন ধরে রাজার খাতিরদারি উপভোগ করল বটে ওরা, কিন্তু মুমু আর পিকুর ভাগ্যে কিং সলোমনের হীরের খনি দেখার সৌভাগ্য হল না। ইগ্নসি ওদের বললেন যে সেই গুপ্ত কক্ষে ঢোকার রাস্তা একমাত্র ডাইনি গাগুলই জানত আর তার মৃত্যুর সাথে সেই রহস্যময় খনি চিরকালের মত মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। স্যার কার্টিসরা নেহাত বরাত জোরে সেখান থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন। একটু মনঃক্ষুন্ন হলেও ওদের মনে হল তা একদিক থেকে ভালই হয়েছে, নইলে দুষ্ট লোকের দল ধীরে ধীরে সব সাবাড় করে দিত।

এতদূর আফ্রিকায় যখন আসাই হল তখন ঋজুদার নাইরোবি সর্দার আর তার মাসাইদের সাথে একবার দেখা করে যাবে না? মুমু বলল "পিকুদা, তুই যাবি যা, আমি কিন্তু পক্ষীরাজের পিঠ থেকে নামব না। নামলেই তো গালে থুতু মাখিয়ে অভ্যর্থনা করবে।" মাসাইদের গ্রামে গিয়ে জানা গেল ঋজুদার সেই নাইরোবি সর্দার আর বেঁচে নেই। কয়েকবছর হল উনি মারা গেছেন। তবে ওনার মাসাইরা ভালই আছে। ওরাও আজকাল পড়াশুনো শিখে কাজকর্ম করছে। আর চোরা শিকারিদের ব্যাপারে ওরা এখন আরও অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। ওদের মধ্যে অনেকে এখন আফ্রিকার বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্ক বা গেম রিজার্ভে ফরেস্ট গার্ডের কাজ করছে। না, মুমুকে বা পিকুকে ওরা থুতু মাখিয়ে আদর করেনি।

এবার মুমুর শখ হল লিলিপুটদের দেখতে যাওয়ার। কিন্তু ওদের দ্বীপটা ঠিক কোথায় সে তো একমাত্র গালিভারই বলতে পারবেন। অতএব পক্ষীরাজ চলো লন্ডন। সেখানে গিয়েও খুব একটা সুবিধা হল না। লেমুয়েল গালিভার অনেকদিন হল মারা গেছেন, ওনার নাতি স্যামুয়েল জানালেন ২০০৪ এর সুনামিতে লিলিপুট, ব্ৰবডিংন্যাগ, লাপুটা এদের সবার দ্বীপগুলো তলিয়ে গেছে সমুদ্রের গভীরে। তাই মুমুর আর লিলিপুট দেখা হল না। স্যামুয়েল অবশ্য ওদের লন্ডন শহরটা ভালো করে ঘুরে দেখালেন। বাকিংহ্যাম প্যালেস অথবা টেমস নদীতে ওদের বিশেষ আকর্ষণ নেই, ওরা বরং ২২ বি বেকার স্ট্রীট নিয়ে বেশি উৎসাহী। শার্লকের ছেলে হ্যাভেলক এখন ওই বাড়িটাতে থাকেন। তিনি পেশায় অধ্যাপক, অবশ্য শখে গোয়েন্দাগিরিও করেন বৈকি।

পিকুর ইচ্ছা একবার টম সাথে দেখা করার। টম সয়ারকে ভারি ভালো লাগে পিকুর। কী দুষ্ট বুদ্ধিই না আসে ওর মাথায়। পক্ষীরাজ খুব জোরে উড়তে লাগল এবার। ওর মাথাতেও তো একটা দায়িত্ত্ব আছে, সঠিক সময়ে বাচ্চাগুলোকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মিসিসিপি নদীর ধারে বিশাল বড় বাংলো টম সয়ারের। না টম আর মোটেই ওরকম দুষ্টু ছেলে নেই, সে এখন রীতিমত বয়স্ক। আন্ট পলির চাপে তাকে পড়াশুনোটা করতেই হয়েছিল। তবে তার প্রাণের বন্ধু হাকেলবেরি ফিনকে দিয়ে অবশ্য পড়াশুনোটা কিছুতেই করানো যায়নি। সে ওরকম ভবগুরে প্রকৃতিরই রয়ে গেছে। টম আর হাক দুজনে মিলে এখন একটা ব্যবসা চালায়। একই বাড়িতে থাকে ওরা। আর হাক এখনও মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্য হাওয়া হয়ে যায়। টম তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না, জানে ও ছিটিয়াল কদিন পরে ঠিক ফিরে আসবে।

পক্ষীরাজ ওদের নামিয়ে দিয়ে গেল জঙ্গলের একবারে কিনারে। সেখান থেকে ওদের গেস্ট হাউস কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ। মুমু আর পিকু দুজনেই খুব খুশি। বায়না করে দুমকা আসা ওদের সফল। বাড়ি ফিরেই বড়দের ওরা বলবে লীলা মজুমদারের গল্পে ঝগড়ু মোটেই গুল মারত না, সত্যি সত্যিই দুমকার জঙ্গলে আশ্চর্য সব জিনিস হয়। তবে হ্যাঁ, দুমকা শহরটা অনেক বদলে গেছে। দুমকায় নাকি কাঁচ পাওয়া যেত না, জানলায় ওরা চাটাই লাগিয়ে রাখত। আজ কিন্তু দূমকার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচের জানলা। কে জানে ঝগড়ু দাদু এসব দেখে যেতে পেরেছে কিনা।

পেশায় শিক্ষিকা। বসবাস কলকাতায়। বই পড়তে, লিখতে, ছবি আঁকতে এবং বেড়াতে ভালবাসেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা