খেলাঘরখেলাঘর



তুতুলের চোখ ছলছল। তাই দেখে মা গল্পের গতি বাড়িয়ে দেন,
“এমন সময় একদিন এক বুড়ো এলো সেই দেশে। লাঠিতে ভর দিয়ে চলছে, শনের নুড়ির মতো চুল ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ছে।
“আমায় কিছু খেতে দেবে গো?” এক চাষীর দোরে এসে হাঁক পাড়ে সে।
“খেতে হয়তো কষ্টেছিষ্টে দিতে পারি, কিন্তু জল মিলবে না।” কান্না-কান্না মুখ করে বলে চাষী।
“ও, তাই বুঝি!” গম্ভীর চালে মাথা নাড়ে বুড়ো। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে তার গায়ে একটু জোর ফিরে এলো। তখন সে ধীরে ধীরে বললো, “শুনেছি, জীয়ন ঝর্ণার জল আছে রামধনুর দেশে। আকাশের ঐ পারে যেখানে রামধনুটা মাটিতে গিয়ে মেশে, সেখানে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ছে এক মিষ্টি জলের ঝর্ণা। সেই জল এক বোতল যদি কেউ নিয়ে আসতে পারে, তবে তা ছিটিয়ে দিলে মরা মানুষ সব আবার বেঁচে উঠবে, শুকনো খাল-বিলও ভরে উঠবে জলে।
“তবে এ কাজে ঝামেলাও যে নেই, বলবো না। এক বিরাট দৈত্য আছে নাকি সে দেশে। সারা দিনরাত সে ঝর্ণা পাহারা দেয়। তার ভয়ে কেউ ওমুখো হয় না।”

“মা, রাজকন্যার গল্প নয় কিন্তু! ওসব সোনালীর মতো বাচ্চারা শোনে।” তুতুল বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গীতে বলে।
মায়ের মুখ এক সুন্দর হাসিতে ভরে যায়। “ও, তাই নাকি – বুঝতেই পারিনি আমাদের তুতুলবাবু কত বড় হয়ে গেছে!” বলে তিনি আবার শুরু করেন,
“তাই শুনে এগিয়ে আসে চাষীর ছেলে সুজন। টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলে, ‘দাদু, কেউ না যায় আমি যাবো সেই জল আনতে। তুমি শুধু বলে দাও সেখানে যেতে হলে কী কী করতে হবে।’
“বুড়োর মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সুজনের পিঠ চাপড়ে বলে, ‘তোমার মতো সাহসী ছেলেই পারবে সে জল আনতে। তবে কয়েকটা কথা মনে রাখবে।
‘প্রথম কথা – দৈত্যকে মারতে তলোয়ার চাই। আজই কামারভাইকে দিয়ে বানিয়ে নাও এক ধারালো তলোয়ার।
‘দ্বিতীয় কথা – যখন পথ চলবে, চোখকান খোলা রাখবে। অসহায় জীবের প্রতি দয়াধর্ম করবে।
‘আর শেষ কথা – এই জীয়ন ঝর্ণার জল অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে, মরা মানুষকে প্রাণ দেয়। কিন্তু হুঁশিয়ার – কোনো মানুষ যদি দুষ্টু হয়, লোক ঠকিয়ে খায়, তবে এই জল তার গায়ে ছিটিয়ে দিলে সে উলটে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।’

“মা, আমি আর চিনি চুরি করে খাবো না।” তুতুল মা’কে আঁকড়ে ধরে।
“ওমা, তুতুল তো আমার লক্ষ্মী সোনা – সে আবার দুষ্টু হলো কবে!” তুতুলকে একটা চুমো দিয়ে মা আবার গল্প শুরু করলেন,
“তারপর বুড়ো তো লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে চলে গেলো। আর কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে সুজন তৈরি হলো রামধনুর দেশে যাবার জন্যে।
“রাজার চর কিন্তু খবরটা রাজার কানে তুলে দিলো। আর যায় কোথায় – সেপাই এসে সুজনকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলো রাজার কাছে।
“কিরে, আমায় না জানিয়ে পালাচ্ছিস যে বড়ো?” রাজা তর্জন করে। কী আর বলবে, সুজন চুপ করেই থাকে।
“যাক, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আসার সময় আমার জন্য সেখান থেকে সোনার ফুল, হীরের পাখি আর মণি-মানিকের গাছ নিয়ে আসবি। নইলে তোর ঘাড়ে মাথা থাকবে না।”
“রাজার কথা শুনে সুজন কাঁচুমাচু মুখে ঘাড় নাড়ে। তারপর গুটিগুটি পায়ে ফিরে আসে।
 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।