সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কালী দি

দিনের কাটন যাবে না, যদি না কালী কে ওর মা মুণ্ডপাৎ করে। ইস্কুল থেকে ফিরে কালী আধ ময়লা নীলচে ফ্রক পরে মাটির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পেছন দিক দিয়ে ওটাকে চিপকে ধরে পা দিয়ে মাটি খুঁটছিল। দাওয়ার মধ্যিখানে দরজার পাশে কালীর দু'ভাই সাদা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে মুড়ি নিয়ে বসে আনন্দে মুড়ি চিবোচ্ছে। কালী হ্যাংলা লোভির মতো একদৃষ্টে ওদের দিকে চেয়ে আছে। আর সেই সঙ্গে ওদের কুঁড়ে ঘরের অন্দর মহল থেকে ঝাঁঝালো বাকুনি ধেয়ে আসছে কালীর দিকে।

একসময় আর সহ্য করতে না পেরে কালীর মা কোমরে কাপড় গুঁজতে গুঁজতে উগ্রচণ্ডী রুপ ধরে ধেয়ে এলো কালীর দিকে। অমনি কালী ভয়ে দৌড়ে দাওয়া থেকে নেমে আসে। থমকে দাঁড়িয়ে যায় ওর মা, মুখ পেঁচিয়ে, বিকৃত স্বরে চ্যাঁচায় – "মুখপুড়ি, ইসকুলে দুপুরে 'খেচড়ি মিল' গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে এয়েচিস, তাও হল না! এখন আবার গিলতে চাইচো? পেটে রাহু ঢুকেচে, অ্যাঁ, রাহু? বাড়িতে তোর বাপ তোর জন্যে মণ মণ চাল, ডাল রেখেচে কি না … যখন খুশি, যা খুশি গিলবে…"। বঙ্কার ইচ্ছে করছিল দৌড়ে গিয়ে কালীদির মাকে মারে সজোরে একটা রাম গোঁত্তা কিন্তু একটু এগোতেই গলায় দড়িতে টান! বাধ্য হয়ে থমকে যেতে হয়। তবুও সে একবার কালীদিকে ডাকলো 'ম্যা – ম্যা' করে। অমনি বঙ্কার মাও তার সঙ্গে সুর করে করুণ সুরে সুর ধরলো –'ম্যা – ম্যা'।

কালী টাও হয়েছে তেমনি একরোখা। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! কী করবে ভেবে পায় না। সে একবার ফিরে বঙ্কা আর তার মার দিকে ফিরে তাকালো। আবারো ওরা একইসঙ্গে 'ম্যাঁ –ম্যাঁ' করে ডেকে উঠল। কালচে কাঠপোড়া কালো রং, দেহের গড়ন রোগা লিক্‌লিকে, মাথায় জট ধরা, তেল না দেওয়া লালচে চুল। মুখের গড়ন দেখে তো ওর মা দিন দু'বেলা গালি পাড়ে –"তোকে আমি কী কুক্ষণে যে পেটে ধরেছি! ছ্যা, ছ্যা..." । কালী ভেবে পায় না ওর নিজের দোষটা কী ? ওর নিজের মনে হয় এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়াটাই ওর কাছে অভিশাপ। হঠাৎ পায়ের কাছে একটা আধা ক্ষয়া কাঠের মুগুর আছড়ে পড়ল! দাওয়া থেকে হুঙ্কার এলো – "খোঁয়াড় থেকে মুরগীগুলো ছেড়ে, ছাগলগুলো দক্ষিণের বিলে চরিয়ে আন। তোকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে কে শুনি?" কালী অগত্যা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল খড়ের চালা, নীলচে নাইলনের জাল ঘেরা মুরগীর খোঁয়াড়ের দিকে।

নীল আকাশ, ছেঁড়া ছেঁড়া পাংশুটে মেঘ। ঝির ঝিরে দখিনা হাওয়ায় বর্ষার আমেজ। আদিগন্ত মাঠের পর মাঠে সদ্য বর্ষার জল পাওয়া চাঁচড় ঘাস গোড়ালি ডোবা জল থেকে মাথা উঁচু করে নতুন আমেজে, নতুন জীবন পেয়ে জেগে উঠেছে। আল বাঁধে নতুন গজানো কচি সবজে দূর্বা ঘাসেরও বাড় বাড়ন্ত। বঙ্কা আর তার মা একমনে 'চ্যাড় – চ্যাড়' শব্দ করে দূর্বার মাথা ছিঁড়ে, চিবিয়ে চলেছে একমনে। আলবাঁধের উল্টোদিকে কিশোর বাবলার ডালে সবুজ কচি পাতা দখিনা হাওয়ায় ঝিরি ঝিরি কাঁপুনি যেন আমেজ আনে। শুকনো মুখে কালী তার তলায় দক্ষিণ মুখো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একবার যেন বাবলার ডালটা কালীর মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে গেল! কী নরম আদুরে স্পর্শ! ওর মনে হল মায়ের আদুরে স্পর্শ বুঝি কী এমনি হয়! এই ছোঁয়াটা পেতে ওর খুব - খুব ইচ্ছে করে। মা ভাইয়েদের এতো আদর করে, খেতে দেয়, ঘুম পাড়ায়, কত্তো যত্ন আত্তি করে কিন্তু কালীর জন্য কেন এতো ঘেন্না, কে জানে! ও যদি মায়ের ছেলে হয়ে জন্মাতো! মা কী এমনি দিন দু'বেলা দুর ছাই করতে পারতো! ভীষণ কান্না পায়। আলতো করে ডালটাকে ধরে ফেলল কালী । তারপর নাকের কাছে এনে শুঁকলো। নতুন গজানো সবুজ পাতার ঘ্রাণ বেশ! তারপর কাঁটা বাঁচিয়ে কয়েকটা নরম পাতা ছিঁড়ে সে মুখের মধ্যে চালান করে দেয়। খেতে একটু কষাটে স্বাদ। আনমনে চিবতে চিবতে তার চোখ জল চলে আসে।

কখন যেন পেছনে বঙ্কা এসে দাঁড়িয়েছে। সে কালীর পায়ের তলায় ঢুকে পড়ে। তারপর পায়ে পায়ে নিজের শরীর বার বার ঘষে আদর খাওয়ার বায়না করতে থাকে। কালী ফিরে দেখে বঙ্কা ওর দিকে মুখ তুলে চেয়ে আছে। চোখের জল মুছে বঙ্কার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ততক্ষণে মুখের কষাটে স্বাদ মিলিয়ে গিয়ে একটা মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ এসেছে। মনটা ভালো হয়ে যায়। কালী ফিক্‌ করে হেসে ফেলে। বঙ্কা এবার প্রশ্রায় পেয়ে তার দু'পা কালীর পেটের উপরে তুলে বাবলার ডালের দিকে মুখ তুলে চায়। অমনি কালী বাবলার ডালটা টেনে এনে ওর মুখের সামনে ধরে। বঙ্কা তড়বড়িয়ে বাবলার পাতগুলো কালো কালো ঠোঁটে চিপে ছিঁড়ে খেতে থাকলো। কালীও একই সঙ্গে একমুঠো পাতা তুলে মুখের ভিতর চালান করে। এবার যেন দু'জনের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে কত তাড়াতাড়ি পেট ভরাতে পারে। হঠাৎ কালী টের পায় তার পেছনে কে যেন দু'পা দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে! পিছন ফিরে দেখে --- বঙ্কার মা 'বুড়ি' কালীর পিঠে পা তুলে দিব্যি বাবলার পাতা চিবোচ্ছে! কালী হেসে কুটো পাটি। হো হো করে হাসতে হাসতে বুড়ির মাথায় আলতো চাঁটি মেরে আদুরে গলায় বলে – "বুড়ি তুইও!"

সন্ধ্যেবেলা মাটির দাওয়ায় তালপাতার চাটাই পেতে কালী পড়তে বসেছে। সামনে টিনের লম্ফ কেরোসিন শুষে কাপড়ের পলতে নিজে পুড়ে যে লালাভ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে তাও আবার দক্ষিণের ঝির ঝিরে হাওয়ায় কাঁপছে। উল্টোদিকে আর একটি চাটাইতে বড় ভাই ঝন্টা স্লেটে চক দিয়ে 'অ – আ' মক্‌শো দিচ্ছে। আর ছোটভাই ভেতরে কাঠের চৌকীতে ঘুমিয়ে কাদা। দাওয়ার অন্যপ্রান্তে ধোঁয়াময় অন্ধকারে লম্ফ আলোয় কালীর বাপ বসন্ত সাউ নাভিতে জাল ছড়ি গুঁজে একমনে জাল বুনেই চলেছে। জালের ফাঁস তৈরী করতে 'সুড়িং' ফাঁসের মধ্যে ঢুকিয়ে 'খ্যাস' করে আওয়াজ হচ্ছ, আবার সুড়িং -এর সুতো শেষ হলে সুতো খুলতে 'সুড়িং' থেকে 'খটাং' করে শব্দ করছে। তার ওপারে কালীর মা মাটির উনুনে শুকনো ডাল - পাতা জ্বালানী দিয়ে ধোঁয়াময় আধো অন্ধকারে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ভাত চাপিয়েছে। হাঁড়ি উপচে ফ্যানা হাঁড়ির গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আর ভাতের গন্ধে চারদিক ম্‌ ম্‌ করছে। অমনি কালীর খিদেটা আরও চাগাড় দিয়ে উঠল। সে বই থেকে মুখ তুলে তার মায়ের দিকে চোরা দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে, চোখ তুলে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে দূরে পাড়ায় পাড়ায় এখন বিজলি বাতির আলোয় ভরে যাচ্ছে। শুধু ওদের এই মাঝ মাঠের ফাঁকা পাড়াটা অন্ধকারে ডুবে আছে। আনমনে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠাকমা বলতো মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। তবে ঠাকমাও বুঝি ওই আকাশের তারা হয়ে গেছে! ও যখন ভাইয়েদের মতো ছোট ছিল ঠাকমা এই দাওয়ায় ছেঁড়া চাটাইয়ে শুয়ে শুয়ে এই তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে কতো ভূত পেত্নীর গপ্পো বলত। এখন বুঝি এই বিশাল আকাশের তারাদের মাঝ থেকে ঠাকমা দরদ ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে! বড্ড একা একা লাগে, অসহায় বোধ করে, ভীষণ কষ্ট হয়। কান্না পায়। ঠোঁটে ঠোঁট চিপে কান্না চেপে থাকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

অন্দর মহলে খাটিয়ার ওপারে বঙ্কা আর তার মা শুয়েছিল। বঙ্কার কী মনে হল সে গুটি গুটি পায়ে ভেতর থেকে দাওয়ায় চলে এল। অমনি পেছন থেকে বঙ্কার মা নিচু স্বরে 'ম্যা – ম্যা' করে বঙ্কাকে যেতে বারণ করছে। অবাধ্য বঙ্কা তবুও এগিয়ে এসে কালীর পিঠে মাথা ঘষতে থাকে। কালী বুঝতে পারে বঙ্কার উপস্তিতি – আদর খাবার অজুহাত। চোখের জল মুছে সে পেছন থেকে বঙ্কাকে টেনে এনে তার কোলের কাছে বসিয়ে দেয়। আর মাথাটা নিজের কোলে টেনে নেয়। তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে, ঝুঁকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে।

আজ সকাল সকাল কালীর বাবা মা মাঠে গেছে বীজতলার মাটি কোদাল দিয়ে চষতে। কালী তার দুই ভাইকে নিয়ে দাওয়ায় খেলছে। ওদিকে কলাগাছের ঝোপের কাছে বঙ্কা আর তার মাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বঙ্কা ছটপট করছে – কখন কালীদি এসে ওদেরকে আলবাঁধে চরাতে নিয়ে যাবে। বঙ্কা দাওয়ায় আসতে চাইছে কিন্তু পেছন থেকে দড়িতে পড়ে টান। তক্ষুণি 'সিঙ্গাড় পল্লী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের' তাপসী দিদিমনি হাতে একটা বোর্ডে আটকানো রুলটানা কাগজ - হাতে পেন নিয়ে উপস্থিত! কালী ও তার ভাইরা সবাই খেলা বন্ধ করে অবাক হয়ে দিদিমনির দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। দিদিমনি নীল রং এর শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে – "কালী , তোর বাবা কোথায়?" কালী আমতা আমতা করে উত্তর দেয় – "ক্ষেতে গেছে বাবা-মা।" মুহুর্ত থমকে দাঁড়ায়। কিছু একটা ভেবে নিয়ে দিদিমনি বোর্ডের কাগজে পেন দিয়ে কীসব লিখতে লিখতে কালী কে জিজ্ঞেস করেন –"তোরা ভাই বোন কতজন?" মাথা চুলকে কালী উত্তর দেয় –"আমরা চারজন।" দিদিমনি আবার জিজ্ঞেস করেন – "ক'জন ভাই, ক'জন বোন?" কালী বলে – "আমি একা আর আমার তিন ভাই।" দিদিমনি দাওয়ায় চোখ চালিয়ে দুই ভাইকে দেখে নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে আবার জিজ্ঞেস করেন – "আর এক ভাই কই?" কালী হেসে উত্তর দেয় – "ওই যে কলা ঝোপের পাশে!" বলেই সে ডাক ছাড়ে – "বঙ্কা, হেই বঙ্কা" অমনি বঙ্কা দু'বার 'ম্যাঁ – ম্যাঁ' করে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে কিন্তু দড়িতে পড়ে টান। দিদিমনি হেসে কালীকে আবার জিজ্ঞেস করেন –"ও তোর কোন ভাই?" কালী আদুরে গলায় বলে – "ও আমার ছোট ভাই।" দিদিমনি আবার জানতে চান – "ওর নাম বঙ্কা কেন?" কালী উচ্ছসিত হয়ে বলে – "বড় ভাই - ঝন্টা, আর মেজো ভাই – মন্টা, তাই ওর নাম মিলিয়ে বঙ্কা।" দিদিমনি হেসে কুটোপাটি।

হাঁটুর উপর সবুজ চেক কাটা লুঙ্গি, পরণে হাফ হাতা ময়লা সাদাটে গেঞ্জি, বগলে ফ্যাকাশে কালো ছাতা, ছাগল ব্যাপারী আলাউদ্দিন সেখ্‌ পায়ে টায়ারের কালো জুতো ঘসটাতে ঘসটাতে ডাক ছেড়ে যায় – "সাগোল বিকিরি করবে গো, সাগোল…" অমনি কালী বুকটা ছনাৎ করে ওঠে, এই বুঝি বা বঙ্কাকে ধরে নিয়ে গেল আলাউদ্দিন! সে দ্রুত বঙ্কা ও তার মাকে টেনে নিয়ে চলে কিন্তু আলবাঁধের সবুজ কচি ঘাসের লোভ সামলাতে পারেনা বঙ্কা ও তার মা। দড়ির উল্টো টানে একগুঁয়ে, জেদি ভাবে ওরা দুখাবলা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে মুখে চালান করে দেয়। ততক্ষ্ণে আলাউদ্দিন ওদের কাছে উপস্থিত! নাদুস নুদুস চেহারার বঙ্কার দিকে সে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। এবার সে কালীর দিকে তাকিয়ে রোদে পোড়া কালসিটে মুখে, পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করে – "তুমি কাদের ঘরের মিয়া গ?" কালী কোন জবাব না দিয়ে চোয়ালে শক্ত করে বঙ্কা আর ওর মাকে টেনে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। অমনি আলাউদ্দিন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বঙ্কার পেটের তলায় হাত ঢুকিয়ে তুলে ধরে, বঙ্কা চার পা ছুঁড়ে ছটপট করতে থাকে। 'ম্যাঁ – ম্যাঁ' করে প্রতিবাদ করে। আলাউদ্দিন জাপ্টে ধরে ওর ওজন অনুমান করে বঙ্কাকে আবার মাটিতে নামিয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজে নিজে বিড় বিড় করে – "উঁ - উঁ, বেশ, বেশ, ভালোই …।" আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বঙ্কা ঘুরে গিয়ে দু'পা তুলে সজোরে গোঁত্তা মারে আলাউদ্দিনের পেছনে। অকস্মাৎ এই আক্রমণের জন্য আলাউদ্দিন প্রস্তুত ছিল না। পেছনে হাত দিয়ে সে অস্ফুট স্বরে কোঁকিয়ে ওঠে – "ইয়া আল্লা, এ তো ভারি দুশ্‌মন দেখছি, ওঃ..." কালী প্রায় দৌড়ে ওদেরকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।

আজ মনটা ভালো নেই কালীর। মনে মনে একটা আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। বঙ্কাকে নিয়ে ওর হাজারো চিন্তা। কী জানি কী হয়! সন্ধ্যেবেলা বঙ্কা আর তার মাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে পুকুর পাড়ে হাত, পা, মুখ ধুতে গিয়ে ফিরে দেখে ও পাড়ার বঙ্কিমবাবুর শহুরে জামাই পরিপাটি জামা কাপড় পরে দাওয়ায় বাঁশের মোড়ায় বসে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। কালী ভ্রূ কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা তালপাতার চাটাইতে বসে আর মা দূরে উনুনের কাছে দাওয়ার বাঁশের খুঁটিতে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় আধো ঘোমটা! কিছু বোঝার আগেই মা ডাক ছাড়ে – "হেই কালী , ইদিকে আয় একবারটি।" কালী আনমনা ভাবে মুহুর্ত থমকে থেকে পায়ে পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে যায়। কেমন একটা শঙ্কা মনে মনে ঘোরা ফেরা করতে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে বাঁশের গরাদ দেওয়া মাটির জানালার ফাঁক দিয়ে বঙ্কা অজানা আশঙ্কায় যেন "ম্যাঁ – ম্যাঁ" করে সাবধান করে দেয় – "কালীদি যাস না, যাস না।"

কাছে যেতেই মা গম্ভীর স্বরে কালী কে আদেশ করে – "যা, দা-বাবুকে পেন্নাম কর।" কালী কিছু বুঝতে পারে না। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মা এবার ঝেঁঝেঁ ওঠে –"কি হলো কতা কানে যাচ্চে নে?" অনিচ্ছা সহকারে কালী মাথা ঝুঁকে 'দা-বাবুর' দামী চকচকে কালো জুতো পরা পায়ে পেন্নাম ঠুকলো। তারপর সরে দাঁড়ালো দরজার কাছে। এবার 'দা-বাবু' উচ্ছসিত হয়ে কালী কে জিজ্ঞেস করে – "কালী , তাহলে! এবার শহরে যাবি, কত্তো কিছু দেখবি - গাড়ি ঘোড়া, মানুষ জন, পার্ক, সার্কাস, সিনেমা, টিভি আরো কত্তো কী! আর আমার বাড়িতে একটা ভাই আছে, তার সঙ্গে খেলবি, খাবি দাবি, মজায় থাকবি। ওই কথা রইল! কাল সকালে রেডি থাকবি। সকাল সকাল রওনা দেবো খন।" কালীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ওর মন একেবারেই যেতে চাইছে না। সে কাঁচু মাচু মুখে বলে – "কাল সকালে আমি ইসকুলে যাবো না?" মা বাবা কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে। কালীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু তার আগেই 'দা-বাবু' বোঝায় – "আচ্ছা, ঠিক আছে শোন, তুই ওখানে গিয়েও পড়াশুনা করবি। সঙ্গে বই খাতা নিয়ে যাবি। আমার কাছে, নাহলে বৌদির কাছে পড়বি!"

আজ সকাল সকাল হাঁড়িতে ভাত চাপানো হয়েছে। চারদিকে ভাতের গন্ধে ম ম করছে। অন্য সময় হলে কালীর খিদেটা বেড়ে যেত কিন্তু আজ আর খাওয়ার ইচ্ছেটাই নেই। কালীর মনে চাপা আতঙ্ক – শহরে কেনই পাঠাচ্ছে মা বাবা! এই গ্রাম, স্কুল, মাঠ, ঘাট তার বড্ড প্রিয়। বড্ড শান্তি। বড্ড আনন্দের। ওর শহরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। শহরের এত্তো আনন্দের উপকরণ ওর চাই না। তক্ষুণি কলা ঝোপের পাশ থেকে বঙ্কা 'ম্যাঁ – ম্যাঁ" করে কালী কে ডাক ছাড়ে, কখন তাদের এবার আলবাঁধে নিয়ে যাবে! কালীর চোখে জল এসে গেল। স্নান সেরে ভেজা চুল মুছতে মুছতে চেয়ে থাকে বঙ্কার দিকে। বড্ড মায়াময় চোখে চেয়ে আছে বঙ্কা আর তার মা। সে সহ্য করতে পারলো না। ঘরে ঢুকে গিয়ে বাঁশ বাখারিরি দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বাইরে যাওয়ার ও স্কুল যাওয়ার একটাই ফ্রক – ওটাকে পরে অনিচ্ছে সহকারে প্রায় তৈরী হল। খাটিয়ায় বসে পড়ল আনমনে। আজ আর কোন বকুনি নেই। সমস্ত ঘরময় শান্ত মেজাজ। সে মাটির তাক থেকে তার বই খাতা গোছাতে থাকলো। হঠাৎ পেছন থেকে কালীর মা কড়া গলায় বলে – "আর পড়াশুনা করতি হবি নি, বই খাতা রাখ। পণ্ডিত হবে! যা এবার গিলে তৈরী হ, বেলা বাড়চে তো..." সামনে কালীর বাপ বসন্ত সাউ একটা কাপড়ের পোঁটলা বগলে চেপে হাঁটে চলেছে। আর পেছনে কালী চোখ মুছতে মুছতে বাপকে অনুসরণ করতে থাকে। পেছনে মা ও ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে। কলা ঝোপের পাশ থেকে এবার জোড়া ডাক "ম্যাঁ – ম্যাঁ"। কালী নিজেকে সামলাতে পারলো না, দৌড়ে গিয়ে বঙ্কা আর তার মা বুড়িকে জড়িয়ে ধরল। হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বসন্ত দাঁড়িয়ে পড়ে। কী বলবে কিছু ভেবে পায় না। সঙ্গে সঙ্গে কালীর মা, আবার রাগীস্বরে চ্যাঁচাতে থাকে – "অনেক নাটক কইরেচিস। দেরি হয়ে যাচ্চে। বাপ এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে! আর উনি ওখানে পরহসন করতিচে। শহরে বাবুর বাড়ি ভালো খাবি, ভালো থাকবি - তা না এখন ন্যাকামো করতেচে!" কালী আর থাকতে না পেরে আরো জোরে কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে। জলে ভরা চোখে কালী মায়ের রাগী চোখ দুটো দেখতে পায়। কালী চোখের জল মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। বঙ্কা আর বুড়িকে মাথায় শেষ বারের মতো হাত বুলিয়ে সোজা বাপের দিকে ফিরে গেল। পেছনে ওরা সমানে "ম্যাঁ – ম্যাঁ" করে করুণ আর্তি জানাতে থাকলো। চোখ ছল্‌ ছল্‌, কাঁদো কাঁদো মুখে হাঁটতে হাঁটতে নিজের পাড়া, গ্রাম, ইঁট খোয়ার লাল রাস্তা, মুদির দোকান, শীতলা থান তার লাগোয়া বড় পুকুরে হাঁসেদের অলস বিচরণ ছাড়িয়ে বাঁকা রাস্তা মোড় নিয়ে এগিয়ে গেল বাস রাস্তার দিকে। এক সময় বঙ্কা – বুড়ির ডাকও মিলিয়ে গেল।

এবার দরাদরি শেষ! দেনা পাওনাও শেষ। কালীর বাপ-মা ভীষণ খুশীতে ডগমগ হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। ঘরে এখন আনন্দের ঢল।

কালী দি

আলাউদ্দিন যেন দানবের আকার ধারণ করেছে। মুখে জয় উল্লাসের পাশবিক ছাপ। বঙ্কার গলায় মোটা দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে চলে। বঙ্কা সমানে "ম্যাঁ – ম্যাঁ' করে ডাক ছাড়ছে। মাথা হেঁট করে জেদি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আলাউদ্দিন আবার সজোরে টান মারে। বঙ্কাকে ঘসটাতে ঘসটাতে এগোতে হয় আর গলায় চিপে যাওয়া দড়িতে ওর নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম, ফ্যাস ফ্যাসে গলায় "ভ্যাঁ –ভ্যাঁ' করে আওয়াজ করে। তবুও প্রণপণে সে যেন করুণ আর্তী জানায়। কোন ফল হয় না উল্টে আলাউদ্দিন আরো পাশবিক হয়ে ওঠে। এবার হাতের সরু বাবলার ছড়ি দিয়ে বঙ্কাকে পেটাতে থাকে। আলবাঁধে বাঁধা বঙ্কার মা 'বুড়ি' সমানে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে "ম্যাঁ – ম্যাঁ" করে। বার বার ছেলের দিকে দৌড়ে যেতে গিয়েও খোঁটায় বাঁধা দড়িতে উল্টো টানে আছড়ে পড়ে। আবার উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে যেতে গিয়েও আবার উল্টে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

চাঁদি ফাটা গনগনে রোদ শহরের ঘরবাড়ি, দোকান –পাট, গাড়ি – ঘোড়া যেন পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। কালো পিচ ঢালা রাস্তা গলে গরম হল্কা বইছে। নিশ্বাস প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার মধ্য দিয়ে ভ্যান রিক্সায় একদঙ্গল ছাগল চাপিয়ে, মোটা বড় বড় ফাঁসের জাল ঢাকা দিয়ে আটকে একটা ভ্যানওয়ালা তালে তালে প্যাডেল করতে করতে এগিয়ে চলেছে। পরণে হাফ হাতা সাদাটে গেঞ্জী ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে আর কালচে বারমুডা প্যান্টটার অবস্থাও একই রকম। মাথার গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে অন্য হাতে ভ্যানের হাতল ধরে এগিয়ে চলে। গরমের জ্বলুনিতে পেছনের ছাগলগুলোর আর্তনাদে তিতিবিরক্ত ভ্যানওয়ালা চ্যাঁচায় – "হুই, চুপ মার, চুপ মার ..." বঙ্কারও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সেই কোন সকাল থেকে একইভাবে বাঁধে রেখেছে ভ্যানের পাটাতনের সঙ্গে। নাভিশ্বাস উঠে আসছে। চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে গলার স্বর ফ্যাস ফ্যাসে হয়ে গেছে। তক্ষুণি ঝাপসা চোখে দেখা যায় সামনের ফুটপাতের ধারে ময়লা ফেলার চৌবাচ্চাতে নীলচে জামা পরা কালচে একটা মেয়ে ময়লা ফেলে খালি কালচে প্লাষ্টিকের ডাব্বাটা হাতে ফিরে যাচ্ছে! বঙ্কার কেমন সন্দেহ হল। আবার ভালো করে চেয়ে দেখতে থাকে। মেয়েটা কালী দি নয়তো! বঙ্কা ছটপট করতে থাকে। ততক্ষনে ভ্যানওয়ালা উল্টোদিকের 'মা কালী মিট সপের' সামনে দাঁড়ায়। দোকানের সামনে কাতগুলো ছাগলের ছাল ছাড়ানো দেহ লোহার আংটায় ঝুলছে। দেখে বঙ্কার বুকের ভেতরটা কাঁপে হিম হয়ে যায়। ওর ভীষণ ভয় পায়। তারস্বরে ফ্যাস ফ্যাসে গলায় চ্যাঁচায় "ম্যাঁ – ম্যাঁ" – কালী দি – কালী দি!

ভ্যানওয়ালা নেমে এসে জাল খুলে বঙ্কার মাথায় একটা রাম চাঁটি মেরে ঘাড় ও পেটের দিকটার শীরদাঁড়া চেপে ধরে দোকানের নিচের ঘুপচি ফোকর দিয়ে ওকে সজোরে ছুঁড়ে দিল। বঙ্কা হুড়মুড়িয়ে অন্ধকার ঘরের মধ্যে আছাড় খেয়ে পড়ল। সমস্ত গায়ে, হাত, পা যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকে, কঁকিয়ে কেঁদে চ্যাঁচাতে থাকে – "ম্যাঁ – ম্যাঁ" – কালী দি – কালী দি! ক্রমে সে ডাক মিলিয়ে যায় ঘন কালো অন্ধকারে চিরতরে।

কাগজে-কলমে গ্রাফিক ডিজাইনার। কিন্তু সে কাজ ছাড়াও ইনি নানা কাজ করেন - মাঝেমধ্যে ইচ্ছামতীর জন্য ছবি আঁকেন, মাঝেমধ্যে ভাল ভাল গল্প লেখেন, আর প্রয়োজন হলেই চাঁদের বুড়িকে নানারকমের সাদাকালো-একঘেয়ে-বিরক্তিকর কাজকর্ম (যেগুলি একটা ব-অ-ড় ওয়েবসাইট চালাতে গেলে করতেই হয়)-সেইসব করতে সাহায্য করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা