সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
বোৎসোয়ানা

আগেরবার আলাপ করেছিলাম দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার সঙ্গে, এবারে চলো অন্য একটা মহাদেশে যাই। আফ্রিকার একটা 'ল্যান্ডলক্ড কান্ট্রি', অর্থাৎ চারপাশে স্থলভাগ দিয়ে ঘেরা দেশ বোৎসোয়ানা। আজ চলো এই দেশটির নানা জানা অজানা কথা খুঁজে আনার চেষ্টা করি আমরা।

ব্রিটিশ শাসনে থাকার সময়ের স্ট্যাম্প
ব্রিটিশ শাসনে থাকার সময়ের স্ট্যাম্প

১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে অব্দি এই অঞ্চল ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন, নাম ছিল বেৎসোয়ানাল্যান্ড প্রটেক্টরেট (Bechuanaland Protectorate)।

 আফ্রিকার মধ্যে বোৎসোয়ানার অবস্থান
আফ্রিকার মধ্যে বোৎসোয়ানার অবস্থান

দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকা, পশ্চিম আর উত্তরে নামিবিয়া, উত্তর-পূর্বে জিম্বাবোয়ে, উত্তরে জাম্বিয়া, এই হল বোৎসোয়ানার সীমানা। পুরোপুরি সমতল দেশটির প্রায় সত্তর শতাংশ এলাকা কালাহারি মরুভূমির অন্তর্গত।


কালাহারি মরুভূমি

জনঘনত্বের বিচারে আমাদের দেশের তুলনায় বোৎসোয়ানার অবস্থানটা বেশ মজার, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ, আর এই ব্যাপারে বোৎসোয়ানার র‍্যাঙ্ক ১৪৫। সবচেয়ে কম জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে একটি হল এই দেশ।

এবার একটু ভূগোল পড়ব, নাকি?


ওকাভ্যাঙ্গো ব-দ্বীপ অঞ্চল

দেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ওকাভ্যাঙ্গো (Okavango) ব-দ্বীপ বিশ্বের বৃহত্তম অন্তর্দেশীয় (Inland) ব-দ্বীপগুলোর মধ্যে একটা। উত্তরদিকে রয়েছে মাকগাডিকগাডি (Makgadikgadi) নামে একটি বিশাল সল্ট প্যান। লিম্পোপো নদীর অববাহিকা বোৎসোয়ানার বেশ কিছুটা জুড়ে রয়েছে। কেবল বোৎসোয়ানা নয়, আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের অনেকটা এলাকাই এই নদীর অববাহিকার অন্তর্গত। লিম্পোপো নদীর আবার অনেকগুলো উপনদী শাখানদী আছে, তাদের মধ্যে দেশের জল সরবরাহে নোৎওয়ানে (Notwane), চোবে (Chobe) ইত্যাদিদের ভূমিকা বেশ উল্লেখযোগ্য। চোবে(Chobe) দেশের উত্তরে নামিবিয়ার জাম্বেজি (Zambezi) নদীর সঙ্গে মিশেছে কাজুঙ্গুলা (Kazungula) বলে একটা জায়গায়, এই কাজুঙ্গুলা শহরটি ছোট্ট হলেও বেজায় রাশভারি , কারণ জাম্বিয়া, বোৎসোয়ানা, জিম্বাবোয়ে, নামিবিয়া - চার চারটে দেশের সীমানা নির্দেশ করে এই শহর।


স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ছবিতে দেখা যায় বাঁদিকে ঝাঁটার মত ওকাভ্যাঙ্গো ব-দ্বীপ অঞ্চল, আর পাশে মাকগাডিকগাডি সল্ট প্যান

বন্যপ্রাণীঃ


চোবে ন্যাশনাল পার্ক-এ হাতির দল

আফ্রিকার দেশ, বন্যপ্রাণী নিয়ে কথা হবে না, তাই কি আর হয়?
বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমাদের এবারের আড্ডার মধ্যমণি বোৎসোয়ানার চোবি ন্যাশনাল পার্কে বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক আফ্রিকান হাতিদের বাস। দেশের উত্তরাঞ্চলে বাস করে বিপন্ন প্রাণী আফ্রিকান বন্য কুকুররা, সারা আফ্রিকায় একমাত্র এখানেই এদের সংখ্যা কিছুটা বেশি। এদেশে জাতীয় উদ্যান ও গেম রিজার্ভ রয়েছে বেশ কয়েকটি। গেম রিজার্ভ কী জিনিস? এগুলো হলো এমন সংরক্ষিত অরণ্য যেখানে নিয়ন্ত্রিতভাবে শিকারের অনুমতি মেলে, যদিও এখন বোৎসোয়ানাতে ট্রফি হান্টিং নিষিদ্ধ।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেম রিজার্ভ হলো এই দেশের মাঝামাঝি অবস্থিত সেন্ট্রাল কালাহারি গেম রিজার্ভ।



ওপরেঃ কেপ স্টার্লিং, লাইল্যাক ব্রেস্টেড রোলার, গ্রেট পেলিক্যান
নীচেঃ প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার, কারমাইন বী ইটার, ক্রেস্টেড বারবেট

চোবি ন্যাশনাল পার্ক আর মরেমি গেম রিজার্ভ রয়েছে পাশাপাশি, চোবি ন্যাশনাল পার্কে আফ্রিকান হাতিদের বাস, প্রায় ৫০০০০ হাতি রয়েছে এই অরণ্যে। এছাড়া, জিরাফ, কেপ বাফেলো, গন্ডার, ওয়ার্টহগ, কুডু, ইম্পালা, সিংহ, জেব্রা ইত্যাদি তো আছেই। পাখিদের মধ্যে আছে কারমাইন বী ঈটার্স, স্পুনবিলস, আইবিস, নানা প্রজাতির স্টর্ক, হাঁস।


ওপরেঃ জিরাফ, বুনো কুকুর, ইম্পালা
নীচেঃ কুডু, ওয়ার্টহগ, চিতা

মরেমি গেম রিজার্ভে রয়েছে ঘাসজমি থেকে শুরু করে ঘন জঙ্গল, জলাভূমি, সবকিছু। ভূমিগত বৈচিত্র্যের জন্যই এখানে জীববৈচিত্র্যও বিশাল। এই অরণ্যে রয়েছে প্রায় ৫০০ প্রজাতির পাখি, এছাড়া প্রাণীদের মধ্যে কেপ বাফেলো, অ্যাঙ্গোলান জিরাফ, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকান সিংহ, হাতি, জলহস্তী, জেব্রা, দক্ষিণ আফ্রিকান চিতা, হায়েনা, ইম্পালা, রেড লেচওয়ে (Red Lechwe) ইত্যাদি দেখা যায়।


সদা ব্যস্ত মীরক্যাটের দল

এদেশের আরেকটি নামী প্রাণী হলো অনেকটা আমাদের কাঠবেড়ালির মতো দেখতে মীরক্যাট। এরা থাকে মরুভূমিতে, মাটির নিচে বাসা করে দল বেঁধে থাকে। এরা নাকি সবাই খুব কাজের মানুষ, ইয়ে, মানে ব্যস্ত প্রাণী, কেউ কক্ষনও হাত গুটিয়ে বসে থাকে না।

যদিও বোৎসোয়ানার প্রায় নব্বই শতাংশই সাভানা তৃণভূমির অন্তর্গত, দেশের অনেকখানি জমি কালাহারি মরুভূমির মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তবে এদেশে বড় গাছপালাও মোটামুটি আছে। প্রথমেই নাম করতে হয় বাওবাব গাছের। আফ্রিকার সঙ্গে বাওবাব গাছের ছবি এমনভাবে জড়িয়ে যে তাকে আলাদা করাটা মুশকিল। আমাদের যেমন 'বৃদ্ধ বট', এদেশে তেমন 'বৃদ্ধ বাওবাব'দের দেখা মেলে। ২০০০ বছরেরও বেশি পুরনো বাওবাব গাছ নাকি পাওয়া যায়। এছাড়া অ্যাকাসিয়া, প্যাপাইরাস, আফ্রিকান ম্যাঙ্গোস্টিন, সসেজ ট্রি ইত্যাদি গাছপালাও রয়েছে।


বাওবাব গাছ

বৃষ্টিপাত কম হওয়ার জন্য, দেশের মানুষজন জীবিকা নির্বাহের জন্য চাষবাসের ওপর একেবারেই নির্ভর করতে পারেন না, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষদের প্রধানত পশুচারণের ওপরেই নির্ভরশীল থাকতে হয়। দেশের প্রায় সত্তর শতাংশ জমি পশুচারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এই অতিরিক্ত পশুচারণের ফলে হচ্ছে কী, জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, ঘাস, গাছপালা জন্মাচ্ছে না, ভূমিক্ষয় হচ্ছে। এই কারণেই ওকাভ্যাঙ্গো বদ্বীপ অঞ্চলও ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে এই সমস্যার সমাধানের জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।


জাওয়ানেং হীরের খনি

বোৎসোয়ানার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো হীরে। সরকারী রাজস্বের প্রায় চল্লিশ শতাংশ আসে হীরে থেকে। বোৎসোয়ানা সরকার আর ডি বিয়ার্স কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা ডেবসোয়ানা (Debswana) হলো দেশের সবচেয়ে বড় মাইনিং কোম্পানি। বিশ্বের দুটি উল্লেখযোগ্য হীরের খনি এদের মালিকানাধীন, ওরাপা (Orapa) : বৃহত্তম হীরের খনি, আর জাওয়ানেং (Jawaneng)ঃ গুণমানের নিরিখে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হীরে পাওয়া যায় এখানে।

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা যাক, এদেশের মুদ্রা হলো পুলা (Botswanan Pula : Bwp)। এক পুলার মূল্য মোটামুটি সাড়ে ছয় ভারতীয় মুদ্রার সমান।

অন্যান্য দেশের মতো বোৎসোয়ানাতেও শিশুশ্রম একটি সমস্যা। যদিও শিশুশ্রমের হার কমানোর জন্য সরকারি ভাবে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষজনের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য, ন্যূনতম প্রসাধনসামগ্রী, স্কুল ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে ২০১৬ সালে UNICEF-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বোৎসোয়ানার ১৬ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার্থী শিশু স্কুলে যায় না। শিশুশ্রম ব্যবস্থার শিকার এদেশের প্রায় ৯ শতাংশ শিশু। তাদের মধ্যে বহু শিশুকে যেমন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পশুচারণের কাজে লাগানো হয়, তেমন অনেক শিশুকিশোরকে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন খারাপ ব্যবসার কাজেও লাগানো হয়।

বোৎসোয়ানার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের শিশুশ্রম সম্পর্কে সচেতন করার এক কর্মসূচীর অংশ হিসেবে বেশ কিছু বছর আগে UNICEF-এর কর্মী ডিজিটাল ডায়েরিস্ট শোলোফেলো সেলুফারো কিছুদিন কাজ করেছিলেন। সেসময় তিনি এক গ্রামে একটি ছোট্ট ছেলের কাছে শোনেন তার লেখা একটি কবিতা :

।।'আমরাই ভবিষ্যৎ'।।

জেনে খুব কষ্ট হয়।
আমার ভাই রয়েছে খালি পায়ে
পশু চরানোর কাজ করছে,
দাম নেই, ওর কাজের দাম নেই কোনও।
আমার বোনটা...
ভেবে চোখে জলের বান আসে।
ওর বাড়ির অবস্থা ভালো নয়
নিষ্ঠুর লোকগুলো সুযোগ নেয় তাই,
দাসত্বে বেঁধে ফেলে ওকে
দাম নেই, ওর কাজের দাম নেই কোনও।
তবুও, আমরাই ভবিষ্যৎ।।

(।।The Future is us।।
It's so painful to know
That my brother is working barefooted
At the cattle post for no pay.
As for my sister,
The thought of it floods my eyes with water.
Those who are heartless take advantage of her
Because of her family background
Enslaving her for nothing.
Yet the future is us.)

এই কবিতার সূত্র

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা