নদী জল দেয়, সুফলা মাটি দেয়, মাছেরও জোগাড় দেয়, কিন্তু জিম্বাবোয়েতে, নদী এছাড়া আরও কিছু দেয়। পাহাড় আর ঝরনার পাথরেরা গড়িয়ে গড়িয়ে এসে জমা হয় নদীর কাছাকাছি, তার মধ্যে বেশকিছু পাথরে থাকে সোনা আর হীরে। এই থুলি নদীর কাছে স্বভাবতই থাকবে সোনা মেশানো পাথর, স্থানীয় লোকে বলে রাব্ল্।
নদীর কাছে পৌঁছাতেই স্বর্ণ সন্ধানী এক ঝাঁক গ্রামবাসীর দেখা। সারা দিন ধরে ওরা নদীর বালি আর আশেপাশে পিট কেটে পেয়ে যায় সোনা, বেশ ভাল পরিমানে সোনা। তবু ওরা গরীব, বেশ গরিব তা ওদের সঙ্গের অর্ধভুক্ত অপুষ্ট শিশু গুলো দেখলে বোঝা যায়। তাহলে সারা দিনে পাওয়া এই সোনা- সেটা তো কম নয়। আমরা তো একটু আগে জেনেছি, আন্দাজ করতে পারি, এরা কতটা পেতে পারে যদি চার পাঁচ জন মিলে এক টনের কাছাকাছি পাথর ধোয়ামোছা করে। তাহলে?
ওদের একজন আমাদের সত্যি কথাটা বলল। এই সব সোনা সপ্তাহে দু-তিন দিন মাফিয়ারা এসে নিয়ে যায় দাদন দেওয়া অল্প পয়সার বিনিময়ে, তাতে কোনো রকমে ভুট্টাদানা কেনা যায়। এখানে গ্রামের সাধারণ লোক ভুট্টাদানা জলে সেদ্ধ করে একরকম পুলটিশ মতো জিনিস বানিয়ে খায়। গমের আটার রুটি খেতে পাওয়া বিলাসিতা, পালে-পরবে হয়ত জুটল।
সেই এক শোষণের কাহিনি সব জায়গাতে। জীবন ও তার সাথি নীরবে ঘাড় নেড়ে জানাল যা আমরা শুনছি সব সত্যি। ওরা হাত তুলে দেখিয়ে দিল অদূরে এক পাহাড়ি টিলার চুড়োতে একটা উঁচু পাঁচিল দেওয়া একটা বেশ বড় বাড়ি, বাইরে থেকে লোক এলে তারা ওখানেই থাকে খায়।
আমাদের কাছে কাপ নুড্ল্ ছিল, এতে গরম জল দিলেই খাবার তৈরি হয়ে যায়। আমরা ওদের জন্য কয়েকটা দিলাম, ওরা ওদের বাচ্চাদের খাইয়ে দিল। এক শ্রমিক রমনী কিছু কাপ নুড্ল্ চেয়ে নিল বাড়ি নিয়ে যাবে তার সন্তানদের জন্যে। আমি ইচ্ছে করে আরো কিছু কাপ নুড্ল্ রেখে এলাম।
চলে আসার সময় দেখি সেই মেয়েটি নুড্ল্-এর কাপগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দ্রুত ঢুকিয়ে নিচ্ছে তার এপ্রনের ভেতরের পকেটে। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে যখন পৌঁছাবে তার কুটিরে তখন আজকের চিত্রটা অন্য রকম হবে। তার শিশুরা হাপুস হুপুস করে খাবে ধোঁয়া ওঠা কাপ নুডুল, মনে হচ্ছে এই ভেবেই তার সারাদিনের উপবাস ক্লিষ্ট শুকনো মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছে। মায়েরা বোধ করি পালটায় না কোথাও!
দু পাশে গভীর ঘাস বনের বুক চিরে, পাকদণ্ডী বাঁধানো পথে, টিলার ওপরে উঁচু পাঁচিল ঘেরা সেই বাড়ির গেটের কাছে যখন পৌঁছালাম তখন পশ্চিম আকাশে একটা লাল বড় গোলা পাটে বসেছে, হাল্কা আলো আছে। দেশীয় ভাষায় জীবন আর তার সঙ্গী, গৃহরক্ষককে ব্যাপারটা বলতেই গেট খুলে গেল শুধুমাত্র রাত্রের আশ্রয়ের জন্যে, কাল সকালেই ছেড়ে চলে যেতে হবে।
এক ঝাঁকা ভর্তি মুরগি আর ভুট্টার আটা আছে, রাত্রে খাবার অসুবিধা হবে না। তবে মালিকদের অনুমতি ছাড়া ঘর খুলে দিতে পারবে না। ছাদের ওপরের ঘরটা ওর, সেটা ছেড়ে দেবে। ছাদে ও শোবে, আমাদের দলের কিছু লোক ওর সাথে সেখানেও শুতে পারে, কাঠের আগুনও থাকবে,শীত করবে না। এখানে দিনে গরম হলেও, রাতে কিন্তু বেশ শীত করে। গেস্ট হাউসের ঠিক পাশ দিয়ে একটা পাহাড়ি ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, আমরা চাইলে এখনি তাতে স্নান করে ফ্রেশ হতে পারি তবে চাঁদ ওঠার আগে সে সব কিছু শেষ করে ফেলাই ভাল।
হঠাৎ চাঁদ ওঠার সাথে আমাদের স্নানের কি সম্পর্ক? জীবনের সাথে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কথাটা বলেই ফেলে সে। "মানে তেমন ভয়ের কিছু নেই এখন আর। আগে এই ঝরনাতে চাঁদের হাট বসে যেতো। জ্যোৎস্নার আলোতে বনের সব জীব-জন্তুরা আসতো দল বেঁধে। এখন কখনো কখনো আসে কেউ কেউ"
আমাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, "কেন? জল তো শুকায় না, এই গরমেও তো দিব্যি বয়ে চলেছে, নাকি আরও কোনো বড় ঝরনা আছে?"
সে আমাদের দিকে তাকিয়ে সাদা দাঁত বের করে হেসে ওঠে"ঝরনা এ তল্লাটে এই একটাই। জংলি জানোয়াররা সব বেঁচেবর্তে থাকলে তবে তো ।
তেনারা সব আসেন, সোনা আদায় করেন,আর শিকার ও করেন। তাদের হাতে মরতে, মরতে একআধটা কেউ কেউ এখন বেঁচে আছে কোনো রকমে। তারাই আসে কখনো কখনো।"