সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
নিখিলেশবাবু ও খিকখিক ভূত

নিখিলেশবাবুর বাড়িটা ভীষণ পুরনো। তার ঠাকুরদাদার বাবার আমলের বাড়ি। এ বাড়িটা এখনো কেমন করে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে আছে, সেটাই এক রহস্য। শুধু যে বেঁচে আছে তাই নয়, নিখিলেশবাবু দিব্যি এ বাড়িতে একাকী বসবাস করছেন। তার মেয়ে, মেয়েজামাই, নাতি- সব শহরে থাকে। মেয়ে কতবার বলেছে, বাবা, এবার তোমার ঐ আদ্যিকালের বাড়িটা ছাড়ো তো। তুমি বরং আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে এসে ওঠো। তুমি একলা মানুষ, ঐ অতবড় পুরনো বাড়িতে ঝোপঝাড়ের মধ্যে একা থাকা তোমার ঠিক নয়।

নিখিলেশবাবু শুনলে তো সেকথা! তিনি এই বাড়িতেই রয়ে গেছেন। তার বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে লোকে ভাববে এ নির্ঘাত ভূতের বাড়ি। দেয়ালের রংচং ফিকে হয়ে গেছে, প্লাস্টার খসে পড়েছে, জানালা-দরজাগুলো ভেঙেচুরে আছে। বিশাল বাড়িটার একটা অংশ নিখিলেশবাবু থাকার উপযোগী করে নিয়েছেন। নতুন করে ভেতরটা রং করে জানালা-দরজাগুলো নতুন করে করিয়ে নিয়েছেন।

বাড়িটা যেমনি বড়, তেমনি এর আঙিনা। চারপাশে বিশাল জায়গাজুড়ে অনেকগুলো গাছপালা। অনেকদিন হয়ে গেছে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করানো হয় নি। আবার জংলা গাছপালা গজিয়ে ঝোপ হয়ে গেছে। এই ঝোপঝাড়, গাছপালার মধ্যে একটি তেঁতুল গাছও রয়েছে। কেউ লাগায় নি গাছখানা। কেমন করে যেন প্রাচীরের পাশে নিজেই গজিয়েছে। হবে হয়তো কেউ তেঁতুল খেয়ে বিচি ফেলেছিল। সে বহুদিন আগের কথা। নিখিলেশবাবুর ঠাকুরদাদার কালের ঘটনা। এরপরে কেন যেন গাছটাকে আর কেউ কাটে নি। গাছটা এখন ডালপালা ছড়িয়ে প্রাচীরের একটা অংশ ভেঙে ফেলে নিজের মতো উঠে পড়েছে। শতবর্ষী গাছটা দেখলেই কেউ শিউরে উঠবে। তেঁতুল গাছের এমনিই ভূতের আস্তানা হিসেবে নাম আছে, উপরন্তু এত বয়সী ঝাঁকড়ানো একটা গাছ। নিখিলেশবাবুর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গেলে দিনের বেলায়ও লোকে দুরু দুরু বুকে রাম নাম জপ করতে করতে যায়। এই গাছ নিয়ে নিখিলেশবাবু কেমন করে যে একা একা এই বাড়িতে বসবাস করছেন, কে জানে!

নিখিলেশবাবুর বাড়ির তেঁতুল গাছটায় কিন্তু সত্যিই ভূতেদের আস্তানা আছে। সেখানে কয়েকটা ভূত পরিবার বহুকাল ধরে বসবাস করছে। এদের মধ্যে আবার দুটো ভাগ আছে। এক দল ভূত মানুষকে ভয় দেখিয়ে বেড়ায়, অন্য দলটি মোটেই মানুষের ক্ষতি করে না। যে দলটি মানুষকে ভয় দেখায়, তাদের বাচ্চাদের ছোট থেকেই ভয় দেখানো শেখানো হয়। আর যে দলটি মানুষকে ভয় দেখায় না, তাদের বাচ্চাদের সেখানো হয় মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে থাকার কলাকৌশল।

তো এই দ্বিতীয় দলের ভূতেদের মধ্যে একটি পরিবারের সন্তান খিকখিক। সে আট বছরের বাচ্চা ভূত। বাবা-মা তাকে সবসময় বলে মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে। কিন্তু খিকখিক ভূত মোটেই তা পছন্দ করে না। তার বড় ইচ্ছে সে মানুষকে ভয় দেখাবে। যখন অন্য দলের ভূতের বাচ্চারা মানুষকে ভয় দেখায়, আর মানুষেরা উল্টেপাল্টে পড়ে, তার কি যে মজা লাগে! কিন্তু মা তাকে সবসময় বারণ করে মানুষকে ভয় দেখাতে। সেজন্যই সে ভয় দেখাতে পারে না।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় খিকখিকের বাবা-মা একটা কাজে বাইরে গেল। খিকখিককে বলে গেল, তাদের ফিরতে শেষ রাত, এমনকি ভোরও হয়ে যেতে পারে। সে যেন চুপটি করে বাসায় বসে খেলাধূলা করে, মোটেই দুষ্টুমি না করে। খিকখিক বলল সে বাবা-মায়ের কথা মেনে লক্ষ্মী হয়ে থাকবে।

বাবা-মা চলে যাওয়ার পর খিকখিক তেঁতুল গাছের ডাল ধরে ঝুলতে লাগল। এটাই তার প্রিয় খেলা। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেল রাস্তা দিয়ে একটা মানুষ যাচ্ছে। সে দ্রুত গাছের মগডালে উঠে গেল। আর ওদিকে মানুষটাকে দেখে অন্য দলের ভূতের ছানারা তাকে ভয় দেখাতে লেগে পড়ল। একজন হিঁ হিঁ করে নাকি সুরে হাসতে শুরু করল। আরেকজন জিভ বের করে উল্টো হয়ে গাছের ডালে ঝুলতে লাগল। মানুষটা যে কি ভয় পেল তা বলে বোঝানো যাবে না! সে রাম রাম করতে করতে ভোঁ দৌড় দিল। ভূতের বাচ্চারা মজা পেয়ে হি হি করে হাসতে শুরু করলো।

খিকখিকেরও বেশ মজা লাগল। সে ভাবল, বাবা-মা যেহেতু বাইরে গেছে, তাই সে এই সুযোগে একটা মানুষকে ভয় দেখাবে। সে অপেক্ষায় রইল কোনো মানুষ আসার। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটুপরেই সে দেখল, এ বাড়ির মালিক বৃদ্ধ মানুষটা এদিকে আসছে। সে গাছের ডালের আড়ালে লুকিয়ে রইল মানুষটাকে ভয় দেখাবে বলে।
নিখিলেশবাবু তেঁতুলগাছের কাছাকাছি আসতেই বিদঘুটে হাসির শব্দ শুনলেন। অন্য কেউ হলে সন্ধ্যারাতে নির্জন বাড়িতে তেঁতুলগাছ থেকে এমন হাসির শব্দ শুনলে হার্টফেল করত নির্ঘাত। কিন্তু মানুষটা যে নিখিলেশবাবু! তিনি জন্ম থেকে এ বাড়িতেই আছেন, এই ভূত-প্রেত সাথে নিয়েই এতদিন বসবাস করে এসেছেন। ভয় না পেয়ে তিনি আরো খানিকটা এগিয়ে গেলেন। খিকখিক তখনো হিঁ হিঁ করে হেসেই চলেছে। নিখিলেশবাবু এবার ভারি বিরক্ত হলেন। ধমক দিয়ে বললেন, "কে রে এমন হি হি করছিস? সাহস থাকে তো সামনে আয় দিকি। জন্ম থেকে ভূতের সাথে বাস করছি, এখন এলেন উনি আমায় ভয় দেখাতে!"

নিখিলেশবাবু ও খিকখিক ভূত

নিখিলেশবাবুর কথা শুনে খিকখিক অবাক হলো। খানিকটা ভয়ও পেল। নিখিলেশবাবু আবার হাঁক দিলেন, "কই রে! সামনে আয়, দেখি তোর চেহারাটা।"

খিকখিক এবার মাথা চুলকাতে চুলকাতে ডালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তারপর মিনমিন করে বলল, "আপনি ভয় পেলেন না কেন? আমি তো আপনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।"

নিখিলেশবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। তার হাসিতে এবার খিকখিকই উল্টো ভয় পেয়ে গেল। তিনি বললেন, "আমি বহু বছর ধরে ভূত-প্রেত সাথে নিয়েই এই নির্জন বাড়িতে বসবাস করছি। ভূতের ভয়ডর আমার থাকবে? তোমার মতো একটা বাচ্চা ভূতের হাসিতে আমি ভয় পাবো? তুমি আমায় চেনো না বাচ্চা। এবার বলো তো, তোমার নাম কী?"

খিকখিকের মা-বাবা শিখিয়েছে মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকতে হয়। কিন্তু এই মানুষটার কথা শুনে খিকখিকের তাকে ভালোই মনে হলো। সে উত্তর দিল, "আমার নাম খিকখিক।"
"হুম, বুঝলাম। শোনো খিকখিক, আজ আমি তোমার হাসিতে ভয় পাই নি ঠিকই, কিন্তু অন্য কেউ হলে ভয় পেয়ে যেত। এটা কিন্তু তুমি ঠিক করো নি। আমি যদি এখন তোমাকে ভয় দেখাই, তাহলে কেমন হবে বলো তো?" বললেন নিখিলেশবাবু।
"মানুষ কি ভূতকে ভয় দেখাতে পারে?" বলল খিকখিক।
নিখিলেশবাবু আবার গগন কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। এরপর ভ্রু নাচিয়ে বললেন, "দেখাব নাকি ভয়? দেখবে?"
খিকখিক ভয় পেয়ে বলল, "না না! কোনো দরকার নেই। আমাকে ভয় দেখালে আমি অনেক ভয় পাবো।"
নিখিলেশবাবু তখন বললেন, "ঠিক তাই। একইভাবে তুমি অন্য কাউকে ভয় দেখালে সেও খুব ভয় পাবে। বেশি ভয় পেয়ে তার শরীর খারাপও হতে পারে। তাই কখনো কাউকে ভয় দেখানো ঠিক নয়। এতে হয়তো তুমি মজা পাচ্ছ, কিন্তু সেই মানুষটা অনেক ভয় পাচ্ছে।"
খিকখিক মাথা নিচু করে বলল, "আমি দুঃখিত। আমি এভাবে ভাবি নি। মা আমাকে সবসময় বলে, কাউকে ভয় না দেখাতে। আমি ভাবলাম ভয় দেখানো অনেক মজার। তাই ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।"
নিখিলেশবাবু কোমল গলায় বললেন, "মায়ের কথা সবসময় শুনতে হয়। কখনো মায়ের কথার অবাধ্য হতে নেই। দ্যাখো, তুমি যে মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে আমাকে ভয় দেখাতে এলে, আমি যদি এখন তোমাকে বোতলে পুরে রাখতাম? তুমি একটা বাচ্চা ভূত বলেই আমি সেটা করি নি। মায়ের কথার অবাধ্য হলে এমন বিপদই হয়।"
খিকখিক বুঝতে পারলো তার ভুলটা। সে লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে বলল, "আমি আর কখনোই এমনটি করবো না।"

গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ। কিন্তু এরপর কী হলো বলো তো? এরপর খিকখিক আর নিখিলেশবাবু খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই খিকখিক নিখিলেশবাবুর বাড়িতে চলে যেত। তার কাছে অনেক মজার মজার গল্প শুনত। মাঝেমধ্যে খিকখিকের মা-বাবাও যেত তার সাথে। আর দুষ্টু ভূতের বাচ্চারা, যারা মানুষকে ভয় দেখাতো, তারাও বুঝতে পারলো মানুষ আসলে অনেক ভালো। তাদের ভয় দেখানো ঠিক নয়। তারাও নিখিলেশবাবুর বন্ধু হয়ে গেল। তারাও খিকখিকের সঙ্গে তার কাছে গল্প শুনতে যেত। এরপর থেকে আর কেউ কখনো নিখিলেশবাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে মাঝরাতে যেতেও ভয় পায় নি। সবার সঙ্গেই ভূতদের পরিচয় হয়েছে। সবাই বরং রাতের বেলায় তেঁতুলগাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার হাঁক ছেড়ে যায়, "খিকখিক, তুমি কেমন আছ? তোমার বন্ধুরা কেমন আছে?"

অনেকগুলো রিনরিনে কচি গলায় উত্তর শোনা যায়, "আমরা সবাই ভালো আছি।"

ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী

কিশোরী লেখক মীম নোশিন নাওয়াল খান বাংলাদেশের ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছে লেখালেখি, সাংবাদিকতা, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি ও হাতের কাজ। ইউনিসেফ থেকে চারবার মীনা অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পুরস্কারজয়ী মীমের অনেকগুলো গল্প, ছড়া ও কিশোর উপন্যাস বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।  

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা