সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ভোলা

চৈত্রের চাঁদিফাটা রোদে পিচ গলা রাস্তায় প্রায় লোকজন নেই বললেই চলে। ওদিকে 'হাই-রোডে' ট্রাক, টেম্পো, ডাম্পার, গাড়ি সব সার দিয়ে ঝিমোতে ঝিমোতে ক্লান্ত শরীরে এগিয়ে চলেছে। সে ছবি এখান থেকে কাঁপা কাঁপা মরীচিকার মতো দেখা যায়। এদিকে বড় সিমেন্ট কারখানার হাজারো নাড়ি ভুঁড়ি জড়ানো কলকব্জার উপর মোটা চিমনী থেকে গল্ গল্ করে সাদা ধোঁয়া সোজা উপরে উঠে নীল আকাশের কোন গভীরে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। আর কারখানার গেটের সামনে কতগুলো ট্রাক সার দিয়ে দাঁড়িয়ে এই রোদে শাস্তি ভোগ করছে। তার উল্টোদিকে ছোট ছোট অস্থায়ী বাঁশ বাখরি ঘেরা কালো পলিথিনের ছাউনি দেওয়া চা দোকান, ভাতের হোটেলে দু - একজন ড্রাইভার, খালাসি জিরিয়ে নিচ্ছে।

ভোলা আজ ভোলানাথ সেজেছে। আর কিছুদিন বাদে চৈত্র সংক্রান্তি। তাই ওর সাজ এইরকম। টায়ারের জুতো পায়ে থপ্ থপ্ করে সেই গলে যাওয়া পিচ রাস্তায় খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ময়লা ফ্যাকাসে হাফ প্যান্টের উপর বাঘ ছালের মতো কমলার উপর কালো ডোরাকাটা মলিন কাপড় জড়ানো। তার একটা কোন টেনে বাঁদিকের ঘাড়ের উপর পেঁচিয়ে পিঠের দিকে একটা নীল প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে বেঁধে ডান দিকের কোমরে প্যান্টের সঙ্গে গিঁট দিয়ে বাঁধা। মাথায় শনের বাদামি জটা। বাঁ কাঁধে গেরুয়া ঝোলা আর টিনের মরচে পড়া ত্রিশূল। ডান হাতে খেলনা ডুগডুগি মাঝে মধ্যে ‘ভড্র – ভড্র’ করে বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার পাশের দোকানগুলো থেকে তখন কেউ কেউ টিপ্পুনি কাটে – "বোম্ – বোম্ ভোলে – হর হর মহাদেব…" ভোলা তখন ওদের পাত্তাই না দিয়ে এগিয়ে চলে সামনে। ওকে দেখে কেউ মস্করা করতে দেখলেই ও পাশ কাটিয়ে দূরে চলে যায়।

যে দোকানে ভীড় কম বা খদ্দের নেই বললেই চলে সেখানে ভোলা স্বস্তি বোধ করে, তখন সে কয়েকবার ডুগডুগি বাজিয়ে নীরবে দোকানদারের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। কেউ দয়া করে পয়সা দিলে তা ঝোলায় চালান করে, এবার অন্য দোকানের দিকে এগিয়ে চলা। সামনের শিরীষ গাছের ছায়ায় চা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর পারা যাচ্ছে না, পেটে ছুঁচোর ডন। তবুও সে তার ডুগডুগিটা বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দোকানদার ভেতরে বসা খদ্দেরদের চায়ের গ্লাস দিয়ে ফিরে এসে দোকানের সামনে ভোলাকে দেখে মজা পায়। সবুজ লুঙ্গির উপর লালচে মলিন গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে মুচকি হাসি হেসে বলে – "আরে এ তো দেখি কচি ভোলের উদয় হয়েছে রে!" অমনি ভেতরে হাসির রোল। দোকানদার এক টাকার একটা 'কয়েন' ভোলার দিকে এগিয়ে দেয়। ভোলা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। দোকানদার ভ্রূ কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সুরে জিজ্ঞেস করে – "কী হল! পছন্দ হচ্ছে না? এর থেকে আর বেশি দিতে পারবো না, চ্যাল্…" ভোলা কাঁচুমাচু মুখে অনুরোধ করে - "কাকু, বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে কিছু খেতে দেবে?" দোকানদার চায়ের কেটলি দিয়ে গ্লাস ধোয়া বন্ধ করে মুহূর্তে ভোলার মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখল। তখন ভেতরের খদ্দেরের একজন বলে – "হেই ভোলে, দেখা তোর নাচন।" ভোলা যেন তৈরী ছিল,নিমেষে উত্তর দেয় – "দেখাবো। খাওয়াবে তো?" দোকানদার তখন ঘুগনি গামলির ঢাকনা 'ঘড়াং' করে খুলে গামলিটা কাত করে দেখে নিয়ে বলে – "তোর ভাগ্যেই বোধ হয় ছিল। হয়ে যাবে। নে শুরু কর…"

ববম – ববম – বম্
ভোলা বোম, ভোলা বড় রঙ্গিলা
লেংটা ত্রিপুরারি শীরে জটাধারী
ভোলার গলে দোলে হাড়ের মালা…।

ভোলা মাথার উপরে দুহাতে ত্রিশূল নিয়ে পা তুলে তা থৈ নাচ শুরু করতেই ভোলার পায়ের ব্যাথাটা আরও বেড়ে যায়। যন্ত্রণা বাড়তে থাকে তবুও সে নাচতে থাকে, নাচের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি করে, লোক হাসানোর চেষ্টা করে। না করলে পাছে যদি খাবারটা না জোটে তাই যন্ত্রণা ভুলতে সে আবারো জোরে গলা ছেড়ে, মোটা মেঠো গলায় গান গাইতে থাকে। ততক্ষণে দু একজন একে একে গাছের তলায় জড় হতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে নাচ থামিয়ে মুখ ফুলিয়ে হাতের ডুগডুগি বাজিয়ে মুখে 'ববম – ববম – বম…' শব্দ করে। তাই না দেখে সব্বাই হেসে কুটোপাটি! আবার অন্য এক ভঙ্গিমায় নাচ শুরু।

খাওয়া শেষ করে 'ঢক্ – ঢক্' করে আধ ময়লা নীল প্লাষ্টিকের মগের পুরোটা খেয়ে একটু স্বস্তি বোধ করে সে। বেঞ্চে বসে জিরোতে থাকে। পায়ের ব্যাথাটা এবার জ্বালাতে শুরু করছে। পেছনের বেঞ্চে বসা লোকগুলোর মধ্যে একজন জানতে চায় – "হেই ভোলে – থাকিস কোথায়?" ভোলা চুপ করে থাকে। কোন উত্তর দেয় না। ভোলা জানে এবার হাজার একটা প্রশ্ন শুরু করবে –
"কোথায় থাকিস?"
"কে কে আছে তোর?"
"বাড়ীর কাজ করবি? দুবেলা খেতে পাবি। মাসের শেষে বেতন পাবি… ভিক্ষে করতে হবে না…"
ভোলা নীরবে ওর ঝোলা, ত্রিশূল তুলে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসে। পেছনে বসা সেই খদ্দেররা খোঁচা দিয়ে বলে – "কী রে খাওয়া শেষ, অমনি হয়ে গেল!" ভোলা খোঁড়াতে খোঁড়াতে নীরবে সেই রোদে বেরিয়ে পড়ল।

এদিকটা ফাঁকা। বাজার শেষে খালি পড়ে আছে ত্রিপলের ছাউনি বাঁশ বাখারির পাটাতনের কাঠামো। সকালে এখানে সব্জি, ফল, মাছের বাজার বসে জমিয়ে। তারপর বেলা বাড়লে সব ফাঁকা। এর পর একটু এগোলেই ইট পাথরের ইমারত। হাজার একটা রকমারী দোকানদানী। এখন সব বন্ধ। চারদিক খাঁ খাঁ করছে। ভোলা একটা খালি বাঁশ বাখারির পাটাতনে বসল। কাঁধের ঝোলা নামিয়ে রেখে পরনের ডোরাকাটা কাপড় খুলে ফেলে সামনে মেলে ধরে। কয়েকটা জায়গায় ফেঁসে গেছে। সে এবার বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল আরাম করে কিন্তু ডান পায়ের ব্যথাটা বেশ জ্বালাচ্ছে! জুতো ক্ষয়ে গিয়ে রাস্তার নুড়ি পাথরে ঘষা খেয়ে গোড়ালিতে ঘা হয়ে গেছে। বেশ ভোগাচ্ছে। ঝোলার ভেতর থেকে একটা প্লাস্টিকের কৌটোর মধ্য থেকে লাল মলম বের করে ব্যাথায় লাগাল।

ঝোলা থেকে সুঁচ সুতো বের করে। তারপর বাঘছাল কাপড়ে ফেঁসে যাওয়া জায়গাটা সামনে মেলে ধরে। বাদামী সুতো সুচের পেছনে গলিয়ে পরপর সেলাই করতে থাকে। আর তখনই মনে মনে হাজার একটা ভাবনা ভেসে বেড়াতে থাকে। ও কখন যেন ছোট্ট বেলায় হারিয়ে গেল। ওদের পাড়ায় বলরাম দাসের গাজনের দলে বাব শিব সাজত। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় মহড়া চলত। পড়া ফেলে ভোলা প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা বন্ধুদের সঙ্গে মহড়ায় গিয়ে বসে থাকত আর অবাক হয়ে বাবার অভিনয় দেখতো। বাবা এমন সব অঙ্গ ভঙ্গি করে সবাইকে হাসাতো যে দর্শক হেসে কুটোপাটি যেতো। এ অঞ্চলে বাবার অভিনয়ের খ্যাতি সবার জানা ছিল। ভোলার বেশ লাগতো। ও একা একা বাড়িতে দেওয়ালে ঝোলানো ছোট্ট আয়নার সামনে বাবার মতো করে অঙ্গ ভঙ্গি করে অভিনয় অনুকরণ করতো। বেশ মজা আছে এই অভিনয়ে! ওকে কেমন অভিনয়ের নেশায় পেয়ে বসল। স্কুলে বন্ধুদের সামনে এই অঙ্গ ভঙ্গি করে সবাইকে হাসিয়ে বেশ বাহবা পেত।

বীরশিবপুরে তখন নতুন নতুন কারখানা তৈরী হচ্ছে। নরম কাদা জমির মাটি কেটে সব লোহা লক্কড় পোঁতার কাজ চলছে। ভোলার বাবা সেখানে জন মজুর খাটতে যেত। বাবা কোদাল দিয়ে মাটি কেটে ঝুড়ি বোঝাই করছিল হেলে দুলে, আর মুখে তালে তালে গাজনের গান। তার সঙ্গে বাকিরাও একসঙ্গে গানে মশগুল হয়ে মজায় কাজে মেতে ছিল। হঠাৎ করে কোদালটা মাটির ভেতরে কী একটা যেন পুরানো মরচে পড়া লোহায় সজোরে ধাক্কা খেয়ে 'ঠ্যাং' করে আওয়াজ হল, আর কোদালটা ফিরে এসে সজোরে আঘাত করলো বাবার পায়ের গোড়ালিতে। গান থেমে গেল। বাবা মুহূর্তে সংজ্ঞা হারাল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই লোহার ধারালো চাঁইয়ে। সব্বাই দৌড়ে এলো। রক্তাত অবস্থায় বাবাকে সবাই মিলে ধরে নিয়ে গেল উলুবেড়িয়ার হাসপাতালে।

এখন ভোলার বাবা খোঁড়া পায়ে বাড়িতেই বসে থাকে আর গুনগুন করে গান করে চলে। আবার কখনো চুপ করে উদাসভাবে চেয়ে থাকে দূরে বলরাম দাসের আখড়ার দিকে, আর গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাঝে মধ্যে ক্র্যাচে ভর দিয়ে আখড়ায় চলে যায় আর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, সবাই তখন সান্ত্বনা দিতে থাকে। ভোলা দৌড়ে বাজারের খাবার হোটেলে যায় মায়ের কাছে। মা তখন হোটেলের থালা বাসন মাজা ফেলে দৌড়ে যায়। তারপর বাবাকে ধরে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে বাড়ি নিয়ে আসে। বাবা তখন একেবারে ছেলেমানুষ। শুধু শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে কপাল চাপড়ে অদৃষ্টকে বারে বারে দোষারোপ করতে থাকে।

বেলা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। ভোলা উঠে দাঁড়ায়। সেলাই করা বাঘছাল কাপড়টা কোমরে পেঁচিয়ে, হাতে ত্রিশূল ও বাঁ কাঁধে ঝোলাটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। পায়ে ব্যথা লাগে তবুও খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে থাকে। তক্ষুনি পেছন থেকে কতগুলো স্কুল ফেরৎ ছেলে পিঠে বইয়ের ব্যাগ সামলে হৈ হৈ করে দৌড়ে এল ভোলার দিকে। ওরা ভোলার সঙ্গে সমানে হাঁটতে হাঁটতে মজা করে বলে – "হেই রে ভোলা— দেখি তোর ঝোলা!" একটা কালো কুদমো মতো ছেলে এসে ভোলার সামনে নাচতে নাচতে, ঘাড় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ভেংচি কাটে – "কিরে ভোলা!— চললি কোথা?" ভোলা ওদের কথা না শোনার ভান্‌ করে সামনের দিকে তাকিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। পেছনের ছেলেগুলো এবার রে রে করে চ্যাঁচায় – "বোম্‌ বোম্‌ ভোলে..." ভোলা একইভাবে এগিয়ে চলে। পেছন থেকে তখন সেই কুদমো ছেলেটা ভোলার সেই ঝোলাটায় টান মারে –"হেই ভোলা...চললি কোথা...বলনা!" ভোলা রেগে আগুন! ঘুরে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে ওদের দিকে নীরবে শাসায় কিন্তু ওতেও দমেনা ওরা। আর একটি ছেলে এসে ভোলার ত্রিশূলে টান মারে। ভোলা রেগে "হেই, হুট্‌ - হুট্‌" করে ওদের তাড়ায়। এতে ছেলেগুলো মজা পেয়ে থামকে দাঁড়িয়। আর কোমর দুলিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে ভেংচি কাটে। ভোলা এবার মুখ ফিরিয়ে আবার হাঁটা দেয়। তখনি সেই কুদমো ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ভোলার বাঘছাল কাপড়ে সজোরে মারল টান। নরম মলিন কাপড় ‘চরাস্’ করে শব্দ হয়ে ফালা ফালা হয়ে ছিঁড়ে গেল। ভোলা পিছন ফিরে দেখে তার বাঘছাল ফালা ফালা! রাগে ক্রোধে সে গর্জে উঠলো। হাতের ত্রিশূল দুহাতে চেপে তেড়ে গেল ওদের দিকে – "তবে রে! শয়তানগুলো, আজ তোদের মজা দেখাচ্ছি…" কিন্তু তার আগেই ক্ষয়ে যাওয়া, ছেঁড়া জুতো পা থেকে ছিঁড়ে ছিটকে পড়ল রাস্তায়। অমনি ব্যথা পায়ে গরম পিচে আঘাত লাগে। সে ব্যথায় কোঁকিয়ে ওঠে। আর নিজেকে সামলাতে না পেরে টালমাটাল হয়ে ভোলা সজোরে আছড়ে পড়ল সেই গরম পিচের রাস্তায়।

ভোলা চোখ মেলে চেয়ে দেখে সে শুয়ে আছে রাস্তার পাশের চা দোকানের কাঠের বেঞ্চের উপর। মাথার উপর কালো ত্রিপলের ছাউনির নিচে কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো ময়লা ধরা কালো পাখাটা বাঁই বাঁই করে ঘুরছে। তারপর চোখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখে বেঞ্চের পাশে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে উদ্বেগে চেয়ে আছে ওর দিকে। একজন ওর কানের কাছে মুখ এনে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে – "কি রে এখন একটু ভালো লাগছে? জল খাবি?" ভোলা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। সেই লোকটা কাঁচের গ্লাসে, প্লাস্টিকের মগ থেকে জল ঢেলে ভোলার মুখের সামনে ধরে। ভোলা উঠে বসতে গেল কিন্তু পারলো না। তখন সবাই ওকে উঠতে মানা করল তারপর ওকে ধরে আবার শুইয়ে দিল। এবার গ্লাস থেকে জল সরু করে ভোলার মুখে ঢালতে থাকা হল।

সমস্ত শরীরে ভীষণ ব্যথা। কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে, বাঁ ঠোঁটের কোনা থেকে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে। সমস্ত শরীরে কেটে ছিঁড়ে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। চা দোকানদার কাকু তখন ওষুধ দোকান থেকে তুলো দিয়ে রক্ত মুছে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। হাতে একটা কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন – "কি রে একা বাড়ি ফিরতে পারবি তো?" ধরা গলায় ভোলা উত্তর দেয় – "পারবো।" তারপর সে আধো আধো করে কাঁদতে কাঁদতে বলে – "কাকু তুমি খুব ভালো। তুমি খুব ভালো। ওই ইশকুলের ছেলেগুলো ভীষণ …" কথা শেষ করার আগেই সেই কাকু বলে – "ওরা খুব খারাপ, ইশকুলে যায় কেন! দাঁড়া, কাল এলে ধরবো হতচ্ছাড়াগুলোকে।"

ভোলা

বাবা কেমন হয়ে গেছে। ভোলার ওই অবস্থা দেখে ছলছল চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে। খুব কষ্ট হচ্ছে বাবার। মা এসে হাউমাউ করে কাঁদতে থেকে। রাগে দুঃখে ফেটে পড়ে। ভোলাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে – "কে করেছে তোর এমন অবস্থা – বল্ - বল্…" ভোলা কোনা উত্তর না দিয়ে গায়ের ছেঁড়া গেঞ্জিটা ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। এবার মা উঠে গিয়ে ভোলার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে – "কী হল বল? কে করেছে তোর এই অবস্থা?" ভোলা কোনা উত্তর করে না। সে এগিয়ে যায় ডোবার ঘাটের দিকে। মা এবার পেছন থেকে ভোলার ডান ধরে হাতে টান মারে। মুহূর্তে ভোলা ব্যথায় কোঁকিয়ে ওঠে। মা আবারো জিজ্ঞেস করে – "কে করেছে এমন, বল?" উত্তর দে?" ভোলা ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে উত্তর দেয় – "ওই ইশকুলের পাজি ছেলেগুলো…"

গায়ে - পায়ে, সমস্ত শরীরের কাটা ছেঁড়া আংশগুলো শুকনো হয়ে হয়ে চামড়া উঠে গিয়ে কালচে দাগ হয়ে গেছে। দাওয়ায় বসে ভোলা তার ভিক্ষে করা পয়সাগুলো জড় করতে থাকে। তারপর গুনে গুনে সেগুলো একপাশে সরিয়ে রাখছে। মা বাজারের হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে গিয়ে ভোলাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করে – "কী করছিস?" ভোলা মুখ গুঁজে পয়সা গুনতে গুনতে উত্তর দেয় – "পয়সাগুলো রেখে দাও।" মা বিরক্ত হয়ে বলে – "কতবার বলেছি তুই ভিক্ষে করতে যাবি না। চাই না তোর ভিক্ষের পয়সা।" ভোলা গম্ভীর স্বরে বলে – "আমি ভিক্ষে করি না। আমি অভিনয় করি, গান গেয়ে রোজকার করি।" মা ঝেঁঝেঁ বলে – "কে বলেছে তোকে রোজকার করতে? কাল থেকে ইশকুলে যাবি। দুফুরের খাবারটাতো পাবি! আর একবেলা আমি চালিয়ে নেব।" ভোলা বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় – "ইশকুলে আমি যাবো না। ওই পাজিগুলোর মতো অমানুষ হতে চাই না।"

ঘর ফাঁকা। মা বেরিয়ে গেছে হোটেলে বাসন মাজতে। বাবা দাওয়ার সামনে শিরীষতলায় বসে সেই একইভাবে উদাস চোখে গুনগুন করে কী সব গেয়ে চলেছে। আধো অন্ধকার ঘরের মধ্যে ভোলা তখন খুব ধীরে ধীরে তার বাবার টিনের তোরঙ্গর ডালাটা তুলে ধরে। হাল্কা 'ঘ্যারর' শব্দ করে ডালাটা খুলতেই আধো আলো তোরঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভোলা হাত চালিয়ে একে একে রংবেরঙের পোশাকগুলো বের করতে থাকে। হঠাৎ হাতে উঠে এল আধখানা বাঘছাল কাপড়ের টুকরো। ভোলার মন আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। সে কাপড়টা কোমরে পেঁচিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর মুখে সাদা পাউডার মাখতে থাকে। সে ভেতরে ভেতরে কেমন রোমাঞ্চ অনুভব করে। মনে মনে আজ একটা নতুন গান আসছে। তাই সে একা একা গুনগুন করে গানটা আওড়াতে থাকে। একে একে সব সাজ পোশাক পরে তৈরী হতে থাকে। কপালে সাদা তিনটে দাগ। চোখের দুদিকে কালো কালি, ঠোঁটে লালচে রং, হাতে ত্রিশূল, ডুগডুগিটা ঝোলায় ঢুকিয়ে বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে চেয়ে থাকে আয়নার দিকে। কী একটা যেন কম মনে হচ্ছে! ভ্রূ কুঁচকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর তার মাথার কালো চুলের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে! সঙ্গে সঙ্গে খাটের উপর রাখা শনের জটা পরচুলাটা তুলে মাথায় চাপিয়ে সে নিশ্চিন্ত হয়। এবার তার মনে মনে এক অদ্ভুৎ আনন্দ জাগে। সে মুহূর্তে চনমনে হয়ে ওঠে। আবার নতুন অভিনয় শুরু! সব নতুন। বেশ মজা! খুশীতে ডগমগ হয়ে ওঠে।

বাজারের ভাতের হোটেলটা এড়িয়ে দুরের সবুজ মাঠের আলবাঁধ ধরে ভোলা হনহনিয়ে এগিয়ে চলে বাস রাস্তার দিকে। অনেকদিন পরে আবার ভোলা, ভোলানাথ হয়েছে।

কাগজে-কলমে গ্রাফিক ডিজাইনার। কিন্তু সে কাজ ছাড়াও ইনি নানা কাজ করেন - মাঝেমধ্যে ইচ্ছামতীর জন্য ছবি আঁকেন, মাঝেমধ্যে ভাল ভাল গল্প লেখেন, আর প্রয়োজন হলেই চাঁদের বুড়িকে নানারকমের সাদাকালো-একঘেয়ে-বিরক্তিকর কাজকর্ম (যেগুলি একটা ব-অ-ড় ওয়েবসাইট চালাতে গেলে করতেই হয়)-সেইসব করতে সাহায্য করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা