সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
রাজা শুশুকের গল্প

আমার নাম রাজা। আমি আসলে একটা শুশুক। তোমরা যাদের ডলফিন বলো। জানি তোমরা কী ভাবছ! বুনো শুশুকদের আবার নাম থাকে নাকি? সমুদ্রের বুনো শুশুকরা তো সবাই শুশুক, বুড়ো শুশুক, বাচ্চা শুশুক, মা শুশুক, বাবা শুশুক এই রকম তাই তো? পোষা শুশুকদের অবশ্য অনেকরকম নাম থাকে শুনেছি। আমি যদিও কারও পোষা নই তাও আমার একটা নাম আছে। তোমরা যদি শুনতে চাও নামটা কী করে পেলাম তাহলে আমি তোমাদের আমার গল্পটা বলতে পারি। শুনতে চাও? তাহলে শোনো!

এটা যখন ঘটেছিল তখন আমি খুব ছোট। মার সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় ঘুরি। শুশুক ছানারা প্রায় দেড় বছর বয়স পর্যন্ত মার সঙ্গে ঘোরে তাই সঠিক কত বয়স ছিল বলত এপারব না। অবশ্য শুধু মা তো নয় আমাদের দলে আর প্রায় দশ পনেরো জন ছিল। সবাই আমাকে খুব আদর করত কারণ আমি ছিলাম সব চেয়ে ছোট। তা একদিন আমাদের সমুদ্রে বিশাল একটা ঝড় উঠল। উফ বাবা! কী ভয়ঙ্কর সেই ঝড়! সব কিছু উথালপাথাল ওলটপালট! মা খুব চেষ্টা করল আমাকে ধরে রাখার কিন্তু পারল না। আমি ছিটকে গেলাম। জলের সঙ্গে পাক খেতে খেতে কোথায় যে যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

যখন ঝড় থামল তখন দেখলাম আমি সমুদ্রের তীরে ডাঙার ওপর পড়ে রয়েছি। খুব ক্লান্ত লাগছিল আর নড়বার ক্ষমতাও তেমন ছিল না।খিদেও পেয়েছিল খুব। এমনিতে আমরা শুশুকরা জলের বাইরে ডাঙায় বেশ কিছুক্ষণ থাকতে পারি কারণ মানুষদের মতন আমরাও ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস নিই, মাছেদের মতন কানকো দিয়ে নয়। কিন্তু ডাঙায় থাকলেও আমাদের গায়ের চামড়াটা জলে ভেজা থাকলেই ভাল হয় নাহলে আমাদের কষ্ট হয়। আরো একটা ব্যাপার হল আমরা যদি জলে ভাসা ছেড়ে ডাঙ্গায় থাকি তাহলে আমাদের শরীরের ভিতরকার অঙ্গগুলোর ওপর একটা বারতি ছাপ পড়ে, সেটাতেই আমাদের শরীর আরো খারাপ লাগে। এই সব আমি এখন জেনেছি, তখন খালি বুঝছিলাম কষ্ট হচ্ছে। ভয়ে চোখ বুজে শুয়েছিলাম আমি হঠাৎ মানুষদের গলার স্বর শুনে চোখ খুললাম। দেখি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। আমি তখন নিজেই ছোট বলে বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন বুঝি ওরা ছিল নেহাতই বাচ্চা ছেলে মেয়ে। ছেলেটার তো আমাকে দেখে কী ফুর্তি। বলল, "ঈপ্সি দেখ দেখ একটা বাচ্চা ডলফিন!একে তুলে নিয়ে গিয়ে আমাদের বাড়িতে অ্যাকুয়েরিয়ামে রাখব!"

ঈপ্সি (পরে জেনেছিলাম ওর পুরো নাম আসলে ঈপ্সিতা) চোখ উলটে বলল, "তোর যেমন বুদ্ধি ধ্রুব! ডলফিনরা কত বড় হয় জানিস?তোর অ্যাকুয়েরিয়াম ফেটে চৌচির হয়ে যাবে!"

ধ্রুব তাও হাল ছাড়বে না, বলল,"ঠিক আছে, অ্যাকুয়েরিয়ামে না ধরলে চৌবাচ্চায় রাখব! কী দারুণ মজা হবে বল তো! সব বন্ধুদের দেখানো যাবে যে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এসে আমরা একটা ডলফিন ধরতে পেরেছি! আমি তো ওর নামও ঠিক করে ফেলেছি – রাজা!"

আমি তো ওর কথা শুনে ভয়েই কাঠ! ছেলেটা আমাকে ধরে নিয়ে গেলে তো মাকে, বাবাকে কোনদিন দেখতে পাব না।

ঈপ্সিতা এতক্ষণ আমাকে ভাল করে দেখছিল। এবার সে ধ্রুবকে বলল, "একদম বাচ্চা শুশুক রে ধ্রুব, তুই একে ধরে নিয়ে যেতে গেলে এ হয়তো মরেই যাবে!"

"না, না, আমি একে নিয়ে যাবই! রাজা আমাদের বাড়িতেই থাকবে!" ধ্রুব কিছুতেই কোন যুক্তি শুনবে না!

"ঠিক আছে নিয়ে যাস না হয়, কিন্তু ওর গায়ে দেখ কী সব জল, ময়লা লেগে আছে। এখন ওকে ধরলে তোর ভাল জামাতেও ওই সব লেগে যাবে। আর আঁশটে গন্ধও হবে। তুই বরং যা গিয়ে এক বালতি জল আর দুয়েকটা তোয়ালে নিয়ে যায়। ওকে ধুয়ে মুছে তারপর নিয়ে যাব, কেমন?"

"আমি যাব না ঈপ্সিতা, তুই যা!"

"আমার বয়েই গেছে যেতে! আমি তো ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই না। তুই চাস তাই তুই যাবি!" ঈপ্সিতা সহজ যুক্তি দিয়ে জানাল।

অগত্যা ধ্রুবকে যেতে হল। ধ্রুব চোখের আড়াল হতেই ঈপ্সিতা নোংরা টোংরার ভ্রুক্ষেপ না করে আমাকে জাপটে ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। আমার ওজন নেহাৎ কম ছিল না তাই ওর বেশ কষ্টই হল। কিন্তু জলে পড়ে আমার যে কী আরাম হল বলে বোঝাতে পারব না, আহ! সারা দেহটা যেন জুড়িয়ে গেল!আমি জল থেকে মুখটা একটু বার করে ওর দিকে তাকাতে ঈপ্সিতা বলল, "আমি জানি তুমি দলছুট হয়ে এখানে এসে পড়েছ। ধ্রুবটা একটা হাঁদা! সে একবারও ভাবছে না ওকে যদি কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে খাঁচায় পুরে রেখে দেয় তাহলে ওর কেমন লাগবে! বাই বাই রাজা! আশাকরি তুমি তোমার মা বাবাকে খুঁজে পাবে! যাও, অন্য কেউ দেখতে পাওয়ার আগে বা ধ্রুব এসে পড়ার আগে পালাও!"

চোখে জল নিয়ে আমি সমুদ্রের অগাধ জলে ডুব দিলাম। মানুষরা যে এত ভাল হয় তা আমার জানা ছিল না। মা তো বলেন ওরা নাকি আমাদের ধরে ধরে মেরে ফেলে কিন্তু ভালো মানুষও যে আছে সেটা আমি সেদিন টের পেলাম। দূর থেকে দেখতে পেলাম ধ্রুব বালতি আর তোয়ালে নিয়ে ফিরে আসছে! আমাকে দেখতে না পেয়ে সে রেগে লাফালাফি করতে লাগল!

আমি আর দাঁড়ালাম না, একটু দূর সাঁতার কাটতেই দেখতে পেলাম মা আর আমাদের দলটা! কী আনন্দ যে হল কী বলব! আমাকে দেখতে পেয়ে মাও খুব খুশি। আনন্দে চিঁহিঁ করে ডেকে উঠলাম আমি আর মা। যদিও আমাদের এই ডাকটাকে ঠিক ডাক বলা যায় না কারণ আমার স্বরযন্ত্র থাকে না। আমরা যে শব্দগুলো করি সেগুলো আমাদের শরীরের ভিতর থাকা হাওয়া ভরা থলি থেকে তৈরি হয়। বাতাসের আনাগোনাতে যে আওয়াজটা হয় সেটা আমরা করি আমাদের কপাল দিয়ে।

সেই ঘটনাটার পর অনেক বছর কেটে গেছে। আমি এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছি, কিন্তু আমার নামটা আমি ভুলিনি। সত্যি বলতে কী ধ্রুব ছেলেটাকে আমার পছন্দ না হলেও ওর দেওয়া নামটা আমার ভালই লেগেছিল! আমার দলের সঙ্গে মনের সুখে সাঁতার কাটি আমি সাগরের জলে। নৌকা করে মানুষ সমুদ্রে আসে আমাদের দেখতে। আমরাও তাদের দেখি কিন্তু চেষ্টা করি বেশি কাছে না যেতে। কখন কে জাল ফেলে ধরে ফেলে তার ঠিক আছে!

তবে আজকে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমাদের দেখতে আসা নৌকা থেকে হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে জলে পড়ে গেল। ছেলেটা সাঁতার জানে কিন্তু অল্প স্বল্প। কোন রকমে ভেসে রয়েছে। আমি দূর থেকে দেখলাম নৌকার লোকজন চিৎকার করছে কিন্তু কেউ জলে নামতে সাহস করছে না। সেটা কেন হবে?আগেও তো দেখেছি উৎসুক লোকজন নৌকা থেকে পড়ে গেছে কিন্তু তাদের তো চটপট তুলে নেওয়া হয়। জলে পড়ে যাওয়াটা তো আর নতুন কিছু নয়। তারপর হঠাৎ কারো জলে না নামার কারণটা দেখতে পেলাম! একটা হাঙর ঘুরপাক খাচ্ছে নৌকাটার কাছে! বাচ্চাটার মা-বাবাকে সবাই মিলে আটকে রেখেছে জলে নামতে দিচ্ছে না!

রাজা শুশুকের গল্প

নাহ আর সময় নষ্ট করলে চলবে না! দলের সবাইকে নিয়ে তীরবেগে ছুটলাম আমি নৌকাটার দিকে। হাঙর ব্যাটারা আমাদের জুজুর মতন ভয় পায়! আমাদের চিৎকার শুনে আর আমাদের ধেয়ে আসতে দেখে বাছাধন চোঁ চাঁ করে দৌড়ে পালাল! বাচ্চাটাকে আমি পিঠের ওপর তুলে নিলাম। কী আশ্চর্য সে একটুও ভয় পেল না উলটে খিলখিল করে হাসল! নৌকাটার আরো কাছে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলাম ওকে। লোকজন হইহই করে জলে নেমে ওকে তুলে নিল। দূর থেকে দেখলাম বাচ্চাটার মা-বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে।

ওর মা নৌকা থেকে চিৎকার করে বলল, "থ্যাঙ্ক ইউ রাজা!তোমার উপকার আমরা কোনদিন ভুলব না!"

একি! আমার নাম জানল কী করে ও? ওই নাম তো মোটে দুজন মানুষ জানে! তার মানে ওই কী সেই ঈপ্সিতা যে অনেক বছর আগে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল? জলে পড়ে যাওয়া বাচ্চাটা কী তাহলে ওরই ছেলে?

যাক, এতদিনে ওর উপকারের একটা প্রতিদান দিতে পেরে কী যে ভাল লাগছে কী বলব!


ছবিঃ পারিজাত ভট্টাচার্য্য

অনন্যা দাশ কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। নেশা বই পড়া আর গল্প লেখা। শিশুদের জন্যে সামাজিক গল্প ও কিশোরদের জন্যে রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসেন। বাংলাতে প্রকাশিত অধিকাংশ শিশু কিশোর পত্রিকাতেই লিখেছেন কোন না কোন সময়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা