খেলাঘরখেলাঘর


“এবার বেঁচে উঠে আরো বড় হয়েছে সুজন। আবার আসে দৈত্য। সে যা একখান লড়াই হয়, সবার অনেকদিন মনে থাকবে। এবারেও জেতে দৈত্য। তবে সে টলছে, ভালো করে চলতে পারছে না। তার সারা শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে।
“দেখি, এবার কোন পশু-পাখি তোকে বাঁচায়!” বলে সে ঝর্ণার পাশে নিয়ে যায় সুজনের শরীরটা। তারপর তাকে আড়াল করে নিজে সটান শুয়ে পড়ে।
“বাঁদর-বেড়ালের তো মাথায় হাত! ঐ পাহাড়ের মত দেহের আড়ালে কী করে সুয্যিমামার চোখ পৌঁছোবে! তাহলে কি আর সুজন বাঁচবে না? চোখের জলে ভাসে তারা। শেষে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে আকূল হয়ে মৌমাছি বন্ধুকে স্মরণ করে।
“এসে গেছি, বন্ধু!” গুনগুন করতে করতে ছুটে আসে মৌমাছি। বেড়াল, বাঁদর সব খুলে বলে তাকে। “হুঁ, এই ব্যাপার! দাঁড়াও, পাজি দৈত্যের জারিজুরি বন্ধ করছি”, বলে উড়ে ফিরে যায় মৌমাছি।
“ভোর হবো হবো করছে। মজাসে ঘুমোচ্ছে দৈত্য। এমন সময় লাখ লাখ মৌমাছির এক ঝাঁক তাকে আক্রমণ করে। কামড়ের পর কামড়, কামড়ের পর কামড় – হুলের জ্বালায় দৈত্য অস্থির হয়ে ওঠে। শেষ অবধি আর থাকতে না পেরে উঠে জঙ্গলের দিকে দৌড় লাগায়।
“সুয্যিমামা তখন উঠে পড়েছেন। তাঁকে দেখে আনন্দে নাচতে থাকে জীয়ন ঝর্ণা। আর তার একটা বড়সড় জলের ঝাপটা এসে আবার সুজনকে জাগিয়ে তোলে। বাড়তে বাড়তে এতদিনে দৈত্যের প্রায় সমান হয়ে উঠেছে সুজন। শক্ত হাতে তলোয়ার ধরে এবার সে শেষ লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়।
“দৈত্য আসে। তারপর চলে সেই লড়াই যা আগে কেউ কখনো দেখেনি, পরেও কখনো দেখবে না। তিনদিন, তিনরাত সমানে যুদ্ধ চলে। দেখেশুনে সুয্যিমামাও যেন পূব আকাশে উঁকি মারতে ভয় পান। তারপর একসময় সুজনের তলোয়ারের কোপে দৈত্যের মাথাটা ছিটকে যায়।
“বনজঙ্গল ভেঙে হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দৈত্যের পেল্লায় লাশ। তারপর আর কী? নিশ্চিন্তে ঝর্ণার জল ভরে নেয় সুজন। হঠাৎ দেখে, আলোয় আলো হয়ে উঠেছে চারদিক। আবাক হয়ে সবাই ওপরে তাকায় – দেখে, আকাশ জুড়ে আবার দেখা দিয়েছে এক সাতরঙা রামধনু।

“গাঁয়ে ফিরে চলে সুজন। ‘চলো, তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’ সাথে সাথে চলে তিন বন্ধু।
“খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে আসে রাজা। ‘দাঁড়াও, একটু মজা করা যাক’, বুদ্ধি-পরামর্শ করে তিন বন্ধু। তারপর মৌমাছি সাজে সোনার ফুল, বেড়াল হীরের পাখি আর বাঁদর মণি-মানিকের গাছ।
“কী রে, এনেছিস আমার জিনিস – আরে, ঐ তো!” লোভে রাজার চোখ জ্বলে ওঠে। সব কিছু ভুলে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। আর তখন সুজন তার গায়ে ছিটিয়ে দেয় জীয়ন ঝর্ণার জল। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যায় দুষ্টু রাজা।
“তারপর আর কী! সারা রাজ্যে নদী-নালা-পুকুর-মাঠে জীয়ন ঝর্ণার জল ছিটিয়ে দেয় সুজন। বেঁচে ওঠে শুকিয়ে মরে যাওয়া যত মানুষ। আর তারপর আকাশ কাঁপিয়ে নামে তুমুল বৃষ্টি। নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর সব জলে থৈ-থৈ করতে থাকে। সবুজ সবুজ গাছপালায় চারদিক ছেয়ে যায়। ধানে মাঠ ভরে ওঠে।”

বড় আনন্দ! এতক্ষণের চেপে রাখা কষ্টটা এবার একটু একটু করে গলে বেরিয়ে আসে। দু’চোখ ঝাপসা হয়ে যায় তুতুলের। ভেজা চোখের পাতায় সে দূর আকাশের রামধনু দেখে।
“মা, বড় হয়ে আমি জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে যাবো।” ফিসফিসিয়ে বলে তুতুল।
“যেও, সোনা।” হঠাৎ বালিশে মুখ লুকিয়ে ফ্যালেন মা। তুতুল তাঁর কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে মায়ের চুল থেকে। জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় তুতুল। স্বপ্নে এক টুকরো ছোট্ট হাসি তার মুখে লেগে থাকে।


 

অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।