সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
রূপকুন্ডের হাতছানি

হঠাৎ বাইরে একটা হৈচৈ শোনা গেল। কিছু বোঝার আগেই যারা আমাদের ঘরে ঢুকলো, তাদের দেখে তো আমরা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। বৈদিনী বুগিয়ালে যে দলটার সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল, তারা ফিরে এসেছে। ওদের কাছে ফিরে আসার কারণ শুনে, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বলা যায় ফিরে আসতে তারা বাধ্য হয়েছে। এখন বুঝতে পারছি, আমরা কত ভাগ্যবান। কত সহজে রূপকুন্ড দেখে, নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পেরেছি। সেদিন আমরা বৈদিনী থেকে চলে আসার পরে, ঐ প্রচন্ড বৃষ্টিতে ওরা বৈদিনীর বাংলো ও টেন্টে আশ্রয় নেয়। ওদের কুলিদের মধ্যে একজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সম্ভবত তার ঠান্ডা লেগেছিল। ওরা তাকে ওদের বুদ্ধি মতো ওষুধ দেয়। তাতেও সে সুস্থ না হয়ে, আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে থাকে। তখন ওরা তাকে কোরামিন দেয়, গরম সেঁক দেয়। কিন্তু এতকিছু করার পরেও, কুলিটা আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ওখানে না আছে ডাক্তার, না আছে পুলিশ। ফলে গাইডের কথা মতো, কুলিটাকে বৈদিনীতে কবর দিয়ে ওরা ফিরে এসেছে। এখন এখানে ওদের কুলিরা আরও অনেক লোক জড়ো করে ক্ষতিপূরণ দাবী করছে। ওরা তাই এ ব্যাপারে কী করা উচিৎ জানার, এবং এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য‌, আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছে।

একটা জলজ্যান্ত লোক, বিনা চিকিৎসায় অসহায় ভাবে মারা যাবার খবরটা শুনে আমরা খুব দুঃখ পেলেও, গঙ্গা আনন্দে নেচে নেচে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। একজন লোকের মৃত্যু যে আর একজন লোকের এত আনন্দের, নাচের কারণ হতে পারে, আগে জানা ছিল না। এইবার গঙ্গার কথায় তার এই নাচের কারণ জানা গেল। ওদের গাইড, রাম সিং গঙ্গার মামাতো ভাই হয়। এই ঘটনার পরে রাম সিং এর ওপর যাত্রীদের আস্থা কমে যাবে। পরোক্ষ ভাবে গঙ্গার ব্যবসা আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে।

নদীর এক পার ভাঙ্গে, অপর পার গড়ে। রাম সিং এর ব্যাড উইল, গঙ্গা সিং এর গুড উইলের কারণ, তাই এত নাচাকোঁদা। এখন মনে হচ্ছে আমার অসুস্থতায় তার এই ব্যস্ততা, তার এত ভয় পাওয়ার কারণও হয়তো সেই ব্যাড উইল।

যাহোক্, ওদেরকে বলা হ'ল কিছু টাকা পয়সা দিয়ে একটা বোঝাপড়া করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। গঙ্গাও তাই বললো। ওরা আমাদের ওদের সঙ্গে গিয়ে কুলিদের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করলো। কিন্তু সিতাংশু আমার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে, ওদেরকে নিজেদেরই কথা বলতে বললো। আমি বললাম, কাল প্রথম বাসেই ওদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। ওরা এখানে যত বেশী সময় নষ্ট করবে, ঝামেলা, চাহিদা, তত বাড়বে। ওরা এবার আমাদের সাথে এক বাসে কাঠগুদাম যাবার কথা বললো। ওরা ওদের দল ভারী করতে চাইছে। কিন্তু এতে আমাদেরও লাভ কম নয়। কাল সকাল থেকে গঙ্গারা আর আমাদের সাথে থাকবে না। বাড়ি ফিরতে এখনও অনেক, অনেক পথ বাকী। ওরা সঙ্গে গেলে অন্তত হাওড়া পর্যন্ত ওদের সঙ্গ পাওয়া যাবে। উপকার কতটা হবে জানিনা, তবু লোকবল তো প্রয়োজন হতেই পারে। ভোরের বাসে ফেরার কথা ঠিক করে, ওরা চলে গেল। আমরাও আর কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়া দাওয়া সারতে গেলে, আগের পরিচিত সেই হোটেল মালিক আমার অসুস্থতার কথা শুনে বললেন, বাবু বাড়ি ফিরে গিয়ে মা'র হাতের ইলিশ মাছের ঝোল ভাত খেলেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। কথায় আছে না—"চাকরি করি তো পুলিশ, মাছ খাই তো ইলিশ"। যাহোক্ খাওয়া সেরে ফিরে এসে, শুয়ে পড়লাম।

রূপকুন্ডের হাতছানি

আজও ঘুম ভাঙ্গলো বেশ ভোরে। রাতেই সিতাংশু গিয়ে গোয়ালদাম থেকে কাঠগুদামের বাসের টিকিট কেটে একবারে সামনের সিট্ রিজার্ভ করে এসেছে। আমরা তৈরী হয়ে বাসে গিয়ে একবারে সামনের সিটে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওরাও বাসে এসে বসলো। ওদের দেখে মনে হ'ল, ওদের টেনশন কমেছে। বোধহয় টাকা পয়সা নিয়ে একটা বোঝাপড়া হয়েছে। যাহোক্, সমঝোতা হলেই মঙ্গল। বাস ছাড়বার ঠিক আগে, আমার ডানদিকের সিটে জানালার ধারে সেই এভারেষ্ট বিজয়ী লামা সাহেব এসে বসলেন। বাস ছাড়তে গঙ্গারা হাত মেলালো। আস্তে আস্তে আমরা ওদের ছেড়ে চিরতরে দূরে চলে গেলাম। বাসের সিটে হেলান দিয়ে আধ শোয়া হয়ে চোখ বুজে রইলাম। শরীর একদম ভাল নয়। গায়ে বেশ জ্বর। অনেকটা পথ বাস জার্নি করে কাঠগুদাম। সেখান থেকে এক রাত্রি ট্রেন জার্নি করে লক্ষ্ণৌ। সেখান থেকে আবার এক রাত্র্রি ট্রেন জার্নি করে হাওড়া। আমার অবস্থার কথা শুনে নতুন সঙ্গীরা বললো, লক্ষ্ণৌতে নেমে ভাল ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করা যাবে। যাহোক্, কোনরকম নতুন ঝামেলা ছাড়াই আমরা একসময় কাঠগুদাম এসে পৌঁছলাম। ট্রেন আসতেই নতুন সঙ্গীরা কামরায় উঠে, আমার শোবার ব্যবস্থা করে দিল। আমাদের সিটের সামনে ওদের ও আমাদের সমস্ত মালপত্র এমন ভাবে রাখলো, যাতে সহজে কেউ আমাদের কাছে যেতে না পারে। রিজার্ভেশন পাওয়া না গেলেও, ওদের সহযোগীতায়, আমাদের বিশেষ কোন অসুবিধা হ'ল না। ওদের সেই বড় বড় কথাবার্তা বা হাবভাব আর নেই। রাতটা ভালোয় ভালোয় কেটে, একসময় আমরা লক্ষ্ণৌ এসে পৌঁছলাম। এখনও আমার জ্বর, চিকিৎসার অভাবেই বোধহয়, এতটুকু কমেনি।

ওরা ডাক্তার দেখাবার আগে, হাওড়ার রিজার্ভেশনের চেষ্টা শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত ওরা রিজার্ভেশনের ব্যবস্থাও করে ফেললো। তবে বিভিন্ন স্টেশন থেকে বিভিন্ন জনের, যখন যেরকম, যেখানে পাওয়া যাবে, শর্তে ব্যবস্থা হ'ল। ডাক্তার আর দেখানো হ'ল না। বেশ কিছু সময় আমাকে বসে যেতে হ'ল। অবশেষে আমার শোবার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। একে একে, আর সকলেরই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বার্থ পাওয়া হ'ল। গোটা ট্রেন যাত্রাটাই আমি প্রায় অচৈতন্য অবস্থায়, ঘুমের ঘোরে পড়ে থাকলাম। অবশেষে একসময়, শেষপর্যন্ত আমরা হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছতে সক্ষম হলাম। ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেল। সিতাংশু আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি একা বাড়ি যেতে পারবো কী না। আমি ওকে আমায় ট্রেনে তুলে দিয়ে যেতে বললাম। ও আমার মালপত্র, মানে প্রায় সব মালপত্র সমেত আমাকে ট্রেনে তুলে দিল। নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে, কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে, বাড়ি ফিরে এসে বিছানা নিলাম। ডাক্তার এলেন, পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু হ'ল। কোন রকমে পরের দিন অফিস জয়েন করে, সিক্ লিভ্ নিলাম। ওজন নিয়ে দেখলাম, আমার ওজন প্রায় পাঁচ কিলোগ্রাম এর ওপর কমে গেছে। হিমালয় মানুষের রক্ত শুষে নেয় বলে নাকি প্রবাদ আছে। তা নিক্, আমার তাতে কিছুমাত্র দুঃখ নেই।

ভবিষ্যতের রূপকুন্ড যাত্রীদের জানাই, রূপকুন্ড যাবার কষ্ট হয়তো অনেক, বিপদও হয়তো পদে পদে আছে, আমাদেরও হয়তো ফিরেই আসতে হ'ত, যদি না গঙ্গা সিংকে সাথে পেতাম। ওর ঠিকানা দিলাম। ওকে সাথে পেলে, বিপদ ও দায়িত্ব অর্ধেক কমে যাবে, এবং রূপকুন্ডে পৌঁছনোর নিশ্চয়তা দ্বিগুন বেড়ে যাবে।

গঙ্গা সিং,প্রযত্নে-বীর সিং নেগী, গ্রাম-পূর্ণা, পোষ্ট- দেবল, জেলা-চামোলী, উত্তর প্রদেশ।

(সমাপ্ত)


ছবিঃ ত্রিপর্ণা মাইতি

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা