সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
মেছো ভালুকের কান্ড
(১)

মোড়ল হলধর কুইরী বলল, "শিবেনকে নগদ পাঁচশত টাকা হারুর হাতে তুলে দিতে হবে। কেননা শিবেনের গরু হারু গোয়ালার ক্ষেতের ফসল নষ্ট তো করেছেই উপরন্তু হারুর কাঁটা দেওয়া বেড়াটাও ভেঙ্গে ফেলেছে। আরেকটি কথা। শিবেনকে কিন্তু এই গাঁয়ের মান্যিগন্যিদের একদিন পেট ভরে মাছ-ভাত খাইয়ে দিতে হবে। এর কমে কিন্তু শিবেনকে ছাড়া চলবে না। "

এই বলে হলধর তার কুতুকুতু চোখে দিয়ে সমবেত গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করতে লাগল। আজ শিবেনকে নিয়ে গ্রামে বিচার সভা বসেছে। প্রকান্ড একটি তেঁতুল গাছের নীচে গ্রামবাসীদের সঙ্গে উপস্থিত রয়েছে হলধর। হলধর ছাড়া আর সবাই মাটিতে বসে রয়েছে। দু-চার জন দাঁড়িয়েও আছে এখানে ওখানে। শুধু হলধর একটি লম্বা পায়ার চেয়ারে বসে রয়েছে।

শিবেন হলধরের বিচার মন দিয়েই শুনল। তাকে হারুর হাতে নগদ কিছু টাকা তুলে দিতে হবে এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু সে একটা জিনিস কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তা হল ঐ পেট ভরে মাছ-ভাত খাওয়ার শর্তটা। তার অবলা গরু হারুর ফসল নষ্ট করেছে বলে মোড়ল আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের মাছ-ভাত খাওয়াতে হবে এটা কেমন বিচার। তবে মোড়লমশাইকে কেউ চটাতে চায় না। কেননা সকলেই জানে মোড়ল মশাই লোকটি মোটেই সুবিধের নয়। শিবেন মোড়ল মশাইয়ের এই অদ্ভূত বিচার মেনে নিতে বাধ্য হল।

কিন্তু এই বেয়াড়া ও অন্যায় বিচার মেনে নিতে পারল না শিবেনের ছেলে তারক। তারক ছেলেটি খুব ডাকাবুকো। সে গোলামারা হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। পড়াশোনাতেও ভাল। তবে তারক ভালো উলফা দিতে পারে বলে 'বালিগাড়া ছৌ-নৃত্য পার্টি' তাকে দলে নিয়ে নিয়েছে। ফলে তারকের প্রায়দিনই স্কুল কামাই হয়। মা-বাবার অভাবের সংসারে তারক কিছু টাকা উপার্জন করে বাবার হাতে তুলে দেয়। এখন ছৌ-নাচের অফ্ সিজন বলে তার হাতেও কিছু কাজ নেই। ফলে জরিমানার পাঁচশত টাকা জোগাড় করা তাদের কাছে খুব কঠিন। তার উপর আবার মাছ-ভাতের দাওয়াই......।

হলধর লোকটি যে কতটা ঘোড়েল তা তার চোখ দেখেই বোঝা যায়। আর এই কুতুকুতু চোখ দুটো সে সবসময় খোলা রাখে। এই খোলা চোখ দিয়ে সে ঠিক বুঝতে পারে কাকে কখন কীভাবে দাঁও মারতে হয়। এই দাঁও মারার বিদ্যেতে সে পারদর্শী বলেই আজ তার দালান-বাড়ি-বাগান-পুকুর সব হয়েছে। বাগানের সবজি আর পুকুরের মাছ বিক্রি করেও হলধর টাকা রোজগারের একটা পথ বের করে রেখেছে। প্রতি রবিবার জেলা শহরে যে হাট বসে তাতে তার পুকুরের মাছ চালান যায়। ভরত মল্লিক খুব ভোরবেলা টাটকা মাছ শহরে নিয়ে যায়। ফিরে আসে সেই দুপুর বেলা। পুকুরের টাটকা রুই কাতলা শহরের বাবুদের খুব পছন্দ। হাটে পৌঁছে মাছ ঢালতে না ঢালতেই খদ্দেরদের ভিড় লেগে যায়। সেই মাছের দামও পাওয়া যায় ভালো। আর ভালো দাম পাওয়া যায় বলে হলধর পুকুরের একটি মাছও কাউকে কোনদিন দান করে না। এজন্য গ্রামের লোকেরা আড়ালে তাকে 'হাড়কেপ্পন হলধর' বলে ডাকে।

তারক বসে থাকবার ছেলে নয়। মোড়লকে কী করে একটু শিক্ষা দেওয়া যায় এই চিন্তা তার মাথায় রাত-দিন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে তারক ওটা বেশ ভালো বোঝে যে মোড়লের সঙ্গে সামনা সামনি শত্রুতা করে পেরে ওঠা যাবে না। তারা গরিব। তার বাবা সামান্য দীনমজুরের কাজ করে তাই তারককে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে হবে।

(২)

ভোরবেলায় ঘন কুয়াশায় পথ-ঘাট সব ঢেকে গেছে। দশ হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে ঠান্ডাও পড়েছে খুব।

তারক খুব ভোরবেলায় সাইকেল নিয়ে শহরে টিউশনি পড়তে যায়। আজও সে ভোরবেলাতেই বইপত্র নিয়ে বের হয়েছে। তাদের গ্রাম থেকে বেরিয়ে শহরে যাবার যে পাকা রাস্তা রয়েছে তার দু-দিকেই রয়েছে বাবলা আর পলাশের জঙ্গল। তারক পাকা রাস্তার এক পাশে সাইকেল রেখে লম্বা থলি থেকে একটা ভালুকের পোষাক ও একটি ভালুকের মুখোশ বের করল। বালিগাড়া ছৌ-নৃত্য পার্টির ম্যানেজার নিতু মামাকে সে সব কথা খুলে বলেছে। কাল রাত্রে নিতু মামাই তাকে এই পোষাকটা দিয়েছে। তারক এই পোষাক পরেই উলফা দিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেয়। আসলে ভালুকের পোষাকটা জবড়জং মনে হলেও এটা খুব হালকা। তাই এটা পরে তারক বেশ ভালোভাবেই খেলা দেখাতে পারে। আজ ভোরবেলা নির্জন রাস্তায় তারক ভালুক সেজে তৈরি হয়ে নিল।

ভরত মল্লিক লোকটা রোগা পটকা। প্রতি রবিবার ভোরবেলায় তাকে এই রাস্তা দিয়েই শহরের হাটে যেতে হয়। হলধর মাঝ রাত্রে পুকুর থেকে বড় বড় মাছ ধরিয়ে সে মাছ পেল্লাই একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ভরে ভরতকে দিয়ে শহরে পাঠায়। সেইমতো আজও ভরত সাইকেলের পিছনে মস্ত বড় হাঁড়িটা বেঁধে সাইকেল চালাচ্ছিল। ঘন কুয়াশার কারণে খুব জোরে সাইকেল চালানোই মুশকিল ব্যাপার।

মেছো ভালুকের কান্ড

তারক তৈরিই ছিল। ভরতকে দেখামাত্রই শূন্যে একবার ডিগবাজি খেয়ে সোজা রাস্তায় এসে পড়ল। তারপর ভরত কিছু বুঝে ওঠার আগেই সোজা ধাক্কা মারল তার সাইকেলে। এরকম হঠাৎ আক্রমণে ভরত মাটিতে ছিটকে পড়ল। সাইকেলে বাঁধা মাছ গড়িয়ে পড়ল। এক সের, দেড় সের ওজনের রুই কাতলা পাকা রাস্তার উপর গড়াগড়ি খেতে লাগল। ভরত নিজেকে বাঁচাতে যেদিক দিয়ে সাইকেল চালিয়ে এসেছিল সেদিকেই দৌড় মারল। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

তারক বুঝল এই সুযোগ। সে নিমেষের মধ্যে রাস্তায় পড়ে থাকা আট-দশটা মাছ থলিতে ভরে ফেলল। তারপর ঝোপের আড়ালে এসে মুখোশ ও পোষাক খুলে বালিয়াড়া গ্রামের দিকে সাইকেল চালিয়ে দিল। তখন আস্তে আস্তে কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। তারকের কপালে এই শীতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। কাজটা সে প্ল্যান মাফিক করতে পেরেছে। এখন এই মাছগুলো নিতুমামার হাতে তুলে দিলেই তার ছুটি। বাকিটা সেই-ই ম্যানেজ করবে বলেছে।

(৩)

হলধর ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা স্কুল মাঠে এসে জড় হয়েছে। আজ রোবরার বলে স্কুল ছুটি তাই স্কুলের মাঠেই খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। শিবেন জরিমানা স্বরূপ আজ তাদের পেট পুরে খাওয়াবে। নিতু শ্বশুর ঘরের সম্পর্কে শিবেনের শ্যালক হয়। সে ছেলেটি বেশ করিৎকর্মা। ইতিমধ্যেই নিতুর মাছ-ভাত রান্না হয়ে গেছে। বাকি আছে শুধু চাটনি। একটু পরেই খাওয়া দাওয়া শুরু হবে। হলধর বাহিনীর ভালুকের গল্প ততক্ষণে রং চড়তে শুরু করেছে। সৃষ্টিধর আর পরাশর দু-জনেই নাকি ঐ ভালুকটাকে গতকাল সন্ধ্যায় পুকুর পাড়ে দেখেছে। ব্যাটা মাছ-খেকো ভালুকটা পুকুরের ধার ধারে ঘোরাফেরা করছিল। ভরতকে এখনো অনেকে ঘিরে রেখেছে। তাকে ভালুকটা কীভাবে আক্রমণ করেছিল আর তার চোখের সামনে সেটা কীভাবে গপাগপ্ করে দেড় সের ওজনের মাছগুলো চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছিল সেটা সে অন্ততঃ তিরিশবার বর্ণনা করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। ভালুকটা আজ তাকে নির্ঘাৎ মেরে ফেলত। নেহাৎ সেটা মাছ-পাগলা বলেই ভরতকে ছেড়ে দিয়েছে।

তারক একমনে ভরতের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। সে যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না এরকম মুখ করে তাকিয়ে আছে। আর মনে মনে ভরতের এই ভালুক বর্ণনার তারিফ করে যাচ্ছে।

নিতু এক হাতে দশটা কাজ করতে পারে। রান্না শেষে এখন সে পরিবেশনার দায়িত্ব নিয়েছে। পংক্তি ভোজের প্রথম সারিতেই বসেছে মোড়ল আর তার খুব কাছের বন্ধুরা। তাদের প্রত্যেকের পাতে নিতু আস্ত একটা করে কাতলা মাছের মুড়ো ঢেলে দিল। সেই মুড়ো চিবোতে চিবোতে হলধর মোড়ল বিগলিত হয়ে গেল। মাছ-ভাত পেটে পড়তেই সকালের টাটকা ভালুকের গল্পটা অনেকখানি বাসি হয়ে গেল।

তারক আর নিতুর মোড়ল অপারেশন সফল হল। হাড়কেপ্পন হলধরের রুই-কাতলা মাছের কিছুটা হলেও সদগতি হল। নিতু আস্ত একটা মুড়ো চিবোতে চিবোতে বলল, "ভালুকটা বোধকরি দলমা পাহাড়ের দিকেই ফিরে গেছে। তা না হলে ব্যাটা মাছের লোভে এতক্ষণ এই স্কুল মাঠেই এসে হাজির হয়ে যেত। "

তারপর খুব নীচু গলায় তারককে বলল,"ভালুক কি উলফা দিতে পারে ? সেটা একবার জেনে নিস্ তো !"


ছবিঃ পিনাকী দত্ত

পুরুলিয়ার বাসিন্দা তরুণ কুমার সরখেল জেলার প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করেন। পাশাপাশি ছোটদের জন্য নিয়মিত লেখালিখি করেন, এবং ছোটদের জন্য একটি মুদ্রিত পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা