খেলাঘরখেলাঘর

পাখি

শীত শেষ হয়ে আসে। বাতাসের শিরশিরানি কেটে গিয়ে দক্ষিন দিক থেকে ভেসে আসে নরম গরম দখিনা হাওয়া। রোদের উষ্ণতা বাড়তে থাকে। লালকন্ঠ বুঝতে পারে এবার ফিরে যাওয়ার দিন এল - আবার সেই উত্তরে। এই কদিনে চিড়িয়াখানার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। দলে দলে মানুষ এসেছে, পশুপাখিদের দেখেছে, মাঠে বসে খাওয়াদাওয়া করেছে, আর ফেলে রেখে গেছে আরো আবর্জনা। বাতাসময় ধুলো আর শুকনো পাতার সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ। বুড়ি সিংহি কৃষ্ণা তো রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর পরের বার আর এখানে আসা যাবেনা - ভাবে লালকন্ঠ। খুঁজে নিতে হবে অন্য কোন জায়গা, যেখানে হয়ত দেখা হয়ে যাবে সাইবেরিয়ার পুরোনো বন্ধুদের সাথে। আগামি কালই ভোর ভোর বেড়িয়ে পরবে সে।

বিষ্ণুর ছোলায় ভাগ বসাতে বসাতে লালকন্ঠ দেখতে পেল - একটা ছোট মেয়ে, তার পরনে সবুজ পোষাক, হাতে একটা থলি, সে সামনের মাঠ থেকে কি সব কুড়োচ্ছে। ভালো করে দেখার জন্য কাঁটাতারের বেড়ার কাছে চলে আসে লালকন্ঠ। তারপরেই অবাক হয়ে যায়...আরে!! একটা নয়, বেশ অনেক ছোট ছোট মেয়ে আর ছেলে, সবুজ পোষাক পড়ে, হাতে থলি নিয়ে মাঠের মধ্যে রয়েছে। তারা মাঠ থেকে নোংরা কাগজ, খাবারের প্যাকেট, এইসব তুলে তুলে তাদের থলিতে জমা করছে। কেউ কেউ আবার পাইপ দিয়ে জল ছিটিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে আশেপাশের গাছপালাগুলো। ওদের সঙ্গে রয়েছে চিড়িয়াখানার কর্মীরাও। তারা পরিষ্কার করছে পরিখাগুলির জল।

দেখতে দেখতে কয়েক ঘন্টার মধ্যে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে উঠল চিড়িয়াখানার চত্বর। লালকন্ঠ এইসবের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। বীরেশ্বর বেশ খুশি তার পরিখার জলটা পরিষ্কার করে দেওয়ায়। এতদিন সে ভালো করে নিজের মুখটাও দেখতে পাচ্ছিল না!! মুনিয়া পাখি গুলি নিজেদের মধ্যে এত কলরবলর করছে যে ওদের সঙ্গে কথাই বলা গেলনা। গম্ভীর পন্ডিত ধনেশ পাখি অবশ্য মুখ বেঁকিয়ে বলেছে - দেখো কতদিন পরিষ্কার থাকে!! তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে প্যাঁচালো গলা পেলিক্যান গুলো। বিজ্ঞ বিজ্ঞ গলায় বলেছে - এইসব এই একদিনই হবে!! ওদের থেকে ভালো শান্ত -শিষ্ট হরিণেরা। তারা একবাক্যে জানিয়েছে তাদের ব্যপারটা বেশ পছন্দ হয়েছে - তাও তো কিছু মানুষের টনক নড়েছে!!

ইতিমধ্যে চিড়িয়াখানার দরজা খুলে গেছে। ক্রমে ক্রমে বাড়ছে মানুষের ভীড়। লালকণ্ঠ দেখলো সেই সবুজ পোষাক পরা ছোটরা সবাইকে বোঝাচ্ছে পরিবেশ কে পরিষ্কার রাখতে। কেউ ভুল করে ঠোঙ্গা বা জলের বোতল মাঠে ফেললে, তার সঙ্গে কথা বলে তাকে দিয়ে সেই জিনিষ বড় বড় ময়লা ফেলার পাত্রে জমা করাচ্ছে।

দিনের শেষে একটা বড় গাড়ি করে যখন সব ময়লা তুলে নিয়ে চলে গেল, তখন বেশ খুশি খুশি মন নিয়ে লালকন্ঠ ঘুমতে গেল। ভাবল, কালকেও কি এমনি হবে? নাকি, ধনেশ পন্ডিত আর প্যাঁচালো পেলিক্যান গুলোর কথাই সত্যি হবে?

পরের দিন সকালে কিন্তু ওরা আবার এল। একই রকম পোষাক পরা অন্য আরো একদল ছেলেমেয়ে...তার পরের দিন ও এল...কাকাতুয়া বাক্যবাগীশ লালকন্ঠকে খবর দিল যে এরকম নাকি রোজই হবে। বকবকে কাকাতুয়ার বন্ধু শহুরে কাকের দল, যারা সারা শহরময় ঘুরে বেড়ায় আর সব্বার হাঁড়ির খবর রাখে, তারাই জানিয়েছে একথা। প্রতিদিনই একদল করে শিশু আসবে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের চিড়িয়াখানা পরিষ্কার রাখার জন্য।

আরো কিছুদিন পরে এক হালকা কুয়াশামাখা ভোরবেলায় লালকন্ঠ তার বিশাল দুটি ডানা ছড়িয়ে ভেসে উঠল আকাশে। পূবের আকাশ লাল করে তখন সবে সূর্যদেব উঠেছেন। সেই লাল- সোনালি নরম আলোয় ঝকঝকে সুন্দর চিড়িয়াখানাকে পেছনে ফেলে নীল আকাশে উড়ে চলল লালকন্ঠ। এবার সে নিশ্চিন্ত। তার বন্ধুরা আর ধুলো ময়লার মধ্যে থাকবে না। আর আগামি বছর সে আবার ফিরে আসবে এখানে। লালকন্ঠ নিশ্চিত, আগামি বছরও এসে সে তার চিড়িয়াখানাকে একইরকম দেখতে পাবে - ঝকঝকে, পরিষ্কার, প্রানের আনন্দে ভরপুর - তার পরিযায়ী জীবনের ছোট্ট এক স্বপ্ন।



মহাশ্বেতা রায়
পাটুলী, কলকাতা


 

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।