সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

খুব বৃষ্টি হয়েছে একদিন । রাস্তাঘাট জল থৈ থৈ । স্কুলে রেনিডে হয়ে গেছে । মিতুল নাচতে নাচতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কতক্ষণে নিজের ঐশ্বর্য্য ঘাঁটতে বসবে সেই নিয়ে মেতে উঠল । স্কুল থেকে ফিরেই মায়ের কাছে দুগাল খিচুড়ি আর পাঁপর ভাজা খেয়েই বসে গেল ছবি আঁকার খাতা নিয়ে । এদিকে বেশি বৃষ্টি হলেই পুরোণো বাড়ির ছাদ থেকে জল সিঁড়ি বেয়ে তিরতির করে পড়তে থাকে বাড়ির মধ্যে । ওদের বসার ঘরের দালানের সামনে, কয়েকবার সেই জলে আছাড় খেয়ে মিতুলের শিক্ষা হয়েছে খুব । তারপর থেকে পা টিপে টিপে চলে সে । সেদিন বৃষ্টির মেঘকালো দুপুরে ঠাকুমা ঘুমোচ্ছে, মা ঘুমোচ্ছে । মিতুল খানিক ছবি এঁকেই ভাবতে বসল বৃষ্টির জলটা ঠিক কোন পথ দিয়ে আসে সেটা বের করতে হবে । ছাদ তো এখন ফাইবার দিয়ে ঢাকা । জলটা তাহলে আসছে কোথা দিয়ে ? সেই রহস্য উন্মোচন করা নিয়ে তোলপাড় হল মিতুলের মন ।

রেনিডে প্রজেক্ট ।

তিনতলা বাড়ি তাদের । একতলা, দোতলা, তিনতলা..

জলের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল সে গুটিগুটি । সিঁড়ির ধাপ দিয়ে জল নেমেছে টসটস করে গড়িয়ে । আরো ওপরে ছাদ । ছাদ তো শুকনো কাঠ । গতবছর তার বাবা খুব খরচাপাতি করে ছাদের মাথায় রঙীন ফাইবার ঢেকে দিয়েছে । ছাদের ওপরে চিলেকোঠা । সে ঘর তো মিতুলের আয়ত্ত্বের মধ্যেই । দরজা টেনে শেকল তোলা থাকে । মিতুল এখন লম্বা হয়েছে । নিজেই হাত পায় । এক নিমেষেই শেকলটা খুলে ঘরে ঢুকল.. ঘরের মধ্যে ঢুকেই ধাক্কা খেল একটা বিশাল মাকড়সার জালে । নাক মুখ পুঁছে আলো জ্বালাল । টিমটিমে আলো । এঘরটায় কত কিছু থাকে, তবু বাড়ির লোকে যে কেন একটু জোরালো আলো দেয়নি এঘরে সেই নিয়ে মিতুলের মনে খটকা লাগল । হারুদাকেও বলতে হবে, ঘরটা নিয়মিত ঝাড়পোঁছ করার জন্য । তাহলে মাকড়সার জাল থেকে মিতুল নিস্তার পাবে । চিলেকোঠা জলে বেশ সপসপে এরমধ্যেই । সেই জল চৌকাঠ ডিঙিয়ে ছাদের একপাশ দিয়ে নীচে নেমেছে । কিন্তু ঘরে তো জানলা নেই । তার মানে ছাদ ফেটে জল পড়েছে । ওপরে তাকিয়ে দেখল ছাদে ফাটল রয়েছে । তাহলে তো ব‌ইপত্র, খাতা, পুরোণো কাগজ সব ভিজে একসা । মিতুল কাগজপত্র গুলো বাঁচাতে গেল । ঘরের দেওয়ালে পেরেকে ঝুলছে একাধিক ঝুড়ি, গোল কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো বালি চালার চালুনী, বেলচা, কোদাল, গাঁইতি...বাড়িতে মিস্ত্রি লাগলে এগুলো কাজে লাগে বলে রাখা থাকে । এসব মিতুল সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছে । একপাশে বিশাল কাঠের বার্কোশ দাঁড় করানো রয়েছে । তার পাশে একটা নৌকোর মধ্যে হাবিজাবি, আগডুম বাগডুম সব জিনিসপত্র রাখা আছে । সে শুনেছে, ঠাকুর্দার আমলে বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে ভিয়েন বসিয়ে মিষ্টি তৈরী হত । তখন রসের মিষ্টি রাখা হত এই নৌকায় । আর ঐ কাঠের বার্কোশে ছানা মাখা হত । দাদুর গাড়ির পার্টস খুঁজতে গিয়ে বাবা সব দেখিয়েছিল তাকে ।

মশা আছে চিলেকোঠায় । আর বর্ষার সময় মশা বাড়ে । নাহ্‌ আর এখানে বসে থাকাটা ঠিক হবেনা । শেষে মশা কামড়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া হলে আর রক্ষে থাকবেনা । অতএব এবার পাততাড়ি গোটাতে হবে মিতুলকে । জলরহস্য সমাধান হল বটে কিন্তু জলপড়াটা তো সে বন্ধ করতে পারবেনা, তার জন্য বাবাকে বলতে হবে মিস্ত্রীকে খবর দিতে। ছাদ থেকে জল পড়া বন্ধ না হলে ঠাকুমাও তো কোনদিন আছাড় খেয়ে পড়ে যাবে মিতুলের মত । সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেল একটু ।

একটা মস্ত লাটাই রয়েছে, ঘরের একপাশে দাঁড় করানো । তার পিছনের দেওয়ালে ঝুলছে বিরাট একটা একতে ঘুড়ি । মিতুল ঘুড়ি ওড়াতে জানেনা তবে বাবা নাকি দারুণ ঘুড়ি ওড়াতে পারে, শুনেছে সে ঠাকুমার কাছে । আরো কত কিছু দেখল মিতুল । লোহার একটা পাখীর খাঁচা আছে । ঠাকুর্দার টিয়াপাখী ছিল একসময় ।

পুরোণো হারিকেন, জুয়েল ল্যাম্প রয়েছে সারেসারে । বাবা গল্প করেছিল মিতুলকে "আমাদের সময় এত লোডশেডিং হত যে পরীক্ষার সময়েও আমরা হারিকেনের আলোতে পড়ে পরীক্ষা দিতাম"

মিতুল ভাবল এখন তো আর আলো যায়না তাই ওগুলো বাতিলের পর্যায়ে । আর এখন আলো হঠাত করে চলে গেলে তাদের এমার্জেন্সি ল্যাম্প আছে । ভাগ্যি সেই লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হয়নি মিতুলকে । একখানা পুরোণো জলচৌকি রয়েছে। তার ওপরে তোরঙ্গ । তার ওপরে কত পুরোণো ব‌ইপত্র । নিশ্চয়ই এগুলো দরকারী । নয়তো মা-ঠাকুমা ওজন দরে বিক্রি করে দিত , মনে মনে ভাবল মিতুল । ইস্‌ ভিজে গ্যাছে এক্কেবারে । এগুলোকে কাল রোদ উঠলেই শুকোতে দিতে হবে ছাদে । মনে মনে বলল সে । পুরোণো ফাইল রয়েছে একপাহাড় । মনে হয় বাবার দরকারী অফিসের কাগজপত্র । মায়ের প্র্যাকটিকাল খাতাও রয়েছে । কি সুন্দর আঁকত তার মা । তাই তো মিতুলের এত সুন্দর আঁকার হাত । মা আরশোলা, ব্যাঙ, মাছ সব এঁকেছে । পেন্সিলে আঁকা যত্ন করে । ডান দিকে একপাশে লাইন কেটে কি সুন্দর লেবেল করেছে মা । ঠিক যেমন করে তাকে আঁকতে শেখায় । কি সুন্দর আছে এখনো । এবার একটা পাতায় নানা রকমের গাছের পাতার ছবি । এটাও নীচে নিয়ে যাবে সে । কাজে লাগবে তার । এখন তো ক্লাসে এইসব পড়াচ্ছে তাদের । আবার শুকনো পাতাও যত্ন করে আটকেছে মা । বট, আম, অশ্বত্থ, তেঁতুল । খুব ইন্টারেস্টিং ! মা যে কি করে ! এতদিন মিতুলকে একবারো দেখায়নি এই খাতাগুলো । এবার ঠাকুমার একটা ভাগবত । এটা বোধ হয় খুব পুরোণো । খাস্তা পুঁথি হয়ে গেছে । ঠাকুমা এখন রোজ স্নান করে নতুন ভাগবত পড়ে । তার মানে এটা বোধ হয় আরো পুরোণো তাই বাতিলের পর্যায় ।

এবার একে একে সব খাতা-ব‌ইপত্র গুছিয়ে রাখতে গিয়ে একখানা পুরোণো খাতা খুঁজে পেল । খাতার ওপরে মলাট দেওয়া ।মলাটটা ছেঁড়া ছেঁড়া, ভেতরের পাতা গুলো লালচে হয়ে গেছে । মলাটের ভেতরে খাতার নাম "বঙ্গলিপি" ! পাশে পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ । কি সুন্দর নাম! মিতুল মনে মনে বলল ।

নীল কালির পেন দিয়ে লেখা। ভাগ্যিস জল লাগেনি এতে! তাহলে একদম বারোটা বেজে যেত কবিতাগুলোর । মিতুলের খুব শান্তি হল মনে । মা বলেছে কিছুদিন আগে অবধি ডট পেনে কেউ লিখত না । কালির পেনে লিখলে হাতের লেখা নাকি সুন্দর হয় । মিতুল তাই মায়ের কথা মত কালি ভরা ফাউন্টেন পেনে লেখে । মা বলেছে বাংলায় বলে ঝর্ণাকলম । অনায়াসে কালি নিবের মধ্যে চলে এসে ঝরণার মত লেখা দেয় খাতার ওপরে ।

খাতার ভেতরে প্রথম পাতায় যত্ন করে তার দাদুর নাম লেখা । পরের পাতায় লেখা "কালি, কলম, মন, লেখে তিনজন" ... ঠাকুমা খুব বলে কথাগুলো । এই তিনটে জিনিস একত্র না হলে লেখা নাকি মনের মত হয়না । খাতার মধ্যে প্রতিটি পাতায় কি সুন্দর গোটা গোটা হাতের লেখায় কবিতা লেখা রয়েছে । এই তো তার দাদুর সেই হারিয়ে যাওয়া কবিতার খাতা ! মিতুল একে একে উল্টে পড়তে লাগল । কিন্তু কবিতাগুলো বেশ গুরুগম্ভীর । এসব সে বুঝতে পারছেনা। হয়ত বড় হয়ে বুঝবে । যাক্‌ ! বাড়ির লোকে তো পড়তে পারবে । পুরোণো খাতার কেমন জানি একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ মিতুল অনুভব করল । বাবা হয়ত খুব খুশি হবে তার বাবার এই খাতাখানি দেখে । আচ্ছা বাবাকে বলে দাদুর এই কবিতাগুলোকে যদি ছাপিয়ে একটা ব‌ই তৈরী করা যায়? এবার ঠাকুমাকে গিয়ে দেখাতে পারবে তার ঠাকুর্দার সেই প্রিয় কবিতার খাতাখানি যেটি হারিয়ে যাওয়ায় ঠাকুর্দা খুব দুঃখ করতেন । ঠাকুমা আজ অবধি কত খুঁজেও সেই খাতার হদিশ পায়নি ।

চিলেকোঠার দরজা বন্ধ করে খাতাখানি হাতে নিয়ে মিতুল চুপিসাড়ে নীচে নেমে এল । যেতেই ধূপের গন্ধ পেল । দাদুর ছবির সামনে ধূপ জ্বলছে কেন অসময়ে ? দালানে দাদুর প্রকান্ড ছবির নীচে দাঁড়িয়ে খাতাখানি ছবিতে ঠেকিয়ে দাদুকে প্রণাম জানাল আর মনে মনে বলল " দাদু, আমি তোমার খাতাখানি খুঁজে দিলাম । তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো যাতে তোমার মত বড় হতে পারি" হঠাত নীচ থেকে শুনতে পেল মা চেঁচিয়ে হারুদাকে কি যেন বলছে । সিঁড়ির কাছে মুখ বাড়িয়ে মিতুল শুনতে পেল তার মা বলছে "সকাল থেকে বৃষ্টি নিয়ে যা হুলুস্থূল গেল এক্কেবারে ভুলে গেছিলাম... এখুনি বাজার থেকে একটা টাটকা রজনীগন্ধার মালা নিয়ে এসো তো হারু, আজ বাবার জন্মদিন । মালাখানি ওনার ঐ বড় ছবিতে পরিয়ে দিও । দাদাবাবু রাতে ফেরার আগেই এনে দাও, ওনার মনে পড়লে কষ্ট পাবেন ভীষণ । এই নাও টাকা । আমি ধূপ জ্বেলে দিয়েছি"

তাই তো! আজ তো আগষ্ট মাসের দশ তারিখ, মিতুলের দাদুর জন্মদিন । ঠাম্মাও আজকাল বড্ড ভুলে যায় সবকিছু । নিজেকে মিতুলের খুব অপরাধী মনে হল । কিন্তু দাদুর জন্মদিনে দাদুকে হারানো খাতাখানা উপহার দিতে পেরে মিতুল আনন্দে আত্মহারা তখন । সে কেন এমন ভুলে গেল? স্কুলের রেনিডে, বৃষ্টিতে জলমগ্ন মহানগরের পথঘাট আর তার পুরোণো বাড়ির জলরহস্যের কিনারা করতে গিয়ে আরেক পাওয়া হল বটে ! চীত্কার করে মা কে বলল মা, শিগগির ঠাম্মাকে নিয়ে দোতলায় এসো । আজ দাদুর হ্যাপি বার্থডে !

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা